[দেশের প্রখ্যাত আলেম, মাসিক ‘মদীনা’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারায় সাহিত্য রচনার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (১৯৩৫-২০১৬)। তিনি ছিলেন দেশের ইসলামী আন্দোলনের একজন সাহসী মুরববী। মাযহাবী মতভিন্নতা সত্ত্বেও ‘আহলেহাদীস আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। ২০০৫ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী তদানীন্তন চারদলীয় জোট সরকার আমীরে জামা‘আতসহ ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে অন্যায়ভাবে কারান্তরীণ করলে তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। অথচ তখন তিনি চার দলীয় জোটের শরীক ছিলেন। এমন একজন সাহসী মানুষের আত্মজীবনী হল ‘জীবনের খেলা ঘরে’। এতে মাওলানার সংগ্রামী জীবনের স্মৃতিগাথা অঙ্কিত হয়েছে। উঠে এসেছে তাঁর ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন ও সমকালীন ইতিহাসের নানা আলেখ্য। সেখান থেকে কিছু চম্বুক অংশ ‘আত-তাহরীক’-এর পাঠকবৃন্দের জন্য পত্রস্থ করা হল।- সম্পাদক]
আমাদের এই অঞ্চলে ছয় শতাধিক বছরের মুসলিম শাসনের কালটাও সবসময় নিষ্ঠাবান মুসলমানদের জন্য অনুকূল পরিবেশমন্ডিত ছিল না। একাধিকবার এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের সম্পূর্ণ উৎখাত করার অপপ্রয়াস হয়েছে। হয়েছে প্রচুর রক্তপাত। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে হযরত নূর কুতবে আলমের জেহাদ, হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদের জেহাদ আন্দোলন, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মীর নেছার আলী তিতুমীর, মাওলানা আবুবকর ছিদ্দিকী ও মুন্সী মেহেরুল্লাহ (রহঃ) প্রমুখের সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস মুসলমানদের বহু দুর্ভোগের অলিখিত বিবরণ বুকে ধারণ করে আছে। আমাদের প্রথম জীবনে যাঁদের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হয়েছি, তাঁদের মধ্যে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ এবং মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমীর জবানীতে মুসলমানদের দুর্ভোগ দুর্দিনের অনেক মর্মস্পর্শী ইতিহাস শ্রবণ করেছি। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে কিভাবে এই অধঃপতিত মুসলিম জাতির জন্য তিলে তিলে কলিজার খুন পানি করে তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন, এ সম্পর্কিত অনেক কাহিনীই মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁর জবানী থেকে শোনার সুযোগ হয়েছে।
১৯৬১-র ২রা মার্চ মঙ্গলবার অপরাহ্নে মাসিক মদীনার কয়েকটা কপি ব্যাগে পুরে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁর দরবারে হাযির হলাম। মাওলানা সাহেব বাদ আছর আজাদ অফিসের আঙ্গিনার বাগানে কুরসী পেতে বসতেন। তাঁর সামনে অর্ধ বৃত্তাকারে সাজানো থাকতো অনেকগুলি হাতলছাড়া চেয়ার। প্রতিদিনই মজলিস জমতো। মাওলানা সাহেব ছিলেন আহলেহাদীস মতাবলম্বী, তাই আছরের নামায পড়তেন মাগরিবের অন্ততঃ দু’ঘণ্টা আগে। সুতরাং মজলিস চলতো একটানা দু’ঘণ্টাতক। এ মজলিসে দেশের সেরা জ্ঞানী-গুণী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী প্রমুখ বিচিত্র ধরনের লোকজনের সমাবেশ ঘটত।
আমি যখন পৌঁছলাম, তখন মাওলানা সাহেব মাত্র বসেছেন। সামনে উল্লেখযোগ্য তেমন কেউ নাই। সালাম দেয়ার সাথে সাথেই আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। সাথে ছিলেন আমার সহপাঠী বন্ধু মরহুম মাওলানা মুজীবুর রহমান। লক্ষ্য করলাম, আমাকে দেখে মাওলানা ছাহেবের সুন্দর চেহারাটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। হাতের ছড়িটা ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা স্নেহের চুম্বন দিলেন। বললেন, আজ সকাল বেলায়ই আজাদে তোমার পত্রিকা প্রকাশ করার খবরটা পড়েছি। এমন একটা খবর পাঠ করে আমার মন আনন্দে একেবারে নেচে উঠেছে। মনে পড়ছে, আজ থেকে ষাট বছর আগে আমি যখন প্রথম কর্মক্ষেত্রে বিশেষতঃ লেখালেখির জগতে অবতরণ করেছি, তখন একদিন এক ইসলামী জালসায় সে যুগের মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুন্সী মেহেরুল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা। সে বছরই আমি মাদরাসায়ে আলীয়া কলিকাতা থেকে জামাতে উলা পাস করেছি। মুন্সী সাহেব ঠিক এভাবেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বলেছিলেন, ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত তোমাদের ন্যায় যুবকদের কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা! উল্লেখ্য যে, সে সময় মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, খুলনার (বর্তমানে সাতক্ষীরা) মাওলানা আহমদ আলী, চট্টগ্রামের মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ অনেকেই বলিষ্ঠ কলম হাতে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করেছেন। মাওলানা সাহেব আরও বললেন, আমাদের পূর্বসূরী সেই মুরুববী পুরুষের অনুসরণে আমিও তোমাকে অভিনন্দিত করছি। তবে একটা অভিযোগও আছে। আমাকে তুমি দাওয়াত করলে না কেন?
আমি বিনয়ের সাথে জবাব দিলাম, ভয়ে। আপনাকে নিয়ে কোথায় বসাবো? তিনি বললেন, কেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহীম খাঁ, কবি গোলাম মোস্তফা, খান বাহাদুর জসিমুদ্দীন প্রমুখ দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা যেখানে বসেছিলেন, সেখানে কি আমার বসার কোন অসুবিধা হতো?
এ প্রশ্নের জবাব দিলেন মাওলানা মুজীবুর রহমান। তিনি সবিস্তারে আমার পাগলামির কথা, দেওয়ান আবদুল হামীদ ও কবি জহীর বিন কুদ্দুছের আয়োজনের কথা বললেন। বিবরণ শুনে মাওলানা সাহেব হাসতে লাগলেন। এই সুযোগে আমি বিনয়ের সাথে তাঁর সামনে রক্ষিত টেবিলটায় মাসিক মদীনার একখানা কপি রাখলাম। মাওলানা সাহেব কপিটা হাতে তুলে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে নেড়েচেড়ে দেখলেন। পত্রিকার মান দেখেও সন্তোষ প্রকাশ করলেন। টুকিটাকি কিছু উপদেশ দিলেন। বললেন, শুরু তো করেছ প্রাণের টানে, ঈমানের উত্তাপ তাড়িত হয়ে, তবে কাজটা খুবই কঠিন। এই সাধনায় আমি বিগত ষাটটি বছর অতিক্রম করেছি। মুসলিম সমাজের অনুভূতি যে কোন্ স্তরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে, তা পদে পদেই অনুভব করতে পারবে। তবে যখনই কোন সংকট অনুভব কর, আমার নিকট চলে এসো। আমার আন্তরিক সহযোগিতা পাবে।
সেদিনের মজলিসে এ দেশের মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি উদ্ধারের সাধনা এবং প্রতিপক্ষের নোংরা কর্মকৌশল নিয়েই আলোচনা হ’ল। সেদিন আমার কানে যে কথাটি সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল, তা হচ্ছে, মাওলানা সাহেব বলছিলেন, আমাদের তিন পুরুষের সাধনায় বাংলার মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমরা অনেক সাধনার পরও নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, স্বতন্ত্র ভাষাশৈলী নির্মাণ করতে পারি নাই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তারপর রবী ঠাকুররা আমাদেরকে ‘যবন হরিদাসে’ রূপান্তরিত করার যে অপপ্রয়াস শুরু করেছিল, চল্লিশের দশকে তা থেকে আমরা বাহ্যত বের হয়ে আসতে সক্ষম হলেও এই ষাটের দশকে এসে আমরা পুনরায় একটা ভয়াবহ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছি। আজ এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের যে তোড়জোড় দেখতে পাচ্ছি, এসবের মধ্যে আমাদের বিগত তিন পুরুষের চেষ্টা-সাধনার শোচনীয় ব্যর্থতাই আমি প্রত্যক্ষ করছি। এক শ্রেণীর শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর মধ্যে যে হারে অপসংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ বাড়ছে, খুব শীঘ্রই এমন একটা সময় আসবে যে, আমাদের সকল অর্জন এসব অপসংস্কৃতির সয়লাবে খড়কুটার মত ভেসে যাবে বলে আমার আশঙ্কা হয়। সামনে খুব দুর্দিনের ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছি। আমরা লড়েছি অমুসলিমদের বিরুদ্ধে। তখন মুসলমান সমাজ বিদ্যাবুদ্ধি এবং অর্থবিত্তে এখনকার তুলনায় অনেক দুর্বল হলেও তাদের মধ্যে একতা ছিল। শত্রু-মিত্রের পার্থক্যবোধ এখনকার তুলনায় অনেক প্রখর ছিল। তারা জ্ঞানী-গুণীদের কথার গুরুত্ব দিতে জানতেন। কিন্তু ইদানীংকালে সে অনুভূতি যেন অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমি আত্মহননের প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি! এমন একটা যুগ সন্ধিক্ষণে তোমার মাসিক মদীনাকে আমি কোন ভাষায় খোশ আমদেদ জানাবো বুঝে পাচ্ছি না। দোয়া করি, সফলকাম হও! (পৃঃ ২৫৬-৫৮)।
উল্লেখ্য যে, এ বছর রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী খুব তোড়জোড় শুরু করেছিল। অবশ্য সচেতন মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত ওরা পিঠটান দিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে সাময়িক এই পরাজয়ে ওরা থেমে যায় নাই। বরং ওদের সাংস্কৃতিক হ্যাংলাপনা আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আর শেষ পর্যন্ত ত্রিকালদর্শী জ্ঞানবৃদ্ধ মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁর আশঙ্কাও একদিন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হতে আমরা দেখেছি।
নানা কারণে ৬৯ সালটা[1] ছিল খুবই ঘটনাবহুল। এই বছরই প্রথম মার্কিন নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করে। সারা দুনিয়াতে তখন একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একশ্রেণীর ছ্যাবলা লোক চাঁদে মানুষের পদচারণাকে ধর্ম-বিশ্বাসের উপর আঘাত করার অস্ত্ররূপে ব্যবহার করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় পন্ডিত বিষয়টা ধর্ম-বিশ্বাসের পরিপন্থী এবং কোন অবস্থাতেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করতে কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়ে। বাংলাদেশের ধর্মীয় পন্ডিত গোষ্ঠীর মধ্যে যে কত পদের মাল রয়েছে তা অনুধাবন করার কিছুটা সুযোগ আমার তখনই হয়েছিল।
বাংলা ভাষায় ইসলামী পঠনসামগ্রীর শোচনীয় দৈন্যদশা সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা ছাত্র জীবনেই হয়েছিল। বিশেষতঃ যাদের মধ্যে কোরআন-হাদীসের জ্ঞান রয়েছে, দুনিয়া এবং এর পারিপার্শ্বিকতা বিষয়ে তাদের ধারণার শোচনীয়তা আমাকে পীড়িত করতো। খুবই দ্রুত বিবর্তনশীল পৃথিবী সম্পর্কে জানবার বোঝবার চেষ্টা না করে বরং উল্টা তর্ক আমরা অনেকেই বেশ রপ্ত করেছিলাম। এমনই এক বিরক্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম মাসিক মদীনার দ্বিতীয় সংখ্যার কপি প্রেসে দেয়ার সময়। এক পড়ন্ত বেলায় একা একা বসে আছি ইংলিশ রোডের অফিসটায়। এমন সময় এলেন মুরুববী শ্রেণীর এক ভদ্রলোক। বললেন, তিনি একটি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হেড মৌলভীর চাকরী করতেন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন। মানুষ চাঁদে যেতে পারে এ কথার প্রতিবাদ করে তিনি একটা দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করেছেন। প্রবন্ধটা তিনি মাসিক মদীনায় ছাপাতে আগ্রহী এবং এখানে বসে তিনি এই দীর্ঘ প্রবন্ধ আমাকে পড়ে শোনাতে চান। আমি তাঁর লেখাটার উপর একটুখানি চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলাম, এটা ছাপার উপযুক্ত নয়। তবুও চক্ষুলজ্জার খাতিরে বললাম, এত বড় প্রবন্ধ পড়ে শোনানোর প্রয়োজন নাই, রেখে যান, অবসর মত আমি নিজেই পড়ে দেখব। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, আমাকে না শুনিয়ে ছাড়বেন না। আমার সম্মতি না নিয়েই পড়তে শুরু করলেন। আধঘণ্টাতক চোখ বুজে শুনলাম। এর মধ্যে হাজির হলেন দেওয়ান আব্দুল হামীদ এবং অধ্যাপক নূরুল হক। (শেষোক্তজন বর্তমানে লন্ডনে ব্যারিস্টারী করেন বলে শুনেছি। তখন নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে অধ্যাপনা করতেন)।
আমি চোখ মুখ বন্ধ করে শুনছিলাম। কিন্তু নূরুল হক শুনতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, হুযুর, এবার থামুন। আপনার এই লেখা মাসিক মদীনায় ছাপা হবে না। সুতরাং আর কষ্ট করবেন না। ভদ্রলোক রাগতঃস্বরে জানতে চাইলেন, কেন ছাপা হবে না শুনি? নূরুল হক বললেন, এজন্য যে, প্রথমতঃ এ পর্যন্ত যা শুনলাম, তার একটি বাক্যও শুদ্ধ হয় নাই। তাছাড়া মানুষ চাঁদে পৌঁছুতে পারে না, এটা ইসলামী বক্তব্য নয়। চাঁদ তো একটা গ্রহ মাত্র। মানুষের সেবার জন্য আল্লাহ পাক তাঁর কুল কায়েনাত সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সেই মানুষ তার কোন খাদেমের গায়ে পা রাখলে সেটা সর্বনাশের কি হলো?
ভদ্রলোক একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, অমন কথা যে বলবে বা বিশ্বাস করবে, সে নির্ঘাত কাফের হয়ে যাবে। সুতরাং আমার এ লেখা প্রকাশ করে মাসিক মদীনাকে প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা কুফুরী মতবাদ প্রচার করতে নামি নাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন হুমকি দিতে লাগলেন যে, তাঁর অনেক ছাত্র আছে। যদি এই লেখা ছাপা না হয় তবে তিনি ছাত্রদের দিয়ে এর প্রতিকার করবেন। পত্রিকা কি করে চালাই দেখে নিবেন।
এবার দেওয়ান আব্দুল হামীদ মুখ খুললেন। বললেন, জনাব! এবার আপনি আসতে পারেন। ছাত্র জুটিয়ে আসবেন। আমরা তখন এখানে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যাব। তবুও আপনার এই ‘রাবিশ’ ছাপার জন্য রাখা যাবে না।
ভদ্রলোক বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর রাগে ফুঁসছিলেন। আমি কিন্তু মোটেও ঘাবড়ালাম না। কেননা ইতিপূর্বে সাপ্তাহিক ‘নেজামে ইসলাম’ পত্রিকা এবং পরে সাপ্তাহিক ‘আজ’ সম্পাদনা করতে গিয়ে এ ধরনের অনেক পাগলের মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু এ লোকটি মনে হল বেশ সেয়ান পাগল। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ঝক্কি-ঝামেলার পর লোকটাকে বিদায় করা গেল (পৃঃ ২৫৮-৬০)।
আববার নিকট পত্রিকা প্রকাশ করার অনুমতি নিয়েছিলাম। কিন্তু তখন সম্ভবতঃ তিনি আমার এই উদ্যোগকে যুব মানসের একটা সাময়িক খেয়ালখুশী রূপেই বিবেচনা করেছিলেন। আর্থিক কোন সহযোগিতা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবে তাঁর নিকট থেকে সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ আমি যা পেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে- তাঁর প্রাণ উজাড় করা ‘মকবুল’ দোয়া। এই দোয়া আমি পেয়েছি ১৯৭৬ সালের রমযান পর্যন্ত। সেদিনই তিনি এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যেদিন পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল সেদিনই প্রথম একটি কপি ডাকযোগে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কপিটা হাতে পেয়ে তিনি যে কি খুশী হয়েছিলেন, তা বর্ণনা করার মত নয়। সে সপ্তাহেই আববা ঢাকা চলে এসেছিলেন এবং দেখা হওয়া মাত্র আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তাঁর স্বভাবসুলভ বাৎসল্যের এই আতিশয্য আমাকে রীতিমত আবেগাপ্লুত করেছিল। বুকে অনেক বেশী বল পেয়েছিলাম। কারণ শিশুকাল থেকেই আমার এমন একটা বিশ্বাস প্রবল ছিল যে, আববার কোন দোয়াই আল্লাহ পাক রদ করেন না। আমি লক্ষ্য করেছি, বিগত তিন যুগের এই চলার পথে অনেক যাতনা ভোগ করেছি। এমন আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছি, যা বলার মত নয়; কিন্তু মাসিক মদীনার অগ্রযাত্রা এসব সংকটে বাধাগ্রস্ত হয় নাই। বিগত তিন যুগে মাসিক মদীনাকে আমি কতটুকু নিষ্ঠাপূর্ণ শ্রম ও মেধা দিয়েছি জানি না, তবে মাসিক মদীনা আমাকে খ্যাতি দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর জীবন-জীবিকায়ও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। এটা ‘মদীনা’ নামের বরকত এবং আমার আববাসহ আরও জানা অজানা অসংখ্য হিতাকাঙ্ক্ষীর আন্তরিক দোয়াতেই যে সম্ভব হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না (পৃঃ ২৬১)।
কর্মজীবনের চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। বিগত অর্ধশতাব্দীকালের আমাদের সামাজিক উত্থান-পতনের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছি। অনেক প্রসিদ্ধ বুযুর্গ এবং পাশাপাশি ভেকধারী পীর-ফকীরের ক্রিয়াকর্ম কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। এখনও স্বঘোষিত বহু মোজাদ্দেদে জমানের প্রাদুর্ভাব অহরহই দেখতে পাই। এদের সাথে আমার মরহুম আববা এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধবের জীবনযাত্রা, চিন্তা-চেতনা এবং আমল-আখলাকের তুলনা করলে শুধু হতাশাই বাড়ে। মনে হয়, সিংহের খান্দান ক্রমেই যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আর তাদের পরিত্যক্ত স্থানে এসে ভীড় করছে ফেউ জাতীয় মেরুদন্ডহীন ধূর্ত কিছু ইতর প্রাণী!! বাংলার মুসলমান আজ নানামুখী বিজাতীয় আগ্রাসনের করুণ শিকার। কিন্তু এই মহাদুর্দিনে তাদের পার্শ্বে একজন মুন্সী মেহেরুল্লাহ বা নিদানপক্ষে একজন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীও নাই!!
এটা কিসের আলামত, সম্পূর্ণ ধ্বংসের, না অন্য কিছু, তা একমাত্র রাববুল আলামীনই বলতে পারেন!! (পৃঃ ২৬২)।
(২) দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন ও মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর পিতা মাওলানা আহমদ আলী (১৮৮৩-১৯৭৬ খৃঃ) সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘... সাতক্ষীরার মাওলানা আহমদ আলী (রহঃ) প্রমুখ অনেকেই কলমের জেহাদে অংশ নিয়ে জাতির জন্য বিরাট জ্ঞানভান্ডার রেখে গেছেন’ (পৃঃ ৬৫)।
(৩) ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ লাহোরে আয়োজিত উপমহাদেশের সকল অঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক মহাসমাবেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ যুগান্তকারী প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন বাংলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নেতা এ.কে. ফজলুল হক। এ উপলক্ষে লাহোরের সেই বিশাল জনসমুদ্রে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, অনেকের মতে সেটি ছিল এ.কে. ফজলুল হকের জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। এ সম্মেলনেই এ.কে. ফজলুল হককে ‘শেরে-বাংলা’ বা বাংলার বাঘ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সাথে সাথেই সমগ্র উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক দারুণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। লাহোর প্রস্তাবে প্রদত্ত শেরে বাংলার হুঙ্কার সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও আমরা সে হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই মুরুববীগণের মুখে মুখে। তখন মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সংবাদপত্র ছিল মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী। অতি উৎসাহী কর্মীদের মাধ্যমে পত্রিকা দুটিই দেশের গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত পৌঁছতে শুরু করে (পৃঃ ৭৮)।
(৪) ছাত্র জীবনে আমাদের সংগঠনটির নাম ছিল জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া। অর্থাৎ আরবী শিক্ষার ছাত্র সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আমার জানা মতে ১৯২৬ খৃষ্টাব্দে। প্রতিষ্ঠাতাগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমী, মাওলানা ওবায়দুল হক প্রমুখ অনেকেই। এঁরা সবাই ছিলেন এ জাতির এক একজন সেরা ব্যক্তিত্ব। এঁদের সকলেরই মেধা, প্রজ্ঞা এবং সাধনা জাতির প্রাণশক্তি উজ্জীবিত করেছে। মুসলিম-বাংলার সাংবাদিকতার পিতৃ-পুরুষ ছিলেন মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ (পৃঃ ১৩৭-৩৮)।
(৫) ঢাকায় তখন ছিলেন মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মুফতী দ্বীন মুহম্মদ খান, মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শী প্রমুখ বিশিষ্ট আলেম এবং সমাজ নেতৃবৃন্দ। আক্ষেপের বিষয়, সেসব মনীষীর তুল্য ব্যক্তিত্ব আমার ধারণায় বর্তমান বাংলাদেশে খুব বেশী নাই। এটাও আমাদের জন্য একটা বড় ধরনের দুর্ভাগ্য বলতে হবে (পৃঃ ১৬৬)।
(৬) ঢাকায় তখন বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরীও ছিল। এগুলির মধ্যে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শী, হাজী বশীরুদ্দীন, মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগড়ী এবং উর্দ্দু দৈনিক পাসবানের সম্পাদক জনাব সৈয়দ মোস্তফা হাসানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীগুলি ছিল স্মরণে রাখার মত।... এখন এই বিরাট ঢাকা শহরে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ বা মাওলানা আবদুল্লাহ আল কাফীর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর ন্যায় একটা লাইব্রেরী কেউ গড়ে তুলতে পারেন নি। পারেন নি মানে সেই রুচি ও গরজবোধই যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে (পৃঃ ১৬৮-৬৯)।
(৭) মাওলানা আরেফদের পরিবারটি ছিল বহু আগ থেকেই আল্লাহর দ্বীনের পথে নিবেদিতপ্রাণ।[2] বালাকোট বিপর্যয়ের পর বিহারের এনায়েত আলী-বেলায়েত আলীর নেতৃত্বে জেহাদ আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল, ঢাকার বংশাল ছিল সে আন্দোলনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান কেন্দ্র। বংশালের বড় মসজিদে সবসময়ই জেহাদ আন্দোলনের কর্মীরা মজুত থাকতেন। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা হাজী বদরুদ্দীন (রহঃ) (বট্টু হাজী) ছিলেন এতদঞ্চলের জেহাদ আন্দোলনের প্রধান প্রতিনিধি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পার্বত্যাঞ্চলের মোজাহেদ ঘাঁটিগুলিতে নিয়মিত অর্থ প্রেরণ করা হতো বংশাল থেকে। ইংরেজের দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বট্টু হাজীর কর্মীরা টাকা নিয়ে যেতেন সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত। ...সীমান্তের মোজাহেদ বাহিনীর সাথে বংশালের সম্পর্ক পঞ্চাশের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল। তখনও রমযান মাসে মোজাহেদদের প্রতিনিধিরা বংশাল বড় মসজিদে আসতেন, অবস্থান করতেন এবং কিছু অর্থ সাহায্য নিয়ে যেতেন। মাওলানা মুহম্মদ আরেফ, তাঁর ছোট ভাই হাজী মুহম্মদ আকীল (রহঃ) এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট মুরুববী এই সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন (পৃঃ ১৬৯-৭০)।
(৮) ...জমিয়তে আহলে হাদীসের সদর মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শী প্রমুখ অনেক যুগশ্রেষ্ঠ ওলামা-মাশায়েখকে। এখনও মুগ্ধ চমৎকৃত হয়ে যাই যখন ভাবি যে, ঐ সমস্ত বুযুর্গগণকে কাছে থেকে দেখা এবং তাঁদের কাছাকাছি বসা, তাদের টুকটাক খেদমত করার[3] সৌভাগ্য আমার হয়েছিল! কারণ সেসব বুযুর্গের সমপর্যায়ের কেউ এদেশে আর জন্মগ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই (পৃঃ ১৭৯-৮০)।
(৯) বর্তমান এই ইংরেজী শতাব্দির শুরুতে এদেশে খৃষ্টান মিশনারী ও হিন্দু আর্যসমাজীদের পাশাপাশি কাদিয়ানী ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটে। এদেশবাসী মুসলমানদের উপর ছিল এটা সবচাইতে বড় আঘাত। কারণ আর্যসমাজীদেরকে একজন সাধারণ মুসলমানও হিন্দু বলেই জানতো। তেমনি খৃষ্টান মিশনারীরাও তাদের নিকট চিহ্নিত ছিল।
এদের প্রচারণায় মুসলমানগণ খুব কমই কান দিত। তাই খৃষ্টান মিশনারীরা হযরত মুহম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুয়তের বিকল্প সৃষ্টি করে। যেহেতু এটা ছিল খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদীদের একটি সাজানো ষড়যন্ত্র, সে কারণে সমসাময়িক আলেম সমাজ এই ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অসংখ্য কাদিয়ানী প্রচার পুস্তিকার মোকাবেলায় মুন্সী মুহম্মদ মেহেরুল্লাহর ‘রদ্দে কাদিয়ানী’ নামের পুস্তকখানা এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে। মাওলানা রুহুল আমীন (চবিবশ পরগনা), মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শীও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।
আমরা যাঁদের দেখেছি এবং যাঁদের লেখা পড়ে দাওয়াত ও জেহাদের পথে উদ্বুদ্ধ হয়েছি এঁদের মধ্যে আমার বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা শক্তিমান লেখক ছিলেন মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমী ও জমিয়তে আহলেহাদীসের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী, মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ (পৃঃ ১৮৩)।
(১০) সাহিত্য ও সংবাদপত্রসেবীদের সাথে সম্পর্কের জের ধরেই ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে দেশে মার্শাল ‘ল’ জারী হওয়ার পরপরই ময়মনসিংহ শহরে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত সাময়িক পত্র-পত্রিকার সম্পাদক-মালিকদের একটা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব জাকির হোসেন। সভাপতিত্ব করেছিলেন সাপ্তাহিক আরাফাত সম্পাদক মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ)। ময়মনসিংহ শহরের জন্য এই সম্মেলনটি ছিল খুবই আলোড়ন সৃষ্টিকারী এবং এতে শহরের সর্বস্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ শরীক হয়েছিলেন।... ময়মনসিংহ সম্মেলন থেকেই আমরা গঠন করেছিলাম ‘ইস্ট পাকিস্তান পিরিওডিক্যালস এসোসিয়েশন’ বা পূর্ব-পাকিস্তান সাময়িকী পরিষদ। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল অবহেলিত সাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলোর মানোন্নয়ন এবং দাবী-দাওয়া আদায়। মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শীকে এই সংস্থার সভাপতি এবং কিতাব আলী তালুকদারকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছিল (পৃঃ ২১৩-১৪)।
(১১) ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের ৬ই মে শুক্রবার দিন হযরত সৈয়দ আহমদ ও মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী (রহঃ) তাঁদের বিশিষ্ট কয়েকজন মুজাহিদ নেতাসহ শহীদ হন। তখন ইংরেজ, শিখ এবং সামন্তবাদী হিন্দুরা অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই বিখ্যাত ইংরেজ আমলারা বলতে বাধ্য হয় যে, ‘জীবিত সৈয়দ আহমদের চাইতে মৃত সৈয়দ আহমদ তাদের জন্য অনেক বেশী বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশেই ওরা পাঞ্জাবের ফরমান আলী নামক জনৈক ব্যক্তির দ্বারা উর্দু ভাষায় পবিত্র কুরআনের একটি বিকৃত তফসীর লেখায়। কিন্তু জীবন বিপন্ন জেনেও তখনকার আলেম সমাজ সেই অপচেষ্টা প্রতিহত করেছিলেন। তারপর হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদের আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে যে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠেছিল, তা নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়েই সাম্রাজ্যবাদী শয়তানেরা কাদিয়ানী ধর্মমতের সৃষ্টি করে। এ নতুন ধর্মের প্রবর্তক নিজেকে নবী বলে দাবি করে জেহাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রচার করে। তার যুক্তি ছিল, প্রথম জামানায় মুসলমানদের শুধু আত্মরক্ষার লক্ষ্যেই জেহাদ ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু এ জামানায় কার বিরুদ্ধে আমরা জেহাদ করব? ইংরেজরা তো আমাদের ধর্মকর্মে বাধা দেয় না। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিটা ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু প্রিয় নবীজী (সাঃ) তো বলে গেছেন যে, ‘জেহাদ কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে’[4]-এই হাদীসের ব্যাখ্যা কি হবে? কাদিয়ানী দাজ্জালদের প্রকৃত স্বরূপ তো আমাদের পিতৃপুরুষেরা পরিষ্কারভাবে উদঘাটন করে গেছেন। কিন্তু এ যুগের প্রতিরোধ আন্দোলনের অপ্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করার উদ্দেশে যখন ওলামা-মাশায়েখগণেরও কারো কারো মুখে সেই কাদিয়ানী দাজ্জালদেরই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই, তখন দুঃখ রাখার আর জায়গা থাকে না। আমার মনে হয় যোগ্যতা ছাড়াই অনেকে শুধুমাত্র পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে ‘গদ্দিনশীন’ পীর হয়ে যান, তারা ‘গদীর’ প্রসারের লক্ষ্যেই হয়ত বা ঝুঁকিপূর্ণ কোন কিছুতে জড়িত হতে চান না। জনগণের বোধ-বিশ্বাস ঈমান-আকীদা নিয়ে যে মুরতাদ শয়তানেরা খেলছে, ক্রমেই দ্বীনের অনুভূতি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে, এ সম্পর্কে সম্ভবত তারা একটু খেয়াল করার সময় পান না (পৃঃ ২২৪-২৫)।
[1]. মূল বইয়ে ভুলবশতঃ ৬১ ছাপা হয়েছে।- সম্পাদক।
[2]. এঁরই পুত্র আলহাজ্জ মোহাম্মাদ আহসান ইতিপূর্বে ছিলেন ঢাকা যেলা ‘আহলেহাদীস যুবসংঘ’-এর সভাপতি এবং বর্তমানে ঢাকা যেলা ‘আহলেহাদীস আন্দোলন’-এর সভাপতি।-সম্পাদক।
[3]. মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ভাষ্য মতে ঢাকায় এসে তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফীর সাপ্তাহিক আরাফাতে দু’বছর কাজ করেছেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন (আত-তাহরীক, আগস্ট’১৬, পৃঃ ২৪, ৩৮)।- সম্পাদক।
[4]. আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪৭৭৫। উক্ত শব্দে (الجهاد ماض إلي يوم القيامة) হাদীসটি যঈফ হলেও মর্ম সহীহ। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জেহাদ ও হিজরতের নিয়ত অবশিষ্ট থাকবে’ (বুখারী হা/১৮৩৪; মুসলিম হা/১৩৫৩; মিশকাত হা/২৭১৫)। -সম্পাদক।
আমাদের এই অঞ্চলে ছয় শতাধিক বছরের মুসলিম শাসনের কালটাও সবসময় নিষ্ঠাবান মুসলমানদের জন্য অনুকূল পরিবেশমন্ডিত ছিল না। একাধিকবার এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের সম্পূর্ণ উৎখাত করার অপপ্রয়াস হয়েছে। হয়েছে প্রচুর রক্তপাত। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে হযরত নূর কুতবে আলমের জেহাদ, হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদের জেহাদ আন্দোলন, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মীর নেছার আলী তিতুমীর, মাওলানা আবুবকর ছিদ্দিকী ও মুন্সী মেহেরুল্লাহ (রহঃ) প্রমুখের সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস মুসলমানদের বহু দুর্ভোগের অলিখিত বিবরণ বুকে ধারণ করে আছে। আমাদের প্রথম জীবনে যাঁদের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হয়েছি, তাঁদের মধ্যে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ এবং মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমীর জবানীতে মুসলমানদের দুর্ভোগ দুর্দিনের অনেক মর্মস্পর্শী ইতিহাস শ্রবণ করেছি। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে কিভাবে এই অধঃপতিত মুসলিম জাতির জন্য তিলে তিলে কলিজার খুন পানি করে তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন, এ সম্পর্কিত অনেক কাহিনীই মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁর জবানী থেকে শোনার সুযোগ হয়েছে।
১৯৬১-র ২রা মার্চ মঙ্গলবার অপরাহ্নে মাসিক মদীনার কয়েকটা কপি ব্যাগে পুরে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁর দরবারে হাযির হলাম। মাওলানা সাহেব বাদ আছর আজাদ অফিসের আঙ্গিনার বাগানে কুরসী পেতে বসতেন। তাঁর সামনে অর্ধ বৃত্তাকারে সাজানো থাকতো অনেকগুলি হাতলছাড়া চেয়ার। প্রতিদিনই মজলিস জমতো। মাওলানা সাহেব ছিলেন আহলেহাদীস মতাবলম্বী, তাই আছরের নামায পড়তেন মাগরিবের অন্ততঃ দু’ঘণ্টা আগে। সুতরাং মজলিস চলতো একটানা দু’ঘণ্টাতক। এ মজলিসে দেশের সেরা জ্ঞানী-গুণী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী প্রমুখ বিচিত্র ধরনের লোকজনের সমাবেশ ঘটত।
আমি যখন পৌঁছলাম, তখন মাওলানা সাহেব মাত্র বসেছেন। সামনে উল্লেখযোগ্য তেমন কেউ নাই। সালাম দেয়ার সাথে সাথেই আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। সাথে ছিলেন আমার সহপাঠী বন্ধু মরহুম মাওলানা মুজীবুর রহমান। লক্ষ্য করলাম, আমাকে দেখে মাওলানা ছাহেবের সুন্দর চেহারাটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। হাতের ছড়িটা ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা স্নেহের চুম্বন দিলেন। বললেন, আজ সকাল বেলায়ই আজাদে তোমার পত্রিকা প্রকাশ করার খবরটা পড়েছি। এমন একটা খবর পাঠ করে আমার মন আনন্দে একেবারে নেচে উঠেছে। মনে পড়ছে, আজ থেকে ষাট বছর আগে আমি যখন প্রথম কর্মক্ষেত্রে বিশেষতঃ লেখালেখির জগতে অবতরণ করেছি, তখন একদিন এক ইসলামী জালসায় সে যুগের মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুন্সী মেহেরুল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা। সে বছরই আমি মাদরাসায়ে আলীয়া কলিকাতা থেকে জামাতে উলা পাস করেছি। মুন্সী সাহেব ঠিক এভাবেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বলেছিলেন, ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত তোমাদের ন্যায় যুবকদের কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা! উল্লেখ্য যে, সে সময় মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, খুলনার (বর্তমানে সাতক্ষীরা) মাওলানা আহমদ আলী, চট্টগ্রামের মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ অনেকেই বলিষ্ঠ কলম হাতে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করেছেন। মাওলানা সাহেব আরও বললেন, আমাদের পূর্বসূরী সেই মুরুববী পুরুষের অনুসরণে আমিও তোমাকে অভিনন্দিত করছি। তবে একটা অভিযোগও আছে। আমাকে তুমি দাওয়াত করলে না কেন?
আমি বিনয়ের সাথে জবাব দিলাম, ভয়ে। আপনাকে নিয়ে কোথায় বসাবো? তিনি বললেন, কেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহীম খাঁ, কবি গোলাম মোস্তফা, খান বাহাদুর জসিমুদ্দীন প্রমুখ দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা যেখানে বসেছিলেন, সেখানে কি আমার বসার কোন অসুবিধা হতো?
এ প্রশ্নের জবাব দিলেন মাওলানা মুজীবুর রহমান। তিনি সবিস্তারে আমার পাগলামির কথা, দেওয়ান আবদুল হামীদ ও কবি জহীর বিন কুদ্দুছের আয়োজনের কথা বললেন। বিবরণ শুনে মাওলানা সাহেব হাসতে লাগলেন। এই সুযোগে আমি বিনয়ের সাথে তাঁর সামনে রক্ষিত টেবিলটায় মাসিক মদীনার একখানা কপি রাখলাম। মাওলানা সাহেব কপিটা হাতে তুলে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে নেড়েচেড়ে দেখলেন। পত্রিকার মান দেখেও সন্তোষ প্রকাশ করলেন। টুকিটাকি কিছু উপদেশ দিলেন। বললেন, শুরু তো করেছ প্রাণের টানে, ঈমানের উত্তাপ তাড়িত হয়ে, তবে কাজটা খুবই কঠিন। এই সাধনায় আমি বিগত ষাটটি বছর অতিক্রম করেছি। মুসলিম সমাজের অনুভূতি যে কোন্ স্তরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে, তা পদে পদেই অনুভব করতে পারবে। তবে যখনই কোন সংকট অনুভব কর, আমার নিকট চলে এসো। আমার আন্তরিক সহযোগিতা পাবে।
সেদিনের মজলিসে এ দেশের মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি উদ্ধারের সাধনা এবং প্রতিপক্ষের নোংরা কর্মকৌশল নিয়েই আলোচনা হ’ল। সেদিন আমার কানে যে কথাটি সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল, তা হচ্ছে, মাওলানা সাহেব বলছিলেন, আমাদের তিন পুরুষের সাধনায় বাংলার মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমরা অনেক সাধনার পরও নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, স্বতন্ত্র ভাষাশৈলী নির্মাণ করতে পারি নাই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তারপর রবী ঠাকুররা আমাদেরকে ‘যবন হরিদাসে’ রূপান্তরিত করার যে অপপ্রয়াস শুরু করেছিল, চল্লিশের দশকে তা থেকে আমরা বাহ্যত বের হয়ে আসতে সক্ষম হলেও এই ষাটের দশকে এসে আমরা পুনরায় একটা ভয়াবহ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছি। আজ এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের যে তোড়জোড় দেখতে পাচ্ছি, এসবের মধ্যে আমাদের বিগত তিন পুরুষের চেষ্টা-সাধনার শোচনীয় ব্যর্থতাই আমি প্রত্যক্ষ করছি। এক শ্রেণীর শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর মধ্যে যে হারে অপসংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ বাড়ছে, খুব শীঘ্রই এমন একটা সময় আসবে যে, আমাদের সকল অর্জন এসব অপসংস্কৃতির সয়লাবে খড়কুটার মত ভেসে যাবে বলে আমার আশঙ্কা হয়। সামনে খুব দুর্দিনের ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছি। আমরা লড়েছি অমুসলিমদের বিরুদ্ধে। তখন মুসলমান সমাজ বিদ্যাবুদ্ধি এবং অর্থবিত্তে এখনকার তুলনায় অনেক দুর্বল হলেও তাদের মধ্যে একতা ছিল। শত্রু-মিত্রের পার্থক্যবোধ এখনকার তুলনায় অনেক প্রখর ছিল। তারা জ্ঞানী-গুণীদের কথার গুরুত্ব দিতে জানতেন। কিন্তু ইদানীংকালে সে অনুভূতি যেন অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমি আত্মহননের প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি! এমন একটা যুগ সন্ধিক্ষণে তোমার মাসিক মদীনাকে আমি কোন ভাষায় খোশ আমদেদ জানাবো বুঝে পাচ্ছি না। দোয়া করি, সফলকাম হও! (পৃঃ ২৫৬-৫৮)।
উল্লেখ্য যে, এ বছর রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী খুব তোড়জোড় শুরু করেছিল। অবশ্য সচেতন মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত ওরা পিঠটান দিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে সাময়িক এই পরাজয়ে ওরা থেমে যায় নাই। বরং ওদের সাংস্কৃতিক হ্যাংলাপনা আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আর শেষ পর্যন্ত ত্রিকালদর্শী জ্ঞানবৃদ্ধ মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁর আশঙ্কাও একদিন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হতে আমরা দেখেছি।
নানা কারণে ৬৯ সালটা[1] ছিল খুবই ঘটনাবহুল। এই বছরই প্রথম মার্কিন নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করে। সারা দুনিয়াতে তখন একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একশ্রেণীর ছ্যাবলা লোক চাঁদে মানুষের পদচারণাকে ধর্ম-বিশ্বাসের উপর আঘাত করার অস্ত্ররূপে ব্যবহার করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় পন্ডিত বিষয়টা ধর্ম-বিশ্বাসের পরিপন্থী এবং কোন অবস্থাতেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করতে কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়ে। বাংলাদেশের ধর্মীয় পন্ডিত গোষ্ঠীর মধ্যে যে কত পদের মাল রয়েছে তা অনুধাবন করার কিছুটা সুযোগ আমার তখনই হয়েছিল।
বাংলা ভাষায় ইসলামী পঠনসামগ্রীর শোচনীয় দৈন্যদশা সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা ছাত্র জীবনেই হয়েছিল। বিশেষতঃ যাদের মধ্যে কোরআন-হাদীসের জ্ঞান রয়েছে, দুনিয়া এবং এর পারিপার্শ্বিকতা বিষয়ে তাদের ধারণার শোচনীয়তা আমাকে পীড়িত করতো। খুবই দ্রুত বিবর্তনশীল পৃথিবী সম্পর্কে জানবার বোঝবার চেষ্টা না করে বরং উল্টা তর্ক আমরা অনেকেই বেশ রপ্ত করেছিলাম। এমনই এক বিরক্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম মাসিক মদীনার দ্বিতীয় সংখ্যার কপি প্রেসে দেয়ার সময়। এক পড়ন্ত বেলায় একা একা বসে আছি ইংলিশ রোডের অফিসটায়। এমন সময় এলেন মুরুববী শ্রেণীর এক ভদ্রলোক। বললেন, তিনি একটি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হেড মৌলভীর চাকরী করতেন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন। মানুষ চাঁদে যেতে পারে এ কথার প্রতিবাদ করে তিনি একটা দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করেছেন। প্রবন্ধটা তিনি মাসিক মদীনায় ছাপাতে আগ্রহী এবং এখানে বসে তিনি এই দীর্ঘ প্রবন্ধ আমাকে পড়ে শোনাতে চান। আমি তাঁর লেখাটার উপর একটুখানি চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলাম, এটা ছাপার উপযুক্ত নয়। তবুও চক্ষুলজ্জার খাতিরে বললাম, এত বড় প্রবন্ধ পড়ে শোনানোর প্রয়োজন নাই, রেখে যান, অবসর মত আমি নিজেই পড়ে দেখব। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, আমাকে না শুনিয়ে ছাড়বেন না। আমার সম্মতি না নিয়েই পড়তে শুরু করলেন। আধঘণ্টাতক চোখ বুজে শুনলাম। এর মধ্যে হাজির হলেন দেওয়ান আব্দুল হামীদ এবং অধ্যাপক নূরুল হক। (শেষোক্তজন বর্তমানে লন্ডনে ব্যারিস্টারী করেন বলে শুনেছি। তখন নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে অধ্যাপনা করতেন)।
আমি চোখ মুখ বন্ধ করে শুনছিলাম। কিন্তু নূরুল হক শুনতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, হুযুর, এবার থামুন। আপনার এই লেখা মাসিক মদীনায় ছাপা হবে না। সুতরাং আর কষ্ট করবেন না। ভদ্রলোক রাগতঃস্বরে জানতে চাইলেন, কেন ছাপা হবে না শুনি? নূরুল হক বললেন, এজন্য যে, প্রথমতঃ এ পর্যন্ত যা শুনলাম, তার একটি বাক্যও শুদ্ধ হয় নাই। তাছাড়া মানুষ চাঁদে পৌঁছুতে পারে না, এটা ইসলামী বক্তব্য নয়। চাঁদ তো একটা গ্রহ মাত্র। মানুষের সেবার জন্য আল্লাহ পাক তাঁর কুল কায়েনাত সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সেই মানুষ তার কোন খাদেমের গায়ে পা রাখলে সেটা সর্বনাশের কি হলো?
ভদ্রলোক একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, অমন কথা যে বলবে বা বিশ্বাস করবে, সে নির্ঘাত কাফের হয়ে যাবে। সুতরাং আমার এ লেখা প্রকাশ করে মাসিক মদীনাকে প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা কুফুরী মতবাদ প্রচার করতে নামি নাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন হুমকি দিতে লাগলেন যে, তাঁর অনেক ছাত্র আছে। যদি এই লেখা ছাপা না হয় তবে তিনি ছাত্রদের দিয়ে এর প্রতিকার করবেন। পত্রিকা কি করে চালাই দেখে নিবেন।
এবার দেওয়ান আব্দুল হামীদ মুখ খুললেন। বললেন, জনাব! এবার আপনি আসতে পারেন। ছাত্র জুটিয়ে আসবেন। আমরা তখন এখানে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যাব। তবুও আপনার এই ‘রাবিশ’ ছাপার জন্য রাখা যাবে না।
ভদ্রলোক বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর রাগে ফুঁসছিলেন। আমি কিন্তু মোটেও ঘাবড়ালাম না। কেননা ইতিপূর্বে সাপ্তাহিক ‘নেজামে ইসলাম’ পত্রিকা এবং পরে সাপ্তাহিক ‘আজ’ সম্পাদনা করতে গিয়ে এ ধরনের অনেক পাগলের মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু এ লোকটি মনে হল বেশ সেয়ান পাগল। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ঝক্কি-ঝামেলার পর লোকটাকে বিদায় করা গেল (পৃঃ ২৫৮-৬০)।
আববার নিকট পত্রিকা প্রকাশ করার অনুমতি নিয়েছিলাম। কিন্তু তখন সম্ভবতঃ তিনি আমার এই উদ্যোগকে যুব মানসের একটা সাময়িক খেয়ালখুশী রূপেই বিবেচনা করেছিলেন। আর্থিক কোন সহযোগিতা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবে তাঁর নিকট থেকে সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ আমি যা পেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে- তাঁর প্রাণ উজাড় করা ‘মকবুল’ দোয়া। এই দোয়া আমি পেয়েছি ১৯৭৬ সালের রমযান পর্যন্ত। সেদিনই তিনি এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যেদিন পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল সেদিনই প্রথম একটি কপি ডাকযোগে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কপিটা হাতে পেয়ে তিনি যে কি খুশী হয়েছিলেন, তা বর্ণনা করার মত নয়। সে সপ্তাহেই আববা ঢাকা চলে এসেছিলেন এবং দেখা হওয়া মাত্র আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তাঁর স্বভাবসুলভ বাৎসল্যের এই আতিশয্য আমাকে রীতিমত আবেগাপ্লুত করেছিল। বুকে অনেক বেশী বল পেয়েছিলাম। কারণ শিশুকাল থেকেই আমার এমন একটা বিশ্বাস প্রবল ছিল যে, আববার কোন দোয়াই আল্লাহ পাক রদ করেন না। আমি লক্ষ্য করেছি, বিগত তিন যুগের এই চলার পথে অনেক যাতনা ভোগ করেছি। এমন আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছি, যা বলার মত নয়; কিন্তু মাসিক মদীনার অগ্রযাত্রা এসব সংকটে বাধাগ্রস্ত হয় নাই। বিগত তিন যুগে মাসিক মদীনাকে আমি কতটুকু নিষ্ঠাপূর্ণ শ্রম ও মেধা দিয়েছি জানি না, তবে মাসিক মদীনা আমাকে খ্যাতি দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর জীবন-জীবিকায়ও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। এটা ‘মদীনা’ নামের বরকত এবং আমার আববাসহ আরও জানা অজানা অসংখ্য হিতাকাঙ্ক্ষীর আন্তরিক দোয়াতেই যে সম্ভব হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না (পৃঃ ২৬১)।
কর্মজীবনের চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। বিগত অর্ধশতাব্দীকালের আমাদের সামাজিক উত্থান-পতনের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছি। অনেক প্রসিদ্ধ বুযুর্গ এবং পাশাপাশি ভেকধারী পীর-ফকীরের ক্রিয়াকর্ম কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। এখনও স্বঘোষিত বহু মোজাদ্দেদে জমানের প্রাদুর্ভাব অহরহই দেখতে পাই। এদের সাথে আমার মরহুম আববা এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধবের জীবনযাত্রা, চিন্তা-চেতনা এবং আমল-আখলাকের তুলনা করলে শুধু হতাশাই বাড়ে। মনে হয়, সিংহের খান্দান ক্রমেই যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আর তাদের পরিত্যক্ত স্থানে এসে ভীড় করছে ফেউ জাতীয় মেরুদন্ডহীন ধূর্ত কিছু ইতর প্রাণী!! বাংলার মুসলমান আজ নানামুখী বিজাতীয় আগ্রাসনের করুণ শিকার। কিন্তু এই মহাদুর্দিনে তাদের পার্শ্বে একজন মুন্সী মেহেরুল্লাহ বা নিদানপক্ষে একজন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীও নাই!!
এটা কিসের আলামত, সম্পূর্ণ ধ্বংসের, না অন্য কিছু, তা একমাত্র রাববুল আলামীনই বলতে পারেন!! (পৃঃ ২৬২)।
(২) দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন ও মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর পিতা মাওলানা আহমদ আলী (১৮৮৩-১৯৭৬ খৃঃ) সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘... সাতক্ষীরার মাওলানা আহমদ আলী (রহঃ) প্রমুখ অনেকেই কলমের জেহাদে অংশ নিয়ে জাতির জন্য বিরাট জ্ঞানভান্ডার রেখে গেছেন’ (পৃঃ ৬৫)।
(৩) ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ লাহোরে আয়োজিত উপমহাদেশের সকল অঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক মহাসমাবেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ যুগান্তকারী প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন বাংলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নেতা এ.কে. ফজলুল হক। এ উপলক্ষে লাহোরের সেই বিশাল জনসমুদ্রে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, অনেকের মতে সেটি ছিল এ.কে. ফজলুল হকের জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। এ সম্মেলনেই এ.কে. ফজলুল হককে ‘শেরে-বাংলা’ বা বাংলার বাঘ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সাথে সাথেই সমগ্র উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক দারুণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। লাহোর প্রস্তাবে প্রদত্ত শেরে বাংলার হুঙ্কার সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও আমরা সে হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই মুরুববীগণের মুখে মুখে। তখন মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সংবাদপত্র ছিল মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী। অতি উৎসাহী কর্মীদের মাধ্যমে পত্রিকা দুটিই দেশের গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত পৌঁছতে শুরু করে (পৃঃ ৭৮)।
(৪) ছাত্র জীবনে আমাদের সংগঠনটির নাম ছিল জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া। অর্থাৎ আরবী শিক্ষার ছাত্র সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আমার জানা মতে ১৯২৬ খৃষ্টাব্দে। প্রতিষ্ঠাতাগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমী, মাওলানা ওবায়দুল হক প্রমুখ অনেকেই। এঁরা সবাই ছিলেন এ জাতির এক একজন সেরা ব্যক্তিত্ব। এঁদের সকলেরই মেধা, প্রজ্ঞা এবং সাধনা জাতির প্রাণশক্তি উজ্জীবিত করেছে। মুসলিম-বাংলার সাংবাদিকতার পিতৃ-পুরুষ ছিলেন মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ (পৃঃ ১৩৭-৩৮)।
(৫) ঢাকায় তখন ছিলেন মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মুফতী দ্বীন মুহম্মদ খান, মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শী প্রমুখ বিশিষ্ট আলেম এবং সমাজ নেতৃবৃন্দ। আক্ষেপের বিষয়, সেসব মনীষীর তুল্য ব্যক্তিত্ব আমার ধারণায় বর্তমান বাংলাদেশে খুব বেশী নাই। এটাও আমাদের জন্য একটা বড় ধরনের দুর্ভাগ্য বলতে হবে (পৃঃ ১৬৬)।
(৬) ঢাকায় তখন বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরীও ছিল। এগুলির মধ্যে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শী, হাজী বশীরুদ্দীন, মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগড়ী এবং উর্দ্দু দৈনিক পাসবানের সম্পাদক জনাব সৈয়দ মোস্তফা হাসানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীগুলি ছিল স্মরণে রাখার মত।... এখন এই বিরাট ঢাকা শহরে মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ বা মাওলানা আবদুল্লাহ আল কাফীর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর ন্যায় একটা লাইব্রেরী কেউ গড়ে তুলতে পারেন নি। পারেন নি মানে সেই রুচি ও গরজবোধই যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে (পৃঃ ১৬৮-৬৯)।
(৭) মাওলানা আরেফদের পরিবারটি ছিল বহু আগ থেকেই আল্লাহর দ্বীনের পথে নিবেদিতপ্রাণ।[2] বালাকোট বিপর্যয়ের পর বিহারের এনায়েত আলী-বেলায়েত আলীর নেতৃত্বে জেহাদ আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল, ঢাকার বংশাল ছিল সে আন্দোলনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান কেন্দ্র। বংশালের বড় মসজিদে সবসময়ই জেহাদ আন্দোলনের কর্মীরা মজুত থাকতেন। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা হাজী বদরুদ্দীন (রহঃ) (বট্টু হাজী) ছিলেন এতদঞ্চলের জেহাদ আন্দোলনের প্রধান প্রতিনিধি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পার্বত্যাঞ্চলের মোজাহেদ ঘাঁটিগুলিতে নিয়মিত অর্থ প্রেরণ করা হতো বংশাল থেকে। ইংরেজের দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বট্টু হাজীর কর্মীরা টাকা নিয়ে যেতেন সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত। ...সীমান্তের মোজাহেদ বাহিনীর সাথে বংশালের সম্পর্ক পঞ্চাশের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল। তখনও রমযান মাসে মোজাহেদদের প্রতিনিধিরা বংশাল বড় মসজিদে আসতেন, অবস্থান করতেন এবং কিছু অর্থ সাহায্য নিয়ে যেতেন। মাওলানা মুহম্মদ আরেফ, তাঁর ছোট ভাই হাজী মুহম্মদ আকীল (রহঃ) এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট মুরুববী এই সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন (পৃঃ ১৬৯-৭০)।
(৮) ...জমিয়তে আহলে হাদীসের সদর মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শী প্রমুখ অনেক যুগশ্রেষ্ঠ ওলামা-মাশায়েখকে। এখনও মুগ্ধ চমৎকৃত হয়ে যাই যখন ভাবি যে, ঐ সমস্ত বুযুর্গগণকে কাছে থেকে দেখা এবং তাঁদের কাছাকাছি বসা, তাদের টুকটাক খেদমত করার[3] সৌভাগ্য আমার হয়েছিল! কারণ সেসব বুযুর্গের সমপর্যায়ের কেউ এদেশে আর জন্মগ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই (পৃঃ ১৭৯-৮০)।
(৯) বর্তমান এই ইংরেজী শতাব্দির শুরুতে এদেশে খৃষ্টান মিশনারী ও হিন্দু আর্যসমাজীদের পাশাপাশি কাদিয়ানী ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটে। এদেশবাসী মুসলমানদের উপর ছিল এটা সবচাইতে বড় আঘাত। কারণ আর্যসমাজীদেরকে একজন সাধারণ মুসলমানও হিন্দু বলেই জানতো। তেমনি খৃষ্টান মিশনারীরাও তাদের নিকট চিহ্নিত ছিল।
এদের প্রচারণায় মুসলমানগণ খুব কমই কান দিত। তাই খৃষ্টান মিশনারীরা হযরত মুহম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুয়তের বিকল্প সৃষ্টি করে। যেহেতু এটা ছিল খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদীদের একটি সাজানো ষড়যন্ত্র, সে কারণে সমসাময়িক আলেম সমাজ এই ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অসংখ্য কাদিয়ানী প্রচার পুস্তিকার মোকাবেলায় মুন্সী মুহম্মদ মেহেরুল্লাহর ‘রদ্দে কাদিয়ানী’ নামের পুস্তকখানা এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে। মাওলানা রুহুল আমীন (চবিবশ পরগনা), মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শীও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।
আমরা যাঁদের দেখেছি এবং যাঁদের লেখা পড়ে দাওয়াত ও জেহাদের পথে উদ্বুদ্ধ হয়েছি এঁদের মধ্যে আমার বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা শক্তিমান লেখক ছিলেন মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমী ও জমিয়তে আহলেহাদীসের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী, মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ (পৃঃ ১৮৩)।
(১০) সাহিত্য ও সংবাদপত্রসেবীদের সাথে সম্পর্কের জের ধরেই ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে দেশে মার্শাল ‘ল’ জারী হওয়ার পরপরই ময়মনসিংহ শহরে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত সাময়িক পত্র-পত্রিকার সম্পাদক-মালিকদের একটা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব জাকির হোসেন। সভাপতিত্ব করেছিলেন সাপ্তাহিক আরাফাত সম্পাদক মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ)। ময়মনসিংহ শহরের জন্য এই সম্মেলনটি ছিল খুবই আলোড়ন সৃষ্টিকারী এবং এতে শহরের সর্বস্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ শরীক হয়েছিলেন।... ময়মনসিংহ সম্মেলন থেকেই আমরা গঠন করেছিলাম ‘ইস্ট পাকিস্তান পিরিওডিক্যালস এসোসিয়েশন’ বা পূর্ব-পাকিস্তান সাময়িকী পরিষদ। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল অবহেলিত সাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলোর মানোন্নয়ন এবং দাবী-দাওয়া আদায়। মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শীকে এই সংস্থার সভাপতি এবং কিতাব আলী তালুকদারকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছিল (পৃঃ ২১৩-১৪)।
(১১) ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের ৬ই মে শুক্রবার দিন হযরত সৈয়দ আহমদ ও মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী (রহঃ) তাঁদের বিশিষ্ট কয়েকজন মুজাহিদ নেতাসহ শহীদ হন। তখন ইংরেজ, শিখ এবং সামন্তবাদী হিন্দুরা অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই বিখ্যাত ইংরেজ আমলারা বলতে বাধ্য হয় যে, ‘জীবিত সৈয়দ আহমদের চাইতে মৃত সৈয়দ আহমদ তাদের জন্য অনেক বেশী বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশেই ওরা পাঞ্জাবের ফরমান আলী নামক জনৈক ব্যক্তির দ্বারা উর্দু ভাষায় পবিত্র কুরআনের একটি বিকৃত তফসীর লেখায়। কিন্তু জীবন বিপন্ন জেনেও তখনকার আলেম সমাজ সেই অপচেষ্টা প্রতিহত করেছিলেন। তারপর হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদের আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে যে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠেছিল, তা নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়েই সাম্রাজ্যবাদী শয়তানেরা কাদিয়ানী ধর্মমতের সৃষ্টি করে। এ নতুন ধর্মের প্রবর্তক নিজেকে নবী বলে দাবি করে জেহাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রচার করে। তার যুক্তি ছিল, প্রথম জামানায় মুসলমানদের শুধু আত্মরক্ষার লক্ষ্যেই জেহাদ ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু এ জামানায় কার বিরুদ্ধে আমরা জেহাদ করব? ইংরেজরা তো আমাদের ধর্মকর্মে বাধা দেয় না। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিটা ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু প্রিয় নবীজী (সাঃ) তো বলে গেছেন যে, ‘জেহাদ কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে’[4]-এই হাদীসের ব্যাখ্যা কি হবে? কাদিয়ানী দাজ্জালদের প্রকৃত স্বরূপ তো আমাদের পিতৃপুরুষেরা পরিষ্কারভাবে উদঘাটন করে গেছেন। কিন্তু এ যুগের প্রতিরোধ আন্দোলনের অপ্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করার উদ্দেশে যখন ওলামা-মাশায়েখগণেরও কারো কারো মুখে সেই কাদিয়ানী দাজ্জালদেরই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই, তখন দুঃখ রাখার আর জায়গা থাকে না। আমার মনে হয় যোগ্যতা ছাড়াই অনেকে শুধুমাত্র পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে ‘গদ্দিনশীন’ পীর হয়ে যান, তারা ‘গদীর’ প্রসারের লক্ষ্যেই হয়ত বা ঝুঁকিপূর্ণ কোন কিছুতে জড়িত হতে চান না। জনগণের বোধ-বিশ্বাস ঈমান-আকীদা নিয়ে যে মুরতাদ শয়তানেরা খেলছে, ক্রমেই দ্বীনের অনুভূতি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে, এ সম্পর্কে সম্ভবত তারা একটু খেয়াল করার সময় পান না (পৃঃ ২২৪-২৫)।
[1]. মূল বইয়ে ভুলবশতঃ ৬১ ছাপা হয়েছে।- সম্পাদক।
[2]. এঁরই পুত্র আলহাজ্জ মোহাম্মাদ আহসান ইতিপূর্বে ছিলেন ঢাকা যেলা ‘আহলেহাদীস যুবসংঘ’-এর সভাপতি এবং বর্তমানে ঢাকা যেলা ‘আহলেহাদীস আন্দোলন’-এর সভাপতি।-সম্পাদক।
[3]. মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ভাষ্য মতে ঢাকায় এসে তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফীর সাপ্তাহিক আরাফাতে দু’বছর কাজ করেছেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন (আত-তাহরীক, আগস্ট’১৬, পৃঃ ২৪, ৩৮)।- সম্পাদক।
[4]. আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪৭৭৫। উক্ত শব্দে (الجهاد ماض إلي يوم القيامة) হাদীসটি যঈফ হলেও মর্ম সহীহ। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জেহাদ ও হিজরতের নিয়ত অবশিষ্ট থাকবে’ (বুখারী হা/১৮৩৪; মুসলিম হা/১৩৫৩; মিশকাত হা/২৭১৫)। -সম্পাদক।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: