‼️ পোস্টটি সুন্দরভাবে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।‼️

মানবরচিত সংবিধানে বিচার করা বিষয়ক আয়াতের সালাফদের থেকে প্রমাণিত সঠিক তাফসীর

বর্তমান ও পূর্বযুগের যারা বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে তাদের অন্যতম হলো খারিজীরা। বর্তমান যুগে কাউকে কাফির বলার পক্ষে যে দলীলের পাশে সবসময় মৌমাছির মতো ভনভন করা হয়, তা হলো আল্লাহ তাআলা এ বাণী:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফির।[1]

আমরা সবাই জানি যে, আয়াতটি কয়েকবার এসেছে এবং তিন শব্দে আয়াতটি শেষ করা হয়েছে।

যেমন: প্রথম শব্দ ‘কাফির’:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফির।[2]

দ্বিতীয় শব্দ ‘জালিম’:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
আর আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই জালিম।[3]

তৃতীয় শব্দ ‘ফাসিক’:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
আর আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই ফাসিক।[4]

কিন্তু তাদের অজ্ঞতার উদাহরণ হচ্ছে, তারা কেবল প্রথম শব্দ ‘কাফির’ দ্বারা দলীল গ্রহণ করে। অর্থাৎ শুধু এ আয়াত তাদের পক্ষে পেশ করে:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফির।[5]

অথচ তাদের উচিত ছিল কমপক্ষে যেসব দলীলে 'কুফর' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোকে কষ্ট করে হলেও একত্রিত করা। কিন্তু তারা এমনটি করেনি। ফলে তারা আয়াতে উল্লিখিত ‘কুফর’ শব্দটি পেয়ে আয়াতটির অর্থ করেছে যে, এ কুফর দ্বারা এমন কুফর উদ্দেশ্য যা ব্যক্তিকে দীন থেকে বের করে দেয়। ফলে তাদের মতে কুফরী কাজে লিপ্ত মুসলিম আর ইহুদী, খ্রিস্টান বা ইসলাম বাদে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

অথচ কুফরের শব্দের যে অর্থের পাশে তারা সবসময় ভনভন করে, কুরআন ও সুন্নাহতে ‘কুফর’ শব্দটি সবসময় সেই অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। তাদের এই ভুল বুঝের কারণে তারা এমন অনেক মুসলিমকে কাফির আখ্যা দিয়ে থাকে, যা থেকে সেসব মুসলিম মুক্ত। কুফর শব্দটি শুধু একটি অর্থ প্রদান করে না, তথা কুফর শব্দটি শুধু মুরতাদ হয়ে যাওয়া ও দীন থেকে বের হয়ে যাওয়া প্রমাণ করে না; বরং একাধিক অর্থ প্রদান করে।

এই কুফর শব্দটির অবস্থা তেমন, যেমন (সূরা মায়েদার) অন্য দুই আয়াতে বর্ণিত ‘ফাসিক’ ও ‘জালিম’ শব্দদ্বয়ের অবস্থা। কাউকে ‘কুফরী করেছে’ আখ্যা দিলে যেমন এর অর্থ নয় যে, সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে, তেমন কাউকে জালিম ও ফাসিক আখ্যা দিলে এর অর্থ নয় যে, সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।

এক শব্দের এমন বিভিন্ন অর্থ থাকা ভাষা ও শরীআত দ্বারা সাব্যস্ত। এ কারণে যারা আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ফয়সালা করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের ওপর ওয়াজিব হচ্ছে- কিতাব, সুন্নাহ ও সালাফে সালিহীনের মানহাজের ব্যাপারে জ্ঞান রাখা। এ বিধান যে-কোনো বিচার ও বিচারকের জন্য প্রযোজ্য: হোক তিনি শাসক বিচারক বা জনসাধারণ বিচারক।

আর আরবী ভাষা ভালোভাবে জানা ছাড়া কিতাব ও কিতাব সংশ্লিষ্ট বিষয় বোঝা সম্ভব নয়। যদি কারো মাঝে আরবী ভাষা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকে, তাহলে তার এই ঘাটতি ও অপরিপূর্ণতা পূরণ হতে পারে পূর্ববর্তী আলিমদের দ্বারস্থ হওয়ার মাধ্যমে; বিশেষকরে পূর্ববর্তী আলিমগণ যদি হন সেই তিন প্রজন্মের, যাদের ব্যাপারে হাদীসে কল্যাণের সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। কাজেই তাদের কাছে ফিরে যাওয়া তার আরবী ভাষা ও সাহিত্যে অপূর্ণতার সহায়ক হতে পারে।

আমরা আবার আয়াতের দিকে ফিরে যাই। আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।[6]

তারাই কাফির’ দ্বারা কি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া আবশ্যক, না কি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার নিম্নপর্যায়ও হতে পারে? এ আয়াত বোঝার ক্ষেত্রে এখানে সূক্ষ্মদর্শী হতে হবে। ‘তারাই কাফির’ দ্বারা কখনো উদ্দেশ্য হতে পারে, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। আবার কখনো উদ্দেশ্য হতে পারে, ইসলাম যা নিয়ে এসেছে তার কিছু থেকে আমলগতভাবে খারিজ হয়ে গিয়েছে। আমাদের এমন ব্যাখ্যা বুঝতে সহযোগিতা করে কুরআনের মুখপাত্র সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.)। তিনি ছিলেন সাহাবীদের অবলম্বন। এ ব্যাপারে ভ্রান্ত ফিরকা ছাড়া সকল মুসলিম একমত যে, তিনি তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম। এ কারণে কিছু সাহাবী তার নাম দিয়েছেন ‘কুরআনের মুখপাত্র আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস?

মনে হয়, তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) সেসময় খুব ভালোভাবে শুনতে পেয়েছিলেন, যেমন আমরা আজ শুনতে পাই যে, কিছু মানুষ এই আয়াতকে বাহ্যিক অর্থে (সরাসরি দীন থেকে খারিজকারী কুফর) বুঝবে, আমরা যে ব্যাখ্যা দিলাম তারা সে-ব্যাখ্যা বুঝবে না। আমাদের ব্যাখ্যা হলো, কখনো ‘কাফির’ দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, ইসলাম থেকে বহির্ভুত মুরতাদ আর কখনো তা দ্বারা ইসলাম থেকে বহির্ভুত মুরতাদ বোঝায় না। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এটা এমন কুফর নয় যা তোমরা মনে করছো।’ তিনি আরো বলেন, ‘তা দ্বারা এমন কুফর উদ্দেশ্য নয়, যা ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘তা দ্বারা ছোটো কুফর উদ্দেশ্য।’[7] সম্ভবত সাহাবী ইবন আব্বাস (রা.) আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী খারিজীদের উদ্দেশ্যে একথাগুলো বলেছিলেন। এ আয়াতের মাধ্যমে খারিজীরা মুমিনদের রক্ত প্রবাহিত করে এবং যে আচরণ তারা মুশরিকদের সঙ্গে করে না, সেই আচরণ তারা মুসলিমদের সঙ্গে করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, এ আয়াতকে পুঁজি করে তারা যেমনটি বলছে, আসলে তেমনটি নয় বা তারা যেমনটি বিশ্বাস করে তা সঠিক নয়; বরং এর দ্বারা ছোটো কুফর উদ্দেশ্য।

এ আয়াতের তাফসীরে এমনটি ছিল কুরআনের মুখপাত্রের সংক্ষিপ্ত ও অতিস্পষ্ট জবাব। আমরা আমাদের বক্তব্যের শুরুতে যেসব দলীল উল্লেখ করেছি, সেসব দলীলের আলোকে কুরআনের মুখপাত্রের এই ব্যাখ্যা ও জবাব ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।[8]

‘কুফর’ শব্দটি অনেক দলীলে উল্লেখ রয়েছে। সেসব দলীলের এমন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, যে ব্যাখ্যা আধুনিক যুগে তারা করে থাকে। ‘কুফর’ শব্দের ব্যাখ্যা ‘ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া’ করা সম্ভব নয়। যেমন বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং হত্যা করা কুফরী।’[9]

আমার মতে ‘হত্যা করা কুফরী’ কথাটি মূলত আরবী ভাষায় একটি বাক্যকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করার পদ্ধতি। যদি কেউ বলে, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ও হত্যা করা কুফরী’, তাহলে তার কথাও সঠিক হবে। কারণ, ফিসক অর্থ নাফরমানি। আর নাফরমানি হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তবে এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ বিপরীতমুখী দুটি কথার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফিসক এবং হত্যা করা কুফরী।’

তাই আমরা হাদীসটির প্রথম বাক্য ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফিসক’-এ উল্লিখিত ‘ফিসক’ শব্দটিকে فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ অর্থাৎ তারাই হলো ফাসিক―এ আয়াতে[10] বর্ণিত ‘ফিসক’ শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারি। অতএব, তারাই হলো ফাসিক এবং মুসলিমকে গালি দেওয়া ফিসক।

আমরা বলব, কখনো ‘ফিসক’ শব্দটি ‘কুফর’ শব্দের সমার্থক হয়। অর্থাৎ কখনো ‘কুফর’ দ্বারা যেমন ইসলাম থেকে খারিজ বোঝায়, তেমন কখনো ‘ফিসক’ শব্দ দ্বারাও ইসলাম থেকে খারিজ বোঝায়। আবার কখনো এ দিক থেকেও সমার্থক হয় যে, উভয় শব্দ দ্বারা ইসলাম থেকে খারিজ বোঝায় না। কুরআনে মুখপাত্র ইবন আব্বাস (রা.) এ অর্থে ‘ছোটো কুফর’ উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

হাদীসটি এ মতকে শক্তিশালী করে যে, কুফর কখনো ছোটো কুফর অর্থে ব্যবহার হয়। কারণ কী? কারণ, আল্লাহ তাআলা প্রসিদ্ধ আয়াতে বলেছেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ
যদি মুমিনদের দুটি দল লড়াই করে তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অন্যদলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দল বাড়াবাড়ি করবে তোমার তার বিরুদ্ধে লড়বে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।[11]

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা হকপন্থি দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়িকারী দলকে ‘মুমিন’ বলেছেন। আল্লাহ তাআলা এ দলকে কাফির বলেননি, অথচ হাদীসে লড়াই করাকে কুফরী আখ্যা দেওয়া হয়েছে।


[1] সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৪
[2] সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৪
[3] সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৫
[4] সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৭
[5] সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৪
[6] সূরা মায়েদাহ, আয়াত:৪৪
[7] আসারটি ইমাম ইবন জারীর (রাহি.) (১০/৩৫৫/১২০৫৩) সহীহ সনদে ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন,
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।[7] ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, তা কুফর। তবে তা আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাকে, তাঁর কিতাবকে ও তাঁর রাসূলদের অস্বীকার নয়।

এ আয়াতের তাফসীরে ইবন আব্বাস (রা.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, ‘এমন কুফর নয় যা তোমরা মনে করছো। তা দ্বারা এমন কুফর উদ্দেশ্য নয় যা ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। তা দ্বারা ছোটো কুফর উদ্দেশ্য।’ এটি বর্ণনা করেছেন হাকিম, ২/৩১৩। ইমাম হাকিম এর সনদকে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী তা সমর্থন করেছেন। ইমাম হাকিম ও ইমাম যাহাবী বলতে পারতেন, বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ। কারণ, তা বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ হওয়ার ন্যায়।

এরপর আমি দেখেছি, হাফিয ইবন কাসীর তার তাফসীরে (৬/১৬৩) হাকিম থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, হাকিম বলেছেন, আসারটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ। বোঝা যাচ্ছে, মুসতাদরাক হাকিমের প্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে এ কথাটুকু বাদ পড়ে গিয়েছে। ইবন কাসীর ইবন আবী হাতিমের সঙ্গেও সম্পৃক্তও করেছেন।

আলী ইবন আবী তালহার বর্ণনায় রয়েছে, তিনি ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে-ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় অস্বীকার করবে, সে কুফরী করবে। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করবে কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করবে না, সে জালিম ফাসিক।’ এটি বর্ণনা করেছেন ইবন জারীর (১২০৬৩)

আমি আলবানী বলব, আলী ইবন আবী তালহা ইবন আব্বাস (রা.) থেকে শুনেননি। তবে এটি শাহিদ হিসেবে উত্তম।

আমি এখানে যা কিছু উল্লেখ করলাম তা সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬/১১৩, ১১৪ হাদীস নং ২৫৫২ থেকে গৃহীত।

[8] শাইখ মুহাম্মাদ ইবন উসাইমীন (রাহি.) আল্লামা আলবানী (রাহি.)-এর আলোচনায় এভাবে টীকায় বলেছেন যে, শাইখ আলবানী ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত এই আসারটি দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। অন্যান্য আলিমগণও এই আসারটিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। কারণ, তা অনেক দলীলের সঙ্গে সত্যিকারার্থে মিলে যায়। নবী ﷺ বলেছেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং হত্যা করা কুফরী।’ (সহীহুল বুখারী, ৪৮; সহীহ মুসলিম, ৬৪) হাদীসে হত্যা করার সঙ্গে ‘কুফরী’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে অথচ হত্যা করার কারণে কাফির হবে না এবং ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ
যদি মুমিনদের দুটি দল মারামারি করে তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অন্যদলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দল বাড়াবাড়ি করবে তোমার তার বিরুদ্ধে লড়বে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৯)

কিন্তু এসব দলীল তাকফীরের ফিতনায় নিমজ্জিত ব্যক্তিদের সন্তুষ্ট করতে পারে না। তারা বলে ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত এই আসার গ্রহণযোগ্য নয়। তার থেকে তা সহীহ সূত্রে বর্ণিত নয়।
তাদেরকে বলা হবে, কীভাবে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়? অথচ এই আসারটি আপনাদের থেকে বড়ো, আপনাদের থেকে উত্তম এবং আপনাদের থেকে হাদীস শাস্ত্রে বেশি পণ্ডিত ব্যক্তিরা গ্রহণ করে নিয়েছেন। আর আপনারা বলছেন, আমরা তা গ্রহণ করব না?

আমাদের জন্য যথেষ্ট যে, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা, ইবনুল কাইয়্যিমপ্রমুখ মহাবিজ্ঞ আলিম তা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন, এর মাধ্যমে আলোচনা করেছেন এবং তা বর্ণনা করেছেন। কাজেই আসারটি সহীহ।

যদি মেনেও নেই যে, আপনারা যা বলছেন তা সঠিক অর্থাৎ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে তা সহীহ সূত্রে বর্ণিত নয়, তারপরও আমাদের কাছে আরো অন্যান্য দলীল রয়েছে, যা প্রমাণ করে, কখনো ‘কুফর’ শব্দটি এমন অর্থে ব্যবহার করা হয় যা দ্বারা ইসলাম থেকে খারিজকারী ‘কুফর’ উদ্দেশ্য নেওয়া হয় না। যেমন নবী ﷺ বলেছেন,
اثْنَتَانِ فِي النَّاسِ هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ الطَّعْنُ فِي النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ
দুটি স্বভাব মানুষের মাঝে রয়েছে, যা কুফর বলে গণ্য: ক. বংশের প্রতি কটাক্ষ করা এবং খ. মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে বিলাপ করা। (সহীহ মুসলিম, ২৩৬)
হাদীসে বর্ণিত এই কুফর ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দিবে না। এতে সামান্য সন্দেহ নেই। তবে শাইখ আলবানী ওয়াফফাকাহুল্লাহ আলোচনার শুরুতে যা বলেছেন, আসল ঘটনা তাই। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম কারণ: ইলমের অগভীরতা। দ্বিতীয় কারণ: এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো, শরীআতের আইন-কানুন ও মূলনীতি এবং সহীহ ইসলামী দাওয়াতের মূলভিত্তির ব্যাপারে তাদের গভীর জ্ঞান না থাকা।’ এটাই তাদেরকে এমন ভ্রষ্টতাকে আবশ্যক করে দিয়েছে।

এর সঙ্গে আমি আরেকটি বিষয় যোগ করছি। তা হলো, খারাপ লক্ষ্য ও ইচ্ছা; যার কারণে খারাপ বুঝ সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, কোনো মানুষ যদি কোনো কিছুর ইচ্ছা করে এবং তা লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে, তখন আবশ্যকীয়ভাবে তার বুঝ তার ইচ্ছা ও লক্ষ্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। এরপর সে অনুযায়ী দলীলসমূহকে বিকৃত করে। এ জন্য আলিমদের কাছে প্রসিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে, তারা বলে থাকেন, ‘আগে দলীল গ্রহণ করো, তারপর তার ওপর আকীদা গঠন করো।’ আকীদা গঠন/নির্মাণ করার পর দলীল খুঁজবে না; অন্যথায় তুমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।

মোটকথা, তাদের এমন বিভ্রান্তির কারণ তিনটি:
প্রথম কারণ: ইলমের অগভীরতা।
দ্বিতীয় কারণ: এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো, শরীআতের আইনকানুন ও মূলনীতি এবং সহীহ ইসলামী দাওয়াতের মূলভিত্তির ব্যাপারে তাদের গভীর জ্ঞান না থাকা।
তৃতীয় কারণ: খারাপ ইচ্ছা ও লক্ষ্যের ওপর নির্মিত খারাপ বুঝ।

[9] সহীহুল বুখারী, ৪৮; সহীহ মুসলিম, ৬৪
[10] সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৭
[11] সূরা হুজুরাত, আয়াত:৯
 

Share this page