সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।

প্রবন্ধ ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৭ম কিস্তি)

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,544
Credits
2,602
(২০) পাওনাদারের পাওনা ফিরিয়ে দেওয়া এবং ভুলকারীর মান-মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা :

ইমাম মুসলিম (রহঃ) আওফ বিন মালিক (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, হিময়ার গোত্রের এক ব্যক্তি (যুদ্ধকালে) শত্রুপক্ষীয় একজনকে হত্যা করে। সে নিহত ব্যক্তির ‘সালাব’ (নিহত ব্যক্তির সাথে থাকা অস্ত্র, কাপড়-চোপড়, অর্থকড়ি ও অন্যান্য সামগ্রীকে একত্রে সালাব বলে) পেতে চেয়েছিল। কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালীদ তাকে তা দিতে অস্বীকার করেন। তিনি ছিলেন দলপতি। আওফ বিন মালিক তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে তাঁকে খবরটা দেন। তিনি খালিদকে বললেন, কি জন্যে তুমি ওকে তার সালাবটা দিলে না? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কাছে পরিমাণটা বেশী মনে হয়েছিল। তিনি বললেন, ওকে সালাব দিয়ে দাও। পরে খালিদ আওফের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আওফ তখন তার চাদর টেনে ধরে বলেন, আমি তোমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট যা বলেছিলাম তা কি পূরণ করতে পেরেছি? কথাটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুনে ফেলেন। এতে তাঁর খুব রাগ হয়। তিনি বলতে থাকেন, খালিদ, ওকে দিও না! খালিদ, ওকে দিও না!! তোমরা কি আমার কথার সূত্র ধরে আমার আমীরদের সাথে যাতা আচরণ করবে? তোমাদের ও তাদের উপমা তো সেই ব্যক্তির মত যাকে উটের কিংবা ছাগলের পালের রাখাল নিযুক্ত করা হয়েছে। সে পশুপাল চরাচ্ছিল। তারপর পানি পান করানোর সময় হ’লে সে তাদের একটা চৌবাচ্চার ধারে নিয়ে গেল। পশুগুলো সেখানে নেমে পরিষ্কার পানি পান করল, আর ঘোলা পানি রেখে গেল। এই পরিষ্কার পানি হ’ল তোমাদের ভাগে, আর ঘোলা পানি মিলল তাদের।[1]

ইমাম আহমাদ (রহঃ) আওফ বিন মালিক আশজাঈ হ’তে এর থেকেও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, শাম (সিরিয়া) অঞ্চলে আমরা একটা যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমাদের সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালীদ। পথিমধ্যে হিমারীয় গোত্রের সহযোগী এক ব্যক্তি আমাদের সাথে যোগ দেয়। সে আমাদের শিবিরে অবস্থান করতে থাকে। তার সাথে একটা তলোয়ার ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। এ সময় মুসলমানদের এক ব্যক্তি একটা উট যবেহ করে। লোকটা তো আমাদের সাথেই অনুক্ষণ ছিল; সে ঐ উটের চামড়া নিয়ে ঢাল বানানোর চেষ্টা করে। সে চামড়াটা মাটিতে বিছিয়ে দেয়। তারপর আগুন দিয়ে তা শুকিয়ে নেয়। সে তাতে ঢালের মত একটা হাতল লাগিয়ে নেয়। এদিকে আমাদের সাথে আমাদের শত্রু রোমক ও আরবীয় সম্মিলিত বাহিনীর মুকাবিলা সংঘটিত হয়। তারা আমাদের বিরুদ্ধে এক কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

শত্রু বাহিনীতে এক রোমক তার লাল হলুদে মিশেল ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছিল, ঘোড়ার জিন ছিল স্বর্ণমন্ডিত, তার কোমরবন্দ ছিল স্বর্ণখচিত, তরবারিও ছিল অনুরূপ। সে তার পক্ষের লোকদের যুদ্ধের জন্য নানাভাবে উত্তেজিত ও অনুপ্রাণিত করছিল। আমাদের সেই সহযোগী লোকটি ঐ রোমকের নাগাল পাওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল। যেই সে তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল অমনি সে তার পিছু নেয় এবং তলোয়ার দিয়ে ঘোড়ার ঠ্যাঙে আঘাত করে। ফলে লোকটি মাটিতে পড়ে যায়। তখন সে তলোয়ারের উপর্যুপরি আঘাতে তাকে হত্যা করে। অতঃপর আল্লাহ যখন মুসলিম বাহিনীর বিজয় দান করলেন তখন সে এসে সালাব দাবী করল। লোকেরাও তার পক্ষে সাক্ষ্য দিল যে, সেই তার হত্যাকারী। খালিদ তাকে সালাবের কিছুটা দিয়ে বেশীর ভাগই রেখে দিলেন। সে আওফের শিবিরে ফিরে গিয়ে তাকে সব বলল। আওফ তাকে বললেন, তুমি তার কাছে ফিরে যাও, সে তোমাকে অবশিষ্ট সালাব ফিরিয়ে দেবে। সে তার নিকট ফিরে গেল। কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করলেন। তখন আওফ হাঁটতে হাঁটতে খালিদের নিকট এসে বললেন, আপনি কি জানেন না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হত্যাকারীকে সালাব দেওয়ার ফায়ছালা দিয়েছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ জানি। তিনি বললেন, তাহ’লে তার হাতে নিহতের সালাব তুলে দিতে আপনার কিসে বাধা হয়ে দাঁড়াল? খালিদ বললেন, আমি তার জন্য এটা অনেক সম্পদ মনে করেছি। আওফ বললেন, আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা দর্শনে সমর্থ হই (অর্থাৎ বেঁচে থাকি) তাহ’লে অবশ্যই আমি বিষয়টা তাঁর সামনে তুলব। মদীনায় পৌঁছে আওফ ঐ সহযোগীকে ডেকে পাঠালেন। সে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট গিয়ে সাহায্য চাইল। তিনি খালিদকে ডাকলেন, আওফ তখন তাঁর কাছে বসা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, খালিদ, এই লোকটাকে তার হাতে নিহত ব্যক্তির সালাব দিতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তার জন্য পরিমাণটা বেশী মনে করেছিলাম। তিনি বললেন, ওকে সালাব (পুরোই) দিয়ে দাও। তিনি তখন আওফের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আওফ তার চাদর টেনে ধরে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আমি তোমার যে কথা বলেছি তার প্রতিদানার্থে আমি এটা করছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একথা শুনে ফেলেন। এতে তাঁর খুব রাগ হয়। তিনি বলে ওঠেন, হে খালিদ! তুমি ওকে তা দিও না। তোমরা কি আমার আমীরদের সাথে যা তা আচরণ করবে? তোমাদের ও তাদের উপমা তো সেই ব্যক্তির মত যাকে উট কিংবা ছাগপালের রাখাল নিযুক্ত করা হয়েছে। সে পশুপাল চরাতে চরাতে তাদের পানি পান করাতে মনস্থ করল। তাই একটা চৌবাচ্চায় তাদের নামিয়ে দিল। তারা পরিষ্কার পানি পান করল এবং ঘোলা-কাদা পানি রেখে গেল। এই পরিষ্কার পানি তোমাদের আর ঘোলা পানি তাদের।[2]

আমরা লক্ষ্য করছি যে, খালিদ (রাঃ) হত্যাকারী সৈনিককে পরিমাণে বেশী সালাব প্রদানের ক্ষেত্রে ইজতিহাদে ভুল করেছেন। তাই নবী করীম (ﷺ) হকদারকে তার হক ফিরিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছেন- যাতে কাজ নিয়মমাফিক হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আওফ (রাঃ)-এর মুখ দিয়ে খালিদ (রাঃ)-কে কটাক্ষ ও মশকরা করে কথা বলতে শুনলেন, তখনই তাঁর রাগ হয়ে গেল। আবার খালিদ (রাঃ)-এর চাদর আওফ (রাঃ) টেনে ধরেছিলেন- যখন তিনি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এতেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই তিনি বলছিলেন, খালিদ তুমি ওকে দিও না।

এ কথার মধ্যে আমীর ও সেনাপতির মান-মর্যাদা রক্ষা করার শিক্ষা নিহিত রয়েছে। কেননা জনগণের মাঝে তাদের মর্যাদা হেফাযত করার মধ্যে যে উপকার রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

এখানে অবশ্য একটি প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। তা হ’ল : হত্যাকারী যখন সালাব লাভের অধিকারী তখন তিনি কিভাবে তাকে তা দিতে বাধা দিতে পারেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম নববী (রহঃ) দু’টি ছুরত বলেছেন। এক. সম্ভবত তিনি হত্যাকারীকে পরে তা দিয়েছিলেন। তিনি তাকে ও আওফ বিন মালিককে শাস্তি দেওয়ার জন্য তা বিলম্বিত করেছিলেন। কেননা তারা দু’জনে খালিদ (রাঃ)-এর ব্যাপারে গলা লম্বা করেছিলেন এবং শাসক ও তার নিয়োগকর্তার মানহানি করেছিলেন। দুই. সম্ভবত তিনি সালাব প্রাপকের মন জয় করার অন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে সে স্বেচ্ছায় তার অধিকার ছেড়ে দিয়েছিল এবং তা মুসলমানদের দিয়ে দিয়েছিল। এতে আমীরের সম্মানার্থে খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-কেও সন্তুষ্ট করা লক্ষ্য ছিল।[3]

ভুলের শিকার যে ব্যক্তি তার ব্যাপারে ভুল শুধরাতে ভুলকারীকে ডেকে পাঠানোর একটি সাক্ষ্য মুসনাদে আহমাদে পাওয়া যায়। আবুত তুফায়েল আমের বিন ওয়াছেলা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি একদল লোকের নিকট গিয়ে তাদেরকে সালাম দেয়। তারা সালামের উত্তর দেয়। পরে সে তাদের ছেড়ে গেলে উপস্থিত একজন বলল, আল্লাহর কসম! আমি এই লোকটাকে আল্লাহর খাতিরে ঘৃণা করি। সভাস্থ লোকেরা সমস্বরে বলে উঠল, আল্লাহর কসম! তুমি কি বাজে কথা বলছ? শোনো, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমরা অবশ্যই কথাটা তাকে জানাব। তারা তাদের মধ্যকার একজনকে ডেকে বলল, ওহে অমুক! ওঠো ঐ লোকটিকে জানিয়ে দিয়ে এস। তাদের বার্তাবাহক লোকটির নাগাল পেয়ে তাকে লোকটি যা বলেছে তা জানিয়ে দিল। লোকটি তখন সোজা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মুসলমানদের একটি সভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাদের মাঝে অমুক উপস্থিত ছিল। আমি তাদের সালাম দিলাম, তারা আমার সালামের জবাব দিল। তারপর আমি তাদের ছেড়ে আসার পর তন্মধ্যস্থিত এক লোক আমার নাগাল পেয়ে জানাল যে, অমুক বলেছে, আল্লাহর কসম, আমি এই লোকটাকে আল্লাহর খাতিরে ঘৃণা করি। আপনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন, কেন সে আমাকে ঘৃণা করে। অনন্তর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ডেকে পাঠালেন। সে এলে তিনি তাকে উল্লিখিত লোকটি তাকে যা জানিয়েছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সে সবই স্বীকার করল এবং বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাকে সে কথা বলেছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তুমি কেন তাকে ঘৃণা কর? সে বলল, আমি তার প্রতিবেশী, আমি তার ভেতর সম্পর্কে অবগত। আল্লাহর কসম! আমি তাকে ফরয সালাত ব্যতীত কখনো কোন সালাত আদায় করতে দেখিনি। এ ফরয সালাত তো সৎ অসৎ সকলেই আদায় করে। লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকে জিজ্ঞেস করুন, সে কি আমাকে ঐ সালাত যথাসময় থেকে বিলম্বিত করতে দেখেছে, অথবা আমি তজ্জন্য ভালভাবে ওযূ করিনি, কিংবা তাতে রুকূ-সিজদা খারাপভাবে করেছি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে এসব বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, না। তারপর সে বলল, আল্লাহর কসম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাকে ঐ মাস ব্যতীত কখনো কোন ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। যেই মাসে ভালমন্দ সকলেই ছিয়াম পালন করে। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে কি কখনো আমাকে ছিয়াম ভেঙে ফেলতে দেখেছে, নাকি আমি তার কোন হক লাঘব করেছি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, না। পুনরায় সে বলল, আল্লাহর কসম, আমি তাকে কখনো কোন প্রার্থী বা ভিক্ষুককে কিছু দিতে দেখিনি এবং আল্লাহর রাস্তায়ও তার সম্পদ থেকে কিছু মাত্র ব্যয় করতে দেখিনি। তবে সে যাকাত দিয়ে থাকে, যা সৎ অসৎ সবাই দিয়ে থাকে। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কি যাকাত থেকে কিছুমাত্র লুকিয়েছি, নাকি তার আদায়কারীর কাছে হিসাব কম দাখিল করেছি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, তুমি উঠে যাও। আমি জানি না; তবু হ’তে পারে সে তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ।[4]

মুসনাদে আহমাদে এই হাদীস উল্লেখের পর সরাসরি নিম্নরূপ বলা হয়েছে- আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন ইয়া‘কূব তিনি বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন আমার পিতা ইবনু শিহাব থেকে; তিনি তাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুললাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় এক ব্যক্তি একদল লোকের নিকট গমন করে। তিনি আবুত তুফায়েলের নাম উল্লেখ করেননি। আব্দুল্লাহ বলেন, আমার নিকট এ কথা পৌঁছেছে যে, ইবরাহীম বিন সা‘দ এ হাদীস তার স্মৃতি থেকে বলেছেন এবং তিনি আবুত তুফায়েল থেকে বর্ণনার কথা বলেছেন। তারপুত্র ইয়া‘কূব পিতার বরাতে বর্ণনা করেছেন- তাতে তিনি আবুত তুফায়েলের নাম বলেননি। আমার মনে হয় তার মধ্যে দ্বিধা তৈরী হয়েছিল। ইয়া‘কূবের বর্ণনাই সহীহ। আল্লাহই বেশী জ্ঞাত।[5]

(২১) দ্বিপক্ষীয় ভুলের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে উভয়ের ভুল সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করা :

অনেক সময় দ্বিপক্ষীয় ভুল হয়ে থাকে। একই সময় ভুলকারী এবং যার বিরুদ্ধে ভুল করা হয়েছে উভয়ে ভুল করতে পারে। অবশ্য উভয় পক্ষের ভুলের হারে তারতম্য হ’তে পারে। সুতরাং দুই দিকের ভুল নিয়ে কথা বলা ও উপদেশ দেওয়া উচিত। নীচে এমন একটি উদাহরণ তুলে ধরা হ’ল।

আব্দুল্লাহ বিন আবু আওফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আব্দুর রহমান বিন আওফ খালিদ বিন ওয়ালীদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অভিযোগ করেন। নবী করীম (ﷺ) তখন খালিদ (রাঃ)-কে বললেন,

يَا خَالِدُ، لاَ تُؤْذِ رَجُلاً مِنْ أَهْلِ بَدْرٍ، فَلَوْ أَنْفَقْتَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا لَمْ تُدْرِكْ عَمَلَهُ، فَقَالَ : يَقَعُوْنَ فِيَّ فَأَرُدُّ عَلَيْهِمْ، فَقَالَ : لاَ تُؤْذُوْا خَالِدًا؛ فَإِنَّهُ سَيْفٌ مِنْ سُيُوْفِ اللهِ صَبَّهُ اللهُ عَلَى الْكُفَّارِ-​

‘হে খালিদ! কোন বদর যোদ্ধাকে কষ্ট দিও না। তুমি যদি ওহোদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও দান কর, তবুও তার আমলের নাগাল পাবে না। সে বলল, তারা আমাকে গালমন্দ করে, ফলে আমি তার উত্তর দেই। তখন তিনি বললেন, তোমরা খালিদকে কষ্ট দিও না। কেননা সে আল্লাহর তরবারি। কাফিরদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাকে প্রয়োগ করেছেন’।[6]

(২২) ভুলকারীকে যার বিরুদ্ধে সে ভুল করেছে তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলা :

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, সফরে একে অপরকে সেবা করা আরবদের একটি চিরাচরিত অভ্যাস। এক সফরে আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর সাথে একজন লোক ছিল। সে তাদের দু’জনের খেদমত করত। একবার তারা ঘুমিয়ে পড়েন, তারপর ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান খাদেম লোকটি তাদের জন্য খাবার তৈরী করেনি। তখন তাদের একজন তার সঙ্গীকে বলে, এতো দেখছি খুব ঘুমকাতুরে। (لنؤوم বা খুব ঘুম কাতুরে শব্দটি দারুশ শা‘ব থেকে প্রকাশিত তাফসীর ইবনু কাছীরের। আলবানী তাঁর সিলসিলাতুছ সহীহাহ গ্রন্থে ২৬০৮ নং হাদীসে উল্লেখ করেছেন

إن هذا ليوائم نوم نعبيكم صلى الله عليه وسلم​

‘এ লোক তো নিশ্চয়ই তোমাদের নবী (ﷺ)-এর মত ঘুম যায়’। অন্য বর্ণনায় আছে ليوائم نوم بيتكم ‘তোমাদের বাড়ীর মতই ঘুম যায়’। তাঁরা তাকে জাগিয়ে বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে বল, আবুবকর ও ওমর আপনাকে সালাম জানিয়েছে, তারা খানা খাওয়ার জন্য আপনার কাছে তরকারি চেয়েছেন। তিনি লোকটির কথা শুনে তাকে বললেন, তুমিও তাদের দু’জনকে সালাম জানাবে এবং বলবে যে, তারা ইতিমধ্যে রুটি তরকারি খেয়ে নিয়েছে। তাঁরা দু’জনেই তার কথায় ভয় পেয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার নিকট তরকারী চেয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম। আপনি তাকে বলেছেন, তাদের রুটি তরকারী খাওয়া হয়ে গেছে। তাহ’লে আমরা কি দিয়ে রুটি খেলাম? তিনি বললেন, তোমাদের ভাইয়ের গোশত দ্বারা। যার হাতে আমার জীবন তার শপথ, নিশ্চয়ই আমি তার গোশত তোমাদের দু’জনের চোখা দাঁতগুলোতে লেগে থাকতে দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ তার গোশত যাদের তাঁরা দু’জনে নিন্দা করেছিলেন। তাঁরা দু’জন বললেন, আমাদের জন্য আপনি ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি বললেন, সেই (নিন্দিত জন) বরং তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে’।[7]

(২৩) ভুলকারীকে যার বিরুদ্ধে সে ভুল করেছে তার মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যাতে সে লজ্জিত হয় এবং ওযরখাহি করে :

এরূপ সমাধান নবী করীম (ﷺ) আবুবকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর মাঝে করেছিলেন। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে তাফসীর অধ্যায়ে আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর মধ্যে আলাপ হয়। আবু বকরের কথায় ওমরের রাগ হয়। রাগের চোটে ওমর (রাঃ) তাঁকে ছেড়ে চলে যান। আবুবকর (রাঃ) তাঁর পিছনে পিছনে যেতে থাকেন এবং তাঁকে মাফ করে দেওয়ার জন্য আবেদন জানাতে থাকেন। কিন্তু তিনি তা না করে ঘরে ঢুকে তাঁর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। ফলে আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আসেন। আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, আমরা এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সব শুনে বললেন, তোমাদের এই সাথী খুব একটা ঝগড়া করেছে। ইতিমধ্যে ওমর (রাঃ)ও তাঁর আচরণে অনুশোচনা বোধ করেন। ফলে তিনিও নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এসে সালাম দেন এবং তাঁর পাশে বসে পুরো ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করেন। আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এতে রেগে যান। এদিকে আবুবকর (রাঃ) বলতে থাকেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিই যুলুম করেছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলে চলেন, তোমরা কি আমার জন্য আমার সাথীকে ত্যাগ করবে? তোমরা কি আমার জন্য আমার সাথীকে ত্যাগ করবে? আমি বলেছিলাম, হে মানব জাতি, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। কিন্তু তোমরা বলেছিলে, তুমি মিথ্যা বলছ, আর আবুবকর বলেছিলেন, আপনি সত্য বলেছেন’।[8]

বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে মানাকিব বা মাহাত্ম্য অধ্যায়ে আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে একই ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-এর পাশে বসা ছিলাম। এমন সময় আবুবকর (রাঃ) তাঁর কাপড়ের কোঁচা তুলে এগিয়ে এলেন। তিনি কাপড় এতটাই তুলে ধরেছিলেন যে, তাঁর দু’হাঁটু বেরিয়ে পড়েছিল। নবী করীম (ﷺ) তা দেখে বললেন, তোমাদের এই সাথী নিশ্চয়ই ঝগড়া করে এসেছে। তিনি সালাম দিয়ে বললেন, আমার ও খাত্ত্বাব তনয়ের মাঝে একটা কিছু ঘটেছিল। আমি তার প্রতি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি (তাকে অপমান করেছি এবং মনে ব্যথা দিয়েছি)। পরে আমি অনুশোচনা করেছি এবং তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু সে অস্বীকার করেছে। তারপর আমি আপনার কাছে এসেছি।

তিনি একথা শুনে তিনবার বললেন, হে আবুবকর! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। তারপর ওমর (রাঃ)-এর মনে অনুশোচনা জাগে। তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করেন, এখানে কি আবুবকর (রাঃ) আছেন? তারা বলল, না। তারপর তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু নবী করীম (ﷺ)-এর চেহারা রাগে লাল হয়ে উঠেছিল। এ দৃশ্য দেখে আবুবকর (রাঃ) ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি তাঁর দু’হাঁটু মাটিতে গেড়ে দু’বার বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! দোষ আমিই করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমাদের কাছে রাসূল করে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা বলেছিলে, তুমি মিথ্যা বলছ; আর আবুবকর (রাঃ) বলেছিলেন, আপনি সত্য বলছেন। তিনি তার জানমাল দিয়ে আমাকে সহায়তা করেছেন। তোমরা কি এমতাবস্থায় আমার জন্য আমার সাথীকে ত্যাগ করবে? কথাটি তিনি দু’বার বলেন। তারপর তাঁকে আর কষ্ট পেতে হয়নি।[9]

(২৪) উত্তেজনা প্রশমনে হস্তক্ষেপ এবং ভুলকারীদের মধ্য থেকে ফেৎনার মূলোৎপাটন :

বহু ক্ষেত্রে নবী করীম (ﷺ) এমন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। মুসলমানদের মাঝে যখন লড়াই বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। যেমন আয়েশা (রাঃ)-এর চরিত্রে অপবাদ দানের ঘটনায় এমন হয়েছিল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ ঘটনাকালে একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জনতার সামনে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ বিন ওবাই সম্পর্কে কৈফিয়ত চাইলেন। তিনি বললেন, হে মুসলিমগণ! কে আছে যে আমাকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে পারবে, যার পক্ষ থেকে আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে? আল্লাহর কসম! আমি আমার পরিবার সম্পর্কে ভাল বৈ অন্য কিছু জানি না। তারা একজনের নামোল্লেখ করেছে তার সম্বন্ধেও আমি ভাল বৈ কিছু জানি না। সে আমার সাথে ছাড়া আমার ঘরে প্রবেশ করে না। তখন বনু আব্দুল আশহালের ভাই সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে কৈফিয়ত দেব। যদি সে আওস গোত্রীয় কেউ হয় তাহ’লে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রীয় কেউ হয়, তবে আপনি যেমন হুকুম করবেন আমরা সেই মত কাজ করব। তখন খাযরাজ গোত্রের একজন উঠে দাঁড়ালেন। হাসসান (রাঃ)-এর মা ছিলেন তাঁর আপন চাচাত বোন। তার নাম সা‘দ বিন ওবাদা। তিনি খাযরাজ গোত্রের প্রধান। তিনি ইতিপূর্বে সৎ লোক বলেই গণ্য ছিলেন। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তিনি আত্মম্ভরিতার শিকার হন। ফলে সা‘দকে লক্ষ্য করে বলে বসেন, আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি তাকে হত্যা করবে না। তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। সে যদি তোমার গোত্রের হয়ে থাকে তাহ’লে তুমি তার নিহত হওয়া পসন্দ করবে না। তখন সা‘দের চাচাত ভাই উসায়েদ বিন হুযায়ের দাঁড়িয়ে সা‘দ বিন ওবাদাকে বললেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। আর তুমি মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছ। অতএব তুমি একজন মুনাফিক। অতঃপর আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় এতই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করে। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখনো মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে। তিনি অনুক্ষণ তাদের মেযাজ ঠান্ডা করতে বলতে থাকায় শেষ পর্যন্ত তারা চুপ করে গেল।[10]

বুখারী ও মুসলিমের আরেক বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ﷺ) বনু আমর বিন আওফ গোত্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনকল্পে তাদের মহল্লায় গিয়েছিলেন। এজন্য তাঁর সালাতের জামা‘আতের প্রথম দিকটা ছুটে গিয়েছিল। নাসাঈর বর্ণনায় আছে সাহল বিন সা‘দ আস-সায়েদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

وَقَعَ بَيْنَ حَيَّيْنِ مِنَ الأَنْصَارِ كَلاَمٌ حَتَّى تَرَامَوْا بِالْحِجَارَةِ فَذَهَبَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لِيُصْلِحَ بَيْنَهُمْ فَحَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَأَذَّنَ بِلاَلٌ وَانْتُظِرَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَاحْتُبِسَ فَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَتَقَدَّمَ أَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه-​

‘আনছারদের দু’টি গোত্রের মাঝে বচসা বা কথা কাটাকাটি হয়। শেষ পর্যন্ত তারা একদল অপর দলের প্রতি পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। নবী করীম (ﷺ) একথা জানতে পেরে তাদের মাঝে মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করেন। ইত্যবসরে সালাতের সময় হয়ে যায়। বিলাল (রাঃ) আযান দেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু তিনি (মীমাংসার কাজে) আটকা পড়ে যান। ফলে বিলাল ইকামত দেন এবং আবুবকর (রাঃ) সামনে এগিয়ে যান (ইমামতি করার জন্য)...।[11]

আহমাদের বর্ণনায় সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,

أَتَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم آتٍ فَقَالَ إِنَّ بَنِى عَمْرِو بْنِ عَوْفٍ قَدِ اقْتَتَلُوا وَتَرَامَوْا بِالْحِجَارَةِ فَخَرَجَ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِيُصْلِحَ بَيْنَهُمْ-​

‘একজন আগমনকারী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বলল, বনু আমর বিন আওফ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে একে অপরের প্রতি পাথর ছুঁড়ে মারছে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের মাঝে সমঝোতা করার উদ্দেশ্যে তাদের মহল্লায় গমন করেন’।[12]

(২৫) ভুলের জন্য ক্রোধ প্রকাশ :

সামনে ভুল দেখতে পেলে কিংবা কানে শুনতে পেলে সময় বিশেষে রাগ করলে ভুল বন্ধ হ’তে পারে। যেমন তাক্বদীর ও কুরআন নিয়ে মতবিরোধ করলে উষ্মা হওয়া স্বাভাবিক। ইবনু মাজাহ গ্রন্থে আমর ইবনু শু‘আইব কর্তৃক তার পিতা থেকে এবং তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন,

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের মাঝে বেরিয়ে এসে দেখলেন, তারা তাক্বদীর নিয়ে বাকবিতন্ডা করছে। এতে তাঁর মাঝে এতটাই রাগের সঞ্চার হয় যে, তাঁর মুখমন্ডলে ডালিমের দানা ফেটে পড়েছে (তাঁর চেহারা লালচে সাদা ছিল। রাগ হ’লে চেহারায় রক্ত জমে যেত। ফলে এমনটা মনে হ’ত)। তিনি তাদের বললেন,

بِهَذَا أُمِرْتُمْ أَوْ لِهَذَا خُلِقْتُمْ تَضْرِبُوْنَ الْقُرْآنَ بَعْضَهُ بِبَعْضٍ- بِهَذَا هَلَكَتِ الأُمَمُ قَبْلَكُمْ​

এ কাজের জন্য কি তোমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে, নাকি এজন্য তোমাদের সৃষ্ট করা হয়েছে? তোমরা কুরআনের একাংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লাগাচ্ছ। এমন আচরণের জন্যই তোমাদের পূর্বেকার জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্ণনাকারী সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুললাহ (ﷺ)-এর এই মজলিসে উপস্থিত না থাকায় আমার মাঝে যে মনস্তাপ হয়েছিল তা অন্য কোন মজলিসে উপস্থিত না থাকার জন্য হয়নি’।[13]

ইবনু আবী আছেম ‘কিতাবুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের মাঝে আবির্ভূত হয়ে দেখলেন তারা তাক্বদীর নিয়ে বিতর্ক করছে। এ এক আয়াত খন্ডন করছে তো ও অন্য আয়াত খন্ডন করছে। এ দেখে তিনি এতটাই রাগান্বিত হ’লেন যেন তাঁর মুখমন্ডলে ডালিমের দানা গলে পড়ছে। তিনি তাদের বললেন, তোমাদের কি এজন্য সৃষ্ট করা হয়েছে, নাকি এজন্য আদিষ্ট হয়েছ? তোমরা আল্লাহর কিতাবের একাংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে ব্যবহার কর না। তোমরা লক্ষ্য কর, কুরআনের মাধ্যমে তোমাদের যা আদেশ দেওয়া হয়েছে তা পালন কর, আর যা নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাক’।[14]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রাগ থেকে আক্বীদাগত বিষয়ে যেমন উল্টাপাল্টা কথা বলা নিষেধ বুঝা যায়, তেমনি ওমর (রাঃ)-এর ঘটনায় শিক্ষার উৎস নিয়ে তাঁর ক্রোধ হেতু বিরুদ্ধ ধারার উৎস থেকে শিক্ষা গ্রহণ যে সমীচীন নয় তা বুঝা যায়।

আহমাদ (রহঃ) তার মুসনাদে জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم بِكِتَابٍ أَصَابَهُ مِنْ بَعْضِ أَهْلِ الْكُتُبِ فَقَرَأَهُ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَغَضِبَ وَقَالَ أَمُتَهَوِّكُونَ فِيهَا يَا ابْنَ الْخَطَّابِ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً لاَ تَسْأَلُوهُمْ عَنْ شَىْءٍ فَيُخْبِرُوكُمْ بِحَقٍّ فَتُكَذِّبُوا بِهِ أَوْ بِبَاطِلٍ فَتُصَدِّقُوْا بِهِ وَالَّذِى نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ مُوسَى صلى الله عليه وسلم كَانَ حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلاَّ أَنْ يَتَّبِعَنِى-​

‘ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একটা বই হাতে করে নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে আসেন। তিনি বইটি একজন আহলে কিতাব (ইহুদী) থেকে পেয়েছিলেন। নবী করীম (ﷺ) বইটি পড়ে রেগে যান। তিনি বলেন, হে খাত্ত্বাব তনয়! তোমরা কি এই বই নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়লে? যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট এক আলোকময় স্বচ্ছ দ্বীন নিয়ে এসেছি, তোমরা তাদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেও না। তারা হয়তো তোমাদের সত্য খবর দেবে কিন্তু তোমরা তা মিথ্যা সাব্যস্ত করবে অথবা বাতিল খবর দেবে, আর তোমরা তা সত্য বলে বিশ্বাস করে বসবে। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ! যদি মূসা (আঃ)ও আজ জীবিত থাকতেন তবে তার জন্যও আমার অনুসরণ ব্যতীত গত্যন্তর থাকত না’।[15]

এই হাদীস ইমাম দারেমী (রহঃ)ও জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَتَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِنُسْخَةٍ مِنَ التَّوْرَاةِ فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ هَذِهِ نُسْخَةٌ مِّنَ التَّوْرَاةِ. فَسَكَتَ فَجَعَلَ يَقْرَأُ وَوَجْهُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَتَغَيَّرُ، فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ : ثَكِلَتْكَ الثَّوَاكِلُ، أَمَا تَرَى مَا بِوَجْهِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم؟ فَنَظَرَ عُمَرُ إِلَى وَجْهِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : أَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ غَضَبِ اللهِ وَمِنْ غَضَبِ رَسُوْلِهِ، رَضِيْنَا بِاللهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِيْناً وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ بَدَا لَكُمْ مُوْسَى فَاتَّبَعْتُمُوْهُ وَتَرَكْتُمُوْنِى لَضَلَلْتُمْ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيْلِ، وَلَوْ كَانَ حَيًّا وَأَدْرَكَ نُبُوَّتِىْ لاَتَّبَعَنِىْ-​

‘ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাওরাতের একটি পান্ডুলিপি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি তাওরাতের একটি পান্ডুলিপি। রাসূল (ﷺ) কোন কথা না বলে চুপ করে রইলেন। ওমর (রাঃ) তা পড়তে লাগলেন, এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে যেতে লাগল। তা দেখে আবুবকর (রাঃ) বলে উঠলেন, তুমি একেবারে গুম হয়ে যাও; তুমি নবী করীম (ﷺ)-এর চেহারা দেখতে পাচ্ছ না? ওমর (রাঃ) তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারার দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমি আল্লাহর ক্রোধ ও তাঁর রাসূলের ক্রোধ থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় চাচ্ছি। আমরা আল্লাহকে রব মেনে, ইসলামকে দ্বীন মেনে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে সন্তুষ্ট। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর শপথ! যদি তোমাদের মাঝে মূসা আত্মপ্রকাশ করতেন, আর তোমরা তার অনুসরণ করতে আর আমাকে বর্জন করতে তাহ’লে অবশ্যই তোমরা সোজা রাস্তা হারিয়ে ফেলতে। আজ যদি তিনি জীবিত থাকতেন এবং আমার নবুঅত পেতেন তাহ’লে অবশ্যই তিনি আমার অনুসরণ করতেন’।[16]

এ হাদীসের অনুরূপ অর্থে আবুদ দারদা (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেন, ওমর (রাঃ) তাওরাতের কিছু অর্থবহ কথাসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি তাওরাতের কিছু অর্থবহ কথা। আমি বনু যুরাইকের আমার এক ভাই থেকে এগুলো সংগ্রহ করেছি। একথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা বিগড়ে গেল। তা দেখে স্বপ্নে যিনি আযান দেখেছিলেন সেই আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) বলে উঠলেন, আল্লাহ কি আপনার বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট করে দিয়েছেন? আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা দেখে বুঝতে পারছেন না? তখন ওমর (রাঃ) বললেন, আমরা আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দ্বীন, মুহাম্মাদকে নবী এবং কুরআনকে ইমাম মেনে সন্তুষ্ট। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কষ্টের সেই আলামত দূর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর শপথ! যদি মূসা আজ তোমাদের মাঝে থাকতেন আর তোমরা আমাকে ছেড়ে তার অনুসরণ করতে তবে নিশ্চিতই তোমরা চরমভাবে বিপথগামী হ’তে। অন্যান্য উম্মতের মুকাবিলায় তোমরা আমার অংশভুক্ত এবং আমি অন্যান্য নবীদের মুকাবিলায় তোমাদের অংশভুক্ত’।[17]

এ ঘটনার বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা উপস্থিতদের পক্ষ থেকে শিক্ষকের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে দেখতে পাই। একই সঙ্গে আমরা শিক্ষকের চেহারা বিবর্ণ হওয়া এবং তার ভিত্তিতে গৃহীত পদক্ষেপও লক্ষ্য করি। এসব কিছু এক সাথে সংঘটিত হওয়ার ফলে উপদেশ গ্রহীতার মনে তার একটা বড় প্রভাব পড়ে। এখানে পর্যায়ক্রমে আমরা কাজগুলো দেখতে পাচ্ছি।

এক. কোন কথা বলার আগেই নবী করীম (ﷺ)-এর চেহারা রাগে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

দুই. আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) তা লক্ষ্য করে ওমর (রাঃ)-কে সতর্ক করেছেন।

তিন. ওমর (রাঃ) তাঁর ভুল সম্পর্কে সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেছেন ও ভুল সংশোধনে দ্রুত এগিয়ে এসেছেন। ভুল যা হয়ে গেছে, সেজন্য নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রোষ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চেয়েছেন এবং ইসলামের মৌল ভিত্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি সন্তুষ্টি তুলে ধরেছেন।

চার. ওমর (রাঃ) নিজের ভুল ধরতে পারায় এবং ভুল থেকে ফিরে আসায় নবী করীম (ﷺ)-এর কপালের ভাঁজ বা রেখাগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেল।

পাঁচ. মূল বিষয় হ’ল- নবী করীম (ﷺ)-এর শরী‘আতের অনুসরণ করা ফরয। অন্য কোন ধর্মীয় উৎস থেকে বিধি-বিধান গ্রহণ করা থেকে সতর্ক থাকা আবশ্যক। এটাই নবী করীম (ﷺ)-এর শেষের কথায় জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

কোন অন্যায় অশোভনীয় কাজ দেখলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাঝে রাগের সঞ্চার হ’ত। তার উদাহরণ সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর হাদীস। তিনি বলেন,

أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى نُخَامَةً فِى الْقِبْلَةِ، فَشَقَّ ذَلِكَ عَلَيْهِ حَتَّى رُئِىَ فِىْ وَجْهِهِ، فَقَامَ فَحَكَّهُ بِيَدِهِ فَقَالَ : إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ فِىْ صَلاَتِهِ، فَإِنَّهُ يُنَاجِى رَبَّهُ أَوْ إِنَّ رَبَّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْقِبْلَةِ فَلاَ يَبْزُقَنَّ أَحَدُكُمْ قِبَلَ قِبْلَتِهِ، وَلَكِنْ عَنْ يَسَارِهِ، أَوْ تَحْتَ قَدَمَيْهِ. ثُمَّ أَخَذَ طَرَفَ رِدَائِهِ فَبَصَقَ فِيْهِ، ثُمَّ رَدَّ بَعْضَهُ عَلَى بَعْضٍ، فَقَالَ : أَوْ يَفْعَلْ هَكَذَا-​

‘নবী করীম (ﷺ) (মসজিদের) কিবলার দিকে কফ পড়ে থাকতে দেখলেন। বিষয়টা তাঁর মনকে এতটাই পীড়া দিল যে, তার আভা তাঁর চেহারায় ফুটে উঠল। তিনি উঠে গিয়ে নিজ হাতে তা অাঁচড়িয়ে তুলে ফেললেন, তারপর বললেন, তোমাদের কেউ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন সে অবশ্যই তার প্রভুর সাথে চুপিসারে কথা বলে। অথবা তার ও কিবলার মাঝে তার রব অবস্থান করে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন কখনই তার কিবলার দিকে থুথু না ফেলে। তবে বামদিকে অথবা দু’পায়ের তলায় ফেলতে পারবে। তারপর তিনি তাঁর চাদরের কোন তুলে ধরে তাতে থুথু ফেললেন; অতঃপর একাংশের উপর অন্য অংশ চাপা দিয়ে ডললেন এবং বললেন, অথবা এমন করবে’।[18]

এ রাগ ও ক্ষোভ থেকে সালাতে থুথু ফেলার নিয়ম জানা গেল। এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সমাজে বিপর্যয় বা ফাসাদ সৃষ্টিকারী একটি ভুলের কথা জানতে পেরে রাগ প্রকাশ করেছিলেন। সহীহ বুখারীতে আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ، إِنِّىْ وَاللهِ لأَتَأَخَّرُ عَنْ صَلاَةِ الْغَدَاةِ مِنْ أَجْلِ فُلاَنٍ، مِمَّا يُطِيْلُ بِنَا فِيْهَا. قَالَ فَمَا رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَطُّ أَشَدَّ غَضَبًا فِىْ مَوْعِظَةٍ مِنْهُ يَوْمَئِذٍ، ثُمَّ قَالَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِيْنَ، فَأَيُّكُمْ مَا صَلَّى بِالنَّاسِ فَلْيُوْجِزْ، فَإِنَّ فِيْهِمُ الْكَبِيْرَ وَالضَّعِيْفَ وَذَا الْحَاجَةِ-​

‘এক লোক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক ফজর সালাতে আমাদের নিয়ে দীর্ঘ কিরাআতে সালাত আদায় করে বিধায় আমি ফজর সালাতের জামা‘আতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকি। বর্ণনাকারী বলেন, তার এই কথার ফলে আমি নবী করীম (ﷺ)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে এতটা কঠিনভাবে রাগ করতে দেখেছি যে আর কোন দিন তা করতে দেখিনি। পরে তিনি বলছিলেন, হে লোক সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে বিরক্তি সৃষ্টিকারী কিছু লোক রয়েছে। তোমাদের যেই সালাতে ইমামতি করবে সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের (সালাত আদায়কারী মুক্তাদীদের) মধ্যে বয়োবৃদ্ধ, দুর্বল ও সমস্যাগ্রস্ত অনেকেই থাকে’।[19]

মাসআলা জিজ্ঞাসাকারীর পালন করা কষ্টকর এমন বিষয়ে প্রশ্ন এবং সংশয়মূলক প্রশ্নের জন্যও উত্তর দাতার রাগ হ’তে পারে। এ সম্পর্কে যায়েদ বিন খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَ أَعْرَابِىٌّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلَهُ عَمَّا يَلْتَقِطُهُ فَقَالَ : عَرِّفْهَا سَنَةً، ثُمَّ احْفَظْ عِفَاصَهَا وَوِكَاءَهَا، فَإِنْ جَاءَ أَحَدٌ يُخْبِرُكَ بِهَا، وَإِلاَّ فَاسْتَنْفِقْهَا. قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَضَالَّةُ الْغَنَمِ قَالَ : لَكَ أَوْ لأَخِيْكَ أَوْ لِلذِّئْبِ. قَالَ ضَالَّةُ الإِبِلِ فَتَمَعَّرَ وَجْهُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم. فَقَالَ : مَا لَكَ وَلَهَا، مَعَهَا حِذَاؤُهَا وَسِقَاؤُهَا، تَرِدُ الْمَاءَ وَتَأْكُلُ الشَّجَرَ-​

‘জনৈক বদ্দু নবী করীম (ﷺ)-এর নিকটে এসে পড়ে থাকা জিনিস তুলে নিলে সে সম্পর্কে কি করণীয় তা তাঁকে জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেন, এক বছর ধরে তা প্রচার কর। তারপর তার ছিপি ও রশি সংরক্ষণ কর। তারপর যদি কেউ এসে তোমাকে এগুলো সম্পর্কে বলে তাহ’লে (তাকে তা দিয়ে দেবে) নতুবা তা খরচ করবে। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হারানো জিনিসটা যদি ছাগল হয়? তিনি বললেন, সেটা তোমার অথবা তোমার ভাইয়ের অথবা নেকড়ের ভাগে পড়বে। সে বলল, যদি হারানো উট হয়? এ কথায় নবী করীম (ﷺ)-এর মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুমি উট ধরে কি করবে? তার সাথে তো তার পা ও পানীয় রয়েছে, সে পানিতে নেমে পানি পানি করবে এবং গাছ গাছালি খাবে। (এমনি করে তার মালিকের কাছে পৌঁছে যাবে)’।[20]

লক্ষ্যণীয় যে, ভুল সংঘটিত হওয়া, কিংবা চোখে পড়া কিংবা কানে আসার সাথে সাথে যদি সংশোধনকারী শিক্ষাদাতার চোখে মুখে তা ফুটে ওঠে তাহ’লে তা ঐ ভুল ও নিষিদ্ধ কথা বা কাজের বিরুদ্ধে তার দিল-জান যে তাজা রয়েছে এবং সে যে এ সবের ক্ষেত্রে নীরব নয়, তারই আলামত বলে গণ্য হবে। এভাবে তাৎক্ষণিক নিষেধে উপস্থিত লোকদের ঐ ভুল সম্পর্কে মনে ভয় জন্মে এবং অন্তরের উপর তার একটি কার্যকরী প্রভাব পড়ে। পক্ষান্তরে ‘যুদ্ধ কবে কাল হাম জায়েগা পরশু’ প্রবাদের মত বিলম্বিত তালে দেরীতে নিষেধ করলে কিংবা বিষয়টা নিষেধ না করে গোপন রাখলে তাতে আদেশ-নিষেধ তেমন প্রভাব ফেলবে না। অনেক সময় সেসব অন্যায় আমাদের গা সওয়া হয়ে যাবে এবং তাদের প্রতি আমাদের অনুভূতি শীতল হয়ে পড়বে।

অবশ্য যদি মনে হয়, মানুষ যখন সাধারণত জমা হবে অথবা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সমাবেশ করার কথা রয়েছে অথবা এই মুহূর্তে উপদেশ দেওয়ার মত যথেষ্ট লোক নেই পরে লোক জমা হ’লে উপদেশ দেওয়া হবে- তেমন ক্ষেত্রে সংঘটিত নিষিদ্ধ কাজ কিংবা ভয়াবহ কথার তাৎক্ষণিক নিষেধ ও প্রতিবাদ না করে লোকসমাবেশের সময়ও নিষেধ করা যাবে। এরূপ ক্ষেত্রে সরাসরি বা সাথে সাথে খাছ বা ব্যক্তিগত আদেশ-নিষেধে যেমন বাধা নেই, তেমনি বিলম্ব করে আমভাবে সকলকে আদেশ-নিষেধ করায়ও অসুবিধা নেই।

এ সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে আবু হুমায়েদ আস-সায়েদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক ব্যক্তিকে (যাকাত আদায়ের) কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। কাজ শেষে ঐ কর্মচারী এসে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। তিনি তাকে বললেন, তোমার মা-বাবার ঘরে বসে থেকে দেখ না কেন- তোমাকে উপহার দেওয়া হয় কি-না? তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিকালে আছর সালাতের পর (জনতার উদ্দেশ্যে) ভাষণের জন্য দাঁড়ালেন। প্রথমে তিনি সাক্ষ্যবাণী উচ্চারণ করলেন, মহান আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করলেন তারপর বললেন, একজন আমিলকে (কর্মচারীকে) আমরা নিয়োগ দেই, তারপর এমন কি অবস্থা ঘটে যে, সে আমাদের কাছে এসে বলে, এগুলো তোমাদের জন্য সংগৃহীত, আর এগুলো আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। সে তার মা-বাবার ঘরে বসে থেকে দেখুক না কেন- তাকে উপহার দেওয়া হয় কি-না? যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর শপথ! যাকাতের সম্পদ থেকে যে কেউ তার কিছুমাত্র আত্মসাৎ করবে ক্বিয়ামতের দিন সে তা নিজ ঘাড়ে বহন করে হাযির হবে। যদি সেটা একটা উট হয় তাহ’লে সে তাকে নিয়ে হাযির হবে আর সেটা তার নিজ স্বরে ডাকতে থাকবে। যদি তা গরু হয় তবে যখন সে তা নিয়ে হাযির হবে তখন তা হাম্বা হাম্বা করে ডাকতে থাকবে। আর যদি ছাগল হয় তবে উপস্থিতকালে তা ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। আমি (তোমাদের কাছে) পৌঁছে দিলাম। আবু হুমায়েদ (রাঃ) বলেন, ‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাত এতখানি উঁচু করলেন যে, আমরা তাঁর দু’বগলের শুভ্র রঙ দেখতে পাচ্ছিলাম’।[21]


[1]. মুসলিম হা/১৭৫৩
[2]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৪০৩৩, সনদ সহীহ।
[3]. আল-ফাতহুর রববানী ১৪/৮৪
[4]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৪০৩৩, সনদ যঈফ; হায়ছামী বলেন, এর রাবীগণ নির্ভরযোগ্য। দ্রঃ মাজমাউয যওয়ায়েদ ২/৫৩৫।।
[5]. আল-মুসনাদ ৫/৪৫৫; হায়ছামী বলেছেন, আহমাদের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, বলিষ্ঠ। দ্র. আল-মাজমা’ ১/২৯১
[6]. হায়ছামী বলেছেন, তাবারানীর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। আল-মাজমা‘ ৯/৩৪৯, তাবারানী আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৩৮০১
[7]. সিলসিলা সহীহাহ হা/২৬০৮, ইবনু কাছীর হাদীসটি সূরা হুজুরাতের তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, ৭/৩৬৩ প্রকাশক : দারুশ শা‘ব
[8]. বুখারী হা/৪৬৪০
[9]. বুখারী হা/৩৬৬১
[10]. বুখারী হা/৪১৪১; মুসলিম হা/২৭৭০
[11]. নাসাঈ হা/৫৪১৩, সনদ সহীহ
[12]. আহমাদ হা/২২৯১৪, সনদ সহীহ
[13]. ইবনু মাজাহ হা/৮৫, যাওয়ায়েদ গ্রন্থে আছে- এই হাদীসের সনদ সহীহ, এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। সহীহ ইবনু মাজাহতে বলা হয়েছে, সনদ হাসান, হাদীস নং ৬৯
[14]. ইবন আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, তাহকীক : আলবানী নং ৪০৬। তিনি বলেছেন, এটির সনদ হাসান
[15]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৫১৯৫, ৩/৩৮৭। ইরওয়াউল গালীল, হা/১৫৮৯, আলবানী, সনদ হাসান
[16]. দারেমী হা/৪৩৫; মিশকাত হা/১৯৪, সনদ সহীহ
[17]. হায়ছামী মাজমা ‘গ্রন্থে বলেছেন, হাদীসটি তাবারানী তার আল-কাবীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এর সনদে আবু আমের আল-কাসিম বিন মুহাম্মাদ আল-আসাদী নামে একজন লোক আছেন। আমি তার জীবনী আলোচনা করতে কাউকে পাইনি। অন্যান্য বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। আল-মাজমা’ ১/১৭৪
[18]. বুখারী হা/৪০৫
[19]. বুখারী হা/৭১৫৯
[20]. বুখারী হা/২৪২৭; ফাৎহুল বারী হা/২৪৩৬
[21]. বুখারী হা/৬৬৩৬



সূত্র: আত-তাহরীক।​
 
Last edited:
Top