সালাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত। এ ইবাদত কবুল হওয়ার উপরেই অন্যান্য ইবাদত নির্ভর করে। অথচ মানুষ সালাতের যথার্থ গুরুত্ব অনুধাবন না করে যেনতেনভাবে সালাত আদায় করে। এ ধরনের সালাত আল্লাহর নিকটে কবুল হবে না; বরং এসব সালাত আদায়কারীর জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে সে বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে।
সালাত আদায়কারী তিন শ্রেণীর মানুষকে জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। প্রথমতঃ যারা অলসতা বা অবহেলা বশতঃ সঠিক সময়ে সালাত আদায় করে না। তাদের সালাত কবুল হবে না। তাদের জন্য পরকালে শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘অতঃপর দুর্ভোগ ঐসব মুছল্লীর জন্য, যারা তাদের সালাত থেকে উদাসীন’ (মাঊন ১০৭/৪-৫)। অর্থাৎ
‘যারা সালাত থেকে উদাসীন ও খেল-তামাশায় ব্যস্ত’। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আউয়াল ওয়াক্ত ছেড়ে যঈফ ওয়াক্তে সালাত আদায় করে। যারা জানা সত্ত্বেও সহীহ হাদীস মোতাবেক সালাত আদায় করে না। রুকূ-সিজদা, উঠা-বসা যথাযথভাবে করে না। ক্বিরাআত ও দো‘আ-দরূদ ঠিকমত পাঠ করে না। কোন কিছুর অর্থ বুঝে না বা বুঝবার চেষ্টাও করে না। আযান শোনার পরেও যারা অলসতাবশে সালাতে দেরী করে বা জামা‘আতে হাযির হওয়া থেকে বিরত থাকে। সালাতে দাঁড়াবার সময় বা সালাতে দাঁড়িয়েও অমনোযোগী থাকে ইত্যাদি।[1]
সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, এর অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যারা অবহেলা বশে সঠিক সময় থেকে দেরীতে সালাত আদায় করে’।[2]
ইবনু কাছীর বলেন,
‘তারা তাদের সালাত থেকে উদাসীন’ অর্থ হ’ল তারা নিয়মিতভাবে বা অধিকাংশ সময়ে আউয়াল ওয়াক্তের বদলে আখেরী ওয়াক্তে সালাত আদায় করে (ইবনু কাছীর)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘ওটা মুনাফিকদের সালাত, যারা সূর্যের প্রতীক্ষায় বসে থাকে, তারপর সূর্য অস্ত যেতে শুরু করলে শয়তান তার শিং মেলিয়ে দেয়, তখন তারা দাঁড়িয়ে মোরগের মত চারটি ঠোকর মারে। তাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই হয়’।[3]
প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ সালাত আদায়কারী মুসলিম জানেন যে, সালাত ফরয। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করাও যে ফরয এটা অনেকেই জানে না। এ কারণেই বলা হয়েছে যে, সালাত আদায় করেও তিন শ্রেণীর মুছল্লী জাহান্নামে যাবে। মহান আল্লাহ সালাত ফরয করার পর বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছে’ (নিসা ৪/১০৩)।
সময়মত সালাত আদায় করা অন্যতম উত্তম আমল। নিম্নের হাদীসটি যার প্রমাণ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথাসময়ে সালাত সম্পাদন করা। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসূল (ﷺ) বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা’।[4] অন্য হাদীসে এসেছে উম্মে ফারওয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমল সমূহের মধ্যে কোন আমল সর্বাধিক উত্তম? তিনি বললেন, আউয়াল (প্রথম) ওয়াক্তে সালাত আদায় করা’।[5]
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহর নিকট প্রিয় ও শ্রেষ্ঠতর আমল হচ্ছে আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলিম সালাত আদায় করে শেষ ওয়াক্তে। উপরের দু’টি সহীহ হাদীস মাযহাবী আলেমগণ মুছল্লীদের সামনে পেশ করে না। তারা শুধু বড় জামা‘আতে বেশী ফযীলত এই ধোঁকা দিয়ে মানুষকে মুনাফিকদের সালাত শিক্ষা দেয়। আর নেতারা শেষ সময় সালাত আদায় করলে করণীয় সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন,
‘নেতারা যখন সালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে দেরী করে পড়বে বা সালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে মেরে ফেলবে তখন তুমি কি করবে? আমি বললাম, আপনি আমাকে কি করতে আদেশ করছেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সালাতের ওয়াক্তেই সালাত আদায় করে নিবে। অতঃপর তাদের সাথে যদি পুনরায় আদায় করতে পার তাহ’লে আদায় করবে। আর তা তোমার জন্য নফল হবে’।[6]
প্রকাশ থাকে যে, বড় জামা‘আতে সালাত আদায় করার চেয়ে আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা উত্তম। কারণ সালাতের শেষ ওয়াক্তে সালাত আদায় করা মুনাফিকী। অতএব দেরিতে সালাত আদায় করলে মুনাফিক হয়ে জাহান্নামে জ্বলতে হবে। আউয়াল ওয়াক্তে একাই সালাত আদায়কারী ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ ক্ষমা রয়েছে। উক্ববা ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমাদের প্রতিপালক আনন্দিত হন ঐ ছাগলের রাখালের প্রতি, যে একাই পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে সালাতের আযান দেয় এবং সালাত আদায় করে। আল্লাহ তা‘আলা তখন ফেরেশতাগণকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা আমার বান্দার প্রতি লক্ষ্য কর, সে আমার ভয়ে আযান দিচ্ছে এবং সালাত আদায় করছে। আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালাম’।[7]
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের একদল লোক বলে যে, ‘আসুন ভাই আসুন খুশি-খুশি জামায়াতের সহিত নামায পড়ি। বহুত ফায়দা আছে’। অথচ দেরী করে সালাত আদায় করে আর উপরের হাদীস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় ফরয করেছেন। অতএব একা হ’লেও ঐ সময়ই সালাত আদায় করতে হবে, তবুও দেরিতে সালাত আদায় করা যাবে না। এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চৌদ্দশত বছর পূর্বে জানিয়ে দিয়ে গেছেন।
দ্বিতীয়তঃ সালাত আদায় করেও জাহান্নামে যাবে ঐসব মুছল্লী যারা রাসূল (ﷺ)-এর পদ্ধতিতে সালাত আদায় না করে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখ, ঠিক সেভাবেই সালাত আদায় কর’।[8]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেভাবে সালাত আদায় করেছেন, সেভাবে সালাত আদায় করতে গেলে অবশ্যই সহীহ হাদীসের আলোকেই সালাত আদায় করতে হবে। কোন ইমাম, তরীকা বা মাযহাবের পদ্ধতিতে সালাত আদায় করলে সেটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতির সালাত হবে না। যেমন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাক্ষাতে তিন, তিন বার সালাত আদায় করেও তা সঠিক বলে গণ্য হয়নি। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
‘রাসূল (ﷺ) মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তুমি যাও, পুনরায় সালাত আদায় কর। কেননা তুমি সালাত আদায় করনি। এভাবে লোকটি তিন বার সালাত আদায় করল। রাসূল (ﷺ) তাকে তিন বারই ফিরিয়ে দিলেন। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, এর চাইতে সুন্দরভাবে আমি সালাত আদায় করতে জানি না। অতএব আমাকে সালাত শিখিয়ে দিন! অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যখন তুমি সালাতে দাঁড়াবে তখন তাকবীর দিবে। অতঃপর কুরআন থেকে যা পাঠ করা তোমার কাছে সহজ মনে হবে, তা পাঠ করবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে রুকূ করবে। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে সাথে সিজদা করবে। অতঃপর মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসবে। আর প্রত্যেক সালাত এভাবে আদায় করবে’।[9]
বিজ্ঞ পাঠক! উপরের হাদীস দ্বারা সালাতে দ্রুততার সাথে কিয়াম-কুউদ ও রুকূ-সিজদা করার পরিণতি জানা গেল। অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় চোর ঐ ব্যক্তি যে তার সালাত চুরি করে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে কিভাবে সালাত চুরি করে? তিনি বললেন, সে সালাতে রুকূ ও সিজদা পূর্ণ করে না’।[10]
রাসূল (ﷺ)-এর ভাষায় বড় চোর হচ্ছে যারা সালাতের মধ্যে চুরি করে। পার্থিব জীবনে মানুষ মানুষের ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা চুরি করে, এটাকে সামান্য চুরি বলা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের মহামূল্যবান সম্পদ, জান্নাতে যাওয়ার পুঁজি, কত ইবাদতের মাঝে শ্রেষ্ঠ ইবাদত চুরি করে সেই প্রকৃতপক্ষে বড় চোর।
বস্ত্ততঃ রুকূ-সিজদা যথাযথভাবে না করলে সালাতই হয় না। রাসূল (ﷺ) বলেন,
‘সালাতের ছওয়াব তিনভাগে বিভক্ত। এক-তৃতীয়াংশ পবিত্রতা, এক-তৃতীয়াংশ রুকূ ও এক-তৃতীয়াংশ সিজদায়। যে এইগুলি পূর্ণ আদায় করল তার সালাত কবুল হ’ল এবং তার সমস্ত আমলও কবুল হ’ল। আর যার সালাত কবুল করা হবে না, তার কোন আমলই কবুল হবে না’।[11]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ বান্দার সালাতের প্রতি দৃষ্টি দেন না, যে সালাতে রুকূ ও সিজদায় পিঠ সোজা করে না’।[12] অন্য হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
‘নিশ্চয়ই কোন মছুল্লী ৬০ বছর যাবৎ সালাত আদায় করছে, কিন্তু তার সালাত কবুল হচ্ছে না। হয়ত সে পূর্ণভাবে রুকূ করে কিন্তু সিজদা পূর্ণভাবে করে না। অথবা পূর্ণভাবে সিজদা করে কিন্তু পূর্ণভাবে রুকূ করে না’।[13]
অন্য বর্ণনায় আছে আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘মুছল্লীর সালাত ততক্ষণ পর্যন্ত যথেষ্ট হবে না যতক্ষণ সে রুকূ ও সিজদায় তার পীঠ সোজা না করবে।[14]
তৃতীয়তঃ যারা লোক দেখানো সালাত আদায় করে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে’ (মাঊন ১০৭/৬)। এটা হচ্ছে মুনাফিকদের সালাত। যেমন মহান আল্লাহ অপর আয়াতে বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। যখন ওরা সালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।
ইমাম সুয়ূতী বলেন, মুনাফিকদের ধোঁকা হ’ল লোক দেখানো সালাত আদায় করা। এভাবে তারা যেন আল্লাহকে ধোঁকা দেয় যে, তারা সালাত আদায় করে থাকে। অথচ আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। আর আল্লাহ তাদের ধোঁকায় ফেলেন অর্থ ওদের লোক দেখানো সালাত জানা সত্ত্বেও তিনি তাদের দুনিয়াতে জান-মালের নিরাপত্তা দান করেন। অথচ আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান নির্ধারণ করেন (নিসা ৪/১৪৫)।[15]
উক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এ নির্বোধ মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলার সাথে প্রতারণা করছে। অথচ তিনি তাদের অন্তরের সমস্ত কথা সম্যক অবগত রয়েছেন। তাদের স্বল্প বুদ্ধির কারণে এ মুনাফিকরা মনে করে নিয়েছে যে, তাদের কপটতা যেমন দুনিয়াতে চলছে তদ্রূপ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সমীপেও চলবে। আসলে কিয়ামতের দিন তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা মুসলমানদের আলোর উপর নির্ভর করে থাকতে চাইবে। কিন্তু তাওহীদবাদী খাঁটি মুসলিমগণ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তখন মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে ডেকে বলবে, তোমরা থাম, আমরা তোমাদের আলোর সাহায্য চাই। মুসলমানরা তখন উত্তর দিবে, তোমরা পিছনে ফিরে যাও এবং আলো অনুসন্ধান কর। তখন তারা পিছনে ফিরবে। এমন সময় তাদের মধ্যে পর্দা পড়ে যাবে। আফসোস! মুসলমানদের মাঝে থাকবে আল্লাহর পক্ষ হ’তে করুণা ও দয়া। আর মুনাফিকদের জন্য থাকবে দুঃখ-বেদনা।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মুনাফিকদের উপর সবচেয়ে ভারী সালাত হচ্ছে এশা ও ফজরের সালাত। যদি তারা এই সালাতের ফযীলতের কথা জানত, তবে হাঁটুতে ভর দিয়ে হ’লেও এ সালাতে হাযির হ’ত। কাজেই আমি তখন ইচ্ছা করি যে, তাকবীর দিয়ে কাউকে ইমামতির স্থানে দাঁড় করতঃ সালাত আরম্ভ করিয়ে দেই, অতঃপর আমি লোকদেরকে বলি যে, তারা যেন জ্বালানী কাঠ নিয়ে এসে ঐ লোকদের বাড়ীর চতুর্দিকে রেখে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। যারা জামা‘আতে হাযির হয় না’।[16]
মূলতঃ লোক দেখানো কোন আমল আল্লাহ কবুল করেন না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি লোককে শুনানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তাকে দিয়েই তা শুনিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তার মাধ্যমে তা দেখিয়ে দেন’।[17] অর্থাৎ আল্লাহ তাকে লজ্জিত করেন এবং স্পষ্ট করে
দেন যে, সে আদৌ মোখলেছ নয়। বস্ত্ততঃ পূর্ণ আল্লাহভীতি এবং খুশূ-খুযূ ও একাগ্রতা ব্যতীত সালাত কবুল হয় না। আর লোক দেখানো আমলকারীকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[18]
পরিশেষে বলব, সঠিক সময়ে খালেছ অন্তরে রাসূল (ﷺ)-এর তরীকায় তথা সহীহ হাদীস মোতাবেক সালাত আদায় করতে হবে। অন্যথা সালাত আদায় করেও জাহান্নামী হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে সালাত আদায়ের তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, পৃঃ ৫০১।
[2]. কুরতুবী হা/৬৪৮৩; বাযযার, ত্বাবারী, বায়হাক্বী। তবে বায়হাক্বী সা‘দ থেকে ‘মওকূফ’ সূত্রে বর্ণনা করার পর সেটাকেই ‘সঠিক’ বলেছেন (২/২১৪-১৫)। হায়ছামী একে ‘হাসান’ বলেছেন (১/৩২৫)।
[3]. মুসলিম হা/৬২২; মিশকাত হা/৫৯৩।
[4]. বুখারী হা/৫২৭, ই.ফা.বা. হা/২১৮, পৃঃ ৫০২; মুসলিম হা/৮৫।
[5]. আবুদাঊদ হা/৪২৬; তিরমিযী হা/১৭০; মিশকাত হা/৬০৭, সনদ সহীহ।
[6]. মুসলিম হা/৬৪৮; ই.ফা. বা. হা/১৩৩৮; মিশকাত হা/৬০০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৫৫২, ২/১৭৭।
[7]. আবু দাঊদ হা/১২০৩; সনদ সহীহ; নাসাঈ হা/৬৬৬; সহীহাহ হা/৪১; মিশকাত হা/৬৬৫, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬১৪, ২/২০২ পৃঃ।
[8]. বুখারী হা/৬৩১; মিশকাত হা/৬৮৩।
[9]. বুখারী হা/৭৫৭; তিরমিযী হা/৩০৩; নাসাঈ হা/৮৮৪; মিশকাত হা/৭৯০ ‘সালাতের বিবারণ’ অধ্যায়।
[10]. মুসনাদে আহামাদ হা/২২৬৯৫; সহীহুল জামে‘ হা/৯৮৬; মিশকাত হা/৮৮৫।
[11]. সিলসিলা সহীহাহ হা/৬৪৩; সহীহ আত-তারগীব হা/৫৩৯।
[12]. আহমাদ হা/১৬৩২৬; সহীহাহ হা/২৫৩৬; মিশকাত হা/৯০৪।
[13]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৯৬৩; সহীহ আত-তারগীব হা/৫২৯; সহীহাহ হা/২৫৩৫, সনদ হাসান।
[14]. আবুদাঊদ হা/৮৫৫, ১/১২৪; মিশকাত হা/৮৭৮; সহীহ তারগীব হা/৫২৮, তাবরানী কাবীর হা/৩৭৪৮।
[15]. তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, পৃঃ ৫০৩।
[16]. মুসলিম হা/৬৫১।
[17]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬ ‘শুনানো ও দেখানো’ অনুচ্ছেদ।
[18]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত ২০৫।
সালাত আদায়কারী তিন শ্রেণীর মানুষকে জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। প্রথমতঃ যারা অলসতা বা অবহেলা বশতঃ সঠিক সময়ে সালাত আদায় করে না। তাদের সালাত কবুল হবে না। তাদের জন্য পরকালে শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ
‘অতঃপর দুর্ভোগ ঐসব মুছল্লীর জন্য, যারা তাদের সালাত থেকে উদাসীন’ (মাঊন ১০৭/৪-৫)। অর্থাৎ
لاهون عن الصلوة ويتغافلون عنها
‘যারা সালাত থেকে উদাসীন ও খেল-তামাশায় ব্যস্ত’। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আউয়াল ওয়াক্ত ছেড়ে যঈফ ওয়াক্তে সালাত আদায় করে। যারা জানা সত্ত্বেও সহীহ হাদীস মোতাবেক সালাত আদায় করে না। রুকূ-সিজদা, উঠা-বসা যথাযথভাবে করে না। ক্বিরাআত ও দো‘আ-দরূদ ঠিকমত পাঠ করে না। কোন কিছুর অর্থ বুঝে না বা বুঝবার চেষ্টাও করে না। আযান শোনার পরেও যারা অলসতাবশে সালাতে দেরী করে বা জামা‘আতে হাযির হওয়া থেকে বিরত থাকে। সালাতে দাঁড়াবার সময় বা সালাতে দাঁড়িয়েও অমনোযোগী থাকে ইত্যাদি।[1]
সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, এর অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
الَّذِيْنَ يُؤَخِّرُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا، تَهَاوُنًا بِهَا-
‘যারা অবহেলা বশে সঠিক সময় থেকে দেরীতে সালাত আদায় করে’।[2]
ইবনু কাছীর বলেন,
عَنْ صَلَوتِهِمْ سَاهُوْنَ
‘তারা তাদের সালাত থেকে উদাসীন’ অর্থ হ’ল তারা নিয়মিতভাবে বা অধিকাংশ সময়ে আউয়াল ওয়াক্তের বদলে আখেরী ওয়াক্তে সালাত আদায় করে (ইবনু কাছীর)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَهَا أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيهَا إِلاَّ قَلِيلاً
‘ওটা মুনাফিকদের সালাত, যারা সূর্যের প্রতীক্ষায় বসে থাকে, তারপর সূর্য অস্ত যেতে শুরু করলে শয়তান তার শিং মেলিয়ে দেয়, তখন তারা দাঁড়িয়ে মোরগের মত চারটি ঠোকর মারে। তাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই হয়’।[3]
প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ সালাত আদায়কারী মুসলিম জানেন যে, সালাত ফরয। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করাও যে ফরয এটা অনেকেই জানে না। এ কারণেই বলা হয়েছে যে, সালাত আদায় করেও তিন শ্রেণীর মুছল্লী জাহান্নামে যাবে। মহান আল্লাহ সালাত ফরয করার পর বলেছেন,
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ كِتَابًا مَوْقُوْتًا-
‘নিশ্চয়ই সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছে’ (নিসা ৪/১০৩)।
সময়মত সালাত আদায় করা অন্যতম উত্তম আমল। নিম্নের হাদীসটি যার প্রমাণ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
سَأَلْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللهِ.
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথাসময়ে সালাত সম্পাদন করা। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসূল (ﷺ) বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা’।[4] অন্য হাদীসে এসেছে উম্মে ফারওয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ الصَّلاَةُ فِىْ أَوَّلِ وَقْتِهَا.
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমল সমূহের মধ্যে কোন আমল সর্বাধিক উত্তম? তিনি বললেন, আউয়াল (প্রথম) ওয়াক্তে সালাত আদায় করা’।[5]
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহর নিকট প্রিয় ও শ্রেষ্ঠতর আমল হচ্ছে আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলিম সালাত আদায় করে শেষ ওয়াক্তে। উপরের দু’টি সহীহ হাদীস মাযহাবী আলেমগণ মুছল্লীদের সামনে পেশ করে না। তারা শুধু বড় জামা‘আতে বেশী ফযীলত এই ধোঁকা দিয়ে মানুষকে মুনাফিকদের সালাত শিক্ষা দেয়। আর নেতারা শেষ সময় সালাত আদায় করলে করণীয় সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন,
كَيْفَ أَنْتَ إِذَا كَانَتْ عَلَيْكَ أُمَرَاءُ يُؤَخِّرُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا أَوْ يُمِيْتُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا. قَالَ قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِىْ قَالَ صَلِّ الصَّلاَةَ لِوَقْتِهَا فَإِنْ أَدْرَكْتَهَا مَعَهُمْ فَصَلِّ فَإِنَّهَا لَكَ نَافِلَةٌ.
‘নেতারা যখন সালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে দেরী করে পড়বে বা সালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে মেরে ফেলবে তখন তুমি কি করবে? আমি বললাম, আপনি আমাকে কি করতে আদেশ করছেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সালাতের ওয়াক্তেই সালাত আদায় করে নিবে। অতঃপর তাদের সাথে যদি পুনরায় আদায় করতে পার তাহ’লে আদায় করবে। আর তা তোমার জন্য নফল হবে’।[6]
প্রকাশ থাকে যে, বড় জামা‘আতে সালাত আদায় করার চেয়ে আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা উত্তম। কারণ সালাতের শেষ ওয়াক্তে সালাত আদায় করা মুনাফিকী। অতএব দেরিতে সালাত আদায় করলে মুনাফিক হয়ে জাহান্নামে জ্বলতে হবে। আউয়াল ওয়াক্তে একাই সালাত আদায়কারী ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ ক্ষমা রয়েছে। উক্ববা ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
يَعْجَبُ رَبُّكُمْ مِنْ رَاعِى غَنَمٍ فِىْ رَأْسِ شَظِيَّةٍ بِجَبَلٍ يُؤَذِّنُ بِالصَّلاَةِ وَيُصَلِّى فَيَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوْا إِلَى عَبْدِىْ هَذَا يُؤَذِّنُ وَيُقِيْمُ الصَّلاَةَ يَخَافُ مِنِّى فَقَدْ غَفَرْتُ لِعَبْدِىْ وَأَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ.
‘তোমাদের প্রতিপালক আনন্দিত হন ঐ ছাগলের রাখালের প্রতি, যে একাই পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে সালাতের আযান দেয় এবং সালাত আদায় করে। আল্লাহ তা‘আলা তখন ফেরেশতাগণকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা আমার বান্দার প্রতি লক্ষ্য কর, সে আমার ভয়ে আযান দিচ্ছে এবং সালাত আদায় করছে। আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালাম’।[7]
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের একদল লোক বলে যে, ‘আসুন ভাই আসুন খুশি-খুশি জামায়াতের সহিত নামায পড়ি। বহুত ফায়দা আছে’। অথচ দেরী করে সালাত আদায় করে আর উপরের হাদীস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় ফরয করেছেন। অতএব একা হ’লেও ঐ সময়ই সালাত আদায় করতে হবে, তবুও দেরিতে সালাত আদায় করা যাবে না। এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চৌদ্দশত বছর পূর্বে জানিয়ে দিয়ে গেছেন।
দ্বিতীয়তঃ সালাত আদায় করেও জাহান্নামে যাবে ঐসব মুছল্লী যারা রাসূল (ﷺ)-এর পদ্ধতিতে সালাত আদায় না করে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِىْ أُصَلِّى
‘তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখ, ঠিক সেভাবেই সালাত আদায় কর’।[8]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেভাবে সালাত আদায় করেছেন, সেভাবে সালাত আদায় করতে গেলে অবশ্যই সহীহ হাদীসের আলোকেই সালাত আদায় করতে হবে। কোন ইমাম, তরীকা বা মাযহাবের পদ্ধতিতে সালাত আদায় করলে সেটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতির সালাত হবে না। যেমন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাক্ষাতে তিন, তিন বার সালাত আদায় করেও তা সঠিক বলে গণ্য হয়নি। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَخَلَ الْمَسْجِدَ، فَدَخَلَ رَجُلٌ فَصَلَّى فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَرَدَّ وَقَالَ ارْجِعْ فَصَلِّ، فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ. فَرَجَعَ يُصَلِّى كَمَا صَلَّى ثُمَّ جَاءَ فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ارْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ ثَلاَثًا. فَقَالَ وَالَّذِى بَعَثَكَ بِالْحَقِّ مَا أُحْسِنُ غَيْرَهُ فَعَلِّمْنِى. فَقَالَ إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلاَةِ فَكَبِّرْ، ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ، ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ جَالِسًا، وَافْعَلْ ذَلِكَ فِى صَلاَتِكَ كُلِّهَا.
‘রাসূল (ﷺ) মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তুমি যাও, পুনরায় সালাত আদায় কর। কেননা তুমি সালাত আদায় করনি। এভাবে লোকটি তিন বার সালাত আদায় করল। রাসূল (ﷺ) তাকে তিন বারই ফিরিয়ে দিলেন। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, এর চাইতে সুন্দরভাবে আমি সালাত আদায় করতে জানি না। অতএব আমাকে সালাত শিখিয়ে দিন! অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যখন তুমি সালাতে দাঁড়াবে তখন তাকবীর দিবে। অতঃপর কুরআন থেকে যা পাঠ করা তোমার কাছে সহজ মনে হবে, তা পাঠ করবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে রুকূ করবে। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে সাথে সিজদা করবে। অতঃপর মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসবে। আর প্রত্যেক সালাত এভাবে আদায় করবে’।[9]
বিজ্ঞ পাঠক! উপরের হাদীস দ্বারা সালাতে দ্রুততার সাথে কিয়াম-কুউদ ও রুকূ-সিজদা করার পরিণতি জানা গেল। অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
أَسْوَأُ النَّاسِ سَرِقَةً الَّذِى يَسْرِقُ مِنْ صَلاَتِهِ. قَالُوْا يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَسْرِقُ مِنْ صَلاَتِهِ؟ قَالَ لاَ يُتِمُّ رُكُوْعَهَا وَلاَ سُجُوْدَهَا.
‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় চোর ঐ ব্যক্তি যে তার সালাত চুরি করে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে কিভাবে সালাত চুরি করে? তিনি বললেন, সে সালাতে রুকূ ও সিজদা পূর্ণ করে না’।[10]
রাসূল (ﷺ)-এর ভাষায় বড় চোর হচ্ছে যারা সালাতের মধ্যে চুরি করে। পার্থিব জীবনে মানুষ মানুষের ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা চুরি করে, এটাকে সামান্য চুরি বলা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের মহামূল্যবান সম্পদ, জান্নাতে যাওয়ার পুঁজি, কত ইবাদতের মাঝে শ্রেষ্ঠ ইবাদত চুরি করে সেই প্রকৃতপক্ষে বড় চোর।
বস্ত্ততঃ রুকূ-সিজদা যথাযথভাবে না করলে সালাতই হয় না। রাসূল (ﷺ) বলেন,
الصَّلاَةُ ثَلاَثَةُ أَثْلاَثٍ الطُّهُوْرُ ثُلُثٌ وَالرُّكُوْعُ ثُلُثٌ وَالسُّجُوْدُ ثُلُثٌ فَمَنْ أَدَّهَا بِحَقِّهَا قُبِلَتْ مِنْهُ وَقُبِلَ مِنْهُ سَائِرُ عَمَلِهِ وَمَنْ رُدَّتْ عَلَيْهِ صَلاَتُهُ رُدَّ عَلَيْهِ سَائِرُ عَمَلِهِ-
‘সালাতের ছওয়াব তিনভাগে বিভক্ত। এক-তৃতীয়াংশ পবিত্রতা, এক-তৃতীয়াংশ রুকূ ও এক-তৃতীয়াংশ সিজদায়। যে এইগুলি পূর্ণ আদায় করল তার সালাত কবুল হ’ল এবং তার সমস্ত আমলও কবুল হ’ল। আর যার সালাত কবুল করা হবে না, তার কোন আমলই কবুল হবে না’।[11]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لاَ يَنْظُرُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى صَلاَةِ عَبْدٍ لاَ يُقِيمُ فِيْهَا صُلْبَهُ بَيْنَ رُكُوْعِهَا وَسُجُوْدِهَا.
‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ বান্দার সালাতের প্রতি দৃষ্টি দেন না, যে সালাতে রুকূ ও সিজদায় পিঠ সোজা করে না’।[12] অন্য হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
إنَّ الرَّجُلَ لَيُصَلِّي سِتِّينَ سَنَةً مَا تُقْبَلُ لَهُ صَلاَةٌ، لَعَلَّهُ يُتِمُّ الرُّكُوعَ، وَلاَ يُتِمُّ السُّجُودَ، وَيُتِمُّ السُّجُودَ، وَلاَ يُتِمُّ الرُّكُوعَ.
‘নিশ্চয়ই কোন মছুল্লী ৬০ বছর যাবৎ সালাত আদায় করছে, কিন্তু তার সালাত কবুল হচ্ছে না। হয়ত সে পূর্ণভাবে রুকূ করে কিন্তু সিজদা পূর্ণভাবে করে না। অথবা পূর্ণভাবে সিজদা করে কিন্তু পূর্ণভাবে রুকূ করে না’।[13]
অন্য বর্ণনায় আছে আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لاَ تُجْزِئُ صَلاَةُ الرَّجُلِ حَتَّى يُقِيْمَ ظَهْرَهُ فِى الرُّكُوْعِ وَالسُّجُوْدِ.
‘মুছল্লীর সালাত ততক্ষণ পর্যন্ত যথেষ্ট হবে না যতক্ষণ সে রুকূ ও সিজদায় তার পীঠ সোজা না করবে।[14]
তৃতীয়তঃ যারা লোক দেখানো সালাত আদায় করে। মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِيْنَ هُمْ يُرَاءُوْنَ
‘যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে’ (মাঊন ১০৭/৬)। এটা হচ্ছে মুনাফিকদের সালাত। যেমন মহান আল্লাহ অপর আয়াতে বলেছেন,
إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَاءُوْنَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلَّا قَلِيْلًا-
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। যখন ওরা সালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।
ইমাম সুয়ূতী বলেন, মুনাফিকদের ধোঁকা হ’ল লোক দেখানো সালাত আদায় করা। এভাবে তারা যেন আল্লাহকে ধোঁকা দেয় যে, তারা সালাত আদায় করে থাকে। অথচ আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। আর আল্লাহ তাদের ধোঁকায় ফেলেন অর্থ ওদের লোক দেখানো সালাত জানা সত্ত্বেও তিনি তাদের দুনিয়াতে জান-মালের নিরাপত্তা দান করেন। অথচ আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান নির্ধারণ করেন (নিসা ৪/১৪৫)।[15]
উক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এ নির্বোধ মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলার সাথে প্রতারণা করছে। অথচ তিনি তাদের অন্তরের সমস্ত কথা সম্যক অবগত রয়েছেন। তাদের স্বল্প বুদ্ধির কারণে এ মুনাফিকরা মনে করে নিয়েছে যে, তাদের কপটতা যেমন দুনিয়াতে চলছে তদ্রূপ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সমীপেও চলবে। আসলে কিয়ামতের দিন তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা মুসলমানদের আলোর উপর নির্ভর করে থাকতে চাইবে। কিন্তু তাওহীদবাদী খাঁটি মুসলিমগণ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তখন মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে ডেকে বলবে, তোমরা থাম, আমরা তোমাদের আলোর সাহায্য চাই। মুসলমানরা তখন উত্তর দিবে, তোমরা পিছনে ফিরে যাও এবং আলো অনুসন্ধান কর। তখন তারা পিছনে ফিরবে। এমন সময় তাদের মধ্যে পর্দা পড়ে যাবে। আফসোস! মুসলমানদের মাঝে থাকবে আল্লাহর পক্ষ হ’তে করুণা ও দয়া। আর মুনাফিকদের জন্য থাকবে দুঃখ-বেদনা।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মুনাফিকদের উপর সবচেয়ে ভারী সালাত হচ্ছে এশা ও ফজরের সালাত। যদি তারা এই সালাতের ফযীলতের কথা জানত, তবে হাঁটুতে ভর দিয়ে হ’লেও এ সালাতে হাযির হ’ত। কাজেই আমি তখন ইচ্ছা করি যে, তাকবীর দিয়ে কাউকে ইমামতির স্থানে দাঁড় করতঃ সালাত আরম্ভ করিয়ে দেই, অতঃপর আমি লোকদেরকে বলি যে, তারা যেন জ্বালানী কাঠ নিয়ে এসে ঐ লোকদের বাড়ীর চতুর্দিকে রেখে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। যারা জামা‘আতে হাযির হয় না’।[16]
মূলতঃ লোক দেখানো কোন আমল আল্লাহ কবুল করেন না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللهُ بِهِ
‘যে ব্যক্তি লোককে শুনানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তাকে দিয়েই তা শুনিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তার মাধ্যমে তা দেখিয়ে দেন’।[17] অর্থাৎ আল্লাহ তাকে লজ্জিত করেন এবং স্পষ্ট করে
দেন যে, সে আদৌ মোখলেছ নয়। বস্ত্ততঃ পূর্ণ আল্লাহভীতি এবং খুশূ-খুযূ ও একাগ্রতা ব্যতীত সালাত কবুল হয় না। আর লোক দেখানো আমলকারীকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[18]
পরিশেষে বলব, সঠিক সময়ে খালেছ অন্তরে রাসূল (ﷺ)-এর তরীকায় তথা সহীহ হাদীস মোতাবেক সালাত আদায় করতে হবে। অন্যথা সালাত আদায় করেও জাহান্নামী হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে সালাত আদায়ের তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, পৃঃ ৫০১।
[2]. কুরতুবী হা/৬৪৮৩; বাযযার, ত্বাবারী, বায়হাক্বী। তবে বায়হাক্বী সা‘দ থেকে ‘মওকূফ’ সূত্রে বর্ণনা করার পর সেটাকেই ‘সঠিক’ বলেছেন (২/২১৪-১৫)। হায়ছামী একে ‘হাসান’ বলেছেন (১/৩২৫)।
[3]. মুসলিম হা/৬২২; মিশকাত হা/৫৯৩।
[4]. বুখারী হা/৫২৭, ই.ফা.বা. হা/২১৮, পৃঃ ৫০২; মুসলিম হা/৮৫।
[5]. আবুদাঊদ হা/৪২৬; তিরমিযী হা/১৭০; মিশকাত হা/৬০৭, সনদ সহীহ।
[6]. মুসলিম হা/৬৪৮; ই.ফা. বা. হা/১৩৩৮; মিশকাত হা/৬০০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৫৫২, ২/১৭৭।
[7]. আবু দাঊদ হা/১২০৩; সনদ সহীহ; নাসাঈ হা/৬৬৬; সহীহাহ হা/৪১; মিশকাত হা/৬৬৫, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬১৪, ২/২০২ পৃঃ।
[8]. বুখারী হা/৬৩১; মিশকাত হা/৬৮৩।
[9]. বুখারী হা/৭৫৭; তিরমিযী হা/৩০৩; নাসাঈ হা/৮৮৪; মিশকাত হা/৭৯০ ‘সালাতের বিবারণ’ অধ্যায়।
[10]. মুসনাদে আহামাদ হা/২২৬৯৫; সহীহুল জামে‘ হা/৯৮৬; মিশকাত হা/৮৮৫।
[11]. সিলসিলা সহীহাহ হা/৬৪৩; সহীহ আত-তারগীব হা/৫৩৯।
[12]. আহমাদ হা/১৬৩২৬; সহীহাহ হা/২৫৩৬; মিশকাত হা/৯০৪।
[13]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৯৬৩; সহীহ আত-তারগীব হা/৫২৯; সহীহাহ হা/২৫৩৫, সনদ হাসান।
[14]. আবুদাঊদ হা/৮৫৫, ১/১২৪; মিশকাত হা/৮৭৮; সহীহ তারগীব হা/৫২৮, তাবরানী কাবীর হা/৩৭৪৮।
[15]. তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, পৃঃ ৫০৩।
[16]. মুসলিম হা/৬৫১।
[17]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬ ‘শুনানো ও দেখানো’ অনুচ্ছেদ।
[18]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত ২০৫।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: