If you're in doubt ask الله.
Forum Staff
Moderator
Generous
ilm Seeker
Uploader
Exposer
HistoryLover
Q&A Master
Salafi User
প্রশ্ন: ফাযীলাতুশ শাইখ! সালাফী দাওয়াতের ব্যাপারে আপনার মতামত কী? বিশেষ করে কুয়েত, মিশর ও সৌদি আরবের সালাফী দাওয়াত।
জবাব: দুঃখজনক হলেও সত্য কথা বলছি যে, বর্তমানে সালাফী দাওয়াত বিশৃঙ্খলার মাঝে রয়েছে। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে, কিছু মুসলিম যুবক খুব জলদি নিজেদেরকে জ্ঞানী মনে করে বসছে। এরপর তারা ফাতাওয়া প্রদান এবং কোনো কিছুর ব্যাপারে হালাল-হারামের সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো দুঃসাহস করতে থাকে। অথচ তাদের ব্যাপারে শুনেছি, তারা দেখে দেখে কুরআন পর্যন্ত পড়তে পারে না আর নির্ভুলভাবে হাদীস পড়া তো অনেক দূরের কথা। এসব যুবকের ব্যাপারে এ প্রবাদ বাক্যটা প্রযোজ্য: আঙুর কাঁচা ও টক থাকতেই সে কিশমিশ বানিয়ে ফেলেছে।
এসব যুবকের অনেকেই খুব সহজেই নিজেকে আলিম দাবি করে এবং লেখক হিসেবে জাহির করে। অথচ তারা জ্ঞানের অর্ধেক রাস্তায়ও চলেনি। এরা বর্তমানে নিজেদেরকে সালাফী দাওয়াতের দিকে সম্পৃক্ত করে। অথচ দুঃখজনক হলেও তা বিভক্তি ও দলাদলি।
এই ব্যাধির একমাত্র প্রতিষেধক হলে, এসব লোকদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং একথা জেনে রাখা যে, জ্ঞানার্জনের শুরুতেই হালাল-হারামের ফাতাওয়া প্রদান এবং হাদীসের সহীহ-যঈফ নির্ধারণ করা যায় না। এর জন্য ব্যয় করতে হয় লম্বা সময়। এখন তো ফাতাওয়া প্রদানের পদ্ধতি এবং কুরআন-সুন্নাহ থেকে মাসআলা উদঘাটন পদ্ধতি রপ্ত করার বয়স।
এসব দাঈ বা সালাফীর ক্ষেত্রে তৃতীয় আরেকটি শর্ত বেঁধে দিতে হবে। আমি শর্তটি ‘উপকারী ইলম ও সৎআমল’ বিষয়ক আলোচনার সময় উল্লেখ করেছি। আমরা বলেছিলাম, ইলম উপকারী হতে হলে তা সালফে সালিহীনের মানহাজ অনুযায়ী হতে হবে।
বর্তমানে অনেক ইসলামী দাঈ এই তৃতীয় শর্ত থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এদিকে ইশারা করে বলেছেন, ‘ইলম তো তা-ই, যা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সাহাবীগণ বলেছেন। প্রলেপদান কোনো ইলম নয়।’
সালাফদের অনুসৃত মানহাজের দিকে যদি ভ্রুক্ষেপ করা না-হয়, তাহলে মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আবারও বিভক্ত হয়ে পড়বে; যেভাবে ইতঃপূর্বে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এভাবে তারা বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভাজন হয়ে পড়বে। আর প্রত্যেক দল তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যা তাদের কাছে থাকে। বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে এটাই আমার মত।
অতএব, তারা যদি একনিষ্ঠ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কাছে আমাদের দাবি, তারা যেন জ্ঞানভিত্তিক সঠিক নীতি-আদর্শ আঁকড়ে ধরে এবং প্রকৃতার্থে যতদিন জ্ঞানের স্তরে না পৌঁছবে, ততদিন ফাতাওয়া প্রদানের দুঃসাহস না দেখায়। বরং ফাতাওয়া প্রদান থেকে সংযত থাকবে এবং ফাতাওয়া প্রদানের দায়িত্ব আলিমদের কাছে ন্যস্ত করবে।
এ প্রসঙ্গে হাদীসের কিতাবে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সম্ভবত আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন, সালাফে সালিহীনদের একজন অন্যতম বিজ্ঞ আলিম। তিনি বলেন, সম্ভবত তিনি মসজিদে নববীর দিকে ইশারা করে বলেছিলেন, আমি এই মসজিদে ৭০ জন সাহাবীকে পেয়েছিলাম। তাদের কারো কাছে ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করা হলে তারা চাইতেন, এই ফাতাওয়া প্রদানের কাজ তার কাঁধে না এসে যদি উপস্থিত অন্য কোনো আলিম সাহাবীকে কাঁধে আসতো! এর কারণ কী? তারা ভয় করতেন, তাদের ভুলের কারণে অন্যকেও তারা ভুলের মাঝে নিক্ষেপ করবেন। তাই তারা খুব করে চাইতেন যে, এই গুরু দায়িত্ব তিনি বহন না করে যদি অন্য কেউ বহন করতেন।
চরম দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান যুগের দৃশ্য তাদের দৃশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এমনটি হওয়ার পেছনে অতিস্পষ্ট একটি কারণ রয়েছে। আমি কারণটি সবসময় উল্লেখ করি। আমরা বুঝতে পারি, বর্তমানে কিতাব, সুন্নাহ ও সালাফী দাওয়াতের জন্য একটি চেতনা শুরু হয়েছে। এই চেতনার বয়স বেশি না হলেও মানুষেরা এই চেতনার ফল পেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ তারা কিতাব ও সুন্নাহর ভিত্তির ওপর লালিত-পালিত হচ্ছে। এরপর কিতাব-সুন্নাহর ওপর ভিত্তিশীল সঠিক লালনপালনের সাথে তারা আশেপাশের বিভিন্ন জিনিস সংযুক্ত করছে।
এই চেতনার সূচনার কারণ হচ্ছে এই দাওয়াত এখনও তার প্রভাব ফেলতে শুরু করেনি। কারণ, বর্তমান যুগে এই দাওয়াতের বয়স এখনও অল্প। এ কারণে আমরা সাহাবীদের দৃশ্যের উলটো দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি; যে দৃশ্যের কথা আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা উল্লেখ করেছেন যে, সাহাবীগণ সতর্ক থাকতেন তাদেরকে যেন কোনো ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করা না-হয়। তারা চাইতেন, অন্যদেরকে যেন জিজ্ঞেস করা হয়। তারা কেবল এ জন্য প্রশ্নের উত্তর দিতেন যে, ইলম গোপন করা জায়েয নয়। এ কারণে তারা ফাতাওয়া দিলেও তাদের হৃদয়ের গহিন আকুতি থাকতো, এই দায়িত্ব যদি অন্য কারো কাঁধে পড়তো!
কিন্তু বর্তমান অবস্থা কী? অন্য সমাজ ও মজলিস তো দূরের কথা আপনি অনেক সালাফী সমাজ ও মজলিসে দেখতে পাবেন, একজন ব্যক্তি এসে উপস্থিতদের মাঝে যাকে বেশি জ্ঞানী মনে হয় তাকে কোনো ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করে। কিন্তু পাশের আরেকজন উত্তর দিতে শুরু করে অথচ তাকে প্রশ্ন করা হয়নি। এমন পরিস্থিতি ও দৃশ্য কেন দেখতে হচ্ছে? কারণ, নিজেকে জাহির করার নেশা, নিজের আমিত্ব প্রকাশ করা এবং একথা জানানো যে আমার এখানে ইলম পাবে।
এমন দৃশ্য প্রমাণ করে, আমরা সালাফদের জ্ঞানের ওপর বেড়ে ওঠলেও সালাফী পদ্ধতিতে লালিত-পালিত হইনি। আমরা প্রত্যেকেই নিজের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় এই ইলম অর্জন করলেও আজ পর্যন্ত সালাফদের ইসলামী সমাজের আদলে লালনপালন করা হয়নি।
এ কারণে আজ এত জামাআত, এত দল। প্রত্যেক দলেই এতগুলো দল। এমন বিভক্তির কারণ হিসেবে আমরা যা পাই তা হলো, সঠিকভাবে ইসলামী লালনপালনের অভাব।
আমি প্রায় বিশ বছর থেকে বলে আসছি, এই উম্মাতকে তার পুরাতন সম্মান ফিরিয়ে আনতে হলে এবং রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে এর একমাত্র পথ ও পদ্ধতি হলো, আমি যাকে সংক্ষিপ্তভাবে বলি তাসফিয়া ও তারবিয়া। এর বিপরীতে অনেক জামাআত মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য যে পদ্ধতির পেছনে শ্রম ব্যয় করে, তা হলো, শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে। কতক দল এর জন্য শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি যেমন নির্বাচনকে গ্রহণ করেছে আর কতক দল রক্তক্ষয়ী পদ্ধতি যেমন বিদ্রোহ ও সেনা অভ্যুদয়কে গ্রহণ করেছে।
আমি বলি, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার এটি পদ্ধতি নয়। বরং এর জন্য সঠিক পদ্ধতি হলো, নববী পদ্ধতি। আপনারা জানেন, নবী ﷺ মক্কায় ১৩ বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন এরপর মদীনায় দাওয়াত পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর অনুসারীদেরকে এবং ঈমানদারকে খাঁটি ও স্বচ্ছ করার পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
বলা হয়ে থাকে, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আমি নিশ্চিতভাবে বলছি এবং অল্পদূরের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা একথা প্রমাণ করে যে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী পূনর্জাগরণ হওয়া এবং মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে:
আমরা বর্তমানে ইলমী চেতনা ও জাগরণের যুগে বাস করছি কিন্তু আমাদের মাঝে লালনপালন ও গড়ে তোলার চেতনা ও জাগরণ নেই। এ কারণে আমরা অনেক দাঈকে দেখি, তাদের ইলম থেকে উপকৃত হওয়া যায় কিন্তু তাদের চরিত্র থেকে উপকৃত হওয়া যায় না। কারণ, তারা ইলমের ওপর নিজেকে গড়ে তুলেছেন কিন্তু ছেলেবেলা থেকে ভালো পরিবেশে বেড়ে উঠেননি। ফলে তারা যে সমাজের মাঝে বসবাস করেছেন, সে সমাজের চরিত্র নিজের মাঝে ধারণ করেছেন। নিঃসন্দেহে সে-সমাজ ইসলামী সমাজ নয়। তারা নিজের ব্যক্তিগত চেষ্টায় বা কোনো আলিমের পরামর্শে সঠিক জ্ঞানের রাস্তায় চলেছেন কিন্তু অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব তাদের চরিত্রে, চালচলনে ও কাজকর্মে প্রকাশ পায় না।
আমরা যে পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কথা আলোচনা করছি এর কারণ হচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক ছাড়া আমাদের ইলম পরিপক্ক হয়নি।
দ্বিতীয়ত: এই সমস্ত লোকের অধিকাংশ সঠিক ইসলামী পদ্ধতিতে লালিত-পালিত হয়নি। এ কারণে প্রাথমিক স্তরের অনেক তালিবুল ইলমকে পাবেন, তারা তালিবুল ইলম হওয়া সত্ত্বেও কোনো জামাআত বা দলের নেতা বা প্রধানের পদে নিজেকে আসীন করে বসে আছে। এই যে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা, এই প্রবণতার ব্যাপারে একটি প্রাচীন বাগধারা হচ্ছে, নিজেকে জাহির করার নেশা পিঠকে ভেঙ্গে ফেলে। নিজেকে জাহির করার প্রবণতার কারণ হচ্ছে, সঠিক ইলমের ওপর সঠিকভাবে লালনপালনের অভাব।[1]
ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহ অন্যত্র বলেন, আমি এখানে আরেকটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। অতীত যুগগুলোতে আমরা যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম, বর্তমানে এসে তার বিপরীত বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। অতীত যুগগুলোতে জনসাধারণ ও তালিবুল ইলম তো দূরের কথা আলিমগণও গোঁড়ামি ও তাকলীদে লিপ্ত থাকতেন। আমরা তখন মাযহাবের তাকলীদী গোঁড়ামির বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম।
অনেক যুগ ধরে মুসলিমদের মাঝ থেকে এই গোঁড়ামি বিদায় নিয়েছে। আমরা বর্তমানে এখন কিতাব ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের এক বরকতপূর্ণ যুগে বসবাস করছি। নিঃসন্দেহে এই বরকতপূর্ণ যুগ তার ফুল-ফল আমাদেরকে প্রদান করছে। তবে আমরা পূর্বযুগের যে সমস্যা ছিল, তার বিপরীত সমস্যার মুখোমুখি। আমরা আগে অভিযোগ করতাম গোঁড়ামি নিয়ে আর এখন অভিযোগ করি মুক্তচিন্তা নিয়ে।
অনেকে কারো থেকে কুরআন ও হাদীসের কিছু কথা শুনে অথবা কোনো দাঈ থেকে ভুল-সঠিক মিশ্রিত কোনো আলোচনা শুনে নিজেকে আলিম ভাবতে শুরু করে। অথচ সে কুরআন ও সুন্নাহর কিছুই বুঝে না। ‘আমার মতে অমুক, আমার সিদ্ধান্ত অমুক, আমার মতে এই মত ভুল’ এভাবে বলাকে নিজেদের জন্য জায়েয মনে করে। তারা ছোটো-বড়ো সকল ব্যাপারেই প্রবেশ করে। অথচ তারা একটি হাদীসও পড়তে জানে না।
এটি অত্যন্ত ভয়ানক ব্যাপার। আমার মতে, যদি এই অবস্থা চালু হয় যে, প্রত্যেক মুসলিম নিজেকে আলিম দাবি করতে থাকে এবং মুজতাহিদ মনে করতে থাকে, তাহলে আমার কাছে এই অবস্থার তুলনায় উত্তম হলো―বাপ-দাদাদের মতো চার মাযহাবের অনুসরণ করা, মাযহাবের ব্যাপারে গোঁড়ামি করা এবং জ্ঞানার্জন করেনি এমন জাহিলদের মতামত নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা। কারণ, কোনো ক্ষতি থেকে কোনো ক্ষতি তুলনামূলক হালকা হয়।
এক ইরাকী মনীষী ও সাহিত্যিক খুব সুন্দর কথা বলেছেন; যদিও তার কথায় কিছু সংশোধন করা যায়। তিনি বলেছেন, কারো তাকলীদ করে সঠিকতায় পৌঁছার তুলনায় ইজতিহাদ করতে গিয়ে ভুল করাটা আমার কাছে বেশি প্রিয়। আমি বলব, ইজতিহাদ করে সঠিকতায় পৌঁছার তুলনায় কারো তাকলীদ করে সঠিকতায় পৌঁছা আমার কাছে বেশি প্রিয়। কারণ, ভুল কখনো সঠিকের তুলনায় ভালো হতে পারে না।[2]
[1] তুরাসুল আলবানী ফিল মানহাজ, ১/১৮৪-১৮৮
[2] তুরাসুল আলবানী ফিল মানহাজ, ১/২০০
জবাব: দুঃখজনক হলেও সত্য কথা বলছি যে, বর্তমানে সালাফী দাওয়াত বিশৃঙ্খলার মাঝে রয়েছে। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে, কিছু মুসলিম যুবক খুব জলদি নিজেদেরকে জ্ঞানী মনে করে বসছে। এরপর তারা ফাতাওয়া প্রদান এবং কোনো কিছুর ব্যাপারে হালাল-হারামের সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো দুঃসাহস করতে থাকে। অথচ তাদের ব্যাপারে শুনেছি, তারা দেখে দেখে কুরআন পর্যন্ত পড়তে পারে না আর নির্ভুলভাবে হাদীস পড়া তো অনেক দূরের কথা। এসব যুবকের ব্যাপারে এ প্রবাদ বাক্যটা প্রযোজ্য: আঙুর কাঁচা ও টক থাকতেই সে কিশমিশ বানিয়ে ফেলেছে।
এসব যুবকের অনেকেই খুব সহজেই নিজেকে আলিম দাবি করে এবং লেখক হিসেবে জাহির করে। অথচ তারা জ্ঞানের অর্ধেক রাস্তায়ও চলেনি। এরা বর্তমানে নিজেদেরকে সালাফী দাওয়াতের দিকে সম্পৃক্ত করে। অথচ দুঃখজনক হলেও তা বিভক্তি ও দলাদলি।
এই ব্যাধির একমাত্র প্রতিষেধক হলে, এসব লোকদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং একথা জেনে রাখা যে, জ্ঞানার্জনের শুরুতেই হালাল-হারামের ফাতাওয়া প্রদান এবং হাদীসের সহীহ-যঈফ নির্ধারণ করা যায় না। এর জন্য ব্যয় করতে হয় লম্বা সময়। এখন তো ফাতাওয়া প্রদানের পদ্ধতি এবং কুরআন-সুন্নাহ থেকে মাসআলা উদঘাটন পদ্ধতি রপ্ত করার বয়স।
এসব দাঈ বা সালাফীর ক্ষেত্রে তৃতীয় আরেকটি শর্ত বেঁধে দিতে হবে। আমি শর্তটি ‘উপকারী ইলম ও সৎআমল’ বিষয়ক আলোচনার সময় উল্লেখ করেছি। আমরা বলেছিলাম, ইলম উপকারী হতে হলে তা সালফে সালিহীনের মানহাজ অনুযায়ী হতে হবে।
বর্তমানে অনেক ইসলামী দাঈ এই তৃতীয় শর্ত থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এদিকে ইশারা করে বলেছেন, ‘ইলম তো তা-ই, যা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সাহাবীগণ বলেছেন। প্রলেপদান কোনো ইলম নয়।’
সালাফদের অনুসৃত মানহাজের দিকে যদি ভ্রুক্ষেপ করা না-হয়, তাহলে মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আবারও বিভক্ত হয়ে পড়বে; যেভাবে ইতঃপূর্বে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এভাবে তারা বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভাজন হয়ে পড়বে। আর প্রত্যেক দল তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যা তাদের কাছে থাকে। বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে এটাই আমার মত।
অতএব, তারা যদি একনিষ্ঠ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কাছে আমাদের দাবি, তারা যেন জ্ঞানভিত্তিক সঠিক নীতি-আদর্শ আঁকড়ে ধরে এবং প্রকৃতার্থে যতদিন জ্ঞানের স্তরে না পৌঁছবে, ততদিন ফাতাওয়া প্রদানের দুঃসাহস না দেখায়। বরং ফাতাওয়া প্রদান থেকে সংযত থাকবে এবং ফাতাওয়া প্রদানের দায়িত্ব আলিমদের কাছে ন্যস্ত করবে।
এ প্রসঙ্গে হাদীসের কিতাবে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সম্ভবত আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন, সালাফে সালিহীনদের একজন অন্যতম বিজ্ঞ আলিম। তিনি বলেন, সম্ভবত তিনি মসজিদে নববীর দিকে ইশারা করে বলেছিলেন, আমি এই মসজিদে ৭০ জন সাহাবীকে পেয়েছিলাম। তাদের কারো কাছে ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করা হলে তারা চাইতেন, এই ফাতাওয়া প্রদানের কাজ তার কাঁধে না এসে যদি উপস্থিত অন্য কোনো আলিম সাহাবীকে কাঁধে আসতো! এর কারণ কী? তারা ভয় করতেন, তাদের ভুলের কারণে অন্যকেও তারা ভুলের মাঝে নিক্ষেপ করবেন। তাই তারা খুব করে চাইতেন যে, এই গুরু দায়িত্ব তিনি বহন না করে যদি অন্য কেউ বহন করতেন।
চরম দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান যুগের দৃশ্য তাদের দৃশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এমনটি হওয়ার পেছনে অতিস্পষ্ট একটি কারণ রয়েছে। আমি কারণটি সবসময় উল্লেখ করি। আমরা বুঝতে পারি, বর্তমানে কিতাব, সুন্নাহ ও সালাফী দাওয়াতের জন্য একটি চেতনা শুরু হয়েছে। এই চেতনার বয়স বেশি না হলেও মানুষেরা এই চেতনার ফল পেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ তারা কিতাব ও সুন্নাহর ভিত্তির ওপর লালিত-পালিত হচ্ছে। এরপর কিতাব-সুন্নাহর ওপর ভিত্তিশীল সঠিক লালনপালনের সাথে তারা আশেপাশের বিভিন্ন জিনিস সংযুক্ত করছে।
এই চেতনার সূচনার কারণ হচ্ছে এই দাওয়াত এখনও তার প্রভাব ফেলতে শুরু করেনি। কারণ, বর্তমান যুগে এই দাওয়াতের বয়স এখনও অল্প। এ কারণে আমরা সাহাবীদের দৃশ্যের উলটো দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি; যে দৃশ্যের কথা আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা উল্লেখ করেছেন যে, সাহাবীগণ সতর্ক থাকতেন তাদেরকে যেন কোনো ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করা না-হয়। তারা চাইতেন, অন্যদেরকে যেন জিজ্ঞেস করা হয়। তারা কেবল এ জন্য প্রশ্নের উত্তর দিতেন যে, ইলম গোপন করা জায়েয নয়। এ কারণে তারা ফাতাওয়া দিলেও তাদের হৃদয়ের গহিন আকুতি থাকতো, এই দায়িত্ব যদি অন্য কারো কাঁধে পড়তো!
কিন্তু বর্তমান অবস্থা কী? অন্য সমাজ ও মজলিস তো দূরের কথা আপনি অনেক সালাফী সমাজ ও মজলিসে দেখতে পাবেন, একজন ব্যক্তি এসে উপস্থিতদের মাঝে যাকে বেশি জ্ঞানী মনে হয় তাকে কোনো ফাতাওয়া জিজ্ঞেস করে। কিন্তু পাশের আরেকজন উত্তর দিতে শুরু করে অথচ তাকে প্রশ্ন করা হয়নি। এমন পরিস্থিতি ও দৃশ্য কেন দেখতে হচ্ছে? কারণ, নিজেকে জাহির করার নেশা, নিজের আমিত্ব প্রকাশ করা এবং একথা জানানো যে আমার এখানে ইলম পাবে।
এমন দৃশ্য প্রমাণ করে, আমরা সালাফদের জ্ঞানের ওপর বেড়ে ওঠলেও সালাফী পদ্ধতিতে লালিত-পালিত হইনি। আমরা প্রত্যেকেই নিজের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় এই ইলম অর্জন করলেও আজ পর্যন্ত সালাফদের ইসলামী সমাজের আদলে লালনপালন করা হয়নি।
এ কারণে আজ এত জামাআত, এত দল। প্রত্যেক দলেই এতগুলো দল। এমন বিভক্তির কারণ হিসেবে আমরা যা পাই তা হলো, সঠিকভাবে ইসলামী লালনপালনের অভাব।
আমি প্রায় বিশ বছর থেকে বলে আসছি, এই উম্মাতকে তার পুরাতন সম্মান ফিরিয়ে আনতে হলে এবং রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে এর একমাত্র পথ ও পদ্ধতি হলো, আমি যাকে সংক্ষিপ্তভাবে বলি তাসফিয়া ও তারবিয়া। এর বিপরীতে অনেক জামাআত মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য যে পদ্ধতির পেছনে শ্রম ব্যয় করে, তা হলো, শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে। কতক দল এর জন্য শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি যেমন নির্বাচনকে গ্রহণ করেছে আর কতক দল রক্তক্ষয়ী পদ্ধতি যেমন বিদ্রোহ ও সেনা অভ্যুদয়কে গ্রহণ করেছে।
আমি বলি, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার এটি পদ্ধতি নয়। বরং এর জন্য সঠিক পদ্ধতি হলো, নববী পদ্ধতি। আপনারা জানেন, নবী ﷺ মক্কায় ১৩ বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন এরপর মদীনায় দাওয়াত পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর অনুসারীদেরকে এবং ঈমানদারকে খাঁটি ও স্বচ্ছ করার পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
বলা হয়ে থাকে, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আমি নিশ্চিতভাবে বলছি এবং অল্পদূরের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা একথা প্রমাণ করে যে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী পূনর্জাগরণ হওয়া এবং মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে:
ক. তাসফিয়া। তাসফিয়া মানে স্বচ্ছ-সঠিক ইলম।
খ. তারবিয়া। তারবিয়া অর্থ স্বচ্ছ-সঠিক ইলম কিতাব ও সুন্নাহর ওপর মানুষকে গড়ে তোলা।
আমরা বর্তমানে ইলমী চেতনা ও জাগরণের যুগে বাস করছি কিন্তু আমাদের মাঝে লালনপালন ও গড়ে তোলার চেতনা ও জাগরণ নেই। এ কারণে আমরা অনেক দাঈকে দেখি, তাদের ইলম থেকে উপকৃত হওয়া যায় কিন্তু তাদের চরিত্র থেকে উপকৃত হওয়া যায় না। কারণ, তারা ইলমের ওপর নিজেকে গড়ে তুলেছেন কিন্তু ছেলেবেলা থেকে ভালো পরিবেশে বেড়ে উঠেননি। ফলে তারা যে সমাজের মাঝে বসবাস করেছেন, সে সমাজের চরিত্র নিজের মাঝে ধারণ করেছেন। নিঃসন্দেহে সে-সমাজ ইসলামী সমাজ নয়। তারা নিজের ব্যক্তিগত চেষ্টায় বা কোনো আলিমের পরামর্শে সঠিক জ্ঞানের রাস্তায় চলেছেন কিন্তু অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব তাদের চরিত্রে, চালচলনে ও কাজকর্মে প্রকাশ পায় না।
আমরা যে পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কথা আলোচনা করছি এর কারণ হচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক ছাড়া আমাদের ইলম পরিপক্ক হয়নি।
দ্বিতীয়ত: এই সমস্ত লোকের অধিকাংশ সঠিক ইসলামী পদ্ধতিতে লালিত-পালিত হয়নি। এ কারণে প্রাথমিক স্তরের অনেক তালিবুল ইলমকে পাবেন, তারা তালিবুল ইলম হওয়া সত্ত্বেও কোনো জামাআত বা দলের নেতা বা প্রধানের পদে নিজেকে আসীন করে বসে আছে। এই যে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা, এই প্রবণতার ব্যাপারে একটি প্রাচীন বাগধারা হচ্ছে, নিজেকে জাহির করার নেশা পিঠকে ভেঙ্গে ফেলে। নিজেকে জাহির করার প্রবণতার কারণ হচ্ছে, সঠিক ইলমের ওপর সঠিকভাবে লালনপালনের অভাব।[1]
ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহ অন্যত্র বলেন, আমি এখানে আরেকটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। অতীত যুগগুলোতে আমরা যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম, বর্তমানে এসে তার বিপরীত বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। অতীত যুগগুলোতে জনসাধারণ ও তালিবুল ইলম তো দূরের কথা আলিমগণও গোঁড়ামি ও তাকলীদে লিপ্ত থাকতেন। আমরা তখন মাযহাবের তাকলীদী গোঁড়ামির বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম।
অনেক যুগ ধরে মুসলিমদের মাঝ থেকে এই গোঁড়ামি বিদায় নিয়েছে। আমরা বর্তমানে এখন কিতাব ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের এক বরকতপূর্ণ যুগে বসবাস করছি। নিঃসন্দেহে এই বরকতপূর্ণ যুগ তার ফুল-ফল আমাদেরকে প্রদান করছে। তবে আমরা পূর্বযুগের যে সমস্যা ছিল, তার বিপরীত সমস্যার মুখোমুখি। আমরা আগে অভিযোগ করতাম গোঁড়ামি নিয়ে আর এখন অভিযোগ করি মুক্তচিন্তা নিয়ে।
অনেকে কারো থেকে কুরআন ও হাদীসের কিছু কথা শুনে অথবা কোনো দাঈ থেকে ভুল-সঠিক মিশ্রিত কোনো আলোচনা শুনে নিজেকে আলিম ভাবতে শুরু করে। অথচ সে কুরআন ও সুন্নাহর কিছুই বুঝে না। ‘আমার মতে অমুক, আমার সিদ্ধান্ত অমুক, আমার মতে এই মত ভুল’ এভাবে বলাকে নিজেদের জন্য জায়েয মনে করে। তারা ছোটো-বড়ো সকল ব্যাপারেই প্রবেশ করে। অথচ তারা একটি হাদীসও পড়তে জানে না।
এটি অত্যন্ত ভয়ানক ব্যাপার। আমার মতে, যদি এই অবস্থা চালু হয় যে, প্রত্যেক মুসলিম নিজেকে আলিম দাবি করতে থাকে এবং মুজতাহিদ মনে করতে থাকে, তাহলে আমার কাছে এই অবস্থার তুলনায় উত্তম হলো―বাপ-দাদাদের মতো চার মাযহাবের অনুসরণ করা, মাযহাবের ব্যাপারে গোঁড়ামি করা এবং জ্ঞানার্জন করেনি এমন জাহিলদের মতামত নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা। কারণ, কোনো ক্ষতি থেকে কোনো ক্ষতি তুলনামূলক হালকা হয়।
এক ইরাকী মনীষী ও সাহিত্যিক খুব সুন্দর কথা বলেছেন; যদিও তার কথায় কিছু সংশোধন করা যায়। তিনি বলেছেন, কারো তাকলীদ করে সঠিকতায় পৌঁছার তুলনায় ইজতিহাদ করতে গিয়ে ভুল করাটা আমার কাছে বেশি প্রিয়। আমি বলব, ইজতিহাদ করে সঠিকতায় পৌঁছার তুলনায় কারো তাকলীদ করে সঠিকতায় পৌঁছা আমার কাছে বেশি প্রিয়। কারণ, ভুল কখনো সঠিকের তুলনায় ভালো হতে পারে না।[2]
[1] তুরাসুল আলবানী ফিল মানহাজ, ১/১৮৪-১৮৮
[2] তুরাসুল আলবানী ফিল মানহাজ, ১/২০০