Md Rahul Khan
Active member
- Joined
- Apr 13, 2024
- Threads
- 13
- Comments
- 37
- Reactions
- 176
- Thread Author
- #1
‘তাশবীহ’ শব্দটি একটি মুজমাল তথা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যেয় শব্দ। যা ব্যাখ্যার দাবী রাখে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ একাধিক স্থানে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাশবীহ’ শব্দটি মুজমাল বা সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাখ্যার দাবী রাখে এমন শব্দ। দেখুন, ইবন তাইমিয়্যাহ, বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়্যাহ ১/১০৯, ৩৮৯; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৫/৩৬৪।
আর যেহেতু এ শব্দটিতে ইজমাল (সংক্ষিপ্ততা) ও ইশতিারক (বহুমুখী অর্থের সমাহার) রয়েছে, ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ যখন ‘আল-আকীদাতুল ওয়াসেত্বিয়্যাহ’ রচনা করেছিলেন তখন এ শব্দটিকে পরিহার করেন। তিনি কুরআন, সুন্নায় ও সালাফে সালেহীনের ভাষ্যে আসা শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন ‘তামসীল’ ও ‘তাকয়ীফ’ ব্যতীত। দেখুন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৯৫, হিকায়াতু মুনাযারাতুল ওয়াসিত্বিয়্যাহ।
তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর সিফাতের ব্যাপারে যা তাঁর থেকে না করতে হবে সেটা বর্ণনার সময় ‘তামসীল’ শব্দটি ব্যবহার করেছি, ‘তাশবীহ’ শব্দটি ব্যবহার করিনি; কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবের সরাসরি শব্দ দিয়ে ‘তামসীল’কেই না করেছেন, যখন তিনি বলেন, ﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١] “তাঁর মত কোনো কিছু নাই”। [সূরা আশ-শূরা: ১১] আরও বলেছেন, ﴿هَلۡ تَعۡلَمُ لَهُۥ سَمِيّٗا ٦٥ ﴾ [مريم: ٦٥] “তুমি কি তার সমনামের কাউকে জান?”। [সূরা মারইয়াম: ৬৫] আর এটি আমার নিকট সেসব শব্দ থেকে বেশি প্রিয় যা আল্লাহর কিতাবে নেই, আর যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামে সুন্নাতে নেই, যদিও কখনও কখনও সে শব্দ (তাশবীহ) দ্বারা ‘না’ করা দ্বারা বিশুদ্ধ অর্থ উদ্দেশ্য হতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা বাতিল অর্থও উদ্দেশ্য নেয়া যায়। মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৬৬।
সালাফে সালেহীনের অনেকেই সেসব মুশাব্বিহাদের নিন্দা করেছেন যারা আল্লাহর গুণাবলীকে বান্দার গুণাবলীর মত মনে করতো। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আব্দুর রহমান ইবন মাহদী, ইয়াযীদ ইবন হারূন আল-ওয়াসেত্বী, আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক্ব ইবন রাহওয়িয়াহ প্রমুখ। [ইবন তাইমিয়্যাহ, বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়্যাহ ১/১৮৭]
যারা ‘তাশবীহ’ শব্দটি নিঃশর্তভাবে সাব্যস্ত কিংবা অসাব্যস্ত করেছেন তাদের ব্যাপারে বিশুদ্ধ ও তাহকীকী কথা হচ্ছে, যদি এ ‘তাশবীহ’ শব্দটি দিয়ে যা কুরআন নিষেধ করেছে, আর বিবেক যার ওপর প্রমাণবহ এমন কিছু উদ্দেশ্য হয় তবে তা হক্ক ও যথাযথ; কারণ মহান রবের বৈশিষ্ট্যের কোনো কিছু দিয়ে সৃষ্টির কাউকে গুণান্বিত করা যাবে না, আর মহান আল্লাহর কোনো গুণাবলীতে তাঁর সৃষ্টির সামান্যতম সমতা থাকতে পারে না।
আর যদি ‘তাশবীহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য এটা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোনো সিফাত সাব্যস্ত করা যাবে না। যেমন বলা হবে না যে তাঁর ইলম রয়েছে, তার কুদরত রয়েছে, তার জীবন রয়েছে; কারণ বান্দা তো এসব গুণে গুণান্বিত, এরকম বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে তো আল্লাহকে জীবিত, জ্ঞানী ও ক্ষমতাবানও বলা যাবে না; কারণ বান্দাকেও কখনও কখনও এ সব নামে নামকরণ করা হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে তাঁর কথা, শোনা, দেখা ও তাকে দেখা ইত্যাদির ব্যাপারেও একই কথা বলা যাবে। তারা (কালাম শাস্ত্রবিদ আশায়েরা ও মাতুরিদীরা) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে একমত হয়ে বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা (মাওজূদ) অস্তিত্ববান, তিনি (হাইয়্যুন) জীবিত, তিনি (আলীমুন) জ্ঞানী, তিনি (কাদেরুন) সক্ষম। অপর দিকে সৃষ্টিকেও বলা হয়, অস্তিত্বশীল, জীবিত, জ্ঞানী, সক্ষম। অথচ বলা হয় না যে এটা তো ‘তাশবীহ’, যা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হবে না, না করা ফরয। আর এটি এমন এক বিষয় যার ওপর কুরআন, সুন্নাহ ও স্পষ্ট বিবেকের যুক্তি সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষেও সেটার বিরোধিতা করা সম্ভব নয়; কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজেকে এমনসব নাম দিয়ে নামকরণ করেছেন, যার অনুরুপ নাম দিয়ে তিনি তাঁর কোনো কোনো বান্দারও নামকরণ করেছেন।
তেমনিভাবে তিনি তাঁর গুণাবলীর জন্য এমনসব বিশেষ্য ব্যবহার করেছেন যেগুলোর কোনো কোনোটি দিয়ে তাঁর সৃষ্টির কারও গুণ বর্ণনা করেছেন। এ নামকৃত সত্তা কখনও সে নামকৃত সত্তার মত নয়। [মিনহাজুস সুন্নাহ ২/১১২]
এখানে ইমাম আশ‘আরী রাহিমাহুল্লাহ যে কথাটি বলেছেন যে, ‘তিনি কোনো কিছুর সাথে তাশবীহ রাখেন না’। এর মাধ্যমে ভিন্ন একটি নিষিদ্ধ অর্থ নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সেটি বলা যাবে না; যার মাধ্যমে আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী অস্বীকার করার সম্ভাবনা আসতে পারে। যেমনটি ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ জাহমিয়্যাহদের সাথে মুনাযারার সময় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদেরকে বললাম, তিনি (আল্লাহ) কি শাই’ (কিছু)? তখন তারা বললো, তিনি (শাইয়ুন লা কাল আশইয়ায়ি) শাই’ তবে অন্যসব শাই’ এর মত নয় (কিছু তবে অন্যকিছুর মত নয়)। তখন আমরা বললাম, যে শাই’ কোনো শাই’ এর মত নয় বিবেকবানরা জানে যে সেটা আসলে কিছুই না। তখন মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় গেল যে, জাহমিয়ারা আসলে কোনো কিছুর ওপরই ঈমান আনে না। তবে তারা প্রকাশ্যে সেটা ঘোষণা না দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করে।’ আর-রাদ্দু আলায যানাদিকাহ ওয়াল জাহমিয়্যাহ পৃ. ২০৯।
এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম আহমাদ বলেছেন, যে শাই’ কোনো শাই’ এর মত নয় বিবেকবানরা জানে যে সেটা আসলে কিছুই না।’ অথচ আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য শাই’ দিয়ে সংবাদ দেয়া সাব্যস্ত করেছেন। [যেমন সূরা আল-আন‘আম: ১৯] সেখানেও মু‘আত্তিলা সম্প্রদায় আল্লাহকে শাই’ বলতে রাযী নয়। আশা‘য়েরা ও মাতুরিদিয়্যাহ সম্প্রদায় যদি আল্লাহকে ‘লা ইয়ুশবিহুল আশইয়া’ বলে, (যা শরী‘আতে কখনও সাব্যস্ত কিংবা নিষেধ করা হয়নি) তাহলে তো তারা এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করার অশুভ পঁয়তারা করেই তা ব্যবহার করলো।
তবে সম্ভবত ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী রাহিমাহুল্লাহ সে উদ্দেশ্যে কথাটি ব্যবহার করেননি, কারণ তিনি সিফাত সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু তার অনুসারী কেউ এ শব্দ নিয়ে অযথা তর্ক করতে পারে তাই ‘তাশবীহ’ শব্দটির ব্যাপারে সালাফে সালেহীনের অবস্থান জানিয়ে দেয়া হলো।
তাশবীহ বা সাদৃশ্য অস্বীকারকারী সম্প্রদায় আল্লাহ তা‘আলার জন্য যারাই কোনো নাম বা গুণ সাব্যস্ত করে তাদেরকেই ‘মুশাব্বিহা’ নামে অভিহিত করে। ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, জাহম ইবন সাফওয়ান মনে করেছে, যে কেউ আল্লাহ তা‘আলাকে সেসব গুণে গুণান্বিত করে যা দিয়ে তিনি নিজেকে তার কিতাবে গুণান্বিত করেছেন, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেগুলো দিয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন, সে কাফের হয়ে যাবে, আর সে মুশাব্বিহা হয়ে যাবে।! দেখুন, ইমাম আহমাদ, আর-রাদ্দু আলায যানাদিকাতি ওয়াল জাহমিয়্যাহ পৃ. ২০৬।
অনুরূপভাবে ‘জাহম’ ইবন সাফওয়ানের পরে যত সিফাত অস্বীকারকারী এসেছে সকলেই এ কাজটি করেছে। যারা আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্ত করেছে তাদেরকেই তারা ‘মুশাব্বিহা’ বা দেহবাদী বলেছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত সিফাত অস্বীকারকারীদের একটি চিহ্নে পরিণত হয়েছে তারা এর মাধ্যমে পরিচিতি পেতে থাকে। এজন্য ইমাম ইসহাক্ব ইবন রাহওয়িয়াহ বলেন, ‘জাহম ও তার অনুসারীদেরে আলামত হচ্ছে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের তাদের মিথ্যাচার করে বলে, এরা মুশাব্বিহা।
যারা এভাবে আহুলুস সুন্নাহকে মুশাব্বিহা বলত, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন, আবুল মা‘আলী আল-জুওয়াইনী। তিনি বলেন, ‘জেনে রাখ, হক মতবাদ হচ্ছে, মহান রব্ব সুবহানাহু যে কোনো হাইয়্যেয বা স্থানে হওয়া থেকে পবিত্র, অনুরূপ কোনো দিক দ্বারা বিশেষিত হওয়া থেকে পবিত্র। আর যারা মুশাব্বিহা তারা বলে, নিশ্চয় মহান আল্লাহ তা‘আলা উপরের দিক দ্বারা বিশেষিত।’ আশ-শামিল পৃ. ৫১১। এখানে তিনি হক মতবাদ বলে আশআরীদের বুঝিয়েছেন।
অনুরূপ কাজটি শাহরাস্তানীও করেছে। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী একটি গোষ্ঠী সালাফে সালেহীন যা বলেছে তার উপর বাড়তি করেছে, তারা বলেছে, এসব আয়াত ও হাদীসকে তার প্রকাশ্য অর্থে নিতে হবে, এভাবে তারা কেবল তাশবীহ বা সাদৃশ্য প্রদানেই নিপতিত হয়েছে। যা সালাফদের বিশ্বাসের বিপরীত।’ আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১/১৪৬।
বরং কোনো কোনো কালাম শাস্ত্রবিদ হাম্বলীদের দিকে তাশবীহ এর দোষ যুক্ত করতো; কারণ ফিকহী মাযহাবের অনুসারীদের মাঝে তারাই অধিক পরিমাণে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্তকরণে বিখ্যাত ছিল। ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ যারা এ ব্যাপারে তার সাথে বিতর্ক করে বলেছিল, ‘আহমাদ এর দিকে বেশ কিছু হাশাওয়িয়্যাহ (অক্ষরবাদী) ও মুশাব্বিহা গোষ্ঠী নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে’, একথার জবাবে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ তিনি তাদের দাবী খণ্ডন করে বলেছিলেন, ইমাম আহমাদের সাথীদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে মুশাব্বিহা ও মুজাসসিমাদের সংখ্যা অনেক বেশি। এই যে কুর্দীরা তারা সবাই শাফে‘ঈ মাযহাবভুক্ত, তাদের মধ্যে যত তাশবীহ আর তাজসীম পাওয়া যায় তা অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে পাওয়া যায় না। জীলানের অধিবাসীরা তাদের মধ্যে শাফে‘ঈ ও হাম্বলী। একান্ত হাম্বলী যারা তাদের মাঝে এসব কিছু নেই যা অন্যদের মধ্যে আছে। এই যে কাররামিয়্যাহ মুজাসসিমাহ, এরা সবাই হানাফী’। মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৯৭; হিকায়াতু মুনাযারাতিল ওয়াসেত্বয়্যিাহ।
ইবন আবিল ইয্য আল-হানাফী রাহিমাহুল্লাহ ইমাম ইসহাক্ব ইবন রাহওয়িয়াহর পূর্বোক্ত বক্তব্য বর্ণনার পরে বলেন, ‘অনুরূপভাবে সালাফগণের অনেক ইমাম বলেছেন, জাহমিয়্যাহদের আলামত হচ্ছে তারা আহলুস সুন্নাহকে মুশাব্বিহা (সাদৃশ্যবাদী) বলে, কারণ আল্লাহর নাম ও গুণ অস্বীকারকারী প্রতিটি সম্প্রদায় যারা নাম ও গুণ সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাব্বিহা বলতো। এজন্য সিফাত অস্বীকারকারী জাহমিয়্যাহ, মু‘তাযিলা, রাফেযী প্রমুখ লোকদের কিতাবসমূহ যারা আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাব্বিহা ও মুজাসসিমা নামক অপবাদে ভরপুর।’ ইবন আবিল ইয্য আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত ত্বাহাওয়িয়্যাহ ১/১৭৯।
ডা আবু বকর মুহাম্মদ জাকারিয়া হাফি.
আর যেহেতু এ শব্দটিতে ইজমাল (সংক্ষিপ্ততা) ও ইশতিারক (বহুমুখী অর্থের সমাহার) রয়েছে, ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ যখন ‘আল-আকীদাতুল ওয়াসেত্বিয়্যাহ’ রচনা করেছিলেন তখন এ শব্দটিকে পরিহার করেন। তিনি কুরআন, সুন্নায় ও সালাফে সালেহীনের ভাষ্যে আসা শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন ‘তামসীল’ ও ‘তাকয়ীফ’ ব্যতীত। দেখুন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৯৫, হিকায়াতু মুনাযারাতুল ওয়াসিত্বিয়্যাহ।
তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর সিফাতের ব্যাপারে যা তাঁর থেকে না করতে হবে সেটা বর্ণনার সময় ‘তামসীল’ শব্দটি ব্যবহার করেছি, ‘তাশবীহ’ শব্দটি ব্যবহার করিনি; কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবের সরাসরি শব্দ দিয়ে ‘তামসীল’কেই না করেছেন, যখন তিনি বলেন, ﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١] “তাঁর মত কোনো কিছু নাই”। [সূরা আশ-শূরা: ১১] আরও বলেছেন, ﴿هَلۡ تَعۡلَمُ لَهُۥ سَمِيّٗا ٦٥ ﴾ [مريم: ٦٥] “তুমি কি তার সমনামের কাউকে জান?”। [সূরা মারইয়াম: ৬৫] আর এটি আমার নিকট সেসব শব্দ থেকে বেশি প্রিয় যা আল্লাহর কিতাবে নেই, আর যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামে সুন্নাতে নেই, যদিও কখনও কখনও সে শব্দ (তাশবীহ) দ্বারা ‘না’ করা দ্বারা বিশুদ্ধ অর্থ উদ্দেশ্য হতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা বাতিল অর্থও উদ্দেশ্য নেয়া যায়। মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৬৬।
সালাফে সালেহীনের অনেকেই সেসব মুশাব্বিহাদের নিন্দা করেছেন যারা আল্লাহর গুণাবলীকে বান্দার গুণাবলীর মত মনে করতো। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আব্দুর রহমান ইবন মাহদী, ইয়াযীদ ইবন হারূন আল-ওয়াসেত্বী, আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক্ব ইবন রাহওয়িয়াহ প্রমুখ। [ইবন তাইমিয়্যাহ, বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়্যাহ ১/১৮৭]
যারা ‘তাশবীহ’ শব্দটি নিঃশর্তভাবে সাব্যস্ত কিংবা অসাব্যস্ত করেছেন তাদের ব্যাপারে বিশুদ্ধ ও তাহকীকী কথা হচ্ছে, যদি এ ‘তাশবীহ’ শব্দটি দিয়ে যা কুরআন নিষেধ করেছে, আর বিবেক যার ওপর প্রমাণবহ এমন কিছু উদ্দেশ্য হয় তবে তা হক্ক ও যথাযথ; কারণ মহান রবের বৈশিষ্ট্যের কোনো কিছু দিয়ে সৃষ্টির কাউকে গুণান্বিত করা যাবে না, আর মহান আল্লাহর কোনো গুণাবলীতে তাঁর সৃষ্টির সামান্যতম সমতা থাকতে পারে না।
আর যদি ‘তাশবীহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য এটা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোনো সিফাত সাব্যস্ত করা যাবে না। যেমন বলা হবে না যে তাঁর ইলম রয়েছে, তার কুদরত রয়েছে, তার জীবন রয়েছে; কারণ বান্দা তো এসব গুণে গুণান্বিত, এরকম বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে তো আল্লাহকে জীবিত, জ্ঞানী ও ক্ষমতাবানও বলা যাবে না; কারণ বান্দাকেও কখনও কখনও এ সব নামে নামকরণ করা হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে তাঁর কথা, শোনা, দেখা ও তাকে দেখা ইত্যাদির ব্যাপারেও একই কথা বলা যাবে। তারা (কালাম শাস্ত্রবিদ আশায়েরা ও মাতুরিদীরা) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে একমত হয়ে বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা (মাওজূদ) অস্তিত্ববান, তিনি (হাইয়্যুন) জীবিত, তিনি (আলীমুন) জ্ঞানী, তিনি (কাদেরুন) সক্ষম। অপর দিকে সৃষ্টিকেও বলা হয়, অস্তিত্বশীল, জীবিত, জ্ঞানী, সক্ষম। অথচ বলা হয় না যে এটা তো ‘তাশবীহ’, যা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হবে না, না করা ফরয। আর এটি এমন এক বিষয় যার ওপর কুরআন, সুন্নাহ ও স্পষ্ট বিবেকের যুক্তি সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষেও সেটার বিরোধিতা করা সম্ভব নয়; কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজেকে এমনসব নাম দিয়ে নামকরণ করেছেন, যার অনুরুপ নাম দিয়ে তিনি তাঁর কোনো কোনো বান্দারও নামকরণ করেছেন।
তেমনিভাবে তিনি তাঁর গুণাবলীর জন্য এমনসব বিশেষ্য ব্যবহার করেছেন যেগুলোর কোনো কোনোটি দিয়ে তাঁর সৃষ্টির কারও গুণ বর্ণনা করেছেন। এ নামকৃত সত্তা কখনও সে নামকৃত সত্তার মত নয়। [মিনহাজুস সুন্নাহ ২/১১২]
এখানে ইমাম আশ‘আরী রাহিমাহুল্লাহ যে কথাটি বলেছেন যে, ‘তিনি কোনো কিছুর সাথে তাশবীহ রাখেন না’। এর মাধ্যমে ভিন্ন একটি নিষিদ্ধ অর্থ নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সেটি বলা যাবে না; যার মাধ্যমে আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী অস্বীকার করার সম্ভাবনা আসতে পারে। যেমনটি ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ জাহমিয়্যাহদের সাথে মুনাযারার সময় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদেরকে বললাম, তিনি (আল্লাহ) কি শাই’ (কিছু)? তখন তারা বললো, তিনি (শাইয়ুন লা কাল আশইয়ায়ি) শাই’ তবে অন্যসব শাই’ এর মত নয় (কিছু তবে অন্যকিছুর মত নয়)। তখন আমরা বললাম, যে শাই’ কোনো শাই’ এর মত নয় বিবেকবানরা জানে যে সেটা আসলে কিছুই না। তখন মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় গেল যে, জাহমিয়ারা আসলে কোনো কিছুর ওপরই ঈমান আনে না। তবে তারা প্রকাশ্যে সেটা ঘোষণা না দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করে।’ আর-রাদ্দু আলায যানাদিকাহ ওয়াল জাহমিয়্যাহ পৃ. ২০৯।
এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম আহমাদ বলেছেন, যে শাই’ কোনো শাই’ এর মত নয় বিবেকবানরা জানে যে সেটা আসলে কিছুই না।’ অথচ আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য শাই’ দিয়ে সংবাদ দেয়া সাব্যস্ত করেছেন। [যেমন সূরা আল-আন‘আম: ১৯] সেখানেও মু‘আত্তিলা সম্প্রদায় আল্লাহকে শাই’ বলতে রাযী নয়। আশা‘য়েরা ও মাতুরিদিয়্যাহ সম্প্রদায় যদি আল্লাহকে ‘লা ইয়ুশবিহুল আশইয়া’ বলে, (যা শরী‘আতে কখনও সাব্যস্ত কিংবা নিষেধ করা হয়নি) তাহলে তো তারা এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করার অশুভ পঁয়তারা করেই তা ব্যবহার করলো।
তবে সম্ভবত ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী রাহিমাহুল্লাহ সে উদ্দেশ্যে কথাটি ব্যবহার করেননি, কারণ তিনি সিফাত সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু তার অনুসারী কেউ এ শব্দ নিয়ে অযথা তর্ক করতে পারে তাই ‘তাশবীহ’ শব্দটির ব্যাপারে সালাফে সালেহীনের অবস্থান জানিয়ে দেয়া হলো।
তাশবীহ বা সাদৃশ্য অস্বীকারকারী সম্প্রদায় আল্লাহ তা‘আলার জন্য যারাই কোনো নাম বা গুণ সাব্যস্ত করে তাদেরকেই ‘মুশাব্বিহা’ নামে অভিহিত করে। ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, জাহম ইবন সাফওয়ান মনে করেছে, যে কেউ আল্লাহ তা‘আলাকে সেসব গুণে গুণান্বিত করে যা দিয়ে তিনি নিজেকে তার কিতাবে গুণান্বিত করেছেন, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেগুলো দিয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন, সে কাফের হয়ে যাবে, আর সে মুশাব্বিহা হয়ে যাবে।! দেখুন, ইমাম আহমাদ, আর-রাদ্দু আলায যানাদিকাতি ওয়াল জাহমিয়্যাহ পৃ. ২০৬।
অনুরূপভাবে ‘জাহম’ ইবন সাফওয়ানের পরে যত সিফাত অস্বীকারকারী এসেছে সকলেই এ কাজটি করেছে। যারা আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্ত করেছে তাদেরকেই তারা ‘মুশাব্বিহা’ বা দেহবাদী বলেছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত সিফাত অস্বীকারকারীদের একটি চিহ্নে পরিণত হয়েছে তারা এর মাধ্যমে পরিচিতি পেতে থাকে। এজন্য ইমাম ইসহাক্ব ইবন রাহওয়িয়াহ বলেন, ‘জাহম ও তার অনুসারীদেরে আলামত হচ্ছে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের তাদের মিথ্যাচার করে বলে, এরা মুশাব্বিহা।
যারা এভাবে আহুলুস সুন্নাহকে মুশাব্বিহা বলত, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন, আবুল মা‘আলী আল-জুওয়াইনী। তিনি বলেন, ‘জেনে রাখ, হক মতবাদ হচ্ছে, মহান রব্ব সুবহানাহু যে কোনো হাইয়্যেয বা স্থানে হওয়া থেকে পবিত্র, অনুরূপ কোনো দিক দ্বারা বিশেষিত হওয়া থেকে পবিত্র। আর যারা মুশাব্বিহা তারা বলে, নিশ্চয় মহান আল্লাহ তা‘আলা উপরের দিক দ্বারা বিশেষিত।’ আশ-শামিল পৃ. ৫১১। এখানে তিনি হক মতবাদ বলে আশআরীদের বুঝিয়েছেন।
অনুরূপ কাজটি শাহরাস্তানীও করেছে। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী একটি গোষ্ঠী সালাফে সালেহীন যা বলেছে তার উপর বাড়তি করেছে, তারা বলেছে, এসব আয়াত ও হাদীসকে তার প্রকাশ্য অর্থে নিতে হবে, এভাবে তারা কেবল তাশবীহ বা সাদৃশ্য প্রদানেই নিপতিত হয়েছে। যা সালাফদের বিশ্বাসের বিপরীত।’ আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১/১৪৬।
বরং কোনো কোনো কালাম শাস্ত্রবিদ হাম্বলীদের দিকে তাশবীহ এর দোষ যুক্ত করতো; কারণ ফিকহী মাযহাবের অনুসারীদের মাঝে তারাই অধিক পরিমাণে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্তকরণে বিখ্যাত ছিল। ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ যারা এ ব্যাপারে তার সাথে বিতর্ক করে বলেছিল, ‘আহমাদ এর দিকে বেশ কিছু হাশাওয়িয়্যাহ (অক্ষরবাদী) ও মুশাব্বিহা গোষ্ঠী নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে’, একথার জবাবে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ তিনি তাদের দাবী খণ্ডন করে বলেছিলেন, ইমাম আহমাদের সাথীদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে মুশাব্বিহা ও মুজাসসিমাদের সংখ্যা অনেক বেশি। এই যে কুর্দীরা তারা সবাই শাফে‘ঈ মাযহাবভুক্ত, তাদের মধ্যে যত তাশবীহ আর তাজসীম পাওয়া যায় তা অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে পাওয়া যায় না। জীলানের অধিবাসীরা তাদের মধ্যে শাফে‘ঈ ও হাম্বলী। একান্ত হাম্বলী যারা তাদের মাঝে এসব কিছু নেই যা অন্যদের মধ্যে আছে। এই যে কাররামিয়্যাহ মুজাসসিমাহ, এরা সবাই হানাফী’। মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৯৭; হিকায়াতু মুনাযারাতিল ওয়াসেত্বয়্যিাহ।
ইবন আবিল ইয্য আল-হানাফী রাহিমাহুল্লাহ ইমাম ইসহাক্ব ইবন রাহওয়িয়াহর পূর্বোক্ত বক্তব্য বর্ণনার পরে বলেন, ‘অনুরূপভাবে সালাফগণের অনেক ইমাম বলেছেন, জাহমিয়্যাহদের আলামত হচ্ছে তারা আহলুস সুন্নাহকে মুশাব্বিহা (সাদৃশ্যবাদী) বলে, কারণ আল্লাহর নাম ও গুণ অস্বীকারকারী প্রতিটি সম্প্রদায় যারা নাম ও গুণ সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাব্বিহা বলতো। এজন্য সিফাত অস্বীকারকারী জাহমিয়্যাহ, মু‘তাযিলা, রাফেযী প্রমুখ লোকদের কিতাবসমূহ যারা আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাব্বিহা ও মুজাসসিমা নামক অপবাদে ভরপুর।’ ইবন আবিল ইয্য আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত ত্বাহাওয়িয়্যাহ ১/১৭৯।
ডা আবু বকর মুহাম্মদ জাকারিয়া হাফি.