হালাল - হারাম মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হারাম মাল দ্বারা উপকার গ্রহণ করা

Habib Bin TofajjalVerified member

If you're in doubt ask الله.
Forum Staff
Moderator
Generous
ilm Seeker
Uploader
Exposer
HistoryLover
Q&A Master
Salafi User
Joined
Nov 25, 2022
Threads
664
Comments
1,231
Solutions
17
Reactions
7,282
আধুনিক উন্নত অর্থনীতি ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকারে যেসব বিরাট সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার অন্যতম হলো, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া ও বৃদ্ধি পাওয়া। কখনো টাকার মূল্যমান কমে যায়। যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। এমনটি হলে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়। আর এটি অধিকাংশ সময় হয়ে থাকে। আবার কখনো এর বিপরীতে মূল্যমান বেড়ে যায়। যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়ে যায়। এমনটি হলে তাকে মুদ্রাসংকোচন বলা হয়। আর এটি খুব কমই হয়ে থাকে।

এই সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে এবং এ সমস্যা কেন্দ্রিক যে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তা নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতগণ আলোচনা করেছেন। এ সমস্যা ঘটে থাকে ইসলামী শরীআতের অর্থনীতি সংক্রান্ত একটি বিরাট নিষিদ্ধের জায়গায়―সুদে। এই সমস্যা সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো খুবই গুরুতর এবং এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ার কারণে অনেক মাসআলা নিয়ে গবেষণা করার দাবি রাখে। যেসব মাসআলা নিয়ে গবেষণার দাবি রাখে, উদাহরণসরূপ তার অন্যতম হলো: অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়ের মাসআলা, কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের মাসআলা, কোনো কিছু তৈরি ও বানিয়ে দেওয়ার চুক্তি, ভবিষ্যতের লম্বা সময়ের জন্য ভাড়া, ঋণ ইত্যাদি।

দেখা যাচ্ছে, যখন ঋণ বা বিক্রয়ের মূল্য পরিশোধের সময় হয়, তখন মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার মূল্যমান অনেক কমে গেছে। যেসময় টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল বা পণ্য বিক্রয় করা হয়েছিল, সেসময় টাকার যে মূল্যবান ও ক্রয়ক্ষমতা ছিল, ঋণ পরিশোধের সময় বা পণ্যমূল্য পরিশোধের সময় মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার মূল্যমান ও ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এভাবে ঋণদাতা ও বিক্রেতা নিজেদের কোনো ত্রুটি ছাড়াই জুলুমের ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

এ বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদে উভয়পক্ষের লেনদেনকারীর মাঝে যে ইনসাফ রক্ষার মূলনীতি ছিল, তা চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকে সঞ্চয়কারীরা সুদী মুনাফা দ্বারা উপকার গ্রহণ করার নীতি প্রস্তাব করে থাকেন। যাতে করে মুদ্রাস্ফীতির কারণে ব্যাংকে সঞ্চয়কৃত তাদের টাকা ও মাল যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া যায়।

এই সমস্যা কেন্দ্রিক উক্ত প্রস্তাবনা কি শরীআতের বিধান ও ফিকহের মূলনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? না-কি ফিকহের মূলনীতি তা নাকচ করে এবং তা সুদ ভক্ষণ ও হারামপন্থায় মাল উপার্জন হিসেবে গণ্য করে?

শরয়ী বিধান ও ফিকহী গবেষণার আলোকে এই মাসআলার জবাব সহজ করার জন্য আমাদের উচিত দুটি মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা।

প্রথম বিষয়: ব্যাংকে যে মাল সঞ্চয় করা হয়, ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে তা পাওনা না-কি আমানত?

দ্বিতীয় বিষয়: মুদ্রাস্ফীতির সময় ঋণ ও নির্দিষ্ট মেয়াদের লেনদেন আদায় করার ক্ষেত্রে ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থান।

ব্যাংকে যে মাল সঞ্চয় করা হয়, ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে তা পাওনা; তা আমানত নয়। যদি ব্যাংকে সঞ্চিত সম্পদকে ব্যাংকের জিম্মায় পাওনা হিসেবে ধরা হয়, তাহলে সঞ্চয়কারী চাহিবামাত্রই ব্যাংক তাকে তা প্রদান করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতির সময় পাওনাগ্রস্ত ব্যক্তি কি পাওনাদারকে পাওনার মূল্যমান ফেরত দিবে; যার ফলে মুদ্রাস্ফীতির কারণে পাওনাদারের যে ক্ষতি হয়েছে তা সে পুষিয়ে নিতে পারে? না-কি পাওনাগ্রস্ত ব্যক্তি যা পাওনা হিসেবে নিয়েছিল তা-ই বা তার সমপরিমাণ ফেরত দিবে; তাতে মুদ্রাস্ফীতির কারণে পাওনাদার যতই ক্ষতিগ্রস্ত হোক?

এ কারণে মুদ্রাস্ফীতির সময় ঋণ ও নির্দিষ্ট মেয়াদের লেনদেন আদায় করার ক্ষেত্রে ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করার দাবি রাখে।

মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের ফকীহদের এবং ইমাম আবূ হানীফার মত হচ্ছে, মুদ্রার মূল্য হ্রাস পেলে বা বৃদ্ধি হলে তা কারো জিম্মায় থাকা পাওনায় কোনো প্রভাব ফেলবে না; তাতে জিম্মায় থাকা পাওনা ঋণের কারণে হোক বা নির্দিষ্ট মেয়াদের ক্রয়বিক্রয় মূল্য হোক বা বাকিতে মোহর হোক বা নির্দিষ্ট মেয়াদের রক্তপণ হোক…। পাওনাগ্রস্ত ব্যক্তির জিম্মায় যতটুকু পাওনা আছে বা যতটুকু সে গ্রহণ করেছিল, ঠিক ততটুকু ফেরত দিবে; তাতে মূল্যমান হ্রাস পাক বা বৃদ্ধি পাক। পাওনার নির্দিষ্ট মেয়াদ যখন চলে আসবে তখন যত পরিমাণ ও যে গুণগতমানের ওপর চুক্তি হয়েছিল ঠিক তত পরিমাণ ও সেই গুণগতমান আদায় করবে।[1]

ইবন আবিদীন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘যদি কেউ এক-ষষ্ঠাংশ দিরহাম বা অর্ধদিরহাম ঋণ নেয় এরপর তার মূল্যমান কমে যায় বা বৃদ্ধি পায়, তাহলে যে সংখ্যা পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল, সে-সংখ্যা পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করবে।… দিরহামের মূল্যমান বৃদ্ধি বা হ্রাসের দিকে সে দেখবে না।’

‘মুদাওয়ানাহ’ গ্রন্থে রয়েছে, আমি বললাম, এক ব্যক্তি কাউকে বললো, আমাকে একদীনার সমমূল্যের দিরহাম ঋণ দেন বা অর্ধদীনার সমমূল্যের দিরহাম ঋণ দেন বা এক-তৃতীয়াংশ দীনার সমমূল্যের দিরহাম ঋণ দেন আর সে তাকে চাওয়া অনুযায়ী দিরহাম ঋণ প্রদান করলো। ইমাম মালিকের মতানুযায়ী সে কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবে? তিনি বললেন, সে যে দিরহাম পরিমাণ নিয়েছিল সেই দিরহাম পরিশোধ করবে। চার দিরহাম প্রদান করে পাঁচ দিরহাম গ্রহণ করা যাবে না। আর এমন নয় যে, যে তাকে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছে সে তাকে রৌপ্যমুদ্রা দিয়েছে। তবে যদি এমন হয়, কেউ কাউকে এক দীনার প্রদান করেছে। এরপর গ্রহীতা অর্ধদীনার খরচ করে ফেলেছে। এখন তাকে বাকি অর্ধদীনার প্রদান করতে হবে আর খরচকৃত অর্ধদীনার পরিশোধ করতে হবে; তাতে দীনের দাম বৃদ্ধি পাক বা কমে যাক।’[2]

ইমাম সুয়ুতী তাঁর ‘কতউল মুজাদালা ইনদা তাগয়ীরিল মুআমালা’ চিঠিতে বলেন, ‘স্বীকৃত বিষয় হচ্ছে, সঠিক পাওনার ক্ষেত্রে সাধারণত সমপরিমাণ ফেরত দিতে হবে। যদি কেউ কারো থেকে এক রিতল মুদ্রা ঋণ নেয়, তাহলে একই মুদ্রার এক রিতল ফেরত দেওয়া ওয়াজিব; তাতে উক্ত মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধি হোক বা হ্রাস পাক।’[3]

হাম্বলী মাযহাবের ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে রয়েছে, ‘ঋণগ্রহীতা সমতুল্য বস্তুর ক্ষেত্রে সমতুল্য বস্তু ফেরত দিবে; তাতে তার মূল্য বৃদ্ধি পাক বা হ্রাস পাক বা স্থির থাকুক।’[4]

উপরিউক্ত মতামতগুলোর আলোকে কারো দায়িত্বে থাকা মাল ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আমরা ফকীহদের একটি মূলনীতি নির্ধারণ করতে পারি। মূলনীতিটি হলো, ‘পাওনা ফেরত দিতে হবে সমপরিমাণ, তাতে তার মূল্যমান বৃদ্ধি পাক বা হ্রাস পাক।’

আমরা যদি এই মূলনীতিটি ব্যাংকে সঞ্চিত ও গচ্ছিত মালের ওপর প্রয়োগ করি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সুদী মুনাফা বিনিময়ের বিধানের দিকে লক্ষ করি, তাহলে প্রমাণ হয়, তা হারাম; জায়েয নয়। গচ্ছিত ও সঞ্চিত মাল ব্যাংকের জিম্মায় থাকে এবং ‘পাওনা আদায় করতে হয় সমপরিমাণ’, তাই সঞ্চয়কারীর জন্য জায়েয নয় যা সঞ্চয় করেছে তার অতিরিক্ত গ্রহণ করা। যদি অতিরিক্ত গ্রহণ করে, তাহলে সে সুদে জড়িত হবে।

ইসলামী ফিকহ কমিটিও জোর দিয়ে বলেছে যে, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া পুষিয়ে নিতে সুদী মুনাফা দ্বারা উপকার গ্রহণ করা জায়েয নয়। বরং ‘সুদী মুনাফা’ মুসলিম-জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা আবশ্যক। আম্মানে তৃতীয় অধিবেশনে ইসলামী ফিকহ কমিটি যে সিদ্ধান্ত প্রদান করে, তা হলো: ‘মুদ্রাবাজার অস্থিরতার কারণে যে প্রভাব পড়ে সে সময় ইসলামী ব্যাংকের জন্য হারাম সঞ্চিত অর্থ থেকে লব্ধ মুনাফার মাধ্যমে তারা তাদের অর্থের প্রকৃত মূল্যমান ধরে রাখবে। এ কারণে সেসব মুনাফা বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে দেওয়া আবশ্যক, যেমন প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, গবেষণা কাজে ব্যয় করা, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা, সদস্য দেশগুলোকে সাহায্য করা, সেসব দেশে টেকনিক্যাল সহযোগিতা করা; একইভাবে শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা ও ইসলামী জ্ঞানপ্রচারকারী শিক্ষালয়কে সহযোগিতা করা।


বই: হারাম সম্পদের বিধিবিধান
লেখক: ড.আব্বাস আহমাদ মুহাম্মাদ আল-বায
তত্ত্বাবধানে: ড.উমার সুলাইমান আল-আশকার
অনুবাদক: আব্দুল্লাহ মাহমুদ​


[1] ইবন আবিদীন, হাশিয়াতু রদ্দিল মুহতার, ৫/১৭২; মালিক ইবন আনাস, আল-মুদাওওয়ানাতুল কুবরা, ৩/১১৬; সুয়ুতী, আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া, ১/১২৭; ইবন কুদামা, আল-মুগনী, ৪/৩৯৬; ইবন হাজার হাইতামী, আল-ফাতাওয়াল কুবরাল ফিকহিয়া, ৫/২৮
[2] মালিক ইবন আনাস, আল-মুদাওওয়ানাতুল কুবরা, ৩/১১৬
[3] সুয়ুতী, আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া, ১/১২৭
[4] ইবন কুদামা, আল-মুগনী, ১/৩৯৬

 
Back
Top