আযান শুরু হওয়ার পর সাহরী খাওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি বিশ্লেষণসাপেক্ষ অর্থাৎ যদি ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথে মুয়াজ্জিন আযান দেন, তাহলে রোজাদারের জন্য ওয়াজিব হল ফজরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা ভঙ্গকারী যাবতীয় বিষয়সমূহ (মুফাত্তিরাত) থেকে বিরত থাকা। কারণ আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ পর্যন্ত না কালোসুতা (রাতের কালো রেখা) হতে ঊষার সাদা সুতা (সাদা রেখা) স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।”[সূরা বাকারাহ ২: ১৮৭] উক্ত আয়াতে পর্যন্ত (حَتَّى)’ একটি অব্যয়, যা সময়ের প্রান্তসীমা শেষ হয়ে যাওয়ার অর্থ জ্ঞাপন করে। ফলে এই আয়াত প্রমাণ করছে, ফজর উদিত হওয়ার সময় থেকেই পানাহার থেকে বিরত থাকার ক্ষণ শুরু হয়। উল্লিখিত আয়াতটির সুস্পষ্ট মর্মার্থ ওই ব্যক্তিকে শামিল করে, যার হাতে কিংবা সম্মুখে আজানের সময় খাদ্য ও পানীয় থাকে। আবার তা ওই ব্যক্তিকেও শামিল করে, যার সম্মুখে আজানের সময় আহার্য থাকে না। সুতরাং ধর্তব্য হচ্ছে ফজর উদিত হওয়া। অতএব, যে ব্যক্তি ফজর উদিত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হবে তার জন্য মুয়াজ্জিন ‘আল্লাহু আক্বার’(আল্লাহ মহান) বলার সাথে সাথে খাদ্য, পানীয়, সহবাস ও সকল রোযা ভঙ্গকারী বিষয় (মুফাত্তিরাত) থেকে বিরত থাকা আবশ্যক হয়ে যায়। কিন্তু যে ব্যক্তি ফজর উদিত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়নি সে ব্যক্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত খেতে পারে। অনুরূপভাবে কেউ যদি জানে যে, মুয়াজ্জিন ওয়াক্ত হওয়ার আগেই আযান দেয় কিংবা সন্দেহ করে যে, মুয়াজ্জিন কি ঠিক সময়ে আযান দিয়েছে নাকি সময়ের আগে; সেক্ষেত্রেও সে ব্যক্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত খেতে পারে। তবে, উত্তম হচ্ছে সতর্কতাস্বরূপ আযান শুনার সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত থাকা শুরু করা।
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেন,
” إذا طلع الفجر وفي فيه طعام فليلفظه , فإن لفظه صح صومه , فإن ابتلعه أفطر … ولو طلع الفجر , وهو مجامع فنزع في الحال صح صومه ، أما إذا طلع الفجر وهو مجامع ، فعلم طلوعه , ثم مكث مستديما للجماع فيبطل صومه, ولا يعلم فيه خلاف للعلماء ، وتلزمه الكفارة على المذهب ”
“যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় কারও মুখে খাবার থাকে, তবে সে যেন তা ফেলে দেয়।(খাবার) ফেলে দিলে তার রোযা শুদ্ধ হবে, আর গিলে ফেললে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় সে সহবাসরত অবস্থায় থাকে, তবে সে অবস্থা থেকে তাৎক্ষণিক সরে গেলে তার রোযা শুদ্ধ হবে। আর যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় সে সহবাসরত অবস্থায় থাকে এবং ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে জেনেও সহবাসে লিপ্ত থাকে, তবে তার রোযা ভঙ্গ হবে এ ব্যাপারে ‘আলেমগণের মাঝে কোন দ্বিমত নেই। আর সে অনুসারে তার উপর কাফ্ফারা আবশ্যক হবে।”(নববী আল-মাজ্মু, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৩২৯)
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:“কোন ব্যক্তি আগেই সেহেরী খেয়েছে। কিন্তু ফজরের আযান চলাকালীন সময়ে অথবা আযান দেওয়ার ১৫ মিনিট পর পানি পান করেছে-এর হুকুম কী?
তাঁরা উত্তরে বলেন:
“إن كان المذكور في السؤال يعلم أن ذلك قبل تبين الصبح فلا قضاء عليه ، وإن علم أنه بعد تبين الصبح فعليه القضاء .
أما إن كان لا يعلم هل كان أكله وشربه بعد تبين الصبح أو قبله فلا قضاء عليه ، لأن الأصل بقاء الليل ، ولكن ينبغي للمؤمن أن يحتاط لصيامه وأن يمسك عن المفطرات إذا سمع الأذان ، إلا إذا علم أن هذا الأذان كان قبل الصبح”
“প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তি যদি জেনে থাকেন যে, সেই আযান সুবহে সাদিক পরিষ্কার হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছিল তবে তার উপর কোন কাযা নেই।আর যদি তিনি জেনে থাকেন যে, সে আযান সুবহে সাদিক পরিষ্কার হওয়ার পরে দেওয়া হয়েছে তবে তার উপর উক্ত রোযা কাযা করা আবশ্যক।আর তিনি যদি না জানেন যে, তার পানাহার ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে ঘটেছে, না পরে ঘটেছে সেক্ষেত্রে তাকে কোন রোযা কাযা করতে হবে না।কারণ এ ক্ষেত্রে মূল অবস্থা হচ্ছে রাত বাকি থাকা। তবে একজন মু’মিনের উচিত তার সিয়ামের ব্যাপারে সাবধান থাকা এবং আযান শোনার সাথে সাথে রোযা ভঙ্গকারী সমস্ত বিষয় থেকে বিরত থাকা। তবে তিনি যদি জেনে থাকেন যে, এই আযান ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছে তাহলে ভিন্ন কথা।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়াহ, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৪০)
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন:মুয়াজ্জিন দ্বিতীয় আযান দিচ্ছেন এমতাবস্থায় সাহরী খাওয়া অব্যাহত রাখা কি জায়েয হবে; নাকি সাহরী খাওয়া পরিত্যাগ করতে হবে?
উত্তর শাইখ বলেন,
هذا فيه تفصيل ، إن كان المؤذن أذّن على الصبح ( يؤذن إذا طلع الفجر حقيقة ) وجب الامتناع والإمساك ، لقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( لا يمنعنكم أذان بلال من سحوركم ، فإنه يؤذّن بليل ، فكلوا واشربوا حتى ينادي ابن أم مكتوم ) . والأصل في هذا قوله تعالى : ( وكلوا واشربوا حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر ) فإذا علم أن الفجر طلع حتى ولو ما أذن ، كما في صحراء أو نحوه إذا رأى الفجر يمتنع ولو ما سمع أذان .
أما إذا كان المؤذن يؤذن مبكراً أو يشك في أذانه هل وافق الصبح أم لا ، فله أن يأكل ويشرب حتى يتحقق طلوع الفجر ، إما بالساعات المعروفة التي ضبطت على أنها طلوع الفجر أو بأذان ثقة يعرف أنه يؤذن على الفجر ، فله أن يأكل في حالة الأذان ، أن يأكل أو يشرب أو يأكل ما في يده أو يشرب ما في يده لأن الأذان ليس على الصبح بل محتمل
এর বিধান বিশ্লেষণসাপেক্ষ। যদি মুয়াজ্জিন ফজর হওয়ার পর আযান দেন (অর্থাৎ সুবহে সাদিক হওয়ার পর আযান দেন) তাহলে খাওয়া পরিহার করা ও উপবাস শুরু করা আবশ্যক। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “বিলালের আযান যেন তোমাদেরকে সাহরী খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। কারণ সে রাত থাকতে আযান দেয়। অতএব, তোমরা পানাহার চালিয়ে যাও যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতুম আযান দেয়।” এ বিধানের মূল দলিল হল আল্লাহ্র বাণী: “তোমরা খাও ও পান কর; যতক্ষণ না ভোরের কালো রেখা থেকে শুভ্র রেখা ফুটে না উঠে।” এ জন্য যদি জানা যায় যে, ফজর উদিত হয়েছে তখন পানাহার থেকে বিরত থাকা আবশ্যক; আযান না দেয়া হলেও যেমন মরুভূমিতে আযান দেয়া হয় না কিংবা আযান না শুনলেও।
আর যদি মুয়াজ্জিন ফজর হওয়ার আগেই আযান দেয় কিংবা তার আযানের ব্যাপারে সন্দেহ হয় যে, সেটা কি ফজরের ওয়াক্তমত হয়েছে নাকি হয়নি; সেক্ষেত্রে সে ব্যক্তি ফজর হয়েছে মর্মে নিশ্চিত হওয়া অবধি পানাহার করতে পারেন; সেটা ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় নির্দিষ্ট করা আছে এমন ঘড়ির সময় দেখার মাধ্যমে কিংবা নির্ভরযোগ্য মুয়াজ্জিনের আযানের মাধ্যমে যার ব্যাপারে জানেন যে, তিনি ফজরের ওয়াক্ত হলেই আযান দেন। তাই এমন আযানের অবস্থায়ও সে ব্যক্তি পানাহার করতে পারবেন কিংবা তার হাতে যে খাবার বা পানীয়টুকু আছে সেটা সম্পূর্ণ করতে পারবেন। যেহেতু এ আযানটি সুবহে সাদিক হওয়ার আযান নয়; বরং সম্ভাব্য আযান।(সূত্র: মাজমুউ ফাতাওয়াস বিন বায; খণ্ড-১৫, পৃষ্ঠা-২৮২)
এখন কেউ ফজরের আযান শুনতে পেলে সে যেন হাতের বাসন রেখে না দেয় এই হাদীসের ব্যাখ্যা কী?
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمُ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ فَلاَ يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِىَ حَاجَتَهُ مِنْهُ “তোমাদের কেউ যখন আজান শোনে, এমতাবস্থায় তার হাতে রয়েছে পানপাত্র, তখন সে যেন ওই পাত্র থেকে নিজের প্রয়োজন সম্পূর্ণ না করার আগে তা রেখে না দেয়।”(আবূ দাঊদ হা/২৩৫০,
মুসনাদে আহমাদ হা/৯৪৭৪, ১০৬২৯, ১০৬৩০, মুসতাদারাক লিল হাকিম ৭২৯, সিলসিলা সহীহাহ হা/ ১৩৯৪, সহীহ আল জামি‘ হা/ ৬০৭)
উপরে উল্লিখিত হাদিসটির ব্যাপারে,আলেমগণ হাদীসটিকে কয়েকটি অর্থ করেছেন। যেমন:
(১).একদল সালাফদের মতে হাদীসটির সনদ এবং মতন উভয়ই মারফু সূত্রে জয়ীফ। বিস্তারিত জানতে দেখুন হাফিয ‘আব্দুর রহমান বিরচিত কিতাবুল ‘ইলাল” গ্রন্থে (খন্ড. ২; পৃষ্ঠা. ২৩৫-২৩৬; প্রশ্ন নং: ৩৪০; খন্ড. ৩; পৃষ্ঠা:. ১৩৭-১৩৮; প্রশ্ন নং: ৭৫৯;এবং ইবনু হাযম আল-মুহাল্লা, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৭১]
(২).একদল আলেম বলেন হাদীসটি সহীহ হলেও তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন: কতিপয় আলেমের মত, উক্ত হাদিসটি আদৌ ফজরের আজানের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং যেকোনো আজানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উদাহরণ স্বরূপ: কেউ খাবার খাচ্ছে। এমন সময় এশার আজান দিল। তাহলে সে যেন খাবার রেখে না দেয় বরং নিজের প্রয়োজন শেষ করে তারপর নামাজে যায়।
(৩).কোন কোন আলেম বলেন, এ আযান দ্বারা ফজরের পূর্বে বিলাল (রাঃ) এর আযান উদ্দেশ্য। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিলাল রাত থাকতেই আযান দেয়, অতএব তোমরা ইবনু উম্মু মাকতূম আযান দেয়ার আগ পর্যন্ত পানাহার করতে থাক।
(৪).এটাও বলা হয়ে থাকে যে, পানাহার হারাম হওয়ার সম্পর্ক ফজর উদয়ের সাথে আযানের সাথে নয়। মুয়াযযিন ফজর উদয়ের আগেও আযান দিতে পারে। আর নাবী (ﷺ) জানতেন, মুয়াজ্জিন ফজর উদয় হওয়ার আগে আজান দেয়। যেহেতু তাঁর পানাহার ফজরের আগেই সম্পন্ন হয়। অতএব এখানে আযান কোন ধর্তব্য বিষয় নয় যদি ফজর উদয়ের বিষয়টি জানা না যায়। এছাড়াও আলেমগণ আরো বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
হাফিয বাইহাক্বী আশ-শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীস বর্ণনা করার পর বলেছেন,
وهذا إنْ صحَّ فهو محمولٌ عند عوام أهل العلم: على أنَّه صلى الله عليه وسلم عَلِم أنَّ المُنادي كان يُنادي قبْل طلوع الفجر، بحيث يَقع شُربُه قُبَيل طلوع الفجر. وقول النبي صلى الله عليه وسلم: (( إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمُ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ ))خبرًا عن النِّداء الأوَّل. ليكون موافقًا لِمَا: أخبرنا أبو عبد الله الحافظ،….، عن عبد الله بن مسعود، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: (( لاَ يَمْنَعَنَّ أَحَدًا مِنْكُمْ أَذَانُ بِلاَلٍ مِنْ سُحُورِهِ، فَإِنَّمَا يُنَادِى لِيُوقِظَ نَائِمَكُمْ وَيَرْجِعَ قَائِمَكُمْ ))، رواه مسلم في “الصحيح” عن إسحاق بن إبراهيم، وأخرجه البخاري مِن أوجْه أُخَر عن التَّيمي. وأخبرنا أبو عبد الله الحافظ،….، عن نافع، عن ابن عمر، وعن القاسم، عن عائشة ــ رضي الله عنهما ــ قالا: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (( إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى تَسْمَعُوا أَذَانَ ابْنِ أُمِّ مَكْتُومٍ ))، رواه البخاري في “الصحيح” عن عُبيد بن إسماعيل، ورواه مسلم عن أبي بكر بن أبي شيبة، كلاهما عن أبي أسامة،… فإنْ صحَّ فكأنَّ ابن أمِّ مكتوم وقع تأذينه قبل الفجر، فلم يَمتنع رسول الله صلى الله عليه وسلم مِن الأكل. وعلى هذا الذي ذَكرنا تتفِق الأخبار، ولا تَختلف، وبالله التوفيق.اهـ
“হাদীসটি যদি বিশুদ্ধ হয়, তাহলে অধিকাংশ ‘আলিমের নিকট সেটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, নাবী ﷺ জানতেন, মুয়াজ্জিন ফজর উদয় হওয়ার আগে আজান দেয়। যেহেতু তাঁর পানাহার ফজরের আগেই সম্পন্ন হয়। নাবী ﷺ যে বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ আজান শোনে, আর পানপাত্র তার হাতে থাকে’, তা প্রথম আজান প্রসঙ্গে। যাতে করে এই হাদীস নিম্নোক্ত হাদীসদ্বয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমাদের কাছে আবূ ‘আব্দুল্লাহ আল-হাফিয বর্ণনা করেছেন…. ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘বিলালের আজান যেন তোমাদেরকে সাহরী খাওয়া থেকে বাধা না দেয়। কেননা সে রাত অবশিষ্ট থাকতেই আজান দেয়, যাতে করে তোমাদের মধ্যে যারা ক্বিয়ামকারী তারা গৃহে ফিরে যায়, আর ঘুমন্ত ব্যক্তিরা জাগ্রত হয়।’ ইমাম মুসলিম হাদীসটি তাঁর ‘সাহীহ’ গ্রন্থে ইসহাক্ব বিন ইবরাহীমের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আর ইমাম বুখারী হাদীসটি তাইমী থেকে একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আমাদের কাছে আবূ ‘আব্দুল্লাহ আল-হাফিয বর্ণনা করেছেন…. নাফি‘র মারফতে ইবনু ‘উমার থেকে, ক্বাসিম হতে বর্ণিত। ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘বিলাল রাত অবশিষ্ট থাকতেই আজান দেয়। সুতরাং ইবনে উম্মে মাকতূমের আজান না শোনা পর্যন্ত তোমরা পানাহার করো।’ ইমাম বুখারী হাদীসটি ‘সাহীহ’ গ্রন্থে ‘উবাইদ বিন ইসমা‘ঈলের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আর ইমাম মুসলিম আবূ বকর বিন শাইবাহ থেকে বর্ণনা করেছেন।সুতরাং হাদীসটি যদি সহিহ হয়, তাহলে ধরে নিতে হয়, হয়তো ইবনে উম্মে মাকতূমের আজান ফজরের আগেই হয়ে গেছে। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ (আজানের পরেও) আহার করা থেকে নিষেধ করেননি। আমাদের উল্লিখিত বিবরণের ওপর ভিত্তি করলেই এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসসমূহের মাঝে সামঞ্জস্যতা রক্ষিত হয় এবং বৈপরীত্য থেকে বেঁচে থাকা যায়। আর আল্লাহই তৌফিকদাতা”।[হাফিয বাইহাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ), সুনানুল কুবরা; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২১৮; হা/৮২৭৭-৮২৭৯ অনুবাদ আব্দুল্লাহ মৃধা ভাই ]
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
” ذكرنا أن من طلع الفجر وفي فيه طعام فليلفظه ويتم صومه , فإن ابتلعه بعد علمه بالفجر بطل صومه , وهذا لا خلاف فيه , ودليله حديث ابن عمر وعائشة رضي الله عنهم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ( إن بلالا يؤذن بليل , فكلوا واشربوا حتى يؤذن ابن أم مكتوم ) رواه البخاري ومسلم , وفي الصحيح أحاديث بمعناه”
وأما حديث أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : ( إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمْ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ فَلا يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِيَ حَاجَتَهُ مِنْهُ ) وفي رواية : ( وكان المؤذن يؤذن إذا بزغ الفجر ) فروى الحاكم أبو عبد الله الرواية الأولى , وقال : هذا صحيح على شرط مسلم , ورواهما البيهقي ، ثم قال : وهذا إن صح محمول عند عوام أهل العلم على أنه صلى الله عليه وسلم علم أنه ينادي قبل طلوع الفجر بحيث يقع شربه قبيل طلوع الفجر . قال : وقوله : ( إذا بزغ ) يحتمل أن يكون من كلام من دون أبي هريرة ، أو يكون خبراً عن الأذان الثاني , ويكون قول النبي صلى الله عليه وسلم : ( إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمْ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ ) خبراً عن النداء الأول ، ليكون موافقا لحديث ابن عمر وعائشة رضي الله عنهم . قال : وعلى هذا تتفق الأخبار . وبالله التوفيق , والله أعلم ”
“আমরা উল্লেখ করেছি যে, ফজর উদিত হওয়ার সময় যদি কারো মুখে খাবার থাকে, তবে সে তা ফেলে দিবে ও তার রোযা সম্পন্ন করবে। আর যদি ফজর হয়েছে জেনেও সে তা গিলে ফেলে, তবে তার রোযা বাতিল হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই”।এর দলীল হচ্ছে ইবনে উমর ও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এর হাদিস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“বিলাল (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) রাত থাকতে আযান দেন।তাই আপনারা খেতে থাকুন ও পান করতে থাকুন যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতূম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আযান দেন।”[হাদিসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম সংকলন করেছেন এবং সহীহ গ্রন্থে এই অর্থের আরও হাদিস রয়েছে।
অতঃপর আবু হুরায়রা হাদিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হাতে খাবারের পাত্র থাকা অবস্থায় যখন তোমাদের কেউ আজান শুনবে, তখন তার প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত যেন সে পাত্রটি রেখে না দেয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন ফজর উদিত হতো তখন মুয়াজ্জিন আজান দিতেন। হাকিম আবু আব্দুল্লাহ প্রথম রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করে বলেছেন: এটি ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহিহ। আর এ দুটিকে ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করে বলেছেন। হাদীসটি যদি বিশুদ্ধ হয়, তাহলে অধিকাংশ ‘আলিমের নিকট সেটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, নাবী ﷺ জানতেন, মুয়াজ্জিন ফজর উদয় হওয়ার আগে আজান দেয়। যেহেতু তাঁর পানাহার ফজরের আগেই সম্পন্ন হয়। তিনি বলেন:- তাঁর কথা (যখন উদিত হবে) এটি আবু হুরায়রার কথা না হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অথবা দ্বিতীয় আযান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা (হাতে খাবারের পাত্র থাকা অবস্থায় যখন তোমাদের কেউ আজান শুনবে,) এটি প্রথম আজান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। যাতে করে ইবনু উমর ও আয়েশার হাদিসের সাথে মিল থাকে। তিনি বলেন: এর উপর ভিত্তি করে হাদিসগুলো মিল রয়েছে অর্থাৎ একই রকম। আল্লাহর অনুগ্রহ । তিনি ভালো জানেন। (নববী আল-মাজ্মু, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৩৩৩)
ইমাম ইবনু ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘তাহযীবু সুনানি আবী দাঊদ’ গ্রন্থে হা/২৩৪৭ এর সংশ্লিষ্ট আলোচনা; টীকায় ‘আওনুল মা‘বূদের টেক্সট-সহ) বলেছেন,
وذهب الجمهور إلى امتناع السحور بطلوع الفجر، وهو قول الأئمة الأربعة، وعامة فقهاء الأمصار، ورُوي معناه عن عمر، وابن عباس.وَاحْتَجَّ الأَوَّلُونَ بِقَوْلِ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّن اِبْن أُمّ مَكْتُوم , وَلَمْ يَكُنْ يُؤَذِّن إِلا بَعْد طُلُوع الْفَجْر ) كَذَا فِي الْبُخَارِيِّ , وَفِي بَعْض الرِّوَايَات : ( وَكَانَ رَجُلا أَعْمَى لا يُؤَذِّن حَتَّى يُقَال لَهُ : أَصْبَحْت أَصْبَحْت ) . . . وَاحْتَجَّ الْجُمْهُور بِقَوْلِهِ تَعَالَى ( وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّن لَكُمْ الْخَيْط الأَبْيَض مِنْ الْخَيْط الأَسْوَد مِنْ الْفَجْر ) , وَبِقَوْلِ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( كُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّن اِبْن أُمّ مَكْتُوم ) , وَبِقَوْلِهِ : ( الْفَجْر فَجْرَانِ , فَأَمَّا الأَوَّل فَإِنَّهُ لا يُحَرِّم الطَّعَام ، وَلا يُحِلّ الصَّلاة , وَأَمَّا الثَّانِي فَإِنَّهُ يُحَرِّم الطَّعَام ، وَيُحِلّ الصَّلاة ) رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ فِي سُنَنه
“অধিকাংশ বিদ্বান এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, ফজর উদিত হয়ে গেলে সেহরি করা নিষিদ্ধ। এটি চার ইমামের অভিমত এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ফাক্বীহবৃন্দের অধিকাংশের অভিমত। এই মর্মের কথা বর্ণিত হয়েছে ‘উমার ও ইবনু ‘আব্বাস থেকে।” প্রথম দল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর এই বাণী দ্বারা দলিল গ্রহন করেছেন।(তোমরা খাও এবং পান করো, যতক্ষণ পর্যন্ত ইবনু উম্মে মাকতুম আজান না দেয়। আর সে ফজর উদিত হওয়ার পর আযান দিতো)। বুখারিতেও এরুপ আছে। আর অন্য কিছু রেওয়াতে রয়েছে, (আর তিনি একজন অন্ধ ব্যক্তি ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে বলা না হতো সকাল হয়ে গেছে সকাল হয়ে গেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আযান দিতেন না)…….। আর জমহুর আলেমগন আল্লাহর এই বাণী দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন: তোমরা আহার ও পান করতে থাক যে পর্যন্ত তোমাদের জন্য কালো রেখা হতে ঊষাকালের সাদা রেখা প্রকাশ না পায়।(সূরা বাকারাহ,১৮৭) এবং রাসূলের এই বাণী দ্বারা তারা দলিল গ্রহন করেছেন। كُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّن اِبْن أُمّ مَكْتُوم.(“যতক্ষণ পর্যন্ত ইবনে উম্মে মাকতুম আজান না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা খাও এবং পান কর”(সাহীহ বুখারী, হা/২৬৫৬, ৬২২, ৬১৭, ১৯১৮; সাহীহ মুসলিম, হা/১০৯২) এবং এই হাদিস দ্বারাও তাঁরা দলিল গ্রহণ করেছেন। (الْفَجْر فَجْرَانِ , فَأَمَّا الأَوَّل فَإِنَّهُ لا يُحَرِّم الطَّعَام ، وَلا يُحِلّ الصَّلاة , وَأَمَّا الثَّانِي فَإِنَّهُ يُحَرِّم الطَّعَام ، وَيُحِلّ الصَّلاة)(ফজর হলো দুটি । একটি ফজর হলো: যাতে খাবার হারাম নয় এবং সলাত পড়া বৈধ নয় (খাবার খাওয়া বৈধ রয়েছে কিন্তু নামাজ পড়া সে সময়ে বৈধ নাই)। আরেকটি ফজর হলো: খাবার হারাম এবং সালাত বৈধ (খাবার খাওয়া সেই সময়ে নিষিদ্ধ কিন্তু সে সময়ে নামাজ পড়া যাবে) (এটাকে ইমাম বায়হাকি তাঁর সুনান গ্রন্থে হা/৮২৬০ এবং ইমাম ইবনে খুজাইমাহ তার সহীহ ইবনে খুজাইমা হা/৩৫৬ এ বর্ণনা করেছেন)ইবনুল কাইয়ুম তাহযীবু সুনানি আবী দাঊদ’ খন্ড:৬; পৃষ্ঠা:৩৪১; হা/২৩৪৭)
ফাক্বীহ ইবনু হাযম আয-যাহিরী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি এর পশ্চাতে বলেছেন, هذا كله على أنَّه لم يَكن يتبيَّن لهم الفجر بعد، فبهذا تتفق السُّنن مع القرآن “এগুলোর সবই এ অর্থে যে, তাঁদের নিকটে ফজর প্রকাশিত হয়েছিল না। এর মাধ্যমেই কুরআনের সাথে সুন্নাহর সামঞ্জস্যবিধান করা যায়।” (আল-মুহাল্লা, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬৯-৩৭০)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) কে একটি প্রশ্ন করা হয়, সে প্রশ্নটির ভাষ্য হচ্ছে- যে ব্যক্তি আযান শুনার পরও পানাহার করেই যাচ্ছে তার রোযার শরয়ি হুকুম কি?
জবাবে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
” الواجب على المؤمن أن يمسك عن المفطرات من الأكل والشرب وغيرهما إذا تبين له طلوع الفجر ، وكان الصوم فريضة كرمضان وكصوم النذر والكفارات ؛ لقول الله عز وجل : ( وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ) البقرة/187 .
فإذا سمع الأذان ، وعلم أنه يؤذن على الفجر : وجب عليه الإمساك .فإن كان المؤذن يؤذن قبل طلوع الفجر : لم يجب عليه الإمساك ، وجاز له الأكل والشرب حتى يتبين له الفجر .
فإن كان لا يعلم حال المؤذن ، هل أذن قبل الفجر أو بعد الفجر : فإن الأولى والأحوط له أن يمسك إذا سمع الأذان ، ولا يضره لو شرب أو أكل شيئا حين الأذان لأنه لم يعلم بطلوع الفجر .
ومعلوم أن من كان داخل المدن التي فيها الأنوار الكهربائية لا يستطيع أن يعلم طلوع الفجر بعينه وقت طلوع الفجر ، ولكن عليه أن يحتاط بالعمل بالأذان والتقويمات التي تحدد طلوع الفجر بالساعة والدقيقة ، عملا بقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لا يَرِيبُكَ ) وقوله صلى الله عليه وسلم : ( مَنْ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ ) والله ولي التوفيق ”
“ঈমানদারের উপর ফরয হচ্ছে তার কাছে ফজর উদিত হওয়া নিশ্চিত হলে পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী বিষয়গুলো থেকে বিরত হওয়া; যদি রোযাটি রমযানের ফরয রোযা হয়, মানতের রোযা হয়, কাফ্ফারার রোযা হয়। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ পর্যন্ত না কালোসুতা (রাতের কালো রেখা) হতে ঊষার সাদা সুতা (সাদা রেখা) স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।”[সূরা বাকারাহ ২ : ১৮৭] যখন কেউ আযান শুনতে পায় এবং সে জানে যে, ফজরের সময় হলেই আযান দেয়া হয় সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী থেকে বিরত হওয়া ফরয। আর যদি মুয়াজ্জিন ফজর হওয়ার পূর্বেই আযান দেয় সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী থেকে বিরত হওয়া ফরয নয়। বরং ফজর উদিত হওয়া নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার করা তার জন্য জায়েয। আর যদি মুয়াজ্জিনের অবস্থা না জানে যে, সে কি ফজর হওয়ার আগে আযান দেয়; নাকি ফজর হওয়ার পরে আযান দেয় তাহলে উত্তম হচ্ছে ও সতর্কতা হচ্ছে- আযান শুনার সাথে সাথে পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত হওয়া। আর যদি আযান চলাকালেও সে কোন কিছু পানাহার করে তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ ফজর উদিত হওয়ার ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়নি। এ কথা সুবিদিত যে, যে ব্যক্তি শহরের ভেতরে বসবাস করে যেখানে বৈদ্যুতিক বাতি রয়েছে সেখানে নিজ চোখে দেখে ফজর উদিত হওয়া অবহিত হওয়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু, তার উচিত আমলের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা; আযানের মাধ্যমে ও ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে; যে সব ক্যালেন্ডারে ঘণ্টা ও মিনিটের মাধ্যমে ফজর উদিত হওয়ার সময় নির্ধারণ করা থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীর উপর আমল করে: “যাতে তোমার সন্দেহ নেই সেটা গ্রহণ করে যাতে তোমার সন্দেহ আছে সেটা বর্জন কর।” এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি সংশয়মূলক বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকে সে ব্যক্তি তার দ্বীনদারি ও সম্ভ্রম রক্ষা করে।” আল্লাহ্ই উত্তম তাওফিকদাতা।(‘ফাতাওয়া রমাদান’ থেকে সংকলিত; সংকলক: আশরাফ আব্দুল মাকছুদ, পৃষ্ঠা-২০১)
পরিশেষে, সন্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, যদি আপনার এলাকার মুয়াজ্জিন ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর আযান দেয়, তাহলে আযানের প্রথম তাকবীর শোনার সাথে সাথে আপনাকে সিয়াম ভঙ্গকারী যাবতীয় বিষয় থেকে
বিরত হয়ে যেতে হবে। আর যদি আপনি জেনে থাকেন যে, মুয়াজ্জিন ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই আযান দেয় অথবা এব্যাপারে আপনি সন্দিহান থাকেন যে, তিনি কি সুবহে সাদিক হওয়ার আগে আযান দেন, নাকি পরে আযান দেন- সেক্ষেত্রে আপনি ব্যক্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত খেতে পারে। কারণ আল্লাহ তা’আলা ফজর পরিস্ফুট হওয়া পর্যন্ত খাওয়া, পান করা ও সহবাস করা বৈধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন فَالْآَنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ) “অতএব এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা (সন্তান) লিখে রেখেছেন তা কামনা করতে পার। আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ কালো সুতা (রাতের কালো রেখা) হতে ঊষার সাদা সুতা (সাদা রেখা) স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।” [সূরা বাকারাহ, ২: ১৮৭] তবে,উত্তম হচ্ছে সতর্কতাস্বরূপ আযান শুনার সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত থাকা শুরু করা।
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেন,
” إذا طلع الفجر وفي فيه طعام فليلفظه , فإن لفظه صح صومه , فإن ابتلعه أفطر … ولو طلع الفجر , وهو مجامع فنزع في الحال صح صومه ، أما إذا طلع الفجر وهو مجامع ، فعلم طلوعه , ثم مكث مستديما للجماع فيبطل صومه, ولا يعلم فيه خلاف للعلماء ، وتلزمه الكفارة على المذهب ”
“যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় কারও মুখে খাবার থাকে, তবে সে যেন তা ফেলে দেয়।(খাবার) ফেলে দিলে তার রোযা শুদ্ধ হবে, আর গিলে ফেললে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় সে সহবাসরত অবস্থায় থাকে, তবে সে অবস্থা থেকে তাৎক্ষণিক সরে গেলে তার রোযা শুদ্ধ হবে। আর যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় সে সহবাসরত অবস্থায় থাকে এবং ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে জেনেও সহবাসে লিপ্ত থাকে, তবে তার রোযা ভঙ্গ হবে এ ব্যাপারে ‘আলেমগণের মাঝে কোন দ্বিমত নেই। আর সে অনুসারে তার উপর কাফ্ফারা আবশ্যক হবে।”(নববী আল-মাজ্মু, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৩২৯)
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:“কোন ব্যক্তি আগেই সেহেরী খেয়েছে। কিন্তু ফজরের আযান চলাকালীন সময়ে অথবা আযান দেওয়ার ১৫ মিনিট পর পানি পান করেছে-এর হুকুম কী?
তাঁরা উত্তরে বলেন:
“إن كان المذكور في السؤال يعلم أن ذلك قبل تبين الصبح فلا قضاء عليه ، وإن علم أنه بعد تبين الصبح فعليه القضاء .
أما إن كان لا يعلم هل كان أكله وشربه بعد تبين الصبح أو قبله فلا قضاء عليه ، لأن الأصل بقاء الليل ، ولكن ينبغي للمؤمن أن يحتاط لصيامه وأن يمسك عن المفطرات إذا سمع الأذان ، إلا إذا علم أن هذا الأذان كان قبل الصبح”
“প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তি যদি জেনে থাকেন যে, সেই আযান সুবহে সাদিক পরিষ্কার হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছিল তবে তার উপর কোন কাযা নেই।আর যদি তিনি জেনে থাকেন যে, সে আযান সুবহে সাদিক পরিষ্কার হওয়ার পরে দেওয়া হয়েছে তবে তার উপর উক্ত রোযা কাযা করা আবশ্যক।আর তিনি যদি না জানেন যে, তার পানাহার ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে ঘটেছে, না পরে ঘটেছে সেক্ষেত্রে তাকে কোন রোযা কাযা করতে হবে না।কারণ এ ক্ষেত্রে মূল অবস্থা হচ্ছে রাত বাকি থাকা। তবে একজন মু’মিনের উচিত তার সিয়ামের ব্যাপারে সাবধান থাকা এবং আযান শোনার সাথে সাথে রোযা ভঙ্গকারী সমস্ত বিষয় থেকে বিরত থাকা। তবে তিনি যদি জেনে থাকেন যে, এই আযান ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছে তাহলে ভিন্ন কথা।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়াহ, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৪০)
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন:মুয়াজ্জিন দ্বিতীয় আযান দিচ্ছেন এমতাবস্থায় সাহরী খাওয়া অব্যাহত রাখা কি জায়েয হবে; নাকি সাহরী খাওয়া পরিত্যাগ করতে হবে?
উত্তর শাইখ বলেন,
هذا فيه تفصيل ، إن كان المؤذن أذّن على الصبح ( يؤذن إذا طلع الفجر حقيقة ) وجب الامتناع والإمساك ، لقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( لا يمنعنكم أذان بلال من سحوركم ، فإنه يؤذّن بليل ، فكلوا واشربوا حتى ينادي ابن أم مكتوم ) . والأصل في هذا قوله تعالى : ( وكلوا واشربوا حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر ) فإذا علم أن الفجر طلع حتى ولو ما أذن ، كما في صحراء أو نحوه إذا رأى الفجر يمتنع ولو ما سمع أذان .
أما إذا كان المؤذن يؤذن مبكراً أو يشك في أذانه هل وافق الصبح أم لا ، فله أن يأكل ويشرب حتى يتحقق طلوع الفجر ، إما بالساعات المعروفة التي ضبطت على أنها طلوع الفجر أو بأذان ثقة يعرف أنه يؤذن على الفجر ، فله أن يأكل في حالة الأذان ، أن يأكل أو يشرب أو يأكل ما في يده أو يشرب ما في يده لأن الأذان ليس على الصبح بل محتمل
এর বিধান বিশ্লেষণসাপেক্ষ। যদি মুয়াজ্জিন ফজর হওয়ার পর আযান দেন (অর্থাৎ সুবহে সাদিক হওয়ার পর আযান দেন) তাহলে খাওয়া পরিহার করা ও উপবাস শুরু করা আবশ্যক। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “বিলালের আযান যেন তোমাদেরকে সাহরী খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। কারণ সে রাত থাকতে আযান দেয়। অতএব, তোমরা পানাহার চালিয়ে যাও যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতুম আযান দেয়।” এ বিধানের মূল দলিল হল আল্লাহ্র বাণী: “তোমরা খাও ও পান কর; যতক্ষণ না ভোরের কালো রেখা থেকে শুভ্র রেখা ফুটে না উঠে।” এ জন্য যদি জানা যায় যে, ফজর উদিত হয়েছে তখন পানাহার থেকে বিরত থাকা আবশ্যক; আযান না দেয়া হলেও যেমন মরুভূমিতে আযান দেয়া হয় না কিংবা আযান না শুনলেও।
আর যদি মুয়াজ্জিন ফজর হওয়ার আগেই আযান দেয় কিংবা তার আযানের ব্যাপারে সন্দেহ হয় যে, সেটা কি ফজরের ওয়াক্তমত হয়েছে নাকি হয়নি; সেক্ষেত্রে সে ব্যক্তি ফজর হয়েছে মর্মে নিশ্চিত হওয়া অবধি পানাহার করতে পারেন; সেটা ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় নির্দিষ্ট করা আছে এমন ঘড়ির সময় দেখার মাধ্যমে কিংবা নির্ভরযোগ্য মুয়াজ্জিনের আযানের মাধ্যমে যার ব্যাপারে জানেন যে, তিনি ফজরের ওয়াক্ত হলেই আযান দেন। তাই এমন আযানের অবস্থায়ও সে ব্যক্তি পানাহার করতে পারবেন কিংবা তার হাতে যে খাবার বা পানীয়টুকু আছে সেটা সম্পূর্ণ করতে পারবেন। যেহেতু এ আযানটি সুবহে সাদিক হওয়ার আযান নয়; বরং সম্ভাব্য আযান।(সূত্র: মাজমুউ ফাতাওয়াস বিন বায; খণ্ড-১৫, পৃষ্ঠা-২৮২)
এখন কেউ ফজরের আযান শুনতে পেলে সে যেন হাতের বাসন রেখে না দেয় এই হাদীসের ব্যাখ্যা কী?
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمُ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ فَلاَ يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِىَ حَاجَتَهُ مِنْهُ “তোমাদের কেউ যখন আজান শোনে, এমতাবস্থায় তার হাতে রয়েছে পানপাত্র, তখন সে যেন ওই পাত্র থেকে নিজের প্রয়োজন সম্পূর্ণ না করার আগে তা রেখে না দেয়।”(আবূ দাঊদ হা/২৩৫০,
মুসনাদে আহমাদ হা/৯৪৭৪, ১০৬২৯, ১০৬৩০, মুসতাদারাক লিল হাকিম ৭২৯, সিলসিলা সহীহাহ হা/ ১৩৯৪, সহীহ আল জামি‘ হা/ ৬০৭)
উপরে উল্লিখিত হাদিসটির ব্যাপারে,আলেমগণ হাদীসটিকে কয়েকটি অর্থ করেছেন। যেমন:
(১).একদল সালাফদের মতে হাদীসটির সনদ এবং মতন উভয়ই মারফু সূত্রে জয়ীফ। বিস্তারিত জানতে দেখুন হাফিয ‘আব্দুর রহমান বিরচিত কিতাবুল ‘ইলাল” গ্রন্থে (খন্ড. ২; পৃষ্ঠা. ২৩৫-২৩৬; প্রশ্ন নং: ৩৪০; খন্ড. ৩; পৃষ্ঠা:. ১৩৭-১৩৮; প্রশ্ন নং: ৭৫৯;এবং ইবনু হাযম আল-মুহাল্লা, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৭১]
(২).একদল আলেম বলেন হাদীসটি সহীহ হলেও তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন: কতিপয় আলেমের মত, উক্ত হাদিসটি আদৌ ফজরের আজানের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং যেকোনো আজানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উদাহরণ স্বরূপ: কেউ খাবার খাচ্ছে। এমন সময় এশার আজান দিল। তাহলে সে যেন খাবার রেখে না দেয় বরং নিজের প্রয়োজন শেষ করে তারপর নামাজে যায়।
(৩).কোন কোন আলেম বলেন, এ আযান দ্বারা ফজরের পূর্বে বিলাল (রাঃ) এর আযান উদ্দেশ্য। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিলাল রাত থাকতেই আযান দেয়, অতএব তোমরা ইবনু উম্মু মাকতূম আযান দেয়ার আগ পর্যন্ত পানাহার করতে থাক।
(৪).এটাও বলা হয়ে থাকে যে, পানাহার হারাম হওয়ার সম্পর্ক ফজর উদয়ের সাথে আযানের সাথে নয়। মুয়াযযিন ফজর উদয়ের আগেও আযান দিতে পারে। আর নাবী (ﷺ) জানতেন, মুয়াজ্জিন ফজর উদয় হওয়ার আগে আজান দেয়। যেহেতু তাঁর পানাহার ফজরের আগেই সম্পন্ন হয়। অতএব এখানে আযান কোন ধর্তব্য বিষয় নয় যদি ফজর উদয়ের বিষয়টি জানা না যায়। এছাড়াও আলেমগণ আরো বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
হাফিয বাইহাক্বী আশ-শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীস বর্ণনা করার পর বলেছেন,
وهذا إنْ صحَّ فهو محمولٌ عند عوام أهل العلم: على أنَّه صلى الله عليه وسلم عَلِم أنَّ المُنادي كان يُنادي قبْل طلوع الفجر، بحيث يَقع شُربُه قُبَيل طلوع الفجر. وقول النبي صلى الله عليه وسلم: (( إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمُ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ ))خبرًا عن النِّداء الأوَّل. ليكون موافقًا لِمَا: أخبرنا أبو عبد الله الحافظ،….، عن عبد الله بن مسعود، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: (( لاَ يَمْنَعَنَّ أَحَدًا مِنْكُمْ أَذَانُ بِلاَلٍ مِنْ سُحُورِهِ، فَإِنَّمَا يُنَادِى لِيُوقِظَ نَائِمَكُمْ وَيَرْجِعَ قَائِمَكُمْ ))، رواه مسلم في “الصحيح” عن إسحاق بن إبراهيم، وأخرجه البخاري مِن أوجْه أُخَر عن التَّيمي. وأخبرنا أبو عبد الله الحافظ،….، عن نافع، عن ابن عمر، وعن القاسم، عن عائشة ــ رضي الله عنهما ــ قالا: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (( إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى تَسْمَعُوا أَذَانَ ابْنِ أُمِّ مَكْتُومٍ ))، رواه البخاري في “الصحيح” عن عُبيد بن إسماعيل، ورواه مسلم عن أبي بكر بن أبي شيبة، كلاهما عن أبي أسامة،… فإنْ صحَّ فكأنَّ ابن أمِّ مكتوم وقع تأذينه قبل الفجر، فلم يَمتنع رسول الله صلى الله عليه وسلم مِن الأكل. وعلى هذا الذي ذَكرنا تتفِق الأخبار، ولا تَختلف، وبالله التوفيق.اهـ
“হাদীসটি যদি বিশুদ্ধ হয়, তাহলে অধিকাংশ ‘আলিমের নিকট সেটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, নাবী ﷺ জানতেন, মুয়াজ্জিন ফজর উদয় হওয়ার আগে আজান দেয়। যেহেতু তাঁর পানাহার ফজরের আগেই সম্পন্ন হয়। নাবী ﷺ যে বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ আজান শোনে, আর পানপাত্র তার হাতে থাকে’, তা প্রথম আজান প্রসঙ্গে। যাতে করে এই হাদীস নিম্নোক্ত হাদীসদ্বয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমাদের কাছে আবূ ‘আব্দুল্লাহ আল-হাফিয বর্ণনা করেছেন…. ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘বিলালের আজান যেন তোমাদেরকে সাহরী খাওয়া থেকে বাধা না দেয়। কেননা সে রাত অবশিষ্ট থাকতেই আজান দেয়, যাতে করে তোমাদের মধ্যে যারা ক্বিয়ামকারী তারা গৃহে ফিরে যায়, আর ঘুমন্ত ব্যক্তিরা জাগ্রত হয়।’ ইমাম মুসলিম হাদীসটি তাঁর ‘সাহীহ’ গ্রন্থে ইসহাক্ব বিন ইবরাহীমের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আর ইমাম বুখারী হাদীসটি তাইমী থেকে একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আমাদের কাছে আবূ ‘আব্দুল্লাহ আল-হাফিয বর্ণনা করেছেন…. নাফি‘র মারফতে ইবনু ‘উমার থেকে, ক্বাসিম হতে বর্ণিত। ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘বিলাল রাত অবশিষ্ট থাকতেই আজান দেয়। সুতরাং ইবনে উম্মে মাকতূমের আজান না শোনা পর্যন্ত তোমরা পানাহার করো।’ ইমাম বুখারী হাদীসটি ‘সাহীহ’ গ্রন্থে ‘উবাইদ বিন ইসমা‘ঈলের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আর ইমাম মুসলিম আবূ বকর বিন শাইবাহ থেকে বর্ণনা করেছেন।সুতরাং হাদীসটি যদি সহিহ হয়, তাহলে ধরে নিতে হয়, হয়তো ইবনে উম্মে মাকতূমের আজান ফজরের আগেই হয়ে গেছে। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ (আজানের পরেও) আহার করা থেকে নিষেধ করেননি। আমাদের উল্লিখিত বিবরণের ওপর ভিত্তি করলেই এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসসমূহের মাঝে সামঞ্জস্যতা রক্ষিত হয় এবং বৈপরীত্য থেকে বেঁচে থাকা যায়। আর আল্লাহই তৌফিকদাতা”।[হাফিয বাইহাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ), সুনানুল কুবরা; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২১৮; হা/৮২৭৭-৮২৭৯ অনুবাদ আব্দুল্লাহ মৃধা ভাই ]
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
” ذكرنا أن من طلع الفجر وفي فيه طعام فليلفظه ويتم صومه , فإن ابتلعه بعد علمه بالفجر بطل صومه , وهذا لا خلاف فيه , ودليله حديث ابن عمر وعائشة رضي الله عنهم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ( إن بلالا يؤذن بليل , فكلوا واشربوا حتى يؤذن ابن أم مكتوم ) رواه البخاري ومسلم , وفي الصحيح أحاديث بمعناه”
وأما حديث أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : ( إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمْ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ فَلا يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِيَ حَاجَتَهُ مِنْهُ ) وفي رواية : ( وكان المؤذن يؤذن إذا بزغ الفجر ) فروى الحاكم أبو عبد الله الرواية الأولى , وقال : هذا صحيح على شرط مسلم , ورواهما البيهقي ، ثم قال : وهذا إن صح محمول عند عوام أهل العلم على أنه صلى الله عليه وسلم علم أنه ينادي قبل طلوع الفجر بحيث يقع شربه قبيل طلوع الفجر . قال : وقوله : ( إذا بزغ ) يحتمل أن يكون من كلام من دون أبي هريرة ، أو يكون خبراً عن الأذان الثاني , ويكون قول النبي صلى الله عليه وسلم : ( إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمْ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ ) خبراً عن النداء الأول ، ليكون موافقا لحديث ابن عمر وعائشة رضي الله عنهم . قال : وعلى هذا تتفق الأخبار . وبالله التوفيق , والله أعلم ”
“আমরা উল্লেখ করেছি যে, ফজর উদিত হওয়ার সময় যদি কারো মুখে খাবার থাকে, তবে সে তা ফেলে দিবে ও তার রোযা সম্পন্ন করবে। আর যদি ফজর হয়েছে জেনেও সে তা গিলে ফেলে, তবে তার রোযা বাতিল হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই”।এর দলীল হচ্ছে ইবনে উমর ও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এর হাদিস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“বিলাল (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) রাত থাকতে আযান দেন।তাই আপনারা খেতে থাকুন ও পান করতে থাকুন যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতূম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আযান দেন।”[হাদিসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম সংকলন করেছেন এবং সহীহ গ্রন্থে এই অর্থের আরও হাদিস রয়েছে।
অতঃপর আবু হুরায়রা হাদিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হাতে খাবারের পাত্র থাকা অবস্থায় যখন তোমাদের কেউ আজান শুনবে, তখন তার প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত যেন সে পাত্রটি রেখে না দেয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন ফজর উদিত হতো তখন মুয়াজ্জিন আজান দিতেন। হাকিম আবু আব্দুল্লাহ প্রথম রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করে বলেছেন: এটি ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহিহ। আর এ দুটিকে ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করে বলেছেন। হাদীসটি যদি বিশুদ্ধ হয়, তাহলে অধিকাংশ ‘আলিমের নিকট সেটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, নাবী ﷺ জানতেন, মুয়াজ্জিন ফজর উদয় হওয়ার আগে আজান দেয়। যেহেতু তাঁর পানাহার ফজরের আগেই সম্পন্ন হয়। তিনি বলেন:- তাঁর কথা (যখন উদিত হবে) এটি আবু হুরায়রার কথা না হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অথবা দ্বিতীয় আযান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা (হাতে খাবারের পাত্র থাকা অবস্থায় যখন তোমাদের কেউ আজান শুনবে,) এটি প্রথম আজান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। যাতে করে ইবনু উমর ও আয়েশার হাদিসের সাথে মিল থাকে। তিনি বলেন: এর উপর ভিত্তি করে হাদিসগুলো মিল রয়েছে অর্থাৎ একই রকম। আল্লাহর অনুগ্রহ । তিনি ভালো জানেন। (নববী আল-মাজ্মু, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৩৩৩)
ইমাম ইবনু ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘তাহযীবু সুনানি আবী দাঊদ’ গ্রন্থে হা/২৩৪৭ এর সংশ্লিষ্ট আলোচনা; টীকায় ‘আওনুল মা‘বূদের টেক্সট-সহ) বলেছেন,
وذهب الجمهور إلى امتناع السحور بطلوع الفجر، وهو قول الأئمة الأربعة، وعامة فقهاء الأمصار، ورُوي معناه عن عمر، وابن عباس.وَاحْتَجَّ الأَوَّلُونَ بِقَوْلِ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّن اِبْن أُمّ مَكْتُوم , وَلَمْ يَكُنْ يُؤَذِّن إِلا بَعْد طُلُوع الْفَجْر ) كَذَا فِي الْبُخَارِيِّ , وَفِي بَعْض الرِّوَايَات : ( وَكَانَ رَجُلا أَعْمَى لا يُؤَذِّن حَتَّى يُقَال لَهُ : أَصْبَحْت أَصْبَحْت ) . . . وَاحْتَجَّ الْجُمْهُور بِقَوْلِهِ تَعَالَى ( وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّن لَكُمْ الْخَيْط الأَبْيَض مِنْ الْخَيْط الأَسْوَد مِنْ الْفَجْر ) , وَبِقَوْلِ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( كُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّن اِبْن أُمّ مَكْتُوم ) , وَبِقَوْلِهِ : ( الْفَجْر فَجْرَانِ , فَأَمَّا الأَوَّل فَإِنَّهُ لا يُحَرِّم الطَّعَام ، وَلا يُحِلّ الصَّلاة , وَأَمَّا الثَّانِي فَإِنَّهُ يُحَرِّم الطَّعَام ، وَيُحِلّ الصَّلاة ) رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ فِي سُنَنه
“অধিকাংশ বিদ্বান এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, ফজর উদিত হয়ে গেলে সেহরি করা নিষিদ্ধ। এটি চার ইমামের অভিমত এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ফাক্বীহবৃন্দের অধিকাংশের অভিমত। এই মর্মের কথা বর্ণিত হয়েছে ‘উমার ও ইবনু ‘আব্বাস থেকে।” প্রথম দল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর এই বাণী দ্বারা দলিল গ্রহন করেছেন।(তোমরা খাও এবং পান করো, যতক্ষণ পর্যন্ত ইবনু উম্মে মাকতুম আজান না দেয়। আর সে ফজর উদিত হওয়ার পর আযান দিতো)। বুখারিতেও এরুপ আছে। আর অন্য কিছু রেওয়াতে রয়েছে, (আর তিনি একজন অন্ধ ব্যক্তি ছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে বলা না হতো সকাল হয়ে গেছে সকাল হয়ে গেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আযান দিতেন না)…….। আর জমহুর আলেমগন আল্লাহর এই বাণী দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন: তোমরা আহার ও পান করতে থাক যে পর্যন্ত তোমাদের জন্য কালো রেখা হতে ঊষাকালের সাদা রেখা প্রকাশ না পায়।(সূরা বাকারাহ,১৮৭) এবং রাসূলের এই বাণী দ্বারা তারা দলিল গ্রহন করেছেন। كُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّن اِبْن أُمّ مَكْتُوم.(“যতক্ষণ পর্যন্ত ইবনে উম্মে মাকতুম আজান না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা খাও এবং পান কর”(সাহীহ বুখারী, হা/২৬৫৬, ৬২২, ৬১৭, ১৯১৮; সাহীহ মুসলিম, হা/১০৯২) এবং এই হাদিস দ্বারাও তাঁরা দলিল গ্রহণ করেছেন। (الْفَجْر فَجْرَانِ , فَأَمَّا الأَوَّل فَإِنَّهُ لا يُحَرِّم الطَّعَام ، وَلا يُحِلّ الصَّلاة , وَأَمَّا الثَّانِي فَإِنَّهُ يُحَرِّم الطَّعَام ، وَيُحِلّ الصَّلاة)(ফজর হলো দুটি । একটি ফজর হলো: যাতে খাবার হারাম নয় এবং সলাত পড়া বৈধ নয় (খাবার খাওয়া বৈধ রয়েছে কিন্তু নামাজ পড়া সে সময়ে বৈধ নাই)। আরেকটি ফজর হলো: খাবার হারাম এবং সালাত বৈধ (খাবার খাওয়া সেই সময়ে নিষিদ্ধ কিন্তু সে সময়ে নামাজ পড়া যাবে) (এটাকে ইমাম বায়হাকি তাঁর সুনান গ্রন্থে হা/৮২৬০ এবং ইমাম ইবনে খুজাইমাহ তার সহীহ ইবনে খুজাইমা হা/৩৫৬ এ বর্ণনা করেছেন)ইবনুল কাইয়ুম তাহযীবু সুনানি আবী দাঊদ’ খন্ড:৬; পৃষ্ঠা:৩৪১; হা/২৩৪৭)
ফাক্বীহ ইবনু হাযম আয-যাহিরী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি এর পশ্চাতে বলেছেন, هذا كله على أنَّه لم يَكن يتبيَّن لهم الفجر بعد، فبهذا تتفق السُّنن مع القرآن “এগুলোর সবই এ অর্থে যে, তাঁদের নিকটে ফজর প্রকাশিত হয়েছিল না। এর মাধ্যমেই কুরআনের সাথে সুন্নাহর সামঞ্জস্যবিধান করা যায়।” (আল-মুহাল্লা, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬৯-৩৭০)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) কে একটি প্রশ্ন করা হয়, সে প্রশ্নটির ভাষ্য হচ্ছে- যে ব্যক্তি আযান শুনার পরও পানাহার করেই যাচ্ছে তার রোযার শরয়ি হুকুম কি?
জবাবে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
” الواجب على المؤمن أن يمسك عن المفطرات من الأكل والشرب وغيرهما إذا تبين له طلوع الفجر ، وكان الصوم فريضة كرمضان وكصوم النذر والكفارات ؛ لقول الله عز وجل : ( وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ) البقرة/187 .
فإذا سمع الأذان ، وعلم أنه يؤذن على الفجر : وجب عليه الإمساك .فإن كان المؤذن يؤذن قبل طلوع الفجر : لم يجب عليه الإمساك ، وجاز له الأكل والشرب حتى يتبين له الفجر .
فإن كان لا يعلم حال المؤذن ، هل أذن قبل الفجر أو بعد الفجر : فإن الأولى والأحوط له أن يمسك إذا سمع الأذان ، ولا يضره لو شرب أو أكل شيئا حين الأذان لأنه لم يعلم بطلوع الفجر .
ومعلوم أن من كان داخل المدن التي فيها الأنوار الكهربائية لا يستطيع أن يعلم طلوع الفجر بعينه وقت طلوع الفجر ، ولكن عليه أن يحتاط بالعمل بالأذان والتقويمات التي تحدد طلوع الفجر بالساعة والدقيقة ، عملا بقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لا يَرِيبُكَ ) وقوله صلى الله عليه وسلم : ( مَنْ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ ) والله ولي التوفيق ”
“ঈমানদারের উপর ফরয হচ্ছে তার কাছে ফজর উদিত হওয়া নিশ্চিত হলে পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী বিষয়গুলো থেকে বিরত হওয়া; যদি রোযাটি রমযানের ফরয রোযা হয়, মানতের রোযা হয়, কাফ্ফারার রোযা হয়। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ পর্যন্ত না কালোসুতা (রাতের কালো রেখা) হতে ঊষার সাদা সুতা (সাদা রেখা) স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।”[সূরা বাকারাহ ২ : ১৮৭] যখন কেউ আযান শুনতে পায় এবং সে জানে যে, ফজরের সময় হলেই আযান দেয়া হয় সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী থেকে বিরত হওয়া ফরয। আর যদি মুয়াজ্জিন ফজর হওয়ার পূর্বেই আযান দেয় সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী থেকে বিরত হওয়া ফরয নয়। বরং ফজর উদিত হওয়া নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার করা তার জন্য জায়েয। আর যদি মুয়াজ্জিনের অবস্থা না জানে যে, সে কি ফজর হওয়ার আগে আযান দেয়; নাকি ফজর হওয়ার পরে আযান দেয় তাহলে উত্তম হচ্ছে ও সতর্কতা হচ্ছে- আযান শুনার সাথে সাথে পানাহার ও অন্যান্য রোযা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত হওয়া। আর যদি আযান চলাকালেও সে কোন কিছু পানাহার করে তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ ফজর উদিত হওয়ার ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়নি। এ কথা সুবিদিত যে, যে ব্যক্তি শহরের ভেতরে বসবাস করে যেখানে বৈদ্যুতিক বাতি রয়েছে সেখানে নিজ চোখে দেখে ফজর উদিত হওয়া অবহিত হওয়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু, তার উচিত আমলের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা; আযানের মাধ্যমে ও ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে; যে সব ক্যালেন্ডারে ঘণ্টা ও মিনিটের মাধ্যমে ফজর উদিত হওয়ার সময় নির্ধারণ করা থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীর উপর আমল করে: “যাতে তোমার সন্দেহ নেই সেটা গ্রহণ করে যাতে তোমার সন্দেহ আছে সেটা বর্জন কর।” এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি সংশয়মূলক বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকে সে ব্যক্তি তার দ্বীনদারি ও সম্ভ্রম রক্ষা করে।” আল্লাহ্ই উত্তম তাওফিকদাতা।(‘ফাতাওয়া রমাদান’ থেকে সংকলিত; সংকলক: আশরাফ আব্দুল মাকছুদ, পৃষ্ঠা-২০১)
পরিশেষে, সন্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, যদি আপনার এলাকার মুয়াজ্জিন ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর আযান দেয়, তাহলে আযানের প্রথম তাকবীর শোনার সাথে সাথে আপনাকে সিয়াম ভঙ্গকারী যাবতীয় বিষয় থেকে
বিরত হয়ে যেতে হবে। আর যদি আপনি জেনে থাকেন যে, মুয়াজ্জিন ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই আযান দেয় অথবা এব্যাপারে আপনি সন্দিহান থাকেন যে, তিনি কি সুবহে সাদিক হওয়ার আগে আযান দেন, নাকি পরে আযান দেন- সেক্ষেত্রে আপনি ব্যক্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত খেতে পারে। কারণ আল্লাহ তা’আলা ফজর পরিস্ফুট হওয়া পর্যন্ত খাওয়া, পান করা ও সহবাস করা বৈধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন فَالْآَنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ) “অতএব এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা (সন্তান) লিখে রেখেছেন তা কামনা করতে পার। আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ কালো সুতা (রাতের কালো রেখা) হতে ঊষার সাদা সুতা (সাদা রেখা) স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।” [সূরা বাকারাহ, ২: ১৮৭] তবে,উত্তম হচ্ছে সতর্কতাস্বরূপ আযান শুনার সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত থাকা শুরু করা।
আপনাদের দ্বীনি ভাই
জুয়েল মাহমুদ সালাফি
জুয়েল মাহমুদ সালাফি