ইসলামের প্রতিটি বিধান ও ইবাদত চরিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত। যে ইবাদত চরিত্রের পরিবর্তন করতে পারে না সেটা মূল্যহীন। কারণ চারিত্রিক পরিবর্তন হওয়া ইবাদত কবুল হওয়ার লক্ষণ। আর প্রত্যেকটা ইবাদতই নৈতিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
১). সালাত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব তেলাওয়াত করুন এবং সালাত প্রতিষ্ঠিত করুন। নিশ্চয় সালাত মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কর্ম হতে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা জানেন’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৫)।
اَلۡفَحۡشَآءُ (ফাহশা) হল- এমন অশ্লীল গুনাহের কাজ, যা মানুষের কুপ্রবৃত্তি কামনা করে। اَلْمُنْكَرُ (মুনকার) হল- ঐসকল গুনাহ, যা ধর্মীয় ও স্বাভাবিক জ্ঞান অপসন্দ করে।
শিক্ষণীয় বিষয় : উপরিউক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সালাত আদায়কারীকে সকল অন্যায়, অশ্লীল ও অপকর্ম থেকে দূরে রাখাই হল সালাতের মূলনীতি। এখন কোন একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে সালাত আদায় করেও যদি সে নিজেকে অন্যায়, অশ্লীল ও অসৎ কর্ম হতে মুক্ত রাখতে না পারে, তার মানে এই যে, সালাত তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না এবং তার সালাত কবুল হচ্ছে না। ক্বিয়ামতের মাঠে এই সালাতই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।
হাসান ও ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুমাল্লাহ) বলেন,
‘যার সালাত তাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখল না, সে সালাত দ্বারাই আল্লাহ থেকে দূরে সরে গেল’।[১]
অতএব অবশ্যই তাকে তার সালাত নিয়ে ভাবতে হবে। কোন্ কারণে সালাত নামক ঔষধ তার জীবন থেকে পাপ নামক ব্যাধিকে দূর করতে পারছে না? ভাবতে হবে! কেননা প্রকৃত সালাত আদায়কারীকে সালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে, এটাই চূড়ান্ত। তাহলে কি আমরা প্রকৃত সালাত আদায়কারী নই? কেননা আমাদের অনেকেই তো সালাতের অনুবর্তী হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় গুনাহে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। তাহলে প্রকৃত মুছল্লী কে? কী তার বৈশিষ্ট্য? প্রকৃত মুছল্লী সেই ব্যক্তি, যে সালাতকে নির্ধারিত সময়ে, রিয়া মুক্ত ও স্বচ্ছ অন্তরে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেয়া পদ্ধতিতে, একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার সাথে, সালাতের রুকন ও শর্তসমূহ যথাযথভাবে ঠিক রেখে আদায় করা হয়। প্রকৃত মুছল্লী সমস্ত রকমের হারাম থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র ও হালাল খাদ্য ভক্ষণ করে সালাত আদায় করে। তখন সালাত তার অন্তরকে আলোকিত ও পবিত্র করে। ফলে সেই ব্যক্তির ঈমান ও তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায় এবং ভাল কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। অপরদিকে খারাপ কাজের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। এভাবেই সালাত ব্যক্তি ও পাপের মধ্যখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়।
২). যাকাত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘(হে নবী!) আপনি তাদের ধন-সম্পদ হতে ছাদাক্বাহ গ্রহণ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে দিবেন, আর তাদের জন্য দু‘আ করুন। নিঃসন্দেহে আপনার দু‘আ হচ্ছে তাদের জন্য শান্তির কারণ, আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১০৩)।
সুধী পাঠক! এখানে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আদেশ দেয়া হচ্ছে যে, ছাদাক্বাহ দ্বারা আপনি মুসলিমদেরকে পবিত্র করুন। অতএব এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, যাকাত ও ছাদাক্বাহ মানুষের আখলাক্ব-চরিত্রকে পবিত্র করার একটি বিশাল বড় মাধ্যম। এছাড়া ছাদাক্বাহকে ছাদাক্বাহ এ জন্যই বলা হয় যে, ছাদাক্বাহ দাতা নিজের ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী।
শিক্ষণীয় বিষয় : যাকাত অন্তরকে সকল ধরনের অপরাধ ও অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ-লালসা ও অহংকারের মত নিকৃষ্ট ব্যাধি হতে মুক্ত করে। যাকাত আদায়কারীকে সূদ, ঘুষ, মিথ্যা ও বেঈমানিসহ সকল ধরনের দুর্নীতি ও অবৈধ পন্থা থেকে দূরে রাখাই হল যাকাতের মূলনীতি। এখন যাকাত আদায় করার পরও যদি কোন ব্যক্তি নিজের আত্মা ও ধন-সম্পতিকে পবিত্র করতে পারছে না, তার মানে এই যে, যাকাতের উদ্দেশ্য তার জীবনে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তার যাকাত কবুল যোগ্য হতে পারছে না। অতএব যাকাতকে কবুলযোগ্য করে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা করা দরকার। যাকাতের বিধি-বিধান ও শর্তসমূহের দিকে লক্ষ্য রেখে যাকাত আদায় করতে হবে, তবেই তা কবুলযোগ্য হতে পারে।
৩). হজ্জ : হজ্জ একটি বাস্তবধর্মী ও বহুমুখী প্রশিক্ষণশালা। ধৈর্যশীলতা ও সহিঞ্চুতার এক মহা পরীক্ষা কেন্দ্র। হিংসা-বিদ্ধেষ, মারামারি-কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, গালিগালাজ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা হজ্জের বিধান দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হজ্জের সময় নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল, তার জন্য হজ্জে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর, নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাক্বওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৭)।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তÍষ্ট করার জন্য হজ্জ করবে এবং এ হজ্জের মধ্যে কোন অশ্লীল কথা ও কর্মে লিপ্ত হবে না, সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।[২]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,
‘এক ওমরাহ হতে অপর ওমরাহ মধ্যবর্তী সময়ের কাফ্ফারা স্বরূপ। কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়’।[৩]
শিক্ষণীয় বিষয় : উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা একথা সূর্যালোকের ন্যায় পরিস্ফুটিত হয় যে, হজ্জ আদায়কারীকে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, পাপ কাজ, হিংসা-বিদ্ধেষ, মারামারি-কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জিত করাই হজ্জের মূলনীতি। এখন কোন একজন ব্যক্তি হজ্জ আদায়ের পরেও যদি প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে, আত্মীয়-স্বজনদের ন্যায্য অধিকারসমূহ আত্মসাৎ করে। নিজের কুপ্রবৃত্তি ও ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। নিজের মুখবিবরকে অশ্লীল ভাষা ও তামাকজাত দ্রব্য হতে পবিত্র করতে না পারে। তার মানে এই হজ্জ তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তার হজ্জ আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই প্রকৃতির হজ্জ আদায়কারীদের হজ্জ, হজ্জে মাবরূর অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশকারী হজ্জ বলে বিবেচিত হয় না। তাই হজ্জকে কবুলের স্বীকৃতি দিতে অবশ্যই হজ্জের শর্তসমূহকে যথাযথভাবে মেনে হজ্জ আদায় করতে হবে।
অনুরূপভাবে সিয়ামও আমাদের কিছু বলতে চায়, কিছু আদব ও শিষ্টাচার শেখাতে চায়। তো আসুন এবার আমরা আমাদের মূল বিষয়ের দিকে ধাবিত হই যার নাম ‘সিয়ামের দাবী ও তার শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ’।
সিয়াম হচ্ছে অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও কঠোর পরিশ্রমের মাস। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যেনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অত্যাচার, ছিনতাই-রাহাজানী, হিংসা-মারামারি ও সকল ধরনের পাপাচার থেকে বাঁচানোর জন্যই সিয়ামের বিধান দিয়েছেন। এটা ৩০ দিনের একটা বার্ষিক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ কোর্স। যা পরবর্তী এগার মাসের ইবাদতের ধরন, আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটা মৌলিক ধারণা দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান ফরয করা হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)।
মুসলিমদের প্রতি সিয়াম ফরযের নির্দেশের সাথে সাথে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিয়াম শুধু তোমাদের প্রতিই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরয করা হয়েছিল। এর দ্বারা যেমন সিয়ামের বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, তেমনি মুসলিমদের এ মর্মে একটি শান্ত¦নাও দেয়া হয়েছে যে, সিয়াম একটি কষ্টকর ‘ইবাদত সত্য, তবে তা শুধু তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর উপরও ফরয করা হয়েছিল। কেননা, সাধারণত দেখা যায়, কোন একটা কষ্টকর কাজে অনেক লোক একই সাথে জড়িত হয়ে পড়লে তা অনেকটা স্বাভাবিক এবং সাধারণ বলে মনে হয়।
সিয়ামের অর্থ
সিয়ামের আভিধানিক অর্থ হল-
‘সাধারণত কোন জিনিস হতে বিরত থাকার নাম’। পারিভাষিক অর্থে
‘ইসলামী শরী‘আতে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ‘ইবাদতের নিয়তে ফজর উদিত হতে সূর্যাস্ত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও যৌন মিলন হতে বিরত থাকাকে সিয়াম বলা হয়’।
সুধী পাঠক, একবার ভাবুন! পানাহার ও যৌন মিলন দু’টিই হালাল কাজ, যদি এর থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম হয়! তাহলে হারাম জিনিস থেকে কতটা কঠোরতার সাথে বিরত থাকতে হবে? অবশ্যই এ সংজ্ঞায় মিথ্যা, অশ্লীল ও অশালীন কথা-কাজ থেকে বিরত থাকাও শামিল। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং মিথ্যা কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।[৪] রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
‘কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়; বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই (প্রকৃত) সিয়াম। সুতরাং যদি তোমাকে কেউ গালিগালাজ করে অথবা তোমার প্রতি মূর্খতা প্রদর্শন করে, তাহলে তুমি (তার প্রতিশোধ না নিয়ে) তাকে বল যে, আমি সিয়ামপালনকারী, আমি সিয়ামপালনকারী’।[৫]
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাক্বারার উপরিউক্ত আয়াতের শেষাংশে সিয়াম ফরযের বিশেষ কারণ উল্লেখ করেছেন। তাহল- এর মাধ্যমে তাক্বওয়াবান বা আল্লাহভীরু হওয়া। তাক্বওয়ার পরিচয়, মুত্তাক্বীর গুণাবলী ও ফলাফল অত্র সূরার ২ নং আয়াতে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাক্বওয়ার পরিচয়
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আপনি কি কখনো কোন কাঁটাযুক্ত পথে হেঁটেছেন? ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হ্যাঁ। উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, কিভাবে হেঁটেছেন? ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে সে জন্য চেষ্টা করেছি ও সতর্কভাবে চলেছি। উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘এটাই হচ্ছে তাক্বওয়ার উদাহরণ’ অর্থাৎ পাপকে কাঁটা মনে করে বেঁচে চলার নামই হল তাক্বওয়া। ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘আল্লাহ তা‘আলার আদেশকে গ্রহণ করা ও নিষেধকে বর্জন করার নামই তাক্বওয়া’।[৬]
সিয়ামের শিক্ষনীয় বিষয়
সিয়াম পালনের মাধ্যমে পালনকারীর অন্তরে আল্লাহর ভয় তৈরি করা ও তাকে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করাই সিয়ামের মূলনীতি। যাতে ঐ ব্যক্তি নিজেকে মিথ্যা কথা, অশ্লীল কাজ ও পাপাচার থেকে বাঁচাতে পারে। কেননা একমাত্র আল্লাহর ভয়ই মানুষকে পাপ থেকে বাঁচাতে পারে। যেমন বাঁচিয়েছিল বানী ইসরাইলের সেই ব্যক্তিকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন
‘দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। পুরুষরা যেমন মহিলাদেরকে ভালোবাসে, আমি তাকে তার চেয়ে অধিক ভালোবাসতাম। একদিন আমি তাকে কুপ্রস্তাব দিলাম (অর্থাৎ ব্যভিচার করতে চাইলাম) কিন্তু তা সে অস্বীকার করল যে পর্যন্ত না আমি তার জন্য একশ’ দিনার নিয়ে আসি। পরে চেষ্টা করে আমি তা যোগাড় করলাম (এবং তার কাছে এলাম)। যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম (অর্থাৎ সম্ভোগ করতে তৈরি হলাম) তখন সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। অন্যায়ভাবে মাহর (পর্দা) ছিঁড়ে দিও না (অর্থাৎ আমার কুমারীর সতীত্ব নষ্ট করো না), তখন আমি আল্লাহ্র ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম’।[৭]
একবার ভাবুন তো এই ব্যক্তির কথা, কত গভীর ভালোবাসা, দীর্ঘদিনের কামনা-বাসনা, আজ নির্জন জায়গায় দু’জনেই বিবস্ত্র, ব্যভিচারের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত, পৃথিবীর এমন কোন্ ভয় আছে যে তাকে এই রকম জায়গা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে, একমাত্র আল্লাহর ভয় ব্যতীত? রামাযান মাসে সিয়াম পালন করেও যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে পাপ, মিথ্যা, অশ্লীলতা থেকে মুক্ত করতে না পারে। তার মানে এই যে, তার মধ্যে আল্লাহভীতি নেই, যা সিয়াম কবুল না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। সিয়ামের উদ্দেশ্য ব্যক্তিকে আল্লাহভীরু করে গড়ে তোলা, তার কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের সামনে পরাজিত করা, যদি উদ্দেশ্যই সফল না হয়, তাহলে কর্ম কী করে কবুল হবে? দীর্ঘ একমাস সালাত আদায়ের অভ্যাস করলেন, নিজেকে তামাকজাত দ্রব্য হতে মুক্ত করার চেষ্টা করলেন, পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করলেন। আর ঈদ হওয়া মাত্রই পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেলেন। এই জাতীয় ‘ইবাদতের কি কোন মূল্য আছে? কোন ইবাদত ঠিক তখনই কবুল হবে যখন তা আপনার পূর্বের ও পরের মধ্যখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে, যে প্রাচীর আর কখনই আপনাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে দেবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘কত সিয়াম পালনকারী আছে যাদের সিয়ামের বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না (কোন ছাওয়াব পায় না)। কত সালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না’।[৮]
বিস্ময়কর বিষয়! সিয়ামের অগণিত পুরস্কার ও মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও বহু সিয়াম পালনকারী এবং তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ গুজারের ভাগ্যে ক্ষুধা-পিপাসা এবং রাত্রি জাগরণ ছাড়া কোন কল্যাণ জোটে না। রামাযান মাসে পৃথিবীর সৃষ্টিকুল আল্লাহর রহমতের স্পর্শ লাভ করে, সেখানে বহু সিয়াম পালনকারীর এই দুরবস্থা কেন? এর কারণ ও প্রতিকার জানা না থাকলে আমরাও সেই হতভাগ্যের মিছিলের অংশীদার হয়ে যেতে পারি।
তাই সিয়াম সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করতে হবে। আসলে সিয়াম বলতে শুধু পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হতে বিরত থাকা নয়, বরং বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকেও খারাপ কাজ হতে বিরত রাখা। যেমন- অন্তর, পেট, জিহ্বা, কান ও চক্ষু। অন্তরকে হিংসা-বিদ্বেষ ও কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখা। পেটকে হারাম ভক্ষণ থেকে, জিহ্বাকে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ কথা বলা থেকে, কানকে অশ্রাব্য কথা ও গান বাজনা শ্রবণ করা থেকে এবং চক্ষুকে অশ্লীল দৃশ্য দেখা থেকে বিরত রাখা। আপনি সিয়ামও পালন করছেন আবার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ দ্বারা হারাম কাজও করছেন এর নাম সিয়াম নই, বরং একে উপোষ থাকা বলে। এক মাস সিয়ামব্রত পালনের পর যদি আপনি অনুভব করতে পারছেন, যে আপনি আর আগের মত নেই, সিয়ামের শুরুতে আপনার মধ্যে যে কুঅভ্যাসগুলো ছিল একমাসের সিয়াম সেগুলোকে বিতাড়িত করেছে, তার মানে আপনার সিয়াম পালন সার্থক হয়েছে। আর যদি এমন হয় যে, আপনি আগেও যে শয়তান ছিলেন, একমাস পরেও ঠিক সেই শয়তানই রয়ে গেছেন, তার মানে সিয়াম আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, নিশ্চিতরূপে আপনার সিয়াম কবুল হয়নি। এমতাবস্থায় অবশ্যই আমাদের সিয়াম নিয়ে ভাবতে হবে, একমাসের কঠোর পরিশ্রম যেন বৃথা না যায়, সে নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। কিভাবে আমাদের সিয়াম কবুলের যোগ্য হবে তা জানতে হবে। আর অবশ্যই তা দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল ১. আমরা আল্লাহভীরু হতে পেরেছি কি না? ২. সিয়াম পালনের মাধ্যমে আমরা হারাম, অবৈধ ও অনৈসলামিক অভ্যাসগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি কী না? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আর যদি উত্তর ‘না’ হয়, তবে আপনার জন্য পরিতাপ ও আফসোস ছাড়া আর কিছু নেই, আপনার সমস্ত শ্রম বৃথা গেল।
তাই আসুন! আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি যে, এবারের সিয়ামকে আমরা বৃথা হতে দেব না, সিয়ামের শর্তগুলোকে যথাযথভাবে মেনে সিয়াম পালন করব। যে কোন মূল্যে সিয়ামকে কবুলের যোগ্য করে তুলব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী, জামিঊল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ৪১০।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/১৫২১, সহীহ মুসলিম, হা/১৩৫০।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৭৭৩, সহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৯।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭। হাদীসটি আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত।
[৫]. মুসতাদরাক হাকিম, হা/১৫৭০; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৯৯৬; সহীহুল জামে‘, হা/৫৩৭৬; সহীহ তারগীব ওয়া তারহীব, হা/১০৮২।
[৬]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২০।
[৭]. সহীহ বুখারী, হা/২৩৩৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৩।
[৮]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯০; সহীহুল জামে‘, হা/৩৪৮৮।
১). সালাত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اُتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ ؕ اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡہٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لَذِکۡرُ اللّٰہِ اَکۡبَرُ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُوۡنَ
‘আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব তেলাওয়াত করুন এবং সালাত প্রতিষ্ঠিত করুন। নিশ্চয় সালাত মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কর্ম হতে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা জানেন’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৫)।
اَلۡفَحۡشَآءُ (ফাহশা) হল- এমন অশ্লীল গুনাহের কাজ, যা মানুষের কুপ্রবৃত্তি কামনা করে। اَلْمُنْكَرُ (মুনকার) হল- ঐসকল গুনাহ, যা ধর্মীয় ও স্বাভাবিক জ্ঞান অপসন্দ করে।
শিক্ষণীয় বিষয় : উপরিউক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সালাত আদায়কারীকে সকল অন্যায়, অশ্লীল ও অপকর্ম থেকে দূরে রাখাই হল সালাতের মূলনীতি। এখন কোন একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে সালাত আদায় করেও যদি সে নিজেকে অন্যায়, অশ্লীল ও অসৎ কর্ম হতে মুক্ত রাখতে না পারে, তার মানে এই যে, সালাত তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না এবং তার সালাত কবুল হচ্ছে না। ক্বিয়ামতের মাঠে এই সালাতই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।
হাসান ও ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুমাল্লাহ) বলেন,
مَنْ لَمْ تَنْهَهُ صَلَاتُهُ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ فَإِنَّهُ لَا يَزْدَادُ مِنَ اللهِ بِذَلِكَ إِلَّا بُعْدًا
‘যার সালাত তাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখল না, সে সালাত দ্বারাই আল্লাহ থেকে দূরে সরে গেল’।[১]
অতএব অবশ্যই তাকে তার সালাত নিয়ে ভাবতে হবে। কোন্ কারণে সালাত নামক ঔষধ তার জীবন থেকে পাপ নামক ব্যাধিকে দূর করতে পারছে না? ভাবতে হবে! কেননা প্রকৃত সালাত আদায়কারীকে সালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে, এটাই চূড়ান্ত। তাহলে কি আমরা প্রকৃত সালাত আদায়কারী নই? কেননা আমাদের অনেকেই তো সালাতের অনুবর্তী হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় গুনাহে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। তাহলে প্রকৃত মুছল্লী কে? কী তার বৈশিষ্ট্য? প্রকৃত মুছল্লী সেই ব্যক্তি, যে সালাতকে নির্ধারিত সময়ে, রিয়া মুক্ত ও স্বচ্ছ অন্তরে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেয়া পদ্ধতিতে, একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার সাথে, সালাতের রুকন ও শর্তসমূহ যথাযথভাবে ঠিক রেখে আদায় করা হয়। প্রকৃত মুছল্লী সমস্ত রকমের হারাম থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র ও হালাল খাদ্য ভক্ষণ করে সালাত আদায় করে। তখন সালাত তার অন্তরকে আলোকিত ও পবিত্র করে। ফলে সেই ব্যক্তির ঈমান ও তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায় এবং ভাল কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। অপরদিকে খারাপ কাজের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। এভাবেই সালাত ব্যক্তি ও পাপের মধ্যখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়।
২). যাকাত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
خُذۡ مِنۡ اَمۡوَالِہِمۡ صَدَقَۃً تُطَہِّرُہُمۡ وَ تُزَکِّیۡہِمۡ بِہَا وَ صَلِّ عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّ صَلٰوتَکَ سَکَنٌ لَّہُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
‘(হে নবী!) আপনি তাদের ধন-সম্পদ হতে ছাদাক্বাহ গ্রহণ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে দিবেন, আর তাদের জন্য দু‘আ করুন। নিঃসন্দেহে আপনার দু‘আ হচ্ছে তাদের জন্য শান্তির কারণ, আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১০৩)।
সুধী পাঠক! এখানে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আদেশ দেয়া হচ্ছে যে, ছাদাক্বাহ দ্বারা আপনি মুসলিমদেরকে পবিত্র করুন। অতএব এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, যাকাত ও ছাদাক্বাহ মানুষের আখলাক্ব-চরিত্রকে পবিত্র করার একটি বিশাল বড় মাধ্যম। এছাড়া ছাদাক্বাহকে ছাদাক্বাহ এ জন্যই বলা হয় যে, ছাদাক্বাহ দাতা নিজের ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী।
শিক্ষণীয় বিষয় : যাকাত অন্তরকে সকল ধরনের অপরাধ ও অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ-লালসা ও অহংকারের মত নিকৃষ্ট ব্যাধি হতে মুক্ত করে। যাকাত আদায়কারীকে সূদ, ঘুষ, মিথ্যা ও বেঈমানিসহ সকল ধরনের দুর্নীতি ও অবৈধ পন্থা থেকে দূরে রাখাই হল যাকাতের মূলনীতি। এখন যাকাত আদায় করার পরও যদি কোন ব্যক্তি নিজের আত্মা ও ধন-সম্পতিকে পবিত্র করতে পারছে না, তার মানে এই যে, যাকাতের উদ্দেশ্য তার জীবনে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তার যাকাত কবুল যোগ্য হতে পারছে না। অতএব যাকাতকে কবুলযোগ্য করে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা করা দরকার। যাকাতের বিধি-বিধান ও শর্তসমূহের দিকে লক্ষ্য রেখে যাকাত আদায় করতে হবে, তবেই তা কবুলযোগ্য হতে পারে।
৩). হজ্জ : হজ্জ একটি বাস্তবধর্মী ও বহুমুখী প্রশিক্ষণশালা। ধৈর্যশীলতা ও সহিঞ্চুতার এক মহা পরীক্ষা কেন্দ্র। হিংসা-বিদ্ধেষ, মারামারি-কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, গালিগালাজ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা হজ্জের বিধান দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلۡحَجُّ اَشۡہُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡہِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡہُ اللّٰہُ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ
‘হজ্জের সময় নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল, তার জন্য হজ্জে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর, নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাক্বওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৭)।
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ঃ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ حَجَّ لِلهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তÍষ্ট করার জন্য হজ্জ করবে এবং এ হজ্জের মধ্যে কোন অশ্লীল কথা ও কর্মে লিপ্ত হবে না, সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।[২]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,
أَلْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِّمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلَّا الْجنَّةُ
‘এক ওমরাহ হতে অপর ওমরাহ মধ্যবর্তী সময়ের কাফ্ফারা স্বরূপ। কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়’।[৩]
শিক্ষণীয় বিষয় : উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা একথা সূর্যালোকের ন্যায় পরিস্ফুটিত হয় যে, হজ্জ আদায়কারীকে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, পাপ কাজ, হিংসা-বিদ্ধেষ, মারামারি-কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জিত করাই হজ্জের মূলনীতি। এখন কোন একজন ব্যক্তি হজ্জ আদায়ের পরেও যদি প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে, আত্মীয়-স্বজনদের ন্যায্য অধিকারসমূহ আত্মসাৎ করে। নিজের কুপ্রবৃত্তি ও ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। নিজের মুখবিবরকে অশ্লীল ভাষা ও তামাকজাত দ্রব্য হতে পবিত্র করতে না পারে। তার মানে এই হজ্জ তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তার হজ্জ আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই প্রকৃতির হজ্জ আদায়কারীদের হজ্জ, হজ্জে মাবরূর অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশকারী হজ্জ বলে বিবেচিত হয় না। তাই হজ্জকে কবুলের স্বীকৃতি দিতে অবশ্যই হজ্জের শর্তসমূহকে যথাযথভাবে মেনে হজ্জ আদায় করতে হবে।
অনুরূপভাবে সিয়ামও আমাদের কিছু বলতে চায়, কিছু আদব ও শিষ্টাচার শেখাতে চায়। তো আসুন এবার আমরা আমাদের মূল বিষয়ের দিকে ধাবিত হই যার নাম ‘সিয়ামের দাবী ও তার শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ’।
সিয়াম হচ্ছে অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও কঠোর পরিশ্রমের মাস। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যেনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অত্যাচার, ছিনতাই-রাহাজানী, হিংসা-মারামারি ও সকল ধরনের পাপাচার থেকে বাঁচানোর জন্যই সিয়ামের বিধান দিয়েছেন। এটা ৩০ দিনের একটা বার্ষিক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ কোর্স। যা পরবর্তী এগার মাসের ইবাদতের ধরন, আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটা মৌলিক ধারণা দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান ফরয করা হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)।
মুসলিমদের প্রতি সিয়াম ফরযের নির্দেশের সাথে সাথে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিয়াম শুধু তোমাদের প্রতিই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরয করা হয়েছিল। এর দ্বারা যেমন সিয়ামের বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, তেমনি মুসলিমদের এ মর্মে একটি শান্ত¦নাও দেয়া হয়েছে যে, সিয়াম একটি কষ্টকর ‘ইবাদত সত্য, তবে তা শুধু তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর উপরও ফরয করা হয়েছিল। কেননা, সাধারণত দেখা যায়, কোন একটা কষ্টকর কাজে অনেক লোক একই সাথে জড়িত হয়ে পড়লে তা অনেকটা স্বাভাবিক এবং সাধারণ বলে মনে হয়।
সিয়ামের অর্থ
সিয়ামের আভিধানিক অর্থ হল-
هو مطلق الإمساك والكف عن الشيء
‘সাধারণত কোন জিনিস হতে বিরত থাকার নাম’। পারিভাষিক অর্থে
هو الإمساك عن شهوتي البطن والفرج في جميع أجزاء النهار من طلوع الفجر إلي غروب الشمس بنية التقرب إلي الله تعالي
‘ইসলামী শরী‘আতে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ‘ইবাদতের নিয়তে ফজর উদিত হতে সূর্যাস্ত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও যৌন মিলন হতে বিরত থাকাকে সিয়াম বলা হয়’।
সুধী পাঠক, একবার ভাবুন! পানাহার ও যৌন মিলন দু’টিই হালাল কাজ, যদি এর থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম হয়! তাহলে হারাম জিনিস থেকে কতটা কঠোরতার সাথে বিরত থাকতে হবে? অবশ্যই এ সংজ্ঞায় মিথ্যা, অশ্লীল ও অশালীন কথা-কাজ থেকে বিরত থাকাও শামিল। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِيْ أَنْ يَّدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং মিথ্যা কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।[৪] রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ فَإِنْ سَابَّكَ أَحَدٌ أَوْ جَهِلَ عَلَيْكَ فَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ إِنِّي صَائِمٌ
‘কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়; বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই (প্রকৃত) সিয়াম। সুতরাং যদি তোমাকে কেউ গালিগালাজ করে অথবা তোমার প্রতি মূর্খতা প্রদর্শন করে, তাহলে তুমি (তার প্রতিশোধ না নিয়ে) তাকে বল যে, আমি সিয়ামপালনকারী, আমি সিয়ামপালনকারী’।[৫]
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাক্বারার উপরিউক্ত আয়াতের শেষাংশে সিয়াম ফরযের বিশেষ কারণ উল্লেখ করেছেন। তাহল- এর মাধ্যমে তাক্বওয়াবান বা আল্লাহভীরু হওয়া। তাক্বওয়ার পরিচয়, মুত্তাক্বীর গুণাবলী ও ফলাফল অত্র সূরার ২ নং আয়াতে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাক্বওয়ার পরিচয়
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আপনি কি কখনো কোন কাঁটাযুক্ত পথে হেঁটেছেন? ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হ্যাঁ। উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, কিভাবে হেঁটেছেন? ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে সে জন্য চেষ্টা করেছি ও সতর্কভাবে চলেছি। উবাই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘এটাই হচ্ছে তাক্বওয়ার উদাহরণ’ অর্থাৎ পাপকে কাঁটা মনে করে বেঁচে চলার নামই হল তাক্বওয়া। ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
والتقوى هي فعل ما أمر الله تعالى به وترك ما نهى عنه
‘আল্লাহ তা‘আলার আদেশকে গ্রহণ করা ও নিষেধকে বর্জন করার নামই তাক্বওয়া’।[৬]
সিয়ামের শিক্ষনীয় বিষয়
সিয়াম পালনের মাধ্যমে পালনকারীর অন্তরে আল্লাহর ভয় তৈরি করা ও তাকে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করাই সিয়ামের মূলনীতি। যাতে ঐ ব্যক্তি নিজেকে মিথ্যা কথা, অশ্লীল কাজ ও পাপাচার থেকে বাঁচাতে পারে। কেননা একমাত্র আল্লাহর ভয়ই মানুষকে পাপ থেকে বাঁচাতে পারে। যেমন বাঁচিয়েছিল বানী ইসরাইলের সেই ব্যক্তিকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন
وَقَالَ الآخَرُ اَللّٰهُمَّ إِنَّهَا كَانَتْ لِيْ بِنْتُ عَمٍّ أَحْبَبْتُهَا كَأَشَدِّ مَا يُحِبُّ الرِّجَالُ النِّسَاءَ فَطَلَبْتُ مِنْهَا فَأَبَتْ عَلَيَّ حَتَّى أَتَيْتُهَا بِمِائَةِ دِيْنَارٍ فَبَغَيْتُ حَتَّى جَمَعْتُهَا فَلَمَّا وَقَعْتُ بَيْنَ رِجْلَيْهَا قَالَتْ يَا عَبْدَ اللهِ اتَّقِ اللهَ وَلَا تَفْتَحْ الْخَاتَمَ إِلَّا بِحَقِّهِ فَقُمْتُ...
‘দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। পুরুষরা যেমন মহিলাদেরকে ভালোবাসে, আমি তাকে তার চেয়ে অধিক ভালোবাসতাম। একদিন আমি তাকে কুপ্রস্তাব দিলাম (অর্থাৎ ব্যভিচার করতে চাইলাম) কিন্তু তা সে অস্বীকার করল যে পর্যন্ত না আমি তার জন্য একশ’ দিনার নিয়ে আসি। পরে চেষ্টা করে আমি তা যোগাড় করলাম (এবং তার কাছে এলাম)। যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম (অর্থাৎ সম্ভোগ করতে তৈরি হলাম) তখন সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। অন্যায়ভাবে মাহর (পর্দা) ছিঁড়ে দিও না (অর্থাৎ আমার কুমারীর সতীত্ব নষ্ট করো না), তখন আমি আল্লাহ্র ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম’।[৭]
একবার ভাবুন তো এই ব্যক্তির কথা, কত গভীর ভালোবাসা, দীর্ঘদিনের কামনা-বাসনা, আজ নির্জন জায়গায় দু’জনেই বিবস্ত্র, ব্যভিচারের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত, পৃথিবীর এমন কোন্ ভয় আছে যে তাকে এই রকম জায়গা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে, একমাত্র আল্লাহর ভয় ব্যতীত? রামাযান মাসে সিয়াম পালন করেও যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে পাপ, মিথ্যা, অশ্লীলতা থেকে মুক্ত করতে না পারে। তার মানে এই যে, তার মধ্যে আল্লাহভীতি নেই, যা সিয়াম কবুল না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। সিয়ামের উদ্দেশ্য ব্যক্তিকে আল্লাহভীরু করে গড়ে তোলা, তার কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের সামনে পরাজিত করা, যদি উদ্দেশ্যই সফল না হয়, তাহলে কর্ম কী করে কবুল হবে? দীর্ঘ একমাস সালাত আদায়ের অভ্যাস করলেন, নিজেকে তামাকজাত দ্রব্য হতে মুক্ত করার চেষ্টা করলেন, পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করলেন। আর ঈদ হওয়া মাত্রই পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেলেন। এই জাতীয় ‘ইবাদতের কি কোন মূল্য আছে? কোন ইবাদত ঠিক তখনই কবুল হবে যখন তা আপনার পূর্বের ও পরের মধ্যখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে, যে প্রাচীর আর কখনই আপনাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে দেবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوْعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ
‘কত সিয়াম পালনকারী আছে যাদের সিয়ামের বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না (কোন ছাওয়াব পায় না)। কত সালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না’।[৮]
বিস্ময়কর বিষয়! সিয়ামের অগণিত পুরস্কার ও মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও বহু সিয়াম পালনকারী এবং তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ গুজারের ভাগ্যে ক্ষুধা-পিপাসা এবং রাত্রি জাগরণ ছাড়া কোন কল্যাণ জোটে না। রামাযান মাসে পৃথিবীর সৃষ্টিকুল আল্লাহর রহমতের স্পর্শ লাভ করে, সেখানে বহু সিয়াম পালনকারীর এই দুরবস্থা কেন? এর কারণ ও প্রতিকার জানা না থাকলে আমরাও সেই হতভাগ্যের মিছিলের অংশীদার হয়ে যেতে পারি।
তাই সিয়াম সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করতে হবে। আসলে সিয়াম বলতে শুধু পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হতে বিরত থাকা নয়, বরং বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকেও খারাপ কাজ হতে বিরত রাখা। যেমন- অন্তর, পেট, জিহ্বা, কান ও চক্ষু। অন্তরকে হিংসা-বিদ্বেষ ও কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখা। পেটকে হারাম ভক্ষণ থেকে, জিহ্বাকে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ কথা বলা থেকে, কানকে অশ্রাব্য কথা ও গান বাজনা শ্রবণ করা থেকে এবং চক্ষুকে অশ্লীল দৃশ্য দেখা থেকে বিরত রাখা। আপনি সিয়ামও পালন করছেন আবার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ দ্বারা হারাম কাজও করছেন এর নাম সিয়াম নই, বরং একে উপোষ থাকা বলে। এক মাস সিয়ামব্রত পালনের পর যদি আপনি অনুভব করতে পারছেন, যে আপনি আর আগের মত নেই, সিয়ামের শুরুতে আপনার মধ্যে যে কুঅভ্যাসগুলো ছিল একমাসের সিয়াম সেগুলোকে বিতাড়িত করেছে, তার মানে আপনার সিয়াম পালন সার্থক হয়েছে। আর যদি এমন হয় যে, আপনি আগেও যে শয়তান ছিলেন, একমাস পরেও ঠিক সেই শয়তানই রয়ে গেছেন, তার মানে সিয়াম আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, নিশ্চিতরূপে আপনার সিয়াম কবুল হয়নি। এমতাবস্থায় অবশ্যই আমাদের সিয়াম নিয়ে ভাবতে হবে, একমাসের কঠোর পরিশ্রম যেন বৃথা না যায়, সে নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। কিভাবে আমাদের সিয়াম কবুলের যোগ্য হবে তা জানতে হবে। আর অবশ্যই তা দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল ১. আমরা আল্লাহভীরু হতে পেরেছি কি না? ২. সিয়াম পালনের মাধ্যমে আমরা হারাম, অবৈধ ও অনৈসলামিক অভ্যাসগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি কী না? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আর যদি উত্তর ‘না’ হয়, তবে আপনার জন্য পরিতাপ ও আফসোস ছাড়া আর কিছু নেই, আপনার সমস্ত শ্রম বৃথা গেল।
তাই আসুন! আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি যে, এবারের সিয়ামকে আমরা বৃথা হতে দেব না, সিয়ামের শর্তগুলোকে যথাযথভাবে মেনে সিয়াম পালন করব। যে কোন মূল্যে সিয়ামকে কবুলের যোগ্য করে তুলব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী, জামিঊল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ৪১০।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/১৫২১, সহীহ মুসলিম, হা/১৩৫০।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৭৭৩, সহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৯।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭। হাদীসটি আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত।
[৫]. মুসতাদরাক হাকিম, হা/১৫৭০; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৯৯৬; সহীহুল জামে‘, হা/৫৩৭৬; সহীহ তারগীব ওয়া তারহীব, হা/১০৮২।
[৬]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২০।
[৭]. সহীহ বুখারী, হা/২৩৩৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৩।
[৮]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯০; সহীহুল জামে‘, হা/৩৪৮৮।
হাসিবুর রহমান বুখারী
Last edited: