আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের মধ্যে ব্যয়[১] করে, ক্রোধ[২] সংবরণ করে ও মানুষদেরকে ক্ষমা করে; আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩৪)।
ক্রোধ বা রাগ কোন সমাধান নয়, বরং এটা ঈমান ও শরীরের জন্য ধ্বংসাত্মক শত্রু। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে মহা বিপত্তিকর বিষবৃক্ষ। কারো থেকে প্রতিশোধ নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের সময় যে তোলপাড় সৃষ্টি হয় তাকে ক্রোধ বলে। ক্রোধ যেমন মানুষের ঈমান ও আত্মার শত্রু, তেমনি অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ স্বাস্থ্যেরও বড় শত্রু। ক্রোধের কারণে মানুষের পশুসুলভ আত্মা সক্রিয় হয়। চেহারা বিবর্ণ হয়, শিরা-উপশিরা ফুলে যায়, মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে অনায়াসে অশ্লীল কথা ও অশালীন আচরণ প্রকাশ পায়।
‘ডেডলি ইমোশন্স’ গ্রন্থের লেখক ড. ডন কোলবার্ট-এর মতে, ‘রাগ আপনার স্বাস্থ্যের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে’। তিনি সতর্ক করে আরো বলেন, ‘বিষণ্ণতা, রাগ, অপরাধবোধ, দোষারোপ, আত্মবিশ্বাসের অভাব এগুলো প্রাণঘাতী টক্সিনের নামান্তর’।
১). পারস্পরিক সম্পর্কে ভাঙন
অন্য যে কোন আবেগ অপেক্ষা ক্রোধ সম্পর্কের জটিলতাগুলো আরো ভয়ঙ্কর করে তোলে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়- স্বজন, প্রতিবেশী বা অন্য কোন ব্যক্তি, সকলেই কিন্তু রাগী মানুষকে অপসন্দ করে। তাই তাকে এড়িয়ে চলতে চায়। সর্বাধিক ভালোবাসা ও পসন্দের সম্পর্ক হল ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’। কিন্তু ক্রোধান্বিত হয়ে এরাও একে অপরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। যার মাশুল দিতে গিয়ে পুরো জীবনটা অন্ধকার কারাগারে না হয় কোর্টে হাজিরা দিতে দিতে ধ্বংস হয়ে যায়। এরকম উদাহরণ আমরা প্রায়ই পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই।
২). পারিবারিক ক্ষতি
সুখী পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে দু’টি জিনিস অত্যাবশ্যকীয়। যথা : (i) Understanding তথা পরস্পর বোঝাপড়া : একে অপরকে উপলব্ধি করা, তার অবস্থান, অভ্যাস, পসন্দ-অপসন্দ, চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো বুঝার চেষ্টা করা এবং বিপরীতধর্মী কোন কিছু না করা। (ii) Compromise তথা সমঝোতা বা আপস করা : সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক ঝামেলা হয়েই থাকে। তাই বলে একে অপরের উপর রাগ ও অভিমান নিয়ে বসে থাকলে সমাধান কোন দিনই সম্ভবপর হবে না। স্ত্রী ভাবছে ‘আমি ওর জন্য বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু ত্যাগ করেছি, কত ভালোবাসি ওকে, কত যত্ন নিই ওর, আর আজ সামান্য কারণে রেগে কথা বলছে, কথা না বললে কী হবে আমিও বলব না’। স্বামী ভাবছে, ‘আমি ওর জন্য কত পরিশ্রম করি, ওর সব চাওয়া-পাওয়া ও আবদার পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি, পরিবর্তে এতটুকুই তো চেয়েছিলাম যে ‘আমার অপসন্দ কোন কাজ করবে না’ এই ছোট্ট দাবিটুকু রাখতে পারল না?’ দু’জনেই যদি রাগ অভিমান ত্যাগ না করে একে অপরের দিকে আপসের জন্য এগিয়ে না আসে, তাহলে সংসার সুখী হবে কী করে? এক্ষেত্রে আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষণীয় আদর্শ।
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কোন এক স্ত্রীর ঘরে ছিলেন। এমন সময় উম্মুল মুমিনীনদের অপর একজন বড় পেয়ালা প্রেরণ করেন, যাতে খাদ্য ছিল। অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যার ঘরে ছিলেন তিনি খাদেমের হাতে আঘাত হানলেন, যাতে পেয়ালা পড়ে গেল এবং টুকরা টুকরা হয়ে গেল। অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়ালার টুকরাগুলো একত্র করলেন, অতঃপর পেয়ালায় যে খাদ্য ছিল তা জমা করতে লাগলেন এবং বললেন, তোমাদের মাতা ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। অতঃপর তিনি খাদেমকে ততক্ষণ পর্যন্ত আটকিয়ে রাখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি যাঁর ঘরে ছিলেন তাঁর ঘর হতে একটি ভাল পেয়ালা আনা না হল। অতঃপর ভাল পেয়ালাটি তিনি তাঁকে দিলেন, যাঁর পেয়ালা ভাঙ্গা হয়েছিল এবং ভাঙ্গাটি তাঁর জন্য রাখলেন যিনি তা ভেঙ্গে ছিলেন।[৩]
শিক্ষণীয় বিষয় : আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সকলের সামনে এই রকম একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটালেন তা সত্ত্বেও ধৈর্যের প্রতীক বিশ্বনবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে তিরষ্কার বা ভর্ৎসনা না করে তাঁকে সাপোর্ট করলেন যে ‘তোমাদের আম্মাজীর আত্মর্যাদাবোধে আঘাত লেগেছে’ এবং তিনি সাহাবীদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মর্যাদা, তাই তিনি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে নাম ধরে না ডেকে ‘তোমাদের মা’ বলে সম্বোধন করেছেন।
পজিটিভ উপদেশ : কেউ রেগে গেলে তার প্রতি পাল্টা রাগ না করে তাকে বুঝার চেষ্টা করুন। সমস্যার সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ।
৩). সামাজিক ক্ষতি
পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক কঠিনতম কাজ হল ‘দশজন মানুষের মত ও চিন্তাভাবনা এক হয়ে যাওয়া’। সমাজে কল্যাণমূলক কাজ দশ-বিশ জনকে নিয়েই করতে হয়, যাদের চিন্তা-ভাবনার মাপকাঠি ভিন্ন ভিন্ন। তাই মতপার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন আপনি দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সততার সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করছেন, তা সত্ত্বেও আপনার সততা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠবে না তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? এবার আপনি যদি ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন ‘এত স্বচ্ছ ও স্বার্থহীনভাবে দায়িত্ব পালন করেও আজ আমার সততা কালিমালিপ্ত। যা দায়িত্বই ছেড়ে দেব’ তাহলে কি আপনার দ্বারা কোন কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদিত হবে? অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ তার দ্বীন হতে ফিরে গেলে সত্বর আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায়কে নিয়ে আসবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসেন আর তারাও তাঁকে ভালোবাসবে, তারা মুমিনদের প্রতি কোমল আর কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে, কোন নিন্দুকের নিন্দাকে তারা ভয় করবে না, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ- যাকে ইচ্ছে তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যের অধিকারী, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-মায়িদা : ৫৪)।
অন্যদিকে যারা অসৎ, স্বার্থোদ্ধত দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের শত তিরষ্কার ও ভৎর্সনা করলেও দায়িত্ব ছাড়ে না, বরং পরবর্তীতে দায়িত্ব পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে, এদের মত লোক ক্ষমতায় আসলে কি সমাজে উন্নয়ন হবে? দ্বিতীয় ব্যক্তির দুনিয়াবী স্বার্থ এত শক্তিশালী যে শত ভৎর্সনাও তাকে দুর্বল করতে পারে না, আর আপনার পরকালের স্বার্থ এতই দুর্বল যে, আপনি সামান্যতেই ভেঙ্গে পড়ছেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘প্রতিটি আত্মা মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ করবে এবং ক্বিয়ামাতের দিন তোমাদেরকে পূর্ণমাত্রায় বিনিময় দেয়া হবে। যে ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করা হল এবং জান্নাতে প্রবেশ করা হল, অবশ্যই সে ব্যক্তি উত্তীর্ণ হল, কেননা পার্থিব জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৮৫)।
এক্ষেত্রে আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শিক্ষণীয় আদর্শ। হাদীসে এসেছে,
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে পথ চলছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল মোটা পাড়ের একখানা নাজরানী চাদর। এমন সময় একজন গ্রাম্য বেদুইন তাঁকে চাদরটি ধরে জোরে টান দিল। টানের চোটে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উক্ত বেদুইনের বক্ষের কাছে এসে পড়লেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল্ল্লুাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাঁধের প্রতি নযর করে দেখলাম যে, জোরে টানার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের ডোরায় ছাপ পড়েছে। অতঃপর বেদুইন বলল, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহ তা‘আলার যে মাল তোমার নিকট আছে, তা হতে আমাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দাও। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিকে ফিরে তাকালেন এবং হাসলেন। অতঃপর তাকে কিছু দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।[৪]
শিক্ষণীয় বিষয় : (ক) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ইতিবাচক শক্তি দ্বারা নেতিবাচক শক্তিকে দমন করেছেন। (খ) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কৌতুকরসবোধ দ্বারা ক্রোধকে দমন করেছেন। আমাদের সাথে যখন রেগে যাওয়ার মত কিছু ঘটে, তখন লক্ষ্য করলে আমরা দেখব ঘটনাটার একটা হিউমেরাস দিকও আছে। আমাদের উচিত হবে ঘটনার রাগের অংশটি উপেক্ষা করে হিউমেরাস অংশটির দিকে মনযোগ দেয়া।
পজিটিভ উপদেশ : কৌতুকরসবোধ দ্বারা ক্রোধকে দমন করুন।
৪). মানসিক ক্ষতি
ক্রোধান্বিত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক ও জিহ্বা দুটোই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ আমরা পূর্বাপর চিন্তাভাবনা না করেই হুটহাট কিছু করে বসি বা বলে দিই। যেমন ‘ত্বালাকের মত ভয়ঙ্কর সম্পর্ক বিচ্ছেদকারী শব্দ’। যদিও ইসলাম রাগান্বিত অবস্থায় ত্বালাক দেয়াকে অনুমোদন করে না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আজ মুসলিম সমাজের সিংহভাগ মানুষই ইসলামের থেকে মাযহাবী ফাতাওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পরে সারাজীবন এর মাশুল গুণতে হয় অনুশোচনা করে আর না হয় সুযোগ হাতছাড়া করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিষণ্ণতা হল চেপে রাখা ক্ষোভ। রাগ বা ক্ষোভ আসলে জীবনের আনন্দকেই কেড়ে নেয়। কোন বিষয়ে রেগে গিয়ে বিষয়টির সমাধান করতে না পারলে আমাদের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরি হয়। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করুন। রাগ দেখিয়ে কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যায় না। শুধু শুধু মানুষের কাছে অপ্রিয় হতে হয়।
৫). শারীরিক ক্ষতি
নিয়মিত রাগ স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। ন্যাচারাল হেলথ্ প্র্যাক্টিশনার ড. মারকোলার মতে, ‘স্বয়ংক্রিয় রাগের প্রতিক্রিয়ায় শারীরিক যে সমস্যাগুলো হতে পারে তাহল- ‘মাথাব্যথা, হজমের সমস্যা, ভারসাম্যহীনতা, ইনসমনিয়া (অনিদ্র), অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের সমস্যা ও এক্সিমা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি’। রাগের উন্মত্ততার ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবগুলো লক্ষ্য করা যায় তাহল-
(ক) হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় : অতিরিক্ত রাগ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, টানা দুই ঘণ্টা যদি কেউ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে, তাহলে তাঁর হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। রাগের প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে হৃদপিণ্ড। ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা ৫০ বছর ও তার চেয়েও অধিক বয়সের মানুষদের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে দেখা যায় যে, মাত্রাতিরিক্ত মেজাজের মানুষদের ধমনীতে অন্যদের তুলনায় বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম জমা হয়। যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ। এই গবেষণার লেখক ব্রুস রাইট বলেন, ‘রাগে ফেটে পড়লে স্ট্রেস হরমোন তরঙ্গায়িত হয় এবং রক্তনালীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার বাস্তব উদাহরণ হল, ডাঃ জন হান্টারের মৃত্যু’। ক্রোধের বিস্ফোরণই হৃদরোগের অন্যতম কারণ-এ সত্যটি আবিষ্কার করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংলান্ডের সেন্ট জার্জেস হাসপাতালের বিখ্যাত ডাক্তার জন হান্টার তার জীবনের বিনিময়ে। চিকিৎসা জগতে জন হান্টার অতি পরিচিত নাম। তার সফল চিকিৎসার সুখ্যাতি বিশ্বময় কিংবদন্তির ন্যায় ছড়িয়ে আছে। বদমেজাজের জন্যও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তার সাথে রুগিরা একটু অপ্রত্যাশিত আচরণ করলেই তিনি রেগে আগুন হয়ে যেতেন। রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়তেন, স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন। এ সময় তার বুকে মৃদু যন্ত্রণা হত। এ অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা যেদিন বেশি হত সেদিন যন্ত্রণা অসহ্য রকমের হত। ডাক্তার হান্টার তার বন্ধুদের বলতেন, দেখ! যদি আমার আকস্মিক মৃত্যু হয় তাহলে বুঝবে আমার ক্রোধের কারণেই হয়েছে।
একদিন তার চেম্বারে একজন খুঁতখুঁতে মেজাজের রোগী এলেন। তার কী রোগ হয়েছে, এ রোগ কেন হয় এরকম বহু প্রশ্ন করে ডাক্তারকে উত্ত্যক্ত করে তুললেন। ডাক্তার তার স্বভাব অনুযায়ী ক্রোধে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েন। বুক চেপে ধরে রোগীকে বললেন, মাফ করবেন, আমি একটু পাশের রুমে যাচ্ছি। পাশের রুমের মেঝেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। বলা যায় তখন থেকেই মানুষ হৃদরোগের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কারণ হিসাবে এই ক্রোধের বিস্ফোরণকেই দায়ী করে আসছে।
(খ) স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে : অতিরিক্ত রাগ কিন্তু স্ট্রোকেরও ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যদি আপনার ক্রোধ অনিয়ন্ত্রিত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আপনাকে দ্রুত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কেননা এটি মস্তিষ্কের ওপর প্রচণ্ড হারে চাপ সৃষ্টি করে। এতে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
(গ) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় : বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘টানা ছয় ঘণ্টা মন-মেজাজ খারাপ থাকলে বা রেগে থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়’। এতে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ (Infection) হয়।
এছাড়াও আমরা যখন রেগে যাই তখন আমাদের দেহে কিছু জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। যেমন, হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়। এছাড়া দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ফলে ঘাম হয় এ তাপমাত্রাকে স্বাভাবিক করার জন্য। পেশী সংকুচিত হয় এবং হাত-পায়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় যেকোন দৈহিক তৎপরতাকে পরিচালনা করার জন্য। অর্থাৎ ফ্লাইট অর ফাইট রেসপন্স সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে যদি এই রেসপন্স চলতে থাকে তাহলে অনেক ধরনের ক্রনিক রোগ হতে পারে। যেমন, ইনসমনিয়া, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, আলসার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মৃগী, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাইগ্রেন, ব্যাকপেইন, ফুসফুসের অসুখ ইত্যাদি’।
৬). আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়
আত্মহত্যার কারণ সমূহের মধ্যে ক্রোধ অন্যতম। যা শতকরা মৃত্যুহারের একটি ভাল পার্সেন্টেজ দখল করে আছে। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখা যায় খুনাখুনি, মারামারি, বউ স্বামীকে হত্যা, স্বামী বউকে হত্যা, অথবা রাগের মাথায় কেউ কাউকে গুলি করেছে।
রাগ একটি ইমোশনাল বিষয়, যার বহিঃপ্রকাশ হয় বিভিন্ন মানুষের বিভিন্নভাবে। যেমন কেউ নিজের শরীরে আঘাত করে, কেউ অন্যকে আঘাত করে, আবার কেউ আত্মহত্যা করে। যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তির নিজের ওপর, তার পরিবারের উপর এবং সমাজের উপর। উদাহরণ স্বরূপ- ১. বাবার কথায় রেগে কেরোসিন খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি যুবক। ২. ব্যর্থ প্রেমিক রাগান্বিত হয়ে এসিড ছুড়ে হত্যা করল প্রেমিকাকে। এ জন্যই ইসলাম রাগকে চিরতরে হারাম করেছে, যার কারণে না থাকবে হাতিয়ার না হবে হত্যা। যেমন হাদীসে এসেছে,
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, আমাকে উপদেশ দিন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি রাগ কর না। সে কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করলে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেকবার একই উত্তর দিলেন, তুমি রাগ কর না।[৫]
আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘তুমি রাগ কর না; তোমার জন্য জান্নাত অবধারিত’।[৬]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
‘ঐ ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে প্রতিপক্ষকে আছাড় দিয়ে ফেলে দিতে পারে। বরং সে ব্যক্তিই প্রকৃত শক্তিশালী, যে ব্যক্তি রাগের সময় নিজেকে সংযত করে রাখতে পারে।[৭]
৭). সফলতার পথে অন্তরায়
সাফল্যের অন্তরায় হিসাবে মনীষীরা সব সময়ই রাগকে শনাক্ত করেছেন। বিশেষ করে হার্ভার্ড ডিসিশন সায়েন্স ল্যাবরেটরির মনীষীগণ। রাগান্বিত অবস্থায় রাগের বিষয়গুলো সর্বদা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকায় অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ কমে যায়। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ হয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, (মানুষের) শরীরের প্রতিটি খণ্ড অস্তির উপর প্রতিদিন একটি করে ছাদাক্বাহ ওয়াজিব হয়। কোন লোককে স্বীয় সাওয়ারীর উপর আরোহণ করিয়ে সাহায্য করা বা তার মাল-সরঞ্জাম বহন করে দেয়া, উত্তম কথা বলা, সালাতের উদ্দেশ্যে যাতায়াতের প্রতিটি পদক্ষেপ এবং (পথিককে) রাস্তা দেখিয়ে দেয়া এসবই ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হা/২৮৯১।
[২]. আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘বাহাদুর সে নয় যে কুস্তিতে কাউকে পরাজিত করে। বাহাদুর সে, যে কঠিন রাগের সময় নিজেকে সামলাতে পারে। দ্র. সহীহ বুখারী, হা/৬১১৪।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/৫২২৫; মিশকাত, হা/২৯৪০।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/৩১৪৯, ৫৮০৯, ৬০৮৮; সহীহ মুসলিম, হা/১০৫৭; মিশকাত, হা/৫৮০৩।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/৬১১৬; মিশকাত, হা/৫১০৪।
[৬]. ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৭৬২; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/২৩৫৩, সনদ সহীহ লি গয়রিহী; সহীহ তারগীব ওয়া তারহীব, হা/২৭৪৯।
[৭]. সহীহ বুখারী, হা/৬১১৪; সহীহ মুসলিম ,হা/২৬০৯; মিশকাত, হা/৫১০৫।
الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ
‘যারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের মধ্যে ব্যয়[১] করে, ক্রোধ[২] সংবরণ করে ও মানুষদেরকে ক্ষমা করে; আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩৪)।
ক্রোধ বা রাগ কোন সমাধান নয়, বরং এটা ঈমান ও শরীরের জন্য ধ্বংসাত্মক শত্রু। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে মহা বিপত্তিকর বিষবৃক্ষ। কারো থেকে প্রতিশোধ নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের সময় যে তোলপাড় সৃষ্টি হয় তাকে ক্রোধ বলে। ক্রোধ যেমন মানুষের ঈমান ও আত্মার শত্রু, তেমনি অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ স্বাস্থ্যেরও বড় শত্রু। ক্রোধের কারণে মানুষের পশুসুলভ আত্মা সক্রিয় হয়। চেহারা বিবর্ণ হয়, শিরা-উপশিরা ফুলে যায়, মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে অনায়াসে অশ্লীল কথা ও অশালীন আচরণ প্রকাশ পায়।
‘ডেডলি ইমোশন্স’ গ্রন্থের লেখক ড. ডন কোলবার্ট-এর মতে, ‘রাগ আপনার স্বাস্থ্যের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে’। তিনি সতর্ক করে আরো বলেন, ‘বিষণ্ণতা, রাগ, অপরাধবোধ, দোষারোপ, আত্মবিশ্বাসের অভাব এগুলো প্রাণঘাতী টক্সিনের নামান্তর’।
ক্রোধের ধ্বংসাত্মক ক্ষতিসমূহ
১). পারস্পরিক সম্পর্কে ভাঙন
অন্য যে কোন আবেগ অপেক্ষা ক্রোধ সম্পর্কের জটিলতাগুলো আরো ভয়ঙ্কর করে তোলে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়- স্বজন, প্রতিবেশী বা অন্য কোন ব্যক্তি, সকলেই কিন্তু রাগী মানুষকে অপসন্দ করে। তাই তাকে এড়িয়ে চলতে চায়। সর্বাধিক ভালোবাসা ও পসন্দের সম্পর্ক হল ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’। কিন্তু ক্রোধান্বিত হয়ে এরাও একে অপরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। যার মাশুল দিতে গিয়ে পুরো জীবনটা অন্ধকার কারাগারে না হয় কোর্টে হাজিরা দিতে দিতে ধ্বংস হয়ে যায়। এরকম উদাহরণ আমরা প্রায়ই পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই।
২). পারিবারিক ক্ষতি
সুখী পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে দু’টি জিনিস অত্যাবশ্যকীয়। যথা : (i) Understanding তথা পরস্পর বোঝাপড়া : একে অপরকে উপলব্ধি করা, তার অবস্থান, অভ্যাস, পসন্দ-অপসন্দ, চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো বুঝার চেষ্টা করা এবং বিপরীতধর্মী কোন কিছু না করা। (ii) Compromise তথা সমঝোতা বা আপস করা : সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক ঝামেলা হয়েই থাকে। তাই বলে একে অপরের উপর রাগ ও অভিমান নিয়ে বসে থাকলে সমাধান কোন দিনই সম্ভবপর হবে না। স্ত্রী ভাবছে ‘আমি ওর জন্য বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু ত্যাগ করেছি, কত ভালোবাসি ওকে, কত যত্ন নিই ওর, আর আজ সামান্য কারণে রেগে কথা বলছে, কথা না বললে কী হবে আমিও বলব না’। স্বামী ভাবছে, ‘আমি ওর জন্য কত পরিশ্রম করি, ওর সব চাওয়া-পাওয়া ও আবদার পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি, পরিবর্তে এতটুকুই তো চেয়েছিলাম যে ‘আমার অপসন্দ কোন কাজ করবে না’ এই ছোট্ট দাবিটুকু রাখতে পারল না?’ দু’জনেই যদি রাগ অভিমান ত্যাগ না করে একে অপরের দিকে আপসের জন্য এগিয়ে না আসে, তাহলে সংসার সুখী হবে কী করে? এক্ষেত্রে আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষণীয় আদর্শ।
عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَ بَعْضِ نِسَائِهِ فَأَرْسَلَتْ إِحْدَى أُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ بِصَحْفَةٍ فِيْهَا طَعَامٌ فَضَرَبَتِ الَّتِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ بَيْتِهَا يَدَ الْخَادِمِ فَسَقَطَتِ الصَّحْفَةُ فَانْفَلَقَتْ فَجَمَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِلَقَ الصَّحْفَةِ ثُمَّ جَعَلَ يَجْمَعُ فِيْهَا الطَّعَامَ الَّذِيْ كَانَ فِي الصَّحْفَةِ وَيَقُوْلُ غَارَتْ أُمُّكُمْ ثُمَّ حَبَسَ الْخَادِمَ حَتَّى أُتِيَ بِصَحْفَةٍ مِنْ عِنْدِ الَّتِيْ هُوَ فِيْ بَيْتِهَا فَدَفَعَ الصَّحْفَةَ الصَحِيْحَةَ إِلَى الَّتِيْ كُسِرَتْ صَحْفَتُهَا وَأَمْسَكَ الْمَكْسُوْرَةَ فِيْ بَيْتِ الَّتِيْ كَسَرَتْ
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কোন এক স্ত্রীর ঘরে ছিলেন। এমন সময় উম্মুল মুমিনীনদের অপর একজন বড় পেয়ালা প্রেরণ করেন, যাতে খাদ্য ছিল। অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যার ঘরে ছিলেন তিনি খাদেমের হাতে আঘাত হানলেন, যাতে পেয়ালা পড়ে গেল এবং টুকরা টুকরা হয়ে গেল। অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়ালার টুকরাগুলো একত্র করলেন, অতঃপর পেয়ালায় যে খাদ্য ছিল তা জমা করতে লাগলেন এবং বললেন, তোমাদের মাতা ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। অতঃপর তিনি খাদেমকে ততক্ষণ পর্যন্ত আটকিয়ে রাখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি যাঁর ঘরে ছিলেন তাঁর ঘর হতে একটি ভাল পেয়ালা আনা না হল। অতঃপর ভাল পেয়ালাটি তিনি তাঁকে দিলেন, যাঁর পেয়ালা ভাঙ্গা হয়েছিল এবং ভাঙ্গাটি তাঁর জন্য রাখলেন যিনি তা ভেঙ্গে ছিলেন।[৩]
শিক্ষণীয় বিষয় : আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সকলের সামনে এই রকম একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটালেন তা সত্ত্বেও ধৈর্যের প্রতীক বিশ্বনবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে তিরষ্কার বা ভর্ৎসনা না করে তাঁকে সাপোর্ট করলেন যে ‘তোমাদের আম্মাজীর আত্মর্যাদাবোধে আঘাত লেগেছে’ এবং তিনি সাহাবীদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মর্যাদা, তাই তিনি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে নাম ধরে না ডেকে ‘তোমাদের মা’ বলে সম্বোধন করেছেন।
পজিটিভ উপদেশ : কেউ রেগে গেলে তার প্রতি পাল্টা রাগ না করে তাকে বুঝার চেষ্টা করুন। সমস্যার সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ।
৩). সামাজিক ক্ষতি
পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক কঠিনতম কাজ হল ‘দশজন মানুষের মত ও চিন্তাভাবনা এক হয়ে যাওয়া’। সমাজে কল্যাণমূলক কাজ দশ-বিশ জনকে নিয়েই করতে হয়, যাদের চিন্তা-ভাবনার মাপকাঠি ভিন্ন ভিন্ন। তাই মতপার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন আপনি দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সততার সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করছেন, তা সত্ত্বেও আপনার সততা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠবে না তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? এবার আপনি যদি ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন ‘এত স্বচ্ছ ও স্বার্থহীনভাবে দায়িত্ব পালন করেও আজ আমার সততা কালিমালিপ্ত। যা দায়িত্বই ছেড়ে দেব’ তাহলে কি আপনার দ্বারা কোন কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদিত হবে? অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَنۡ یَّرۡتَدَّ مِنۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِہٖ فَسَوۡفَ یَاۡتِی اللّٰہُ بِقَوۡمٍ یُّحِبُّہُمۡ وَ یُحِبُّوۡنَہٗۤ ۙ اَذِلَّۃٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَعِزَّۃٍ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ ۫ یُجَاہِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ لَا یَخَافُوۡنَ لَوۡمَۃَ لَآئِمٍ ؕ ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ তার দ্বীন হতে ফিরে গেলে সত্বর আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায়কে নিয়ে আসবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসেন আর তারাও তাঁকে ভালোবাসবে, তারা মুমিনদের প্রতি কোমল আর কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে, কোন নিন্দুকের নিন্দাকে তারা ভয় করবে না, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ- যাকে ইচ্ছে তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যের অধিকারী, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-মায়িদা : ৫৪)।
অন্যদিকে যারা অসৎ, স্বার্থোদ্ধত দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের শত তিরষ্কার ও ভৎর্সনা করলেও দায়িত্ব ছাড়ে না, বরং পরবর্তীতে দায়িত্ব পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে, এদের মত লোক ক্ষমতায় আসলে কি সমাজে উন্নয়ন হবে? দ্বিতীয় ব্যক্তির দুনিয়াবী স্বার্থ এত শক্তিশালী যে শত ভৎর্সনাও তাকে দুর্বল করতে পারে না, আর আপনার পরকালের স্বার্থ এতই দুর্বল যে, আপনি সামান্যতেই ভেঙ্গে পড়ছেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اِنَّمَا تُوَفَّوۡنَ اُجُوۡرَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ فَمَنۡ زُحۡزِحَ عَنِ النَّارِ وَ اُدۡخِلَ الۡجَنَّۃَ فَقَدۡ فَازَ ؕ وَ مَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ
‘প্রতিটি আত্মা মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ করবে এবং ক্বিয়ামাতের দিন তোমাদেরকে পূর্ণমাত্রায় বিনিময় দেয়া হবে। যে ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করা হল এবং জান্নাতে প্রবেশ করা হল, অবশ্যই সে ব্যক্তি উত্তীর্ণ হল, কেননা পার্থিব জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৮৫)।
এক্ষেত্রে আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শিক্ষণীয় আদর্শ। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنْتُ أَمْشِيْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانِيٌّ غَلِيْظُ الْحَاشِيَةِ فَأَدْرَكَهُ أَعْرَابِيٌّ فَجَبَذَهُ جَبْذَةً شَدِيْدَةً وَرَجَعَ نَبِيُّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ نَحْرِ الْأَعْرَابِيِّ حَتَّى نَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ أَثَرْتَ بِهِ حَاشِيَةُ الْبُرْدِ مِنْ شِدَّةِ جَبْذَتِهِ ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُرْ لِيْ مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِي عَنْدَكَ فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ ضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে পথ চলছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল মোটা পাড়ের একখানা নাজরানী চাদর। এমন সময় একজন গ্রাম্য বেদুইন তাঁকে চাদরটি ধরে জোরে টান দিল। টানের চোটে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উক্ত বেদুইনের বক্ষের কাছে এসে পড়লেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল্ল্লুাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাঁধের প্রতি নযর করে দেখলাম যে, জোরে টানার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের ডোরায় ছাপ পড়েছে। অতঃপর বেদুইন বলল, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহ তা‘আলার যে মাল তোমার নিকট আছে, তা হতে আমাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দাও। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিকে ফিরে তাকালেন এবং হাসলেন। অতঃপর তাকে কিছু দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।[৪]
শিক্ষণীয় বিষয় : (ক) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ইতিবাচক শক্তি দ্বারা নেতিবাচক শক্তিকে দমন করেছেন। (খ) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কৌতুকরসবোধ দ্বারা ক্রোধকে দমন করেছেন। আমাদের সাথে যখন রেগে যাওয়ার মত কিছু ঘটে, তখন লক্ষ্য করলে আমরা দেখব ঘটনাটার একটা হিউমেরাস দিকও আছে। আমাদের উচিত হবে ঘটনার রাগের অংশটি উপেক্ষা করে হিউমেরাস অংশটির দিকে মনযোগ দেয়া।
পজিটিভ উপদেশ : কৌতুকরসবোধ দ্বারা ক্রোধকে দমন করুন।
৪). মানসিক ক্ষতি
ক্রোধান্বিত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক ও জিহ্বা দুটোই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ আমরা পূর্বাপর চিন্তাভাবনা না করেই হুটহাট কিছু করে বসি বা বলে দিই। যেমন ‘ত্বালাকের মত ভয়ঙ্কর সম্পর্ক বিচ্ছেদকারী শব্দ’। যদিও ইসলাম রাগান্বিত অবস্থায় ত্বালাক দেয়াকে অনুমোদন করে না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আজ মুসলিম সমাজের সিংহভাগ মানুষই ইসলামের থেকে মাযহাবী ফাতাওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পরে সারাজীবন এর মাশুল গুণতে হয় অনুশোচনা করে আর না হয় সুযোগ হাতছাড়া করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিষণ্ণতা হল চেপে রাখা ক্ষোভ। রাগ বা ক্ষোভ আসলে জীবনের আনন্দকেই কেড়ে নেয়। কোন বিষয়ে রেগে গিয়ে বিষয়টির সমাধান করতে না পারলে আমাদের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরি হয়। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করুন। রাগ দেখিয়ে কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যায় না। শুধু শুধু মানুষের কাছে অপ্রিয় হতে হয়।
৫). শারীরিক ক্ষতি
নিয়মিত রাগ স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। ন্যাচারাল হেলথ্ প্র্যাক্টিশনার ড. মারকোলার মতে, ‘স্বয়ংক্রিয় রাগের প্রতিক্রিয়ায় শারীরিক যে সমস্যাগুলো হতে পারে তাহল- ‘মাথাব্যথা, হজমের সমস্যা, ভারসাম্যহীনতা, ইনসমনিয়া (অনিদ্র), অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের সমস্যা ও এক্সিমা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি’। রাগের উন্মত্ততার ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবগুলো লক্ষ্য করা যায় তাহল-
(ক) হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় : অতিরিক্ত রাগ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, টানা দুই ঘণ্টা যদি কেউ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে, তাহলে তাঁর হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। রাগের প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে হৃদপিণ্ড। ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা ৫০ বছর ও তার চেয়েও অধিক বয়সের মানুষদের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে দেখা যায় যে, মাত্রাতিরিক্ত মেজাজের মানুষদের ধমনীতে অন্যদের তুলনায় বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম জমা হয়। যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ। এই গবেষণার লেখক ব্রুস রাইট বলেন, ‘রাগে ফেটে পড়লে স্ট্রেস হরমোন তরঙ্গায়িত হয় এবং রক্তনালীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার বাস্তব উদাহরণ হল, ডাঃ জন হান্টারের মৃত্যু’। ক্রোধের বিস্ফোরণই হৃদরোগের অন্যতম কারণ-এ সত্যটি আবিষ্কার করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংলান্ডের সেন্ট জার্জেস হাসপাতালের বিখ্যাত ডাক্তার জন হান্টার তার জীবনের বিনিময়ে। চিকিৎসা জগতে জন হান্টার অতি পরিচিত নাম। তার সফল চিকিৎসার সুখ্যাতি বিশ্বময় কিংবদন্তির ন্যায় ছড়িয়ে আছে। বদমেজাজের জন্যও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তার সাথে রুগিরা একটু অপ্রত্যাশিত আচরণ করলেই তিনি রেগে আগুন হয়ে যেতেন। রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়তেন, স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন। এ সময় তার বুকে মৃদু যন্ত্রণা হত। এ অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা যেদিন বেশি হত সেদিন যন্ত্রণা অসহ্য রকমের হত। ডাক্তার হান্টার তার বন্ধুদের বলতেন, দেখ! যদি আমার আকস্মিক মৃত্যু হয় তাহলে বুঝবে আমার ক্রোধের কারণেই হয়েছে।
একদিন তার চেম্বারে একজন খুঁতখুঁতে মেজাজের রোগী এলেন। তার কী রোগ হয়েছে, এ রোগ কেন হয় এরকম বহু প্রশ্ন করে ডাক্তারকে উত্ত্যক্ত করে তুললেন। ডাক্তার তার স্বভাব অনুযায়ী ক্রোধে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েন। বুক চেপে ধরে রোগীকে বললেন, মাফ করবেন, আমি একটু পাশের রুমে যাচ্ছি। পাশের রুমের মেঝেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। বলা যায় তখন থেকেই মানুষ হৃদরোগের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কারণ হিসাবে এই ক্রোধের বিস্ফোরণকেই দায়ী করে আসছে।
(খ) স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে : অতিরিক্ত রাগ কিন্তু স্ট্রোকেরও ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যদি আপনার ক্রোধ অনিয়ন্ত্রিত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আপনাকে দ্রুত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কেননা এটি মস্তিষ্কের ওপর প্রচণ্ড হারে চাপ সৃষ্টি করে। এতে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
(গ) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় : বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘টানা ছয় ঘণ্টা মন-মেজাজ খারাপ থাকলে বা রেগে থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়’। এতে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ (Infection) হয়।
এছাড়াও আমরা যখন রেগে যাই তখন আমাদের দেহে কিছু জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। যেমন, হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়। এছাড়া দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ফলে ঘাম হয় এ তাপমাত্রাকে স্বাভাবিক করার জন্য। পেশী সংকুচিত হয় এবং হাত-পায়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় যেকোন দৈহিক তৎপরতাকে পরিচালনা করার জন্য। অর্থাৎ ফ্লাইট অর ফাইট রেসপন্স সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে যদি এই রেসপন্স চলতে থাকে তাহলে অনেক ধরনের ক্রনিক রোগ হতে পারে। যেমন, ইনসমনিয়া, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, আলসার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মৃগী, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাইগ্রেন, ব্যাকপেইন, ফুসফুসের অসুখ ইত্যাদি’।
৬). আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়
আত্মহত্যার কারণ সমূহের মধ্যে ক্রোধ অন্যতম। যা শতকরা মৃত্যুহারের একটি ভাল পার্সেন্টেজ দখল করে আছে। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখা যায় খুনাখুনি, মারামারি, বউ স্বামীকে হত্যা, স্বামী বউকে হত্যা, অথবা রাগের মাথায় কেউ কাউকে গুলি করেছে।
রাগ একটি ইমোশনাল বিষয়, যার বহিঃপ্রকাশ হয় বিভিন্ন মানুষের বিভিন্নভাবে। যেমন কেউ নিজের শরীরে আঘাত করে, কেউ অন্যকে আঘাত করে, আবার কেউ আত্মহত্যা করে। যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তির নিজের ওপর, তার পরিবারের উপর এবং সমাজের উপর। উদাহরণ স্বরূপ- ১. বাবার কথায় রেগে কেরোসিন খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি যুবক। ২. ব্যর্থ প্রেমিক রাগান্বিত হয়ে এসিড ছুড়ে হত্যা করল প্রেমিকাকে। এ জন্যই ইসলাম রাগকে চিরতরে হারাম করেছে, যার কারণে না থাকবে হাতিয়ার না হবে হত্যা। যেমন হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْصِنِيْ قَالَ لَا تَغْضَبْ فَرَدَّ ذَلِكَ مِرَارًا قَالَ لَا تَغْضَبْ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, আমাকে উপদেশ দিন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি রাগ কর না। সে কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করলে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেকবার একই উত্তর দিলেন, তুমি রাগ কর না।[৫]
আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
لَا تَغْضَبْ ولَكَ الجنَّةُ
‘তুমি রাগ কর না; তোমার জন্য জান্নাত অবধারিত’।[৬]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
لَيْسَ الشَّدِيْدُ بِالصُّرْعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيْدُ الَّذِيْ يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ
‘ঐ ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে প্রতিপক্ষকে আছাড় দিয়ে ফেলে দিতে পারে। বরং সে ব্যক্তিই প্রকৃত শক্তিশালী, যে ব্যক্তি রাগের সময় নিজেকে সংযত করে রাখতে পারে।[৭]
৭). সফলতার পথে অন্তরায়
সাফল্যের অন্তরায় হিসাবে মনীষীরা সব সময়ই রাগকে শনাক্ত করেছেন। বিশেষ করে হার্ভার্ড ডিসিশন সায়েন্স ল্যাবরেটরির মনীষীগণ। রাগান্বিত অবস্থায় রাগের বিষয়গুলো সর্বদা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকায় অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ কমে যায়। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ হয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, (মানুষের) শরীরের প্রতিটি খণ্ড অস্তির উপর প্রতিদিন একটি করে ছাদাক্বাহ ওয়াজিব হয়। কোন লোককে স্বীয় সাওয়ারীর উপর আরোহণ করিয়ে সাহায্য করা বা তার মাল-সরঞ্জাম বহন করে দেয়া, উত্তম কথা বলা, সালাতের উদ্দেশ্যে যাতায়াতের প্রতিটি পদক্ষেপ এবং (পথিককে) রাস্তা দেখিয়ে দেয়া এসবই ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হা/২৮৯১।
[২]. আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘বাহাদুর সে নয় যে কুস্তিতে কাউকে পরাজিত করে। বাহাদুর সে, যে কঠিন রাগের সময় নিজেকে সামলাতে পারে। দ্র. সহীহ বুখারী, হা/৬১১৪।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/৫২২৫; মিশকাত, হা/২৯৪০।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/৩১৪৯, ৫৮০৯, ৬০৮৮; সহীহ মুসলিম, হা/১০৫৭; মিশকাত, হা/৫৮০৩।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/৬১১৬; মিশকাত, হা/৫১০৪।
[৬]. ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৭৬২; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/২৩৫৩, সনদ সহীহ লি গয়রিহী; সহীহ তারগীব ওয়া তারহীব, হা/২৭৪৯।
[৭]. সহীহ বুখারী, হা/৬১১৪; সহীহ মুসলিম ,হা/২৬০৯; মিশকাত, হা/৫১০৫।
হাসীবুর রহমান বুখারী
Last edited: