- Joined
- Jul 24, 2023
- Threads
- 520
- Comments
- 533
- Reactions
- 5,571
- Thread Author
- #1
ভূমিকা :
পুলছিরাত হ’ল জাহান্নামের উপরে নির্মিত সেতু। পরকালের অন্যতম একটি ভয়ঙ্কর জায়গা এই পুলছিরাত। এটা অতিক্রম না করে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। মুমিনগণ তাদের আমল ও ঈমানের নূর অনুযায়ী পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবেন। কিন্তু পাপী ও মুনাফিকরা সেখান থেকে পিছলে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। পুলছিরাত একটি পারলৌকিক ও গায়েবী বিষয়, যার প্রতি ঈমান রাখা ফরয। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-
পুলছিরাতের পরিচয় :
‘পুলছিরাত’ শব্দটি ফার্সী ও আরবী ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। ‘পুল’ ফার্সী শব্দ, যার অর্থ ‘সেতু’। আর ‘ছিরাত’ আরবী শব্দ, যার অর্থ রাস্তা বা পথ। বাংলা ভাষায় বহু আরবী ও ফার্সী শব্দ স্থান লাভ করেছে। তন্মধ্যে পুলছিরাত অন্যতম। এ শব্দটি সরাসরি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই। বরং পুলছিরাতের আরবী হ’ল- الصِّرَاطُ ‘রাস্তা বা পথ’ এবং الجِسْرُ ‘পুল, সাঁকো, সেতু’। হাদীসে পুলছিরাতকে এই দুই নামেই অভিহিত করা হয়েছে। কতিপয় আরবী ভাষাবিদের মতে, صِراط শব্দটি এসেছে سرط থেকে, যার অর্থ গ্রাস করা, গিলে ফেলা। যেহেতু এই পুলছিরাত আল্লাহর ইচ্ছায় পাপী বান্দাদের গ্রাস করবে।[1]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাশরের ময়দানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
‘অতঃপর জাহান্নামের উপর পুলছিরাত স্থাপন করা হবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সেই পুলছিরাত কী? তিনি বললেন, দুর্গম পিচ্ছিল স্থান। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, সেগুলো শক্ত চওড়া উল্টো কাঁটা বিশিষ্ট হবে। সেই কাঁটাগুলো নাজ্দ এলাকায় জনেম থাকে। এগুলোকে সা‘দান বলা হয়’।[2]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে আরেক বর্ণনায় এসেছে,
‘পুলছিরাত চুলের চেয়েও অনেক চিকন এবং তরবারির চেয়েও অধিকতর ধারালো হবে’।[3] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘পুলছিরাত হবে ক্ষুরের চেয়েও অনেক ধারালো’।[4]
ইবনু হাযম আন্দালূসী (রহঃ) বলেন,
‘পুলছিরাত সত্য। আর সেটা হ’ল জাহান্নামের দুই প্রান্তের উপরিভাগ দিয়ে নির্মিত একটি পথ। আল্লাহ যাকে চাইবেন সে (এর ভয়াবহতা থেকে) মুক্তি পাবে। আর তিনি যাকে চাইবেন সে ধ্বংস হবে’।[5]
শায়খ ছালেহ আল-ওছায়মীন (রহঃ) বলেন,
‘পুলছিরাত হ’ল জাহান্নামের উপর অবস্থিত একটি সাঁকো। মুমিনগণ হাশরের মাঠ থেকে জান্নাতে যাবে এই সেতুতে আরোহণ করে। আর এই সেতুতে শুধু মুমিনরাই আরোহণ করবে। কেননা কাফেরদেরকে (পুলছিরাতের আগেই) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। কিন্তু মুমিনগণ এই পুলছিরাত অতিক্রম করবেন’।[6]
মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেছেন,
‘যেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং পরিবর্তিত হবে আকাশমন্ডলী। আর মানুষ মহা পরাক্রমশালী একক আল্লাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হবে’ (ইবরাহীম ১৪/৪৮)।
আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, মানুষ তখন কোথায় থাকবে? উত্তরে তিনি বললেন, عَلَى الصِّرَاطِ ‘পুলছিরাতের উপর থাকবে’।[7]
কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- তরবারির চেয়েও ধারালো, চুলের চেয়েও চিকন, কাঁটাযুক্ত পিচ্ছিল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই পুলের উপর দিয়ে মানুষ কিভাবে পার হবে? এর জবাবে শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন,
‘আখেরাতের বিষয়গুলো কখনোই দুনিয়ার সাথে তুলনীয় নয়। মহান আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। আমরা জানি না- মানুষ কিভাবে পুলছিরাত অতিক্রম করবে, সবাই একসাথে পার হবে না-কি একজন একজন করে পার হবে’।[8]
ক্বানত্বারাহ :
পুলছিরাতে একটি অংশের নাম ক্বানত্বারাহ (قَنْطَرَة)। ইমাম কুরতুবী এটাকে দ্বিতীয় পুলছিরাত হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[9] পুলছিরাত পার হওয়ার পরে এখানে সেই সকল বান্দাকে থামিয়ে দেওয়া হবে যারা পরস্পরের উপর যুলুম করেছিল। অতঃপর তাদের ক্বিছাছ বা বদলা নেওয়া হবে এই ক্বানত্বারাহ নামক পুলের উপর। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘মু’মিনগণ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্বানত্বারাহর ওপর তাদের দাঁড় করানো হবে, যা জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে অবস্থিত। দুনিয়ায় যারা একে অপরের উপর যুলুম করেছিল তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করানো হবে। তারা যখন পাক-সাফ হয়ে যাবে, তখন তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে’।[10]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ক্বানত্বারাহ হ’ল আখেরাতের দ্বিতীয় পুলছিরাত, যা জাহান্নাম ও জান্নাতের মাঝে অবস্থিত। প্রথম পুলছিরাত পার হওয়ার পরে এই পুলছিরাত আসবে। আমল ওযন করার সময় যাদের নেকীর পাল্লা হালকা হবে, তারা প্রথম পুলছিরাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে অথবা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু মুমিনরা প্রথম পুলছিরাত পার হয়ে যাবে এবং ক্বানত্বারাহ্তে তাদেরকে থামানো হবে। তবে ক্বানত্বারাহ থেকে আর কেউ জাহান্নামে ফিরে যাবে না। আর এখানকার ক্বিছাছ হাশরের মাঠের ক্বিছাছের মত নয়; বরং এটা বিশেষ ধরনের ক্বিছাছ, যার মাধ্যমে মুমিনদের অন্তরগুলোকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পরিচ্ছন্ন করা হবে।[11]
হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) ইমাম কুরতুবীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ক্বানত্বারাহ হ’ল দ্বিতীয় পুলছিরাত, যেটা কেবল মুমিনদের জন্য খাছ। এখান থেকে কেউ জাহান্নামে পতিত হবে না। কেননা জাহান্নামের আগুন পার হয়ে যাওয়ার পর ক্বানত্বারাহ আসবে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।[12]
শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘ক্বানত্বারাহও একটি সেতু। তবে এটা পুলছিরাতের চেয়ে ছোট সেতু, যা (জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝামাঝি) কোন নদীর পানি বা তৎসদৃশ কোন কিছুর উপরে নির্মিত। তবে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে ইখতেলাফ রয়েছে যে, ক্বানত্বারাহ কি পুলছিরাতের একটি অংশ না-কি স্বতন্ত্র কোন সেতু। আমি বলব, এ ব্যাপারে আল্লাহ্ই সবচেয়ে ভালো জানেন। আমাদের শুধু এতটুকু বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ক্বানত্বারাহর উপরে বান্দাদেরকে থামানো হবে’।[13]
পুলছিরাতের বাস্তবতা :
ঈমানের ছয়টি রুকনের মাঝে অন্যতম হ’ল আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা। আর আখেরাত ও গায়েবের একটি বিষয় হ’ল পুলছিরাত, যার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস থাকা ফরয। ক্বিয়ামতের ময়দানে হিসাব-নিকাশ, আমলনামা বণ্টন, আমলসমূহ পরিমাপ, হাউযে কাউছার এবং জান্নাতী ও জাহান্নামীদের পৃথক করার পর পুলছিরাতের পর্বটি আসবে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে পৌঁছবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অমোঘ সিদ্ধান্ত। অতঃপর আমরা মুত্তাক্বীদের মুক্তি দেব এবং সীমালংঘনকারীদের তার মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ (মারয়াম ১৯/৭১-৭২)।
আলোচ্য আয়াতে وَارِدُهَا ‘সেখানে পৌঁছবে’-এর ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কেউ বলেছেন, পুলছিরাতে পৌঁছবে। তবে শেষোক্ত মতই সঠিক ও অগ্রগণ্য।[14]
হাফছাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আমি আশা করি বদর এবং হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণকারী কেউই জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে না। অপর বর্ণনায় রয়েছে, তাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে না। তখন হাফ্ছাহ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা‘আলা কি এ কথা বলেননি?
‘অবশ্যই তোমাদের তা (পুলছিরাত) প্রত্যেকেই অতিক্রম করবে’। অর্থাৎ পুলছিরাত অতিক্রম করতে গেলে তো আগুন স্পর্শ করবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তুমি কি শুননি, আল্লাহ তা‘আলা এটাও তো বলেছেন,
‘অতঃপর আমরা মুত্তাক্বীদের মুক্তি দেব এবং সীমালংঘনকারীদের তার মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’।[15] ইমাম শাওক্বানী (রহঃ) বলেন, পুলছিরাতের আগুন মুমিনদের জন্য প্রশান্তিদায়ক হবে, যেমন নমরূদের প্রজবলিত আগুন ইবরাহীম (আঃ)-এর জন্য প্রশান্তিদায়ক ছিল’।[16]
বারবাহারী (রহঃ) বলেন,
‘জাহান্নামের উপর নির্মিত পুলছিরাতের প্রতি ঈমান আনা অবশ্যক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করবেন তাকে এই পুলছিরাত গ্রাস করবে এবং যাকে ইচ্ছা মুক্তি দিবেন। আর তিনি যাকে ইচ্ছা করবেন সে জাহান্নামে পতিত হবে। আর বান্দারা তাদের ঈমান অনুযায়ী (পুলছিরাতে) নূর লাভ করবে’।[17]
সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন,
‘সুন্নাত হ’ল দশ প্রকার। যার মধ্যে এগুলো থাকবে, তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এগুলোর কোন একটিকে পরিত্যাগ করবে, সে ঈমানকে পরিত্যাগ করবে। আর সেগুলো হ’ল তাক্বদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করা, (উম্মতের মাঝে) আবূ বকর ও ওমর (রাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়া, শাফা‘আত, মীযান, পুলছিরাত প্রভৃতি সত্য বলে বিশ্বাস করা...।[18]
আবুল হাসান আল-আশ‘আরী (রহঃ) বলেন,
‘এ ব্যাপারে বিদ্বানগণ একমত হয়েছেন যে, জাহান্নামের উপরে পুলছিরাত বিস্তৃত থাকবে। বান্দাগণ তাদের আমলের পরিমাণ অনুযায়ী এর ওপর দিয়ে পার হয়ে যাবে। আমলের তারতম্য অনুসারে তাদের (পুলছিরাত পারাপারের) দ্রুততা ও মন্থরতা নির্ধারিত হবে’।[19] অর্থাৎ যার আমল যত বেশী তিনি তত দ্রুত পার হবেন। আর যার আমল যত কম, তার অতিক্রম ততই ধীরগতিতে হবে। ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন,
‘পুলছিরাত সত্য। পুণ্যবান ব্যক্তিরা এটা পার হয়ে (জান্নাতে) চলে যাবেন এবং পাপী ব্যক্তিরা এখান থেকে পিছলে (জাহান্নামে) পড়ে যাবেন’।[20]
পুলছিরাত অতিক্রমকারীদের প্রকারভেদ ও গতি :
ক্বিয়ামতের দিন মানুষ তাদের আমলের তারতম্য অনুযায়ী পুলছিরাত পার হবে। ঈমান ও আমলে যিনি যত বলীয়ান তিনি তত দ্রুত ও নিরাপদে পার হয়ে যাবেন। আর দুনিয়াতে যার পরহেযগারিতা ও নেক আমল কম ছিল, তার পারাপারের গতি ততই মন্থর হবে। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘পুলছিরাত জাহান্নামের দুই তীরের সাথে যুক্ত থাকবে। তাতে থাকবে সা‘দান বৃক্ষের কাঁটা সদৃশ কাঁটাসমূহ। মানুষকে তার উপর দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হবে। কতক মুসলিম নিরাপদে তার উপর দিয়ে অতিক্রম করবে, কতক ব্যক্তি কাঁটার অাঁচড় খেয়ে ক্ষত-বিক্ষত হবে, তারপর নাজাত পাবে এবং কতক ব্যক্তি সেখানে আটকে যাবে এবং মুখ থুবড়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’।[21] এই হাদীসের মাধ্যমে বোঝা যায় পুলছিরাতের ওপর দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তিদের অবস্থা তিন রকম হবে। (১) নিরাপদে মুক্তিলাভকারী (২) ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মুক্তি লাভকারী (৩) জাহান্নামে পতিত।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, অতঃপর জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। সে পুলের উপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো। তবে মুক্তিপ্রাপ্তরা কেউ নিরাপদে চলে আসবেন, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। একবারে শেষে অতিক্রম করবে যে লোকটি, সে হেঁচড়িয়ে কোনভাবে পার হয়ে আসবে।[22]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ) বলেন,
‘জাহান্নামের পৃষ্ঠদেশে নির্মিত সেতু হ’ল পুলছিরাত। এর পরেই থাকবে জান্নাত। মানুষ তাদের আমল মোতাবেক এর উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। যার পাপের চেয়ে নেকী বেশী হবে অথবা পাপ ও নেকী সমান সমান হবে অথবা আল্লাহ যাকে মাফ করে দিবেন, সে নাজাত পাবে। আর যার নেকীর চেয়ে গুনাহ বেশী হবে সে পিছলে (জাহান্নামে) পড়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ক্ষমা করে দিবেন, তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। আল্লাহর তাওহীদপন্থীদের মধ্য থেকে যারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে তথা জাহান্নামে যাবে, পরবর্তিতে তারা শাফ‘আত এবং অন্য কোন মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। আর নাজতপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি (কারো প্রতি যুলুম করার কারণে) দায়বদ্ধ থাকে এবং যুলুমের সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী পরিমাণ নেকী থাকে, তাহ’লে তার যুলুমের পরিমাণ অনুযায়ী নেকী কেটে নেওয়া হবে। অতঃপর তাকে মুক্তি দেওয়া হবে’।[23]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
‘লোকেরা নিজ নিজ আমল অনুযায়ী এর উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। তাদের কেউ চোখের পলকে চলবে, কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ উটে আরোহীদের গতিতে, কেউ দৌড়ে, কেউ হেঁটে এবং কেউ হামাগুড়ি দিয়ে পার হবে। কাউকে সেখান থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। পুলছিরাতের উপর থাকবে অসংখ্য লোহার আঁকড়া বা কাঁটা, যেগুলো মানুষের আমল অনুযায়ী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে’।[24] খালেদ ছালেহ (রহঃ) বলেন, ‘পুলছিরাতের উপর মানুষের গতির এই ভিন্নতার করণ হ’ল নেক আমল। কেননা আল্লাহ বলেছেন, وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ ‘আর অগ্রভাগের লোকেরা। তারা তো অগ্রবর্তীই’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/১০)। অর্থাৎ দুনিয়াতে যারা আল্লাহর অনুগত্য, ইবাদত ও সৎকাজে অগ্রগামী ছিল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে তারাই পুলছিরাতে অগ্রগামী হবে। তারা পুলছিরাতের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাতে চলে যাবে’।[25]
পুলছিরাতের ভয়াবহতা
১. ফেরেশতারা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে :
পুলছিরাত ও মীযান এমন দু’টি ভয়ানক জায়গা, যা দেখে ফেরেশতাগণ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবেন। যদিও তাদের আমল মীযানে পরিমাপ করা হবে না এবং পুলছিরাত অতিক্রম করতে হবে না। সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামদের দিন মীযান স্থাপন করা হবে। এখানে যদি আকাশসমূহ ও যমীন পরিমাপ করা হয়, তবে তা সম্ভব হবে। তখন ফেরেশতারা বলবেন,يَا رَبِّ لِمَنْ يَزِنُ هَذَا؟ ‘হে রব! কাকে পরিমাপ করা হবে?’ আল্লাহ বলবেন, لِمَنْ شِئْتُ مِنْ خَلْقِي، ‘আমার সৃষ্টির মাঝে যাকে ইচ্ছা (তাকে আমি ওযন করব)। তখন ফেরেশতারা ভয়ে কাতর হয়ে বলবেন,سُبْحَانَكَ مَا عَبَدْنَاكَ حَقَّ عِبَادَتِكَ، ‘তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমরা তোমার যথাযোগ্য ইবাদত করতে পারিনি’। এরপর ক্ষুরের মত ধারালো পুলছিরাত স্থাপন করা হবে।
ফেরেশতারা বলবেন, مَنْ تُجِيزُ عَلَى هَذَا؟ ‘হে রব! এর উপর দিয়ে কে পার হবে?’ আল্লাহ বলবেন, مَنْ شِئْت مِنْ خَلْقِي، ‘আমার সৃষ্টির মাঝে যাকে আমি চাইব (সেই পার হবে)। তখন ফেরেশতারা ভয়ে কাতর হয়ে বলবেন,سُبْحَانَكَ مَا عَبَدْنَاكَ حَقَّ عِبَادَتِكَ، ‘তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমরা তোমার যথাযোগ্য ইবাদত করতে পারিনি’।[26]
ক্বাসত্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘ভেবে দেখুন! যখন আপনি পুলছিরাতের উপর উঠবেন এবং (সেখান থেকে) নিমণবর্তী জাহান্নামের দিকে দৃষ্টি দিবেন। অতঃপর জ্বলন্ত আগুনের গর্জন, জাহান্নামের নিঃশ্বাস ও কৃষ্ণতা আপনার কর্ণকুহরে ধ্বনিত হ’তে থাকবে, তখন আপনার কেমন অবস্থা হবে? যদি আপনার কোন পা পিছলে যায়, তবে আপিন এর প্রখরতা টেঁর পাবেন এবং দ্বিতীয় পা উপরে ধরে রাখার কসরত করবেন। আপনার সামনেই অন্যরা পিছলে পড়ে যাবে এবং আগুনের তাপ অনুভব করবে। জাহান্নামের ফেরেশতারা তাদেরকে পাকড়াও করতে থাকবে, যারা (পুলছিরাতের) উল্টো কাঁটযুক্ত আংটা ও অাঁকড়াতে বিদ্ধ হবে। আপনি সেটা দেখতে থাকবেন। তখন সেই দৃশ্যটা কত বিভীষিকাময় হবে? আরোহণের পথটা কতই না ভয়ংকর হবে এবং অতিক্রমটাও কতই না সঙ্কীর্ণতর হবে? আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই, সাহায্য চাই এবং অনুগ্রহ কামনা করি’।[27]
২. পুলছিরাতে নবী-রাসূল ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না:
পুলছিরাতের কাছে মানুষ এমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে যে, কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। কেবল নবীগণ কাতর কণ্ঠে ফরিয়াদ করতে থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আর জাহান্নামের দুই প্রান্তে সেতু নির্মাণ করা হবে। রাসূলগণের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম আমার উম্মতকে নিয়ে এ পথ অতিক্রম করব। সেদিন রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ কথা বলবে না। আর রাসূলগণের কথা হবে,اللَّهُمَّ سَلِّمْ سَلِّمْ، ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিম সাল্লিম’ (হে আল্লাহ! রক্ষা করুন, রক্ষা করুন!)।[28] মূলতঃ এই দো‘আর মাধ্যমে নবীগণ তাদের উম্মতের জন্য শাফা‘আত করবেন। অপর বর্ণনায় এসেছে যে, ফেরেশতারাও এই দো‘আর মাধ্যমে মুমিনদের জন্য শাফা‘আত করবেন।[29] শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলেন, এটা সেই তাওহীদপন্থী ব্যক্তিদের জন্য শাফা‘আত, যারা জাহান্নামে প্রবেশ করার হক্বদার হয়ে গেছে। কেননা আল্লাহ যাকে রক্ষা করবেন না, সে অবশ্যই জাহান্নামে পতিত হবে।[30]
৩. পুলছিরাতের কাছে রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আত :
ক্বিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আটটি পর্যায়ে শাফা‘আত করবেন।[31] তাঁর শাফা‘আতের অন্যতম জায়গা হ’ল পুলছিরাত। আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট নিবেদন করলাম যে, তিনি যেন ক্বিয়ামত দিবসে আমার জন্য শাফা‘আত করেন।[32] তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি শাফা‘আত করব। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে কোথায় খোঁজ করব? তিনি বললেন,
‘তুমি সর্বপ্রথম আমাকে পুলছিরাতের উপর খোঁজ করবে’। আমি বললাম, পুলছিরাতে যদি আপনাকে না পাই? তিনি বললেন,
‘তাহ’লে মীযানের কাছে খুঁজবে। আমি আবার বললাম, মীযানের কাছেও যদি আপনাকে না পাই? তিনি বললেন,
‘তাহ’লে হাওযে কাওছারের সামনে খুঁজবে। আমি এ তিনটি জায়গার যে কোন একটিতে অবশ্যই উপস্থিত থাকব’।[33] অন্যত্র তিনি বলেছেন,
‘তোমাদের সামেনে একটি দুর্গম-অনতিক্রম্য গিরিপথ আছে। পাপের বোঝায় ভারাক্রান্ত ব্যক্তিরা এটা পার হ’তে পারবে না। আমি সেই গিরিপথের বোঝা হালকা করে দেওয়ার প্রত্যাশা রাখি’।[34]
অন্যত্র তিনি বলেন,
‘তোমাদের নবী পুলছিরাতের উপর দাঁড়িয়ে বলতে থাকবেন, ‘রবিব! সাল্লিম সাল্লিম’ (হে আমার রব! নিরাপদ রাখুন, রক্ষা করুন!)। পরিশেষে কিছুসংখ্যক বান্দার আমল এতই কম হবে যে, তাদের পুলছিরাত অতিক্রম করার সাধ্য থাকবে না। এমনকি সেসময় এক লোক হামাগুড়ি দিতে দিতে অতিক্রম করবে’। পুলছিরাতের উভয় কিনারায় আংটা ঝুলন্ত থাকবে। যাকে পাকড়াও করার নির্দেশ থাকবে উক্ত আংটা তাকে পাকড়াও করবে। ফলে কেউ কেউ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় মুক্তি পাবে আবার কোন কোন ব্যক্তিকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রাবী (রাঃ) বলেন, ‘সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ! জাহান্নামের গভীরতা সত্তর বছর দূরত্বের সমান।[35]
মুমিনরা পুলছিরাত পার হয়ে যাওয়ার পরেও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের জন্য শাফা‘আত করবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘ক্বিয়ামতের দিন নবীদের মধ্যে আমার অনুসারীদের সংখ্যা হবে সবচাইতে বেশী। আর আমিই সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় কড়া নাড়ব’।[36] তিনি আরো বলেন,
‘ক্বিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় এসে তা খোলার জন্য বলব। তখন তার প্রহরী বলবেন, আপনি কে? বলব, আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)! তখন প্রহরী বলবেন, আপনার সম্পর্কে আমাকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনার আগে আমি যেন অন্য কারো জন্য এ দরজা না খুলি’।[37]
এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জান্নাতের দরজা খোলার জন্য শাফা‘আত করবেন। তারপর দরজা খোলা হবে। তাঁর শাফা‘আত করার আগে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এটা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
যেমন আল্লাহ বলেন,
‘আর যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে নিয়ে যাওয়া হবে জান্নাতের দিকে। অবশেষে তারা যখন সেখানে উপস্থিত হবে ও তার দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে’ (যুমার ৩৯/৭৩)।
এত্র আয়াতে মহান আল্লাহ পূর্বে বর্ণিত জাহান্নামীদের অবস্থার মত বলেননি যে,
অত্র আয়াতে فُتِحَتْ-এর আগে واو হরফের মাধ্যমে ইশারা করা হয়েছে যে, জান্নাতের দরজা খোলার আগে কিছু একটা হবে, আর সেটাই হ’ল শাফা‘আত’।[38]
[1]. ইবনু ফারেস, মাক্বাঈসিল লুগাত, ৩/১৫২; আবূ মানছূর আযহারী, তাহযীবুল লুগাত, ১২/২৩২।
[2]. বুখারী হা/৭৪৩৯।
[3]. মুসলিম হা/১৮৩।
[4]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৮৭৩৯; সহীহাহ্ হা/৯৪১, সনদ সহীহ।
[5]. ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-মুহাল্লা বিল আছার, ১/৩৬।
[6]. ওছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আস-সাফ্ফারীনিইয়াহ, পৃ. ৪৭৫।
[7]. মুসলিম হা/২৭৯১।
[8]. ওছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৫১৮।
[9]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল ক্বাদীর, ১১/৩৯৯।
[10]. বুখারী হা/৬৫৩৫; মিশকাত হা/৫৫৮৯।
[11]. কুরতুবী, আত-তাযকিরাহ, ২/৩৬।
[12]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২০/১০১।
[13]. ওছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৫২০।
[14]. ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ৪/২৬৬; ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ ওয়া আছহাবিল হাদীস ১/১২১; ইবনু আবিল ‘ইয আল-হানাফী, শারহুল আক্বীদাহ আত-ত্বাহাবিইয়াহ, পৃ. ৪১৫; ইবনে তাইমিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৪/২৭৯।
[15]. মুসলিম হা/২৪৯৬; তিরমিযী হা/৩৮৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২৮১; মিশকাত হা/৬২২৭।
[16]. শাওক্বানী, ফাৎহুল ক্বাদীর, ৩/৪০৬।
[17]. বারবাহারী, শারহুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৭।
[18]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আত, ১/১৭৫।
[19]. আবুল হাসান আল-আশ‘আরী, রিসালাতুন ইলা আহলিছ ছুগার, পৃ.১৬৩।
[20]. ইবনু কুদামাহ, লুম‘আতুল ই‘তিক্বাদ, পৃ. ৩৩।
[21]. আহমাদ হা/১১০৮১; ইবনে মাজাহ হা/৪২৮০, সনদ সহীহ।
[22]. বুখারী হা/৭৪৩৯; মুসলিম হা/১৮৩।
[23]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১১/৩৯৯।
[24]. ইবনে তাইমিয়াহ, আল-আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৯৯।
[25]. শারহু লুম‘আতিল ই‘তিক্বাদ ১৩/১০।
[26]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৮৭৩৯; সহীহাহ হা/৯৪১, সনদ সহীহ।
[27]. আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ক্বাসত্বাল্লানী, ইরশাদুস সারী ৯/৩৩০।
[28]. বুখারী হা/৮০৬।
[29]. আহমাদ হা/১১২০২, সনদ সহীহ।
[30]. শারহু সুনানে আবীদাঊদ ২৭/২৪৯।
[31]. ড. ছালেহ আল-ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ১২১।
[32]. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে শাফা‘আত চাওয়া বৈধ ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং এখন যদি কেউ রাসূল (ﷺ)-এর কবরের কাছে গিয়ে বা দূর থেকে তাঁর কাছে শাফা‘আত কামনা করে, তবে সেটা শিরক হবে। তাই রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আতের জন্য কেবল আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে।
[33]. তিরমিযী হা/২৪৩৩; মিশকাত হা/৫৫৯৫, সনদ সহীহ।
[34]. সহীহাহ হা/২৪৮০; সহীহুল জামে‘ হা/৩১৭৭, সনদ সহীহ।
[35]. মুসলিম হা/১৯৫; মিশকাত হা/৫৬০৮।
[36]. মুসলিম হা/১৯৬; মিশকাত হা/৫৭৪২।
[37]. মুসলিম হা/১৯৭; মিশকাত হা/৫৭৪৩।
[38]. শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৫২২।
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পুলছিরাত হ’ল জাহান্নামের উপরে নির্মিত সেতু। পরকালের অন্যতম একটি ভয়ঙ্কর জায়গা এই পুলছিরাত। এটা অতিক্রম না করে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। মুমিনগণ তাদের আমল ও ঈমানের নূর অনুযায়ী পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবেন। কিন্তু পাপী ও মুনাফিকরা সেখান থেকে পিছলে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। পুলছিরাত একটি পারলৌকিক ও গায়েবী বিষয়, যার প্রতি ঈমান রাখা ফরয। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-
পুলছিরাতের পরিচয় :
‘পুলছিরাত’ শব্দটি ফার্সী ও আরবী ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। ‘পুল’ ফার্সী শব্দ, যার অর্থ ‘সেতু’। আর ‘ছিরাত’ আরবী শব্দ, যার অর্থ রাস্তা বা পথ। বাংলা ভাষায় বহু আরবী ও ফার্সী শব্দ স্থান লাভ করেছে। তন্মধ্যে পুলছিরাত অন্যতম। এ শব্দটি সরাসরি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই। বরং পুলছিরাতের আরবী হ’ল- الصِّرَاطُ ‘রাস্তা বা পথ’ এবং الجِسْرُ ‘পুল, সাঁকো, সেতু’। হাদীসে পুলছিরাতকে এই দুই নামেই অভিহিত করা হয়েছে। কতিপয় আরবী ভাষাবিদের মতে, صِراط শব্দটি এসেছে سرط থেকে, যার অর্থ গ্রাস করা, গিলে ফেলা। যেহেতু এই পুলছিরাত আল্লাহর ইচ্ছায় পাপী বান্দাদের গ্রাস করবে।[1]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাশরের ময়দানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
ثُمَّ يُؤْتَى بِالْجَسْرِ فَيُجْعَلُ بَيْنَ ظَهْرَيْ جَهَنَّمَ، قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا الجَسْرُ؟ قَالَ: مَدْحَضَةٌ مَزِلَّةٌ، عَلَيْهِ خَطَاطِيفُ وَكَلاَلِيبُ، وَحَسَكَةٌ مُفَلْطَحَةٌ لَهَا شَوْكَةٌ عُقَيْفَاءُ، تَكُونُ بِنَجْدٍ، يُقَالُ لَهَا: السَّعْدَانُ،
‘অতঃপর জাহান্নামের উপর পুলছিরাত স্থাপন করা হবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সেই পুলছিরাত কী? তিনি বললেন, দুর্গম পিচ্ছিল স্থান। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, সেগুলো শক্ত চওড়া উল্টো কাঁটা বিশিষ্ট হবে। সেই কাঁটাগুলো নাজ্দ এলাকায় জনেম থাকে। এগুলোকে সা‘দান বলা হয়’।[2]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে আরেক বর্ণনায় এসেছে,
أَنَّ الْجِسْرَ أَدَقُّ مِنَ الشَّعْرَةِ، وَأَحَدُّ مِنَ السَّيْفِ،
‘পুলছিরাত চুলের চেয়েও অনেক চিকন এবং তরবারির চেয়েও অধিকতর ধারালো হবে’।[3] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘পুলছিরাত হবে ক্ষুরের চেয়েও অনেক ধারালো’।[4]
ইবনু হাযম আন্দালূসী (রহঃ) বলেন,
أَنَّ الصِّرَاطَ حَقٌّ وَهُوَ طَرِيقٌ يُوضَعُ بَيْنَ ظَهْرَانَيْ جَهَنَّمَ فَيَنْجُو مَنْ شَاءَ اللهُ تَعَالَى وَيَهْلِكُ مَنْ شَاءَ،
‘পুলছিরাত সত্য। আর সেটা হ’ল জাহান্নামের দুই প্রান্তের উপরিভাগ দিয়ে নির্মিত একটি পথ। আল্লাহ যাকে চাইবেন সে (এর ভয়াবহতা থেকে) মুক্তি পাবে। আর তিনি যাকে চাইবেন সে ধ্বংস হবে’।[5]
শায়খ ছালেহ আল-ওছায়মীন (রহঃ) বলেন,
الصِّراطُ جِسرٌ يوضَعُ على جَهنَّمَ يَصعَدُ منه الـمُؤمِنونَ من أرضِ الـمَحشَرِ إلى الجَنةِ، ولا يَصعَدُه إلَّا الـمُؤمِنونَ، أمَّا الكُفَّارُ فقد سِيقوا إلى جَهَنَّمَ وأُلقوا فيها، لَكِنِ الـمُؤمِنونَ همُ الذين يَصعَدونَ هذا الصِّراطَ،
‘পুলছিরাত হ’ল জাহান্নামের উপর অবস্থিত একটি সাঁকো। মুমিনগণ হাশরের মাঠ থেকে জান্নাতে যাবে এই সেতুতে আরোহণ করে। আর এই সেতুতে শুধু মুমিনরাই আরোহণ করবে। কেননা কাফেরদেরকে (পুলছিরাতের আগেই) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। কিন্তু মুমিনগণ এই পুলছিরাত অতিক্রম করবেন’।[6]
মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেছেন,
يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ وَبَرَزُوا لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ،
‘যেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং পরিবর্তিত হবে আকাশমন্ডলী। আর মানুষ মহা পরাক্রমশালী একক আল্লাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হবে’ (ইবরাহীম ১৪/৪৮)।
আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, মানুষ তখন কোথায় থাকবে? উত্তরে তিনি বললেন, عَلَى الصِّرَاطِ ‘পুলছিরাতের উপর থাকবে’।[7]
কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- তরবারির চেয়েও ধারালো, চুলের চেয়েও চিকন, কাঁটাযুক্ত পিচ্ছিল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই পুলের উপর দিয়ে মানুষ কিভাবে পার হবে? এর জবাবে শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন,
أن أمور الآخرة لا تقاس بأمور الدنيا، فالله تعالى على كل شيء قدير، ولا ندري كيف يعبرون: هل يجتمعون جميعا في هذا الطريق أو واحدا بعد واحد،
‘আখেরাতের বিষয়গুলো কখনোই দুনিয়ার সাথে তুলনীয় নয়। মহান আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। আমরা জানি না- মানুষ কিভাবে পুলছিরাত অতিক্রম করবে, সবাই একসাথে পার হবে না-কি একজন একজন করে পার হবে’।[8]
ক্বানত্বারাহ :
পুলছিরাতে একটি অংশের নাম ক্বানত্বারাহ (قَنْطَرَة)। ইমাম কুরতুবী এটাকে দ্বিতীয় পুলছিরাত হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[9] পুলছিরাত পার হওয়ার পরে এখানে সেই সকল বান্দাকে থামিয়ে দেওয়া হবে যারা পরস্পরের উপর যুলুম করেছিল। অতঃপর তাদের ক্বিছাছ বা বদলা নেওয়া হবে এই ক্বানত্বারাহ নামক পুলের উপর। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
يَخْلُصُ الـمُؤْمِنُونَ مِنَ النَّارِ، فَيُحْبَسُونَ عَلَى قَنْطَرَةٍ بَيْنَ الجَنَّةِ وَالنَّارِ، فَيُقَصُّ لِبَعْضِهِمْ مِنْ بَعْضٍ مَظَالِمُ كَانَتْ بَيْنَهُمْ فِي الدُّنْيَا، حَتَّى إِذَا هُذِّبُوا وَنُقُّوا أُذِنَ لَهُمْ فِي دُخُولِ الجَنَّةِ،
‘মু’মিনগণ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্বানত্বারাহর ওপর তাদের দাঁড় করানো হবে, যা জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে অবস্থিত। দুনিয়ায় যারা একে অপরের উপর যুলুম করেছিল তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করানো হবে। তারা যখন পাক-সাফ হয়ে যাবে, তখন তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে’।[10]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ক্বানত্বারাহ হ’ল আখেরাতের দ্বিতীয় পুলছিরাত, যা জাহান্নাম ও জান্নাতের মাঝে অবস্থিত। প্রথম পুলছিরাত পার হওয়ার পরে এই পুলছিরাত আসবে। আমল ওযন করার সময় যাদের নেকীর পাল্লা হালকা হবে, তারা প্রথম পুলছিরাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে অথবা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু মুমিনরা প্রথম পুলছিরাত পার হয়ে যাবে এবং ক্বানত্বারাহ্তে তাদেরকে থামানো হবে। তবে ক্বানত্বারাহ থেকে আর কেউ জাহান্নামে ফিরে যাবে না। আর এখানকার ক্বিছাছ হাশরের মাঠের ক্বিছাছের মত নয়; বরং এটা বিশেষ ধরনের ক্বিছাছ, যার মাধ্যমে মুমিনদের অন্তরগুলোকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পরিচ্ছন্ন করা হবে।[11]
হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) ইমাম কুরতুবীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ক্বানত্বারাহ হ’ল দ্বিতীয় পুলছিরাত, যেটা কেবল মুমিনদের জন্য খাছ। এখান থেকে কেউ জাহান্নামে পতিত হবে না। কেননা জাহান্নামের আগুন পার হয়ে যাওয়ার পর ক্বানত্বারাহ আসবে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।[12]
শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘ক্বানত্বারাহও একটি সেতু। তবে এটা পুলছিরাতের চেয়ে ছোট সেতু, যা (জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝামাঝি) কোন নদীর পানি বা তৎসদৃশ কোন কিছুর উপরে নির্মিত। তবে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে ইখতেলাফ রয়েছে যে, ক্বানত্বারাহ কি পুলছিরাতের একটি অংশ না-কি স্বতন্ত্র কোন সেতু। আমি বলব, এ ব্যাপারে আল্লাহ্ই সবচেয়ে ভালো জানেন। আমাদের শুধু এতটুকু বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ক্বানত্বারাহর উপরে বান্দাদেরকে থামানো হবে’।[13]
পুলছিরাতের বাস্তবতা :
ঈমানের ছয়টি রুকনের মাঝে অন্যতম হ’ল আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা। আর আখেরাত ও গায়েবের একটি বিষয় হ’ল পুলছিরাত, যার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস থাকা ফরয। ক্বিয়ামতের ময়দানে হিসাব-নিকাশ, আমলনামা বণ্টন, আমলসমূহ পরিমাপ, হাউযে কাউছার এবং জান্নাতী ও জাহান্নামীদের পৃথক করার পর পুলছিরাতের পর্বটি আসবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا، ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا،
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে পৌঁছবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অমোঘ সিদ্ধান্ত। অতঃপর আমরা মুত্তাক্বীদের মুক্তি দেব এবং সীমালংঘনকারীদের তার মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ (মারয়াম ১৯/৭১-৭২)।
আলোচ্য আয়াতে وَارِدُهَا ‘সেখানে পৌঁছবে’-এর ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কেউ বলেছেন, পুলছিরাতে পৌঁছবে। তবে শেষোক্ত মতই সঠিক ও অগ্রগণ্য।[14]
হাফছাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আমি আশা করি বদর এবং হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণকারী কেউই জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে না। অপর বর্ণনায় রয়েছে, তাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে না। তখন হাফ্ছাহ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা‘আলা কি এ কথা বলেননি?
وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا
‘অবশ্যই তোমাদের তা (পুলছিরাত) প্রত্যেকেই অতিক্রম করবে’। অর্থাৎ পুলছিরাত অতিক্রম করতে গেলে তো আগুন স্পর্শ করবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তুমি কি শুননি, আল্লাহ তা‘আলা এটাও তো বলেছেন,
ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا،
‘অতঃপর আমরা মুত্তাক্বীদের মুক্তি দেব এবং সীমালংঘনকারীদের তার মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’।[15] ইমাম শাওক্বানী (রহঃ) বলেন, পুলছিরাতের আগুন মুমিনদের জন্য প্রশান্তিদায়ক হবে, যেমন নমরূদের প্রজবলিত আগুন ইবরাহীম (আঃ)-এর জন্য প্রশান্তিদায়ক ছিল’।[16]
বারবাহারী (রহঃ) বলেন,
الإيمانُ بالصِّراطِ على جَهَنَّمَ، يَأخُذُ الصِّراطُ من شاءَ اللهُ، ويَجوزُ من شاءَ الله، ويَسقُطُ في جَهنَّمَ من شاءَ اللهُ، ولهم أنوارٌ على قَدْرِ إيمانِهم،
‘জাহান্নামের উপর নির্মিত পুলছিরাতের প্রতি ঈমান আনা অবশ্যক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করবেন তাকে এই পুলছিরাত গ্রাস করবে এবং যাকে ইচ্ছা মুক্তি দিবেন। আর তিনি যাকে ইচ্ছা করবেন সে জাহান্নামে পতিত হবে। আর বান্দারা তাদের ঈমান অনুযায়ী (পুলছিরাতে) নূর লাভ করবে’।[17]
সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন,
السُّنَّةُ عَشَرةٌ، فمَن كُن فيه فقَدِ استَكملَ السُّنَّةَ، ومن تَرك منها شَيئًا فقد تَرَك السُّنَّةَ: إثباتُ القَدَرِ، وتَقديمُ أبي بَكرٍ وعُمَر، والحَوضُ، والشَّفاعةُ، والميزانُ، والصِّراطُ...
‘সুন্নাত হ’ল দশ প্রকার। যার মধ্যে এগুলো থাকবে, তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এগুলোর কোন একটিকে পরিত্যাগ করবে, সে ঈমানকে পরিত্যাগ করবে। আর সেগুলো হ’ল তাক্বদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করা, (উম্মতের মাঝে) আবূ বকর ও ওমর (রাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়া, শাফা‘আত, মীযান, পুলছিরাত প্রভৃতি সত্য বলে বিশ্বাস করা...।[18]
আবুল হাসান আল-আশ‘আরী (রহঃ) বলেন,
أجمعوا على أن الصراط (جسر) ممدود على جهنم يجوز عليه العباد بقدر أعمالهم، وأنهم يتفاوتون في السرعة والإبطاء على قدر ذلك
‘এ ব্যাপারে বিদ্বানগণ একমত হয়েছেন যে, জাহান্নামের উপরে পুলছিরাত বিস্তৃত থাকবে। বান্দাগণ তাদের আমলের পরিমাণ অনুযায়ী এর ওপর দিয়ে পার হয়ে যাবে। আমলের তারতম্য অনুসারে তাদের (পুলছিরাত পারাপারের) দ্রুততা ও মন্থরতা নির্ধারিত হবে’।[19] অর্থাৎ যার আমল যত বেশী তিনি তত দ্রুত পার হবেন। আর যার আমল যত কম, তার অতিক্রম ততই ধীরগতিতে হবে। ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন,
الصراط حق يجوزه الأبرار، ويزل عنه الفجار،
‘পুলছিরাত সত্য। পুণ্যবান ব্যক্তিরা এটা পার হয়ে (জান্নাতে) চলে যাবেন এবং পাপী ব্যক্তিরা এখান থেকে পিছলে (জাহান্নামে) পড়ে যাবেন’।[20]
পুলছিরাত অতিক্রমকারীদের প্রকারভেদ ও গতি :
ক্বিয়ামতের দিন মানুষ তাদের আমলের তারতম্য অনুযায়ী পুলছিরাত পার হবে। ঈমান ও আমলে যিনি যত বলীয়ান তিনি তত দ্রুত ও নিরাপদে পার হয়ে যাবেন। আর দুনিয়াতে যার পরহেযগারিতা ও নেক আমল কম ছিল, তার পারাপারের গতি ততই মন্থর হবে। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
يُوضَعُ الصِّرَاطُ بَيْنَ ظَهْرَانَيْ جَهَنَّمَ، عَلَى حَسَكٍ كَحَسَكِ السَّعْدَانِ، ثُمَّ يَسْتَجِيزُ النَّاسُ، فَنَاجٍ مُسَلَّمٌ، وَمَخْدُوجٌ بِهِ، ثُمَّ نَاجٍ، وَمُحْتَبَسٌ بِهِ، وَمَنْكُوسٌ فِيهَا،
‘পুলছিরাত জাহান্নামের দুই তীরের সাথে যুক্ত থাকবে। তাতে থাকবে সা‘দান বৃক্ষের কাঁটা সদৃশ কাঁটাসমূহ। মানুষকে তার উপর দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হবে। কতক মুসলিম নিরাপদে তার উপর দিয়ে অতিক্রম করবে, কতক ব্যক্তি কাঁটার অাঁচড় খেয়ে ক্ষত-বিক্ষত হবে, তারপর নাজাত পাবে এবং কতক ব্যক্তি সেখানে আটকে যাবে এবং মুখ থুবড়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’।[21] এই হাদীসের মাধ্যমে বোঝা যায় পুলছিরাতের ওপর দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তিদের অবস্থা তিন রকম হবে। (১) নিরাপদে মুক্তিলাভকারী (২) ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মুক্তি লাভকারী (৩) জাহান্নামে পতিত।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, অতঃপর জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। সে পুলের উপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো। তবে মুক্তিপ্রাপ্তরা কেউ নিরাপদে চলে আসবেন, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। একবারে শেষে অতিক্রম করবে যে লোকটি, সে হেঁচড়িয়ে কোনভাবে পার হয়ে আসবে।[22]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ) বলেন,
إنَّ الصِّراطَ جِسرٌ مَوضوعٌ على مَتنِ جَهنَّمَ، وأنَّ الجَنةَ وراءَ ذلك، فيَمُرُّ عليه النَّاسُ بحَسَبِ أعمالِهم، فمنهمُ النَّاجي: وهو مَن زادَت حَسَناتُه على سَيِّئاتِه، أوِ استَويا، أو تَجاوَزَ اللهُ عنه، ومنهمُ السَّاقِطُ: وهو مَن رَجَحَت سَيِّئاتُه على حَسَناتِه إلَّا من تَجاوَزَ اللهُ عنه، فالسَّاقِطُ من الموَحِّدينَ يُعذَّبُ ما شاءَ اللهُ، ثُمَّ يَخرُجُ بالشَّفاعةِ وغَيرِها، والنَّاجي قد يَكونُ عليه تَبِعاتٌ وله حَسَناتٌ توازيها أو تَزيدُ عليها، فيُؤخَذُ من حَسَناتِه ما يَعدِلُ تَبعاتِه، فيُخَلَّصُ منها،
‘জাহান্নামের পৃষ্ঠদেশে নির্মিত সেতু হ’ল পুলছিরাত। এর পরেই থাকবে জান্নাত। মানুষ তাদের আমল মোতাবেক এর উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। যার পাপের চেয়ে নেকী বেশী হবে অথবা পাপ ও নেকী সমান সমান হবে অথবা আল্লাহ যাকে মাফ করে দিবেন, সে নাজাত পাবে। আর যার নেকীর চেয়ে গুনাহ বেশী হবে সে পিছলে (জাহান্নামে) পড়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ক্ষমা করে দিবেন, তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। আল্লাহর তাওহীদপন্থীদের মধ্য থেকে যারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে তথা জাহান্নামে যাবে, পরবর্তিতে তারা শাফ‘আত এবং অন্য কোন মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। আর নাজতপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি (কারো প্রতি যুলুম করার কারণে) দায়বদ্ধ থাকে এবং যুলুমের সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী পরিমাণ নেকী থাকে, তাহ’লে তার যুলুমের পরিমাণ অনুযায়ী নেকী কেটে নেওয়া হবে। অতঃপর তাকে মুক্তি দেওয়া হবে’।[23]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
يَمُرُّ النَّاسُ عَلَيْهِ عَلَى قَدْرِ أَعْمَالِهِمْ، فَمِنْهُمْ مَنْ يَمُرُّ كَلَمْحِ الْبَصَرِ، وَمِنْهُم مَن يَمُرُّ كَالْبَرْقِ، وَمِنْهُم مَن يَمُرُّ كَالرِّيحِ، ومِنْهُم مَن يَمُرُّ كَالْفَرَسِ الْجَوَادِ، وَمِنْهُم مَن يَمُرُّ كَرِكَابِ الإِبِلِ، ومِنْهُم مَن يَعْدُو عَدْوًا، وَمِنْهُم مَن يَمْشِي مَشْيًا، وَمِنْهُم مَن يَزْحَفُ زَحْفًا، وَمَنْهُم مَن يُخْطَفُ خَطْفًا وَيُلْقَى فِي جَهَنَّمَ؛ فَإِنَّ الْجِسرَ عَلَيْهِ كَلاَلِيبُ تَخْطِفُ النَّاسَ بِأَعْمَالِهِم،
‘লোকেরা নিজ নিজ আমল অনুযায়ী এর উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। তাদের কেউ চোখের পলকে চলবে, কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ উটে আরোহীদের গতিতে, কেউ দৌড়ে, কেউ হেঁটে এবং কেউ হামাগুড়ি দিয়ে পার হবে। কাউকে সেখান থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। পুলছিরাতের উপর থাকবে অসংখ্য লোহার আঁকড়া বা কাঁটা, যেগুলো মানুষের আমল অনুযায়ী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে’।[24] খালেদ ছালেহ (রহঃ) বলেন, ‘পুলছিরাতের উপর মানুষের গতির এই ভিন্নতার করণ হ’ল নেক আমল। কেননা আল্লাহ বলেছেন, وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ ‘আর অগ্রভাগের লোকেরা। তারা তো অগ্রবর্তীই’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/১০)। অর্থাৎ দুনিয়াতে যারা আল্লাহর অনুগত্য, ইবাদত ও সৎকাজে অগ্রগামী ছিল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে তারাই পুলছিরাতে অগ্রগামী হবে। তারা পুলছিরাতের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাতে চলে যাবে’।[25]
পুলছিরাতের ভয়াবহতা
১. ফেরেশতারা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে :
পুলছিরাত ও মীযান এমন দু’টি ভয়ানক জায়গা, যা দেখে ফেরেশতাগণ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবেন। যদিও তাদের আমল মীযানে পরিমাপ করা হবে না এবং পুলছিরাত অতিক্রম করতে হবে না। সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামদের দিন মীযান স্থাপন করা হবে। এখানে যদি আকাশসমূহ ও যমীন পরিমাপ করা হয়, তবে তা সম্ভব হবে। তখন ফেরেশতারা বলবেন,يَا رَبِّ لِمَنْ يَزِنُ هَذَا؟ ‘হে রব! কাকে পরিমাপ করা হবে?’ আল্লাহ বলবেন, لِمَنْ شِئْتُ مِنْ خَلْقِي، ‘আমার সৃষ্টির মাঝে যাকে ইচ্ছা (তাকে আমি ওযন করব)। তখন ফেরেশতারা ভয়ে কাতর হয়ে বলবেন,سُبْحَانَكَ مَا عَبَدْنَاكَ حَقَّ عِبَادَتِكَ، ‘তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমরা তোমার যথাযোগ্য ইবাদত করতে পারিনি’। এরপর ক্ষুরের মত ধারালো পুলছিরাত স্থাপন করা হবে।
ফেরেশতারা বলবেন, مَنْ تُجِيزُ عَلَى هَذَا؟ ‘হে রব! এর উপর দিয়ে কে পার হবে?’ আল্লাহ বলবেন, مَنْ شِئْت مِنْ خَلْقِي، ‘আমার সৃষ্টির মাঝে যাকে আমি চাইব (সেই পার হবে)। তখন ফেরেশতারা ভয়ে কাতর হয়ে বলবেন,سُبْحَانَكَ مَا عَبَدْنَاكَ حَقَّ عِبَادَتِكَ، ‘তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমরা তোমার যথাযোগ্য ইবাদত করতে পারিনি’।[26]
ক্বাসত্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘ভেবে দেখুন! যখন আপনি পুলছিরাতের উপর উঠবেন এবং (সেখান থেকে) নিমণবর্তী জাহান্নামের দিকে দৃষ্টি দিবেন। অতঃপর জ্বলন্ত আগুনের গর্জন, জাহান্নামের নিঃশ্বাস ও কৃষ্ণতা আপনার কর্ণকুহরে ধ্বনিত হ’তে থাকবে, তখন আপনার কেমন অবস্থা হবে? যদি আপনার কোন পা পিছলে যায়, তবে আপিন এর প্রখরতা টেঁর পাবেন এবং দ্বিতীয় পা উপরে ধরে রাখার কসরত করবেন। আপনার সামনেই অন্যরা পিছলে পড়ে যাবে এবং আগুনের তাপ অনুভব করবে। জাহান্নামের ফেরেশতারা তাদেরকে পাকড়াও করতে থাকবে, যারা (পুলছিরাতের) উল্টো কাঁটযুক্ত আংটা ও অাঁকড়াতে বিদ্ধ হবে। আপনি সেটা দেখতে থাকবেন। তখন সেই দৃশ্যটা কত বিভীষিকাময় হবে? আরোহণের পথটা কতই না ভয়ংকর হবে এবং অতিক্রমটাও কতই না সঙ্কীর্ণতর হবে? আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই, সাহায্য চাই এবং অনুগ্রহ কামনা করি’।[27]
২. পুলছিরাতে নবী-রাসূল ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না:
পুলছিরাতের কাছে মানুষ এমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে যে, কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। কেবল নবীগণ কাতর কণ্ঠে ফরিয়াদ করতে থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আর জাহান্নামের দুই প্রান্তে সেতু নির্মাণ করা হবে। রাসূলগণের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম আমার উম্মতকে নিয়ে এ পথ অতিক্রম করব। সেদিন রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ কথা বলবে না। আর রাসূলগণের কথা হবে,اللَّهُمَّ سَلِّمْ سَلِّمْ، ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিম সাল্লিম’ (হে আল্লাহ! রক্ষা করুন, রক্ষা করুন!)।[28] মূলতঃ এই দো‘আর মাধ্যমে নবীগণ তাদের উম্মতের জন্য শাফা‘আত করবেন। অপর বর্ণনায় এসেছে যে, ফেরেশতারাও এই দো‘আর মাধ্যমে মুমিনদের জন্য শাফা‘আত করবেন।[29] শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলেন, এটা সেই তাওহীদপন্থী ব্যক্তিদের জন্য শাফা‘আত, যারা জাহান্নামে প্রবেশ করার হক্বদার হয়ে গেছে। কেননা আল্লাহ যাকে রক্ষা করবেন না, সে অবশ্যই জাহান্নামে পতিত হবে।[30]
৩. পুলছিরাতের কাছে রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আত :
ক্বিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আটটি পর্যায়ে শাফা‘আত করবেন।[31] তাঁর শাফা‘আতের অন্যতম জায়গা হ’ল পুলছিরাত। আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট নিবেদন করলাম যে, তিনি যেন ক্বিয়ামত দিবসে আমার জন্য শাফা‘আত করেন।[32] তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি শাফা‘আত করব। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,
يَا رَسُولَ اللهِ فَأَيْنَ أَطْلُبُكَ؟
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে কোথায় খোঁজ করব? তিনি বললেন,
اطْلُبْنِي أَوَّلَ مَا تَطْلُبُنِي عَلَى الصِّرَاطِ،
‘তুমি সর্বপ্রথম আমাকে পুলছিরাতের উপর খোঁজ করবে’। আমি বললাম, পুলছিরাতে যদি আপনাকে না পাই? তিনি বললেন,
فَاطْلُبْنِي عِنْدَ الـمِيزَانِ،
‘তাহ’লে মীযানের কাছে খুঁজবে। আমি আবার বললাম, মীযানের কাছেও যদি আপনাকে না পাই? তিনি বললেন,
فَاطْلُبْنِي عِنْدَ الحَوْضِ فَإِنِّي لَا أُخْطِئُ هَذِهِ الثَّلَاثَ الـمَوَاطِنَ
‘তাহ’লে হাওযে কাওছারের সামনে খুঁজবে। আমি এ তিনটি জায়গার যে কোন একটিতে অবশ্যই উপস্থিত থাকব’।[33] অন্যত্র তিনি বলেছেন,
إنّ أمامَكم عقبةً كؤودًا، لا يجوزُها الـمُثقِلونَ، فأُحبُّ أنْ أتخففَ لتلكِ العقبةِ
‘তোমাদের সামেনে একটি দুর্গম-অনতিক্রম্য গিরিপথ আছে। পাপের বোঝায় ভারাক্রান্ত ব্যক্তিরা এটা পার হ’তে পারবে না। আমি সেই গিরিপথের বোঝা হালকা করে দেওয়ার প্রত্যাশা রাখি’।[34]
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَنَبِيُّكُمْ قَائِمٌ عَلَى الصِّرَاطِ يَقُولُ: رَبِّ سَلِّمْ سَلِّمْ، حَتَّى تَعْجِزَ أَعْمَالُ الْعِبَادِ، حَتَّى يَجِيءَ الرَّجُلُ فَلَا يَسْتَطِيعُ السَّيْرَ إِلَّا زَحْفًا،
‘তোমাদের নবী পুলছিরাতের উপর দাঁড়িয়ে বলতে থাকবেন, ‘রবিব! সাল্লিম সাল্লিম’ (হে আমার রব! নিরাপদ রাখুন, রক্ষা করুন!)। পরিশেষে কিছুসংখ্যক বান্দার আমল এতই কম হবে যে, তাদের পুলছিরাত অতিক্রম করার সাধ্য থাকবে না। এমনকি সেসময় এক লোক হামাগুড়ি দিতে দিতে অতিক্রম করবে’। পুলছিরাতের উভয় কিনারায় আংটা ঝুলন্ত থাকবে। যাকে পাকড়াও করার নির্দেশ থাকবে উক্ত আংটা তাকে পাকড়াও করবে। ফলে কেউ কেউ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় মুক্তি পাবে আবার কোন কোন ব্যক্তিকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রাবী (রাঃ) বলেন, ‘সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ! জাহান্নামের গভীরতা সত্তর বছর দূরত্বের সমান।[35]
মুমিনরা পুলছিরাত পার হয়ে যাওয়ার পরেও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের জন্য শাফা‘আত করবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
أَنَا أَكْثَرُ الْأَنْبِيَاءِ تَبَعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يَقْرَعُ بَابَ الْجَنَّةِ
‘ক্বিয়ামতের দিন নবীদের মধ্যে আমার অনুসারীদের সংখ্যা হবে সবচাইতে বেশী। আর আমিই সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় কড়া নাড়ব’।[36] তিনি আরো বলেন,
آتِي بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتفْتِحُ، فَيَقُولُ الْخَازِنُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُولُ: مُحَمَّدٌ، فَيَقُولُ: بِكَ أُمِرْتُ لَا أَفْتَحُ لِأَحَدٍ قَبْلَكَ،
‘ক্বিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় এসে তা খোলার জন্য বলব। তখন তার প্রহরী বলবেন, আপনি কে? বলব, আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)! তখন প্রহরী বলবেন, আপনার সম্পর্কে আমাকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনার আগে আমি যেন অন্য কারো জন্য এ দরজা না খুলি’।[37]
এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জান্নাতের দরজা খোলার জন্য শাফা‘আত করবেন। তারপর দরজা খোলা হবে। তাঁর শাফা‘আত করার আগে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এটা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
যেমন আল্লাহ বলেন,
وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا
‘আর যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে নিয়ে যাওয়া হবে জান্নাতের দিকে। অবশেষে তারা যখন সেখানে উপস্থিত হবে ও তার দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে’ (যুমার ৩৯/৭৩)।
এত্র আয়াতে মহান আল্লাহ পূর্বে বর্ণিত জাহান্নামীদের অবস্থার মত বলেননি যে,
حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا
অত্র আয়াতে فُتِحَتْ-এর আগে واو হরফের মাধ্যমে ইশারা করা হয়েছে যে, জান্নাতের দরজা খোলার আগে কিছু একটা হবে, আর সেটাই হ’ল শাফা‘আত’।[38]
[1]. ইবনু ফারেস, মাক্বাঈসিল লুগাত, ৩/১৫২; আবূ মানছূর আযহারী, তাহযীবুল লুগাত, ১২/২৩২।
[2]. বুখারী হা/৭৪৩৯।
[3]. মুসলিম হা/১৮৩।
[4]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৮৭৩৯; সহীহাহ্ হা/৯৪১, সনদ সহীহ।
[5]. ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-মুহাল্লা বিল আছার, ১/৩৬।
[6]. ওছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আস-সাফ্ফারীনিইয়াহ, পৃ. ৪৭৫।
[7]. মুসলিম হা/২৭৯১।
[8]. ওছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৫১৮।
[9]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল ক্বাদীর, ১১/৩৯৯।
[10]. বুখারী হা/৬৫৩৫; মিশকাত হা/৫৫৮৯।
[11]. কুরতুবী, আত-তাযকিরাহ, ২/৩৬।
[12]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২০/১০১।
[13]. ওছায়মীন, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৫২০।
[14]. ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ৪/২৬৬; ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ ওয়া আছহাবিল হাদীস ১/১২১; ইবনু আবিল ‘ইয আল-হানাফী, শারহুল আক্বীদাহ আত-ত্বাহাবিইয়াহ, পৃ. ৪১৫; ইবনে তাইমিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৪/২৭৯।
[15]. মুসলিম হা/২৪৯৬; তিরমিযী হা/৩৮৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২৮১; মিশকাত হা/৬২২৭।
[16]. শাওক্বানী, ফাৎহুল ক্বাদীর, ৩/৪০৬।
[17]. বারবাহারী, শারহুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৭।
[18]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আত, ১/১৭৫।
[19]. আবুল হাসান আল-আশ‘আরী, রিসালাতুন ইলা আহলিছ ছুগার, পৃ.১৬৩।
[20]. ইবনু কুদামাহ, লুম‘আতুল ই‘তিক্বাদ, পৃ. ৩৩।
[21]. আহমাদ হা/১১০৮১; ইবনে মাজাহ হা/৪২৮০, সনদ সহীহ।
[22]. বুখারী হা/৭৪৩৯; মুসলিম হা/১৮৩।
[23]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১১/৩৯৯।
[24]. ইবনে তাইমিয়াহ, আল-আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৯৯।
[25]. শারহু লুম‘আতিল ই‘তিক্বাদ ১৩/১০।
[26]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৮৭৩৯; সহীহাহ হা/৯৪১, সনদ সহীহ।
[27]. আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ক্বাসত্বাল্লানী, ইরশাদুস সারী ৯/৩৩০।
[28]. বুখারী হা/৮০৬।
[29]. আহমাদ হা/১১২০২, সনদ সহীহ।
[30]. শারহু সুনানে আবীদাঊদ ২৭/২৪৯।
[31]. ড. ছালেহ আল-ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ১২১।
[32]. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে শাফা‘আত চাওয়া বৈধ ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং এখন যদি কেউ রাসূল (ﷺ)-এর কবরের কাছে গিয়ে বা দূর থেকে তাঁর কাছে শাফা‘আত কামনা করে, তবে সেটা শিরক হবে। তাই রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আতের জন্য কেবল আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে।
[33]. তিরমিযী হা/২৪৩৩; মিশকাত হা/৫৫৯৫, সনদ সহীহ।
[34]. সহীহাহ হা/২৪৮০; সহীহুল জামে‘ হা/৩১৭৭, সনদ সহীহ।
[35]. মুসলিম হা/১৯৫; মিশকাত হা/৫৬০৮।
[36]. মুসলিম হা/১৯৬; মিশকাত হা/৫৭৪২।
[37]. মুসলিম হা/১৯৭; মিশকাত হা/৫৭৪৩।
[38]. শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিইয়াহ, পৃ. ৫২২।
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Last edited: