‼️ পোস্টটি সুন্দরভাবে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।‼️

দাওয়াহ বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৩য় কিস্তি)

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,544
Credits
2,602
সঞ্চারণশীল উপকারমূলক আমলের কিছু নমুনা

১. আল্লাহর দিকে দাওয়াত :

অন্যদের জন্য উপকারী যত আমল আছে তন্মধ্যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দান সর্বোত্তম। আসলে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহবান জানানো এবং দ্বীনের চিন্তা-ভাবনা মনে লালন ও দ্বীনের তাবলীগের মতো অন্যদের জন্য উপকারী আমল দ্বিতীয়টি নেই। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা এহেন কাজের দায়িত্ব দান করেছিলেন নবী-রাসূলগণের উপর, যারা ছিলেন আদম সন্তানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনিভাবে যারা তাদের পথের পথিক তাদেরও একই দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ-​

‘ঐ ব্যক্তির চাইতে কথায় উত্তম আর কে আছে, যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয়ই আমি আজ্ঞাবহদের অন্তর্ভুক্ত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৩)

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর দিকে ডাকে’ অর্থ, আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর দিকে ডাকে। ‘নিজে সৎকাজ করে এবং বলে যে, আমি মুসলিমদের একজন’ অর্থাৎ সে যে কথা বলে সেটা নিজে আমল করে। ফলে তার কাজের উপকারিতা সে নিজে যেমন পায়, অন্যেরাও তেমনি পায়। সে তাদের শ্রেণীভুক্ত নয় যারা অন্যদের সৎকাজের আদেশ করে কিন্তু নিজেরা করে না, আবার অন্যদের অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে কিন্তু নিজেরা সে নিষেধ মানে না। বরং সে ভাল কাজ করে এবং মন্দ কাজ পরিহার করে। আর সৃষ্টিকে তার মহান স্রষ্টার দিকে ডাকে। এ আয়াতের বিধান ‘আমভাবে তাদের সকলের জন্য, যারা ভাল কাজের দিকে ডাকে এবং নিজেরা সৎপথ অাঁকড়ে ধরে থাকে’।[1]

ফলতঃ আল্লাহর পথে দাওয়াতদাতাগণ তাদের চোখের সামনে (গুমরাহীতে) ডুবন্ত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে সন্তুষ্ট চিত্তে নিশ্চিন্ত মনে নিশ্চেষ্ট বসে থাকতে পারে না। পথের দিশারীর অভাবে পথহারা মানুষ যখন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন আল্লাহর পথের দাঈগণ মানবতা খুইয়ে তাদেরকে ঐ অবস্থায় ছেড়ে থাকতে পারে না। তারা তাদের ইলম বা বিদ্যা মাটির তলে দাফন করে দেয়নি, আবার তাদের বিদ্যা ও বিবেক-বুদ্ধি নিজেদের কাছেই বন্ধক রাখেনি, বরং তারা আরামের ঘুম হারাম করে, অলসতার ধুলি নিজেদের গা থেকে ঝেড়ে ফেলে অন্যদের জন্য আলোর মশাল হাতে করে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয় পড়ে। তারা আল্লাহর পথ সম্পর্কে অজ্ঞদের আল্লাহর পথ শিক্ষা দেয়। এ পথ সম্পর্কে উদাসীন-গাফেলদের সজাগ করে তোলে এবং পথহারা গুমরাহদের আল্লাহর হুকুমে তাঁরই দেওয়া ক্ষমতাবলে পথের দিশা দেয়।

অন্যদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপকারী কর্ম হ’ল, তাদেরকে কুফুরী, বিদ‘আত ও পাপাচারের অন্ধকার থেকে বের করে তাওহীদ, সুন্নাহ ও সৎকাজের পথ বাৎলে দেওয়া। আল্লাহ বলেন,

أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُوْرًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْكَافِرِينَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ-​

‘আর যে ব্যক্তি মৃত ছিল, অতঃপর আমরা তাকে জীবিত করেছি এবং তাকে আলো দিয়েছি যা দিয়ে সে লোকদের মধ্যে চলাফেরা করে, সে কি ঐ ব্যক্তির মত হ’তে পারে, যে অন্ধকারে ডুবে আছে ও সেখান থেকে বের হবার পথ পায় না। এভাবেই অবিশ্বাসীদের জন্য তাদের কৃতকর্ম সুশোভিত করে দেওয়া হয়’ (আন‘আম ৬/১২২)

২. মানুষকে উপকারী বিদ্যা শিক্ষাদান :

সঞ্চারণশীল উপকারের যে সকল মূল্যবান ক্ষেত্র রয়েছে তন্মধ্যে মানুষকে ভাল কিছু শিক্ষাদান এবং তাদের সামনে হালাল-হারামের পরিচয় তুলে ধরা অন্যতম। এজন্যেই মানুষকে শিক্ষাদানের ফযীলত বা মাহাত্ম্য সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

মু‘আয বিন আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهِ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ-​

‘যে ব্যক্তি ইলম বা বিদ্যা শিখাবে তার জন্যও সেই পরিমাণ ছওয়াব মিলবে, যে পরিমাণ ছওয়াব সেই বিদ্যা অনুযায়ী আমলকারীর মিলবে। আমলকারীর ছওয়াব তাতে কমবে না’।[2]

ওছমান (রাঃ) নবী করীম (ﷺ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ​

‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়’।[3]

হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) ফাৎহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন,

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ​

‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়’ বাক্যটিতে নিঃসন্দেহে ফুটে উঠেছে যে, কুরআন নিজে শেখা ও অন্যকে শিক্ষাদানের মতো দু’টি কাজ যার মধ্যে একত্রিত হয়েছে তিনি নিজেকে যেমন পরিপূর্ণকারী, তেমনি অন্যকেও পরিপূর্ণকারী। তিনি সীমাবদ্ধ কল্যাণ ও সঞ্চারণশীল কল্যাণকে একত্রিতকারী। এজন্যই তিনি শ্রেষ্ঠ। এ ধরনের লোক আল্লাহ তা‘আলার বাণী

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ،​

‘ঐ ব্যক্তির চাইতে কথায় উত্তম আর কে আছে, যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয়ই আমি আজ্ঞাবহদের অন্তর্ভুক্ত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৩) এর মধ্যে বর্ণিত লোকদের শ্রেণীভুক্ত। আল্লাহর দিকে দাওয়াত নানা কাজের মাধ্যমে হয়, তন্মধ্যে কুরআন শিক্ষাদান অন্যতম এবং তা সবচেয়ে বেশী মর্যাদাপূর্ণ।[4]

আবু মূসা (রাঃ) নবী করীম (ﷺ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

مَثَلُ مَا بَعَثَنِى اللهُ بِهِ مِنَ الْهُدَى وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ الْغَيْثِ الْكَثِيرِ أَصَابَ أَرْضًا، فَكَانَ مِنْهَا نَقِيَّةٌ قَبِلَتِ الْمَاءَ، فَأَنْبَتَتِ الْكَلأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيرَ، وَكَانَتْ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ، فَنَفَعَ اللهُ بِهَا النَّاسَ، فَشَرِبُوا وَسَقَوْا وَزَرَعُوا، وَأَصَابَتْ مِنْهَا طَائِفَةً أُخْرَى، إِنَّمَا هِىَ قِيعَانٌ لاَ تُمْسِكُ مَاءً، وَلاَ تُنْبِتُ كَلأً، فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقِهَ فِى دِينِ اللهِ وَنَفَعَهُ مَا بَعَثَنِى اللهُ بِهِ، فَعَلِمَ وَعَلَّمَ، وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأْسًا، وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللهِ الَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ-​

‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হেদায়াত ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত হ’ল ভূমিতে পতিত প্রবল বৃষ্টিপাতের ন্যায়। কোন ভূমি উর্বর যা পানি শুষে নেয়। ফলে সেখানে প্রচুর ঘাস ও তরুলতা জন্মে। আবার কিছু ভূমি কঠিন যা পানি ধরে রাখে। ফলে তা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপকার লাভের সুযোগ করে দেন। তারা সে পানি পান করে, অন্যদের পান করায় এবং ক্ষেত-খামার আবাদ করে। বৃষ্টি আরেক প্রকার ভূমিতে পতিত হয়, যা একেবারে মসৃণ, পানি মোটেও ধরে রাখতে পারে না এবং ঘাস-তরুলতাও জন্মাতে পারে না। এই হ’ল তার দৃষ্টান্ত যে আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করে এবং আল্লাহ আমাকে যা সহকারে পাঠিয়েছেন তা দ্বারা সে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে শিখে, আবার অন্যদের শেখায়। আবার ঐ বৃষ্টি তারও দৃষ্টান্ত যে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি মাথা তুলে তাকায় না এবং আল্লাহর যে হেদায়াত নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি তা গ্রহণও করে না’।[5]

মহান আল্লাহ বিভিন্ন প্রাণীকে আলেমদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন। আবু উমামা আল-বাহেলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرَضِيْنَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ-​

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, আসমান ও যমীনবাসী এমনকি গর্তের পিপীলিকা ও মাছ পর্যন্ত মানুষকে কল্যাণপ্রদ জিনিস শিক্ষাদানকারী শিক্ষকের জন্য দো‘আ করে’।[6]

আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ الْعَالِمَ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِيْ جَوْفِ الْمَاءِ، وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلَا دِرْهَمًا، وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ-​

‘যে ব্যক্তি ইলম শেখার মানসে কোন পথ ধরে চলে আল্লাহ সেজন্য তাকে জান্নাতের পথে চালিত করবেন। আর নিশ্চয়ই ফেরেশতারা বিদ্যার্থী-ছাত্রদের খুশি করার মানসে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয়। আর নিশ্চয়ই আলেমের জন্য আসমান ও যমীনবাসী এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে। আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর তদ্রূপ, যদ্রূপ চাঁদের মর্যাদা সকল তারকার উপর। নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী এবং নবীগণ দীনার ও দিরহামের উত্তরাধিকারী রেখে যাননি, তাঁরা ইলমের উত্তরাধিকারী রেখে গেছেন। সুতরাং যে তা লাভ করবে সে পূর্ণ অংশ লাভ করবে’।[7]

কেন প্রাণীকুল আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে?

প্রথমত :
যেহেতু সে জনগণকে আল্লাহর শরী‘আত বা বিধান শিক্ষা দেয় তাই এটি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত তার সম্মান।

দ্বিতীয়ত : আলেমের ইলমের উপকার অন্যদের মাঝে এতটা সঞ্চারিত হয় যে, প্রাণীকুল পর্যন্ত তাতে উপকৃত হয়। কেননা আলেমগণ পশু-পাখির প্রতিও দয়া করতে আদেশ দেন,

فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ-​

‘যখন তোমরা হত্যা করবে তখন দয়াপরবশ হয়ে হত্যা করবে এবং যখন যবেহ করবে তখন দয়াপরবশ হয়ে যবেহ করবে’।[8]
এতদসঙ্গে তারা যবহের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বিধানও বর্ণনা করেন। ফলে পশু-পাখিকুলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার এবং তাদের প্রতি দয়া করার প্রতিদানে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আলেমদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

কাযী মুবারকপুরী (রহঃ) ‘আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর তদ্রূপ, যদ্রূপ চাঁদের মর্যাদা সকল তারকার উপর’ এ সম্পর্কে বলেন,

شَبَّهَ العالم بالقمر والعابد بالكواكب؛ لأن كمال العبادة ونورها لا يتعدى من العابد، ونور العالم يتعدى إلى غيره-​

‘আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আলেমকে চাঁদের সাথে এবং আবেদকে তারার সাথে উপমা দিয়েছেন এজন্য যে, ইবাদতের পূর্ণতা ও নূর আবেদ থেকে অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হয় না, কিন্তু আলেমের ইলমী নূর তার থেকে অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হয়’।[9]

ইবাদতে লিপ্ত থাকা উত্তম, না ইলমচর্চা ও শিক্ষাদানে রত থাকা?

হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, আদিষ্ট ব্যক্তির উপর ফরযে আইন বা ব্যক্তিগত ফরযের অতিরিক্ত আমলের পরিধি যতই বৃদ্ধি পাবে সেগুলো পালনে মানুষ দুই শ্রেণীর হবে। এক শ্রেণী যারা চিন্তাশীল ও লেখনী শক্তির অধিকারী। তাদের জন্য চিন্তা-গবেষণা ও লেখালেখি ছেড়ে ইবাদতে ব্যস্ত হওয়ার তুলনায় চিন্তা-গবেষণা ও লেখালেখিতে লিপ্ত হওয়া উত্তম। কারণ এ কাজের মধ্যে অন্যদের মাঝে সঞ্চারণশীল উপকার বিদ্যমান। আর যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে এ বিষয়ের অভাব বোধ করে তার কর্তব্য নফল ইবাদতে মনোনিবেশ করা। কেননা একই সঙ্গে দু’টো কাজ আঞ্জাম দেওয়া এক ব্যক্তির পক্ষে দুরূহ। এক্ষেত্রে প্রথমজন যদি বিদ্যাচর্চা ছেড়ে দেয় তাহ’লে তার এ মুখ ফেরানোর দরুন শরী‘আতের কিছু বিধি-বিধান বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। আবার দ্বিতীয় জন যদি ইবাদত ছেড়ে ইলম চর্চায় মশগূল হয় তবে সে দু’টি সুযোগই হারাবে। কারণ তার তো ইলমের পুঁজি নেই, আবার অন্যদিকে ইবাদতকে উপেক্ষা করায় সেই সুযোগও সে নষ্ট করবে’।[10]

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য নিজে কুরআন পড়া, অন্যকে কুরআন পড়ানো এবং নিজে বিদ্যা শেখা ও অন্যদের শেখানো জায়েয আছে। ই‘তিকাফরত অবস্থায় এসব কাজ করা মাকরূহ বা অপসন্দনীয় নয়’।[11]

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন,

طَلَبُ الْعِلْمِ أَفْضَلُ مِنْ صَلاةِ النَّافِلَةِ​

‘বিদ্যাচর্চা নফল সালাত আদায় থেকে উত্তম’।[12]
কেননা বিদ্যাচর্চা করা ফরযে কিফায়া, আর ফরযে কিফায়া নফল থেকে উত্তম। বিদ্যার মাধ্যমে সালাত ও অন্যান্য ইবাদত সহীহ-শুদ্ধ করা হয়, বিদ্যার উপকারিতা বিদ্বান থেকে জনমানুষের মাঝে সঞ্চারিত হয়। তাছাড়া প্রচুর হাদীস থেকে সাক্ষ্য মেলে যে, নফল সালাত আদায়ে লিপ্ত হওয়া থেকে বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত হওয়া শ্রেয়।

শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) অনেক দিন নফল ছিয়াম ছেড়ে দিতেন এবং বলতেন, ছিয়ামের ফলে মানুষের দরকার পূরণে শরীরে দুর্বলতা দেখা দেয়।

৩. আল্লাহর পথে জিহাদ :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল আল্লাহর পথে জিহাদের সমতুল্য আমল কোনটি? তিনি বললেন,

لاَ تَسْتَطِيعُونَهُ قَالَ فَأَعَادُوا عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا كُلُّ ذَلِكَ يَقُولُ لاَ تَسْتَطِيعُونَهُ. وَقَالَ فِى الثَّالِثَةِ مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِى سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ الْقَانِتِ بِآيَاتِ اللهِ لاَ يَفْتُرُ مِنْ صِيَامٍ وَلاَ صَلاَةٍ حَتَّى يَرْجِعَ الْمُجَاهِدُ إِلَى أَهْلِهِ-​

‘তোমরা তা করতে সমর্থ হবে না। বর্ণনাকারী বলেন, তারা দু’বার কিংবা তিনবার প্রশ্নটি করলেন। প্রতিবারই তিনি বললেন, তোমরা তা করতে সমর্থ হবে না। তৃতীয়বারে তিনি বললেন, আল্লাহর পথের মুজাহিদের দৃষ্টান্ত সেই ছিয়াম ও সালাত আদায়কারী এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি অনুগত ব্যক্তির ন্যায় যে ঐ মুজাহিদের নিজ পরিবারে ফিরে আসা অবধি বিরতিহীনভাবে সালাত ও ছিয়ামে রত থাকে’।[13]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিজ্ঞেস করা হ’ল যে,

يَا رَسُولَ اللهِ، أَىُّ النَّاسِ أَفْضَلُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُؤْمِنٌ يُجَاهِدُ فِى سَبِيلِ اللهِ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ قَالُوا ثُمَّ مَنْ قَالَ مُؤْمِنٌ فِى شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَتَّقِى اللهَ، وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ-​

‘হে আল্লাহর রাসূল! কোন লোক উত্তম? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সেই মুমিন যে আল্লাহর পথে নিজের জান ও মাল দিয়ে যুদ্ধ করে। তারা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, কোন গিরিপথে বসবাসকারী সেই মুমিন যে আল্লাহকে ভয় করে এবং লোকেদের ক্ষতি করা থেকে নিজেকে দূরে রাখে’।[14]

মুজাহিদ ব্যক্তি মানুষের সংস্রব ত্যাগকারী মুমিন থেকে উত্তম এ কারণে যে, সে তার জান-মাল ব্যয় করে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। একই সাথে এর মধ্যে সঞ্চারণশীল উপকারিতা বিদ্যমান রয়েছে। কেননা জিহাদের ফলে মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করে, কুফর ও কাফের লোকেরা অপদস্থ হয়, দ্বীনের সীমারেখা সুরক্ষিত থাকে, মুসলিমদের ইয্যত-আব্রুর হেফাযত হয়। এছাড়া আরো নানাবিধ উপকার জিহাদের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

অন্যান্য উম্মতের উপর মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্বের কারণও এই মানবকল্যাণ। তারা অন্যান্য জাতির তুলনায় মানবজাতির বেশী কল্যাণকারী। মানুষের জন্য সার্বিকভাবে সবচেয়ে দরকারী যে জিনিস তা এই উম্মতই মানবজাতির দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে তাদের কল্যাণ করে থাকে। সেই দরকারী জিনিসটা হচ্ছে ইসলামের পথের দিশা দান এবং তার প্রেক্ষিতে তাদের জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির চেষ্টা।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর বাণী

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ​

‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে’ সম্পর্কে বলেন,

خَيْرَ النَّاسِ لِلنَّاسِ، تَأْتُونَ بِهِمْ فِى السَّلاَسِلِ فِى أَعْنَاقِهِمْ حَتَّى يَدْخُلُوا فِى الإِسْلاَمِ-​

‘শ্রেষ্ঠ মানুষ তারাই যারা মানুষের জন্য নিবেদিত। তোমরা লোকেদের (যুদ্ধবন্দীদের) গলদেশে শিকল পরিয়ে (অর্থাৎ বন্দি করে) নিয়ে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা ইসলামে প্রবেশ করবে’।[15]

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,

خَيْرَ النَّاسِ لِلنَّاسِ​

‘শ্রেষ্ঠ মানুষ মানুষের জন্য’ কথাটির অর্থ যারা মানুষের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকারী। এ শ্রেষ্ঠত্বের কারণ তারা তাদের ইসলাম গ্রহণের উপলক্ষ’।[16]

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ইবনুল জাওযী (রহঃ) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, উক্ত কথার অর্থ, তারা মুসলিম মুজাহিদদের হাতে বন্দি ও শৃঙ্খলিত হয়ে এসেছে। তারপর যখন তারা ইসলামের শুদ্ধতা জানতে পেরেছে তখন স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। ফলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করেছে’।[17]

৪. আল্লাহর পথে পাহারাদারী :

যেসব আমলের কল্যাণ অন্যদের মাঝে সঞ্চারণযোগ্য তন্মধ্যে আল্লাহর পথে পাহারাদারী অন্যতম। ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেন,

أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِلَيْلَةٍ أَفْضَلَ مِنْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ؟ حَارِسٌ حَرَسَ فِي أَرْضِ خَوْفٍ لَعَلَّهُ لَا يَرْجِعُ إِلَى أَهْلِهِ-​

‘আমি কি তোমাদেরকে ক্বদরের রাতের থেকেও শ্রেষ্ঠ রাতের কথা জানাব না? সে ঐ পাহারাদারের রাত, যে ভয়সঙ্কুল স্থানে পাহারা দেয়, তার আশঙ্কা হয় যে, সে হয়তো তার পরিবারে জীবিত ফিরতে পারবে না’।[18]

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

عَيْنَانِ لَا تَمَسُّهُمَا النَّارُ: عَيْنٌ بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ، وَعَيْنٌ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِي سَبِيلِ اللهِ-​

‘দু’টি চোখকে আগুন স্পর্শ করবে না। এক চোখ যে আল্লাহর ভয়ে কান্না করে। আরেক চোখ যে আল্লাহর পথে (জিহাদে) রাত জেগে পাহারা দেয়’।[19] দু’টি চোখকে আগুন স্পর্শ করবে না অর্থ, দু’শ্রেণীর চোখের মালিকদের আগুন স্পর্শ করবে না। এখানে অঙ্গ বলে পুরো ব্যক্তিকে নির্দেশ করা হয়েছে’।[20]


[1]. তাফসীর ইবনু কাছীর ৭/১৭৯।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২৪০; সহীহুত তারগীব হা/৮০।
[3]. বুখারী হা/৫০২৭; মিশকাত হা/২১০৯
[4]. ফাৎহুল বারী ৯/৭৬।
[5]. বুখারী হা/৭৯; মুসলিম হা/২২৮২; মিশকাত হা/১৫০।
[6]. তিরমিযী হা/২৬৭৫; সহীহুত তারগীব হা/৮১; মিশকাত হা/২১৩।
[7]. তিরমিযী হা/২৬৮২; সহীহুত তারগীব হা/৭০; মিশকাত হা/২১২।
[8]. মুসলিম হা/১৯৫৫; মিশকাত হা/৪০৭৩।
[9]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/৪৭১।
[10]. ফাৎহুল বারী ১৩/২৬৭।
[11]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৬/৫২৮ পৃঃ।
[12]. সিলসিলা আছারুছ সহীহাহ হা/৩৪৮; মুসনাদুশ শাফেঈ হা/১২২৫।
[13]. বুখারী হা/২৭৮৭; মুসলিম হা/১৮৭৮; আহমাদ হা/৯৪৭৭; মিশকাত হা/৩৭৮৮।
[14]. বুখারী হা/২৭৮৬; মুসলিম হা/১৮৮৮
[15]. বুখারী হা/৪৫
[16]. ফাৎহুল বারী ৮/২২৫
[17]. ফাৎহুল বারী ৬/১৪৫
[18]. হাকেম হা/২৪২৪। তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন; সহীহুত তারগীব হা/১২৩২।
[19]. তিরমিযী হা/১৬৩৯; মিশকাত হা/৩৮২৯, সনদ সহীহ।
[20]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/২২



সূত্র: আত-তাহরীক।​
 
Last edited:
COMMENTS ARE BELOW

Share this page