সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।
Mahmud ibn Shahidullah

প্রবন্ধ বাউল মতবাদ

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,445
Credits
2,602
ভূমিকা

বাউল মতবাদ একটি রুচিহীন নিকৃষ্ট যৌন মতবাদ। কিছু অসভ্য বিজাতীয় দর্শনের সমন্বয়ে এ মতবাদের জন্ম হয়েছে। সমাজে যৌনবৃত্তি ছড়ানোই এর মূল কাজ। মানুষকে অসভ্য, বর্বর, রুচিহীন নরপশুতে পরিণত করে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধকে একাকার করার নামে ইসলামকে চরমভাবে কলুষিত করছে আর আড়ালে যৌনাচার ছড়াচ্ছে। এটি এমন নষ্টামি বিস্তার করে তাতে এর সম্পর্কে আলোচনা না করাই উচিত। কিন্তু একশ্রেণীর উচ্চশিক্ষিত জ্ঞানপাপী এই নষ্ট মতবাদের ভক্ত। বাউল গান না শুনলে নাকি তারা তৃপ্তি পায় না। এই দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত থাকলে মুসলিম বলে গণ্য হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এদের জ্ঞাতার্থেই এই আলোচনার অবতারণা।

বাউল মতবাদের পরিচয়

আমাদের দেশের এক ধরনের মানুষ দেখা যায়, যাদের মাথায় লম্বা কেশ, মুখে লম্বা দাড়ি, গোঁফে মুখ ঢাকা, পরনে ডোরকৌপীন, গায়ে আলখেল্লা। কারো মাথায় ও দাড়িতে জট, কারো পরনে সেলাইবিহীন লাল শালু। কারো ন্যাড়া মাথা ও গোঁফ-দাড়ি কামানো। এরাই আউল, বাউল, কর্তাভোজা, সহজিয়া, সাঁই, ন্যাড়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। ভারতীয় সমাজে কথিত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেশির ভাগ মানুষই অতিমানুষ, মহান মানুষ, প্রতিভাবান মানুষের প্রতি ভক্তির মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে তাকে বানিয়ে ফেলেন ঋষি, মহা-ঋষি, যোগী, মুনি, সাধক এবং সবশেষে ভগবান পর্যন্ত করে ফেলেন তাকে।[১]

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শ্রী ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী মহাশয় ‘বাংলার বাউল’ নামের একটি বিখ্যাত বই লিখেছেন। বইটিতে তিনি ঋক-সাম-যজু-অথর্ব বেদ বেদান্ত সামনে করে সংস্কৃত নানা শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বাউল সম্প্রদায়ের মূল উৎস বেদ থেকে। ক্ষিতিমোহন বাবু বাউলদের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দেহের মধ্যেই তাঁহাদের বিশ্ব। জাতি ও সমাজের বন্ধন উভয়ের কাছেই অর্থহীন। এই সন্তমত বা বাউলিয়া মতে সব গুরুরাই প্রায় হীনবংশজাত ও নিরক্ষর। এই সব নিরক্ষর দীনহীনের কথা বহুকাল ভারতের কোন পণ্ডিতজনের লেখায় আত্মপ্রকাশ করতে পারে নাই’।[২]

বাউল মতবাদের উৎপত্তি

ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করে আমাদের ধারণা জন্মেছে যে, নদীয়া যেলা বাউল মতের উদ্ভবের স্থান। কেননা বাংলাদেশের প্রাচীন সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল নদীয়া।[৩]
তাই বৃহত্তর নদীয়ায় বাউল মতের প্রসার অধিক হয়েছে। ঈশ্বরপুরী, চৈতন্যদেব, অদ্বৈতাচার্য হরি গুরু প্রমুখ ছিলেন এর প্রবক্তা। এদের প্রভাবে সুলতানী ও মোগল আমলে ওলী-আউলিয়াদের ইসলাম প্রচার খুব জোরালো হতে পারেনি। বাউল মতবাদের অনুসারী লালন শাহ্ (আনুমানিক ১৮১৫-১৮৮৬ খ্রি.) ১৮২৩ সালে কুষ্টিয়ায় ছেউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করলে তা বাউল মতবাদের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।[৪]

ডাঃ এম.এ. রহীমের মতে, বাউল মতবাদ তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম, সহজিয়া বৈষ্ণববাদ ও ছূফীবাদের ফলশ্রুতি। ন্যাড়া ফকীররাই বাউলদের পূর্বসূরি ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। যে সব বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে তাদের মাথা মুণ্ডন করে ফেলত তাদের থেকে ন্যাড়া ফকীরদের উৎপত্তি হয়েছে। এসব বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক হিন্দু ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং সহজিয়া ভাবধারা নিয়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে তারা বৈষ্ণব সহজিয়াদের অভ্যাসসমূহ গ্রহণ করে। বহু সহজিয়া বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের কেউ কেউ সহজিয়া বিশ্বাসগত মাথা মুণ্ডনের নীতি বজায় রাখে। এরা ‘ন্যাড়া ফকীর’ রূপে পরিচিতি লাভ করে। তাদের অভ্যাসের সঙ্গে শরী‘আতের কোন সম্পর্ক ছিল না।[৫]

মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নদীয়ার শান্তিপুরের কাছে বুড়ল গ্রামে মুনশী আব্দুল্লাহ নামের এক লোক ছিল। শ্রী চৈতন্যের মতো একজন বড় দার্শনিকের কাছে তর্কে পরাজিত হয়ে মুনশীজী শ্রী চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। শ্রী চৈতন্য তার নাম রেখেছিলেন যবন হরিদাস। আশুতোষ দেব তার বাংলা অভিধানে লিখেছেন, যবন হরিদাস একজন মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন। শ্রী চৈতন্যের ভক্ত হয়ে ‘যবন হরিদাস’ হিসাবে খ্যাত হন। এই যবন হরিদাস চৈতন্যের কাছে শিক্ষা-দিক্ষা নিয়ে অশিক্ষিত মুসলিমদের মাঝে প্রচার করতে লাগলো হুঁ-হুঁ- বাবারা ভেদ আছে, ভেদ আছে। মৌলভী মাওলানাদের কাছে আসল ভেদ নেই। আসল ভেদ আমাদের কাছে আছে। এই বলে যবন হরিদাস কিছু ভক্ত তৈরি করে ফেলল। এই ভক্তরাই হল বাউল ফকীরদের দল।[৬] এই কথার সমর্থন মিলে সুরজিৎ দাশগুপ্তের লেখায়। তিনি বলেন ‘চৈতন্যদেব হলেন বাউলদের আদি গুরু।[৭]

মূলত হিন্দু বৌদ্ধ যোগী সন্ন্যাসীদের থেকেই বাউল সহজিয়া ও ন্যাড়া ফকীরদের উৎপত্তি। ইতিহাসে যাদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় তারা সবাই হিন্দু। যেমন সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাউল হলেন আদিনাথ, তার শিষ্য মূলনাথ, তার শিষ্য নিত্যনাথ, নিত্যনাথের বন্ধু ও গুরু ভাই ছিলেন মনাই ফকীর। নিত্যনাথের শিষ্য কালাচাঁদ, তাঁর শিষ্য হারাই, তার শিষ্য দীননাথ, তার শিষ্য ঈষাণ এবং ঈষানের শিষ্য হলেন একালের অন্যতম প্রধান বাউল মদন।[৮]
লালন ফকীরের প্রধান শিষ্যের নাম গগন ডাকহরকরা। তার অপর বিখ্যাত শিষ্যের নাম হরিনাথ মজুমদার, তার শিষ্য ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়।[৯]
উল্লেখ্য, সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে এদের কোন তথ্য ও অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় তা সমস্তই সপ্তাদশ শতাব্দীর পরের।

হিন্দু ধর্মে বর্ণবৈষম্য, উঁচু-নীচু ভেদাভেদের প্রতিকূলে ইসলামের সাম্য ও উদার নীতি-আদর্শ অবলোকন করে বহু হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এই স্রোতকে বাধা দানের জন্যই শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্মের উদ্ভব ঘটান। আর এটা এমন এক ধরনের ধর্মমত, যা হিন্দুও না মুসলিমও না, বরং নতুন এক অনৈসলামী দর্শন।[১০]

বাউল শব্দের উৎপত্তি

‘বাউল’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ড. পঞ্চনন সাহা বলেন, হিন্দী শব্দ ‘বাউরা’ বা উন্মাদ থেকে বাউল কথাটি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন যে, সংস্কৃত ‘বাতুন’ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। অন্যদিকে ছূফীরা সাধু ফকীরকে বলে আউলিয়া। এই আউলিয়া শব্দটি উদ্ধৃত ‘আউল’ শব্দটি ‘বাউল’ শব্দটির সাথে যুক্ত হয়েছে। এই বাউলরা জাত-পাত হিন্দু-মুসলমানে বিচার করে না।[১১] মূলত এরা পাঙ্গাশ ও ক্ষ্যাপা ভাবধারার।

এম. এ. রহীম বলেন, বাউল শব্দটি সংস্কৃত ‘বাতুন’ শব্দ থেকে এসেছে; এর অর্থ পাগল বা মানসিক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি। এভাবে বাউল নামটি একদা ব্যক্তি বিশেষের জন্য ব্যবহৃত হলেও পরবর্তী পর্যায়ে যারা আধ্যাত্মিক উন্মাদনায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকেন, তাদের জন্য উহা সাধারণভাবে প্রচলিত হয়ে যায়।[১২]

গুরু শব্দের উৎপত্তি ও বিকাশ

তারাচাঁদ বলেন, গুরু ভক্তির মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এটা শুরু হয় শী‘আদের দ্বারা এবং গ্রহণ করে ছূফীরা। তবে এটা মানতেই হবে যে, প্রাচীন ভারতীয় একটা ধারণা হল গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা। বেশী পিছনে না গিয়েও যে কেউ তা গুহ্য সূত্র ও ধর্মশাস্ত্রেও দেখতে পাবেন। গুরু ও ব্রহ্মচারীর (ছাত্র) মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে অনেক কথা সেখানে বলা আছে। ছাত্র তার গুরুকে আপন পিতার চেয়েও বেশী মান্য করবে। ছাত্রাবস্থায় গুরুর প্রতি সর্বতোভাবে অনুগত থাকবে এবং সারা জীবনই আনুগত্য বজায় রেখে চলতে হবে। গুরুকে এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গেও তুলনা করা হয়।[১৩] বাউলরা তাদের আধ্যাত্মিক গুরুকে এমন বেশী মর্যাদা দান করে যে, তারা তার মধ্যে বিধাতার প্রতিরূপ দেখতে পায়।[১৪] গুরুই এদের চালিকা শক্তি। গুরু শিক্ষা দিবে, দীক্ষা দিবে। এমনকি সাধন-ভজন সবই গুরু। বাউল ফকীররা বলে,

মন পাগলরে গুরু ভজনা
গুরু বিনে মুক্তি পাবি না।
গুরু নামে আছে সুধা
যিনি গুরু তিনিই খোদা
মন পাগলরে গুরু ভজনা।[১৫]

তাদের এই গানে গুরু আর আল্লাহ একাকার হয়ে গেছে। দু’টি যেন একই সত্তা (নাউযুবিল্লাহ)। হিন্দু শাস্ত্রে যেমন হরির কোন অন্ত নেই। গাছপালা, সাপ, ব্যাঙ, পানি সবই হরি। তেমনি বাউলদের গুরুর অভাব নেই। যেমন তারা গায়-

গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?
তোর অথিত গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন।
গুরু যে তোর বরণ ডালা, গুরু যে তোর মরণ জ্বালা
গুরু যে তোর হৃদয় ব্যথা, যে ঝরায় দু’নয়ন।
কারে প্রণাম করবি মন?[১৬]

বাউলরা নৈরাশ্যের অন্ধকারে গুরুকে প্রদীপ স্বরূপ মনে করে। আধ্যাত্মিক সাফল্য লাভের পর্যায়ে তারা ‘মন গুরু’ ও ‘স্রষ্টা গুরু’ এই দুই ধরনের গুরুর উপস্থিতি অনুভব করে থাকে। বাউলদের মতে, মন গুরুর আরাধনা স্রষ্টা গুরুর আরাধনায় পর্যবসিত হয়। একটি মুর্শীদী সঙ্গীতে লালন শাহ বলেন, মুর্শিদ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন সম্পদ নেই। মুর্শিদের পদামৃতে সব ক্ষুধা তৃষ্ণার তৃপ্তি ঘটে। মনে কোন দ্বিধা-সংশয় রেখ না, যিনিই মুর্শিদ তিনি খোদা।[১৭]

শাস্ত্রহীন বাউল দর্শন

বাউলদের মতে, শাস্ত্রীয় আলোচনা, ধর্মীয় ক্রিয়া-কর্ম ও অনুষ্ঠানগুলো মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে টেনে নেয় এবং সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই লালন শাহ বলেন, ‘বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার, উদয় হয় না দিনমণি’। একটি বাউল গানে আছে, ‘ঘরের মানুষ বসত করে ঘরেতে, বৃথায় তুমি খোঁজ তারে বাহিরে; তোমার নিজের দোষে তুমি চিরকাল ঘুরে মরছ। তুমি গয়া বেনারস ও বৃন্দাবনে ছিলে এবং তীর্থ যাত্রার ছলে তুমি বহু নদ, নদী, বন-উপবন ও অন্যান্য স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছ; কিন্তু বল, এসব জায়গাগুলোতে তুমি যার নাম শুনেছ তার কি কোন চিহ্ন দেখতে পেয়েছ? গোলক-ধাঁধায় পড়ে তুমি তোমার উপলব্ধির সব ক্ষমতা হারিয়ে বসে আছ; স্বীয় বস্ত্রের সঙ্গে মুক্তা বেঁধে তুমি তারই অন্বেষণে সাঁতার কাটছ। সতর্ক থাকলে তুমি সহজেই মুক্তা পেতে পারতে। কিন্তু অসাবধানে তুমি একে একে সবই হারাচ্ছ; মুক্তা তোমার চোখের এত কাছে চকচক করছে, কিন্তু হায়! তুমি তোমার চোখ বন্ধ করে রেখেছ এবং কিছুই দেখতে পাও না’।[১৮]

বাউলের বিশ্বাস মতে, আদিতে আল্লাহ ব্যতীত কিছুই ছিল না। আল্লাহর সত্তাসারের কোন নির্দিষ্ট আকার বা রূপ ছিল না। তিনি সৃষ্টির আদি বর্ণ-ঘন অন্ধকার রূপ বা ‘আল-আমার’ মধ্যে মৃতের মত ঘুমন্ত অবস্থায় বা অবচেতন অবস্থায় ছিলেন। নিজের অজ্ঞাতে তিনি তাঁর নিজের নূরের প্রতি প্রেম-আকর্ষণ অনুভব করে চেতনা লাভ করেন। প্রেম-আকর্ষণের ফলে তিনি নিজেকে প্রকাশ করার বাসনা অনুভব করেন এবং আপন প্রতিরূপ একটি নূর বা আলোক সৃষ্টি করে সেই নূরের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন। এই নূরেই নূরে-মুহাম্মাদী, প্রথম বুদ্ধি বা ‘আকলে কুল’। সৃষ্টির প্রথম দিনে নূরে-মুহাম্মাদীর উৎপত্তি হয় এবং নূরে মুহাম্মাদী থেকে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সকল বস্তু তথা বেহেশত, দোজখ, আরশ, কুরসি, লওহে মাহফুজ, ফেরেশতা, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবী, চৌদ্দ ভূবন, সাগর, মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, জড়জগৎ, উদ্ভিদজগৎ, প্রাণীজগৎ ও মানবজগতের উৎপত্তি হয়। মানুষের দেহ পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়, তার আত্মা পরমাত্মার ‘রূহ’ থেকে সৃষ্ট। আল্লাহ আপন প্রতিরূপে মানুষ সৃষ্টি করেন, তার দেহে আল্লাহ আপন ‘রূহ’ বা আত্মার অনুপ্রবেশ ঘটান এবং পূর্ণ-মানবের মাঝে নিজেকে পূর্ণরূপে প্রকাশ করেন।[১৯]

বাউলরা বিশ্বাস করে যে, নূর (আলো) ও প্রেম (ভালবাসা, আল্লাহর শক্তি) পয়গয়ম্বরের মধ্যে বিকশিত হয়েছে। আল্লাহ তাঁর নিজস্ব মূর্তিতে আদম ও সব মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি আত্মারূপে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিরাজমান। আল্লাহর ক্ষমতা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মধ্যে পূর্ণভাবে উপস্থিত। সুতরাং পয়গম্বর হচ্ছেন ইনসানে কামিল (পূর্ণ মানব)। পয়গম্বর ও শ্রীচৈতন্য মহৎ গুরু। আর বাউলরা আল্লাহকে অন্তরের সহজ মানুষ বা মনের মানুষ রূপে অভিহিত করে।

নূরে মুহাম্মাদীর এই তথাকথিত চিরন্তন স্বরূপ উপলব্ধি করার এক পর্যায়ে মরমি কবি পাঞ্জু শাহ বলেন,

‘মুহম্মদ নাম নূরেতে হয়, নবুয়াতে নবী নাম কয়,
রাসুলুল্লা ফানা-ফিল্লা আল্লাতে মিশেছে।
মুহম্মদ হন সৃষ্টিকর্তা, নবী নামে ধর্ম দত্তা।

এতে মনে হয় কোন কোন মরমি সাধক নূর-নবীকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামে উল্লেখ করেন। লালন চিরন্তন স্ত্রী-শক্তি ও চিরন্তন জড়-শক্তি এবং মুহাম্মাদের সৃষ্টিকর্তা হওয়া সম্পর্কিত মতবাদ সরাসরি স্বীকার না করেও বলেন, ‘আল্লাহর নূরে নবী পয়দা, নবীর নূরে সারা জাহান সৃষ্টি হয়’। তাঁর মতে, ‘আল্লাহর ইচ্ছানুসারে নূরের ছায়াহীন কায়া থেকে ছায়াযুক্ত ত্রিভুবন সৃষ্টি হয়েছে’।

এই মূলত নূরে-মুহাম্মাদী তত্ত্বেরই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আল্লাহর ‘গুপ্ত নূর’ বিবর্তিত হয়ে ‘নূর-নবী’ ও ‘নূর-আদম’-এর উৎপত্তি। সৃষ্টিতত্ত্ব, নির্গমন তত্ত্ব, প্রকাশতত্ত্ব বা অবতরণতত্ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে লালন আরবী অক্ষর ও কুরআনের বাণী ‘আলিফ-লাম-মিম’-এর আশ্রয় গ্রহণ করে বলেন, আল্লাহ, নবী ও আদম যেন বীজ, অঙ্কুর ও গাছ। আল্লাহর একই নূর ‘আহাদিয়াত’ অবস্থায় অব্যক্ত, অপ্রকাশ্য, অচিন, অজ্ঞেয়। ‘ওয়াহ্দানিয়াত’ অবস্থা বা নূর-নবী-অবস্থায় কিঞ্চিৎ ব্যক্ত, সামান্য প্রকাশিত নূর। কিন্তু যাত, আর ওয়াহ্দিয়াত-অবস্থা বা নূরে আদম অবস্থায় অধিকতর ব্যক্ত ও জাগ্রত হয়। এই অবস্থা বর্ণনা করে তিনি রূপকের সাহায্যে বলেন-

‘আলিফ লাম মীম আহাদ-নুরী।
তিন হরফের মর্ম ভারী।।
আলিফেতে আল্লাহ হাদি
মিমেতে নূর মুহাম্মদি
লামের মানে কেউ করলে না
নুক্তা বুঝি হলো চুরি।

ড. মোঃ সোলায়মান আলী সরকার বলেন, আদিতে ‘আহাদ আর আহমদ একলা এক সে আল্লাহ, নবী দুই অবতার এক নূরেতে মিশকাত করা, ‘রাসূলুল্লাহ আর খোদাতালা, ভিন্ন নয় সে একই আল্লাহ, নিগূঢ় করছে খেলা, খেলছে খেলা জাতে’। নূর-নবী পাক-জাতের একটি দিক, একটি রূপ, একটি সত্তা, সামগ্রিক পাক-জাতের সাথে তুলনা করলে তা যেন পাক-জাতের ভিতরেই একটি অচীন-সত্তা, লালনের কথায়,‘অচিন মানুষ’। আত্মপ্রকাশের ইচ্ছে মনে উদয় হওয়ায় এই অচীন-মানুষই যেন আল্লাহর মনের উপর নড়াচড়া শুরু করে, অধর আল্লাহ যেন ‘রস’ রূপ ধারণ করেন, কারণ বারির আবির্ভাব ঘটে, নীরে নিরঞ্জনের অবতার ঘটে, সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু হয়।[২০]

উপেন্দ্রনাথ ভট্টচার্য লালন সম্বন্ধে লিখেছেন, লালন জাতিতে জাতিতে ও ধর্মে ধর্মে কোন পার্থক্য দেখেন নাই। হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মে কোন বিভেদ বুঝেন নাই। তিনি আল্লাহ্কে অধর কালা মুহাম্মাদ ও চৈতন্যদেব উভয়কেই সমানভাবে ঐশী শক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত মানবশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছেন (নাউযুবিল্লাহ্)। তারাই উদ্ধারের জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের মধ্যেই ভগবানের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। লালনের একটি গানে আছে,

যে যা ভাবে সেই যে হয়
রাম রহিম করিম কালা এক আড্ডা জগৎময়।[২১]

লালন তার বিভিন্ন গানে হিন্দু, মুসলিম, রাম ও রহিম, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর চৈতন্যদেব, গুরু আর আল্লাহর মধ্যে কোন ভেদাভেদ খুঁজে পাননি। আসলে পাবে কী করে? সে তো ইসলাম ও মুসলিমের ধার ধারেনি।

বাউল উপাদান

বাউলদের পাঁচটি উপাদান রয়েছে। ড. ‘আবদুর রশীদ তার ‘সুফী দর্শন’ গ্রন্থে বাউলদের পাঁচটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন,

প্রথম উপাদান : গুরুবাদ

প্রত্যেক ধর্ম শাস্ত্রের গুরুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত। গুরুর সাধারণ অর্থ শিক্ষক বা Teacher (ছূফীদের ভাষায় পীর)। কিন্তু বাউলদের গুরু বলতে ভিন্ন অর্থ বুঝায়। তাদের মতে গুরু ও মানব গুরু পরম তত্ত্ব ও ভগবান দুই-ই। লালনের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-

আগমে নিগমে কয়, গুরু রূপে দিন দয়াময়।
অসময়ে মকাশে হয়, যে তারে ভজিবে
গুরুকে মনুষ্য জ্ঞান যার,
অধঃপতে গতি হয় তার।

বাউল মতে, প্রকৃতপক্ষে ভগবানই গুরুরূপে মানুষকে সাধন পথে পরিচালিত করে। তারা মূল গুরু হিসাবে ভগবানকেই বুঝিয়েছে। কাজেই যেই মুর্শিদ, সেই খোদা।[২২]

দ্বিতীয় উপাদান : শাস্ত্র বহির্ভূত ধর্ম

বাউলরা কোন ধর্মের ধার ধারে না। তারা ধর্মকে অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে রাগের আচার অনুসরণ করে। বাউলরা ধর্ম নাশ করেই বাউল হয়। বাউল গানে তাই বলা হয়েছে,

তোমার সেবা ছাড়ি আমি করিল সন্যাস
বাউল হইয়া আমি কৈল ধর্ম নাশ।[২৩]

তাই ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে মনের মানুষ পাওয়া যায় না। আনুষ্ঠানিক ধর্ম প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে অসমর্থ। তাই ধর্মের বিধানের প্রতি বাউলদের ভীতি শ্রদ্ধার অভাব।[২৪]


তথ্যসুত্র :
[১]. আল্লামা গোলাম আহমদ মোর্তজা, এ এক অন্য ইতিহাস (ঢাকা : ২০০৫ ইং), পৃ. ১৮৮।
[২]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬-১৮৭।
[৩]. ফাতেমা ইয়াসমিন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৪বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ২৩১।
[৪]. গোলাম রহমান, প্রসঙ্গ : বাউল সাধনা (রাজশাহী : মাসিক আত-তাহরীক), আগস্ট ২০০৬, পৃ. ১৯।
[৫]. ড: এম. এ. রহীম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৮২), ২য় খ-, পৃ. ২৮৫।
[৬]. মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী, সাধু সাবধান, পৃ. ৩-৪।
[৭]. সুরজিৎ দাস গুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম (কলকাতা, ১৯৯১ ইং), পৃ. ১০৪।
[৮]. ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃ. ১০৫।।
[৯]. প্রাগুক্ত।
[১০]. ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, ভ্রান্তির বেডাজালে ইক্বামতে দ্বীন (রাজশাহী : বাংলাদেশ আহলেহাদীস যুবসংঘ, ২য় সংস্করণ, ২০১৪), পৃ. ১৯৮।
[১১]. ড. পঞ্চনন সাহা, হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক নতুন ভাবনা (ঢাকা, ২০০১), পৃ. ৭৭।
[১২]. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ২য় খ-, পৃ. ২৮৮।
[১৩]. ডঃ তারাচাঁদ, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব (ঢাকা, ১৯৯১), পৃ. ১১১।
[১৪]. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ২য় খ-, পৃ. ২৮৮।
[১৫]. সাধু সাবধান, পৃ. ১৯।
[১৬]. ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃ. ১০৬; হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক নতুন ভাবনা, পৃ. ৮১।
[১৭]. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ২য় খ-, পৃ. ২৮৬-২৮৭।
[১৮]. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ২য় খ-, পৃ. ২৮৬।
[১৯]. লালন শাহের মরমি দর্শন, পৃ. ১২২।
[২০]. লালন শাহের মরমি দর্শন, পৃ. ১৩৩।
[২১]. হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, পৃ. ৭৯।
[২২]. শাইখ রফিকুল ইসলাম, বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ (ঢাকা : আত-তাওহীদ প্রকাশনী, জানুয়ারী ২০১৮), পৃ. ১৮।
[২৩]. এ. এম.এম লুৎফর রহমান, বাউল তত্ত্ব ও বাউল গান (ধরণী সাহিত্য সংসদ), পৃ. ২৭।
[২৪]. বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ, পৃ. ১৮।



সূত্র: আল-ইখলাছ।​
 
Last edited:
COMMENTS ARE BELOW
Top