মুসলিমদের পাহারা নিয়ে আববাদ বিন বিশর (রাঃ)-এর কাহিনী :
আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে নাজদের দিকে যুদ্ধযাত্রা করেছিলাম।* আমরা মুশরিকদের বাড়ি-ঘর থেকে একটি বাড়ি ঘেরাও করি। সেখানে আমাদের হাতে একজন পুরুষের স্ত্রী বন্দী হয়। তার স্বামী তখন গৃহে ছিল না। সে বাড়ি ফিরে এলে স্ত্রীর বন্দী হওয়ার কথা তাকে জানানো হয়। সে তখন শপথ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদের মধ্যে রক্তপাত না ঘটিয়ে সে বাড়ি ফিরে যাবে না। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (মদীনার পানে) ফিরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি এক গিরিপথে ডেরা ফেলেন এবং বলেন,
‘কে সে দু’জন, যারা এই রাতে শত্রুর হানা থেকে আমাদেরকে পাহারা দিবে?’
তখন মুহাজিরদের থেকে একজন (আম্মার বিন ইয়াসির) এবং আনছারদের থেকে একজন (আববাদ বিন বিশর) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে পাহারা দিব। বর্ণনাকারী বলেন, তারা দু’জন তখন সেনাদলকে পিছনে রেখে গিরিপথের মুখে অবস্থান নিলেন। এ সময় আনছার সাহাবী মুহাজির সাহাবীকে বললেন, আপনি কি আমাকে রাতের প্রথমাংশে (ঘুমানোর) সুযোগ দিবেন এবং আমি আপনাকে রাতের শেষাংশে সুযোগ দিব। নাকি আপনি আমাকে রাতের শেষাংশে সুযোগ দিবেন এবং আমি আপনাকে রাতের প্রথমাংশে সুযোগ দিব? মুহাজির সাহাবী বললেন, আপনি বরং আমাকে রাতের প্রথমাংশে (ঘুমানর) সুযোগ দিন এবং আমি আপনাকে রাতের শেষাংশে সুযোগ দিব। অতঃপর মুহাজির সাহাবী ঘুমিয়ে গেলেন এবং আনছার সাহাবী সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি কুরআনের একটি সূরা শুরু করলেন। তার সূরা পাঠরত অবস্থায় সেই মহিলার স্বামী এসে হাযির হ’ল। সে যখন লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তখন বুঝতে পারল ইনি সেনাদলের নিরাপত্তা রক্ষী। সে তাকে লক্ষ্য করে একটা তীর তুলে নিল। তীরটা তার দেহে গিয়ে বিঁধল, কিন্তু তিনি তখনও দাঁড়িয়ে সালাতে যে সূরা পড়ছিলেন তা পড়ে চলেছেন। সূরা পাঠে ছেদ ঘটার আশঙ্কায় তিনি একটুও নড়াচড়া করলেন না।
বর্ণনাকারী বলেন, মহিলার স্বামী পুনরায় আরেকটা তীর নিয়ে তার দেহে বিদ্ধ করল। তিনি সালাতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই সেটা খুলে রেখে দিলেন এবং সূরা পাঠে ছেদ ঘটার আশঙ্কায় একটুও নড়াচড়া করলেন না। মহিলার স্বামী তৃতীয় বার আরেকটা তীর নিয়ে তার দেহে বিদ্ধ করল। তিনি সালাতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই সেটা খুলে রেখে দিলেন। তারপর তিনি রুকূ-সিজদা করে সালাত শেষে তার সঙ্গীকে বললেন, ওঠো, আমি আহত হয়েছি। মুহাজির সাহাবী উঠে বসলেন। মহিলার স্বামী যখন দু’জনকে দেখতে পেল তখন সে পালিয়ে গেল এবং বুঝতে পারল যে, তারা টের পেয়ে যাবে। ইতিমধ্যে মহিলার স্বামীর তীর বর্ষণের ফলে আনছার সাহাবীর আহত স্থান থেকে তীব্র বেগে রক্তক্ষরণ হ’তে লাগল। তখন তার মুহাজির ভাই তাকে বললেন, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তীরের প্রথম আঘাতেই আমাকে তুমি জানালে না কেন? তিনি বললেন, আমি কুরআনের একটা সূরা পড়া শুরু করেছিলাম, যা দিয়ে আমি সালাত আদায় করছিলাম। সেই সূরা তেলাওয়াত বন্ধ করে দেওয়া আমার পসন্দ হয়নি, (তাই আমি তোমাকে জানাইনি)।
‘আল্লাহর কসম! যে ঘাঁটি পাহারা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে আদেশ দিয়েছেন তা আমার হাত দিয়ে ধ্বংস হওয়ার ভয় যদি আমি না করতাম তাহ’লে সূরা তেলাওয়াত বন্ধের আগে আমার জীবন বায়ু নির্বাপিত হওয়া নিয়ে আমি কোন পরোয়া করতাম না’।[1]
৫. মসজিদ নির্মাণ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আল্লাহর মসজিদ সমূহ কেবল তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। নিশ্চয়ই তারা সুপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (তওবা ৯/১৮)।
ওছমান বিন আফফান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর (চেহারা/সান্নিধ্য) তথা সন্তুষ্টি অন্বেষণার্থে একটি মসজিদ বানাবে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তার জন্য অনুরূপ একটি গৃহ তৈরি করবেন’।[2]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘মুমিনের মৃত্যুর পরে তার আমল ও পুণ্য থেকে যা তার সঙ্গে যুক্ত হয় তন্মধ্যে রয়েছে: (১) ঐ ইলম বা বিদ্যা, যা সে অন্যদের শিখিয়েছে এবং প্রচার করেছে, (২) নেক সন্তান যাকে সে ছেড়ে এসেছে, (৩) মুছহাফ বা কুরআন কারীম যা সে উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে এসেছে, (৪) যে মসজিদ সে নির্মাণ করেছে, অথবা (৫) মুসাফিরদের জন্য যে সরাইখানা সে বানিয়েছে, অথবা (৬) পানি সরবরাহের জন্য যে নহর বা খাল সে খনন করেছে, অথবা (৭) তার জীবদ্দশায় ও সুস্থ অবস্থায় তার অর্থ-সম্পদ থেকে যে দান সে করেছে, তা সবই তার মৃত্যুর পরেও তার সাথে যুক্ত হবে’।[3]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং মসজিদে নববী নির্মাণে সাহাবীদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মসজিদে নববী নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা একটা একটা করে কাঁচা ইট বহন করছিলাম, আর আম্মার দু’টি দু’টি করে বহন করছিলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার গা থেকে ধুলি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেন,
‘আহ আম্মার! তাকে একটা বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। সে তাদের জান্নাতের দিকে ডাকবে, আর তারা তাকে ডাকবে জাহান্নামের দিকে। বর্ণনাকারী বলেন, আম্মার তখন বলছিলেন, আমি ফিৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইছি’।[4]
৬. নছীহত বা কল্যাণ কামনা :
তামীম দারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, الدِّينُ النَّصِيحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত বা কল্যাণ কামনা। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বললেন,
‘আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম শাসকদের জন্য এবং আম মুসলমানের জন্য’।[5]
ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এ হাদীস সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি দ্বীনের এক-চতুর্থাংশ’।[6] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘এই হাদীসটি অনেক বড় মর্যাদাপূর্ণ এবং এটির উপরই ইসলামের ভিত্তি; অনেক আলেমের মতে, এ হাদীস ইসলামের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ সেই চার হাদীসের একটি যাতে ইসলামের যাবতীয় বিষয় শামিল রয়েছে, তাদের কথাগুলো সঠিক নয়, বরং এই একটিমাত্র হাদীসের উপরই ইসলামের ভিত্তি। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।[7]
আল্লাহর জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ আল্লাহকে তাঁর প্রাপ্য যথাযোগ্য গুণে গুণান্বিত করা, প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বতোভাবে আল্লাহর সমীপে নত থাকা, তাঁর আনুগত্যমূলক কাজের মাধ্যমে তাঁর ভালবাসায় অনুপ্রাণিত হওয়া, তাঁর ক্রোধে পতিত হওয়ার ভয়ে তাঁর নাফরমানি থেকে বাঁচা, পাপীদেরকে তাঁর দিকে ফেরাতে প্রাণান্ত জিহাদ করা।
আল্লাহর কিতাবের জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ আল্লাহর কিতাব শেখা, অন্যদের শিখানো, মুখে উচ্চারণকালে হরফসমূহ তাজবীদের নিয়ম মেনে পড়া, লেখার সময়ে যথানিয়মে লেখা, অর্থ বুঝা, তার সীমা হেফাযত করা, তার বিষয়বস্ত্ত অনুসারে আমল করা, বাতিলপন্থীদের হাতে কুরআনের রদ-বদল রোধে ভূমিকা রাখা।
আল্লাহর রাসূলের জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ আল্লাহর রাসূলকে সম্মান করা, জীবনে-মরণে তাঁকে সাহায্য করা, শেখা এবং অন্যদের শিখানোর মাধ্যমে তাঁর সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করা, তাঁর কথা ও কাজ মেনে চলা, তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের মহববত করা।
মুসলিম শাসকদের কল্যাণ কামনার অর্থ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তাদেরকে সাহায্য করা, দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাদের সতর্ক করা, তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করা, তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকা, তাদের প্রতি যারা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায় তাদের প্রতিবাদ করা এবং সম্ভব হ’লে আপোষে মিল করে দেওয়া। তাদের প্রতি সবচেয়ে বড় কল্যাণ করা হবে সুন্দরতম উপায়ে তাদেরকে যুলুম-অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখা।
আম মুসলমানের কল্যাণ কামনার অর্থ তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে যা যা কল্যাণপ্রসূ সেসব বিষয়ে তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা, তাদেরকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, দ্বীনের যেসব বিষয়ে তারা অজ্ঞ সেসব বিষয় তাদের শিখিয়ে দেওয়া, কথা ও কাজের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা, তাদের দোষ গোপন রাখা, তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করা, তাদের জন্য যা অপকারী তা দমন করা এবং যা উপকারী তা যোগাড় করে দেওয়া, খুবই নম্রতা ও ইখলাছের সঙ্গে তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা, তাদের প্রতি দয়া ও করুণা করা, তাদের বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা, সদুপদেশের মাধ্যমে তাদের সাথে মিত্রতা বজায় রাখা, তাদের সাথে প্রতারণা-হিংসা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা, নিজের জন্য ভাল যা কিছু পসন্দনীয় তা তাদের জন্য ভালবাসা, নিজের জন্য যা কিছু অপসন্দনীয় তা তাদের জন্যও অপসন্দ করা, তাদের জান-মাল-ইয্যতের হেফাযত করা, উল্লেখিত নছীহতসমূহ যাতে তাদের চরিত্রে রূপায়িত হয় সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং আনন্দিত চিত্তে তারা যেন ভাল কাজে আগুয়ান হয় সেজন্য তাদের উদ্দীপ্ত করা। সালাফদের মধ্যে অনেককে তো নছীহত করতে গিয়ে নিজের জাগতিক ক্ষতিও সইতে হয়েছে।
৭. মানুষের মাঝে মীমাংসা করে দেওয়া :
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।
আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন, লোকেরা যে গোপনে আলোচনা এবং বলাবলি করে তার অনেক কিছুতেই কোন খায়ের-বরকত নেই। হয়তো সেসব কথা আদতেই অনর্থক। যেমন- বৈধ গালগল্প করা; নয়তো তা খারাপ ও ক্ষতিকারক, যেমন- হারাম অশ্লীল কথাবার্তা, পরনিন্দা, গালি ইত্যাদি।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিক্রম হিসাবে বলেছেন, তবে যারা ছাদাক্বা করার আদেশ দেয়, যে ছাদাক্বা হ’তে পারে ধন-সম্পদ, হ’তে পারে বিদ্যা, হ’তে পারে অন্য যে কোন প্রকার উপকার, এমনকি তার মধ্যে ইবাদতে কাছেরাও (যে ইবাদতের ছওয়াব ও উপকার কেবল নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ) শামিল হ’তে পারে। যেমন- নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) পাঠ ছাদাক্বা, প্রত্যেক তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ ছাদাক্বা, প্রত্যেক তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) পাঠ ছাদাক্বা, প্রত্যেক ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা ছাদাক্বা, সৎকাজের আদেশ দান ছাদাক্বা, অসৎকাজের নিষেধ ছাদাক্বা, এমনকি তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মিলনও ছাদাক্বা’।[8]
‘অথবা সৎকাজের আদেশ দেয়’ এখানে আয়াতে বর্ণিত ‘মা‘রূফ’ অর্থ সৎ ও ভাল কাজ। শরী‘আত ও বিবেকে যা কিছু ভাল বলে বিবেচিত তাই মা‘রূফ। কুরআন সুন্নাহর কোন স্থানে যখন মা‘রূফের আদেশের সাথে মুনকারের নিষেধ করার কথা উল্লেখ থাকবে না সেখানে মা‘রূফের আদেশের সাথে মুনকারের নিষেধও অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা মুনকার পরিহারও মা‘রূফের অন্তর্ভুক্ত। আর ভাল কাজ পরিপূর্ণ হয় না মন্দ কাজ ত্যাগ না করা পর্যন্ত। যে ভাল-মন্দ দু’টিই করে তাকে সৎলোক বলা যায় না। তবে যেখানে মা‘রূফ ও মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ নিষেধ) একই সাথে উল্লেখ থাকে সেখানে মা‘রূফ বলতে অনুমোদিত কাজ এবং মুনকার বলতে নিষিদ্ধ কাজ বুঝায়।
মীমাংসা কেবল দুই দ্বন্দ্বমুখর বিবদমান পক্ষের মাঝে হয়ে থাকে। দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, বিবাদ, রাগারাগী যে কত বড় ক্ষতি ও মানুষে মানুষে কত দূরত্ব তৈরি করে তা বলে শেষ করা যায় না। এজন্যই শরী‘আত প্রবর্তক মানুষের জান-মাল-ইয্যত কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মীমাংসার উপর জোর দিয়েছে। এমনকি ধর্মে ধর্মে সংঘাতের মীমাংসার বিষয়েও ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং (দ্বীনের ব্যাপারে) পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
তিনি আরো বলেন,
‘যদি মুমিনদের দুই দল পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর সীমালংঘন করে, তাহ’লে তোমরা ঐ দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যে দল সীমালংঘন করে। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের (সন্ধির) দিকে ফিরে আসে। অতঃপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তোমরা উভয় দলের মধ্যে ন্যায়ানুগভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)।
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘মীমাংসাই উত্তম (নিসা ৪/১২৮)। সংঘাতের মুখোমুখি লোকেদের মাঝে মীমাংসার জন্য যে ব্যক্তি দৌড়-ঝাঁপ ও চেষ্টা করে সে সালাত আদায়কারী, ছিয়াম পালনকারী ও ছাদাক্বাদাতা থেকে উত্তম।
মীমাংসাকারীর চেষ্টা-সাধনা ও কর্মকান্ড আল্লাহ তা‘আলা ঠিকঠাক করে দেন। পক্ষান্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কর্মকান্ডকে আল্লাহ তা‘আলা সংশোধন করেন না এবং তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও পূরণ হয় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহ বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হ’তে দেন না’ (ইউনুস ১০/৮১)।
এ সকল জিনিস যেখানে যেভাবেই করা হোক তা হবে কল্যাণকর। যেমনটা আয়াতে উল্লেখিত ব্যতিক্রম থেকে পরিস্কার বুঝা যায়। কারণ এ কাজগুলো সঞ্চারণশীল কল্যাণবাহী। তবে ছওয়াবের পরিপূর্ণতা ও সম্পূর্ণতা নির্ভর করে আমলকারীর নিয়তের উপর। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।[9]
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করে দেওয়া শ্রেষ্ঠ ছাদাক্বা’।[10]
আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম, সালাত ও ছাদাক্বার থেকেও শ্রেষ্ঠ আমলের সন্ধান দিব না? তারা বললেন, কেন নয়, অবশ্যই দিবেন। তিনি বললেন, দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করে দেওয়া’।[11]
সন্দেহ নেই যে, ছিয়াম ও সালাতের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। এ দু’টি ইসলামের স্তম্ভ। এখানে নফল সালাত ও ছিয়ামকে বুঝানো হয়েছে। এমতাবস্থায় নফল সালাত ও ছিয়াম থেকে দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করা উত্তম হবে। কেননা নফল সালাত ও ছিয়ামের ছওয়াব ও কল্যাণ কেবল আমলকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। পক্ষান্তরে দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করার উপকার ও কল্যাণ অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি তার সময় পরস্পরের দ্বন্দ্ব মীমাংসায় ব্যয় করে সে ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম যে নফল সালাত ও ছিয়ামে সময় ব্যয় করে।
৮. সুফারিশ ও মযলূমদের সাহায্য :
একজন মুসলিম তার মুসলিম ভাইয়ের উপকার সাধন কিংবা ক্ষতি থেকে রক্ষায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করতে পারে। এটাই হচ্ছে স্বীয় পদমর্যাদা দিয়ে মুসলিমদের কল্যাণ সাধন। আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে যখন কোন ভিক্ষুক/প্রার্থী আসত অথবা তাঁর কাছে কোন প্রয়োজন পূরণের আবেদন করা হ’ত তখন তিনি বলতেন,
‘তোমরা সুফারিশ করো, তাতে তোমাদের ছওয়াব মিলবে। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর যবান দিয়ে সেই ফায়ছালা করিয়ে নেন যা তিনি চান’।[12]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস অনুসারে বুঝা যায়, মুবাহ প্রয়োজনের যারা মুখাপেক্ষী তাদের জন্য সুফারিশ করা মুস্তাহাব। এ সুফারিশ চাই রাষ্ট্রপ্রধান, গভর্ণর কিংবা তাদের মতো কারো কাছে করা হোক, কিংবা অন্য যেকোন মানুষের কাছে করা হোক। রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে সুফারিশ যুলুম-অত্যাচার বন্ধের জন্য হোক, কিংবা লঘু কোন দন্ড মওকূফের জন্য হোক, অথবা অভাবগ্রস্ত মানুষের ভাতা ছাড় ইত্যাদি কাজের জন্য হোক। তবে হদ্দ বা আল্লাহর নির্ধারিত দন্ড মওকূফের জন্য সুফারিশ করা হারাম। তেমনি কোন বাতিল বিষয় কার্যকর করতে কিংবা কোন হক বা ন্যায়কে বাতিল করার মত কাজে সুফারিশ করা হারাম।[13]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উক্তি (আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর যবান দিয়ে সেই ফায়ছালা করিয়ে নেন যা তিনি চান) থেকে এ নির্দেশনা মেলে যে, সুফারিশের জন্য চেষ্টা-তদবিরকারীর চেষ্টা সফল হোক, কিংবা ব্যর্থ হোক তিনি উভয় অবস্থাতেই ছওয়াব পাবেন।[14]
নবী করীম (ﷺ) মুসলিমদের উপকার ও কল্যাণার্থে নিজেও তাঁর পদমর্যাদা ব্যবহার করেছেন। তিনি তাদের জন্য সুফারিশ করতেন, এমনকি তাদের একান্ত নিজস্ব বিষয়েও।
বারীরা (রাঃ)-কে যখন তার মনীব মুক্ত করে দেন তখন তিনি তার বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করে দেন। তার স্বামী তখনও দাস ছিলেন। বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করায় তার স্বামী খুবই ব্যথিত হন। স্ত্রীকে তিনি যারপরনাই ভালবাসতেন। স্ত্রীকে ফিরে পাবার জন্য তিনি মদীনার রাস্তায় রাস্তায় তার পিছন পিছন কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতেন। স্ত্রী যাতে ফিরে আসে সেজন্য তিনি নবী করীম (ﷺ)-কেও তার নিকট সুফারিশ করার জন্য ধরে বসেন। নবী করীম (ﷺ)ও সুফারিশ করেন। তিনি বারীরাকে বলেন,
‘তুমি যদি তার কাছে ফিরে যেতে! সে তো তোমার সন্তানদের জনক। বারীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কি আমাকে হুকুম করছেন? তিনি বললেন, ‘না, আমি কেবল সুফারিশকারী’। বারীরা বললেন, তাকে আমার কোনই প্রয়োজন নেই’।[15]
* এটি ছিল যাতুর রিকা যুদ্ধ। বেদুঈন কিছু গোত্রের অতর্কিতে মদীনা আক্রমণের খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযানে গিয়েছিলেন।
[1]. আহমাদ হা/১৪৪৫১; আবুদাউদ হা/১৯৮।
[2]. বুখারী হা/৪৫০; মুসলিম হা/৫৩৩।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/২৪২; সহীহুত তারগীব হা/৭৭; মিশকাত হা/২৫৪।
[4]. বুখারী হা/৪৪৭;আহমাদ হা/১১৮৭৯; সহীহ ইবনু হিববান হা/২৬৫৩।
[5]. মুসলিম হা/৫৫; আবুদাঊদ হা/৪৯৪৪; মিশকাত হা/৪৯৬৬।
[6]. ফাৎহুল বারী ১/১৩৮।
[7]. নববী, শরহ মুসলিম ২/৩৭।
[8]. মুসলিম হা/১০০৯; আহমাদ হা/২১৫১১; মিশকাত হা/১৮৯৮।
[9]. তায়সীরুল কারীমির রহমান, পৃ. ২০২।
[10]. মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ হা/৩৩৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৬৩৯।
[11]. আবুদাউদ হা/৪৯১৯; তিরমিযী হা/২৫০৯; মিশকাত হা/৫০৩৮; সহীহুল জামে‘ হা/২৫৯৫।
[12]. বুখারী হা/৬০২৭; মুসলিম হা/২৬২৭; মিশকাত হা/৪৯৫৬।
[13]. নববী, শরহ মুসলিম ১৬/১৭৭।
[14]. ইবনু বাত্তাল, শরহ বুখারী, ৩/৪৩৪।
[15]. নাসাঈ হা/৫৪১৭; ইবনু মাজাহ হা/২০৭৫; দারেমী হা/২২৯২।
আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে নাজদের দিকে যুদ্ধযাত্রা করেছিলাম।* আমরা মুশরিকদের বাড়ি-ঘর থেকে একটি বাড়ি ঘেরাও করি। সেখানে আমাদের হাতে একজন পুরুষের স্ত্রী বন্দী হয়। তার স্বামী তখন গৃহে ছিল না। সে বাড়ি ফিরে এলে স্ত্রীর বন্দী হওয়ার কথা তাকে জানানো হয়। সে তখন শপথ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদের মধ্যে রক্তপাত না ঘটিয়ে সে বাড়ি ফিরে যাবে না। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (মদীনার পানে) ফিরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি এক গিরিপথে ডেরা ফেলেন এবং বলেন,
مَنْ رَجُلاَنِ يَكْلآنَا فِى لَيْلَتِنَا هَذِهِ مِنْ عَدُوِّنَا
‘কে সে দু’জন, যারা এই রাতে শত্রুর হানা থেকে আমাদেরকে পাহারা দিবে?’
তখন মুহাজিরদের থেকে একজন (আম্মার বিন ইয়াসির) এবং আনছারদের থেকে একজন (আববাদ বিন বিশর) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে পাহারা দিব। বর্ণনাকারী বলেন, তারা দু’জন তখন সেনাদলকে পিছনে রেখে গিরিপথের মুখে অবস্থান নিলেন। এ সময় আনছার সাহাবী মুহাজির সাহাবীকে বললেন, আপনি কি আমাকে রাতের প্রথমাংশে (ঘুমানোর) সুযোগ দিবেন এবং আমি আপনাকে রাতের শেষাংশে সুযোগ দিব। নাকি আপনি আমাকে রাতের শেষাংশে সুযোগ দিবেন এবং আমি আপনাকে রাতের প্রথমাংশে সুযোগ দিব? মুহাজির সাহাবী বললেন, আপনি বরং আমাকে রাতের প্রথমাংশে (ঘুমানর) সুযোগ দিন এবং আমি আপনাকে রাতের শেষাংশে সুযোগ দিব। অতঃপর মুহাজির সাহাবী ঘুমিয়ে গেলেন এবং আনছার সাহাবী সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি কুরআনের একটি সূরা শুরু করলেন। তার সূরা পাঠরত অবস্থায় সেই মহিলার স্বামী এসে হাযির হ’ল। সে যখন লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তখন বুঝতে পারল ইনি সেনাদলের নিরাপত্তা রক্ষী। সে তাকে লক্ষ্য করে একটা তীর তুলে নিল। তীরটা তার দেহে গিয়ে বিঁধল, কিন্তু তিনি তখনও দাঁড়িয়ে সালাতে যে সূরা পড়ছিলেন তা পড়ে চলেছেন। সূরা পাঠে ছেদ ঘটার আশঙ্কায় তিনি একটুও নড়াচড়া করলেন না।
বর্ণনাকারী বলেন, মহিলার স্বামী পুনরায় আরেকটা তীর নিয়ে তার দেহে বিদ্ধ করল। তিনি সালাতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই সেটা খুলে রেখে দিলেন এবং সূরা পাঠে ছেদ ঘটার আশঙ্কায় একটুও নড়াচড়া করলেন না। মহিলার স্বামী তৃতীয় বার আরেকটা তীর নিয়ে তার দেহে বিদ্ধ করল। তিনি সালাতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই সেটা খুলে রেখে দিলেন। তারপর তিনি রুকূ-সিজদা করে সালাত শেষে তার সঙ্গীকে বললেন, ওঠো, আমি আহত হয়েছি। মুহাজির সাহাবী উঠে বসলেন। মহিলার স্বামী যখন দু’জনকে দেখতে পেল তখন সে পালিয়ে গেল এবং বুঝতে পারল যে, তারা টের পেয়ে যাবে। ইতিমধ্যে মহিলার স্বামীর তীর বর্ষণের ফলে আনছার সাহাবীর আহত স্থান থেকে তীব্র বেগে রক্তক্ষরণ হ’তে লাগল। তখন তার মুহাজির ভাই তাকে বললেন, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তীরের প্রথম আঘাতেই আমাকে তুমি জানালে না কেন? তিনি বললেন, আমি কুরআনের একটা সূরা পড়া শুরু করেছিলাম, যা দিয়ে আমি সালাত আদায় করছিলাম। সেই সূরা তেলাওয়াত বন্ধ করে দেওয়া আমার পসন্দ হয়নি, (তাই আমি তোমাকে জানাইনি)।
ايْمُ اللهِ لَوْلاَ أَنْ أُضَيِّعَ ثَغْراً أَمَرَنِى بِهِ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِحِفْظِهِ لَقَطَعَ نَفْسِى قَبْلَ أَنْ أَقْطَعَهَا
‘আল্লাহর কসম! যে ঘাঁটি পাহারা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে আদেশ দিয়েছেন তা আমার হাত দিয়ে ধ্বংস হওয়ার ভয় যদি আমি না করতাম তাহ’লে সূরা তেলাওয়াত বন্ধের আগে আমার জীবন বায়ু নির্বাপিত হওয়া নিয়ে আমি কোন পরোয়া করতাম না’।[1]
৫. মসজিদ নির্মাণ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ اللهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ-
‘আল্লাহর মসজিদ সমূহ কেবল তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। নিশ্চয়ই তারা সুপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (তওবা ৯/১৮)।
ওছমান বিন আফফান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
مَنْ بَنَى مَسْجِدًا يَبْتَغِي بِهِ وَجْهَ اللهِ، بَنَى اللهُ لَهُ مِثْلَهُ فِي الْجَنَّةِ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর (চেহারা/সান্নিধ্য) তথা সন্তুষ্টি অন্বেষণার্থে একটি মসজিদ বানাবে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তার জন্য অনুরূপ একটি গৃহ তৈরি করবেন’।[2]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ: عِلْمًا عَلِمَهُ وَنَشَرَهُ، وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ، أَوْ مُصْحَفًا وَرَّثَهُ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ، أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ، أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ، تَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ-
‘মুমিনের মৃত্যুর পরে তার আমল ও পুণ্য থেকে যা তার সঙ্গে যুক্ত হয় তন্মধ্যে রয়েছে: (১) ঐ ইলম বা বিদ্যা, যা সে অন্যদের শিখিয়েছে এবং প্রচার করেছে, (২) নেক সন্তান যাকে সে ছেড়ে এসেছে, (৩) মুছহাফ বা কুরআন কারীম যা সে উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে এসেছে, (৪) যে মসজিদ সে নির্মাণ করেছে, অথবা (৫) মুসাফিরদের জন্য যে সরাইখানা সে বানিয়েছে, অথবা (৬) পানি সরবরাহের জন্য যে নহর বা খাল সে খনন করেছে, অথবা (৭) তার জীবদ্দশায় ও সুস্থ অবস্থায় তার অর্থ-সম্পদ থেকে যে দান সে করেছে, তা সবই তার মৃত্যুর পরেও তার সাথে যুক্ত হবে’।[3]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং মসজিদে নববী নির্মাণে সাহাবীদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মসজিদে নববী নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা একটা একটা করে কাঁচা ইট বহন করছিলাম, আর আম্মার দু’টি দু’টি করে বহন করছিলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার গা থেকে ধুলি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেন,
وَيْحَ عَمَّارٍ تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ، يَدْعُوهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ، وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ-
‘আহ আম্মার! তাকে একটা বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। সে তাদের জান্নাতের দিকে ডাকবে, আর তারা তাকে ডাকবে জাহান্নামের দিকে। বর্ণনাকারী বলেন, আম্মার তখন বলছিলেন, আমি ফিৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইছি’।[4]
৬. নছীহত বা কল্যাণ কামনা :
তামীম দারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, الدِّينُ النَّصِيحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত বা কল্যাণ কামনা। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বললেন,
لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ-
‘আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম শাসকদের জন্য এবং আম মুসলমানের জন্য’।[5]
ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এ হাদীস সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি দ্বীনের এক-চতুর্থাংশ’।[6] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘এই হাদীসটি অনেক বড় মর্যাদাপূর্ণ এবং এটির উপরই ইসলামের ভিত্তি; অনেক আলেমের মতে, এ হাদীস ইসলামের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ সেই চার হাদীসের একটি যাতে ইসলামের যাবতীয় বিষয় শামিল রয়েছে, তাদের কথাগুলো সঠিক নয়, বরং এই একটিমাত্র হাদীসের উপরই ইসলামের ভিত্তি। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।[7]
আল্লাহর জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ আল্লাহকে তাঁর প্রাপ্য যথাযোগ্য গুণে গুণান্বিত করা, প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বতোভাবে আল্লাহর সমীপে নত থাকা, তাঁর আনুগত্যমূলক কাজের মাধ্যমে তাঁর ভালবাসায় অনুপ্রাণিত হওয়া, তাঁর ক্রোধে পতিত হওয়ার ভয়ে তাঁর নাফরমানি থেকে বাঁচা, পাপীদেরকে তাঁর দিকে ফেরাতে প্রাণান্ত জিহাদ করা।
আল্লাহর কিতাবের জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ আল্লাহর কিতাব শেখা, অন্যদের শিখানো, মুখে উচ্চারণকালে হরফসমূহ তাজবীদের নিয়ম মেনে পড়া, লেখার সময়ে যথানিয়মে লেখা, অর্থ বুঝা, তার সীমা হেফাযত করা, তার বিষয়বস্ত্ত অনুসারে আমল করা, বাতিলপন্থীদের হাতে কুরআনের রদ-বদল রোধে ভূমিকা রাখা।
আল্লাহর রাসূলের জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ আল্লাহর রাসূলকে সম্মান করা, জীবনে-মরণে তাঁকে সাহায্য করা, শেখা এবং অন্যদের শিখানোর মাধ্যমে তাঁর সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করা, তাঁর কথা ও কাজ মেনে চলা, তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের মহববত করা।
মুসলিম শাসকদের কল্যাণ কামনার অর্থ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তাদেরকে সাহায্য করা, দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাদের সতর্ক করা, তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করা, তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকা, তাদের প্রতি যারা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায় তাদের প্রতিবাদ করা এবং সম্ভব হ’লে আপোষে মিল করে দেওয়া। তাদের প্রতি সবচেয়ে বড় কল্যাণ করা হবে সুন্দরতম উপায়ে তাদেরকে যুলুম-অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখা।
আম মুসলমানের কল্যাণ কামনার অর্থ তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে যা যা কল্যাণপ্রসূ সেসব বিষয়ে তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা, তাদেরকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, দ্বীনের যেসব বিষয়ে তারা অজ্ঞ সেসব বিষয় তাদের শিখিয়ে দেওয়া, কথা ও কাজের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা, তাদের দোষ গোপন রাখা, তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করা, তাদের জন্য যা অপকারী তা দমন করা এবং যা উপকারী তা যোগাড় করে দেওয়া, খুবই নম্রতা ও ইখলাছের সঙ্গে তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা, তাদের প্রতি দয়া ও করুণা করা, তাদের বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা, সদুপদেশের মাধ্যমে তাদের সাথে মিত্রতা বজায় রাখা, তাদের সাথে প্রতারণা-হিংসা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা, নিজের জন্য ভাল যা কিছু পসন্দনীয় তা তাদের জন্য ভালবাসা, নিজের জন্য যা কিছু অপসন্দনীয় তা তাদের জন্যও অপসন্দ করা, তাদের জান-মাল-ইয্যতের হেফাযত করা, উল্লেখিত নছীহতসমূহ যাতে তাদের চরিত্রে রূপায়িত হয় সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং আনন্দিত চিত্তে তারা যেন ভাল কাজে আগুয়ান হয় সেজন্য তাদের উদ্দীপ্ত করা। সালাফদের মধ্যে অনেককে তো নছীহত করতে গিয়ে নিজের জাগতিক ক্ষতিও সইতে হয়েছে।
৭. মানুষের মাঝে মীমাংসা করে দেওয়া :
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا،
‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।
আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন, লোকেরা যে গোপনে আলোচনা এবং বলাবলি করে তার অনেক কিছুতেই কোন খায়ের-বরকত নেই। হয়তো সেসব কথা আদতেই অনর্থক। যেমন- বৈধ গালগল্প করা; নয়তো তা খারাপ ও ক্ষতিকারক, যেমন- হারাম অশ্লীল কথাবার্তা, পরনিন্দা, গালি ইত্যাদি।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিক্রম হিসাবে বলেছেন, তবে যারা ছাদাক্বা করার আদেশ দেয়, যে ছাদাক্বা হ’তে পারে ধন-সম্পদ, হ’তে পারে বিদ্যা, হ’তে পারে অন্য যে কোন প্রকার উপকার, এমনকি তার মধ্যে ইবাদতে কাছেরাও (যে ইবাদতের ছওয়াব ও উপকার কেবল নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ) শামিল হ’তে পারে। যেমন- নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
إِنَّ بِكُلِّ تَسْبِيحَةٍ صَدَقَةً، وَكُلُّ تَكْبِيرَةٍ صَدَقَةٌ، وَكُلُّ تَحْمِيدَةٍ صَدَقَةٌ، وَكُلُّ تَهْلِيلَةٍ صَدَقَةٌ، وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوفِ صَدَقَةٌ وَنَهْيٌ عَنِ الْمُنْكَرِ صَدَقَةٌ وَفِي بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ-
‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) পাঠ ছাদাক্বা, প্রত্যেক তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ ছাদাক্বা, প্রত্যেক তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) পাঠ ছাদাক্বা, প্রত্যেক ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা ছাদাক্বা, সৎকাজের আদেশ দান ছাদাক্বা, অসৎকাজের নিষেধ ছাদাক্বা, এমনকি তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মিলনও ছাদাক্বা’।[8]
‘অথবা সৎকাজের আদেশ দেয়’ এখানে আয়াতে বর্ণিত ‘মা‘রূফ’ অর্থ সৎ ও ভাল কাজ। শরী‘আত ও বিবেকে যা কিছু ভাল বলে বিবেচিত তাই মা‘রূফ। কুরআন সুন্নাহর কোন স্থানে যখন মা‘রূফের আদেশের সাথে মুনকারের নিষেধ করার কথা উল্লেখ থাকবে না সেখানে মা‘রূফের আদেশের সাথে মুনকারের নিষেধও অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা মুনকার পরিহারও মা‘রূফের অন্তর্ভুক্ত। আর ভাল কাজ পরিপূর্ণ হয় না মন্দ কাজ ত্যাগ না করা পর্যন্ত। যে ভাল-মন্দ দু’টিই করে তাকে সৎলোক বলা যায় না। তবে যেখানে মা‘রূফ ও মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ নিষেধ) একই সাথে উল্লেখ থাকে সেখানে মা‘রূফ বলতে অনুমোদিত কাজ এবং মুনকার বলতে নিষিদ্ধ কাজ বুঝায়।
মীমাংসা কেবল দুই দ্বন্দ্বমুখর বিবদমান পক্ষের মাঝে হয়ে থাকে। দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, বিবাদ, রাগারাগী যে কত বড় ক্ষতি ও মানুষে মানুষে কত দূরত্ব তৈরি করে তা বলে শেষ করা যায় না। এজন্যই শরী‘আত প্রবর্তক মানুষের জান-মাল-ইয্যত কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মীমাংসার উপর জোর দিয়েছে। এমনকি ধর্মে ধর্মে সংঘাতের মীমাংসার বিষয়েও ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَوْ أَنَّهُمْ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَمَثُوبَةٌ
‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং (দ্বীনের ব্যাপারে) পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
তিনি আরো বলেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ-
‘যদি মুমিনদের দুই দল পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর সীমালংঘন করে, তাহ’লে তোমরা ঐ দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যে দল সীমালংঘন করে। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের (সন্ধির) দিকে ফিরে আসে। অতঃপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তোমরা উভয় দলের মধ্যে ন্যায়ানুগভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)।
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘মীমাংসাই উত্তম (নিসা ৪/১২৮)। সংঘাতের মুখোমুখি লোকেদের মাঝে মীমাংসার জন্য যে ব্যক্তি দৌড়-ঝাঁপ ও চেষ্টা করে সে সালাত আদায়কারী, ছিয়াম পালনকারী ও ছাদাক্বাদাতা থেকে উত্তম।
মীমাংসাকারীর চেষ্টা-সাধনা ও কর্মকান্ড আল্লাহ তা‘আলা ঠিকঠাক করে দেন। পক্ষান্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কর্মকান্ডকে আল্লাহ তা‘আলা সংশোধন করেন না এবং তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও পূরণ হয় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
إِنَّ اللهَ لَا يُصْلِحُ عَمَلَ الْمُفْسِدِينَ
‘নিশ্চয় আল্লাহ বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হ’তে দেন না’ (ইউনুস ১০/৮১)।
এ সকল জিনিস যেখানে যেভাবেই করা হোক তা হবে কল্যাণকর। যেমনটা আয়াতে উল্লেখিত ব্যতিক্রম থেকে পরিস্কার বুঝা যায়। কারণ এ কাজগুলো সঞ্চারণশীল কল্যাণবাহী। তবে ছওয়াবের পরিপূর্ণতা ও সম্পূর্ণতা নির্ভর করে আমলকারীর নিয়তের উপর। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।[9]
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِنَّ أَفْضَلَ الصَّدَقَةِ إِصْلَاحُ ذَاتِ الْبَيْنِ-
‘নিশ্চয়ই দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করে দেওয়া শ্রেষ্ঠ ছাদাক্বা’।[10]
আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلَاةِ وَالصَّدَقَةِ؟ قَالُوا: بَلَى، يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: إِصْلَاحُ ذَاتِ الْبَيْنِ-
‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম, সালাত ও ছাদাক্বার থেকেও শ্রেষ্ঠ আমলের সন্ধান দিব না? তারা বললেন, কেন নয়, অবশ্যই দিবেন। তিনি বললেন, দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করে দেওয়া’।[11]
সন্দেহ নেই যে, ছিয়াম ও সালাতের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। এ দু’টি ইসলামের স্তম্ভ। এখানে নফল সালাত ও ছিয়ামকে বুঝানো হয়েছে। এমতাবস্থায় নফল সালাত ও ছিয়াম থেকে দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করা উত্তম হবে। কেননা নফল সালাত ও ছিয়ামের ছওয়াব ও কল্যাণ কেবল আমলকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। পক্ষান্তরে দু’পক্ষের মাঝে মীমাংসা করার উপকার ও কল্যাণ অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি তার সময় পরস্পরের দ্বন্দ্ব মীমাংসায় ব্যয় করে সে ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম যে নফল সালাত ও ছিয়ামে সময় ব্যয় করে।
৮. সুফারিশ ও মযলূমদের সাহায্য :
একজন মুসলিম তার মুসলিম ভাইয়ের উপকার সাধন কিংবা ক্ষতি থেকে রক্ষায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করতে পারে। এটাই হচ্ছে স্বীয় পদমর্যাদা দিয়ে মুসলিমদের কল্যাণ সাধন। আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে যখন কোন ভিক্ষুক/প্রার্থী আসত অথবা তাঁর কাছে কোন প্রয়োজন পূরণের আবেদন করা হ’ত তখন তিনি বলতেন,
اشْفَعُوا فَلْتُؤْجَرُوا وَيَقْضِي اللهُ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا شَاءَ-
‘তোমরা সুফারিশ করো, তাতে তোমাদের ছওয়াব মিলবে। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর যবান দিয়ে সেই ফায়ছালা করিয়ে নেন যা তিনি চান’।[12]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস অনুসারে বুঝা যায়, মুবাহ প্রয়োজনের যারা মুখাপেক্ষী তাদের জন্য সুফারিশ করা মুস্তাহাব। এ সুফারিশ চাই রাষ্ট্রপ্রধান, গভর্ণর কিংবা তাদের মতো কারো কাছে করা হোক, কিংবা অন্য যেকোন মানুষের কাছে করা হোক। রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে সুফারিশ যুলুম-অত্যাচার বন্ধের জন্য হোক, কিংবা লঘু কোন দন্ড মওকূফের জন্য হোক, অথবা অভাবগ্রস্ত মানুষের ভাতা ছাড় ইত্যাদি কাজের জন্য হোক। তবে হদ্দ বা আল্লাহর নির্ধারিত দন্ড মওকূফের জন্য সুফারিশ করা হারাম। তেমনি কোন বাতিল বিষয় কার্যকর করতে কিংবা কোন হক বা ন্যায়কে বাতিল করার মত কাজে সুফারিশ করা হারাম।[13]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উক্তি (আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর যবান দিয়ে সেই ফায়ছালা করিয়ে নেন যা তিনি চান) থেকে এ নির্দেশনা মেলে যে, সুফারিশের জন্য চেষ্টা-তদবিরকারীর চেষ্টা সফল হোক, কিংবা ব্যর্থ হোক তিনি উভয় অবস্থাতেই ছওয়াব পাবেন।[14]
নবী করীম (ﷺ) মুসলিমদের উপকার ও কল্যাণার্থে নিজেও তাঁর পদমর্যাদা ব্যবহার করেছেন। তিনি তাদের জন্য সুফারিশ করতেন, এমনকি তাদের একান্ত নিজস্ব বিষয়েও।
বারীরা (রাঃ)-কে যখন তার মনীব মুক্ত করে দেন তখন তিনি তার বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করে দেন। তার স্বামী তখনও দাস ছিলেন। বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করায় তার স্বামী খুবই ব্যথিত হন। স্ত্রীকে তিনি যারপরনাই ভালবাসতেন। স্ত্রীকে ফিরে পাবার জন্য তিনি মদীনার রাস্তায় রাস্তায় তার পিছন পিছন কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতেন। স্ত্রী যাতে ফিরে আসে সেজন্য তিনি নবী করীম (ﷺ)-কেও তার নিকট সুফারিশ করার জন্য ধরে বসেন। নবী করীম (ﷺ)ও সুফারিশ করেন। তিনি বারীরাকে বলেন,
لَوْ رَاجَعْتِيهِ، فَإِنَّهُ أَبُو وَلَدِكِ قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَتَأْمُرُنِي؟ قَالَ: إِنَّمَا أَنَا شَفِيعٌ قَالَتْ: فَلاَ حَاجَةَ لِي فِيهِ-
‘তুমি যদি তার কাছে ফিরে যেতে! সে তো তোমার সন্তানদের জনক। বারীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কি আমাকে হুকুম করছেন? তিনি বললেন, ‘না, আমি কেবল সুফারিশকারী’। বারীরা বললেন, তাকে আমার কোনই প্রয়োজন নেই’।[15]
* এটি ছিল যাতুর রিকা যুদ্ধ। বেদুঈন কিছু গোত্রের অতর্কিতে মদীনা আক্রমণের খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযানে গিয়েছিলেন।
[1]. আহমাদ হা/১৪৪৫১; আবুদাউদ হা/১৯৮।
[2]. বুখারী হা/৪৫০; মুসলিম হা/৫৩৩।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/২৪২; সহীহুত তারগীব হা/৭৭; মিশকাত হা/২৫৪।
[4]. বুখারী হা/৪৪৭;আহমাদ হা/১১৮৭৯; সহীহ ইবনু হিববান হা/২৬৫৩।
[5]. মুসলিম হা/৫৫; আবুদাঊদ হা/৪৯৪৪; মিশকাত হা/৪৯৬৬।
[6]. ফাৎহুল বারী ১/১৩৮।
[7]. নববী, শরহ মুসলিম ২/৩৭।
[8]. মুসলিম হা/১০০৯; আহমাদ হা/২১৫১১; মিশকাত হা/১৮৯৮।
[9]. তায়সীরুল কারীমির রহমান, পৃ. ২০২।
[10]. মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ হা/৩৩৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৬৩৯।
[11]. আবুদাউদ হা/৪৯১৯; তিরমিযী হা/২৫০৯; মিশকাত হা/৫০৩৮; সহীহুল জামে‘ হা/২৫৯৫।
[12]. বুখারী হা/৬০২৭; মুসলিম হা/২৬২৭; মিশকাত হা/৪৯৫৬।
[13]. নববী, শরহ মুসলিম ১৬/১৭৭।
[14]. ইবনু বাত্তাল, শরহ বুখারী, ৩/৪৩৪।
[15]. নাসাঈ হা/৫৪১৭; ইবনু মাজাহ হা/২০৭৫; দারেমী হা/২২৯২।
-মূল (আরবী) : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
Last edited: