ইবাদতের বসন্তকাল নামে পরিচিত মাহে রামাযানের শেষ দশক খুবই মূল্যবান। এ সময় মুমিনের জন্য বেশি-বেশি ইবাদতে মশগূল থেকে পাপ মোচন ও পুঁজি সংগ্রহের জন্য বিশেষ সুযোগ রয়েছে। কারণ এ দশদিনে একজন মুমিন ই‘তিকাফ ও লাইলাতুল ক্বদর পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করে। যারা এ দশকের বিশেষ রাত্রি লাইলাতুল ক্বদরে ‘ইবাদত করা থেকে বঞ্চিত হল, তারা যেন সব ধরনের কল্যাণ এবং মঙ্গল থেকে বঞ্চিত হল।[১]
রামাযানের শেষ দশকে বিশেষ আমলগুলোর অন্যতম হল, ই‘তিকাফ, বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ, ক্বিয়ামুল লাইল, কুরআন তেলাওয়াত, দান, ছাদাক্বাহ, বেশি-বেশি দু‘আ ও তওবাহ-ইস্তেগফার করা ইত্যাদি। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা ‘রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও ফযীলত
শেষ দশকের এ রাতগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দশকের জোড়[২] কিংবা বিজোড় যে কোন রাতে লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমভাবে এ দশদিনে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন।[৩] লাইলাতুল ক্বদর অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হল, এ রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় আমরা কুরআন অবতীর্ণ করেছি এক মহিমান্বিত রজনীতে। আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রজনী কী? মহিমান্বিত রজনী হল- হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরীল) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। (এ রাতে বিরাজ করে) শান্তি আর শান্তি, রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’ (সূরা আল-ক্বদর : ১-৫)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আমরা তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ফয়সালা হয়’ (সূরা আদ-দুখান : ৩-৫)। এ রাতের নেক আমল সমূহের ছওয়াব তুলনাহীন। তাছাড়া এ রাতে সর্বাধিক মর্যাদাম-িত কিতাব সর্বাধিক মর্যাদাম-িত রাসূলের নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। সেকারণেও এ রাতকে লায়লাতুল ক্বদর বা মহিমান্বিত রজনী হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকতে পারে। এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ এলাহী গ্রন্থ আল-কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে ক্বদরের রাত্রিতে। এ রাত্রিটা কোন্ মাসে? সে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘রামাযান মাস। যে মাসে নাযিল হয়েছে কুরআন, মানবজাতির জন্য হেদায়াত ও হেদায়াতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।
রামাযান মাসে লাইলাতুল ক্বদরের রাতে আল-কুরআন নাযিলের ফলে এ রাতের মর্যাদা শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন, ‘আপনি কি জানেন ক্বদরের রাত্রি কী’? অতঃপর তিনি বলেন- ‘ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম’। অর্থাৎ লায়লাতুল ক্বদর যাবতীয় সময়কালের চেয়ে উত্তম, যাতে লায়লাতুল ক্বদর নেই। আরবরা الف বা ‘হাযার’ শব্দ ব্যবহার করে থাকে ‘কোন বস্তুর চূড়ান্তসীমা’ বুঝানোর জন্য। যেমন সূরা আল-বাক্বারাতে (৯৬ নং আয়াতে) আল্লাহ বলেছেন, الف سنة-এখানে ‘হাযার বছর’ অর্থ চিরকাল, অনন্তকাল।[৪]
অর্থাৎ কেবল এক হাযার মাসের নয়, বরং এ রাতের ‘ইবাদত ও নেক আমল হাযার হাযার মাসের ইবাদতের তুলনায় উত্তম। তিনটি আয়াতে পরস্পর তিনবার ‘লায়লাতুল ক্বদর’ উল্লেখ করার পর বলা হচ্ছে এটি হাযার মাসের চেয়ে উত্তম। বারবার বলার মাধ্যমে এ রাতের মর্যাদা আরও উন্নীত হয়েছে।[৫]
অনেকে হাযার মাসের ব্যাখ্যা ৮৩ বছর ৪ মাস করেছেন। অতএব এক হাজার মাস সমান ৩০ হাজার রাত্রি । অর্থাৎ এই রাতের মর্যাদা ৩০,০০০ গুণ অপেক্ষাও বেশী! সুতরাং বলা যায় যে, এই রাতের ১টি তাসবীহ অন্যান্য রাতের ৩০, ০০০ তাসবীহ অপেক্ষা উত্তম। এই রাতের ১ রাক‘আত সালাত অন্যান্য রাতের ৩০,০০০ রাক‘আত অপেক্ষা উত্তম। বলা বাহুল্য, এই রাতের আমল শবেক্বদর বিহীন অন্যান্য ৩০ হাজার রাতের আমল অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ। সুতরাং যে ব্যক্তি এই রাতে ইবাদত করল, আসলে সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাস অপেক্ষাও বেশী সময় ধরে ইবাদত করল । যদিও এ হিসাব একটি কল্পনা মাত্র।
এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্ববর্তী (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়’।[৬] রামাযানের আগমনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রামাযান মাস এসেছে। তার সিয়াম আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেছেন। তাতে আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। অবাধ্য শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়। আল্লাহর বিশেষ রহমতের জন্য তাতে এমন একটি রাত আছে, যা হাযার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষাও উত্তম। যে তা হতে বঞ্চিত হয়েছে সে সর্বপ্রকার মঙ্গল হতে বঞ্চিত হয়েছে’।[৭]
এ রাতে রহমত ও বরকতের ডালি নিয়ে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর নেতৃত্বে অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করে আল্লাহর বিশেষ অনুমতি ক্রমে। ক্বাতাদাহ ও অন্যান্য বিদ্বান (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘যাতে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত থাকে এবং মৃত্যু ও রূযির হিসাব নির্ধারিত থাকে’।[৮]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আল্লাহর ঐ সকল নির্দেশসহকারে (ফেরেশতা আগমন করে) যা তিনি আগামী এক বছরের জন্য নির্ধারিত করেছেন ও ফায়ছালা করেছেন’।[৯]
ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ রাতে ফেরেশতাগণ অধিক সংখ্যায় অবতরণ করে অধিক বরকতের কারণে। অধিকহারে বরকত ও রহমতের অবতরণের সাথে সাথে ফেরেশতাগণও অধিকহারে অবতরণ করে থাকে। যেমন তারা কুরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহকে স্মরণ করার মজলিসসমূহ ঘিরে রাখে। সেখানে প্রশান্তির বিশেষ রহমত নাযিল করে। তারা ইলম অন্বেষণকারীর প্রতি সম্মানের জন্য তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেয়’।[১০]
ক্বাতাদাহ ও ইবনু যায়েদ (রাহিমাহুমাল্লাহ) বলেন, ‘এ রাতে কেবলই মঙ্গল। ফজর পর্যন্ত কোন অমঙ্গল নেই’। যাহ্হাক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ রাতে আল্লাহ শান্তি ব্যতীত অন্য কিছুই নির্ধারণ করেন না’। মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটি নিরাপদ রাত্রি। এ রাতে শয়তান কোন মন্দ বা কষ্টদায়ক কাজ করতে সক্ষম হয় না’। শা‘বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ রাতে মাগরিব হতে ফজর পর্যন্ত ফেরেশতাগণ মসজিদের মুছল্লীদের উপরে এবং প্রত্যেক মুমিনের উপরে সালাম করে বলে, ‘হে মুমিন! আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হোক!।[১১]
লাইলাতুল ক্বদর কোন্ রাত্রিতে?
লাইলাতুল ক্বদর রামাযান মাসে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে রামাযান মাসের কোন্ রাত্রিতে লাইলাতুল ক্বদর তা নির্ধারণ সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আলিমগণ লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক মতবিরোধ করেছেন। এ ব্যাপারে প্রায় চল্লিশটিরও বেশি বক্তব্য পাওয়া যায়’।[১২] তবে অধিকাংশের বক্তব্য হচ্ছে, রামাযান মাসের শেষ দশ দিনের কোন এক রাত্রিতে লাইলাতুল ক্বদর হয়।[১৩] অনুরূপ অধিকাংশের বক্তব্য এটাও যে, শেষ দশদিনের বেজোড় রাত্রিসমূহে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ অথবা ২৯তম) লাইলাতুল কদর।[১৪]
এ মতটি অধিক শক্তিশালী। আর লাইলাতুল ক্বদর একেক বছর একেক রাত্রিতে হয়। সাতাশতম রাত্রির সাথে নির্দিষ্ট নয়। উবাই বিন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যে দৃঢ়তার সাথে সাতাশতম রাত্রির কথা বলেছিলেন তা সে বছর ঘটেছিল।[১৫]
প্রতিবছর ঐ রাত্রি লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারণ হয়ে যাবে এমনটি নয়। লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারিত নয় বরং আবর্তিত হয়ে থাকে।[১৬]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে ক্বদরের রাত্রি তালাশ করবে’।[১৭]
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণের কয়েকজনকে স্বপ্নে দেখানো হল এই মর্মে যে, ক্বদরের রাত্রি শেষের সাত রাত্রির মধ্যে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
‘আমিও তোমাদের সকলের স্বপ্নের একইরূপ দেখছি যে, শেষ সাত রাত্রিতে সীমাবদ্ধ। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অšে¦ষণ করে, সে যেন শেষ সাত রাত্রিতে অšে¦ষণ করে’।[১৮]
লাইলাতুল ক্বদর গোপন রাখার হিকমত
এর হিকমত হল, লাইলাতুল ক্বদর তালাশে বান্দা যাতে করে প্রতি রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে মনোনিবেশ করতে পারে। ওবাদা ইবনু ছামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ক্বদর রাত্রির সংবাদ দেয়ার জন্য বের হলেন। এ সময় মুসলিমদের দু’ব্যক্তি ঝগড়া আরম্ভ করল। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে ক্বদর রাত্রি সম্পর্কে খবর দেয়ার জন্য বের হয়েছিলাম কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়ায় লিপ্ত হল, ফলে তা উঠিয়ে নেয়া হল। সম্ভবত এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলই হয়েছে। সুতরাং তোমরা তা ২৯, ২৭ ও ২৫ শে রাতে তালাশ করবে।[১৯]
লাইলাতুল ক্বদরের নিদর্শনাবলী
এ রাতের কয়েকটি নিদর্শন হল, আবহাওয়া স্বাভাবিক হবে, রাতটি স্থির হবে এবং সূর্যের আলো স্বাভাবিক হবে। গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না। হালকা বাতাস প্রবাহিত হবে। ইবাদতের কারণে এক ধরনের প্রফুল্লতা এবং স্বাদ অনুধাবন করবে, যা অন্যান্য সময় সাধারণত বুঝা যায় না। সকালে হালকা আলোরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। সে রাতের সকালে সূর্য সাদা হয়ে উদয় হবে; তার কোন কিরণ থাকবে না। অথবা ক্ষীণ রক্তিম অবস্থায় উদিত হবে; ঠিক পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মত। অর্থাৎ তার রশ্মি চারিদিকে বিকীর্ণ হবে না।[২০]
ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।[২১]
এছাড়া লোক মুখে যে সব আলামতের কথা প্রচলিত। যেমন- ১. সে রাতে কুকুর ভেকায় না বা কম ভেকায়। ২. দালান কোঠা ঘুমিয়ে পড়ে। ৩. গাছ-পালা মাটিতে নুয়ে পড়ে আল্লাহকে সিজদা করে। ৪. সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মিঠা হয়ে যায়। ৫. নূরের ঝলকে অন্ধকার জায়গা আলোকিত হয়ে যায়। ৬. নেক লোকেরা ফেরেশতার সালাম শুনতে পান ইত্যাদি আলামতসমূহ কাল্পনিক। এগুলো শারঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এ সব কথা নিশ্চিতরূপে অভিজ্ঞতা ও বাস্তব বিরোধী।
রামাযানের শেষ দশকে করণীয়
আমলের অপূর্ণতা এবং ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার মোক্ষম সময় রামাযানের শেষের দশক। তাই সকল গাফিলতি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এখনই আল্লাহমুখী হওয়া খুব যরূরী। রামাযানের অবশিষ্ট দিনগুলোতে যে কয়েকটা আমল আমাদের বিশেষভাবে করতে হবে, তা নি¤েœ আলোচনা করা হল-
১). ই‘তিকাফ করা
রামাযান মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করা মুস্তাহাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর যতক্ষণ তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রামাযানে দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেছেন সে বছর বিশদিন ই‘তিকাফ করেছেন’।[২২]
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ইন্তেকাল করলেন, তারপর তাঁর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফ করতেন’।[২৩]
মূলত ই‘তিকাফে অধিক অধিক কল্যাণমূলক কাজ করা যায় এবং নেক আমল করার জন্য অত্যধিক প্রচেষ্টা করার সুযোগ থাকে। যা অন্যাবস্থায় থাকে না। যার কারণে লাইলাতুল ক্বদরের রাত পাওয়া সহজ হয়।
২). রাত জেগে ইবাদতে মগ্ন থাকা
মুসলিমদের জন্য কর্তব্য হল, এ রাতগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত করা ও পরিবার-পরিজনকে ইবাদতে উৎসাহিত করা। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে ফেলতেন। তিনি রাত্রি জেগে নিজে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারকেও জাগাতেন’।[২৪]
৩). বেশি বেশি পরিশ্রম করা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য রাতগুলোর চেয়ে শেষ দশকের রাতগুলোতে ‘ইবাদতের জন্য বেশি পরিশ্রম করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ইবাদত করার জন্য এত পরিশ্রম করতেন, যা অন্য সময়ে করতেন না’।[২৫]
৪). বেশি বেশি আমলে ছালিহ তথা সৎ আমল করা
রামাযান মাসে সৎ আমলের প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়। তাই এ মাসে বিশেষ করে বিদায়ী শেষ দশকে বেশি বেশি আমলে ছালিহ আত্মনিয়োগ করা উচিত। কেননা এ সময় বান্দার আমল দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তাছাড়া রামাযানে প্রত্যেক আমল তার দশ গুণ মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘আদম সন্তানের নেক আমল বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ হতে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তবে সিয়াম ব্যতীত। কারণ সিয়াম আমারই জন্য পালন করা হয় এবং তার প্রতিদান আমিই দিব’।[২৬] সহীহ বুখারীর অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ’।[২৭]
৫). মিথ্যা আমল ও কাজ পরিহার করা
একজন মুমিন সর্বদাই মিথ্যা কথা ও কাজ পরিহার করে সততার পথ অবলম্বন করবে। রামাযান মাসে এই সততার গুণ অর্জন করার বিশেষ শিক্ষা দেয়া হয়। তাই শেষ দশকে সৎ আমল করার পাশাপাশি সকল প্রকার মিথ্যা ও অপকর্ম থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اجۡتَنِبُوۡا قَوۡلَ الزُّوۡرِ ‘তোমরা দূরে থাক মিথ্যা বলা হতে’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩৯)।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।[২৮]
৬). জান্নাত তালাশ করা ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রান চাওয়া
প্রকৃত সফল ব্যক্তি সেই, যে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল। রামাযান মাসে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত লাভের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। তাই এ দশকে আল্লাহর কাছে বারবার জাহান্নাম থেকে বাঁচা ও জান্নাত লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করতে হবে। কারণ এ মাসে অসংখ্য জাহান্নামীকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা হয়।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন রামাযান মাসের প্রথম রাত্রি আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনদেরকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে কল্যাণের অšে¦ষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অšে¦ষণকারী! থাম। আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন, আর এটা প্রত্যেক রাতেই হয়ে থাকে।[২৯]
সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজার নাম রাইয়ান। সিয়ামপালনকারী ব্যতীত ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না’।[৩০]
৭). রহমত তালাশ করা
রামাযান মাসে আসমান ও রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। সুতরাং শেষ দশকে বেশি বেশি রহমত কামনা করা উচিত। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘যখন রামাযান মাস আসে, তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’।[৩১]
তিনি আরো বলেন,
‘রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’।[৩২]
৮). বেশি বেশি ছাদাক্বাহ করা
এ দশকে সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণে দান-ছাদাক্বাহ করা উচিত। এ দশকে কেউ একটি টাকা দান করলে এবং সেটা লাইলাতুল ক্বদরের মধ্যে পড়ে গেলে তা অন্য মাসে ৩০০০০ টাকা দান করার চেয়েও বেশি ছওয়াবের অধিকারী হবে (সুবহা-নাল্লাহ)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। আর রামাযানে অধিক দান করতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, দানের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। আর তাঁর হৃদয়ের এ প্রশস্ততা রামাযান মাসে সবচেয়ে বেশী বেড়ে যেত। রামাযানে প্রত্যেক রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তিনি তাঁকে কুরআন শুনাতেন যখন তাঁর সাথে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) সাক্ষাৎ করতেন, তাঁর দান প্রবাহিত বাতাসের বেগের চেয়েও বেড়ে যেত।[৩৩]
৯). কুরআন তেলাওয়াত করা
রামাযানের সাথে কুরআনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। কারণ রামাযান মাসেই কুরআন অবতরণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানে প্রত্যেক রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তিনি তাঁকে কুরআন শুনাতেন।[৩৪] সুতরাং এ মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা দরকার। কারণ কুরআনের একটি অক্ষর পড়লে দশটি করে ছাওয়াব পাওয়া যায়।[৩৫] তাই শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদরের একটি অক্ষরের বিনিময় ৩০০০০ এরও বেশি সওয়াব আমরা পেতে পারি। তাছাড়া কুরআন ক্বিয়ামতের দিন তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, সিয়াম এবং কুরআন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে দিনে তার খাদ্য ও প্রবৃত্তি হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।[৩৬]
১০). বেশি বেশি দু‘আ করা
রামাযান মাসে দু‘আ কবুলের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই শেষ দশকে বেশি বেশি দু‘আ করা উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘তিন ব্যক্তির দু‘আ ফেরত দেয়া হয় না। ১. পিতা-মাতার দু‘আ। ২. সিয়াম পালনকারীর দু‘আ এবং ৩. মুসাফিরের দু‘আ’।[৩৭] রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,
‘আল্লাহ রামাযানে প্রত্যেক দিন ও রাতে বান্দাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং দু‘আ কবুল করেন’।[৩৮]
যে দু‘আটি বেশি বেশি পড়তে হয় তাহল- আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! যদি আমি বুঝতে পারি রাতের মধ্যে ক্বদরের রাত কোন্টি? তখন আমি কী বলব? তিনি বললেন, তুমি বলবে,
‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমাকে ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন’।[৩৯]
১১). তওবা ও ইস্তেগফার করা
তওবা ও ইস্তেগফারের মাস হল রমাযান মাস। সুতরাং এ মাসের সুবর্ণ সুযোগ যে হাতছাড়া করল তার মত হতভাগা আর কেউ হতে পারে না। তাই পুরো রামাযান বিশেষ করে শেষ দশকে বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করা উচিত। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যার নিকট আমার নাম নেয়া হয় অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে না। ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যার নিকট রামাযান মাস উপস্থিত হল, অথচ তার গুনাহ মাফ করার পূর্বে তা অতিবাহিত হয়ে গেল। ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যে তার পিতা-মাতা অথবা তাদের দু’জনের একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল, অথচ তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না।[৪০]
পরিশেষে বলা যায়, রামাযানের পুরো মাস জুড়েই ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। তাই পুরো মাস ইবাদতের পাশাপাশি বিদায়ের শেষ দশকে আরো সচেতন হয়ে ইবাদত করলে তা আমাদের জন্য আরো কল্যাণ বয়ে আনবে। আল্লাহ আমাদের রামাযান মাসের বরকত, রহমত ও মাগফিরাতের সুযোগ লাভে ধন্য করুন-আমীন!!
[১]. নাসাঈ, হা/২১০৬।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/২০২২।
[৩]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৯।
[৪]. তাফসীরে কুরতুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪; সূরা আল-বাক্বারার ৯৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[৫]. তাফসীরে কুরতুবী, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৩১।
[৬]. সহীহ বুখারী, হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৯, ৭৬০।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৯৩; নাসাঈ, হা/২১০৬, সনদ সহীহ।
[৮]. ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৪।
[৯]. তাফসীরে কুরতুবী, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৩১।
[১০]. ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৪।
[১১]. কুরতুবী, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৩১; ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৪।
[১২]. ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩০৯।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[১৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৭।
[১৫]. সহীহ মুসলিম, হা/৭৬২; তিরমিযী, হা/৩৩৫১।
[১৬]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[১৭]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৭।
[১৮]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৫; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৫।
[১৯]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৩, ৬০৪৯।
[২০]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[২১]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭; সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৯-১৫০।
[২২]. সহীহ বুখারী, হা/২০৪৪।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৬; সহীহ মুসলিম, হা/১১৭২।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[২৫]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫।
[২৬]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[২৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭।
[২৯]. তিরমিযী, হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২, সনদ সহীহ।
[৩০]. সহীহ বুখারী, হা/৩২৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫২।
[৩১]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯, ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।
[৩২]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯, ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।
[৩৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২, ৪৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮।
[৩৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২, ৪৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮।
[৩৫]. তিরমিযী, হা/২৯১০; মিশকাত, হা/২১৩৭, সনদ সহীহ।
[৩৬]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৯৯৪।
[৩৭]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৬৬১৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭৯৭।
[৩৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪৪৩, সনদ সহীহ।
[৩৯]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮৫০, সনদ সহীহ।
[৪০]. তিরমিযী, হা/৩৫৪৫।
রামাযানের শেষ দশকে বিশেষ আমলগুলোর অন্যতম হল, ই‘তিকাফ, বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ, ক্বিয়ামুল লাইল, কুরআন তেলাওয়াত, দান, ছাদাক্বাহ, বেশি-বেশি দু‘আ ও তওবাহ-ইস্তেগফার করা ইত্যাদি। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা ‘রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও ফযীলত
শেষ দশকের এ রাতগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দশকের জোড়[২] কিংবা বিজোড় যে কোন রাতে লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমভাবে এ দশদিনে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন।[৩] লাইলাতুল ক্বদর অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হল, এ রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ - وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ - لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَہۡرٍ - تَنَزَّلُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ الرُّوۡحُ فِیۡہَا بِاِذۡنِ رَبِّہِمۡ ۚ مِنۡ کُلِّ اَمۡرٍ - سَلٰمٌ ۟ۛ ہِیَ حَتّٰی مَطۡلَعِ الۡفَجۡرِ
‘নিশ্চয় আমরা কুরআন অবতীর্ণ করেছি এক মহিমান্বিত রজনীতে। আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রজনী কী? মহিমান্বিত রজনী হল- হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরীল) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। (এ রাতে বিরাজ করে) শান্তি আর শান্তি, রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’ (সূরা আল-ক্বদর : ১-৫)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ اِنَّا کُنَّا مُنۡذِرِیۡنَ - فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ
‘আমরা তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ফয়সালা হয়’ (সূরা আদ-দুখান : ৩-৫)। এ রাতের নেক আমল সমূহের ছওয়াব তুলনাহীন। তাছাড়া এ রাতে সর্বাধিক মর্যাদাম-িত কিতাব সর্বাধিক মর্যাদাম-িত রাসূলের নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। সেকারণেও এ রাতকে লায়লাতুল ক্বদর বা মহিমান্বিত রজনী হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকতে পারে। এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ এলাহী গ্রন্থ আল-কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে ক্বদরের রাত্রিতে। এ রাত্রিটা কোন্ মাসে? সে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ
‘রামাযান মাস। যে মাসে নাযিল হয়েছে কুরআন, মানবজাতির জন্য হেদায়াত ও হেদায়াতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।
রামাযান মাসে লাইলাতুল ক্বদরের রাতে আল-কুরআন নাযিলের ফলে এ রাতের মর্যাদা শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন, ‘আপনি কি জানেন ক্বদরের রাত্রি কী’? অতঃপর তিনি বলেন- ‘ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম’। অর্থাৎ লায়লাতুল ক্বদর যাবতীয় সময়কালের চেয়ে উত্তম, যাতে লায়লাতুল ক্বদর নেই। আরবরা الف বা ‘হাযার’ শব্দ ব্যবহার করে থাকে ‘কোন বস্তুর চূড়ান্তসীমা’ বুঝানোর জন্য। যেমন সূরা আল-বাক্বারাতে (৯৬ নং আয়াতে) আল্লাহ বলেছেন, الف سنة-এখানে ‘হাযার বছর’ অর্থ চিরকাল, অনন্তকাল।[৪]
অর্থাৎ কেবল এক হাযার মাসের নয়, বরং এ রাতের ‘ইবাদত ও নেক আমল হাযার হাযার মাসের ইবাদতের তুলনায় উত্তম। তিনটি আয়াতে পরস্পর তিনবার ‘লায়লাতুল ক্বদর’ উল্লেখ করার পর বলা হচ্ছে এটি হাযার মাসের চেয়ে উত্তম। বারবার বলার মাধ্যমে এ রাতের মর্যাদা আরও উন্নীত হয়েছে।[৫]
অনেকে হাযার মাসের ব্যাখ্যা ৮৩ বছর ৪ মাস করেছেন। অতএব এক হাজার মাস সমান ৩০ হাজার রাত্রি । অর্থাৎ এই রাতের মর্যাদা ৩০,০০০ গুণ অপেক্ষাও বেশী! সুতরাং বলা যায় যে, এই রাতের ১টি তাসবীহ অন্যান্য রাতের ৩০, ০০০ তাসবীহ অপেক্ষা উত্তম। এই রাতের ১ রাক‘আত সালাত অন্যান্য রাতের ৩০,০০০ রাক‘আত অপেক্ষা উত্তম। বলা বাহুল্য, এই রাতের আমল শবেক্বদর বিহীন অন্যান্য ৩০ হাজার রাতের আমল অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ। সুতরাং যে ব্যক্তি এই রাতে ইবাদত করল, আসলে সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাস অপেক্ষাও বেশী সময় ধরে ইবাদত করল । যদিও এ হিসাব একটি কল্পনা মাত্র।
এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্ববর্তী (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়’।[৬] রামাযানের আগমনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ تُفْتَحُ فِيْهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَتُغْلَقُ فِيْهِ أَبْوَابُ الْجَحِيْمِ وَتُغَلُّ فِيْهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِيْنِ لِلهِ فِيْهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ
‘তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রামাযান মাস এসেছে। তার সিয়াম আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেছেন। তাতে আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। অবাধ্য শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়। আল্লাহর বিশেষ রহমতের জন্য তাতে এমন একটি রাত আছে, যা হাযার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষাও উত্তম। যে তা হতে বঞ্চিত হয়েছে সে সর্বপ্রকার মঙ্গল হতে বঞ্চিত হয়েছে’।[৭]
এ রাতে রহমত ও বরকতের ডালি নিয়ে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর নেতৃত্বে অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করে আল্লাহর বিশেষ অনুমতি ক্রমে। ক্বাতাদাহ ও অন্যান্য বিদ্বান (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘যাতে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত থাকে এবং মৃত্যু ও রূযির হিসাব নির্ধারিত থাকে’।[৮]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আল্লাহর ঐ সকল নির্দেশসহকারে (ফেরেশতা আগমন করে) যা তিনি আগামী এক বছরের জন্য নির্ধারিত করেছেন ও ফায়ছালা করেছেন’।[৯]
ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ রাতে ফেরেশতাগণ অধিক সংখ্যায় অবতরণ করে অধিক বরকতের কারণে। অধিকহারে বরকত ও রহমতের অবতরণের সাথে সাথে ফেরেশতাগণও অধিকহারে অবতরণ করে থাকে। যেমন তারা কুরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহকে স্মরণ করার মজলিসসমূহ ঘিরে রাখে। সেখানে প্রশান্তির বিশেষ রহমত নাযিল করে। তারা ইলম অন্বেষণকারীর প্রতি সম্মানের জন্য তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেয়’।[১০]
ক্বাতাদাহ ও ইবনু যায়েদ (রাহিমাহুমাল্লাহ) বলেন, ‘এ রাতে কেবলই মঙ্গল। ফজর পর্যন্ত কোন অমঙ্গল নেই’। যাহ্হাক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ রাতে আল্লাহ শান্তি ব্যতীত অন্য কিছুই নির্ধারণ করেন না’। মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটি নিরাপদ রাত্রি। এ রাতে শয়তান কোন মন্দ বা কষ্টদায়ক কাজ করতে সক্ষম হয় না’। শা‘বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ রাতে মাগরিব হতে ফজর পর্যন্ত ফেরেশতাগণ মসজিদের মুছল্লীদের উপরে এবং প্রত্যেক মুমিনের উপরে সালাম করে বলে, ‘হে মুমিন! আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হোক!।[১১]
লাইলাতুল ক্বদর কোন্ রাত্রিতে?
লাইলাতুল ক্বদর রামাযান মাসে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে রামাযান মাসের কোন্ রাত্রিতে লাইলাতুল ক্বদর তা নির্ধারণ সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আলিমগণ লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক মতবিরোধ করেছেন। এ ব্যাপারে প্রায় চল্লিশটিরও বেশি বক্তব্য পাওয়া যায়’।[১২] তবে অধিকাংশের বক্তব্য হচ্ছে, রামাযান মাসের শেষ দশ দিনের কোন এক রাত্রিতে লাইলাতুল ক্বদর হয়।[১৩] অনুরূপ অধিকাংশের বক্তব্য এটাও যে, শেষ দশদিনের বেজোড় রাত্রিসমূহে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ অথবা ২৯তম) লাইলাতুল কদর।[১৪]
এ মতটি অধিক শক্তিশালী। আর লাইলাতুল ক্বদর একেক বছর একেক রাত্রিতে হয়। সাতাশতম রাত্রির সাথে নির্দিষ্ট নয়। উবাই বিন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যে দৃঢ়তার সাথে সাতাশতম রাত্রির কথা বলেছিলেন তা সে বছর ঘটেছিল।[১৫]
প্রতিবছর ঐ রাত্রি লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারণ হয়ে যাবে এমনটি নয়। লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারিত নয় বরং আবর্তিত হয়ে থাকে।[১৬]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে ক্বদরের রাত্রি তালাশ করবে’।[১৭]
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণের কয়েকজনকে স্বপ্নে দেখানো হল এই মর্মে যে, ক্বদরের রাত্রি শেষের সাত রাত্রির মধ্যে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِي السَّبْعِ الْأَوَاخِرِ فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيَهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِي السَّبْعِ الْأَوَاخِرِ
‘আমিও তোমাদের সকলের স্বপ্নের একইরূপ দেখছি যে, শেষ সাত রাত্রিতে সীমাবদ্ধ। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অšে¦ষণ করে, সে যেন শেষ সাত রাত্রিতে অšে¦ষণ করে’।[১৮]
লাইলাতুল ক্বদর গোপন রাখার হিকমত
এর হিকমত হল, লাইলাতুল ক্বদর তালাশে বান্দা যাতে করে প্রতি রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে মনোনিবেশ করতে পারে। ওবাদা ইবনু ছামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ক্বদর রাত্রির সংবাদ দেয়ার জন্য বের হলেন। এ সময় মুসলিমদের দু’ব্যক্তি ঝগড়া আরম্ভ করল। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে ক্বদর রাত্রি সম্পর্কে খবর দেয়ার জন্য বের হয়েছিলাম কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়ায় লিপ্ত হল, ফলে তা উঠিয়ে নেয়া হল। সম্ভবত এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলই হয়েছে। সুতরাং তোমরা তা ২৯, ২৭ ও ২৫ শে রাতে তালাশ করবে।[১৯]
লাইলাতুল ক্বদরের নিদর্শনাবলী
এ রাতের কয়েকটি নিদর্শন হল, আবহাওয়া স্বাভাবিক হবে, রাতটি স্থির হবে এবং সূর্যের আলো স্বাভাবিক হবে। গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না। হালকা বাতাস প্রবাহিত হবে। ইবাদতের কারণে এক ধরনের প্রফুল্লতা এবং স্বাদ অনুধাবন করবে, যা অন্যান্য সময় সাধারণত বুঝা যায় না। সকালে হালকা আলোরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। সে রাতের সকালে সূর্য সাদা হয়ে উদয় হবে; তার কোন কিরণ থাকবে না। অথবা ক্ষীণ রক্তিম অবস্থায় উদিত হবে; ঠিক পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মত। অর্থাৎ তার রশ্মি চারিদিকে বিকীর্ণ হবে না।[২০]
ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।[২১]
এছাড়া লোক মুখে যে সব আলামতের কথা প্রচলিত। যেমন- ১. সে রাতে কুকুর ভেকায় না বা কম ভেকায়। ২. দালান কোঠা ঘুমিয়ে পড়ে। ৩. গাছ-পালা মাটিতে নুয়ে পড়ে আল্লাহকে সিজদা করে। ৪. সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মিঠা হয়ে যায়। ৫. নূরের ঝলকে অন্ধকার জায়গা আলোকিত হয়ে যায়। ৬. নেক লোকেরা ফেরেশতার সালাম শুনতে পান ইত্যাদি আলামতসমূহ কাল্পনিক। এগুলো শারঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এ সব কথা নিশ্চিতরূপে অভিজ্ঞতা ও বাস্তব বিরোধী।
রামাযানের শেষ দশকে করণীয়
আমলের অপূর্ণতা এবং ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার মোক্ষম সময় রামাযানের শেষের দশক। তাই সকল গাফিলতি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এখনই আল্লাহমুখী হওয়া খুব যরূরী। রামাযানের অবশিষ্ট দিনগুলোতে যে কয়েকটা আমল আমাদের বিশেষভাবে করতে হবে, তা নি¤েœ আলোচনা করা হল-
১). ই‘তিকাফ করা
রামাযান মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করা মুস্তাহাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَا تُبَاشِرُوۡہُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ فِی الۡمَسٰجِدِ
‘আর যতক্ষণ তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন
يَعْتَكِفُ فِيْ كُلِّ رَمَضَانٍ عَشَرَةَ أَيَّامٍ فَلَمَّا كَانَ العَامُ الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ اعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ يَوْمًا.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রামাযানে দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেছেন সে বছর বিশদিন ই‘তিকাফ করেছেন’।[২২]
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتّٰى تَوَفَّاهُ اللهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ
‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ইন্তেকাল করলেন, তারপর তাঁর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফ করতেন’।[২৩]
মূলত ই‘তিকাফে অধিক অধিক কল্যাণমূলক কাজ করা যায় এবং নেক আমল করার জন্য অত্যধিক প্রচেষ্টা করার সুযোগ থাকে। যা অন্যাবস্থায় থাকে না। যার কারণে লাইলাতুল ক্বদরের রাত পাওয়া সহজ হয়।
২). রাত জেগে ইবাদতে মগ্ন থাকা
মুসলিমদের জন্য কর্তব্য হল, এ রাতগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত করা ও পরিবার-পরিজনকে ইবাদতে উৎসাহিত করা। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ
‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে ফেলতেন। তিনি রাত্রি জেগে নিজে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারকেও জাগাতেন’।[২৪]
৩). বেশি বেশি পরিশ্রম করা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য রাতগুলোর চেয়ে শেষ দশকের রাতগুলোতে ‘ইবাদতের জন্য বেশি পরিশ্রম করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مَا لَا يَجْتَهِدُ فِيْ غَيْرِهَا
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ইবাদত করার জন্য এত পরিশ্রম করতেন, যা অন্য সময়ে করতেন না’।[২৫]
৪). বেশি বেশি আমলে ছালিহ তথা সৎ আমল করা
রামাযান মাসে সৎ আমলের প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়। তাই এ মাসে বিশেষ করে বিদায়ী শেষ দশকে বেশি বেশি আমলে ছালিহ আত্মনিয়োগ করা উচিত। কেননা এ সময় বান্দার আমল দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তাছাড়া রামাযানে প্রত্যেক আমল তার দশ গুণ মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ تَعَالَى إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِيْ وَأَنَا أَجْزِي بِهِ
‘আদম সন্তানের নেক আমল বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ হতে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তবে সিয়াম ব্যতীত। কারণ সিয়াম আমারই জন্য পালন করা হয় এবং তার প্রতিদান আমিই দিব’।[২৬] সহীহ বুখারীর অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا
‘আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ’।[২৭]
৫). মিথ্যা আমল ও কাজ পরিহার করা
একজন মুমিন সর্বদাই মিথ্যা কথা ও কাজ পরিহার করে সততার পথ অবলম্বন করবে। রামাযান মাসে এই সততার গুণ অর্জন করার বিশেষ শিক্ষা দেয়া হয়। তাই শেষ দশকে সৎ আমল করার পাশাপাশি সকল প্রকার মিথ্যা ও অপকর্ম থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اجۡتَنِبُوۡا قَوۡلَ الزُّوۡرِ ‘তোমরা দূরে থাক মিথ্যা বলা হতে’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩৯)।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِيْ أَنْ يَّدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।[২৮]
৬). জান্নাত তালাশ করা ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রান চাওয়া
প্রকৃত সফল ব্যক্তি সেই, যে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল। রামাযান মাসে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত লাভের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। তাই এ দশকে আল্লাহর কাছে বারবার জাহান্নাম থেকে বাঁচা ও জান্নাত লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করতে হবে। কারণ এ মাসে অসংখ্য জাহান্নামীকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা হয়।
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِيْنُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ فُتِحَتْ اَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَيُنَادِيْ مُنَادٍ يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أقْصِرْ وَلِلهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন রামাযান মাসের প্রথম রাত্রি আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনদেরকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে কল্যাণের অšে¦ষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অšে¦ষণকারী! থাম। আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন, আর এটা প্রত্যেক রাতেই হয়ে থাকে।[২৯]
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ مِنْهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ لَا يَدْخُلُهُ إِلَّا الصَّائِمُوْنَ
সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজার নাম রাইয়ান। সিয়ামপালনকারী ব্যতীত ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না’।[৩০]
৭). রহমত তালাশ করা
রামাযান মাসে আসমান ও রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। সুতরাং শেষ দশকে বেশি বেশি রহমত কামনা করা উচিত। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ
‘যখন রামাযান মাস আসে, তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’।[৩১]
তিনি আরো বলেন,
فُتِحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ
‘রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’।[৩২]
৮). বেশি বেশি ছাদাক্বাহ করা
এ দশকে সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণে দান-ছাদাক্বাহ করা উচিত। এ দশকে কেউ একটি টাকা দান করলে এবং সেটা লাইলাতুল ক্বদরের মধ্যে পড়ে গেলে তা অন্য মাসে ৩০০০০ টাকা দান করার চেয়েও বেশি ছওয়াবের অধিকারী হবে (সুবহা-নাল্লাহ)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। আর রামাযানে অধিক দান করতেন।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُوْنُ فِيْ رَمَضَانَ وَكَانَ جِبْرِيْلُ يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِيْ رَمَضَانَ يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقُرْآنَ فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيْلُ كَانَ أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ.
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, দানের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। আর তাঁর হৃদয়ের এ প্রশস্ততা রামাযান মাসে সবচেয়ে বেশী বেড়ে যেত। রামাযানে প্রত্যেক রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তিনি তাঁকে কুরআন শুনাতেন যখন তাঁর সাথে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) সাক্ষাৎ করতেন, তাঁর দান প্রবাহিত বাতাসের বেগের চেয়েও বেড়ে যেত।[৩৩]
৯). কুরআন তেলাওয়াত করা
রামাযানের সাথে কুরআনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। কারণ রামাযান মাসেই কুরআন অবতরণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানে প্রত্যেক রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তিনি তাঁকে কুরআন শুনাতেন।[৩৪] সুতরাং এ মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা দরকার। কারণ কুরআনের একটি অক্ষর পড়লে দশটি করে ছাওয়াব পাওয়া যায়।[৩৫] তাই শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদরের একটি অক্ষরের বিনিময় ৩০০০০ এরও বেশি সওয়াব আমরা পেতে পারি। তাছাড়া কুরআন ক্বিয়ামতের দিন তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَقُوْلُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ إِنِّيْ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهْوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ فَيُشْفَعَانِ.
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, সিয়াম এবং কুরআন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে দিনে তার খাদ্য ও প্রবৃত্তি হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।[৩৬]
১০). বেশি বেশি দু‘আ করা
রামাযান মাসে দু‘আ কবুলের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই শেষ দশকে বেশি বেশি দু‘আ করা উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
ثَلَاثُ دَعَوَاتٍ لَا تُرَدُّ دَعْوَةُ الْوَالِدِ وَدَعْوَةُ الصَّائِمِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ
‘তিন ব্যক্তির দু‘আ ফেরত দেয়া হয় না। ১. পিতা-মাতার দু‘আ। ২. সিয়াম পালনকারীর দু‘আ এবং ৩. মুসাফিরের দু‘আ’।[৩৭] রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,
إِنَّ لِلهِ عُتَقَاءَ فِىْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ
‘আল্লাহ রামাযানে প্রত্যেক দিন ও রাতে বান্দাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং দু‘আ কবুল করেন’।[৩৮]
যে দু‘আটি বেশি বেশি পড়তে হয় তাহল- আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! যদি আমি বুঝতে পারি রাতের মধ্যে ক্বদরের রাত কোন্টি? তখন আমি কী বলব? তিনি বললেন, তুমি বলবে,
اَللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ.
‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমাকে ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন’।[৩৯]
১১). তওবা ও ইস্তেগফার করা
তওবা ও ইস্তেগফারের মাস হল রমাযান মাস। সুতরাং এ মাসের সুবর্ণ সুযোগ যে হাতছাড়া করল তার মত হতভাগা আর কেউ হতে পারে না। তাই পুরো রামাযান বিশেষ করে শেষ দশকে বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করা উচিত। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُّغْفَرَ لَهُ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ
ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যার নিকট আমার নাম নেয়া হয় অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে না। ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যার নিকট রামাযান মাস উপস্থিত হল, অথচ তার গুনাহ মাফ করার পূর্বে তা অতিবাহিত হয়ে গেল। ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যে তার পিতা-মাতা অথবা তাদের দু’জনের একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল, অথচ তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না।[৪০]
পরিশেষে বলা যায়, রামাযানের পুরো মাস জুড়েই ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। তাই পুরো মাস ইবাদতের পাশাপাশি বিদায়ের শেষ দশকে আরো সচেতন হয়ে ইবাদত করলে তা আমাদের জন্য আরো কল্যাণ বয়ে আনবে। আল্লাহ আমাদের রামাযান মাসের বরকত, রহমত ও মাগফিরাতের সুযোগ লাভে ধন্য করুন-আমীন!!
[১]. নাসাঈ, হা/২১০৬।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/২০২২।
[৩]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৯।
[৪]. তাফসীরে কুরতুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪; সূরা আল-বাক্বারার ৯৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[৫]. তাফসীরে কুরতুবী, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৩১।
[৬]. সহীহ বুখারী, হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৯, ৭৬০।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৯৩; নাসাঈ, হা/২১০৬, সনদ সহীহ।
[৮]. ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৪।
[৯]. তাফসীরে কুরতুবী, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৩১।
[১০]. ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৪।
[১১]. কুরতুবী, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৩১; ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৪।
[১২]. ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩০৯।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[১৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৭।
[১৫]. সহীহ মুসলিম, হা/৭৬২; তিরমিযী, হা/৩৩৫১।
[১৬]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৮; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[১৭]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৭।
[১৮]. সহীহ বুখারী, হা/২০১৫; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৫।
[১৯]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৩, ৬০৪৯।
[২০]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[২১]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭; সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৯-১৫০।
[২২]. সহীহ বুখারী, হা/২০৪৪।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৬; সহীহ মুসলিম, হা/১১৭২।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[২৫]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫।
[২৬]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[২৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭।
[২৯]. তিরমিযী, হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২, সনদ সহীহ।
[৩০]. সহীহ বুখারী, হা/৩২৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫২।
[৩১]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯, ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।
[৩২]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯, ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।
[৩৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২, ৪৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮।
[৩৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২, ৪৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮।
[৩৫]. তিরমিযী, হা/২৯১০; মিশকাত, হা/২১৩৭, সনদ সহীহ।
[৩৬]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৯৯৪।
[৩৭]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৬৬১৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭৯৭।
[৩৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪৪৩, সনদ সহীহ।
[৩৯]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮৫০, সনদ সহীহ।
[৪০]. তিরমিযী, হা/৩৫৪৫।
মাইনুল ইসলাম মঈন
Last edited: