সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি আমাদেরকে বরকতময় পবিত্র রামাযান মাসে উপনীত করেছেন, আল-হামদুলিল্লাহ। দরূদ ও তাসলীম বর্ষিত হোক বিশ্বনবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর প্রতি, যিনি এ মহিমান্বিত মাসের সকল সুসংবাদ আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর বাস্তব জীবনে সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। আল্ল-হুম্মা ছল্লি ওয়া সাল্লিম ‘আলা নাবীয়িনা মুহাম্মাদ।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর রামাযান মাস কেন্দ্রিক আমলগুলোকে চারভাবে ভাগ করা যায়। যেমন,
প্রথমতঃ রমযান মাসের প্রারম্ভিক আমলসমূহ
(১) শা‘বান মাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম আদায় করা :
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধারে (এত অধিক) সিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) সিয়াম ছেড়ে দিতেন, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রামাযান ব্যতীত কোন পুরা মাসের সিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে কোন মাসে অধিক (নফল) সিয়াম পালন করতে দেখিনি’।[১]
(২) মহিমান্বিত রামাযান মাসের সুসংবাদ প্রদান :
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘রামাযান আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করা’।[২]
(৩) সিয়ামের হুকুম-আহকাম ও করণীয়-বর্জনীয় বর্ণনা করা :
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের নিকট রামাযান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের উপরে আল্লাহ তা‘আলা অত্র মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এ মাস আগমনে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের গলায় লোহার বেড়ী পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল’।[৩]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’[৪]।
(৪) রামাযান মাসের চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু করা। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলে শা‘বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করা :
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘মাস ঊনত্রিশ রাত বিশিষ্ট হয়। তাই তোমরা চাঁদ না দেখে সিয়াম শুরু করবে না। যদি আকাশ মেঘাবৃত থাকে, তাহলে তোমরা ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে’।[৫]
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
‘লোকেরা রামাযানের চাঁদ অন্বেষণ করছিল। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। অতঃপর তিনি নিজেও সওম রাখলেন এবং লোকদেরকেও রমাযানের সওম পালনের নির্দেশ দিলেন’।[৬]
দ্বিতীয়তঃ রামাযান মাসে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের আমলসমূহ
(১) রামাযান মাসের পূর্ণ সিয়াম পালন করা।
সিয়াম সংশ্লিষ্ট রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কর্মসমূহ নিম্নরূপ :
(ক) দেরিতে সাহরী গ্রহণ করা এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি ইফতার করা। ইবনু আবী ‘আওফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
‘কোন এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বললেন, সওয়ারী হতে নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সূর্য এখনো অস্ত যায়নি। তিনি বললেন, সওয়ারী হতে নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সূর্য এখনো ডুবেনি। তিনি বললেন, সওয়ারী হতে নাম এবং আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। অতঃপর সে সওয়ারী হতে নেমে ছাতু গুলিয়ে আনলে তিনি তা পান করলেন এবং হাতের ইঙ্গিতে বললেন, ‘যখন দেখবে রাত এদিক হতে ঘনিয়ে আসছে, তখন বুঝবে সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির ইফতারের সময় হয়েছে’।[৭]
(খ) ইফতারের দু‘আ পড়া : সাধারণ দু‘আ হিসাবে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।[৮] অতঃপর বলবে,
‘যাহাবায যামাউ ওয়াব তাল্লাতিল ‘উরূকু ওয়া ছাবাতুল আজরু ইনশাআল্লাহ। অনুবাদ : ‘পিপাসা দূরীভূত হয়েছে, শিরা-উপশিরাগুলো সিক্ত হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ প্রতিদানও নির্ধারিত হয়েছে’।[৯]
(গ) কাঁচা/পাকা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা এবং সাহরীতে খেজুর খাওয়া। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মাগরিবের) সালাত আদায়ের পূর্বেই কয়েকটা তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। তিনি তাজা খেজুর না পেলে কয়েকটা শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন আর শুকনো খেজুরও না পেলে তবে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন’।[১০] অপর বর্ণনায় আছে, ‘শীতের সময় শুকনো খেজুর দ্বারা এবং গ্রীষ্মের সময় পানি দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইফতার করতেন।[১১] রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘ঈমানদার ব্যক্তির জন্য খেজুর দিয়ে সাহারী খাওয়া কতই না উত্তম’।[১২]
(ঘ) অল্প পরিমাণ হলেও সাহরী গ্রহণ করা। কেননা সাহারীতে বরকত রয়েছে। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘তোমরা সাহরী গ্রহণ কর। কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে’।[১৩]
ইহুদী-খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের সিয়ামের মধ্য পার্থক্য হল সাহারী গ্রহণ করা। আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘আমাদের ও কিতাবীদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া’।[১৪]
(ঙ) সিয়াম অবস্থায় মেসওয়াক করা। জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও যায়েদ ইবনু খালেদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম অবস্থায় বা সিয়াম অবস্থায় নয় এরূপ অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।[১৫]
ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)ও এদু’টির মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।[১৬]
(চ) রামাযানের রাতে তিনি জুনুবী অবস্থায় ফজর করতেন অথচ তিনি ছায়েম। রামাযানের রাত্রে স্ত্রী সহবাস করে পবিত্র না হয়ে সাহারী করা ও পরে গোসলের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে ফজর সালাত আদায় করা বৈধ। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এবং উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন,
‘নিজ স্ত্রীর সাথে মিলনজনিত অপবিত্র অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফজরের সময় হয়ে যেত। তখন তিনি গোসল করতেন এবং সাওম পালন করতেন’।[১৭]
(ছ) সিয়াম থাকাবস্থায় গরমের উত্তাপে অথবা তৃষ্ণায় মাথায় পানি দিতেন : আবূ বকর ইবনু আব্দুর রহমান (রাহিমাহুল্লাহ) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন এক সাহাবীর থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের বছরে এক সফরে আমি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে লোকদের প্রতি সিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ দিতে দেখেছি। তিনি বলেছেন, দুশমনের মোকাবিলায় তোমরা শক্তি সঞ্চয় কর। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে সিয়াম রেখেছেন। আবূ বকর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসটি বর্ণনাকারী সাহাবী বলেছেন,
‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে ‘আল-‘আর্জ’ নামক স্থানে পিপাসার কারণে বা গরমের ফলে সিয়াম অবস্থায় তাঁর মাথায় পানি ঢালতে দেখেছি’।[১৮]
(জ) ওযূর সময় কুলি করতেন ও নাকে পানি দিতেন। তবে বেশি ভিতরে দিতেন না। লাক্বীত্ব ইবন‘ ছাবরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ওযূ সম্পর্কে অবহিত করুন। তিনি বলেন,
‘পরিপূর্ণরূপে ওযূ করবে, অঙ্গুলসমূহ খিলাল করবে এবং নাকে উত্তমরূপে পানি পৌঁছাবে, তবে সিয়াম অবস্থায় নয়’।[১৯]
(ঝ) তিনি সাহারী-ইফতার না করে একাধারে সিয়াম পালন করতেন, যাকে ‘সিয়ামে বেছাল’ বলা হয়। তবে সেটা তার জন্য খাছ, তাঁর উম্মতের জন্য নয়। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
‘তোমরা ‘সাওমে বিছাল’ পালন করবে না। লোকেরা বলল, আপনি যে ছওমে বিছাল করেন? তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের মত নই। আমাকে পানাহার করানো হয় অথবা বললেন, আমি পানাহার অবস্থায় রাত অতিবাহিত করি’।[২০]
(ঞ) সফর অবস্থায় তিনি কখনো রামাযানের সিয়াম পালন করতেন। তবে কষ্টকর হলে ছেড়েও দিতেন। কেননা সফর অবস্থায় আল্লাহ ছাড় দিয়েছেন। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযান মাসে ছওম অবস্থায় (মক্কা অভিমুখে) সফর করেছেন। অবশেষে তিনি ‘উসফান নামক স্থানে পৌঁছলে একপাত্র পানি দিতে বললেন। তারপর দিনের বেলাতেই তিনি সে পানি পান করলেন। যাতে লোকজনকে তাঁর ছওমবিহীন অবস্থা দেখাতে পারেন। এরপর মক্কা পৌঁছা পর্যন্ত তিনি আর ছওম পালন করেননি। বর্ণনাকারী বলেছেন, পরবর্তীকালে ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলতেন,
‘সফরে কোন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম পালন করতেন আবার কোন সময় তিনি সিয়ামবিহীন অবস্থায়ও ছিলেন। তাই সফরে যার ইচ্ছা সিয়াম পালন করবে যার ইচ্ছা সিয়ামবিহীন থাকবে’। (সফর শেষে বাসস্থানে তা আদায় করে নিতে হবে)।[২১]
(ট) শাওয়ালের চাঁদ দেখে রামাযানের সিয়াম ভঙ্গ করতেন। মেঘের কারণে বা অন্য কারণে চাঁদ দেখা না গেলে রামাযান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করতেন। আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রামাযান বা শা‘বান মাসের সন্দেহযুক্ত দিনে লোকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘শুন! আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের সাথে বসা ছিলাম। আমি তাদের প্রশ্ন করলে তাঁরা আমার কাছে বর্ণনা করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম পালন কর এবং চাঁদ দেখে সিয়াম ভঙ্গ কর। আর চাঁদ দেখেই কুরবানী কর। তবে হ্যাঁ, (শা‘বান মাসের ২৯ তারিখে) যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে তোমরা মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করে নেবে। তবে দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে তোমরা সিয়াম পালন করবে এবং ভঙ্গ করবে’।[২২]
(২) রামাযানের রাতে কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহর সালাত আদায় করা।
আবূ সালামাহ ইবনু আব্দুর রহমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করেন, রামাযান মাসে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযান মাসে এবং অন্যান্য সময় (রাতে) এগার রাক‘আতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। তিনি চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। তুমি সেই সালাতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন কর না। তারপর চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করো না। অতঃপর তিনি তিন রাক‘আত (বিতর) সালাত আদায় করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘(একদা) আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি কি বিতরের পূর্বে ঘুমিয়ে থাকেন? তিনি বললেন, আমার চোখ দু’টি ঘুমায় কিন্তু আমার হৃদয় ঘুমায় না’।[২৩]
(৩) রামাযানে (লাইলাতুল ক্বদর) ই‘তিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রামাযানে ই‘তিকাফ করতেন। ফজরের সালাত শেষে ই‘তিকাফের নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করতেন’।[২৪]
(৪) রামাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করা। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের প্রথম দশকে ই’তিকাফ করলেন। এরপর তিনি মাঝের দশকেও একটি তুর্কি তাঁবুর মধ্যে ই’তিকাফ করলেন এবং তাঁবুর দরজায় একটি চাটাই ঝুলানো ছিল। রাবী বলেন, তিনি নিজ হাতে চাটাই ধরে তা তাঁবুর কোণে রাখলেন, এরপর নিজের মাথা বাইরে এনে লোকদের সাথে কথা বললেন এবং তারাও তার নিকট এগিয়ে এলো। তিনি বললেন,
‘এ রাতের অনুসন্ধানকল্পে আমি (রামাযানের) প্রথম দশকে ই’তিকাফ করলাম। অতঃপর মাঝের দশকে ই‘তিকাফ করলাম। এরপর আমার নিকট একজন আগন্তুক এসে আমাকে বলল, লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে নিহিত আছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ই’তিকাফ করতে চায়, সে যেন ই‘তিকাফ করে। অতঃপর লোকেরা তাঁর সঙ্গে (শেষ দশকে) ই‘তিকাফ করল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বললেন, ‘স্বপ্নে আমাকে তা কোন এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং আমি যেন সে রাতে কাদা ও পানির মধ্যে ফজরের সাজদাহ করছি’।[২৫]
(৫) ফেরেশতা জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-কে রামাযানে কুরআন শুনানো। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সব চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রামাযানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কুরআন শুনাতেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়েও অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন’।[২৬]
(৬) রামাযান মাসে বিনয়ী হওয়া এবং ইবাদতে সাদ্ধমত চেষ্টা চালানো। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
‘লোকেরা রামাযান মাসে মসজিদে বিচ্ছিন্নভাবে সালাত আদায় করত। আমার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নির্দেশ মোতাবেক আমি তাঁর জন্য একটা মাদুর বিছিয়ে দিলে তিনি তার উপর সালাত আদায় করলেন। অতঃপর বর্ণনাকারী ঘটনাটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে লোক সকল! আল্লাহর শপথ! আল্লাহর প্রশংসা, আমার রাতটি আমি গাফিলভাবে অতিবাহিত করিনি এবং তোমাদের অবস্থাও আমার নিকট গোপন থাকেনি’।[২৭]
(৭) মানুষের সাথে সদাচারণ করা ও বেশি বেশি দান, ছাদাক্বাহ করা। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রামাযানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কুরআন শুনাতেন। জিবরীল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়েও অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন’।[২৮]
(৮) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক রামাযান মাসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
‘রামাযানের ষোল দিন অতিবাহিত হবার পর আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ সময় আমাদের কেউ সিয়াম পালন করছিলেন, আবার কেউ তা ছেড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এতে সিয়াম পালনকারী সিয়াম ভঙ্গকারীকে কোন দোষারোপ করেনি এবং সিয়াম ভঙ্গকারীও সিয়াম পালনকারীকে কোন প্রকার দোষারোপ করেনি’।[২৯]
(৯) রামাযানে কিছু আমলের মাধ্যমে ইহুদী-খ্রিস্টানদের বিরোধিতা করা। অর্থাৎ দ্রুত ইফতার এ শেষ সময়ে সাহারী গ্রহণ করা। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘দ্বীন বিজয়ী থাকবে যতদিন লোকেরা অবিলম্বে ইফতার করবে। কেননা ইহুদী ও খ্রিস্টানরা বিলম্বে ইফতার করে’।[৩০]
(১০) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ বয়সে এসে রামাযানে সৎ কাজগুলো বাড়িয়ে দিতেন। যেমন, যে বছর তিনি দুনিয়া থেকে চলে যান, সে বছর জিবরীল আমীনকে ২ বার কুরআন শুনান। ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমবার আমাকে বলেছিলেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) প্রতি বছর একবার আমার সঙ্গে কুরআন পাঠ করতেন, এ বছর দু’বার পড়ে শুনিয়েছেন। আমার মনে হয় আমার বিদায় বেলা উপস্থিত এবং অতঃপর আমার পরিবারেরর মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে। তা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। অতঃপর বলেছিলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, জান্নাতবাসী নারীদের অথবা মুমিন নারীদের তুমি সরদার হবে। এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম’।[৩১]
তৃতীয়তঃ রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরিবার-পরিজনের সাথে কিভাবে সময় অতিবাহিত করতেন :
(এক) রামাযান মাস ও সিয়াম সম্পর্কে বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েল, আদব, শিষ্ঠাচার শিক্ষা দিতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, হে আল্লাহ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি যদি কদরের রাত পেয়ে যাই তবে কী দু‘আ পড়ব? তিনি বলেন, তুমি বলবে, اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيْمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী, আপনি ক্ষমা করতেই ভালবাসেন। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন’।[৩২] অন্যত্র মু‘আযাহ বলেন,
আমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে প্রশ্ন করলাম, ঋতুবতী মহিলা সাওম ক্বাযা করবে এবং সালাত ক্বাযা করবে না এটা কেমন কথা? তিনি বললেন, তুমি কি হারূরিয়্যাহ? আমি বললাম, আমি হারূরিয়্যাহ নই; বরং আমি (জানার জন্যই কেবল) জিজ্ঞেস করছি। তখন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, আমাদের এরূপ হত। তখন আমাদেরকে কেবল সাওম ক্বাযা করার নির্দেশ দেয়া হত, সালাত ক্বাযা করার নির্দেশ দেয়া হত না’।[৩৩]
(দুই) তাঁর পরিবারের লোকজনকে তিনি ইবাদত করে দেখাতেন এবং তাদেরকে এর মাধ্যমে উৎসাহিত করতেন।[৩৪] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন’।[৩৫]
(তিন) পরিবার-পরিজনকে সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে উৎসাহিত করতেন ও তাদেরকে সংশ্লিষ্ট করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রামাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান কর’।[৩৬]
(চার) স্ত্রীদের কে তার সাথে ইতেকাফ করার অনুমতি দেয়া। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর কাছে ই‘তিকাফ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। এরপর হাফছাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। তা দেখে যায়নাব বিনতু জাহশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নিজের জন্য তাঁবু লাগানোর নির্দেশ দিলে তা পালন করা হল’।[৩৭]
(পাঁচ) স্ত্রী-পরিবারকে সাথে নিয়ে রামযানের ইবাদতে শামিল করা। যেমন ক্বিয়ামুল লাইল, ই‘তিকাফ, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে তাঁর কোন এক স্ত্রী ইস্তিহাযা অবস্থায় ই’তিকাফ করেন।[৩৮]
(ছয়) স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করা ও তাদের প্রতি আন্তরিক হওয়া। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব সময় তাঁর স্ত্রীদের নিকটে অতীব প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতেন, রামাযান মাসেও তাদের খোঁজ-খবর ও উত্তম মু‘আমালাত বজায় রাখতেন।[৩৯]
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫৭; মিশকাত, হা/২০৩৬।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯; মিশকাত, হা/১৯৫৬।
[৩]. নাসাঈ, হা/২১০৬; মিশকাত, হা/১৯৬২, সনদ সহীহ।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩; মিশকাত, হা/১৯৯৯।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮২; নাসাঈ, হা/২১১৬।
[৬]. আবূ দাউদ, হা/২৩৪২, সহীহ।
[৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৫, ১৯৫৬, ৫২৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/১১০১।
[৮]. সহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৬; মিশকাত, হা/৪১৫৯।
[৯]. আবু দাউদ, হা/২৩৭৫, হাসান সহীহ।
[১০]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৫৬, সনদ সহীহ।
[১১]. তিরমিযী, হা/৬৯৬; মিশকাত, হা/১৯৯১, সনদ সহীহ।
[১২]. আবূ দাউদ, হা/২৩৪৫; মিশকাত, হা/১৯৯৮, সনদ সহীহ।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৯২৩; সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৫; মিশকাত, হা/১৯৮২।
[১৪]. সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৫; আবূ দাঊদ, হা/২৩৪৩; মিশকাত, হা/১৯৮৩।
[১৫]. সহীহ বুখারী, ১ম খ-, পৃ. ২৫৯, ‘সিয়াম’ অধ্যায়-৩০।
[১৬]. قَالَ فِيهِ مَنْ تَوَضَّأَ وُضُوئِي هَذَا وَلَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ صَائِمٍ وَمُفْطِرٍ -ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহ সহীহ বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফ, ১৩৭৯ হি.), ৪র্থ খ-, পৃ. ১৫৮।
[১৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৮২৯, ১৮২৬; সহীহ মুসলিম, হা/১১০৯।
[১৮]. আবু দাউদ/২৩৬৫; মিশকাত, হা/২০১১, সনদ সহীহ।
[১৯]. আবু দাউদ/১৪২; মিশকাত, হা/৪০৫, সনদ সহীহ।
[২০]. সহীহ বুখারী, হা/১৯৬১,১৯৬৫।
[২১]. সহীহ বুখারী, হা/৪২৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/১১২২; আবূ দাঊদ, হা/২৪০৭।
[২২]. নাসাঈ, হা/২১১৬, সনদ সহীহ।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/১১৪৭; সহীহ মুসলিম, হা/৭৩৮; আবূ দাঊদ, হা/১৩৪১।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০৪১, ২০২৬; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[২৫]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[২৬]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮; মিশকাত, হা/২০৯৮।
[২৭]. আবূ দাঊদ, হা/১৩৭৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৩৪৯, সনদ হাসান সহীহ।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮; মিশকাত, হা/২০৯৮।
[২৯]. সহীহ মুসলিম, হা/১১১৬।
[৩০]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৫৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯৭; মিশকাত, হা/১৯৯৫, সনদ সহীহ।
[৩১]. সহীহ বুখারী, হা/৩৬২৪, ৪৯৯৮।
[৩২]. তিরমিযী, হা/৩৫১৩; মিশকাত, হা/২০৯১, সনদ সহীহ।
[৩৩]. সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫।
[৩৪]. সহীহ বুখারী, হা/১১৪৭; সহীহ মুসলিম, হা/৭৩৮; আবূ দাঊদ, হা/১৩৪১।
[৩৫]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৪; মিশকাত, হা/২০৯০।
[৩৬]. সহীহ বুখারী, হা/২০২০, ২০২৪; তিরমিযী, হা/৭৯৫, ৮০৬।
[৩৭]. সহীহ বুখারী, হা/২০৪৫।
[৩৮]. সহীহ বুখারী, হা/৩০৯; তিরমিযী, হা/৮০৬।
[৩৯]. সহীহ বুখারী, হা/২০৩৩; ফাৎহুল বারী শারহু সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩২৪; আল-মুনতাকা লিল বাজী, পৃ. ২।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর রামাযান মাস কেন্দ্রিক আমলগুলোকে চারভাবে ভাগ করা যায়। যেমন,
প্রথমতঃ রমযান মাসের প্রারম্ভিক আমলসমূহ
(১) শা‘বান মাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম আদায় করা :
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُ حَتَّى نَقُوْلَ لَا يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُوْلَ لَا يَصُوْمُ فَمَا رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلَّا رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِيْ شَعْبَانَ
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধারে (এত অধিক) সিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) সিয়াম ছেড়ে দিতেন, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রামাযান ব্যতীত কোন পুরা মাসের সিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে কোন মাসে অধিক (নফল) সিয়াম পালন করতে দেখিনি’।[১]
(২) মহিমান্বিত রামাযান মাসের সুসংবাদ প্রদান :
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتْ الشَّيَاطِيْنُ
‘রামাযান আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করা’।[২]
(৩) সিয়ামের হুকুম-আহকাম ও করণীয়-বর্জনীয় বর্ণনা করা :
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের নিকট রামাযান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের উপরে আল্লাহ তা‘আলা অত্র মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এ মাস আগমনে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের গলায় লোহার বেড়ী পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল’।[৩]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِيْ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’[৪]।
(৪) রামাযান মাসের চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু করা। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলে শা‘বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করা :
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
الشَّهْرُ تِسْعٌ وَعِشْرُوْنَ لَيْلَةً فَلَا تَصُوْمُوْا حَتَّى تَرَوْهُ فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا الْعِدَّةَ ثَلاَثِيْنَ
‘মাস ঊনত্রিশ রাত বিশিষ্ট হয়। তাই তোমরা চাঁদ না দেখে সিয়াম শুরু করবে না। যদি আকাশ মেঘাবৃত থাকে, তাহলে তোমরা ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে’।[৫]
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
تَرَائِى النَّاسُ الْهِلَالَ فَأَخْبَرْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنِّيْ رَأَيْتُهُ فَصَامَهُ وَأَمَرَ النَّاسَ بِصِيَامِهِ
‘লোকেরা রামাযানের চাঁদ অন্বেষণ করছিল। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। অতঃপর তিনি নিজেও সওম রাখলেন এবং লোকদেরকেও রমাযানের সওম পালনের নির্দেশ দিলেন’।[৬]
দ্বিতীয়তঃ রামাযান মাসে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের আমলসমূহ
(১) রামাযান মাসের পূর্ণ সিয়াম পালন করা।
সিয়াম সংশ্লিষ্ট রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কর্মসমূহ নিম্নরূপ :
(ক) দেরিতে সাহরী গ্রহণ করা এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি ইফতার করা। ইবনু আবী ‘আওফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ سَفَرٍ فَقَالَ لِرَجُلٍ انْزِلْ فَاجْدَحْ لِيْ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الشَّمْسُ قَالَ انْزِلْ فَاجْدَحْ لِيْ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الشَّمْسُ قَالَ انْزِلْ فَاجْدَحْ لِيْ فَنَزَلَ فَجَدَحَ لَهُ فَشَرِبَ ثُمَّ رَمَى بِيَدِهِ هَا هُنَا ثُمَّ قَالَ إِذَا رَأَيْتُمْ اللَّيْلَ أَقْبَلَ مِنْ هَا هُنَا فَقَدْ أَفْطَرَ الصَّائِمُ
‘কোন এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বললেন, সওয়ারী হতে নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সূর্য এখনো অস্ত যায়নি। তিনি বললেন, সওয়ারী হতে নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সূর্য এখনো ডুবেনি। তিনি বললেন, সওয়ারী হতে নাম এবং আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। অতঃপর সে সওয়ারী হতে নেমে ছাতু গুলিয়ে আনলে তিনি তা পান করলেন এবং হাতের ইঙ্গিতে বললেন, ‘যখন দেখবে রাত এদিক হতে ঘনিয়ে আসছে, তখন বুঝবে সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির ইফতারের সময় হয়েছে’।[৭]
(খ) ইফতারের দু‘আ পড়া : সাধারণ দু‘আ হিসাবে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।[৮] অতঃপর বলবে,
ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ
‘যাহাবায যামাউ ওয়াব তাল্লাতিল ‘উরূকু ওয়া ছাবাতুল আজরু ইনশাআল্লাহ। অনুবাদ : ‘পিপাসা দূরীভূত হয়েছে, শিরা-উপশিরাগুলো সিক্ত হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ প্রতিদানও নির্ধারিত হয়েছে’।[৯]
(গ) কাঁচা/পাকা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা এবং সাহরীতে খেজুর খাওয়া। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُفْطِرُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ عَلَى رُطَبَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ فَتُمَيْرَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تُمَيْرَاتٌ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ. أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُفْطِرُ فِي الشِّتَاءِ عَلَى تَمَرَاتٍ وَفِي الصَّيْفِ عَلَى الْمَاءِ
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মাগরিবের) সালাত আদায়ের পূর্বেই কয়েকটা তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। তিনি তাজা খেজুর না পেলে কয়েকটা শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন আর শুকনো খেজুরও না পেলে তবে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন’।[১০] অপর বর্ণনায় আছে, ‘শীতের সময় শুকনো খেজুর দ্বারা এবং গ্রীষ্মের সময় পানি দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইফতার করতেন।[১১] রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
نِعْمَ سَحُوْرُ الْمُؤْمِنِ التَّمْرُ
‘ঈমানদার ব্যক্তির জন্য খেজুর দিয়ে সাহারী খাওয়া কতই না উত্তম’।[১২]
(ঘ) অল্প পরিমাণ হলেও সাহরী গ্রহণ করা। কেননা সাহারীতে বরকত রয়েছে। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
تَسَحَّرُوْا فَإِنَّ فِى السَّحُوْرِ بَرَكَةً
‘তোমরা সাহরী গ্রহণ কর। কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে’।[১৩]
ইহুদী-খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের সিয়ামের মধ্য পার্থক্য হল সাহারী গ্রহণ করা। আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ
‘আমাদের ও কিতাবীদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া’।[১৪]
(ঙ) সিয়াম অবস্থায় মেসওয়াক করা। জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও যায়েদ ইবনু খালেদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম অবস্থায় বা সিয়াম অবস্থায় নয় এরূপ অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।[১৫]
ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)ও এদু’টির মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি।[১৬]
(চ) রামাযানের রাতে তিনি জুনুবী অবস্থায় ফজর করতেন অথচ তিনি ছায়েম। রামাযানের রাত্রে স্ত্রী সহবাস করে পবিত্র না হয়ে সাহারী করা ও পরে গোসলের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে ফজর সালাত আদায় করা বৈধ। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এবং উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُدْرِكُهُ الْفَجْرُ وَهُوَ جُنُبٌ مِنْ أَهْلِهِ ثُمَّ يَغْتَسِلُ وَيَصُوْمُ
‘নিজ স্ত্রীর সাথে মিলনজনিত অপবিত্র অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফজরের সময় হয়ে যেত। তখন তিনি গোসল করতেন এবং সাওম পালন করতেন’।[১৭]
(ছ) সিয়াম থাকাবস্থায় গরমের উত্তাপে অথবা তৃষ্ণায় মাথায় পানি দিতেন : আবূ বকর ইবনু আব্দুর রহমান (রাহিমাহুল্লাহ) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন এক সাহাবীর থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের বছরে এক সফরে আমি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে লোকদের প্রতি সিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ দিতে দেখেছি। তিনি বলেছেন, দুশমনের মোকাবিলায় তোমরা শক্তি সঞ্চয় কর। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে সিয়াম রেখেছেন। আবূ বকর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসটি বর্ণনাকারী সাহাবী বলেছেন,
لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْعَرْجِ يَصُبُّ عَلَى رَأْسِهِ الْمَاءَ وَهُوَ صَائِمٌ مِنَ الْعَطَشِ أَوْ مِنَ الْحَرِّ
‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে ‘আল-‘আর্জ’ নামক স্থানে পিপাসার কারণে বা গরমের ফলে সিয়াম অবস্থায় তাঁর মাথায় পানি ঢালতে দেখেছি’।[১৮]
(জ) ওযূর সময় কুলি করতেন ও নাকে পানি দিতেন। তবে বেশি ভিতরে দিতেন না। লাক্বীত্ব ইবন‘ ছাবরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ওযূ সম্পর্কে অবহিত করুন। তিনি বলেন,
أَسْبِغِ الْوُضُوْءَ وَخَلِّلْ بَيْنَ الأَصَابِعِ وَبَالِغْ فِي الاِسْتِنْشَاقِ إِلَّا أَنْ تَكُوْنَ صَائِمًا
‘পরিপূর্ণরূপে ওযূ করবে, অঙ্গুলসমূহ খিলাল করবে এবং নাকে উত্তমরূপে পানি পৌঁছাবে, তবে সিয়াম অবস্থায় নয়’।[১৯]
(ঝ) তিনি সাহারী-ইফতার না করে একাধারে সিয়াম পালন করতেন, যাকে ‘সিয়ামে বেছাল’ বলা হয়। তবে সেটা তার জন্য খাছ, তাঁর উম্মতের জন্য নয়। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
لَسْتُ كَأَحَدٍ مِنْكُمْ إِنِّي أُطْعَمُ وَأُسْقَى أَوْ إِنِّي أَبِيتُ أُطْعَمُ وَأُسْقَى
‘তোমরা ‘সাওমে বিছাল’ পালন করবে না। লোকেরা বলল, আপনি যে ছওমে বিছাল করেন? তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের মত নই। আমাকে পানাহার করানো হয় অথবা বললেন, আমি পানাহার অবস্থায় রাত অতিবাহিত করি’।[২০]
(ঞ) সফর অবস্থায় তিনি কখনো রামাযানের সিয়াম পালন করতেন। তবে কষ্টকর হলে ছেড়েও দিতেন। কেননা সফর অবস্থায় আল্লাহ ছাড় দিয়েছেন। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযান মাসে ছওম অবস্থায় (মক্কা অভিমুখে) সফর করেছেন। অবশেষে তিনি ‘উসফান নামক স্থানে পৌঁছলে একপাত্র পানি দিতে বললেন। তারপর দিনের বেলাতেই তিনি সে পানি পান করলেন। যাতে লোকজনকে তাঁর ছওমবিহীন অবস্থা দেখাতে পারেন। এরপর মক্কা পৌঁছা পর্যন্ত তিনি আর ছওম পালন করেননি। বর্ণনাকারী বলেছেন, পরবর্তীকালে ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলতেন,
صَامَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي السَّفَرِ وَأَفْطَرَ فَمَنْ شَاءَ صَامَ وَمَنْ شَاءَ أَفْطَرَ
‘সফরে কোন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম পালন করতেন আবার কোন সময় তিনি সিয়ামবিহীন অবস্থায়ও ছিলেন। তাই সফরে যার ইচ্ছা সিয়াম পালন করবে যার ইচ্ছা সিয়ামবিহীন থাকবে’। (সফর শেষে বাসস্থানে তা আদায় করে নিতে হবে)।[২১]
(ট) শাওয়ালের চাঁদ দেখে রামাযানের সিয়াম ভঙ্গ করতেন। মেঘের কারণে বা অন্য কারণে চাঁদ দেখা না গেলে রামাযান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করতেন। আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রামাযান বা শা‘বান মাসের সন্দেহযুক্ত দিনে লোকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘শুন! আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের সাথে বসা ছিলাম। আমি তাদের প্রশ্ন করলে তাঁরা আমার কাছে বর্ণনা করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَانْسُكُوْا لَهَا فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوْا ثَلَاثِيْنَ فَإِنْ شَهِدَ شَاهِدَانِ فَصُوْمُوْا وَأَفْطِرُوْا
‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম পালন কর এবং চাঁদ দেখে সিয়াম ভঙ্গ কর। আর চাঁদ দেখেই কুরবানী কর। তবে হ্যাঁ, (শা‘বান মাসের ২৯ তারিখে) যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে তোমরা মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করে নেবে। তবে দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে তোমরা সিয়াম পালন করবে এবং ভঙ্গ করবে’।[২২]
(২) রামাযানের রাতে কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহর সালাত আদায় করা।
আবূ সালামাহ ইবনু আব্দুর রহমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করেন, রামাযান মাসে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযান মাসে এবং অন্যান্য সময় (রাতে) এগার রাক‘আতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। তিনি চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। তুমি সেই সালাতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন কর না। তারপর চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করো না। অতঃপর তিনি তিন রাক‘আত (বিতর) সালাত আদায় করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘(একদা) আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি কি বিতরের পূর্বে ঘুমিয়ে থাকেন? তিনি বললেন, আমার চোখ দু’টি ঘুমায় কিন্তু আমার হৃদয় ঘুমায় না’।[২৩]
(৩) রামাযানে (লাইলাতুল ক্বদর) ই‘তিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ فِيْ كُلِّ رَمَضَانٍ وَإِذَا صَلَّى الْغَدَاةَ دَخَلَ مَكَانَهُ الَّذِيْ اعْتَكَفَ فِيْهِ
‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রামাযানে ই‘তিকাফ করতেন। ফজরের সালাত শেষে ই‘তিকাফের নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করতেন’।[২৪]
(৪) রামাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করা। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের প্রথম দশকে ই’তিকাফ করলেন। এরপর তিনি মাঝের দশকেও একটি তুর্কি তাঁবুর মধ্যে ই’তিকাফ করলেন এবং তাঁবুর দরজায় একটি চাটাই ঝুলানো ছিল। রাবী বলেন, তিনি নিজ হাতে চাটাই ধরে তা তাঁবুর কোণে রাখলেন, এরপর নিজের মাথা বাইরে এনে লোকদের সাথে কথা বললেন এবং তারাও তার নিকট এগিয়ে এলো। তিনি বললেন,
إِنِّيْ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيْتُ فَقِيْلَ لِيْ إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ قَالَ وَإِنِّيْ أُرِيتُهَا لَيْلَةَ وِتْرٍ وَأَنِّيْ أَسْجُدُ صَبِيْحَتَهَا فِيْ طِيْنٍ وَمَاءٍ
‘এ রাতের অনুসন্ধানকল্পে আমি (রামাযানের) প্রথম দশকে ই’তিকাফ করলাম। অতঃপর মাঝের দশকে ই‘তিকাফ করলাম। এরপর আমার নিকট একজন আগন্তুক এসে আমাকে বলল, লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে নিহিত আছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ই’তিকাফ করতে চায়, সে যেন ই‘তিকাফ করে। অতঃপর লোকেরা তাঁর সঙ্গে (শেষ দশকে) ই‘তিকাফ করল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বললেন, ‘স্বপ্নে আমাকে তা কোন এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং আমি যেন সে রাতে কাদা ও পানির মধ্যে ফজরের সাজদাহ করছি’।[২৫]
(৫) ফেরেশতা জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-কে রামাযানে কুরআন শুনানো। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُوْنُ فِيْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ وَكَانَ جِبْرِيْلُ عَلَيْهِ السَّلَام يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِيْ رَمَضَانَ حَتَّى يَنْسَلِخَ يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقُرْآنَ فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيْلُ عَلَيْهِ السَّلَام كَانَ أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنْ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ
‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সব চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রামাযানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কুরআন শুনাতেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়েও অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন’।[২৬]
(৬) রামাযান মাসে বিনয়ী হওয়া এবং ইবাদতে সাদ্ধমত চেষ্টা চালানো। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
كَانَ النَّاسُ يُصَلُّوْنَ فِي الْمَسْجِدِ فِيْ رَمَضَانَ أَوْزَاعًا فَأَمَرَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضَرَبْتُ لَهُ حَصِيْرًا فَصَلَّى عَلَيْهِ بِهَذِهِ الْقِصَّةِ قَالَتْ فِيْهِ قَالَ تَعْنِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّهَا النَّاسُ أَمَا وَاللهِ مَا بِتُّ لَيْلَتِيْ هَذِهِ بِحَمْدِ اللهِ غَافِلْا وَلَا خَفِيَ عَلَىَّ مَكَانُكُمْ
‘লোকেরা রামাযান মাসে মসজিদে বিচ্ছিন্নভাবে সালাত আদায় করত। আমার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নির্দেশ মোতাবেক আমি তাঁর জন্য একটা মাদুর বিছিয়ে দিলে তিনি তার উপর সালাত আদায় করলেন। অতঃপর বর্ণনাকারী ঘটনাটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে লোক সকল! আল্লাহর শপথ! আল্লাহর প্রশংসা, আমার রাতটি আমি গাফিলভাবে অতিবাহিত করিনি এবং তোমাদের অবস্থাও আমার নিকট গোপন থাকেনি’।[২৭]
(৭) মানুষের সাথে সদাচারণ করা ও বেশি বেশি দান, ছাদাক্বাহ করা। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রামাযানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কুরআন শুনাতেন। জিবরীল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়েও অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন’।[২৮]
(৮) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক রামাযান মাসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
غَزَوْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِسِتَّ عَشْرَةَ مَضَتْ مِنْ رَمَضَانَ فَمِنَّا مَنْ صَامَ وَمِنَّا مَنْ أَفْطَرَ فَلَمْ يَعِبِ الصَّائِمُ عَلَى الْمُفْطِرِ وَلَا الْمُفْطِرُ عَلَى الصَّائِمِ
‘রামাযানের ষোল দিন অতিবাহিত হবার পর আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ সময় আমাদের কেউ সিয়াম পালন করছিলেন, আবার কেউ তা ছেড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এতে সিয়াম পালনকারী সিয়াম ভঙ্গকারীকে কোন দোষারোপ করেনি এবং সিয়াম ভঙ্গকারীও সিয়াম পালনকারীকে কোন প্রকার দোষারোপ করেনি’।[২৯]
(৯) রামাযানে কিছু আমলের মাধ্যমে ইহুদী-খ্রিস্টানদের বিরোধিতা করা। অর্থাৎ দ্রুত ইফতার এ শেষ সময়ে সাহারী গ্রহণ করা। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
لَا يَزَالُ الدِّيْنُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُوْنَ
‘দ্বীন বিজয়ী থাকবে যতদিন লোকেরা অবিলম্বে ইফতার করবে। কেননা ইহুদী ও খ্রিস্টানরা বিলম্বে ইফতার করে’।[৩০]
(১০) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ বয়সে এসে রামাযানে সৎ কাজগুলো বাড়িয়ে দিতেন। যেমন, যে বছর তিনি দুনিয়া থেকে চলে যান, সে বছর জিবরীল আমীনকে ২ বার কুরআন শুনান। ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
أَسَرَّ إِلَيَّ إِنَّ جِبْرِيْلَ كَانَ يُعَارِضُنِي الْقُرْآنَ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً وَإِنَّهُ عَارَضَنِي الْعَامَ مَرَّتَيْنِ وَلَا أُرَاهُ إِلَّا حَضَرَ أَجَلِيْ وَإِنَّكِ أَوَّلُ أَهْلِ بَيْتِيْ لَحَاقًا بِيْ فَبَكَيْتُ فَقَالَ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ تَكُوْنِيْ سَيِّدَةَ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ أَوْ نِسَاءِ الْمُؤْمِنِيْنَ فَضَحِكْتُ لِذَلِكَ
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমবার আমাকে বলেছিলেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) প্রতি বছর একবার আমার সঙ্গে কুরআন পাঠ করতেন, এ বছর দু’বার পড়ে শুনিয়েছেন। আমার মনে হয় আমার বিদায় বেলা উপস্থিত এবং অতঃপর আমার পরিবারেরর মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে। তা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। অতঃপর বলেছিলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, জান্নাতবাসী নারীদের অথবা মুমিন নারীদের তুমি সরদার হবে। এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম’।[৩১]
তৃতীয়তঃ রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরিবার-পরিজনের সাথে কিভাবে সময় অতিবাহিত করতেন :
(এক) রামাযান মাস ও সিয়াম সম্পর্কে বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েল, আদব, শিষ্ঠাচার শিক্ষা দিতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, হে আল্লাহ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি যদি কদরের রাত পেয়ে যাই তবে কী দু‘আ পড়ব? তিনি বলেন, তুমি বলবে, اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيْمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী, আপনি ক্ষমা করতেই ভালবাসেন। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন’।[৩২] অন্যত্র মু‘আযাহ বলেন,
سَأَلْتُ عَائِشَةَ فَقُلْتُ مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِي الصَّوْمَ وَلَا تَقْضِي الصَّلَاةَ فَقَالَتْ أَحَرُوْرِيَّةٌ أَنْتِ؟ قُلْتُ لَسْتُ بِحَرُوْرِيَّةٍ وَلَكِنِّيْ أَسْأَلُ قَالَتْ كَانَ يُصِيْبُنَا ذَلِكَ فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلَا نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلَاةِ
আমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে প্রশ্ন করলাম, ঋতুবতী মহিলা সাওম ক্বাযা করবে এবং সালাত ক্বাযা করবে না এটা কেমন কথা? তিনি বললেন, তুমি কি হারূরিয়্যাহ? আমি বললাম, আমি হারূরিয়্যাহ নই; বরং আমি (জানার জন্যই কেবল) জিজ্ঞেস করছি। তখন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, আমাদের এরূপ হত। তখন আমাদেরকে কেবল সাওম ক্বাযা করার নির্দেশ দেয়া হত, সালাত ক্বাযা করার নির্দেশ দেয়া হত না’।[৩৩]
(দুই) তাঁর পরিবারের লোকজনকে তিনি ইবাদত করে দেখাতেন এবং তাদেরকে এর মাধ্যমে উৎসাহিত করতেন।[৩৪] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ
‘যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন’।[৩৫]
(তিন) পরিবার-পরিজনকে সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে উৎসাহিত করতেন ও তাদেরকে সংশ্লিষ্ট করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ وَيَقُولُ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রামাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান কর’।[৩৬]
(চার) স্ত্রীদের কে তার সাথে ইতেকাফ করার অনুমতি দেয়া। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرَ أَنْ يَعْتَكِفَ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ فَاسْتَأْذَنَتْهُ عَائِشَةُ فَأَذِنَ لَهَا وَسَأَلَتْ حَفْصَةُ عَائِشَةَ أَنْ تَسْتَأْذِنَ لَهَا فَفَعَلَتْ فَلَمَّا رَأَتْ ذَلِكَ زَيْنَبُ ابْنَةُ جَحْشٍ أَمَرَتْ بِبِنَاءٍ فَبُنِيَ لَهَا.
‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর কাছে ই‘তিকাফ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। এরপর হাফছাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। তা দেখে যায়নাব বিনতু জাহশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নিজের জন্য তাঁবু লাগানোর নির্দেশ দিলে তা পালন করা হল’।[৩৭]
(পাঁচ) স্ত্রী-পরিবারকে সাথে নিয়ে রামযানের ইবাদতে শামিল করা। যেমন ক্বিয়ামুল লাইল, ই‘তিকাফ, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে তাঁর কোন এক স্ত্রী ইস্তিহাযা অবস্থায় ই’তিকাফ করেন।[৩৮]
(ছয়) স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করা ও তাদের প্রতি আন্তরিক হওয়া। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব সময় তাঁর স্ত্রীদের নিকটে অতীব প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতেন, রামাযান মাসেও তাদের খোঁজ-খবর ও উত্তম মু‘আমালাত বজায় রাখতেন।[৩৯]
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫৭; মিশকাত, হা/২০৩৬।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯; মিশকাত, হা/১৯৫৬।
[৩]. নাসাঈ, হা/২১০৬; মিশকাত, হা/১৯৬২, সনদ সহীহ।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩; মিশকাত, হা/১৯৯৯।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮২; নাসাঈ, হা/২১১৬।
[৬]. আবূ দাউদ, হা/২৩৪২, সহীহ।
[৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৫, ১৯৫৬, ৫২৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/১১০১।
[৮]. সহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৬; মিশকাত, হা/৪১৫৯।
[৯]. আবু দাউদ, হা/২৩৭৫, হাসান সহীহ।
[১০]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৫৬, সনদ সহীহ।
[১১]. তিরমিযী, হা/৬৯৬; মিশকাত, হা/১৯৯১, সনদ সহীহ।
[১২]. আবূ দাউদ, হা/২৩৪৫; মিশকাত, হা/১৯৯৮, সনদ সহীহ।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৯২৩; সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৫; মিশকাত, হা/১৯৮২।
[১৪]. সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৫; আবূ দাঊদ, হা/২৩৪৩; মিশকাত, হা/১৯৮৩।
[১৫]. সহীহ বুখারী, ১ম খ-, পৃ. ২৫৯, ‘সিয়াম’ অধ্যায়-৩০।
[১৬]. قَالَ فِيهِ مَنْ تَوَضَّأَ وُضُوئِي هَذَا وَلَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ صَائِمٍ وَمُفْطِرٍ -ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহ সহীহ বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফ, ১৩৭৯ হি.), ৪র্থ খ-, পৃ. ১৫৮।
[১৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৮২৯, ১৮২৬; সহীহ মুসলিম, হা/১১০৯।
[১৮]. আবু দাউদ/২৩৬৫; মিশকাত, হা/২০১১, সনদ সহীহ।
[১৯]. আবু দাউদ/১৪২; মিশকাত, হা/৪০৫, সনদ সহীহ।
[২০]. সহীহ বুখারী, হা/১৯৬১,১৯৬৫।
[২১]. সহীহ বুখারী, হা/৪২৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/১১২২; আবূ দাঊদ, হা/২৪০৭।
[২২]. নাসাঈ, হা/২১১৬, সনদ সহীহ।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/১১৪৭; সহীহ মুসলিম, হা/৭৩৮; আবূ দাঊদ, হা/১৩৪১।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০৪১, ২০২৬; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[২৫]. সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।
[২৬]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮; মিশকাত, হা/২০৯৮।
[২৭]. আবূ দাঊদ, হা/১৩৭৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৩৪৯, সনদ হাসান সহীহ।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮; মিশকাত, হা/২০৯৮।
[২৯]. সহীহ মুসলিম, হা/১১১৬।
[৩০]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৫৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯৭; মিশকাত, হা/১৯৯৫, সনদ সহীহ।
[৩১]. সহীহ বুখারী, হা/৩৬২৪, ৪৯৯৮।
[৩২]. তিরমিযী, হা/৩৫১৩; মিশকাত, হা/২০৯১, সনদ সহীহ।
[৩৩]. সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫।
[৩৪]. সহীহ বুখারী, হা/১১৪৭; সহীহ মুসলিম, হা/৭৩৮; আবূ দাঊদ, হা/১৩৪১।
[৩৫]. সহীহ বুখারী, হা/২০২৪; মিশকাত, হা/২০৯০।
[৩৬]. সহীহ বুখারী, হা/২০২০, ২০২৪; তিরমিযী, হা/৭৯৫, ৮০৬।
[৩৭]. সহীহ বুখারী, হা/২০৪৫।
[৩৮]. সহীহ বুখারী, হা/৩০৯; তিরমিযী, হা/৮০৬।
[৩৯]. সহীহ বুখারী, হা/২০৩৩; ফাৎহুল বারী শারহু সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩২৪; আল-মুনতাকা লিল বাজী, পৃ. ২।
-শরীফ বিন আব্দুস সামাদ
Last edited: