কুরআন ও তাফসীর বনী ইসরায়েলের জমিনে দুইবার ফেতনা করার বিষয়ক আয়াতগুলোর বিস্তারিত তাফসির- পর্ব:১

Joined
Jan 8, 2025
Threads
6
Comments
8
Reactions
77
বনী ইসরায়েলের জমিনে দুইবার ফেতনা করার বিষয়ক আয়াতগুলোর ব্যাখা- পর্ব:১

وَ قَضَیۡنَاۤ اِلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ فِی الۡکِتٰبِ لَتُفۡسِدُنَّ فِی الۡاَرۡضِ مَرَّتَیۡنِ وَ لَتَعۡلُنَّ عُلُوًّا کَبِیۡرًا ★ فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ اُوۡلٰىهُمَا بَعَثۡنَا عَلَیۡکُمۡ عِبَادًا لَّنَاۤ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ فَجَاسُوۡا خِلٰلَ الدِّیَارِ ؕ وَ کَانَ وَعۡدًا مَّفۡعُوۡلًا ★ ثُمَّ رَدَدۡنَا لَکُمُ الۡکَرَّۃَ عَلَیۡهِمۡ وَ اَمۡدَدۡنٰکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّ بَنِیۡنَ وَ جَعَلۡنٰکُمۡ اَکۡثَرَ نَفِیۡرًا ★ اِنۡ اَحۡسَنۡتُمۡ اَحۡسَنۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ ۟ وَ اِنۡ اَسَاۡتُمۡ فَلَهَا ؕ فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ الۡاٰخِرَۃِ لِیَسُوۡٓءٗا وُجُوۡهَکُمۡ وَ لِیَدۡخُلُوا الۡمَسۡجِدَ کَمَا دَخَلُوۡهُ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ لِیُتَبِّرُوۡا مَا عَلَوۡا تَتۡبِیۡرًا ★ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یَّرۡحَمَکُمۡ ۚ وَ اِنۡ عُدۡتُّمۡ عُدۡنَا ۘ وَ جَعَلۡنَا جَهَنَّمَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ حَصِیۡرًا

আয়াতের অনুবাদ:

আর আমরা কিতাবে বনী ইসরাঈলকে জানিয়েছিলাম যে, অবশ্যই তোমরা পৃথিবীতে দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকারস্ফীত হবে। ★ অতঃপর এ দুটির প্রথমটির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হল তখন আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম, যুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী আমাদের বান্দাদেরকে; অতঃপর তারা ঘরে ঘরে প্ৰবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। আর এটা ছিল এমন প্রতিশ্রুতি যা কার্যকর হওয়ারই ছিল। ★ তারপর আমরা তোমাদেরকে আবার তাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করলাম, তোমাদেরকে ধন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করলাম এবং সংখ্যায় গরিষ্ঠ করলাম। ★ তোমরা সৎকাজ করলে সৎকাজ নিজেদের জন্য করবে এবং মন্দকাজ করলে তাও করবে নিজেদের জন্য। তারপর পরবর্তী নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে (আমি আমার বান্দাদের পাঠালাম) তোমাদের মুখমন্ডল কালিমাচ্ছন্ন করার জন্য, প্রথমবার তারা যেভাবে মসজিদে প্ৰবেশ করেছিল আবার সেভাবেই তাতে প্ৰবেশ করার জন্য এবং তারা যা অধিকার করেছিল তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার জন্য। ★ সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের প্রতি দয়া করবেন, কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের আগের আচরণের পুনরাবৃত্তি কর তবে আমরাও পুনরাবৃত্তি করব। আর জাহান্নামকে আমরা করেছি কাফিরদের জন্য কারাগার। ( সূরা বানী - ইসরায়েল: ৪-৮)

الاتجاهاتُ التفسيريَّةُ في آياتِ علوِّ بني إسرائيل من سُورة الإسراء

এখন "সূরা ইসরায়" বনি ইসরাঈলের ঔদ্ধত্য সম্পর্কিত আয়াতসমূহের তাফসিরমূলক ধারা বর্ণনা করা হচ্ছে:

আল্লাহ তায়ালা আয়াতের মধ্যে বলেছেন:
{لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ}
(অবশ্যই তোমরা পৃথিবীতে দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে) এই দুইবার ফাসাদের বিষয়ে এখতেলাফ রয়েছে। বিশেষ করে প্রথমবারের সময় ও ঘটনা নিয়ে।

এখতেলাফ হয়েছে যেমন-

(১) প্রথমবার ফাসাদ সত্যিই ঘটেছিল কি না?

(২) যদি ঘটে থাকে, তাহলে সেটা ইসলামের আগের সময় ছিল, না ইসলামের পরের সময়?

(৩) ফাসাদ দু’বারই ঘটেছিল, নাকি একবারই ঘটেছিল? আর অন্যটা কি এখনো ঘটেনি?

(৪) এই বার্তা কি শুধুমাত্র বনী ইসরাইল এর জন্য ছিল, নাকি এর কিছু অংশ এই উম্মাহর জন্যও প্রযোজ্য?

এ-বিষয়ে নিম্নে মুফাচ্ছিরিনদের মতগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া হলো, সঙ্গে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাটিও উল্লেখ করা হলো:

প্রথম মত: এ দুই ফসাদ ইসলামের পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল এবং এই বক্তব্যটি শুধুমাত্র বনি ইসরাইলের প্রতি সম্বোধন করা হয়েছে।

এই মতের অনুসারীরা মনে করেন, এই দুটি ফসাদ ইসলামের বহু পূর্বেই সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং, এটি কুরআনের পক্ষ থেকে অতীতের ঘটনাবলির আলোচনা মাত্র। আর এ মতটি বর্ণনা করা হয়েছে হযরত আলী ইবনে আবু তালিব, ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, সাঈদ ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ, হাসান, কাতাদা, সুদ্দি, দহ্‌হাক, রবি ইবনে আনাস, মুকাতিল এবং ইবনু জাইদ থেকে।

এ মতটিকে সমর্থন করেছেন তাফসীরবিদদের মধ্যে: তাবারী, সামরকন্দ, ইবনে আবি যামিন, ছাআলাবী, মাক্কী, মাহদাবী, ওয়াহিদী তিনি এই মতকে "তাফসীরবিদদের মত" বলে উল্লেখ করেছেন, সামআনী, বাগাভি, কারমানী, আবু হাফস নাসাফী, যামাখশরী, ইবনে আতিয়্যাহ, ইবনে জাওযী তাঁর বক্তব্য থেকেও এ মতটি তাফসীরবিদদের অভিমত বলে বোঝা যায়, রাযী, বায়যাবী, ইবন তাইমিয়্যাহ, খাযিনী, ইবন জুযাই, আবু হাইয়্যান, কুমি নাইসাবুরী, কুরআনী, সুয়ূতী, সাআলাবী, আলিমী, ইসমাইল হাক্কী, আলূসী, কাসেমী, মারাগী, সা‘দী, তাহির ইবন আশূর, শানকীতী এবং ওয়াহবাহ যুহাইলী।


তবে বনী ইসরায়েলদের উপর প্রথমবার পাঠানো শাস্তিদানকারি কারা, সেই ব্যক্তিদের পরিচয় নির্ধারণে মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন: তারা ছিল জালূত; আবার কেউ বলেছেন: বুখতেনসর; কেউ বলেছেন: সানহারীব; কেউ বলেছেন: আমালিকাবংশীয়রা; কেউ বলেছেন: পারস্যের কিছু রাজা; আর কেউ বলেছেন: তারা ছিল কিছু মুমিন জাতি।(১)


(১). (আন-নুকাতু ওয়াল-উয়ূন, আলী ইবন মুহাম্মদ আল-মাওয়ার্দী, তাহক্কীক: সাইয়্যিদ ইবন আব্দুল মাকসুদ, প্রকাশনী: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৯,) (তাহযিবু ফীত তাফসীর, আল-হাকিম আল-জুশুমী, তাহক্কীক: আবদুর রহমান আস-সালিমি, প্রকাশনী: দারুল কিতাব আল-মিসরী, কায়রো, প্রথম সংস্করণ, ১৪৩৯ হিজরি, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৫৮)।

আর দ্বিতীয়বারের (শাস্তির) ক্ষেত্রে, ইমাম তাবারী বলেন যে, এটি ছিল হযরত ইয়াহইয়া (আলাইহিস সালাম)–কে হত্যা করার কারণে, এ বিষয়ে তাফসীরবিদদের মধ্যে ইজমা রয়েছে। তবে মতভেদ হয়েছে এই বিষয়ে সেই সময়ে আল্লাহ যাকে পাঠিয়েছিলেন, তিনি কি বুখতনসর ছিলেন, না কি রোমানদের কোনো রাজা?

এই বিষয়ে গভীরভাবে গবেষণাকারী আলিমগণ প্রমান করেন, বুখতনসর হযরত ইয়াহইয়ার যুগে ছিলেন না; বরং তিনি তাঁর বহু শতাব্দী আগের ছিলেন। আর আহলে কিতাবদের ইতিহাস অনুযায়ী, দ্বিতীয়বার পাঠানো ব্যক্তি ছিলেন "এসপিয়ানুস" (إسبيانوس), যিনি ছিলেন রোমানদের একজন সম্রাট।(২)

(২). (আন-নুকাতু ওয়াল-উয়ূন, আল-মাওয়ার্দী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৩০–২৩১) (হাদায়িকুর রূহি ওয়ার-রাইহান, মুহাম্মদ আল-হারারি, প্রকাশনী: দার তৌক আন-নাজাহ, বৈরুত প্রথম সংস্করণ, ১৪২১ হিজরি, খণ্ড ১৬, পৃষ্ঠা ২৭)।

এদের (অর্থাৎ পাঠানো ব্যক্তিদের) পরিচয় নির্ধারণে বড় কোনো উপকার নেই যেহেতু এ বিষয়ে একমত হওয়া গেছে যে, এগুলো ইতিহাসভিত্তিক ঘটনা। মূল উদ্দেশ্য হলো এ-থেকে নসিহত গ্রহণ করা এবং শিক্ষা নেওয়া।(৩)

(৩).(মাফাতিহুল গায়েব ইমাম রাযী- ২০/৩০০, গরয়িবুল কুরআন আল কুম্মী- ৪/৩২৭, রুহুল মাআনী ইমাম আলুসী- ৮/২১)।

এই মতের আলেমগণ দলিল হিসেবে কুরআনি এবং তারিখের কিতাব থেকে প্রমাণ পেশ করেছেন। যেমন-

প্রথম দলিল: আল্লাহ তাআলার এই বাণী:
{وَ حَسِبُوۡۤا اَلَّا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ فَعَمُوۡا وَ صَمُّوۡا ثُمَّ تَابَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمۡ ثُمَّ عَمُوۡا وَ صَمُّوۡا کَثِیۡرٌ مِّنۡهُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ بَصِیۡرٌۢ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ}
আর তারা মনে করেছিল যে, তাদের কোন বিপর্যয় হবে না। ফলে তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছিল। তারপর আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করেছিলেন। তারপর তাদের অনেকেই অন্ধ ও বধির হয়েছিল। আর তারা যা আমল করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। —সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৭১)

আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে জানিয়েছেন যে, বনি ইসরাইল দুইবার অন্ধত্ব ও বধিরতার শিকার হয়েছিল। আর এই দুইবারই ছিল সেই দুটি ঘটনা, যার পরিণতি সূরা ইসরা-তে উল্লেখিত বনি ইসরাইলের উপর কঠিন দুটি শাস্তি নেমে আসার বিবরণ।(৪)

(৪). (তাওয়েলাতু আহলুস সুন্নাহ মাতুরিদী- ৩/৫৬১, মাফাতিহুল গায়েব রাযী- ১২/৪০৭, তাহরির ওয়ান তানবির ইমাম ত্বহের ইবনে আশুর- ৬/২৭৭-২৭৮, আদওয়া উল-বায়ান মুহাম্মদ শানকিত্বী- ২/১৪০)

দ্বিতীয় দলিল: আল্লাহ তাআলার বাণী:
{وَ اِذۡ تَاَذَّنَ رَبُّکَ لَیَبۡعَثَنَّ عَلَیۡهِمۡ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ مَنۡ یَّسُوۡمُهُمۡ سُوۡٓءَ الۡعَذَابِ ؕ اِنَّ رَبَّکَ لَسَرِیۡعُ الۡعِقَابِ ۚۖ وَ اِنَّهٗ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ}
আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ঘোষণা করেন যে অবশ্যই তিনি কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর এমন লোকদেরকে পাঠাবেন, যারা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকবে। আর নিশ্চয় আপনার রব শাস্তি দানে তৎপর এবং নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়।
– সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ১৬৭

এই আয়াতটি একটি চূড়ান্ত ও দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতি জানায় যে, যারা আল্লাহর শরিয়ত অমান্য করবে, তাদের মধ্যে ইহুদিদের উপর তিনি কঠিন শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। এটিই আসলে সূরা ইসরা-র সেই প্রতিশ্রুতিরই পুনরাবৃত্তি, যেখানে আল্লাহ বলেন:
{وَإِنْ عُدْتُمْ عُدْنَا}
তোমরা যদি তোমাদের আগের আচরণের পুনরাবৃত্তি কর তবে আমরাও পুনরাবৃত্তি করব।
এ বিষয়ের উপর সালাফগন একমত হয়েছে।(৫)

(৫). (জামেউল বায়ান ইমাম তাবারী- ১০/৫২৯-৫৩৩, ১৪/৪০৬)

ইমাম শানকীত্বী বলেন: সূরা আরাফের এই মর্যাদাপূর্ণ আয়াতে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা এসেছে যে, কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ দুনিয়ায় ইহুদিদের উপর এমন লোকদের চাপিয়ে দেবেন, যারা তাদেরকে কঠিন শাস্তি ও দুর্ভোগের স্বাদ দেবে এবং তাদেরকে সবচেয়ে কঠিন ও পূর্ণাঙ্গ শাস্তি দান করবে…। কেননা আল্লাহ পূর্বেও তাদের উপর বুখতেনসরকে চাপিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাকে দিয়ে তাদেরকে চরমভাবে অপমান করিয়েছিলেন, এবং এরপর রোমান সম্রাটকে পাঠিয়েছিলেন…। আল্লাহ বলেন:
{وَ قَضَیۡنَاۤ اِلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ فِی الۡکِتٰبِ لَتُفۡسِدُنَّ فِی الۡاَرۡضِ مَرَّتَیۡنِ}
আর আমরা কিতাবে বনী ইসরাঈলকে জানিয়েছিলাম যে, অবশ্যই তোমরা পৃথিবীতে দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

তাফসীরবিদ ও ইতিহাসবিদরা বলেন, এই দুটি ফাসাদের একটির ক্ষেত্রে ছিল বুখতনসরের শাস্তি আর অপরটির ক্ষেত্রে ছিল রোমান সম্রাটের শাস্তি।(৬)

(৬). (আল আযবুন্নামির ইমাম শানকিত্বী- ৪/২৯১, আত-তাহরির ওয়াত তানবির- ৯/১৫৬-১৫৭)।

তৃতীয় দলিল: আল্লাহ তাআলার বাণী:
{وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنۡ یُّذۡکَرَ فِیۡهَا اسۡمُهٗ وَ سَعٰی فِیۡ خَرَابِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ مَا کَانَ لَهُمۡ اَنۡ یَّدۡخُلُوۡهَاۤ اِلَّا خَآئِفِیۡنَ ۬ؕ}
আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তার নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে? অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের জন্য সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিল না। – সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১১৪

এই আয়াতটি বর্ণনা করে যে, কিছু অন্যায়কারী ও ফাসাদকারী আল আকসা মসজিদকে ধ্বংস করেছে এবং সেখানে আল্লাহর ইবাদত বন্ধ করেছে। এটা বনি ইসরাইলের দ্বিতীয় ফাসাদের পর ঘটেছিল, যার পর রোমানদের দ্বারা বনি ইসরাইলের আক্রমণ এবং আল আকসা মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এমতাবস্থায়, প্রাচীন তাফসীরবিদদের বৃহত্তর অংশ এটাই মত দিয়েছেন।(৭)

(৭). (জামেউল বায়ান ইমাম তাবারী- ২/৪৪২-৪৪৩, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ইবনে আবি হাতেম- ২/২১০-২১১)।

চতুর্থ দলিল: আল্লাহ তাআলার বাণী:
{لُعِنَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡۢ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ عَلٰی لِسَانِ دَاوٗدَ وَ عِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ ؕ ذٰلِکَ بِمَا عَصَوۡا وَّ کَانُوۡا یَعۡتَدُوۡنَ}
ইসরাঈল-বংশধরদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা দাউদ ও মারইয়াম-পুত্র ঈসার মুখে অভিশপ্ত হয়েছিল। তা এ জন্যে যে, তারা তারা অবাধ্যতা করেছিল আর তারা সীমালঙ্ঘন করত। – সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৭৮

এই আয়াতে বনি ইসরাইলের উপর দুইবার অভিশাপ নেমে আসার কথা উল্লেখ আছে। এটি বনি ইসরাইলের দুইবারের ফাসাদের ঘটনাকে সমর্থন করে। এবং এটি সাধারণ তাফসীরবিদ ও ইতিহাসবিদদের মতের সঙ্গতিপূর্ণ, যারা বলেছেন প্রথম ফসাদটি ঘটেছিল দাউদে(আ)-র যুগের পর এবং দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ঈসা(আ)-র যুগের পর।(৮)

(৮). আল-জাওয়াবুস সহীহ ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ৫/৯৪-৯৫, কিছু প্রাচীন ও আধুনিক তাফসিরকার ব্যাখ্যা করেছেন যে, প্রথমবারের ঘটনাটি হলো সেই ঘটনা যার প্রতি আল্লাহ সূরা আল-বাক্বারায় তালুত ও জালুতের কাহিনির মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন। যেহেতু এই প্রমাণটি প্রেরিতদের পরিচয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই আমি এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করিনি। তবে সাধারণভাবে এ বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, অন্তত প্রথমবারের ফাসাদের ঘটনা ইসলাম পূর্ব যুগেই সংঘটিত হয়েছিল।(লেখক)

পঞ্চম দলিল: নিশ্চয়ই এ কথার ওপরই ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই ইজমার অস্তিত্ব বোঝা যায় ইমাম তাবারির এই কথার মাধ্যমে:
«وأمَّا إفسادُهم في الأرضِ المَّرةَ الآخرةَ فلا اختلافَ بين أهلِ العلمِ أنَّه كان قتلَهم يحيى بن زكريا»
তাদের দ্বিতীয়বারের ফাসাদ সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই যে, এটি ছিল আল্লাহর নবী ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া (আ)-কে হত্যা করার কারণে।(৯) আর যদি দ্বিতীয়বারের ফাসাদ ইয়াহইয়া (আ.)-কে হত্যার কারণে হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই প্রথমবারের ঘটনাটি তা পূর্বেই সংঘটিত হয়েছিল।

(৯). জামেউল বায়ান ইমাম তাবারী- ১৪/৪৬৯.

বাস্তবে, এই ঐক্যমত শুধুমাত্র সালাফে সালেহিনদের যুগেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা পরবর্তী তাফসীরবিদদের মধ্যেও অব্যাহত ছিল। কেবলমাত্র গত হিজরী শতাব্দীতেই এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে।

এই ঐক্যমতের সঠিকতা আরও জোরদার করে যে, বনী- ইসরায়েলের এই আয়াতের ব্যাপারে সবাই প্রচলিতভাবেই বলতে থাকে যে, এটি ইসলামের পূর্বের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কিত, যদিও কিছু মানুষের কাছে সেই প্রচলন স্পষ্ট নয়।(১০)

(১০) আল-জওয়াবুস সহীহ ইমাম ইবনে তাইমিয়া- ৬/৩৩৭.

ষষ্ঠ দলিল: এই আয়াতে করিম স্পষ্ট করেছে যে, মসজিদুল আকসা দুবার ধ্বংস করা হবে। এই দুই ধ্বংস সাধিত হয়েছিল ফার্সি ও রোমান শাসকদের দ্বারা। এবং এটি আহলে কিতাবের নিজেদের স্বীকৃত একটি বিষয়। এটি মুসলমান ও অমুসলমান উভয় প্রাচীন ইতিহাসবিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও স্বীকৃত। উস্তাদ অধ্যাপক দ্রোজে বলেছেন:
«والضربتانِ الأخيرتانِ ذُكِرتا في مدوَّناتٍ يهوديَّةٍ ويونانيةٍ ورومانيةٍ قديمةٍ أيضًا»
{শেষের দুইটি আঘাতহানার ঘটনা ইহুদি, গ্রিক ও রোমান প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজেও উল্লেখ করা হয়েছে}(১১) অতএব, এই বক্তব্যের পক্ষে দলীল: কুরআনের আয়াত, ইজমা এবং ইতিহাসের তথ্য দ্বারা দেওয়া হয়েছে।

(১১). আত তাফসীরুল হাদিস মুহাম্মদ ইজ্জাত- ৩/৩৬০, আল কামেল ফীত তারিখ ইবনুল আছির- ১/২৭২, তারিখুল খুমাইসি হুসাইন আদ-দিয়ার বাকরী- ১/১৭৭, আল বাহরুল মাদীদ ইমাম আহমদ হুসাইন আল ফাসী- ৩/১৮৩।

পর্ব আকারে চলবে............. ইনশাআল্লাহ।

মূল লেখক: শায়খ ড. মানসুর বিন হামদ আল-ঈদী (হাফি.)
ইমাম আবদুর রহমান বিন ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরআন বিষয়ক গবেষণা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (তাফসির), সৌদি আরব।

অনুবাদ: আমির হামজা
অধ্যায়ণরত: আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়্যাহ- কুষ্টিয়া
 
Back
Top