• আসসালামু আলাইকুম, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের ফোরামে মেজর কিছু চেঞ্জ আসবে যার ফলে ফোরামে ১-৩ দিন মেইনটেনেন্স মুডে থাকবে। উক্ত সময়ে আপনাদের সকলকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানাচ্ছি।
‼️ পোস্টটি সুন্দরভাবে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।‼️

প্রবন্ধ মুনাফিকী

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,566
Credits
2,602
ভূমিকা :

সকল প্রশংসা সমগ্র সৃষ্টির মালিক মহান আল্লাহর। অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর।

মুনাফিকী একটি মারাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধি মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মানুষের মনকে কলুষিত করার যত রকম ব্যাধি আছে তন্মধ্যে মুনাফিকী অন্যতম বড় ব্যাধি। মানুষ স্বেচ্ছায় মুনাফিক হয়ে যায় না, বরং তার অজান্তেই এ ব্যাধিতে সে আক্রান্ত হয়। বিশেষতঃ আমলী (কর্মগত) নিফাকের বেলায় একথা খুবই প্রযোজ্য। এর মানে এই নয় যে, মানুষ এর মুকাবিলা না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এবং নিজেকে এত্থেকে রক্ষা না করে যে এ বিষয়টাকে হেয় জ্ঞান করে তার ভুল ধরবে। কেননা মুনাফিকী মানুষের সব সৎ ও ভাল গুণ ছিনিয়ে নেয়। তাকে সৎ আমল সমূহ থেকে বঞ্চিত করে এবং উন্নত মূল্যবোধগুলো তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। এক পর্যায়ে তাকে সমাজে পরিত্যক্ত পরাভূত মানুষে পরিণত করে। এজন্যই কুরআন মাজীদের একাধিক সূরায় মুনাফিকদের স্বরূপ উন্মোচিত করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্রন্থে আমরা মুনাফিকীর পরিচয়, প্রকারভেদ, মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য এবং তা থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে আলোচনা করব। এই গ্রন্থ প্রস্ত্তত ও প্রকাশের প্রতিটি স্তরে যারা যারা অংশ নিয়েছেন, আমি তাদের প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা জানাই। আর আল্লাহ যেন অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ করেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর।

মুনাফিকীর পরিচয়

আভিধানিক অর্থে :


আরবী ভাষায় ن (নূন), ف (ফা) ও ق (ক্বাফ) বর্ণ তিনটি দ্বারা গঠিত শব্দের দু’টি উচ্চারণ রয়েছে- نَفَقَ ও نَفِقَ তন্মধ্যে একটির অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, বিদূরিত হওয়া এবং অন্যটির অর্থ কোন জিনিস গোপন করা, উপেক্ষা করা। শব্দটি اَلنَّفَقُ থেকে নির্গত। এ শব্দটির অর্থ মাটির মধ্যস্থিত গর্ত বা সুড়ঙ্গ, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা যায়। মুনাফিককে এজন্য মুনাফিক বলা হয়েছে যে, মুনাফিক তার কুফরী বিশ্বাসকে মনের মাঝে লুকিয়ে রাখে।[1] যদিও মুনাফিকীর বিষয়টি আরবী ভাষায় সুবিদিত। তবুও আরবরা শব্দটিকে কোন বিশেষ অর্থে নির্দিষ্ট করেনি।

শরী‘আতের পরিভাষায় মুনাফিকী :

ভালকে প্রকাশ করা এবং মন্দকে গোপন রাখার নাম মুনাফিকী। ইবনু জুরাইজ বলেছেন, মুনাফিক সেই যার কথা তার কাজের, গোপনীয়তা প্রকাশ্যতার, ভেতর বাহিরের এবং বাহ্যিকতা অদৃশ্যমানতার বিপরীত।[2]

মুনাফিকীর প্রকারভেদ :

মুনাফিকী বড় ও ছোট এই দু’ভাগে বিভক্ত। ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, ‘কুফরের মতই মুনাফিকীর স্তর ভেদ আছে। এজন্য অনেক সময় বলা হয়, এমন কুফর যা ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং এমন কুফর যা ইসলাম থেকে বের করে না। অনুরূপ বড় মুনাফিকী (نفاق أكبر) ও ছোট মুনাফিকী (نفاق أصغر)।[3]

১. বিশ্বাসগত মুনাফিকী (বড় মুনাফিকী) : যে মুনাফিক বাইরে নিজের ঈমান ও ইসলাম যাহির করে কিন্তু নিজের মনের মাঝে কুফরী লালন করে, সে আক্বীদাগত মুনাফিক। এ ধরনের মুনাফিক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে ছিল। এদেরই নিন্দায় কুরআন নাযিল হয়েছে এবং এদেরকে কুরআন কাফির বলেও ঘোষণা দিয়েছে। কুরআনের বার্তা অনুযায়ী এরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে বসবাস করবে। ইবনু রজব বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতা মন্ডলী, তাঁর গ্রন্থাবলী, তাঁর রাসূলগণ ও পরকালের প্রতি ঈমানের কথা যে মুখে প্রকাশ করে কিন্তু এর সবগুলো কিংবা অংশবিশেষকে অন্তরে অবিশ্বাস করে সে বড় মুনাফিক।[4] ফকীহ বা মুসলিম আইনজ্ঞরা কখনো কখনো মুনাফিক এর স্থলে ‘যিনদীক’ শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘এক শ্রেণীর যিনদীক আছে যারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম ও রাসূলগণের অনুসরণের কথা প্রকাশ করে এবং মনের মাঝে কুফর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে শত্রুতা লুকিয়ে রাখে। এরাই মূলতঃ মুনাফিক এবং এদেরই আবাসস্থল হবে জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে’।[5]

২. আমল বা কর্মগত মুনাফিকী (ছোট মুনাফিকী) :

ধর্মীয় কাজগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়মমাফিক পালন না করা, তবে জনসমক্ষে সেগুলো যথাযথ পালন করার নাম আমল বা কর্মগত মুনাফিকী। এক্ষেত্রে কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমান ও অন্যান্য আক্বীদা-বিশ্বাসে কোন ঘাটতি থাকবে না। ইবনু রজব বলেছেন, ছোট মুনাফিকী হ’ল আমলে মুনাফিকী। যখন মানুষ প্রকাশ্যে নেক আমল করে কিন্তু অপ্রকাশ্যে তার উল্টো কাজ করে তখন তা ছোট মুনাফিকী বলে গণ্য হয়।[6]

আমলকেন্দ্রিক এই ছোট মুনাফিকী মূল ঈমান বিদ্যমান থাকা অবস্থায়ও মুসলিমের মনে বাসা বাধতে পারে। যদিও সেটা কবীরা বা বড় গুনাহ। কিন্তু বড় মুনাফিকী সর্বতোভাবে ঈমানের পরিপন্থী। তা কোনভাবেই একজন মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে যুক্ত হ’তে পারে না। তবে ছোট মুনাফিকী যখন অন্তরে শিকড় গেড়ে বসে এবং পূর্ণতা লাভ করে, তখন সময় বিশেষে তা ঐ মুনাফিককে বড় মুনাফিকীর দিকে ধাবিত করে এবং দ্বীন থেকে একেবারে খারিজ করে দেয়।

আমলগত মুনাফিক জাহান্নামের চিরস্থায়ী অধিবাসী হবে না। সে বরং অন্য সকল কবীরা গুনাহগারদের কাতারভুক্ত। আল্লাহ চাইলে ক্ষমা করে তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন, আর চাইলে তার পাপের কারণে শাস্তি দিয়ে পরিশেষে জান্নাতের অধিবাসী করবেন।

মৌলিক ও অমৌলিক মুনাফিকী :

যে লোক আদি থেকেই কোনদিন সহীহ-শুদ্ধ, খাঁটি ইসলামে বিশ্বাসী নয় মূলতঃ সেই মূল থেকে মুনাফিক। জাগতিক কোন স্বার্থের টানে এমন লোকেরা ইসলামের সঙ্গে সম্বন্ধ যাহির করে বটে, অথচ তারা মন থেকে ইসলামকে বিশ্বাস করে না। ফলে তারা তাদের ইসলাম ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই মুনাফিক। তারপর সেই মুনাফিকীর উপর তারা চলছেই। এটা মৌলিক মুনাফিকী। আবার কিছু লোক আছে যারা সত্যসত্যই অন্তর থেকে ইসলামের ঘোষণা দেয়। তারপর এক সময় তাদের মনে সন্দেহ ও শঠতা জাগে। অতঃপর বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন করে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঈমানের সত্যতার পরীক্ষা নেন। তখন তারা ইসলামের দাবী রক্ষা করতে না পেরে ভেতর থেকে ইসলাম ছেড়ে দেয় বা মুরতাদ হয়ে যায়। কিন্তু প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলে তাদের উপর মুরতাদের বিধান কার্যকর হ’তে পারে কিংবা মুসলিম নাম বহাল থাকায় জাগতিক যেসব সুযোগ-সুবিধা সে পাচ্ছে তা খোয়াতে হবে, অথবা তাকে নিন্দা শুনতে হবে এবং সমাজে তার যে অবস্থান আছে তা সে হারিয়ে বসবে। এরকম আরো অনেক উপভোগ্য ও লোভনীয় বিষয়ের কথা চিন্তা করে তারা প্রকাশ্যে ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিতে ভয় পায়। ফলে তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামের উপর চলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কাফির মুরতাদ হয়ে গেছে। এটাই অমৌলিক মুনাফিকী।

মুনাফিক হয়ে পড়ার ভয় :

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও তাঁদের পরবর্তী আমলের নেককার লোকেরা মুনাফিকীকে প্রচন্ড ভয় করতেন। এমনকি আবুদ্দারদা (রাঃ) সালাতে তাশাহহুদ শেষে মুনাফিকী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বেশী বেশী করে আল্লাহ পাকের আশ্রয় চাইতেন। একবার তো এক ব্যক্তি তাঁকে বলেই বসল, হে আবুদ্দারদা! মুনাফিকী নিয়ে আপনি এত বিচলিত বোধ করেন কেন? তিনি উত্তরে বললেন,

دعنا عنك والله إن الرجل ليقلب عن دينه في الساعة الواحدة فيخلع منه.​

অর্থাৎ আমাদের কথা ছাড়। আল্লাহর কসম! মানুষ এক মুহূর্তে তার দ্বীন বদলে ফেলতে পারে! তখন তার নিকট থেকে দ্বীন ছিনিয়ে নেয়া হয়।[7]

হানযালা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবুবকর (রাঃ) আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, হানযালা কেমন আছ? আমি বললাম, হানযালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে (نَافَقَ حَنْظَلَةُ)। তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! আরে তুমি বলছ কি? আমি বললাম, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট থাকি আর তিনি আমাদের সামনে জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন তখন তো মনে হয় আমরা যেন সেগুলো চোখে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট থেকে চলে আসি আর স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি এবং পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়ি, তখন আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমারও তো এমন অবস্থা হয়। তখন আবুবকর (রাঃ) ও আমি রওয়ানা হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট হাযির হ’লাম। আমি তাকে বললাম, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সেটা কীভাবে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা যখন আপনার কাছে থাকি এবং আপনি আমাদের নিকট জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন তখন তো মনে হয় আমরা ওগুলো স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। অথচ যখন আপনার নিকট থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়ি তখন তার অনেক কিছুই ভুলে যাই।

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ إِنْ لَوْ تَدُومُونَ عَلَى مَا تَكُونُونَ عِنْدِى وَفِى الذِّكْرِ لَصَافَحَتْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ عَلَى فُرُشِكُمْ وَفِى طُرُقِكُمْ وَلَكِنْ يَا حَنْظَلَةُ سَاعَةً وَسَاعَةً.​

‘যার হাতে আমার জীবন তার শপথ! তোমরা যদি আমার নিকট থাকাকালীন অবস্থায় এবং সর্বদা যিকিররত থাকতে পারতে, তাহ’লে তোমাদের ঘরে-বাইরে ফেরেশতারা তোমাদের সাথে মুছাফাহা (করমর্দন) করত। কিন্তু হে হানযালা! সময় সময় অবস্থার হেরফের ঘটে’।[8]

‘হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে’ (نافق حنظلة) কথাটির অর্থ তাঁর এ শঙ্কা মনে জাগছে যে, তিনি মুনাফিক। কারণ তিনি যখন নবী করীম (ﷺ)-এর মাহফিলে থাকেন তখন তাঁর মনে এক প্রকার ভয় কাজ করে। এর প্রভাব স্বরূপ আখিরাতের প্রতি তাঁর ধ্যান-ধারণা ও মনোনিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়ার পর স্ত্রী, সন্তান ও জীবন-জীবিকার মাঝে মশগূল হয়ে পড়লে তাঁর এ ভাবনা অনেকাংশে লঘু হয়ে পড়ে। তাই তাঁর চিন্তা হয়- তিনি মুনাফিক হয়ে গেছেন বলেই এমন হয় কি-না। কিন্তু মুনাফিকী তো মূলত দুরভিসন্ধি মনের মাঝে গোপন রেখে তার উল্টোটা প্রকাশ করা। তাই নবী করীম (ﷺ) তাঁদের জানিয়ে দিলেন, এরূপ অবস্থা তৈরী হওয়া কোন মুনাফিকী নয় এবং নবী করীম (ﷺ)-এর মাহফিলে থাকাকালীন মানসিক অবস্থায় সর্বক্ষণ বিরাজিত থাকার জন্যও তারা বাধ্য নন। ‘সময় সময়’ অর্থ এক সময়ে অবস্থা উন্নত হ’তে পারে এবং অন্য সময়ে তার অবনতি ঘটতে পারে অর্থাৎ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে।[9]

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি জানাযায় হাযির হওয়ার জন্য ওমর (রাঃ)-কে ডাকা হয়। তিনি তাতে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আমি তখন তাঁকে অাঁকড়ে ধরে বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন!! আপনি বসুন। কেননা এই মৃত লোকটা ওদের অর্থাৎ মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত। আমার কথা শুনে ওমর (রাঃ) বললেন, তোমাকে আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কি তাদের একজন? আমি বললাম, না। অবশ্য আপনার জীবনাবসানের পর আমি আর কাউকে নির্দোষ আখ্যায়িত করব না।[10]

ইবনু আবী মুলাইকা বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-এর ত্রিশজন সাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছি যাঁদের প্রত্যেকেই নিজের মাঝে মুনাফিকী থাকার ভয় করতেন। তাঁরা কেউই বলতেন না, আমার ঈমান জিবরীল ও মিকাঈলের তুল্য।[11]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম! এই সাহাবীদের অন্তর ঈমান ও ইয়াকীনে একদম পরিপূর্ণ ছিল। অথচ তাঁরা কঠিনভাবে মুনাফিকীর ভয় করতেন। মুনাফিকী নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। কিন্তু তাঁদের পরবর্তীকালে এসে অনেককে দেখুন, ঈমান তাদের কণ্ঠদেশও অতিক্রম করেনি অথচ তাদের ঈমান জিবরীল মিকাইলের সমতুল্য বলে তারা দাবী করে।[12]

সাহাবীগণ তাঁদের মুনাফিকী দ্বারা ঈমানের পরিপন্থী যে মুনাফিকী তাকে বুঝাননি। বরং মূল ঈমানের সঙ্গে যে মুনাফিকী যুক্ত হয় তাই বুঝিয়েছেন।[13]

কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত মুনাফিকদের স্বভাব-চরিত্র :

কুরআন ও সুন্নাহর নানা স্থানে মুনাফিকদের প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে মুনাফিকদের স্বভাব-চরিত্র বা দোষ-ত্রুটি তুলে ধরা হয়েছে এবং মুমিনদের সে সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। এমনকি মুনাফিকদের নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা স্বতন্ত্র একটি সূরাই (সূরা মুনাফিকূন) নাযিল করেছেন। নিম্নে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হ’ল।

১. ব্যাধিগ্রস্ত মন : আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-

فِيْ قُلُوْبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللهُ مَرَضاً وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ بِمَا كَانُوْا يَكْذِبُوْنَ​

‘এদের (মুনাফিকদের) মনের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক ব্যাধি। অতঃপর (প্রতারণার কারণে) আল্লাহ তা‘আলা এদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মিথ্যাবাদিতার কারণে তাদের জন্য রয়েছে পীড়াদায়ক শাস্তি’ (বাক্বারাহ ২/১০)

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর খেয়াল-খুশির ব্যাধিগুলো তাদের মনে জেঁকে বসায় তা নষ্ট হয়ে গেছে। আর ভাল ইচ্ছেগুলোর উপর মন্দ ইচ্ছেগুলো জয়যুক্ত হওয়ায় তাদের মন-মানসিকতা কলুষিত হয়ে গেছে। আর তাদের এহেন নষ্ট অবস্থা তাদেরকে ধ্বংসের কিনারে নিক্ষেপ করেছে। ফলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাও এখন তাদের অন্তরের ব্যাধির চিকিৎসা করতে সক্ষম হচ্ছেন না। সেজন্যই আল্লাহ বলেছেন, তাদের মন ব্যাধিগ্রস্ত। ফলে আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন’।[14]

২. খেয়াল-খুশির প্রলোভন :

আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,

إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهِ مَرَضٌ​

‘আল্লাহকে ভয় করলে তোমরা অন্য পুরুষের সাথে কথা বলার সময় নম্র আওয়াযে কথা বলো না। এমন করলে যাদের মনে ব্যাধি আছে তারা তোমাদের প্রতি প্রলুব্ধ হবে’ (আহযাব ৩৩/৩২)। যাদের ঈমান দুর্বল তারা নারীদের (কোমল কথা শ্রবণ করে) প্রতি প্রলুব্ধ ও আকৃষ্ট হয়। তাদের ঈমানী দুর্বলতা ইসলামের প্রতি সন্দেহবশতঃ হ’লে তো তারা মুনাফিক। আর এজন্যই মুনাফিকরা আল্লাহর বিধি-বিধানকে লঘু মনে করে। আবার অশ্লীল কাজের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানোর জন্যও তাদের ঈমান দুর্বল হ’তে পারে।[15]

৩. অহংকার প্রদর্শন :

মুনাফিকরা অহংকারী হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا يَسْتَغْفِرْ لَكُمْ رَسُوْلُ اللهِ لَوَّوْا رُؤُوْسَهُمْ وَرَأَيْتَهُمْ يَصُدُّوْنَ وَهُم مُّسْتَكْبِرُوْنَ​

‘এদের (মুনাফিকদের) যখন বলা হয় তোমরা (আল্লাহর রাসূলের কাছে) এসো তাহ’লে আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন এরা অবজ্ঞাভরে মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং তুমি (এও) দেখতে পাবে, তারা অহংকারের সাথে তোমাকে এড়িয়ে চলে’ (মুনাফিকূন ৬৩/৫)

মুনাফিকদের উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক। তাদেরকে যখন ডেকে বলা হয়, তোমরা আল্লাহর রাসূলের নিকট এসো। তিনি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন অহংকারবশতঃ তারা সে কথা মোটেও গ্রাহ্য করে না বরং সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে মাথা দুলিয়ে চলে যায়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেছেন, অহংকার বশে ওদের তুমি মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবে। পরে আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতিফল কী দাঁড়াবে তা উল্লেখ করে বলেছেন,

سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَن يَغْفِرَ اللهُ لَهُمْ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ​

‘(আসলে) তুমি এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর কিংবা না কর উভয়ই তাদের জন্য সমান। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কখনই তাদের ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা কোন ফাসিক জাতিকে হেদায়াত দান করেন না’ (মুনাফিকূন ৬৩/০৬)।[16]

৪. আল্লাহর আয়াত সমূহের সাথে ঠাট্টা-তামাশা :

মুনাফিকরা আল্লাহর আয়াত তথা কথা ও বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে। তাদের এ আচরণের জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوْا إِنَّ اللهَ مُخْرِجٌ مَّا تَحْذَرُوْنَ​

‘মুনাফিকরা (সদাই) এ আশংকায় থাকে যে, তাদের বিপক্ষে এমন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় কি-না যাতে তাদের মনের কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। তুমি বল, তোমরা ঠাট্টা-মশকরা করতে থাক। তোমরা যার ভয় করছ, আল্লাহ তা ঠিকই প্রকাশ করে দিবেন’ (তওবা ৯/৬৪)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগের মুনাফিকদের মনে সব সময় এই আশঙ্কা বিরাজ করত যে, কুরআনের কোন সূরা নাযিল হয়ে মুমিনদের নিকট তাদের মনের সকল দূরভিসন্ধি ও জারিজুরি ফাঁস করে দেয় কি-না? কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের উপর এ আয়াত নাযিলের কারণ হ’ল, মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দোষারোপ করত এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও মুসলমানদের কাজের সমালোচনা করত। যখন তারা এসব করত তখন বলত, দেখ, আল্লাহ আবার আমাদের গোপন কথা তাঁর নবীর নিকট ফাঁস করে দেন কি-না? ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বললেন, ওদের তুমি ধমকের সুরে ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে বল, ঠিক আছে তোমরা ঠাট্টা-মশকরা চালিয়ে যাও। তোমরা যার ভয় করছ, আল্লাহ তা ঠিকই প্রকাশ করে দিবেন।[17]

৫. মুমিনদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা :

আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا لَقُواْ الَّذِيْنَ آمَنُواْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِيْنِهِمْ قَالُواْ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ، اللهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ-​

‘তারা (মুনাফিকরা) যখন ঈমানদারদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি, আবার যখন তাদের দুষ্ট নেতাদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো অবশ্যই তোমাদের সাথে আছি। (ঈমানের কথা বলে তাদের সাথে) আমরা কেবলই ঠাট্টা করি। (মূলতঃ) আল্লাহ তাদের সাথে ঠাট্টা করেন এবং সীমালংঘনজনিত কাজে যাতে তারা উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেজন্য তাদের অবকাশ দিয়ে রাখেন’ (বাক্বারাহ ২/১৪-১৫)

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, মুনাফিকরা প্রত্যেকেই দ্বিমুখী আচরণকারী। এক মুখে তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়। অন্য মুখে ভোল পাল্টিয়ে তারা তাদের কাফির ভাইদের সাথে মিলিত হয়। তাদের জিহবাও দু’টো। এক জিহবা দিয়ে তারা মুসলমানদের সাথে উপর উপর কথা বলে, আর অন্য জিহবা তাদের গোপন অবস্থার ভাষ্যকার।

কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারীদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামশা করা এবং তাদের তুচ্ছ ভাবা ওদের স্বভাব। এ কারণে তারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের যে বিদ্যা-বুদ্ধি আছে, তা কেবলই তাদের ঔদ্ধত্য ও অহংকার বাড়িয়ে তোলে। বিনয়-নম্রতা কী তা তারা বোঝে না? ফলে অহংকার হেতু তারা অহি-র বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। ফলে প্রিয় পাঠক! আপনি মুনাফিকদের দেখবেন, তারা অহি-র খোলামেলা সহজবোধ্য বিষয়ের সাথেও ঠাট্টা-তামাশা করতেই থাকে। তাইতো আল্লাহ তাদের সাথে ঠাট্টা করেন এবং সীমালংঘনজনিত কাজে যাতে তারা উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেজন্য তাদের অবকাশ দেন।[18]

৬. মানুষকে আল্লাহর পথের পথিকদের জন্য ব্যয়ে বাধা দান:

তাদের এরূপ অভ্যাস সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,

هُمُ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ لاَ تُنْفِقُوْا عَلَى مَنْ عِندَ رَسُوْلِ اللهِ حَتَّى يَنْفَضُّوْا وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَا يَفْقَهُوْنَ-​

‘এই মুনাফিকরা তো সেসব লোক, যারা (আনছারদের) বলে, আল্লাহর রাসূলের (মুহাজির) সাথীদের জন্য তোমরা কোন রকম অর্থ ব্যয় করো না। (তাহ’লে আর্থিক সংকটের কারণে) তারা রাসূলের কাছ থেকে সরে পড়বে। অথচ আসমান ও যমীনের ধনভান্ডার সমূহ তো আল্লাহর। আসলে মুনাফিকরা কিছুই বুঝতে চায় না’ (মুনাফিকূন ৬৩/৭)

যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি এক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সে যুদ্ধে আমি আব্দুল্লাহ বিন উবাই (মুনাফিকদের নেতা)-কে বলতে শুনলাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটস্থ মক্কার মুহাজিরদের জন্য তোমরা মদীনাবাসীরা কিছুই খরচ করো না। দেখবে, অর্থকষ্টে পড়ে তারা তাঁর নিকট থেকে সরে পড়বে। মদীনায় ফিরে যেতে পারলে অবশ্যই আমরা সম্মানী লোকেরা সেখানে অবস্থিত ছোট লোকদের (অর্থাৎ মুহাজিরদের) বের করে দেব। আমি এ কথা আমার চাচা অথবা ওমর (রাঃ)-কে বললাম। তিনি কথাটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জানালেন। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালে আমি তাঁকে সব বললাম। তিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাথীদের ডাকিয়ে আনলেন। তারা শপথ করে বলল, এমন কথা তারা বলেইনি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন আমাকে মিথ্যুক এবং আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে সত্যবাদী ভাবলেন। ফলে আমি যার পর নেই ব্যথিত হ’লাম। মনোকষ্টে আমি ঘরে বসে থাকলাম। এ অবস্থা দেখে আমার চাচা আমাকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমাকে মিথ্যুক মনে করেছেন এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে কি তুমি মনে করলে? তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন, إِذَا جَاءكَ الْمُنَافِقُونَ ‘যখন মুনাফিকরা তোমার নিকট আসে...। এ সূরা নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার নিকট লোক পাঠান। তিনি সূরা পড়ে শুনান এবং বলেন, إِنَّ اللهَ قَدْ صَدَّقَكَ يَا زَيْدُ ‘হে যায়েদ! আল্লাহ তোমাকে সত্যবাদী আখ্যা দিয়েছেন’।[19]

৭. মুমিনদের মূর্খ আখ্যা দেওয়া :

আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُواْ أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ أَلا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَـكِنْ لاَّ يَعْلَمُوْنَ​

‘যখন তাদের (মুনাফিকদের) বলা হয়, লোকেরা যেমন ঈমান এনেছে তোমরাও তেমন ঈমান আনো, তখন তারা বলে, ঐ নির্বোধরা যেমন ঈমান এনেছে আমাদেরও কি তেমন ঈমান আনতে হবে? সাবধান! ওরাই আসলে নির্বোধ। কিন্তু ওরা তা অনুধাবন করতে পারে না’ (বাক্বারাহ ২/১৩)

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘মুনাফিকরা কুরআন ও সুন্নাহর ধারক-বাহকদের প্রান্তিক ও ব্রাত্যজন হিসাবে মনে করে। তাদের ধারণায় এদের বোধ-বুদ্ধি খুবই অল্প। তাদের মতে কুরআন-হাদীসের বাণী বাহকরা সেই গাধাতুল্য যে তার পিঠে বইয়ের বোঝা বহন করে। গাধার চিন্তা থাকে কেবল বোঝা বহন করা। তাই বইয়ের বোঝা বইলেও তো আর গাধাটাকে শিক্ষিত বলা যায় না। অহি-র বেসাতিকারীর পণ্য (অর্থাৎ ইসলামী বিধানের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় জীবনপাতকারীর চেষ্টা) মুনাফিকদের দৃষ্টিতে মন্দা ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের কাছে এ পণ্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা মনে করে ইসলামের অনুসারীরা নির্বোধ। ফলে তারা নিজেরা যখন একান্তে মিলিত হয় তখন মুসলমানদের নষ্ট ও অপয়া হিসাবে তুলে ধরতে তৎপরতা দেখায়’।[20]

৮. কাফেরদের সাথে সম্প্রীতি রাখা :

মুনাফিকদের সখ্যতা ও সম্প্রীতি মুমিনদের সাথে নয় বরং কাফেরদের সাথে লক্ষ্য করা যায়। কাফেরদের সাথে তাদের এই দহরম মহরমের জন্য আল্লাহ বলেছেন,

بَشِّرِ الْمُنَافِقِيْنَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَاباً أَلِيْماً، الَّذِيْنَ يَتَّخِذُوْنَ الْكَافِرِيْنَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِيْنَ أَيَبْتَغُوْنَ عِندَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ العِزَّةَ لِلّهِ جَمِيْعاً-​

‘হে নবী! তুমি মুনাফিকদের এই সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক ভয়াবহ আযাব রয়েছে, যারা (দুনিয়ার ফায়েদার জন্য) ঈমানদারদের বদলে কাফেরদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। তারা কি এর দ্বারা এদের কাছ থেকে কোন সম্মান লাভের প্রত্যাশা করে? অথচ যাবতয়ি সম্মান আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট’ (নিসা ৪/১৩৮-৩৯)

এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, হে রাসূল! যারা আমার সাথে কুফরী করে এবং আমার দ্বীনের মধ্যে বিরোধিতার পথ বের করে তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে মুমিনদের বাদ দিয়ে তারা মুনাফিক। এই মুনাফিকদের তুমি কঠিন শাস্তি লাভের সুসংবাদ দাও। তারা কি আমার প্রতি যারা ঈমান রাখে তাদের বাদ দিয়ে কাফেরদের বন্ধু ও সহযোগিতাকারী রূপে গ্রহণ করার মাধ্যমে তাদের কাছে শক্তি ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে? কিন্তু সম্মান, শক্তি, সহযোগিতা সবই তো আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত। অতএব তারা কেন মুমিনদের বন্ধু ও সহযোগিতাকারী রূপে গ্রহণ করে না? তা করলে তারা আল্লাহর কাছে সম্মান, প্রতিরোধ ও সহযোগিতার আবেদন করতে পারত। যার কাছেই মূলতঃ সব শক্তি ও দাপট জমা রয়েছে। তিনি যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন। এভাবে ঐ মুনাফিকরাও তখন সম্মান ও শক্তির মালিক হ’ত।[21]

৯. মুমিনদের ব্যাপারে প্রতীক্ষা :

[মুনাফিকরা মুসলমানদের ভাল-মন্দের প্রতীক্ষা করে। ভাল কিছু হ’লে বলে, আমরা তো তোমাদেরই লোক। এ কাজে আমাদেরও অংশ আছে। আর খারাপ কিছু হ’লে কাফেরদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সুবিধা আদায় করে।-অনুবাদক]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَّذِيْنَ يَتَرَبَّصُوْنَ بِكُمْ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِّنَ اللهِ قَالُواْ أَلَمْ نَكُنْ مَّعَكُمْ وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِيْنَ نَصِيْبٌ قَالُواْ أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ فَاللهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَنْ يَجْعَلَ اللهُ لِلْكَافِرِيْنَ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ سَبِيْلاً​

‘যারা (মুনাফিকরা) তোমাদের অকল্যাণের প্রতীক্ষায় থাকে। যদি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তোমাদের বিজয় আসে তখন এরা বলে, আমরা কি (এ যুদ্ধে) তোমাদের সাথে ছিলাম না? আর যদি কাফেরদের ভাগে বিজয়ের অংশ লেখা হয় তখন এরা বলে, আমরা কি তোমাদেরকে (গোপনে) সহায়তা করিনি এবং তোমাদেরকে মুসলমানদের কাছ থেকে রক্ষা করিনি? এমতাবস্থায় কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ফায়ছালা শুনিয়ে দেবেন এবং সেদিন আল্লাহ মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের কোন অজুহাত পেশ করার কোন পথই খোলা রাখবেন না’ (নিসা ৪/১৪১)। বস্ত্তত মুনাফিকরা মুমিনদের বেলায় অপেক্ষায় থাকে। যদি কোন যুদ্ধে মুসলমানদেরকে আল্লাহ তা‘আলা তাদের শত্রুপক্ষের উপর বিজয় দান করেন এবং তাতে গণীমতের সম্পদ অর্জিত হয় তখন তারা মুমিনদের নিকট এসে বলে, আমরা কি তোমাদের সাথে থেকে তোমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করিনি? তোমাদের সঙ্গে থেকে লড়াই করিনি? যেহেতু আমরা তোমাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি সেহেতু তোমরা গণীমতের একটা অংশ আমাদের দাও। আর যদি মুসলমানদের শত্রুপক্ষ কাফের বাহিনী মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়, তখন মুনাফিকরা কাফেরদের নিকট গিয়ে বলে, আমরা কি তোমাদের বিজয়ের পথ করে দেইনি? সেজন্যই তো তোমরা মুমিনদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছ। আমরা তোমাদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। ফলে তারা অপদস্থ হয়ে যুদ্ধ বিরতি দিয়েছিল, আর সেই ফাঁকে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছ। এখন এরূপ করলেও কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা ঠিকই মুমিন ও মুনাফিকদের মাঝে ঠিক ঠিক বিচার করবেন। চূড়ান্ত বিচারে তিনি মুমিনদের জান্নাতে দাখিল করবেন আর মুনাফিকদেরকে তাদের বন্ধু কাফেরদের সাথে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।[22]


[1]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১০/৩৫৭; ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৫/৪৫৫।
** [বাংলা ভাষায় ‘মুনাফিক’ শব্দটির অর্থ কপট, ভন্ড, দ্বিমুখী নীতি বিশিষ্ট, শঠ, প্রবঞ্চক, সত্য গোপনকারী ইত্যাদি এবং মুনাফিকী অর্থ প্রতারণা, শঠতা, কপটাচার, ভন্ডামি ইত্যাদি (বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃঃ ৯৯২)।-অনুবাদক]
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ১/১৭৬।
[3]. ইবনু তাইমিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া ৭/৫২৪।
[4]. ইবনু রজব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৪৩১।
[5]. ইবনুল কাইয়িম, তরীকুল হিজরাতায়ন, পৃঃ ৫৯৫।
[6]. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৪৩১।
[7]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/৩৮২, যাহাবী বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।
[8]. মুসলিম হা/২৭৫০।
[9]. নববী, শারহু মুসলিম ১৭/৬৬-৬৭।
[10]. ইবনু আবী শায়বা ৮/৬৩৭; আল-হায়ছামী মাজমাউয যাওয়ায়েদ (৩/৪২ পৃষ্ঠায়) বলেছেন, সনদের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ (رجاله ثقات)। শু‘আইব আরনাউত একে সহীহ বলেছেন। দ্রঃ মুসনাদ আহমাদ হা/২৬৬৬৩, ৬/৩০৭।
[11]. বুখারী ১/২৬।
[12]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৫৮।
[13]. ইমাম গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/১৭২।
[14]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৪৯।
[15]. ইবনু জারীর ত্বাবারী, জামিউল বায়ান ২০/২৫৮।
[16]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৪/৪৭৩।
[17]. জামিউল বায়ান ১৪/৩৩১।
[18]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৫০।
[19]. বুখারী হা/৪৯০০; মুসলিম হা/২৭৭২।
[20]. ইবনুল কাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৫০।
[21]. জামিউল বায়ান ৯/৩১৯।
[22]. প্রাগুক্ত ৯/৩২৪।




মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
 
Last edited:

Share this page