‼️ পোস্টটি সুন্দরভাবে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।‼️

প্রবন্ধ ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (শেষ কিস্তি)

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,544
Credits
2,602
(২৬) ভুলকারী থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং এই আশায় বিতর্ক পরিহার করা যে, সে সঠিক পথে ফিরে আসবে :

ইমাম বুখারী আলী বিন আবু তালিব (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم طَرَقَهُ وَفَاطِمَةَ عَلَيْهَا السَّلاَمُ بِنْتَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لَهُمْ أَلاَ تُصَلُّونَ. فَقَالَ عَلِىٌّ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّمَا أَنْفُسُنَا بِيَدِ اللهِ، فَإِذَا شَاءَ أَنْ يَبْعَثَنَا بَعَثَنَا، فَانْصَرَفَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم حِينَ قَالَ لَهُ ذَلِكَ وَلَمْ يَرْجِعْ إِلَيْهِ شَيْئًا، ثُمَّ سَمِعَهُ وَهْوَ مُدْبِرٌ يَضْرِبُ فَخِذَهُ وَهْوَ يَقُولُ : (وَكَانَ الإِنْسَانُ أَكْثَرَ شَىْءٍ جَدَلاً)-​

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে তাঁর ও রাসূল তনয়া ফাতিমা (রাঃ)-এর দরজায় করাঘাত করেন। তিনি তাদেরকে বলেন, তোমরা কি সালাত আদায় করবে না? আলী (রাঃ) বলেন, আমি তখন বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের প্রাণ তো আল্লাহর হাতে। সুতরাং তিনি যখন আমাদের ঘুম থেকে জাগাতে চাইবেন তখন আমরা জাগব। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের ভালমন্দ কোন কিছু না বলে পিছন ফিরলেন। তাঁর ফিরে যাওয়ার পথে আলী (রাঃ) তাঁকে উরুদেশে করাঘাত করতে করতে একথা বলতে শুনলেন- ‘মানুষ সবচেয়ে বেশী বিতর্কপ্রিয়’। আলী (রাঃ)-এর এই বর্ণনার মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে।[1]

(২৭) ভুলকারীকে তিরস্কার করা :

হাতেব (রাঃ)-কে নবী করীম (ﷺ) এরূপ কারণে তিরস্কার করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের জন্য মুসলমানরা সংকল্প করছে- এমন কথা জানিয়ে হাতেব (রাঃ) কুরাইশ কাফিরদের নিকট একটি পত্র দূত মারফত পাঠিয়েছিলেন। তার এ ভুলের জন্য নবী করীম (ﷺ) তাকে বলেন, তুমি যা করেছ সেজন্য তোমাকে কিসে প্ররোচিত করেছে? তিনি বললেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মুমিন বৈ নই। আমার দ্বীন-ধর্মও আমি বদলে ফেলিনি। আমি শুধু এই ইচ্ছা পোষণ করেছি যে, কুরাইশ গোত্রের প্রতি আমার একটা অনুগ্রহ থাকুক- যার বদৌলতে মক্কায় আল্লাহ তা‘আলা আমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদকে হেফাযত করবেন। আর সেখানে আপনার অন্যান্য সাহাবীদের এমন লোক আছেন যাদের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদের পরিবার ও সম্পদের নিরাপত্তা দান করবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সে সত্য বলেছে। সুতরাং তোমরা তাকে ভাল বৈ বল না। তখন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলে উঠলেন, সে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং মুমিনদের সাথে গাদ্দারি করেছে। সুতরাং আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দেই। কিন্তু তিনি বললেন, হে ওমর! তোমার কি জানা নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা বদর যোদ্ধাদের সম্পর্কে ভাল অবগত আছেন। তাই তো তিনি বলেছেন, তোমরা যা ইচ্ছা তাই করো। তোমাদের জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেছে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথায় ওমর (রাঃ)-এর দু’চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বলতে লাগলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত।[2]

এ ঘটনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। যেমন-

১. নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক বড় ভুলকারী একজন সাহাবীকে ‘কি জন্যে তুমি এমন কাজ করলে’ বলে ভৎর্সনা করা।

২. ভুলকারীর ভুলের পেছনে নিহিত কারণ উদঘাটন করা, যাতে তার ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।

৩. মহাজন ও অগ্রস্থানীয় লোকেরাও বড় বড় পাপ থেকে মুক্ত নন।

৪. প্রশিক্ষণদাতা বা অভিভাবকের মন প্রশস্ত হওয়া উচিত। তাতে করে তিনি তার সাথীদের ভুল-ভ্রান্তি মেনে নিয়ে চলতে পারেন। সঙ্গীরাও তাঁর থেকে সমান আচরণ লাভ করতে পারে। মোটের উপর উদ্দেশ্য তো তাদের সংশোধন, তাদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়া নয়।

৫. প্রশিক্ষণদাতা বা অভিভাবকের সাথী যারা থাকে তাদের মানবীয় দুর্বলতাকে হিসাবে নেওয়া উচিত। কখনো কখনো কিছু বড় মাপের লোকদের থেকে বড়সড় কোন ভুল কিংবা কদাচার হয়ে গেলে তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনা ভাল।

৬. ভুলকারীদের মধ্যে যিনি নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য তাকে নিরাপত্তা দেওয়া।

৭. ভুলকারীর যখন পূর্বেকার ভাল ভাল কাজ থাকবে তখন তার ভুল-ভ্রান্তির সাথে সেগুলোরও হিসাব রাখা এবং তদনুযায়ী তার অবস্থান নির্ণয় করা।

(২৮) ভুলকারীকে কটু কথা বলা :

চোখের সামনে স্পষ্ট অপরাধ দেখে চুপ থাকা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে অপরাধীকে ভৎর্সনা করা একান্ত কর্তব্য। যাতে সে তার ভুল বুঝতে পারে।

ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের গনীমত থেকে আমি আমার অংশে একটি বয়ষ্ক উট পেয়েছিলাম, আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর খুমুস (গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ) থেকে আমাকে একটি বড় উট দিয়েছিলেন। তারপর যখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-এর সঙ্গে বাসর শয্যা রচনার পরিকল্পনা করলাম তখন আমি বনু কায়নুকা গোত্রীয় একজন স্বর্ণকারের সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হ’লাম যে, সে আমার সাথে যাবে। আমরা ইযখির ঘাস এনে স্বর্ণকারদের কাছে বেচব এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ আমার বিয়ের ওয়ালীমার কাজে লাগাব। এজন্যে আমি আমার উট দু’টোর হাওদা, বস্তা, রশি ইত্যাদি সরঞ্জাম যোগাড়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমার উট দু’টো তখন এক আনছার সাহাবীর কুঁড়েঘরের পাশে বসা অবস্থায় ছিল। যা কিছু আমার সংগ্রহ করার ছিল তা সংগ্রহ করে আমি যখন ফিরে এলাম তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার উট দু’টোর চুঁট কেটে ফেলা হয়েছে এবং ওদের বুক চিরে কলিজা বের করে নেওয়া হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমি আর আমার চোখের পানি সামলাতে পারলাম না। আমি বললাম, এ কাজ কে করেছে? লোকেরা বলল, হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব। সে এখন এই বাড়িতে আনছারদের একদল নেশাখোরের সাথে আছে। আমি সোজা নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে চলে গেলাম, তাঁর কাছে তখন যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ) ছিলেন। নবী করীম (ﷺ) আমার চেহারা দেখেই আমার কষ্টের কথা বুঝে ফেললেন। তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি হয়েছে? আমি বললাম, হে রাসূল আল্লাহ (ﷺ), আজকের মত ঘটনার মুখোমুখি আর কখনো হইনি। হামযাহ আমার উট দু’টোর উপর চড়াও হয়ে তাদের চুঁট কেটে ফেলেছ এবং ওদের বুক চিরে দু’ভাগ করে দিয়েছে। এখন সে অমুক বাড়িতে আছে, আর তার সাথে আছে একদল নেশাখোর। নবী করীম (ﷺ) তাঁর চাদর চেয়ে নিলেন এবং হেঁটে রওয়ানা দিলেন। আমি ও যায়েদ তাঁর পিছনে পিছনে গেলাম। তিনি ঐ বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন সেখানে হামযাহ (রাঃ) ছিলেন। তিনি বাড়ীতে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। তারা অনমুতি দিল। ঢুকেই তিনি নেশাখোরদের মুখোমুখি হ’লেন। এবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হামযাহ যে কাজ করেছেন সেজন্য তাকে গালমন্দ করতে লাগলেন। এদিকে হামযার নেশা চড়ে গিয়েছিল। তার চোখ দু’টো লাল হয়ে উঠেছিল। এবার হামযাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে (কটমট করে) তাকালেন আর নযর চড়াতে লাগলেন। প্রথমে তিনি তাঁর হাঁটুর দিকে তাকালেন, তারপর নযর উঠিয়ে নাভির দিকে তাকালেন, তারপর নযর উঠিয়ে তাঁর চেহারার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর হামযাহ বললেন, তুমি আমার পিতার দাস ছিলে না? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বুঝতে পারলেন, তাকে নেশায় পেয়ে বসেছে। তিনি পিছু হটে এলেন, আর আমরাও তাঁর সাথে বেরিয়ে এলাম।[3]

(২৯) ভুলকারী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া :

ইমাম আহমাদ (রহঃ) হুমায়েদ হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি ও আমার জনৈক বন্ধু এক সাথে ছিলাম, এমন সময় ওয়ালীদ আমার কাছে এলেন। তিনি বললেন, তোমরা দু’জন আমার থেকে বয়সে বেশী যুবক, হাদীসও আমার থেকে বেশী স্মরণ রাখতে পার, কাজেই চল যাই। এই বলে সে আমাদেরকে বিশর বিন আছেমের নিকট নিয়ে গেল। তখন আবুল আলীয়া নামক একজন বলল, তুমি এ দু’জনকে হাদীস শোনাও। সে বলল, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন উকবা বিন মালিক। তিনি বলেছেন আবুন নযর আল-লায়ছী থেকে, তিনি বলেছেন, বাহয (রাঃ) থেকে। বাহয আবুন নযরের গোত্রের লোক। তিনি (বাহয) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একজন সাহাবীর নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। তারা এক গোত্রকে আক্রমণ করে। ঐ গোত্রের একজন লোক দৌড়ে ভেগে যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে সেনাদলের একজন তলোয়ার উঁচিয়ে তার পশ্চাদ্ধাবন করল। তখন ঐ পলায়নপর লোকটি বলল, নিশ্চয়ই আমি একজন মুসলিম। কিন্তু তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে সে তলোয়ারের আঘাতে তাকে হত্যা করল। একথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কানে পৌঁছলে তিনি তার সম্পর্কে খুব কঠিন একটা কথা বলেন। সে কথা হত্যাকারীর কানে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আমাদের মাঝে খুৎবা দিচ্ছিলেন তখন ঐ হত্যাকারী বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ আল্লাহর কসম! ঐ লোকটা যা বলেছিল তা কেবল হত্যা থেকে বাঁচার জন্যই বলেছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার ও তার দিকের সকল লোকের থেকে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন এবং খুৎবা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর সে আবার বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ ঐ লোকটা যা বলেছিল তা কেবল হত্যা থেকে বাঁচার জন্যই বলেছিল। কিন্তু এবারও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার ও তার দিকের সকল লোক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং খুৎবা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এবার আর লোকটার সহ্য হ’ল না। তৃতীয়বার সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম! সে হত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্যই উক্ত কথা বলেছিল। এবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার দিকে ফিরে তাকালেন। তাঁর মুখমন্ডলে বেদনার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি তাকে লক্ষ্য করে তিনবার বললেন,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أَبَى عَلَى مَنْ قَتَلَ مُؤْمِناً ثَلاَثَ مَرَّاتٍ.​

‘নিশ্চয়ই মহামহিম আল্লাহ তা‘আলা মুমিনের হত্যাকারীকে অপসন্দ করেন’।[4]

নাসাঈ (রহঃ) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন যে,

أَنَّ رَجُلاً قَدِمَ مِنْ نَجْرَانَ إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهِ خَاتَمٌ مِنْ ذَهَبٍ فَأَعْرَضَ عَنْهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَقَالَ : إِنَّكَ جِئْتَنِى وَفِى يَدِكَ جَمْرَةٌ مِنْ نَارٍ-​

‘নাজরান থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আসল। তার আঙ্গুলে একটা সোনার আংটি ছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, তোমার হাতে জাহান্নামের একটা অঙ্গার নিয়ে তুমি আমার কাছে এসেছ’।[5]

ইমাম আহমাদ (রহঃ) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে এর চাইতেও বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, নাজরানের এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আসল। তার হাতে একটা সোনার আংটি ছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি তাকে কোন কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। লোকটি তার স্ত্রীর কাছে ফিরে গিয়ে বিষয়টা তাকে বর্ণনা করল। স্ত্রী তাকে বলল, নিশ্চয়ই তোমার গুরুতর কিছু হয়েছে। সুতরাং তুমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে যাও। সে তাঁর কাছে ফিরে এল। তার সেই আংটি আর গায়ের জুববা সে খুলে ফেলল। অতঃপর তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি অনুমতি দিলে সে তাঁর নিকট ঢুকে তাঁকে সালাম দিল। তিনি সালামের উত্তর দিলেন। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইতিপূর্বে আমি আপনার কাছে আসলে আপনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন কেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তুমি তখন তোমার হাতে জাহান্নামের একটা অঙ্গার পরে এসেছিলে। লোকটা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), এখন তো আমি অনেক অঙ্গার নিয়ে এসেছি। সে বাহরাইন থেকে অনেক অলঙ্কার সাথে করে এনেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তুমি যা এনেছ তা আমাদের কোনই কাজে লাগবে না; কেবল হাররার পাথর যা কিছু কাজে লাগবে। তবে এ সবই পার্থিব জীবনের ভোগ্যপণ্য। এবার লোকটা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), আপনি আপনার সাহাবীদের মাঝে আমার পক্ষ থেকে ওযর তুলে ধরুন- যাতে তারা ধারণা না করে যে, আপনি কোন বিষয়ে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার ওযর তুলে ধরলেন এবং তার থেকে কি ঘটেছে তা জানিয়ে দিলেন। তা ঘটেছিল সোনার আংটি পরাকে কেন্দ্র করে।[6]

(৩০) ভুলকারীকে বয়কট করা :

ভুল দূরীকরণে নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক গৃহীত এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি। বিশেষ করে যদি ভুলের মাত্রা হয় বড় মাপের। এ বয়কট ও একঘরে অবস্থা ভুলকারীর মনে চরমভাবে রেখাপাত করে। এর উদাহরণ কা‘ব বিন মালিক ও তার দুই সাথীর ঘটনা। তারা তিন জন তাবুক যুদ্ধে যোগদান না করায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও মুসলিম সমাজ কর্তৃক বয়কটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাবুক যুদ্ধ ছিল তৎকালীন পরাশক্তি রোমকদের বিরুদ্ধে। মুসলমানদের জনবল অর্থবল উভয়ই কম ছিল। তাই সঙ্গত কারণ ছাড়া সকল সক্ষম পুরুষের যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু মুনাফিকরা ইচ্ছে করেই এ যুদ্ধে যোগ দেয়নি। যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় ফিরে এলে তারা নানা অজুহাত ও কারণ দেখিয়ে মুক্তির আবদার করে। যদিও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে তাদের কথা আগেই অহি-র মাধ্যমে জানান হয়েছিল। তবুও তাদের মাফ করে দেওয়া হয়। কিন্তু কা‘ব বিন মালিক ও তার দুই সাথী মুনাফিকদের মত অজুহাত না দেখিয়ে বলেন, তারা ইচ্ছে করেই যুদ্ধে যাননি।

নবী করীম (ﷺ)ও নিশ্চিত হন যে তাদের যুদ্ধে যোগদান না করার সঙ্গত কোন কারণ ছিল না এবং কা‘ব (রাঃ) নিজেও তা স্বীকার করেন।

কা‘ব (রাঃ) নিজে বলেছেন, যারা তাবুক যুদ্ধে যোগদান না করে বসেছিল তাদের মধ্যে আমাদের তিনজনের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কথা বলতে নিষেধ করে দেন। লোকেরা আমাদের এড়িয়ে চলতে থাকে। তাদের আচরণ আমাদের জন্য একেবারে পাল্টে যায়। এমনকি আমার মনে হ’তে থাকে এ ভূমি আমার অপরিচিত। এ যেন আমার চেনাজানা সেই দেশ নয়। এভাবে আমাদের পঞ্চাশ রাত কেটে যায়। আমার দুই সাথী খুবই ম্রিয়মান হয়ে পড়ে এবং ঘরে বসে কাঁদতে থাকে। আমি ছিলাম তাদের মধ্যে তুলনামূলক যুবক, শরীরেও ছিল বলশক্তি বেশী। তাই আমি বাড়ীর বাইরে বের হ’তাম, মুসলমানদের সাথে সালাতের জামা‘আতে শরীক হ’তাম, বাজারেও ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু আমার সাথে কেউ কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে, তাঁকে সালাম দিতাম, তিনি যখন সালাত শেষে তাঁর জায়গায় অবস্থায় করতেন তখন আমি সালাম দিতাম। আমি লক্ষ্য করতাম যে, আমার সালামের উত্তর দিতে তাঁর ঠোঁট দু’টো নড়ে কি-না। আবার আমি তাঁর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতাম, আর চুরি করে তাকাতাম। যেই আমি আমার সালাতে মন দিতাম অমনি তিনি আমার দিকে লক্ষ্য করতেন। আবার যেই আমি আড় চোখে তাঁর দিকে তাকাতাম অমনি তিনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে মানুষের বৈরী আচরণ যখন দীর্ঘায়িত হ’তে থাকে তখন একদিন আমি হাঁটতে হাঁটতে আমার চাচাত ভাই ও সবচেয়ে প্রিয়ভাজন মানুষ আবু কাতাদার খেজুর বাগানের প্রাচীর বেয়ে তার কাছে উপস্থিত হই এবং সালাম দেই। কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের উত্তর দিল না। তখন আমি বললাম, হে আবু কাতাদা! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জান যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি? কিন্তু সে চুপ করে থাকল। আমি আল্লাহর কসম দিয়ে তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম। এবারও সে চুপ করে থাকল। আবারও আমি তাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। এবার সে বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশী জানেন। এ কথায় আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। প্রাচীর বেয়ে আমি সেখান থেকে ফিরে এলাম... এভাবে কা‘ব (রাঃ) তাঁর ঘটনার শেষ পর্যায়ে বলেন, এমনি করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা নিষেধের পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হ’ল। পঞ্চাশতম রাতের সকালে আমি ফজর সালাত আদায় করে আমাদের একটা ঘরের চালে উঠে বসে ছিলাম। আল্লাহ পাক কুরআনে যেমন বলেছেন, তেমন করেই আমার জন্য আমার জীবন সংকীর্ণ হয়ে এসেছিল এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। আমার দুশ্চিন্তা মগ্ন অবস্থাতেই আমি সালা‘ (سَلْعٍ) পাহাড়ের শিখর থেকে একজন চীৎকারকারীকে তার স্বরে বলতে শুনলাম, হে কা‘ব বিন মালিক! সুসংবাদ শোন।[7]

এ ঘটনার মধ্যে অনেক ফায়েদা ও শিক্ষণীয় উপদেশ রয়েছে, যা হাতছাড়া করা কোন অবস্থাতেই উচিত নয়। আলেমরা ঘটনাটির ব্যাখ্যাবলী যা তাদের বই-পুস্তকে লিখেছেন তা থেকে সেসব ফায়েদা ও শিক্ষা জানা সম্ভব। যেমন যাদুল মা‘আদ (زاد المعاد) ও ফাৎহুল বারী (فتح البارى)।

বয়কটের এই পদ্ধতি নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক অবলম্বনের পেছনের কারণ তিরমিযী (রহঃ) কর্তৃক উদ্ধৃত একটি হাদীস থেকেও মেলে।

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

مَا كَانَ خُلُقٌ أَبْغَضَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْكَذِبِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُحَدِّثُ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِالْكِذْبَةِ فَمَا يَزَالُ فِى نَفْسِهِ حَتَّى يَعْلَمَ أَنَّهُ قَدْ أَحْدَثَ مِنْهَا تَوْبَةً.​

‘মিথ্যা থেকে অধিক ঘৃণিত আর কোন চারিত্রিক আচরণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ছিল না। নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট কোন ব্যক্তি মিথ্যা বললে সে মিথ্যা অনুক্ষণ তাঁর অন্তরে গেঁথে থাকত, যে পর্যন্ত না তিনি জানতে পারেন যে লোকটি তওবা করেছে’।[8]

আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,

فَمَا يَزَالُ فِى نَفْسِهِ عَلَيْهِ​

‘মিথ্যুকের বিরুদ্ধে অনুক্ষণ তাঁর অন্তরে’...।[9] আরেক বর্ণনায় আছে,

وما اطلع منه على شيء عند أحد من أصحابه فيبخل له من نفسه حتى يعلم أن ( قد ) أحدث توبة​

‘তাঁর সাহাবীদের কারো থেকে যদি তিনি মিথ্যা কিছু জানতে পারতেন তাহ’লে তাঁর মনটা তার প্রতি অপ্রসন্ন হয়ে পড়ত, যে পর্যন্ত না তিনি জানতে পেতেন যে, সে তওবা করেছে’।[10] আরেক বর্ণনায় আছে, তিনি যদি তাঁর পরিবারভুক্ত কাউকে মিথ্যা বলার কথা জানতে পারতেন তাহ’লে তার ঐ মিথ্যা থেকে তওবা করার কথা না জানা পর্যন্ত তিনি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন।[11]

পূর্ববর্তী বর্ণনাগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ভুলকারীর নিজের ভুল থেকে ফিরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত তার মুখ ফিরিয়ে থাকা ও সংস্রব বর্জন করা একটি উপকারী শিক্ষণীয় পদ্ধতি। তবে এ পদ্ধতিকে উপকারী করতে হ’লে অবশ্যই যার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে তথা বয়কট করা হয়েছে তার মনে বয়কটকারী মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ব্যক্তির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসন থাকতে হবে। নচেৎ এতে কোন ইতিবাচক ফল না ফলে বরং বয়কটকৃত লোকটার মনে হবে, ওরা আমাকে ত্যাগ করেছে না; বেঁচেছি।

(৩১) ঘাড়তেড়া ভুলকারীর বিরুদ্ধে বদদো‘আ :

ইমাম মুসলিম (রহঃ) বর্ণনা করেছেন,

أَنَّ رَجُلاً أَكَلَ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِشِمَالِهِ فَقَالَ : كُلْ بِيَمِيْنِكَ. قَالَ لاَ أَسْتَطِيْعُ قَالَ لاَ اسْتَطَعْتَ. مَا مَنَعَهُ إِلاَّ الْكِبْرُ. قَالَ فَمَا رَفَعَهَا إِلَى فِيهِ​

‘এক লোক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাশে বাম হাত দিয়ে খাচ্ছিল। তিনি তাকে বললেন, তোমার ডান হাত দিয়ে খাও। সে বলল, আমি পারি না। তিনি বললেন, তুমি যেন আর না পারো। অহংকারবশতঃ সে ডান হাত ব্যবহার করত না। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর থেকে সে তার ডান হাত আর মুখ পর্যন্ত তুলতে পারত না’।[12]

আহমাদের এক বর্ণনায় এসেছে, ইয়াস বিন সালামা ইবনুল আকওয়া হ’তে বর্ণিত, তার পিতা তার নিকট বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

يَقُولُ لِرَجُلٍ يُقَالُ لَهُ بُسْرُ بْنُ رَاعِى الْعِيرِ أَبْصَرَهُ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ فَقَالَ كُلْ بِيَمِينِكَ. فَقَالَ لاَ أَسْتَطِيعُ. فَقَالَ لاَ اسْتَطَعْتَ. قَالَ فَمَا وَصَلَتْ يَمِينُهُ إِلَى فَمِهِ بَعْدُ-​

‘বুসর বিন রা‘ঈ আল-ঈর নামক এক ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাম হাত দিয়ে খেতে দেখতে পেলেন। এ সময় আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, তুমি তোমার ডান হাত দিয়ে খাও। সে বলল, আমি পারি না। তিনি বললেন, তুমি যেন তা আর না পার। বর্ণনাকারী সালামা (রাঃ) বলেন, এরপর থেকে সে তার ডান হাত তার মুখ পর্যন্ত আর তুলতে পারত না’।[13]

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘এ হাদীস থেকে বিনা ওযরে যে শরী‘আতের বিধান লংঘন করে তার বিরুদ্ধে বদদো‘আর বৈধতা মেলে। এতে আরো বুঝা যায় যে, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ সর্বাবস্থাতেই করতে হবে- এমন কি খাওয়ার সময়েও।

(৩২) ভুলকারীর প্রতি করুণাবশত কিছু ভুল ধরা এবং কিছু ভুল উপেক্ষা করা, যাতে ইশারা-ইঙ্গিতে পুরো ভুলটা উপলব্ধিতে আসে :

সূরা আত-তাহরীমের ৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلَى بَعْضِ أَزْوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَتْ بِهِ وَأَظْهَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ عَرَّفَ بَعْضَهُ وَأَعْرَضَ عَنْ بَعْضٍ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِ قَالَتْ مَنْ أَنْبَأَكَ هَذَا قَالَ نَبَّأَنِيَ الْعَلِيمُ الْخَبِيرُ-​

‘যখন নবী তাঁর স্ত্রীদের একজনকে একান্ত চুপিসারে কিছু কথা বললেন এবং সে তা (অন্যের নিকট) প্রকাশ করে দিল, আর আল্লাহ তাঁকে (অহি-র মাধ্যমে) বিষয়টি জানিয়ে দিলেন। তখন তিনি কিছু কথা গোপনীয়তা প্রকাশকারী স্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন এবং কিছু কথা এড়িয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি যখন তাকে (গোপনীয়তা প্রকাশকারী স্ত্রীকে) কিছু কথা জানালেন তখন সে বলল, আপনাকে এ খবরটা কে জানালো? তিনি বললেন, আমাকে (আল্লাহ) জানিয়েছেন, যিনি সর্বজ্ঞ, সব কিছুর খবর রাখেন’ (তাহরীম ৬৬/৩)

আল-কাসেমী (রহঃ) ‘মাহাসিনুত তাবীল’ গ্রন্থে বলেছেন :

(وإذ أسرّ النبي) ‘যখন নবী একান্ত চুপিসারে বললেন’ অর্থাৎ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) (إلى بعض أزواجه) তার একজন স্ত্রীর কাছে, তিনি হাফছাহ (রাঃ)-কে (حديثا) একটি কথা বলেন তাহ’ল তাঁর দাসীকে হারাম করার কথা, অথবা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জন্য হালাল করেছেন এমন কোন কিছু তাঁর নিজের উপর তিনি হারাম করে নিয়েছিলেন। (فلما نبأت به) অতঃপর সে যখন তা বলেছিল অর্থাৎ সেই গোপন কথা তার সতীন আয়েশা (রাঃ)-কে বলে দিল। (وأظهره الله عليه) আল্লাহ তা তাঁর নিকট তুলে ধরলেন অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার বিষয় তাঁকে জানিয়ে দিলেন। (عرّف بعضه) তিনি কিছু জানালেন অর্থাৎ তার প্রকাশ করে দেওয়া কথার কিছু তাকে জানালেন তিরস্কার করার সূত্রে (وأعرض عن بعض) এবং কিছু এড়িয়ে গেলেন অর্থাৎ কিছু কথা উপেক্ষা করলেন দয়াবশত।

‘আল-ইকলীল’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে যে, অন্তরঙ্গ নির্ভরযোগ্য যেমন স্ত্রী, বন্ধু এমন কারো নিকট কোন কথা গোপন রাখায় কোন দোষ নেই। এতে আরো রয়েছে যে, স্ত্রীদের সাথে সুন্দরভাবে মিলেমিশে বাস করতে হবে। তিরস্কার করতে হবে কোমল কণ্ঠে এবং অপরাধের গভীর পর্যন্ত অনুসন্ধানে নামা যাবে না।[14] আল-হাসান বলেছেন, কোন ভদ্রলোক কখনো অপরাধের শিকড় সন্ধান করে না। সুফইয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, অপরাধ উপেক্ষা করা ভদ্রলোকদের কাজ।

(৩৩) মুসলিমকে তার ভুল সংশোধনে সহযোগিতা করা :

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,

بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوْسٌ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ، فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ هَلَكْتُ. قَالَ : مَا لَكَ. قَالَ وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِى وَأَنَا صَائِمٌ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هَلْ تَجِدُ رَقَبَةً تُعْتِقُهَا. قَالَ لاَ. قَالَ فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ. قَالَ لاَ . فَقَالَ فَهَلْ تَجِدُ إِطْعَامَ سِتِّينَ مِسْكِينًا. قَالَ لاَ . قَالَ فَمَكَثَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم، فَبَيْنَا نَحْنُ عَلَى ذَلِكَ أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَقٍ فِيهَا تَمْرٌ وَالْعَرَقُ الْمِكْتَلُ قَالَ أَيْنَ السَّائِلُ. فَقَالَ أَنَا. قَالَ خُذْهَا فَتَصَدَّقْ بِهِ. فَقَالَ الرَّجُلُ أَعَلَى أَفْقَرَ مِنِّى يَا رَسُولَ اللَّهِ فَوَاللهِ مَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا يُرِيدُ الْحَرَّتَيْنِ أَهْلُ بَيْتٍ أَفْقَرُ مِنْ أَهْلِ بَيْتِى، فَضَحِكَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ ثُمَّ قَالَ أَطْعِمْهُ أَهْلَكَ-​

‘আমরা নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট বসা ছিলাম, এমন সময় এক লোক এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন, তোমার কি হ’ল? সে বলল, ছিয়াম পালনরত অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীর সাথে সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার কি একটা দাস মুক্ত করার সামর্থ্য আছে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহ’লে কি তুমি এক নাগাড়ে দুই মাস ছিয়াম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহ’লে কি ষাট জন মিসকীনকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) থেমে গেলেন। আমরা ঐ অবস্থায় থাকতে থাকতেই নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এক ঝুড়ি খেজুর এল। তিনি বললেন, সেই প্রশ্নকারী কোয়ায়? সে বলল, এই যে আমি। তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে দান করে দাও। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার থেকেও কি দরিদ্র শ্রেণীর উপরে? আল্লাহর কসম, মদীনার দুই পাথুরে প্রান্তের মাঝে আমার পরিবার থেকে অধিক দরিদ্র আর কোন পরিবার নেই। তার কথায় নবী করীম (ﷺ) এতটাই হেসে উঠলেন যে, তাঁর চোখা দাঁতগুলো বের হয়ে পড়ল। তারপর তিনি বললেন, তোমার পরিবারকেই খেতে দাও’।[15]

আহমাদের বর্ণনায় আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে,

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَا هُوَ جَالِسٌ فِى ظِلِّ فَارِعِ أُجُمِ حَسَّانَ جَاءَهُ رَجُلٌ فَقَالَ احْتَرَقْتُ يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ مَا شَأْنُكَ. قَالَ وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِى وَأَنَا صَائِمٌ. قَالَتْ وَذَاكَ فِى رَمَضَانَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم اجْلِسْ. فَجَلَسَ فِى نَاحِيَةِ الْقَوْمِ فَأَتَى رَجُلٌ بِحِمَارٍ عَلَيْهِ غِرَارَةٌ فِيهَا تَمْرٌ قَالَ هَذِهِ صَدَقَتِى يَا رَسُولَ اللهِ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم- أَيْنَ الْمُحْتَرِقُ آنِفاً. فَقَالَ هَا هُوَ ذَا أَنَا يَا رَسُولَ اللهِ . قَالَ خُذْ هَذَا فَتَصَدَّقْ بِهِ. قَالَ وَأَيْنَ الصَّدَقَةُ يَا رَسُولَ اللهِ إِلاَّ عَلَىَّ وَلِى فَوَالَّذِى بَعَثَكَ بِالْحَقِّ مَا أَجِدُ أَنَا وَعِيَالِى شَيْئاً. قَالَ فَخُذْهَا فَأَخَذَهَا-​

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাসসান (রাঃ)-এর কেল্লার চিলেকোঠার ছায়ায় বসে ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জ্বলেপুড়ে গেছি। তিনি বললেন, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি ছিয়াম অবস্থায় আমার স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করেছি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ ঘটনা ঘটেছিল রামাযান মাসে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, তুমি বস। সে মজলিসের এক প্রান্তে গিয়ে বসল। তখন একটি গাধা নিয়ে এক লোক উপস্থিত হ’ল। তার পিঠে একটি বস্তা ছিল, যাতে ছিল খেজুর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ আমার যাকাত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন বললেন, জ্বলেপুড়ে যাওয়া লোকটি কোথায়? সে বলল, এই যে আমি এখানে, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, এই বস্তাটা নাও এবং দান করে দাও। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উপরই দান আবশ্যক, আবার আমাকে ছাড়া আর কোথায় কাকে দান করব? যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! আমি ও আমার পরিবারের হাতে কিছু মাত্র নেই। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমিই নাও। অতঃপর সে তা নিয়ে গেল’।[16]

(৩৪) ভুলকারীর সাথে সাক্ষাৎ এবং আলোচনার জন্য তার সাথে বৈঠক :

সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমার পিতা এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দেন। তিনি তার পুত্রবধুকে দেখতে আসতেন আর তার স্বামী সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করতেন। বউমা তাকে বলত, সে কতই না একজন ভাল পুরুষ! আমার তার কাছে আসা অবধি না সে আমাদের বিছানায় পা রেখেছে, না আমাদের দেহের কোন দিক তালাশ করে দেখেছে। যখন বিষয়টি তার কাছে দীর্ঘ হয়ে দাঁড়াল তখন তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট বিষয়টি তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, তাকে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে বল। পরবর্তীতে আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, তুমি কিভাবে ছিয়াম পালন কর? আমি বললাম, প্রতিদিন। তিনি বললেন, কিভাবে কুরআন খতম কর? আমি বললাম, প্রতিরাতে। তিনি বললেন, তুমি প্রতি মাসে তিন দিন ছিয়াম রাখ এবং প্রতিমাসে একবার কুরআন খতম কর। আমি বললাম, আমি তা থেকে বেশী সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহ’লে সপ্তাহে তিন দিন ছিয়াম পালন কর। আমি বললাম, আমি তার থেকেও বেশী পারব। তিনি বললেন, একদিন ছিয়াম পালন কর, মাঝে দু’দিন বন্ধ রাখ। আমি বললাম, আমি তার থেকেও বেশী পারব। তিনি বললেন, তুমি উত্তম ছিয়াম দাঊদের ছিয়াম পালন কর। তা হ’ল একদিন ছিয়াম পালন পরদিন ছিয়াম ভঙ্গ। আর প্রতি সাত রাতে একবার কুরআন পড়া শেষ কর। আফসোস! আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেওয়া অবকাশ গ্রহণ করতাম। কেননা আমি এখন বয়স্ক ও দুর্বল হয়ে পড়েছি। ফলশ্রুতিতে তিনি তার পরিবারের কোন একজন সদস্যকে দিনের বেলায় কুরআনের এক-সপ্তমাংশ পড়ে শুনাতেন, আবার যাকে তিনি শুনাতেন সেও ঐ পরিমাণ তাকে শুনাত। এভাবে রাতের কষ্ট তার জন্য লাঘব হ’ত। আবার যখন তিনি দৈহিক বল বৃদ্ধির ইচ্ছে করতেন তখন কিছুদিন ছিয়াম পালন বন্ধ রাখতেন, তার হিসাবও রাখতেন। পরে সমপরিমাণ ছিয়াম (লাগাতার) পালন করতেন। যে আমলের উপর রেখে নবী করীম (ﷺ) তার থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন তার কিছুমাত্র ছেড়ে দেওয়া অপসন্দনীয় হওয়ার কারণে তিনি এভাবে করে ঠিক রাখতেন।[17]

আহমাদের বর্ণনায় আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা কুরাইশ বংশীয় একটি মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু ছিয়াম ও সালাতের মত ইবাদতে আমার খুব সামর্থ্য ও আগ্রহ ছিল, তাই তার সঙ্গে দেখা হওয়া অবধি আমি তাকে আতঙ্কিত করিনি। আমর বিন আছ (রাঃ) তার বউমাকে দেখতে এসে বলল, তোমার স্বামীকে কেমন পেলে? সে বলল, খুব ভাল পুরুষ অথবা খুব ভাল স্বামী। সে আমাদের দেহের কোন দিক খুঁজে দেখেনি এবং আমাদের বিছানার সাথেও তার পরিচয় ঘটেনি। তিনি আমার কাছে এসে আমাকে গালাগালি করলেন এবং কথা দিয়ে আঘাত করলেন। তিনি বললেন, আমি তোমাকে কুরাইশদের একটা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলাম আর তুমি কি-না তার সঙ্গে স্বামীসুলভ ব্যবহারই করলে না? তুমি তার সাথে এমন এমন করলে? তারপর তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকটে গিয়ে তাঁর নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। নবী করীম (ﷺ) তখন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তাঁর নিকট এলে তিনি বললেন, তুমি কি দিনে ছিয়াম পালন কর? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কিন্তু আমি ছিয়াম পালন করি, ছিয়াম বন্ধ রাখি, সালাত আদায় করি, ঘুমাই, স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করি। যে আমার সুন্নাতের প্রতি বিমুখতা দেখাবে সে আমার দলভুক্ত থাকবে না। তিনি বললেন, তুমি প্রতি মাসে একবার কুরআন শেষ কর। আমি বললাম, আমি এর চেয়েও কম সময়ে শেষ করার সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহ’লে প্রতি দশ দিনে একবার পড়। আমি বললাম, আমি এর চেয়েও কম সময়ে শেষ করার সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহ’লে তিন দিনে একবার পড়া শেষ কর। তারপর তিনি বললেন, তুমি প্রতিমাসে তিন দিন ছিয়াম পালন করবে। আমি বললাম, আমি তার থেকেও বেশী সামর্থ্য রাখি। তিনি আমাকে বাড়াতে বাড়াতে শেষ পর্যন্ত বললেন, একদিন ছিয়াম পালন কর, পরদিন ভঙ্গ কর। এটাই উত্তম ছিয়াম। আমার ভাই দাঊদ (আঃ) এভাবে ছিয়াম পালন করতেন। হুছাইন তার বর্ণনায় বলেছেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, প্রত্যেক ইবাদতকারীর মধ্যে একটা তেজীভাব থাকে, আর প্রত্যেক তেজীভাবের সাথে একটা অবসাদ জড়িয়ে থাকে। এই অবসাদ তাকে পরবর্তীতে হয় সুন্নাতের দিকে নিয়ে যায় অথবা বিদ‘আতের দিকে নিয়ে যায়। যার অবসাদ তাকে সুন্নাতের দিকে নিল সে তো আল্লাহর পথ পেয়ে গেল। আর যার অবসাদ তাকে অন্য দিকে নিল সে ধ্বংস হয়ে গেল।

মুজাহিদ বলেন, পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ বিন আমর যখন দুর্বল ও বয়স্ক হয়ে পড়লেন তখন মাঝে বাদ না দিয়ে কয়েকদিন ধরে ছিয়াম পালন করতেন। তারপর হিসাব অনুযায়ী ক’দিন ছিয়াম বন্ধ রাখতেন, আর এভাবে তিনি দেহের শক্তি সঞ্চয় করতেন। আর কুরআন পাঠের ভাগও তিনি কম বেশী করতেন। তবে তিনি সংখ্যা ঠিক রাখতেন। হয় সাত দিনে, নয় তিন দিনে খতম করতেন। এ সময় তিনি বলতেন, আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেওয়া ছাড় গ্রহণ করতাম তাহ’লে সেটাই হ’ত আমার জন্য তার বিনিময়ে দেয় যে কোন কিছুর থেকে প্রিয়। কিন্তু আমি তাঁর মৃত্যুকালে যে আমলের উপর তাঁকে বিদায় জানিয়েছি তার ব্যতিক্রম করে অন্য কিছু করা আমার অপসন্দ।[18]

ঘটনার ফায়েদাসমূহ :

নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক বৈবাহিক সমস্যার কারণ উদঘাটন। বেশী বেশী ইবাদতে মশগূল থাকার ফলে স্ত্রীর হক আদায়ের সুযোগ না পাওয়া। এখানেই হয়েছে ত্রুটি।

‘প্রত্যেক হকদারের হক দিয়ে দাও’ এই সূত্র ও নীতি সৎকাজে লিপ্ত প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যে শিক্ষার্থী পড়ায় বেশীমাত্রায় মশগূল, যে দাঈ (ইসলাম প্রচারক) প্রচার কাজে ডুবে থাকে তার বা তাদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অভিযোগ খুবই স্বাভাবিক। এটার উদ্ভব ঘটে বিভিন্ন সৎকাজ প্রতিপালনে মাত্রাজ্ঞানের অভাব এবং হকদারদের জন্য সময় বণ্টন না করার কারণে। সুতরাং পড়ুয়ার পড়ার সময় এবং দাঈর দাওয়াতের কাজ একটু কমিয়ে ঘর গৃহস্থালি, স্ত্রী ও সন্তানাদির দেখভাল করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দ করায় কোন সমস্যা নেই। পরিবারের সদস্যদের সংশোধন, একত্রে বসবাস ও তাদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দানে সময় ব্যয় একান্ত যরূরীও বটে।

(৩৫) ভুলকারীর মুখের উপর তার অবস্থা ও ভুলের কথা বলে দেওয়া :

ইমাম বুখারী (রহঃ) আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

كَانَ بَيْنِى وَبَيْنَ رَجُلٍ كَلاَمٌ، وَكَانَتْ أُمُّهُ أَعْجَمِيَّةً، فَنِلْتُ مِنْهَا فَذَكَرَنِى إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لِى أَسَابَبْتَ فُلاَنًا. قُلْتُ نَعَمْ. قَالَ أَفَنِلْتَ مِنْ أُمِّهِ. قُلْتُ نَعَمْ. قَالَ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ. قُلْتُ عَلَى حِينِ سَاعَتِى هَذِهِ مِنْ كِبَرِ السِّنِّ قَالَ نَعَمْ، هُمْ إِخْوَانُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ جَعَلَ اللهُ أَخَاهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ، فَإِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ-​

‘আমার ও এক ব্যক্তির মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। তার মা ছিল অনারব। আমি তার প্রসঙ্গ তুলে গালি দেই। সে আমার কথা নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট উল্লেখ করে। তিনি আমাকে বলেন, তুমি কি অমুককে গালি দিয়েছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি তার মায়ের নামে গালি দিয়েছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তুমি এমন একজন লোক, যার মধ্যে জাহিলিয়াত বিরাজ করছে। আমি বললাম, আমার এই বুড়ো বয়সেও কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারা (দাসরা) তোমাদের ভাই, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার ভাইকে আল্লাহ তা‘আলা তার অধীন করে দিয়েছেন সে নিজে যা খায় তা থেকে যেন তাকে খেতে দেয়, সে নিজে যা পরে তাকে তা থেকে পরতে দেয়। তাকে এমন কাজের দায়িত্ব না চাপায় যা সে করতে সমর্থ নয়। যদি তার সামর্থ্যের বাইরে কোন কাজ চাপায় তাহ’লে যেন তাকে সাহায্য করে’।[19]

সহীহ মুসলিমে আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমার ও আমাদের ভাইদের মধ্যস্থিত এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তার মা ছিল অনারব। ফলে আমি তার মাকে তুলে তাকে অপমান করি। সে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। আমি নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে দেখা করলাম। তিনি বললেন, হে আবু যার! তুমি এমন একজন লোক যার মধ্যে জাহিলিয়াত বিরাজ করছে। আমি বললাম, এটা তো নিয়ম যে, যে ব্যক্তি লোকেদের গালি দিবে তারাও তার বাপ-মা তুলে গালি দিবে। তিনি বললেন, হে আবু যার! তুমি এমন একজন লোক যার মধ্যে জাহিলিয়াত বিরাজ করছে। তারা (দাসরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা যা খাও তাদেরকে তা থেকে খেতে দাও, আর তোমরা যা পর তাদেরকে তা থেকে পরতে দাও। তাদেরকে এমন কাজের দায়িত্ব দিও না যা তাদের সাধ্যে কুলাবে না। যদি দায়িত্ব দাও তাহ’লে তাদের সাহায্য করো’।[20]

নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক এভাবে আবু যার (রাঃ)-এর মুখের উপরে ভুলের কথা খোলামেলা বলে দেওয়া এজন্যেই সম্ভব হয়েছিল যে, তিনি জানতেন, আবু যার (রাঃ) এভাবে বলায় অসন্তুষ্ট হবেন না বরং তা মেনে নিবেন। মুখের উপরে বলা বা নিষেধ করা পদ্ধতি হিসাবে বেশ উপকারী। এতে সময় কম লাগে, চেষ্টা ফলপ্রসু হয় এবং উদ্দেশ্য সহজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এভাবে সরাসরি বলা স্থান, কাল, পাত্র বুঝে বলতে হবে।

সরাসরি বলার কারণে বড় কোন অনিষ্ট দেখা দেওয়া কিংবা ভাল কোন সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ভয় দেখা দিলে এরূপ বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন ভুলকারী যদি কোন পদস্থ ব্যক্তি হন, আর তিনি এভাবে বলা মেনে নিতে প্রস্ত্তত না থাকেন কিংবা এরূপ বলায় তিনি (ভুলকারী) কঠিন সঙ্কটে পড়বেন অথবা ভুলকারী একজন অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ মানুষ হন এবং প্রকাশ্যে বলায় তিনি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান, তখন সরাসরি মুখের উপর বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৩৬) ভুলকারীকে জেরা করা :

ভুলকারীর মাথা নত করে দেওয়া। ভুলকারীকে ভুলের উপর অনবরত জেরা করা ভাল। এরূপ জেরার ফলে তার অন্তর্দৃষ্টির উপর যে আবরণ জমা হয়ে পর্দা পড়ে থাকে তা দূরীভূত হওয়ায় সে সত্য ও সোজাপথে ফিরে আসতে পারে। এর উদাহরণ তাবারাণী কর্তৃক ‘আল-মু‘জামুল কাবীরে উদ্ধৃত একটি হাদীস।

আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ غُلاَمًا شَابًّا أَتَى رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ، فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ، ائْذَنْ لِي فِي الزِّنَا، فَصَاحَ النَّاسُ فَقَالَ: مَهْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ أَقِرُّوهُ ادْنُ، فَدَنَا حَتَّى جَلَسَ بَيْنَ يَدَيْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ أَتُحِبُّهُ لِأُمِّكَ؟ قَالَ : لاَ. قَالَ: وَكَذَلِكَ النَّاسُ لاَ يُحِبُّونَهُ لِأُمَّهَاتِهِمْ، أَتُحِبُّهُ لِابْنَتِكَ؟ قَالَ: لاَ. قَالَ: وَكَذَلِكَ النَّاسُ لاَ يُحِبُّونَهُ لِبَنَاتِهِمْ، أَتُحِبُّهُ لِأُخْتِكَ؟ قَالَ : لاَ. قَالَ : وَكَذَلِكَ النَّاسُ لَا يُحِبُّونَهُ لِأَخَوَاتِهِمْ، أَتُحِبُّهُ لِعَمَّتِكَ؟ قَالَ : لاَ. قَالَ: وَكَذَلِكَ النَّاسُ لاَ يُحِبُّونَهُ لِعَمَّاتِهِمْ؟ أَتُحِبُّهُ لِخَالَتِكَ؟ قَالَ : لاَ. قَالَ: وَكَذَلِكَ النَّاسُ لاَ يُحِبُّونَهُ لِخَالَاتِهِمْ. فَوَضَعَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ يَدَهُ عَلَى صَدْرِهِ، وَقَالَ : اللهُمَّ كَفِّرْ ذَنْبَهُ، وَطَهِّرْ قَلْبَهُ، وَحَصِّنْ فَرْجَهُ-​

‘এক যুবক গোলাম এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। তার কথা শুনে লোকেরা চীৎকার করে উঠল। কিন্তু নবী করীম (ﷺ) বললেন, তোমরা চুপ কর এবং তাকে জায়গা দাও। তারপর তিনি তাকে বললেন, কাছে এস, সে কাছে আসতে আসতে একেবারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে গিয়ে বসল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, তুমি কি তোমার মায়ের জন্য যেনা করা ভাল মনে কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, অনুরূপভাবে সকল লোকই তাদের মায়ের জন্য এ কাজ ভাল মনে করে না। তোমার মেয়ের জন্য কি তা ভালবাস? সে বলল, না। তিনি বললেন, এমনিভাবে সকলেই তাদের মেয়েদের সাথে এ কাজ ভালবাসে না। তোমার বোনের জন্য কি তুমি এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, একইভাবে কোন লোকই তাদের বোনেদের জন্য তা পসন্দ করে না। তুমি কি তোমার ফুফুর জন্য এ কাজ ভালবাস? সে বলল, না। তিনি বললেন, অনুরূপভাবে সকল লোকই তাদের ফুফুদের জন্য এটা ভালবাসে না। তুমি কি তোমার খালার জন্য এটা পসন্দ কর? সে বলল, না। তিনি বললেন, একইভাবে সকল লোকই তাদের খালাদের সাথে তা পসন্দ করে না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাত তার বুকের উপর রেখে বললেন, হে আল্লাহ! তার পাপ মোচন করে দাও, তার কলব পবিত্র করে দাও এবং তার লজ্জাস্থানের হেফাযত কর’।[21]

(৩৭) ভুলকারীকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তার খোঁড়া অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয় :

ভুলকারীরা অনেক সময় নিজেদের নির্দোষ যাহির করার জন্য অগ্রহণযোগ্য নানা খোঁড়া অজুহাত পেশ করে। বিশেষ করে তাদের ভুল হঠাৎ করে মানুষের চোখে ধরা পড়ে এবং তারাও প্রথম প্রথম এ কাজ করতে চায়। জেরার জবাবে তাদের কেউ কেউ তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিতে গিয়ে খোঁড়া অজুহাত তুলে ধরে। যারা তাদের দোষ ঢাকার জন্য মিথ্যা ভালভাবে রপ্ত করতে পারেনি তাদের বেলায় এমনটা বিশেষতঃ ঘটে। তাহ’লে একজন প্রশিক্ষক যখন এমন কোন ভুলকারীকে হাতে পাবে তখন তার সাথে কেমন আচরণ করবে? নিম্নে বর্ণিত ঘটনা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।

খাওয়াত্ব বিন জুবায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে মক্কার সন্নিকটস্থ মাররুয যাহরান নামক স্থানে ডেরা ফেললাম। তারপর আমার তাঁবু থেকে বের হয়ে হঠাৎই দেখলাম কিছু মহিলা বসে গল্পগুজব করছে। আমায় দেখে খুব পসন্দ হ’ল। আমি তাঁবুতে ফিরে এসে আমার কাপড়ের ব্যাগ বের করলাম। তারপর কাপড়ের ব্যাগ থেকে এক সেট কাপড় নিয়ে পরলাম এবং ওখানে গিয়ে তাদের সাথে বসলাম। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেরিয়ে এসে বললেন, আবু আব্দুল্লাহ! অর্থাৎ তিনি ঐ অনাত্মীয় মহিলাদের সাথে তার বসায় খুব নাখোশ হয়েছেন। যেই না আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখলাম অমনি আমার উপর ভয় চেপে বসল এবং অজুহাত খুঁজতে গিয়ে গোলমাল করে ফেললাম। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একটা উট ভেগে গেছে আমি তার জন্য রশি তালাশ করছি।

এই সাহাবী নিজের কাজ নির্দোষ প্রমাণের জন্য খোঁড়া অজুহাত তুলে ধরেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর গন্তব্যে চলতে থাকেন। রাবী বলেন, আমি (খাওয়াত) তাঁর পেছন পেছন যেতে থাকি, তিনি তাঁর চাদরটা আমার গায়ে ফেলে দিয়ে ‘আরাক’ বনে ঢুকে পড়লেন। আমি যেন এখনো সবুজ আরাকগুলোর মাঝে তাঁর সাদা পিঠের শুভ্রতা দেখতে পাচ্ছি। তিনি সেখানে তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়োজন (পেশাব/পায়খানা) শেষ করলেন, ওযূ করলেন, তারপর সামনে এগিয়ে এলেন। তখন ওযূর পানি তাঁর দাড়ি বেয়ে বুকে পড়ছিল। তিনি আমাকে বললেন, আবু আব্দুল্লাহ, তোমার উটের ভেগে যাওয়ার কি হ’ল? তারপর আমরা যাত্রা করলাম। পথে যতবারই তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে ততবারই তিনি আমাকে বলেছেন, আস-সালামু আলাইকা, আবু আব্দুল্লাহ! সেই উটের ভেগে যাওয়ার কি হ’ল? এটা দেখে আমি দ্রুত মদীনায় পৌঁছলাম এবং মসজিদে যাওয়া ও নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে উঠাবসা বন্ধ করে দিলাম। যখন এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হ’ল তখন আমি এমন একটা সময় বের করলাম যখন মসজিদ জনশূন্য থাকে। আমি মসজিদে গেলাম এবং সালাতে দাঁড়ালাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তাঁর কোন এক কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এসে সংক্ষিপ্তাকারে দু’রাক‘আত সালাত আদায় করলেন। কিন্তু আমি এই আশায় সালাত লম্বা করতে লাগলাম যে তিনি চলে যাবেন এবং আমাকে ছাড় দিবেন। (ঘটনা তা হ’ল না, বরং) তিনি বললেন, আবু আব্দুল্লাহ! তোমার মনে যত সময় চায় তুমি সালাত লম্বা কর, তোমার না ফেরা পর্যন্ত আমি উঠছি না। তখন আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ওযরখাহী করব এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মন ভারমুক্ত করব।

আমি ফিরে এলে তিনি বললেন, আস-সালামু আলাইকা, আবু আব্দুল্লাহ! তোমার উটের ভেগে যাওয়ার কি হ’ল? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ! আমার ইসলাম গ্রহণ অবধি আমার উট ভেগে যায়নি। তিনি তখন তিনবার বললেন, আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন। তারপর যা ঘটেছে সেজন্য তিনি পুনর্বার কিছু বলেননি।[22]

এই হাদীস তারবিয়াতের (প্রশিক্ষণের) ক্ষেত্রে এক অভিনব শিক্ষা বহন করে। এতে প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিকল্পনা রয়েছে যা কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনে। এছাড়াও নিম্নের ফায়েদাগুলো হাদীসটি থেকে লাভ করা সম্ভব।

* যে অপরাধ করেছে সে মর্যাদাশালী তারবিয়াতদাতা শিক্ষকের পাশ দিয়ে যেতে সংকোচ বোধ করে।

* তত্ত্বাবধায়কের চিন্তা-ভাবনা এবং প্রশ্নাবলী যদিও তা সংক্ষিপ্ত ও ছোট্ট তবুও মানব মনে সেগুলোর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

* খোঁড়া অজুহাত, যার অসঙ্গতি সুস্পষ্ট তা শোনার পরও অজুহাত পেশকারীকে কোন কিছু না বলে এড়িয়ে যাওয়ায় তার অজুহাত যে গ্রাহ্য করা হয়নি তা সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তাকে তওবা ও ওযরখাহী করে মুক্তির চেষ্টা করতে হয়। হাদীসে فمضى বা ‘চলে গেলেন’ কথা থেকে এ কথা বুঝা যায়।

* একজন ভাল তারবিয়াত প্রদানকারী তিনিই যাকে দেখে ভুলকারী প্রথমে লজ্জায় লজ্জায় লুকিয়ে থাকে। কিন্তু পরে তার নিকট প্রয়োজনের স্বার্থে আবার ফিরে আসে। দ্বিতীয় অবস্থাই তখন প্রথম অবস্থার উপর জয়যুক্ত হয়।

* ভুলকারীর মানসিক ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হেতু এরূপ ক্ষেত্রে নিজের ভুল স্বীকার এবং ভুল থেকে ফিরে আসার মনোভাব তৈরী হয়।

* তারবিয়াত প্রদানকারীর সঙ্গী-সাথীদের মনের মাঝে তার প্রতি অনেক বড় ও উঁচু স্থান থাকে। তিনি হয়ত তাদের কাউকে তিরস্কার করছেন কিংবা ভুল ধরছেন, আর তাতে তাঁর অন্য সকলেরও সংশোধনের লক্ষ্য থাকে। কারণ সাধারণভাবে যারাই তা জানতে পারে তারাই তাতে উপকৃত হয়। তবে অনেক সময় ব্যক্তি বিশেষের নেতিবাচক প্রভাব তাতে দূর হয় না। তখন তার কুপ্রভাব দূর করতে একজন অনুগামীরও নেতৃস্থানীয় কারো সাহায্য নিতে হয়। যেমন মুগীরা (রাঃ) ওমর (রাঃ)-এর সাহায্য নিয়ে তার সমস্যা দূর করেছিলেন। অপরপক্ষে নেতা ও তারবিয়াত দানকারীর মধ্যেও তার অনুসারীর মর্যাদা ভালভাবে বুঝতে হবে এবং তার প্রতি সুধারণা রাখতে হবে। তাহ’লে ভুল সংশোধনে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে।

(৩৮) মানুষের মেযাজ ও সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি লক্ষ্য রাখা :

নিষেধের ক্ষেত্রে মানুষের মেযাজ ও সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। নবী করীম (ﷺ) তাঁর স্ত্রীদের মর্যাদাবোধের বিষয়টি লক্ষ্য করে চলতেন। তাঁদের কারো থেকে কোন ভুল হ’লে তিনি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করতেন এবং ন্যায় ও সুবিচার বজায় রাখতেন। এর একটি উদাহরণ ইমাম বুখারী (রহঃ) কর্তৃক তাঁর সহীহ গ্রন্থে সংকলিত হাদীস।

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم عِنْدَ بَعْضِ نِسَائِهِ فَأَرْسَلَتْ إِحْدَى أُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِينَ بِصَحْفَةٍ فِيهَا طَعَامٌ، فَضَرَبَتِ الَّتِى النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فِى بَيْتِهَا يَدَ الْخَادِمِ فَسَقَطَتِ الصَّحْفَةُ فَانْفَلَقَتْ، فَجَمَعَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فِلَقَ الصَّحْفَةِ، ثُمَّ جَعَلَ يَجْمَعُ فِيهَا الطَّعَامَ الَّذِى كَانَ فِى الصَّحْفَةِ وَيَقُولُ غَارَتْ أُمُّكُمْ، ثُمَّ حَبَسَ الْخَادِمَ حَتَّى أُتِىَ بِصَحْفَةٍ مِنْ عِنْدِ الَّتِى هُوَ فِى بَيْتِهَا، فَدَفَعَ الصَّحْفَةَ الصَّحِيحَةَ إِلَى الَّتِى كُسِرَتْ صَحْفَتُهَا، وَأَمْسَكَ الْمَكْسُورَةَ فِى بَيْتِ الَّتِى كَسَرَتْ-​

‘নবী করীম (ﷺ) তাঁর এক স্ত্রীর কাছে অবস্থান করছিলেন। এ সময় উম্মুল মমিনীনদের একজন এক বড় থালায় করে খাবার পাঠান। যাঁর ঘরে নবী করীম (ﷺ) ছিলেন তিনি খাদেমের হাতে আঘাত করেন। ফলে থালাটা পড়ে গিয়ে ফেটে যায়। তখন নবী করীম (ﷺ) থালার ভাঙ্গা টুকরাগুলো একত্র করলেন এবং থালায় যে খাদ্য ইতিপূর্বে ছিল তা তাতে তুললেন। আর তিনি বলতে লাগলেন, তোমাদের মায়ের মর্যাদাবোধে লেগেছে। তারপর তিনি খাদেমকে আটকে রাখলেন এবং যাঁর ঘরে তিনি ছিলেন তাঁর নিকট থেকে একটি থালা আনিয়ে ভাল থালাটা তাকে দিলেন যার থালা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল এবং ভাঙ্গা থালাটা তাঁর ঘরে রেখে দিলেন যিনি ওটা ভেঙ্গে ছিলেন’।[23]

নাসাঈতে স্ত্রীদের সাথে বসবাস অধ্যায়ে উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি [উম্মে সালামা (রাঃ)] তাঁর একটি থালায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের জন্য খাবার নিয়ে আসেন। এ সময় আয়েশা (রাঃ) একটা কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে সেখানে আসেন। তাঁর হাতে ছিল এক খন্ড পাথর। তা দিয়ে তিনি থালাটি ভেঙ্গে দেন। নবী করীম (ﷺ) তখন থালার দু’টুকরো জমা করেন এবং দু’বার বলেন, তোমরা খাও, তোমাদের মায়ের সম্মানে লেগেছে! তোমরা খাও, তোমাদের মায়ের সম্মানে লেগেছে!! তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয়েশা (রাঃ)-এর থালা নিয়ে উম্মে সালামা (রাঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন এবং উম্মে সালামা (রাঃ)-এর থালা আয়েশা (রাঃ)-কে দিলেন।

দারেমী ‘বেচাকেনা’ অধ্যায়, ‘যে কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলবে তাকে অনুরূপ একটি প্রদান করতে হবে’ অনুচ্ছেদে আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ)-এর সহধর্মিনীদের মধ্য থেকে একজন তাঁকে একটি থালা উপহার দেন, তাতে ছিল ‘ছারীদ’ নামক খাদ্য। তিনি তখন তাঁর অন্য এক স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করছিলেন। ঐ স্ত্রী থালায় আঘাত করলে তা ভেঙ্গে যায়। ফলে নবী করীম (ﷺ) ছারীদ হাতে করে থালায় তুলতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, তোমরা খাও; তোমাদের মায়ের সম্মানে লেগেছে।...

মেয়েদের মর্যাদাবোধ একটি সহজাত প্রবৃত্তি। মর্যাদায় আঘাত লাগলে তারা কঠিন কিছুও করে ফেলে, কাজের পরিণাম কি দাঁড়াবে তা তাদের নযরে আসে না।

এজন্যই বলা হয়, মেয়ে লোকের যখন মর্যাদায় চোট লাগে তখন তার উপত্যকার উপর-নিচ কোন কিছুই খেয়াল থাকে না।

উপসংহার :

সুন্নাতের সুবাসিত বাগিচায় এক চক্কর লাগানো এবং মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনে নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক গৃহীত পথ ও পদ্ধতি জানার পর এবং আলোচ্য বিষয় শেষ করার আগে নিম্নের কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা ভাল হবে।

ভুল শুধরানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরয বা আবশ্যিক বিষয়। এটা রাসূল (ﷺ)-এর বাণী ‘কল্যাণ কামনাই দ্বীন’ এবং অন্যায় অবৈধ কাজের নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটাই সমগ্র ফরয নয়। কেননা দ্বীন শুধু অন্যায়ের নিষেধের নাম নয়, বরং ন্যায় ও সৎকর্মের আদেশও তার দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।

তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণ শুধুই ভুল সংশোধনকে বলে না। এটা বরং দ্বীনের মৌলিক বিষয়াবলী ও শরী‘আতের বিধানাবলী বুঝানো, শেখানো ও প্রচার-প্রসারের নাম। একই সাথে নেতৃত্বদান, ওয়ায-নছীহত, ঘটনা, কাহিনী ইত্যাদির সাহায্যে তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণ যাতে মানুষের অন্তরে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায় সেজন্য বিভিন্ন পন্থা ও মাধ্যম ব্যবহার করাও তারবিয়াত। এখান থেকেই অনেক মাতা, পিতা, শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের তারবিয়াতের ক্ষেত্রে ত্রুটি বেরিয়ে আসে। তারা ভুল সংশোধন ও বিচ্যুতির পেছনে সময় ব্যয় করতে বড়ই তৎপরতা দেখান। কিন্তু প্রথমেই যে তাদের দ্বীনের মৌলিক বিষয় শিক্ষা দেওয়া দরকার এবং ভুল ও বিচ্যুতির কারণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বের করা প্রয়োজন সেদিকে তারা যান না। এগুলো করা হ’লে ভুল ও বিচ্যুতি ঘটত না, আর ঘটলেও তার মাত্রা হ’ত স্বল্প।

আমাদের আগের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে ভুলের ক্ষেত্রে মহানবী (ﷺ) স্থান, কাল, পাত্র ও পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। সুতরাং যার বুঝ সমঝ ভাল আছে এবং নবী করীম (ﷺ)-এর অনুসরণ করতে চায় সে যেন বর্ণিত অবস্থান ও ঘটনাবলীর ভিত্তিতে ভুল সংশোধনে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয় এবং দৃষ্টান্তের সাথে দৃষ্টান্ত ও উপমার সঙ্গে উপমা মিলিয়ে কাজ করে।

কথা এখানেই শেষ। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন আমাদেরকে সঠিক পথ জানিয়ে দেন; আমাদের নফসের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন; আমাদেরকে ভালর চাবি বানান, মন্দের তালা করেন এবং আমাদেরকে ও আমাদের মাধ্যমে অন্যদেরকে সুপথ দান করেন। তিনিই সর্বশ্রোতা, নিকটজন, সাড়াদানকারী। তিনি কতই না ভাল অভিভাবক এবং কতই না ভাল সাহায্যকারী! তিনিই সোজাপথের উপর স্থির রাখার অধিকারী!

আল্লাহ তা‘আলা রহমত বর্ষণ করুন নিরক্ষর নবী, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সকল সাহাবীর উপর, আর সকল প্রশংসা তো আল্লাহরই। যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক।


[1]. বুখারী হা/৭৩৪৭
[2]. বুখারী হা/৬২৫৯, ৩৯৮৩
[3]. বুখারী হা/৩০৯১। এ ঘটনা মদ হারাম হওয়ার পূর্বেকার। দ্রঃ ফাৎহুল বারী হা/৩০৯১-এর আলোচনা, ৬/২০১।
[4]. মুসনাদে আহমাদ ৫/২৮৯; সিলসিলা সহীহাহ হা/৬৮৯-এর অধীনে ২/১৮৮
[5]. নাসাঈ হা/৫১৮৮, সনদ সহীহ
[6]. মুসনাদে আহমাদ হা/৬৫১৮, আহমাদ শাকের এর সনদ সহীহ বলেছেন
[7]. বুখারী হা/৪৪১৮
[8]. তিরমিযী হা/১৯৭৩; সহীহ তারগীব হা/২৯৪১
[9]. মুসনাদে আহমাদ ৬/১৫২, হা/২৫২২৪, সনদ সহীহ
[10]. সিলসিলা সহীহাহ হা/২০৫২
[11]. হাকেম; সহীহুল জামে‘ হা/৪৬৭৫
[12]. মুসলিম হা/২০২১
[13]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৬৫৪৬; দারেমী হা/২০৩২, সনদ সহীহ।
[14]. মাহাসিনুত তাবীল ১৬/২২২
[15]. বুখারী হা/১৯৩৬
[16]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৪০২, হাদীস সহীহ
[17]. বুখারী হা/৫০৫২
[18]. আহমাদ হা/৬৪৭৭, সনদ সহীহ
[19]. বুখারী হা/৬০৫০
[20]. মুসলিম হা/১৬৬১
[21]. ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৭৬৭৯, ৭৭৫৯; সহীহাহ হা/৩৭০।
[22]. হায়ছামী বলেন, তাবারানী দু’টি সনদে এটি বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে একটি সনদের বর্ণনাকারীগণ জারাহ বিন মাখলাদ ব্যতীত বুখারী মুসলিমের বর্ণনাকারীভুক্ত, আর জারাহ বিন মাখলাদ নির্ভরযোগ্য রাবী। আল-মাজমা‘ হা/১৬১০৫, ৯/৪০১, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৪১৪৬, ৪/২০৩ পৃষ্ঠায় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যায়েদ বিন আসলাম খাওয়াত বিন জুবায়ের থেকে বর্ণনা করেছেন। আত-তাহযীব গ্রন্থে খাওয়াত (রাঃ)-এর জীবনী থেকে বুঝা যায়, যায়েদ বিন আসলাম তার থেকে মুরসালভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ‘আল-ইছাবা গ্রন্থে আছে, খাওয়াত ৪০ কিংবা ৪২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আর যায়েদ বিন আসলাম সিয়ার গ্রন্থ অনুসারে ১৩৯ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এ হিসাবে সনদটি মুনকাতি‘ বা বিচ্ছিন্ন।
[23]. বুখারী হা/৫২২৫; মিশকাত হা/২৯৪০



সূত্র: আত-তাহরীক।​
 
Last edited:

Share this page