আল-কুরআন হল মুসলিমদের পবিত্র গ্রন্থ, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর নাযিল করেছেন। এই কুরআনই নবী (ﷺ)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ ও জীবন্ত মু‘জিযা।
এটাই একমাত্র মু‘জিযা, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। কেননা নবী (ﷺ)-ই শেষ নবী হওয়ায় তাঁর দাওয়াত ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। সুতরাং তাঁর শেষ্ঠ মু‘জিযা এই কুরআনও ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আর আল-কুরআনের বিশেষ মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য হল, এর মু‘জিযা বা অলৌকিকতা। আল-কুরআনে সাহিত্য, ইলম, শিখন-প্রশিক্ষণ, বিধি-বিধানসহ সকল ক্ষেত্রে অলৌকিক মাহাত্ম্য বিদ্যমান।
এটি এমন একটি গ্রন্থ যার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সাহিত্য গর্ভী জাহেল ব্যক্তির নিকট এমর্মে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। তিনি মানব ও জিন জাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের সূরার মত একটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, অথচ এতে তারা অক্ষম হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৮)। নিম্নে আল-কুরআনের মু‘জিযা বা অলৌকিক মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।
আল-কুরআনুল কারীমের মু‘জিযা বা অলৌকিক মাহাত্ম্যঃ
পুরো কুরআনুল কারীমই এর অলৌকিক মাহাত্ম্যে ভরপুর। এই অলৌকিক মাহাত্ম্যকে আহলুল ইলম প্রধানত চারভাগে ভাগ করেছেন। যা নিম্নরূপ :
১. বর্ণনাগত মু‘জিযা
কুরআনুল কারীমের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মু‘জিযা হল, বর্ণনাগত মু‘জিযা। আর বর্ণনাগত মু‘জিযা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বাক্যের অসামান্য শৈল্পিক গঠন, অবস্থা অনুযায়ী যথাযোগ্য ব্যবহার ও নির্ভুল অর্থে বাক্যের প্রয়োগ। সুতরাং কোন বিশুদ্ধভাষী আরব পণ্ডিত যদি কুরআনের কোন শব্দকে বাদ দিয়ে একই অর্থের অন্য কোন শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করতে চায়, তবে সে তা করতে পারবে না; বরং গঠনগত ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে বাক্যের সৌন্দর্য, এর গঠন ও যথাযোগ্য ব্যবহার বিনষ্ট করে ফেলবে। কেননা কুরআনে ব্যবহৃত শব্দমালা অর্থ, শব্দের সৌন্দর্য ও বিষয়বস্তুর সাথে শব্দের সুসমঞ্জস্যতার বিচারে অতি উন্নত ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কুরআনের প্রতিটি আয়াত অলঙ্কার ও উন্নত বাচনভঙ্গি দ্বারা পরিপূর্ণ। কেউ কুরআনের আয়াতসমূহের মাঝে কোন বৈপরীত্য খুঁজে পাবে না।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তবে কি তারা কুরআনকে গভীরভাবে অনুধাবন করে না? যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তারা এতে অনেক অসঙ্গতি পেত’ (সূরা আন-নিসা : ৮২)।
২. জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক মু‘জিযা
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বাস্তবমুখী ও প্রকৃত জ্ঞান, যার ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। কুরআনুল কারীমে এমন অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে, যা মানুষ ও জীব-জন্তু সৃষ্টির রহস্য এবং প্রাকৃতিক বিষয়াবলী সম্পর্কে আলোচনা করে। যেমন বেশ কিছু আয়াত আছে যা জ্যোতির্বিদ্যা, পৃথিবী সৃষ্টির পদ্ধতি ও অন্যান্য নানা বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে। আর এটা কুরআনুল কারীমের এমন মু‘জিযা হিসাবে গণ্য, যা মানুষের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিষয়ে আলোচনা করে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবকে সকল যুগের জন্য জীবন্ত মু‘জিযা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘অচিরেই আমরা তাদেরকে আমাদের নিদর্শনাবলী দেখাব, বিশ্বজগতের প্রান্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, অবশ্যই এটা (কুরআন) সত্য। এটা কি আপনার রবের সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব কিছুর উপর সাক্ষী?’ (সূরা আল-ফুচ্ছিলাত : ৫৩)।
৩. আইন বা বিধান সম্পর্কিত মু‘জিযা
একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীম অসংখ্য শিক্ষা ও বিধানাবলী নিয়ে আগমন করেছে। সুতরাং মুসলিমগণ যদি এই কুরআনের আনুগত্য করে তবে তাদের রাষ্ট্রের উন্নতি ঘটবে ও পরিধি বৃদ্ধি পাবে। আর যারা এ কুরআন থেকে দূরে সরে যাবে তারা পৃথিবীতে অপদস্ত হবে। কেননা কুরআন মানুষের সামাজিক জীবনের যাবতীয় সমস্যার নির্ভুল সমাধান ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এছাড়া কুরআনের অন্যতম মু‘জিযা হল, কুরআনের যাবতীয় বিধানাবলী মানব জীবনের সকল স্থানের ও সর্বকালের সকল সমস্যার সমাধানের জন্য প্রযোজ্য। এটি মানব জাতির প্রতি উত্তম চরিত্র গঠনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। এমনকি এই কুরআন উত্তম চরিত্র গঠন, যথাযোগ্য হকদারের নিকট আমানত পৌঁছে দেয়া ও বিভিন্ন সৎ আমল করা মুসলিমদের প্রতি ফরয বা আবশ্যক সাব্যস্ত করেছে।
৪. গায়েবী বিষয়ে মু‘জিযা
এ বিষয়ে কুরআনে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। হয়তো তা বহুকাল পূর্বে সংঘটিত কোন ঘটনা হতে পারে। যেমন, নবীদের কাহিনী, আছহাবে কাহ্ফের কাহিনী ও আরো অন্যান্যের কাহিনী। এই ঘটনাগুলো নবী (ﷺ)-এর সময়ে কুরআনের পূর্বে কেউ জানত না এবং কেউ তা বর্ণনাও করেনি। এই অজানা ঘটনা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের মাধ্যমে শুধু জানিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং এ ঘটনাগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এসব গায়েবের সংবাদ আমরা আপনাকে অহী দ্বারা অবহিত করেছি, যা এর আগে আপনি জানতেন না এবং আপনার সম্প্রদায়ও জানত না। কাজেই আপনি ধৈর্যধারণ করুন। নিশ্চয় শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্যই’ (সূরা হূদ : ৪৯)।
এছাড়া কুরআন এমন গায়েবী ঘটনা বর্ণনা করেছে, যা নবী (ﷺ)-এর সময়েই ঘটেছে কিন্তু তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। যেমন যুদ্ধের সময় কাফেরদের চক্রান্ত সম্পর্কে নবী (ﷺ) জানতে পারতেন। এমনকি মুনাফিক্বদের অন্তরের গোপন বিষয়ও জানতে পারতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়’ (সূরা আল-আহযাব : ১২)।
এমনকি আল-কুরআনে গায়েবী বিষয় তথা ভবিষ্যতের সংবাদ ও ভবিষ্যতে যা ঘটবে তার অনেক বর্ণনা রয়েছে। এটাও আল-কুরআনের মু‘জিযার অন্যতম একটি অংশ।
আল-কুরআনের মধ্যে ভবিষ্যৎকালীন মু‘জিযাঃ
আল-কুরআনের মু‘জিযার অন্যতম দিক হল, এই কিতাব ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে এমন ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অবহিত করেছে। কেননা আল-কুরআন ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আর ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো ক্রমেই বাস্তবায়িত হতে থাকবে। যেমন,
ক. ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আল-কুরআন যে সকল সংবাদ দিয়েছে তার মধ্যে কতিপয় এমন ঘটনা আছে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়েই বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন মুসলিমদেরকে যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর সাহায্য অথবা কিছু কাফের তার কুফুরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘ধ্বংস হোক আবূ লাহাবের হস্তদয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসেনি। অচিরেই সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে’ (সূরা আল-লাহাব : ১-৩)।
খ. আবার আল-কুরআন এমনও বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, যা নবী করীম (ﷺ)-এর ওফাতের পর সংঘটিত হয়েছে। যেমন আল-কুরআন মুসলিমদেরকে সংবাদ দিয়েছে যে, তারা অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা সম্প্রদায়ের সাথে লড়াই করবে। সুতরাং তারা হয় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে অথবা তারা (কাফেররা) আত্মসমর্পণ করবে। যেমন আল্লাহর বাণী,
‘যেসব মরুবাসী পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদেরকে বলুন, অবশ্যই তোমরা আহূত হবে এক কঠোর যোদ্ধা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে; তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে অথবা তারা আত্মসমর্পণ করে’ (সূরা আল-ফাত্হ : ১৬)।
গ. আল-কুরআন এমন বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর বাস্তবায়িত হয়নি তবে অচিরেই আবশ্যিভাবে তা সংঘটিত হবে। আল-কুরআনে ক্বিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হবে এমন কিছু ঘটনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ইয়াজূজ-মাজূজ বের হওয়ার ঘটনা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘অবশেষে যখন ইয়াজূজ ও মাজূজকে মুক্তি দেয়া হবে, আর তারা প্রতিটি উঁচু ভুমি থেকে ছুটে আসবে’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৯৬)। আর এর পর পৃথিবীতে যা ঘটবে তা হল, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যখন আসমান বিদীর্ণ হবে। আর যখন নক্ষত্রগুলো ঝরে পড়বে’ (সূরা আল-ইনফিত্বার : ১-২)।
জ্ঞান-বিজ্ঞানগত মু‘জিযার কতিপয় দৃষ্টান্তঃ
কুরআনুল কারীমে জ্ঞান-বিজ্ঞানগত যে মু‘জিযা বিদ্যমান তা বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি ও ব্যাপক গবেষণার ফলে, সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি যে সকল বিষয় আমাদের বুঝতে অসুবিধা হত, বিজ্ঞানের বিস্তারের ফলে তা বুঝা আমাদের জন্য অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। সুতরাং কুরআনের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক তথ্যাদি রয়েছে। যা আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকৃতি দেয়। এমনকি বিজ্ঞানের উন্নতির প্রতিটি ধাপে আল-কুরআনে অবস্থিত বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যাদি থেকে আরো ভালোভাবে পর্দা সরে গেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে কুরআনের মু‘জিযার মধ্যে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নরূপ :
ক. গর্ভজাত শিশুর ক্রমবর্ধমান স্তরসমূহ
আল-কুরআন বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে যে, গর্ভস্থিত ভ্রুণ কিভাবে ক্রমে ক্রমে স্তর ভিত্তিক বৃদ্ধি হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে রূপান্তরিত হয় এবং এক পর্যায়ে ভূমিষ্ট হয় ও বার্ধক্যে উপনিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে তাঁর বিজ্ঞানময় কুরআনে বলেন,
‘হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমরা সন্দেহে থাক তবে অনুধাবন কর, আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি হতে, তারপর শুক্র হতে, তারপর ‘আলাক্বাহ বা জমাটবদ্ধ রক্তপিণ্ড হতে, তারপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোস্তপিণ্ড হতে- যাতে আমরা বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রকাশ করি। আর আমরা যা ইচ্ছা করি তা এক নির্দিষ্টকালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি। তারপর আমরা তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনিত হও’ (সূরা আল-হজ্জ : ৫)।
খ. বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে যে, কোন উদ্ভিদের তথা খেজুর, ডুমুর ইত্যাদি গাছে ফল হওয়ার জন্য বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন আবশ্যক। কেননা পুরুষ ফুলের কাছ থেকে স্ত্রী ফুলের নিকট বাতাসের মাধমে রেনু গিয়ে সেখানে পরাগায়ন হয়ে ফল-ফলাদী হয়। আর এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَرْسَلْنَا الرِّيَاحَ لَوَاقِحَ ‘আর আমরা বৃষ্টি-গর্ভ বায়ু পাঠাই’ (সূরা আল-হিজর : ২২)।
গ. অণুর বিভাজন
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে যে, অণু একটি অনেক ছোট আকৃতির বস্তু। আর এই অণু গঠিত হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ ছোট ছোট অনেকগুলো উপাদান থেকে। যেমন ইলেক্ট্রন ও প্রোটন। আর এটা তো কুরআনুল কারীমের মধ্যে বহুকাল পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয় এবং তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই’ (সূরা ইউনুস : ৬১)।
ঘ. দিবা-রাত্রি সৃষ্টি রহস্য
বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, রাতের বেলায় ঘুমানোই ঘুমের জন্য যথোপযুক্ত ও স্বাভাবিক সময়। আর দিন মানুষের যাবতীয় কাজ-কর্ম করার পূর্ণদ্দোমে কর্মতৎপর হওয়র সময়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তিনি তৈরি করেছেন তোমাদের জন্য রাত, যেন তোমরা বিশ্রাম করতে পার এবং দেখার জন্য দিন। যে সম্প্রদায় কথা শুনে নিশ্চয় তাদের জন্য এতে আছে অনেক নিদর্শন’ (সূরা ইউনুস : ৬৭)।
উপসংহারঃ
উপরিউক্ত আলোচনা হতে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, মানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য এক অনন্য মু‘জিযায় ভরপুর। আর এটি যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে তা প্রমাণিত সত্য। কেননা এর শুরুতেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া আছে যে,
‘এটা এমন একটি কিতাব যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
তাছাড়া তিনি তো মানুষ ও জিন জাতিকে এর মত একটি আয়াত নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার দুঃসাহস আজো কেউ দেখাতে পারেনি। তাছাড়া যুগে যুগে যারাই এ কিতাবের ভুল ধরার অপচেষ্টা চালিয়েছে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
এটাই একমাত্র মু‘জিযা, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। কেননা নবী (ﷺ)-ই শেষ নবী হওয়ায় তাঁর দাওয়াত ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। সুতরাং তাঁর শেষ্ঠ মু‘জিযা এই কুরআনও ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আর আল-কুরআনের বিশেষ মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য হল, এর মু‘জিযা বা অলৌকিকতা। আল-কুরআনে সাহিত্য, ইলম, শিখন-প্রশিক্ষণ, বিধি-বিধানসহ সকল ক্ষেত্রে অলৌকিক মাহাত্ম্য বিদ্যমান।
এটি এমন একটি গ্রন্থ যার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সাহিত্য গর্ভী জাহেল ব্যক্তির নিকট এমর্মে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। তিনি মানব ও জিন জাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের সূরার মত একটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, অথচ এতে তারা অক্ষম হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ لَئِنْ اجْتَمَعَتِ الْإِنسُ وَالْجِنُ عَلَى أَنْ يَأْتُوْا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُوْنَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيْرًا
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৮)। নিম্নে আল-কুরআনের মু‘জিযা বা অলৌকিক মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।
আল-কুরআনুল কারীমের মু‘জিযা বা অলৌকিক মাহাত্ম্যঃ
পুরো কুরআনুল কারীমই এর অলৌকিক মাহাত্ম্যে ভরপুর। এই অলৌকিক মাহাত্ম্যকে আহলুল ইলম প্রধানত চারভাগে ভাগ করেছেন। যা নিম্নরূপ :
১. বর্ণনাগত মু‘জিযা
কুরআনুল কারীমের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মু‘জিযা হল, বর্ণনাগত মু‘জিযা। আর বর্ণনাগত মু‘জিযা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বাক্যের অসামান্য শৈল্পিক গঠন, অবস্থা অনুযায়ী যথাযোগ্য ব্যবহার ও নির্ভুল অর্থে বাক্যের প্রয়োগ। সুতরাং কোন বিশুদ্ধভাষী আরব পণ্ডিত যদি কুরআনের কোন শব্দকে বাদ দিয়ে একই অর্থের অন্য কোন শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করতে চায়, তবে সে তা করতে পারবে না; বরং গঠনগত ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে বাক্যের সৌন্দর্য, এর গঠন ও যথাযোগ্য ব্যবহার বিনষ্ট করে ফেলবে। কেননা কুরআনে ব্যবহৃত শব্দমালা অর্থ, শব্দের সৌন্দর্য ও বিষয়বস্তুর সাথে শব্দের সুসমঞ্জস্যতার বিচারে অতি উন্নত ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কুরআনের প্রতিটি আয়াত অলঙ্কার ও উন্নত বাচনভঙ্গি দ্বারা পরিপূর্ণ। কেউ কুরআনের আয়াতসমূহের মাঝে কোন বৈপরীত্য খুঁজে পাবে না।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أفَلَا يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللّٰهِ لَوَجَدُوْا فِيْهِ اخْتِلَافًا كَثِيْرًا
‘তবে কি তারা কুরআনকে গভীরভাবে অনুধাবন করে না? যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তারা এতে অনেক অসঙ্গতি পেত’ (সূরা আন-নিসা : ৮২)।
২. জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক মু‘জিযা
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বাস্তবমুখী ও প্রকৃত জ্ঞান, যার ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। কুরআনুল কারীমে এমন অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে, যা মানুষ ও জীব-জন্তু সৃষ্টির রহস্য এবং প্রাকৃতিক বিষয়াবলী সম্পর্কে আলোচনা করে। যেমন বেশ কিছু আয়াত আছে যা জ্যোতির্বিদ্যা, পৃথিবী সৃষ্টির পদ্ধতি ও অন্যান্য নানা বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে। আর এটা কুরআনুল কারীমের এমন মু‘জিযা হিসাবে গণ্য, যা মানুষের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিষয়ে আলোচনা করে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবকে সকল যুগের জন্য জীবন্ত মু‘জিযা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
سَنُرِيْهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ
‘অচিরেই আমরা তাদেরকে আমাদের নিদর্শনাবলী দেখাব, বিশ্বজগতের প্রান্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, অবশ্যই এটা (কুরআন) সত্য। এটা কি আপনার রবের সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব কিছুর উপর সাক্ষী?’ (সূরা আল-ফুচ্ছিলাত : ৫৩)।
৩. আইন বা বিধান সম্পর্কিত মু‘জিযা
একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীম অসংখ্য শিক্ষা ও বিধানাবলী নিয়ে আগমন করেছে। সুতরাং মুসলিমগণ যদি এই কুরআনের আনুগত্য করে তবে তাদের রাষ্ট্রের উন্নতি ঘটবে ও পরিধি বৃদ্ধি পাবে। আর যারা এ কুরআন থেকে দূরে সরে যাবে তারা পৃথিবীতে অপদস্ত হবে। কেননা কুরআন মানুষের সামাজিক জীবনের যাবতীয় সমস্যার নির্ভুল সমাধান ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এছাড়া কুরআনের অন্যতম মু‘জিযা হল, কুরআনের যাবতীয় বিধানাবলী মানব জীবনের সকল স্থানের ও সর্বকালের সকল সমস্যার সমাধানের জন্য প্রযোজ্য। এটি মানব জাতির প্রতি উত্তম চরিত্র গঠনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। এমনকি এই কুরআন উত্তম চরিত্র গঠন, যথাযোগ্য হকদারের নিকট আমানত পৌঁছে দেয়া ও বিভিন্ন সৎ আমল করা মুসলিমদের প্রতি ফরয বা আবশ্যক সাব্যস্ত করেছে।
৪. গায়েবী বিষয়ে মু‘জিযা
এ বিষয়ে কুরআনে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। হয়তো তা বহুকাল পূর্বে সংঘটিত কোন ঘটনা হতে পারে। যেমন, নবীদের কাহিনী, আছহাবে কাহ্ফের কাহিনী ও আরো অন্যান্যের কাহিনী। এই ঘটনাগুলো নবী (ﷺ)-এর সময়ে কুরআনের পূর্বে কেউ জানত না এবং কেউ তা বর্ণনাও করেনি। এই অজানা ঘটনা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের মাধ্যমে শুধু জানিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং এ ঘটনাগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تِلْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهَا إِلَيْكَ مَا كُنْتَ تَعْلَمُهَا أَنْتَ وَلَا قَوْمُكَ مِنْ قَبْلِ هَذَا فَاصْبِرْ إِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِينَ
‘এসব গায়েবের সংবাদ আমরা আপনাকে অহী দ্বারা অবহিত করেছি, যা এর আগে আপনি জানতেন না এবং আপনার সম্প্রদায়ও জানত না। কাজেই আপনি ধৈর্যধারণ করুন। নিশ্চয় শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্যই’ (সূরা হূদ : ৪৯)।
এছাড়া কুরআন এমন গায়েবী ঘটনা বর্ণনা করেছে, যা নবী (ﷺ)-এর সময়েই ঘটেছে কিন্তু তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। যেমন যুদ্ধের সময় কাফেরদের চক্রান্ত সম্পর্কে নবী (ﷺ) জানতে পারতেন। এমনকি মুনাফিক্বদের অন্তরের গোপন বিষয়ও জানতে পারতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذْ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللّٰهُ وَرَسُوْلُهُ إِلَّا غُرُوْرًا
‘আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়’ (সূরা আল-আহযাব : ১২)।
এমনকি আল-কুরআনে গায়েবী বিষয় তথা ভবিষ্যতের সংবাদ ও ভবিষ্যতে যা ঘটবে তার অনেক বর্ণনা রয়েছে। এটাও আল-কুরআনের মু‘জিযার অন্যতম একটি অংশ।
আল-কুরআনের মধ্যে ভবিষ্যৎকালীন মু‘জিযাঃ
আল-কুরআনের মু‘জিযার অন্যতম দিক হল, এই কিতাব ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে এমন ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অবহিত করেছে। কেননা আল-কুরআন ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আর ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো ক্রমেই বাস্তবায়িত হতে থাকবে। যেমন,
ক. ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আল-কুরআন যে সকল সংবাদ দিয়েছে তার মধ্যে কতিপয় এমন ঘটনা আছে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়েই বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন মুসলিমদেরকে যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর সাহায্য অথবা কিছু কাফের তার কুফুরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَتَبَّ- مَا أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ - سَيَصْلَىٰ نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ
‘ধ্বংস হোক আবূ লাহাবের হস্তদয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসেনি। অচিরেই সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে’ (সূরা আল-লাহাব : ১-৩)।
খ. আবার আল-কুরআন এমনও বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, যা নবী করীম (ﷺ)-এর ওফাতের পর সংঘটিত হয়েছে। যেমন আল-কুরআন মুসলিমদেরকে সংবাদ দিয়েছে যে, তারা অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা সম্প্রদায়ের সাথে লড়াই করবে। সুতরাং তারা হয় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে অথবা তারা (কাফেররা) আত্মসমর্পণ করবে। যেমন আল্লাহর বাণী,
قُل لِّلْمُخَلَّفِينَ مِنَ الْأَعْرَابِ سَتُدْعَوْنَ إِلَىٰ قَوْمٍ أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ تُقَاتِلُونَهُمْ أَوْ يُسْلِمُونَ
‘যেসব মরুবাসী পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদেরকে বলুন, অবশ্যই তোমরা আহূত হবে এক কঠোর যোদ্ধা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে; তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে অথবা তারা আত্মসমর্পণ করে’ (সূরা আল-ফাত্হ : ১৬)।
গ. আল-কুরআন এমন বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর বাস্তবায়িত হয়নি তবে অচিরেই আবশ্যিভাবে তা সংঘটিত হবে। আল-কুরআনে ক্বিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হবে এমন কিছু ঘটনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ইয়াজূজ-মাজূজ বের হওয়ার ঘটনা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوْجُ وَمَأْجُوْجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُوْنَ.
‘অবশেষে যখন ইয়াজূজ ও মাজূজকে মুক্তি দেয়া হবে, আর তারা প্রতিটি উঁচু ভুমি থেকে ছুটে আসবে’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৯৬)। আর এর পর পৃথিবীতে যা ঘটবে তা হল, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ - وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ
‘যখন আসমান বিদীর্ণ হবে। আর যখন নক্ষত্রগুলো ঝরে পড়বে’ (সূরা আল-ইনফিত্বার : ১-২)।
জ্ঞান-বিজ্ঞানগত মু‘জিযার কতিপয় দৃষ্টান্তঃ
কুরআনুল কারীমে জ্ঞান-বিজ্ঞানগত যে মু‘জিযা বিদ্যমান তা বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি ও ব্যাপক গবেষণার ফলে, সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি যে সকল বিষয় আমাদের বুঝতে অসুবিধা হত, বিজ্ঞানের বিস্তারের ফলে তা বুঝা আমাদের জন্য অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। সুতরাং কুরআনের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক তথ্যাদি রয়েছে। যা আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকৃতি দেয়। এমনকি বিজ্ঞানের উন্নতির প্রতিটি ধাপে আল-কুরআনে অবস্থিত বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যাদি থেকে আরো ভালোভাবে পর্দা সরে গেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে কুরআনের মু‘জিযার মধ্যে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নরূপ :
ক. গর্ভজাত শিশুর ক্রমবর্ধমান স্তরসমূহ
আল-কুরআন বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে যে, গর্ভস্থিত ভ্রুণ কিভাবে ক্রমে ক্রমে স্তর ভিত্তিক বৃদ্ধি হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে রূপান্তরিত হয় এবং এক পর্যায়ে ভূমিষ্ট হয় ও বার্ধক্যে উপনিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে তাঁর বিজ্ঞানময় কুরআনে বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوْا أَشُدَّكُمْ
‘হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমরা সন্দেহে থাক তবে অনুধাবন কর, আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি হতে, তারপর শুক্র হতে, তারপর ‘আলাক্বাহ বা জমাটবদ্ধ রক্তপিণ্ড হতে, তারপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোস্তপিণ্ড হতে- যাতে আমরা বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রকাশ করি। আর আমরা যা ইচ্ছা করি তা এক নির্দিষ্টকালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি। তারপর আমরা তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনিত হও’ (সূরা আল-হজ্জ : ৫)।
খ. বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে যে, কোন উদ্ভিদের তথা খেজুর, ডুমুর ইত্যাদি গাছে ফল হওয়ার জন্য বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন আবশ্যক। কেননা পুরুষ ফুলের কাছ থেকে স্ত্রী ফুলের নিকট বাতাসের মাধমে রেনু গিয়ে সেখানে পরাগায়ন হয়ে ফল-ফলাদী হয়। আর এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَرْسَلْنَا الرِّيَاحَ لَوَاقِحَ ‘আর আমরা বৃষ্টি-গর্ভ বায়ু পাঠাই’ (সূরা আল-হিজর : ২২)।
গ. অণুর বিভাজন
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে যে, অণু একটি অনেক ছোট আকৃতির বস্তু। আর এই অণু গঠিত হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ ছোট ছোট অনেকগুলো উপাদান থেকে। যেমন ইলেক্ট্রন ও প্রোটন। আর এটা তো কুরআনুল কারীমের মধ্যে বহুকাল পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِيْ كِتَابٍ مُبِيْنٍ
‘আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয় এবং তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই’ (সূরা ইউনুস : ৬১)।
ঘ. দিবা-রাত্রি সৃষ্টি রহস্য
বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, রাতের বেলায় ঘুমানোই ঘুমের জন্য যথোপযুক্ত ও স্বাভাবিক সময়। আর দিন মানুষের যাবতীয় কাজ-কর্ম করার পূর্ণদ্দোমে কর্মতৎপর হওয়র সময়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوْا فِيْهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُوْنَ
‘তিনি তৈরি করেছেন তোমাদের জন্য রাত, যেন তোমরা বিশ্রাম করতে পার এবং দেখার জন্য দিন। যে সম্প্রদায় কথা শুনে নিশ্চয় তাদের জন্য এতে আছে অনেক নিদর্শন’ (সূরা ইউনুস : ৬৭)।
উপসংহারঃ
উপরিউক্ত আলোচনা হতে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, মানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য এক অনন্য মু‘জিযায় ভরপুর। আর এটি যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে তা প্রমাণিত সত্য। কেননা এর শুরুতেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া আছে যে,
ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيْهِ
‘এটা এমন একটি কিতাব যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
তাছাড়া তিনি তো মানুষ ও জিন জাতিকে এর মত একটি আয়াত নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার দুঃসাহস আজো কেউ দেখাতে পারেনি। তাছাড়া যুগে যুগে যারাই এ কিতাবের ভুল ধরার অপচেষ্টা চালিয়েছে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
- আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস