তাওয়াক্কুল : মনোবিদ্যা ও মনের কাজ
আল্লাহর উপর ভরসা মন সংক্রান্ত বিদ্যা ও মনোবৃত্তি সংক্রান্ত কাজের সমষ্টি। মনসংক্রান্ত বিদ্যা এজন্য যে, বান্দার জানা আছে যে, আল্লাহই সকল কাজের পরিকল্পনাকারী ও নিয়ন্ত্রক ...। আর মনোবৃত্তি সংক্রান্ত কাজ এজন্য যে, তাওয়াক্কুলের ফলে বান্দার মন স্রষ্টায় স্থির থাকে, তার উপরই ভরসা ও নির্ভর করে...।
বিষয়টি পরিষ্কার করতে আমরা বলছি, আল্লাহর উপর ভরসাকারী বান্দার নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানতে এবং আমলে নিতে হবে।
১. রব ও তাঁর গুণাবলীর পরিচয় লাভ : বান্দাকে তার প্রভুর নাম ও গুণাবলীসহ জানতে হবে। প্রভুর ক্ষমতা, যথেষ্টতা, রক্ষণাবেক্ষণ, শক্তিমত্তা, শ্রেষ্ঠত্ব, চিরঞ্জীবতা, ঘুম-ক্লান্তির ধারে-কাছেও না ঘেঁষা ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। বান্দা যখন এসব কিছু জানবে ও বুঝবে তখনই সে যথাযথভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করবে এবং জানতে পারবে যে, সে এক পরাক্রমশালী মহাশক্তিধরের নিকট তার সবকিছু সঁপে দিয়েছে।
২. তাওহীদের পথে দৃঢ় থাকা : বান্দা যখন তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস নিশ্চিত করতে পারবে, তখন তার তাওয়াক্কুলের একটি বিরাট অংশ অর্জিত হবে। আল্লাহ বলেন,
‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তার উপরেই আমি ভরসা করি’ (তওবা ৯/১২৯)। আল্লাহকে যথেষ্ট ভাবাই তো তাওহীদ ও ভরসা।
৩. সকল কাজে আল্লাহর উপর নির্ভর করা : সুখে-দুঃখে, সম্পদে-বিপদে সর্বাবস্থায় আমাদেরকে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরতা কোনমতেই ঐসব জাহেল মূর্খদের মত হবে না যারা সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ হাতের নাগালে পেলে আল্লাহকে ভুলে বসে থাকে এবং উপায়-উপকরণ নিয়ে মেতে থাকে; আর সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ হাতছাড়া হয়ে গেলে তখনই কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে।
৪. আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ : মুমিন বান্দা যতই তার রবের উপর ভরসা করবে ততই তার প্রতি সুধারণা পোষণ করবে। সে জেনে রাখবে যে, মালিকের উপর যে ভরসা করে মালিক তার জন্য যথেষ্ট, তার আর অন্য কিছু প্রয়োজন নেই।
এতে করে তার অন্তর অস্থিরতায় ভুগবে না এবং দুনিয়া তার হাতে এল কিংবা হাতছাড়া হ’ল বলে কোন পরোয়া করবে না। কেননা তার নির্ভরতা তো তার মালিক আল্লাহর উপর। যেমন একজন বাদশাহ কোন লোককে এক টাকা দিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তা চুরি হয়ে গেল। তখন বাদশাহ তাকে বলল, চিন্তা কর না, আমার কাছে প্রচুর টাকা রয়েছে। তুমি যখনই আসবে আমি তোমাকে আমার কোষাগার থেকে তা কয়েকগুণ বেশী করে দেব। সুতরাং যে জানে যে, আল্লাহ সকল বাদশাহর বাদশাহ এবং তার ভান্ডার সব সময় পরিপূর্ণ থাকে, দুনিয়ার কোন স্বার্থ ছুটে গেলে তাতে সে পেরেশান হয় না বা অস্থিরতাবোধ করে না।
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন,أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِىْ بِىْ ‘আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা করে আমি তার নিকট তেমনই’।[1] সুতরাং সুধারণা যেমন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের দিকে আহবান জানায়, তেমনি আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের মাঝেও অবশ্যই সুধারণা থাকে।
৫. আন্তরিকভাবে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ : দুনিয়াতে একজন হীন ক্রীতদাস যেমন তার মনিবের অনুগত থাকে এবং তার কথা মেনে চলে, তেমন করে বান্দা যদি আল্লাহকে আনুগত্য ও মান্য করে তাহ’লেই ভরসা অর্জিত হবে। কবি বলেন,
‘বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ভরসা করো আল্লাহ পরে,
ভাল-মন্দ যা কিছু হোক খুশী থাক তাঁর তরে।
বিপদ যিনি কাটিয়ে দেন, তিনি মোদের আল্লাহ,
ফায়ছালা যা করেন তিনি মেনে চল সর্বদা।
মালিকের বিচার থেকে উদ্ধারের নেই কোন উপায়,
বুঝে নিও, যা পেয়েছ তাই যে ছিল প্রাপ্য তোমায়।
হতাশা তো ছিন্ন করে আশাবাদীর আশার বাণী,
কভু হতাশ হয়ো নাকো প্রভু তোমার কাদের গণী।[2]
৬. দায়িত্বভার সমর্পণ : ফিরাউনের দলবলে বসবাসকারী একজন মুমিনের যবানীতে আল্লাহ বলেছেন,
‘আমি যা তোমাদের (ফিরাউন ও তার লোকদের) বলছি অচিরেই তোমরা তা মনে করবে। আমি আমার দায়িত্বভার আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি’ (মুমিন ৪০/৪৪)।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন,
‘কর্মভার আল্লাহর নিকট সমর্পণ সংক্রান্ত আল্লাহর কিতাবে সবচেয়ে বড় আয়াত আল্লাহর বাণী ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য বেরোনোর উপায় করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না’ (তালাক্ব ৬৫/২-৩)।[3]
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম তাঁর শিক্ষক ইবনু তায়মিয়ার বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘ফায়ছালাকৃত বিষয়কে দু’টি জিনিস ঘিরে থাকে। আগে থাকে ভরসা পরে থাকে সন্তুষ্টি। সুতরাং কাজে নামার আগে যে আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং কাজের পরে আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকে সেই উবূদিয়াত বা দাসত্বের দায়িত্ব পালন করে’।[4]
এজন্যই ইস্তিখারার দো‘আয় দেখুন বলা হয়েছে,
‘আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ কর, তা সে যেখানেই হোক ও তাতে আমাকে খুশী রাখ’।[5] সুতরাং সিদ্ধান্তকৃত কাজে নেমে পড়ার আগে আল্লাহর উপর ভরসা করলে তা হবে আল্লাহর নিকট কর্মভার সমর্পণ, আর কাজ শেষে তার উপর ভরসা করলে তা হবে সন্তুষ্টি।
৭. কাজের উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করা, তবে তাকে কার্য সাধনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না ভাবা :
জীবন ধারণে বা কোন কাজ সম্পন্ন করতে যে উপায়-উপকরণ অবলম্বনের কথা অস্বীকার করে এবং নিশ্চেষ্ট বসে থাকে, সে গন্ডমূর্খ ও পাগল। আবার যে আল্লাহর কুদরতের উপর ভরসা না করে শুধুই উপায়-উপকরণ নিয়ে পড়ে থাকে তার আচরণ শিরকী।
আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি কি তাকে (আমার উষ্ট্রীটাকে) বেঁধে রেখে (আল্লাহর উপর) ভরসা করব, না কি তাকে বন্ধনমুক্ত করে দিয়ে ভরসা করব? তিনি বললেন, আগে বেঁধে রাখো, তারপর ভরসা কর’।[6] অনেক সময় বান্দা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করা ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পায় না, অথচ দেখুন এই দো‘আ কতই না উত্তম অবলম্বন।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁর বান্দাদেরকে উপায় অবলম্বন করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘তিনি সেই মহান সত্তা যিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে অনুকূল করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার (ভূমির) বুকে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রূযী খাও’ (মুলক ৬৭/১৫)। তিনি আরও বলেন,
‘তারপর যখন (জুম‘আর) সালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান করবে, আর আললাহকে বেশী বেশী স্মরণ করবে। সম্ভবতঃ তোমরা সফল হবে’ (জুম‘আ ৬২/১০)।
তিনি আরও বলেন,
‘আর অন্য কিছু লোক আছে, যারা যমীনে বিচরণ করে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করে’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)।
ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর যুগে কিছু লোক দাবী করত যে তারা ভরসাকারী। তারা বলত, আমরা বসে থাকব, আমাদের খাওয়া-পরা দেওয়ার দায়িত্ব আল্লাহর উপর। তাদের উক্তি সম্পর্কে ইমাম ছাহেবকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘এটা একদম রাবিশ কথা, আল্লাহ কি বলেননি,
‘হে ঈমানদারগণ! যখন জুম‘আর দিনে সালাতের আযান দেওয়া হয় তখন তোমরা বেচাকেনা ছেড়ে আল্লাহর যিকিরে (সালাতে) এগিয়ে এস। যদি তোমাদের বোধ-বুদ্ধি থাকে তবে এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। অতঃপর যখন সালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করবে আর আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করবে, সম্ভবতঃ তোমরা সফল হবে’ (জুম‘আ ৬২/৯-১০)।[7]
তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কার্যাবলী :
১. কুলক্ষণ ও অশুভ : কুলক্ষণ ও অশুভ বলতে বুঝায়- কোন মানুষ একটা কিছু দেখতে কিংবা শুনতে পেয়ে তাকে কুলক্ষণ ও অশুভ গণ্য করে এবং মনে করে যে, এই দেখা বা শোনার ফলে তার মনোবাসনা ও লক্ষ্য মোটেও পূরণ হবে না। আর কাজে নামার আগে এরূপ ঘটলে তার ঐ কাজে নামা উচিত হবে না।
এরূপ অশুভ ভাবনা আল্লাহর উপর ভরসার একেবারেই পরিপন্থী। কেননা আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে থাকা মন এবং আল্লাহর উপর ভরসাকারী কোন অন্তরকে কখনই কোন কানা লোকের দর্শন, বাম দিক দিয়ে পাখি উড়ে যাওয়া, বিমানে তের নম্বর সিট লাভ করা ইত্যাকার কোন অনর্থক ও বাতিল কথা তার গন্তব্য থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে না।
এদিকে নবী করীম (ﷺ)ও কুলক্ষণ ও অশুভ গণ্য করা সম্পর্কে সবাইকে হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, لاَ طِيَرَةَ ‘কুলক্ষণ ও অশুভ বলে কিছু নেই’।[8]
এই কুলক্ষণ ও অশুভর প্রতি বিশ্বাস এবং এগুলো মেনে চলা কেবলই যে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী তা নয়; বরং এগুলো আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসেরও পরিপন্থী।
২. জ্যোতিষী ও গণকের কাছে যাওয়া : তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী যেসব কাজ রয়েছে তন্মধ্যে জ্যোতিষী, গণক ও হারানো বস্ত্তর সন্ধানদাতাদের নিকট ধর্ণা দেওয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব গণক ও জ্যোতিষী অদৃশ্য লোক ও ভবিষ্যৎ জানার দাবী করে। মুমিন বান্দা যদি সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকে তাহ’লে সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দ্বারস্থ হবে না এবং যিনি ছাড়া আর কারো গায়েব বা অদৃশ্য লোকের খবর জানা সম্ভব নয়, সেই মহান আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কাউকে সে খুঁজবে না।
ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আলী (রাঃ) যখন খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করছিলেন তখন এক জ্যোতিষী এসে তাঁকে বলে, হে আমিরুল মুমিনীন, আপনি এই যুদ্ধে যাবেন না। কারণ চাঁদ এখন বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করছে। চাঁদ বৃশ্চিক রাশিতে থাকাকালে আপনি যাত্রা করলে আপনার বাহিনী পরাজিত হবে। তখন আলী (রাঃ) বলেছিলেন, আমি বরং আল্লাহর উপর ভরসা ও ভরসার্থে এবং তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণ করতে অবশ্যই যাত্রা করব। শেষ পর্যন্ত তিনি যাত্রা করেন এবং ঐ সফরে তিনি প্রচুর কল্যাণ লাভ করেন। অধিকাংশ খারেজী এ যুদ্ধে ধরাশায়ী হয়। আর নবী করীম (ﷺ)-এর আদেশ মতো যুদ্ধ করে জয়ী হওয়াতে আলী (রাঃ) অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।[9]
কোন মুমিন যদি এ ধরনের কোন জ্যোতিষী, গণকঠাকুর কিংবা হারানো বস্ত্তর সন্ধানদাতা থেকে কোন খবর শুনতে পায় তাহ’লে তার বিরোধিতা করা এবং তার কোন কথা বিশ্বাস না করাতেই সে সর্বাত্মক মঙ্গল লাভ করবে।
৩. তাবীয ঝুলান : গলা, হাত ইত্যাদি যে কোন অঙ্গে তাবীয ঝুলানো বা বাঁধা ভরসা বিরোধী কাজ। অনেক জাহেল মূর্খ তাদের বুকের উপর নীল সুতা কিংবা কাগজ পাতা ঝুলিয়ে রাখে। ভেল্কিভাজ, যাদুকর, গণকঠাকুর কিসিমের লোকদের থেকে তারা আত্মরক্ষার্থে এগুলো ব্যবহার করে। যার কাজ এ ধরনের তার আল্লাহর উপর ভরসা থাকল কোথায়?
অপরাধ অনুপাতে এসব লোক শাস্তিযোগ্য হবে। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
‘যে তার দেহে (তাবীয ইত্যাদি) যা কিছু লটকাবে তাকে তার উপরেই সোপর্দ করা হবে’।[10] যখন সে কালি লেখা পাতা বা অনুরূপ কিছু ঝুলাবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করবে না, তখন আল্লাহ তাকে ঐ ঝুলানো বস্ত্তর উপরে অর্পণ করবেন। তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য এটাই হবে যথেষ্ট।
৪. গাছ, পাথর ইত্যাদিকে বরকতময় ভেবে তার থেকে বরকত কামনা করা :
গাছ, পাথর ও অন্য যেসব জিনিস থেকে বরকত লাভের আশা করা অবৈধ সেসব কিছু থেকে বরকত লাভ করা তাওয়াক্কুল বিরোধী কাজ। কখনো কখনো এ ধরনের কাজ শিরকের দিকে ধাবিত করে। নাঊযুবিল্লাহ।
৫. জীবিকার খোঁজ না করে বেকার বসে থাকা : ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, উপায়-অবলম্বন গ্রহণ করা তাওয়াক্কুলের অন্যতম শর্ত। অবলম্বন গ্রহণ না করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী। আমাদের এ কালে যে বালা-মুছীবত ব্যাপকতা লাভ করছে সে সম্পর্কে আমরা এখানে কিছু আলোচনা করছি। এ মুছীবত হ’ল বেকারত্ব। অনেক লোকই তাদের খাওয়া-পরার জন্য কোন কাজকর্ম না করে অন্যের উপর ভরসা করে পড়ে থাকে। ছেলে খাবারের জন্য পিতার উপর এবং ভাই চাকুরিজীবী বোনের উপর ভরসা করে থাকে। যুবশ্রেণী কোন ফলপ্রসূ কাজ তালাশ করে না, বরং তারা যে কাজে কোন শ্রম নেই কিংবা থাকলেও সামান্য তেমন কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে ভালবাসে। জীবিকার জন্য শ্রম ও চেষ্টার উপর বেকার ও অলস সময় কাটানোকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অথচ কুরআন-সুন্নাহতে জীবিকা উপার্জনের অনেক পথের কথা বলা হয়েছে। আমরা তার কিছু এসব অলস বেকারদের জন্য তুলে ধরছি।
(ক) জীবিকার সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন এবং হালালের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হালাল জীবিকা হ’ল যুদ্ধলব্ধ গণীমত।
আল্লাহ বলেন,
‘সুতরাং যুদ্ধে তোমরা যা কিছু গণীমত রূপে লাভ করেছ, তা হালাল ও পবিত্র হিসাবে ভক্ষণ কর’ (আনফাল ৮/৬৯)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘আর আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে’।[11]
(খ) নিজ হাতে কামাই : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘কোন ব্যক্তি নিজ হাতের কামাইয়ের মাধ্যমে যা খায় তার থেকে উত্তম কোন খাদ্য সে কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাঊদ নিজ হাতের কামাই থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন’।[12] তিনি আরো বলেন,
‘তোমাদের কারো পিঠে করে কাঠের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া অপরের কাছে ভিক্ষা চাওয়া অপেক্ষা অনেক ভাল, সে লোকটা তাকে দিতেও পারে আবার নাও পারে’।[13]
(গ) ব্যবসা-বাণিজ্য : বহু আনছার ও মুহাজির সাহাবীর পেশা ছিল ব্যবসা। আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ)-কে দেখুন, তার আনছারী ভাই তাকে তার মালের অর্ধেক দিতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে বললেন, دُلُّونِى عَلَى السُّوقِ ‘তোমরা আমাকে বাজারের রাস্তা দেখিয়ে দাও’।[14]
(ঘ) চাষাবাদ ও ফল বাগান তৈরী : এগুলো জীবিকা অন্বেষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এগুলোতে যতটা আল্লাহর উপর ভরসা করতে দেখা যায়, অন্য কোন কাজে তা দেখা যায় না। এতে প্রকৃতই আল্লাহর উপর ভরসা করতে হয়। কেননা চাষী যখন বীজ বপন করে, পানি সেচ দেয় তখন তার খুব ভাল মতো জানা থাকে যে, বীজের অঙ্কুরোদগম হওয়া আল্লাহর মর্যির উপর নির্ভরশীল, আবার প্রাকৃতিক বিপদ-আপদ থেকে ফসলের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই আছে। কত ফসল যে পঙ্গপালের আক্রমণে নিঃশেষ হয়ে গেছে! আর কত ক্ষেত-খামার অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, প্রচন্ড তুষারপাতে ধ্বংস হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা আছে কি?
এজন্যই চাষী কৃষকরা শ্রমজীবী লোকদের মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে অধিক সম্পর্কযুক্ত মানুষ। তাকালেই তা নযরে আসবে।
৬. চিকিৎসার চেষ্টা না করা :
রোগশোক দেখা দিলে চিকিৎসার চেষ্টা না করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কাজ। নবী করীম (ﷺ) তো বলেছেন,
‘আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন রোগ দেননি যার প্রতিষেধক বা চিকিৎসা তিনি দেননি’।[15]
একইভাবে তিনি রোগের চিকিৎসা করতেও আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, يَا عِبَادَ اللهِ تَدَاوَوْا ‘আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা চিকিৎসা করাও’।[16]
আর চিকিৎসাতো আল্লাহ কর্তৃক বিধেয় অবলম্বনের অন্তর্গত।
ভরসাকারীদের কাহিনী :
আল্লাহর উপর ভরসাকারী নেককারদের কাহিনী শুনলে বান্দা আল্লাহর উপর অবশ্যই তাওয়াক্কুলে উদ্বুদ্ধ হবে। আল্লাহর উপর সত্য ভরসা করে তারা কী ফল লাভ করেছে তা জানলে নিশ্চয়ই তার আগ্রহ বাড়বে। আর ভরসাকারীদের শিরোমণি তো আমাদের রাসূল (ﷺ)।
নবী করীম (ﷺ) ও তরবারিওয়ালা :
এক সফরে নবী করীম (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ এক মরু উপত্যকায় বিশ্রামের জন্য ডেরা ফেলেন। নবী করীম (ﷺ) একটা গাছে তাঁর তরবারি ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়েন। সাহাবীরাও যে যার মত ছায়াদার গাছ দেখে বিশ্রামে মশগুল হয়ে পড়েন। হঠাৎ করে নবী করীম (ﷺ)-এর গলার আওয়াযে তারা ঘাবড়িয়ে যান। তারা তাঁর কাছে এসে দেখেন তাঁর পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পাশে একটা তরবারি পড়ে আছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের বললেন,
‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, এমন সময় এই লোকটা এসে তরবারিটা হাতে করে। আমি জেগে দেখি, সে আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম তার হাতে তরবারির খাপ খোলা। সে আমাকে বলল, আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? আমি বললাম, আল্লাহ। দ্বিতীয়বার সে বলল, আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? আমি বললাম, আল্লাহ। এবার সে তরবারিটা খাপে পুরে ফেলল। এখন তো তাকে দেখছ, সে বসে পড়েছে’।[17] একেই বলে ভরসা, আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা।
নবী করীম (ﷺ) গিরিগুহায় :
আবুবকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘(ছাওর) গিরিগুহায় থাকাকালে আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বললাম, (হে আল্লাহর রাসূল!) কেউ যদি তার দু’পায়ের নিচ দিয়ে তাকায় তাহ’লে তো সে অবশ্যই আমাদের দেখে ফেলবে। তিনি বললেন, হে আবুবকর! দু’জন ভাবছ কি? আল্লাহ তো তাদের (আমাদের) তৃতীয়জন’।[18]
এই হ’ল ভরসা ও আল্লাহতে সমর্পণ, যা ভীষণ সঙ্কট কালে বান্দার থেকে খোলাখুলি ফুটে উঠেছে। বান্দা অন্তর থেকে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার উপর ভরসা করেছে এবং তার নিকটেই নিজের যাবতীয় কাজ অর্পণ করেছে, বিশেষ করে যখন আল্লাহর নিকট সমর্পণ ব্যতীত তার আর কোন অবলম্বন অবশিষ্ট নেই।
জনৈকা মহিলা ও তার ছাগপাল :
মহিলা ও তার ছাগল পালের ঘটনায় তাওয়াক্কুলের গুরুত্বের চূড়ান্ত রূপ ধরা পড়েছে। ভরসা করলে একজন মানুষ কী ফল লাভ করতে পারে সে কথাও এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) তাঁর গ্রন্থে নবী করীম (ﷺ)-এর যুগের এ ঘটনাটি সংকলন করেছেন।
‘জনৈকা মহিলা মদীনায় বাড়ীতে ছিল। অতঃপর সে মুসলিম সেনাদলের সাথে যুদ্ধে যাত্রা করেছিল। বাড়ীতে সে ১২টা ছাগল এবং তার কাপড় বুননের একটা তাঁত/কাঁটা/মাকু রেখে গিয়েছিল। বাড়ী ফিরে এসে সে দেখে, তার ছাগপাল থেকে একটা ছাগল আর তার সেই তাঁত/কাঁটা/মাকু নেই। সে তখন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলল, হে আমার মালিক! তুমি তো তোমার রাস্তায় যে বের হবে তার হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছ। এদিকে আমি তোমার রাস্তায় বের হয়ে ফিরে এসে দেখছি আমার ছাগপাল থেকে একটা ছাগল আর আমার কাপড় বুননের তাঁত/কাঁটা/মাকু নেই। আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি, আমার ছাগল ও তাঁত/কাঁটা/মাকু ফিরিয়ে দাও। উক্ত মহিলা তার মালিকের নিকট কঠিনভাবে যে শপথ করেছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বার বার তার উল্লেখ করলেন। অবশেষে মহিলাটি সকাল বেলা তার ছাগল ও অনুরূপ একটা ছাগল আর তাঁত/কাঁটা/মাকু এবং অনুরূপ একটা তাঁত/ কাঁটা/মাকু ফিরে পেল’।[19] সুবহানাল্লাহ! কী ভীষণ ব্যাপার!!
এই মহিলা আল্লাহর উপর প্রকৃত অর্থে ভরসা করেছিল। ফলে আল্লাহ কেবল তার ছাগলই হেফাযত করেননি; বরং তাওয়াক্কুলের বরকতে তাকে দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।
জনৈকা মহিলা ও তার চুলা :
ইমাম আহমাদ (রহঃ) আরেকটি ঘটনা তাঁর সনদে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘অতীতকালে দু’জন স্বামী-স্ত্রী ছিল। ধন-সম্পদ বলতে তাদের কিছুই ছিল না। স্বামী বেচারা একদিন সফর করে বাড়ী ফিরে এল। সে ছিল প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে সে তার স্ত্রীর নিকটে বলল, তোমার কাছে খাবার মত কিছু আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ, সুসংবাদ শোন তোমার নিকট আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক এসেছে। [তার কাছে আসলে কিছুই ছিল না, কেবলই আল্লাহর উপর আশা-ভরসা ও নির্ভর করে সে একথা বলেছিল]। পুরুষ লোকটা বলল, তোমার ভাল হোক, তোমার কাছে কিছু থাকলে একটু জলদি কর। সে বলল, হ্যাঁ আছে বৈকি। একটু ছবর কর, আমরা আল্লাহর রহমতের আশা করছি। এভাবে যখন তার ক্ষুধা দীর্ঘায়িত হয়ে চলল তখন সে তার স্ত্রীকে বলল, তোমার উপর রহম হোক, ওঠো, দেখ, তোমার কাছে রুটি-টুটি থাকলে তা নিয়ে এস। আমি তো ক্ষুধায় একবারে শেষ হয়ে গেলাম। স্ত্রী বলল, এই তো চুলা পেকে এল বলে, তাড়াহুড়ো কর না। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলে যখন স্বামীটা আবার কথা বলবে বলবে এমন সময় স্ত্রী মনে মনে বলল, আমি উঠে গিয়ে আমার চুলাটা দেখি না। সে গিয়ে দেখল, চুলা ছাগলের সিনার/রানের গোশতে ভরপুর হয়ে আছে, আর তার যাঁতা দু’টো থেকে আটা বের হয়ে চলেছে। সে যাঁতার নিকট গিয়ে তা ঝেড়ে মুছে আটা বের করে নিল এবং চুলা থেকে ছাগলের সিনার/রানের গোশত বের করে আনল। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, যাঁর হাতে আবুল কাসেম মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জীবন তাঁর শপথ! মহিলাটি যদি তার দু’যাঁতায় যা আটা ছিল এবং ঝাড়ামুছা না করত তাহ’লে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত যাঁতাটি তাকে আটা দিয়ে যেত’।[20]
ওমর (রাঃ) ও কুষ্ঠরোগী এবং খালিদ (রাঃ) ও বিষ :
হাদীসের গ্রন্থগুলোতে দু’টি ঘটনার উল্লেখ আছে কিছু লোক যা দুষ্কর মনে করে।
একটি ঘটনা ইবনু ওমর (রাঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। তিনি একজন কুষ্ঠরোগীর সাথে বসে খেয়েছিলেন।[21]
দ্বিতীয় ঘটনা হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর বিষ পানের সাথে জড়িত। আবুস সাফার থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার খালিদ বিন ওয়ালীদ হিরা নগরে অবস্থান করছিলেন। তখন লোকেরা তাকে বলল,
‘আপনি কিন্তু সাবধানে থাকবেন, অনারবরা যেন আপনাকে বিষ পান না করিয়ে দেয়। তিনি তখন বললেন, তোমরা আমার নিকট বিষ নিয়ে এস। তাঁর নিকট বিষ নিয়ে আসা হ’ল। তিনি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তা পান করে নিলেন। বিষে তার মোটেও কোন ক্ষতি হ’ল না’।[22]
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ঘটনায় আল্লাহ তা‘আলার উপর তাঁর কঠিন তাওয়াক্কুলের নিদর্শন মেলে।
আলেমগণ এ ঘটনার বেশ কিছু দিক উল্লেখ করেছেন। যেমন-
(১) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) রোগ সংক্রমণের বিষয়কে দৃঢ়ভাবে নাকচ করতে চেয়েছেন এবং কুষ্ঠরোগী থেকে নবী করীম (ﷺ)-এর দূরে থাকার আদেশ লঙ্ঘন করতে চাননি।
(২) ওমর (রাঃ) কুষ্ঠ রোগীকে সমবেদনা জানাতে এরূপ করেছিলেন।
(৩) যে আল্লাহর উপর শক্তিশালী ভরসা রাখে সে হাদীসلاَ عَدْوَى ‘রোগ সংক্রমণ বলে কিছু নেই’-এর উপর আমল করবে; আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলে দুর্বল সে ‘কুষ্ঠরোগী থেকে পালিয়ে যাও’ (فِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ) হাদীসেরউপর আমল করবে।[23]
আর খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর ঘটনা থেকে বুঝা যায় তিনি আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থ ভরসা করেছিলেন বলেই বিষ তাঁর উপর কোনই ক্রিয়া করতে পারেনি। তাই বলে অন্য কারো জন্য বিষ পানে খালিদ (রাঃ)-এর অনুকরণ আদেŠ সিদ্ধ হবে না। বিদ্বানগণ তাঁর ঘটনারও বেশ কিছু দিক তুলে ধরেছেন। যেমন-
(১) এটি ছিল খালিদ (রাঃ)-এর কারামত। তাই অন্য কারো পক্ষে তার অনুসরণ বৈধ হবে না। নচেৎ বিষের প্রভাবে সে নিহত হ’তে পারে।
(২) হ’তে পারে যে, নবী করীম (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে খালিদের জন্য এমন কোন অঙ্গীকার ছিল যে, বিষ তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই খালিদ (রাঃ) আল্লাহর উপর ভরসা করে তা পান করে নিয়েছিলেন।[24]
(৩) কিছু বর্ণনায় এসেছে, শত্রুপক্ষ যাতে এ দৃশ্য দেখে তার অনুগত হয় এবং মুসলমানদের জান-মালের কোন ক্ষতি না করে সেজন্য তিনি বিষ পান করেছিলেন।
শেষ কথা :
প্রিয় ভাই আমার! উপরের আলোচনা থেকে আপনার কাছে আল্লাহর উপর ভরসা করার শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমরা আপনাকে ব্যাখ্যা করেছি যে, ভরসা উপায়-উপকরণ অবলম্বনে বাধা দেয় না এবং উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করাকে ভরসা (توكل) বলে না; বরং তাওয়াকুল (التواكل) বা তাওয়াক্কুলের ভান বলে। তাওয়াকুল বাতিলের পূজারী ও কুঁড়েদের দর্শন।
আমরা আপনার সামনে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের হুকুম বা বিধান এবং যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ তাওয়াক্কুলের আদেশ দিয়েছেন তেমন কিছু ক্ষেত্রও আলোচনা করেছি।
আমরা আল্লাহর উপর যথার্থ ভরসাকারী কিছু লোকের ঘটনা এবং তাদের অর্জিত ফলাফলের কথাও আপনার সামনে তুলে ধরেছি। ভরসা বিষয়ে আল্লাহর সহযোগিতায় আমাদের সামান্য কিছু আলোচনা এখানেই শেষ করছি।
আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমাদের একান্ত প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে এবং আপনাদেরকে তাঁর উপর ভরসাকারীদের শ্রেণীভুক্ত করেন, আমাদেরকে একত্ববাদীদের দলভুক্ত করেন এবং আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা হক কথা বলে এবং হক মত বিচার করে। আর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হৌক আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর।
[1]. বুখারী হা/৭৪০৫; মুসলিম হা/২৬৭৫।
[2]. শিহাবুদ্দীন আল-আবশীহী, আল-মুস্তাতরাফ ২/১৫১।
[3]. আল-মু‘জামুল কাবীর, ৯/১৩৩, হা/৮৬৫৯।
[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ২/১২২।
[5]. বুখারী হা/১১৬২; তিরমিযী হা/৪৮০; নাসাঈ হা/৩২৫৩।
[6]. তিরমিযী হা/২৫১৭, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
[7]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস, পৃঃ ৩৪৮।
[8]. বুখারী হা/৫৭৫৪; মুসলিম হা/২২২৩; মিশকাত হা/৪৫৭৬।
[9]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা ১/৫৭।
[10]. তিরমিযী হা/২০৭২; নাসাঈ হা/৪০৭৯, শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী। মিশকাত হা/৪৫৫৬।
[11]. আহমাদ হা/৫১১৪; ইরওয়া হা/২৬৯১, আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন।
[12]. বুখারী হা/২০৭২; মিশকাত হা/২৭৫৯।
[13]. বুখারী হা/২০৭৪।
[14]. বুখারী হা/৫০৭২।
[15]. বুখারী হা/৫৬৭৮।
[16]. তিরমিযী হা/২০৩৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৪৩৬; হাদীস সহীহ।
[17]. মুসলিম হা/৮৪৩।
[18]. বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৭১।
[19]. আহমাদ হা/২০৬৮৩; সহীহাহ হা/২৯৩৫, হাদীস সহীহ।
[20]. আহমাদ হা/৯৪৪৫, হায়ছামী মাজমাউয যাওয়ায়েদ গ্রন্থে (হা/১৭৮৭৪)এর বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্য আখ্যা দিয়েছেন। তবে শায়খ আলবানী ও শু‘আয়েব আরনাউত যঈফ বলেছেন। সহীহাহ হা/২৯৩৭-এর আলোচনা দ্রঃ।
[21]. তিরমিযী হা/১৮১৭, সনদ যঈফ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হা/২৫০২২; মূল বইয়ে ভুলবশতঃ ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ছাপা হয়েছে।
[22]. মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৭১৮৬।
[23]. বুখারী হা/৫৭০৭; মিশকাত হা/৪৫৭৭।
[24]. ঐ, ১০/২৪৮।
আল্লাহর উপর ভরসা মন সংক্রান্ত বিদ্যা ও মনোবৃত্তি সংক্রান্ত কাজের সমষ্টি। মনসংক্রান্ত বিদ্যা এজন্য যে, বান্দার জানা আছে যে, আল্লাহই সকল কাজের পরিকল্পনাকারী ও নিয়ন্ত্রক ...। আর মনোবৃত্তি সংক্রান্ত কাজ এজন্য যে, তাওয়াক্কুলের ফলে বান্দার মন স্রষ্টায় স্থির থাকে, তার উপরই ভরসা ও নির্ভর করে...।
বিষয়টি পরিষ্কার করতে আমরা বলছি, আল্লাহর উপর ভরসাকারী বান্দার নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানতে এবং আমলে নিতে হবে।
১. রব ও তাঁর গুণাবলীর পরিচয় লাভ : বান্দাকে তার প্রভুর নাম ও গুণাবলীসহ জানতে হবে। প্রভুর ক্ষমতা, যথেষ্টতা, রক্ষণাবেক্ষণ, শক্তিমত্তা, শ্রেষ্ঠত্ব, চিরঞ্জীবতা, ঘুম-ক্লান্তির ধারে-কাছেও না ঘেঁষা ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। বান্দা যখন এসব কিছু জানবে ও বুঝবে তখনই সে যথাযথভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করবে এবং জানতে পারবে যে, সে এক পরাক্রমশালী মহাশক্তিধরের নিকট তার সবকিছু সঁপে দিয়েছে।
২. তাওহীদের পথে দৃঢ় থাকা : বান্দা যখন তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস নিশ্চিত করতে পারবে, তখন তার তাওয়াক্কুলের একটি বিরাট অংশ অর্জিত হবে। আল্লাহ বলেন,
فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ
‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তার উপরেই আমি ভরসা করি’ (তওবা ৯/১২৯)। আল্লাহকে যথেষ্ট ভাবাই তো তাওহীদ ও ভরসা।
৩. সকল কাজে আল্লাহর উপর নির্ভর করা : সুখে-দুঃখে, সম্পদে-বিপদে সর্বাবস্থায় আমাদেরকে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরতা কোনমতেই ঐসব জাহেল মূর্খদের মত হবে না যারা সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ হাতের নাগালে পেলে আল্লাহকে ভুলে বসে থাকে এবং উপায়-উপকরণ নিয়ে মেতে থাকে; আর সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ হাতছাড়া হয়ে গেলে তখনই কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে।
৪. আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ : মুমিন বান্দা যতই তার রবের উপর ভরসা করবে ততই তার প্রতি সুধারণা পোষণ করবে। সে জেনে রাখবে যে, মালিকের উপর যে ভরসা করে মালিক তার জন্য যথেষ্ট, তার আর অন্য কিছু প্রয়োজন নেই।
এতে করে তার অন্তর অস্থিরতায় ভুগবে না এবং দুনিয়া তার হাতে এল কিংবা হাতছাড়া হ’ল বলে কোন পরোয়া করবে না। কেননা তার নির্ভরতা তো তার মালিক আল্লাহর উপর। যেমন একজন বাদশাহ কোন লোককে এক টাকা দিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তা চুরি হয়ে গেল। তখন বাদশাহ তাকে বলল, চিন্তা কর না, আমার কাছে প্রচুর টাকা রয়েছে। তুমি যখনই আসবে আমি তোমাকে আমার কোষাগার থেকে তা কয়েকগুণ বেশী করে দেব। সুতরাং যে জানে যে, আল্লাহ সকল বাদশাহর বাদশাহ এবং তার ভান্ডার সব সময় পরিপূর্ণ থাকে, দুনিয়ার কোন স্বার্থ ছুটে গেলে তাতে সে পেরেশান হয় না বা অস্থিরতাবোধ করে না।
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন,أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِىْ بِىْ ‘আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা করে আমি তার নিকট তেমনই’।[1] সুতরাং সুধারণা যেমন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের দিকে আহবান জানায়, তেমনি আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের মাঝেও অবশ্যই সুধারণা থাকে।
৫. আন্তরিকভাবে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ : দুনিয়াতে একজন হীন ক্রীতদাস যেমন তার মনিবের অনুগত থাকে এবং তার কথা মেনে চলে, তেমন করে বান্দা যদি আল্লাহকে আনুগত্য ও মান্য করে তাহ’লেই ভরসা অর্জিত হবে। কবি বলেন,
إذا ابتليت فثق بالله وارضَ به*إن الذي يكشف البلوى هو الله
إذا قضى الله فاستسلم لقدرته* ما لامريء حيلة فيما قضى الله
اليأس يقطع أحياناً بصاحبه * لا تيأسن فنعم القادر الله-
إذا قضى الله فاستسلم لقدرته* ما لامريء حيلة فيما قضى الله
اليأس يقطع أحياناً بصاحبه * لا تيأسن فنعم القادر الله-
‘বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ভরসা করো আল্লাহ পরে,
ভাল-মন্দ যা কিছু হোক খুশী থাক তাঁর তরে।
বিপদ যিনি কাটিয়ে দেন, তিনি মোদের আল্লাহ,
ফায়ছালা যা করেন তিনি মেনে চল সর্বদা।
মালিকের বিচার থেকে উদ্ধারের নেই কোন উপায়,
বুঝে নিও, যা পেয়েছ তাই যে ছিল প্রাপ্য তোমায়।
হতাশা তো ছিন্ন করে আশাবাদীর আশার বাণী,
কভু হতাশ হয়ো নাকো প্রভু তোমার কাদের গণী।[2]
৬. দায়িত্বভার সমর্পণ : ফিরাউনের দলবলে বসবাসকারী একজন মুমিনের যবানীতে আল্লাহ বলেছেন,
فَسَتَذْكُرُوْنَ مَا أَقُوْلُ لَكُمْ وَأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللهِ
‘আমি যা তোমাদের (ফিরাউন ও তার লোকদের) বলছি অচিরেই তোমরা তা মনে করবে। আমি আমার দায়িত্বভার আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি’ (মুমিন ৪০/৪৪)।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন,
إِنَّ أَكْبَرَ آيَةٍ فِي كِتَابِ اللهِ تَفْوِيْضًا {وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ}
‘কর্মভার আল্লাহর নিকট সমর্পণ সংক্রান্ত আল্লাহর কিতাবে সবচেয়ে বড় আয়াত আল্লাহর বাণী ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য বেরোনোর উপায় করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না’ (তালাক্ব ৬৫/২-৩)।[3]
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম তাঁর শিক্ষক ইবনু তায়মিয়ার বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘ফায়ছালাকৃত বিষয়কে দু’টি জিনিস ঘিরে থাকে। আগে থাকে ভরসা পরে থাকে সন্তুষ্টি। সুতরাং কাজে নামার আগে যে আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং কাজের পরে আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকে সেই উবূদিয়াত বা দাসত্বের দায়িত্ব পালন করে’।[4]
এজন্যই ইস্তিখারার দো‘আয় দেখুন বলা হয়েছে,
وَاقْدُرْ لِىَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِى بِهِ-
‘আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ কর, তা সে যেখানেই হোক ও তাতে আমাকে খুশী রাখ’।[5] সুতরাং সিদ্ধান্তকৃত কাজে নেমে পড়ার আগে আল্লাহর উপর ভরসা করলে তা হবে আল্লাহর নিকট কর্মভার সমর্পণ, আর কাজ শেষে তার উপর ভরসা করলে তা হবে সন্তুষ্টি।
৭. কাজের উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করা, তবে তাকে কার্য সাধনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না ভাবা :
জীবন ধারণে বা কোন কাজ সম্পন্ন করতে যে উপায়-উপকরণ অবলম্বনের কথা অস্বীকার করে এবং নিশ্চেষ্ট বসে থাকে, সে গন্ডমূর্খ ও পাগল। আবার যে আল্লাহর কুদরতের উপর ভরসা না করে শুধুই উপায়-উপকরণ নিয়ে পড়ে থাকে তার আচরণ শিরকী।
আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ أَعْقِلُهَا وَأَتَوَكَّلُ أَوْ أُطْلِقُهَا وَأَتَوَكَّلُ قَالَ : اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ-
‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি কি তাকে (আমার উষ্ট্রীটাকে) বেঁধে রেখে (আল্লাহর উপর) ভরসা করব, না কি তাকে বন্ধনমুক্ত করে দিয়ে ভরসা করব? তিনি বললেন, আগে বেঁধে রাখো, তারপর ভরসা কর’।[6] অনেক সময় বান্দা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করা ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পায় না, অথচ দেখুন এই দো‘আ কতই না উত্তম অবলম্বন।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁর বান্দাদেরকে উপায় অবলম্বন করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُوْلاً فَامْشُوْا فِيْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِزْقِهِ
‘তিনি সেই মহান সত্তা যিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে অনুকূল করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার (ভূমির) বুকে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রূযী খাও’ (মুলক ৬৭/১৫)। তিনি আরও বলেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلاَةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوْا اللهَ كَثِيْرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ-
‘তারপর যখন (জুম‘আর) সালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান করবে, আর আললাহকে বেশী বেশী স্মরণ করবে। সম্ভবতঃ তোমরা সফল হবে’ (জুম‘আ ৬২/১০)।
তিনি আরও বলেন,
وَآخَرُوْنَ يَضْرِبُوْنَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللهِ-
‘আর অন্য কিছু লোক আছে, যারা যমীনে বিচরণ করে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করে’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)।
ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর যুগে কিছু লোক দাবী করত যে তারা ভরসাকারী। তারা বলত, আমরা বসে থাকব, আমাদের খাওয়া-পরা দেওয়ার দায়িত্ব আল্লাহর উপর। তাদের উক্তি সম্পর্কে ইমাম ছাহেবকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘এটা একদম রাবিশ কথা, আল্লাহ কি বলেননি,
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ- فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلاَةُ فَانْتَشِرُوْا فِيْ الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيْرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! যখন জুম‘আর দিনে সালাতের আযান দেওয়া হয় তখন তোমরা বেচাকেনা ছেড়ে আল্লাহর যিকিরে (সালাতে) এগিয়ে এস। যদি তোমাদের বোধ-বুদ্ধি থাকে তবে এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। অতঃপর যখন সালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করবে আর আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করবে, সম্ভবতঃ তোমরা সফল হবে’ (জুম‘আ ৬২/৯-১০)।[7]
তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কার্যাবলী :
১. কুলক্ষণ ও অশুভ : কুলক্ষণ ও অশুভ বলতে বুঝায়- কোন মানুষ একটা কিছু দেখতে কিংবা শুনতে পেয়ে তাকে কুলক্ষণ ও অশুভ গণ্য করে এবং মনে করে যে, এই দেখা বা শোনার ফলে তার মনোবাসনা ও লক্ষ্য মোটেও পূরণ হবে না। আর কাজে নামার আগে এরূপ ঘটলে তার ঐ কাজে নামা উচিত হবে না।
এরূপ অশুভ ভাবনা আল্লাহর উপর ভরসার একেবারেই পরিপন্থী। কেননা আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে থাকা মন এবং আল্লাহর উপর ভরসাকারী কোন অন্তরকে কখনই কোন কানা লোকের দর্শন, বাম দিক দিয়ে পাখি উড়ে যাওয়া, বিমানে তের নম্বর সিট লাভ করা ইত্যাকার কোন অনর্থক ও বাতিল কথা তার গন্তব্য থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে না।
এদিকে নবী করীম (ﷺ)ও কুলক্ষণ ও অশুভ গণ্য করা সম্পর্কে সবাইকে হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, لاَ طِيَرَةَ ‘কুলক্ষণ ও অশুভ বলে কিছু নেই’।[8]
এই কুলক্ষণ ও অশুভর প্রতি বিশ্বাস এবং এগুলো মেনে চলা কেবলই যে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী তা নয়; বরং এগুলো আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসেরও পরিপন্থী।
২. জ্যোতিষী ও গণকের কাছে যাওয়া : তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী যেসব কাজ রয়েছে তন্মধ্যে জ্যোতিষী, গণক ও হারানো বস্ত্তর সন্ধানদাতাদের নিকট ধর্ণা দেওয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব গণক ও জ্যোতিষী অদৃশ্য লোক ও ভবিষ্যৎ জানার দাবী করে। মুমিন বান্দা যদি সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকে তাহ’লে সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দ্বারস্থ হবে না এবং যিনি ছাড়া আর কারো গায়েব বা অদৃশ্য লোকের খবর জানা সম্ভব নয়, সেই মহান আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কাউকে সে খুঁজবে না।
ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আলী (রাঃ) যখন খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করছিলেন তখন এক জ্যোতিষী এসে তাঁকে বলে, হে আমিরুল মুমিনীন, আপনি এই যুদ্ধে যাবেন না। কারণ চাঁদ এখন বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করছে। চাঁদ বৃশ্চিক রাশিতে থাকাকালে আপনি যাত্রা করলে আপনার বাহিনী পরাজিত হবে। তখন আলী (রাঃ) বলেছিলেন, আমি বরং আল্লাহর উপর ভরসা ও ভরসার্থে এবং তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণ করতে অবশ্যই যাত্রা করব। শেষ পর্যন্ত তিনি যাত্রা করেন এবং ঐ সফরে তিনি প্রচুর কল্যাণ লাভ করেন। অধিকাংশ খারেজী এ যুদ্ধে ধরাশায়ী হয়। আর নবী করীম (ﷺ)-এর আদেশ মতো যুদ্ধ করে জয়ী হওয়াতে আলী (রাঃ) অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।[9]
কোন মুমিন যদি এ ধরনের কোন জ্যোতিষী, গণকঠাকুর কিংবা হারানো বস্ত্তর সন্ধানদাতা থেকে কোন খবর শুনতে পায় তাহ’লে তার বিরোধিতা করা এবং তার কোন কথা বিশ্বাস না করাতেই সে সর্বাত্মক মঙ্গল লাভ করবে।
৩. তাবীয ঝুলান : গলা, হাত ইত্যাদি যে কোন অঙ্গে তাবীয ঝুলানো বা বাঁধা ভরসা বিরোধী কাজ। অনেক জাহেল মূর্খ তাদের বুকের উপর নীল সুতা কিংবা কাগজ পাতা ঝুলিয়ে রাখে। ভেল্কিভাজ, যাদুকর, গণকঠাকুর কিসিমের লোকদের থেকে তারা আত্মরক্ষার্থে এগুলো ব্যবহার করে। যার কাজ এ ধরনের তার আল্লাহর উপর ভরসা থাকল কোথায়?
অপরাধ অনুপাতে এসব লোক শাস্তিযোগ্য হবে। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ
‘যে তার দেহে (তাবীয ইত্যাদি) যা কিছু লটকাবে তাকে তার উপরেই সোপর্দ করা হবে’।[10] যখন সে কালি লেখা পাতা বা অনুরূপ কিছু ঝুলাবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করবে না, তখন আল্লাহ তাকে ঐ ঝুলানো বস্ত্তর উপরে অর্পণ করবেন। তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য এটাই হবে যথেষ্ট।
৪. গাছ, পাথর ইত্যাদিকে বরকতময় ভেবে তার থেকে বরকত কামনা করা :
গাছ, পাথর ও অন্য যেসব জিনিস থেকে বরকত লাভের আশা করা অবৈধ সেসব কিছু থেকে বরকত লাভ করা তাওয়াক্কুল বিরোধী কাজ। কখনো কখনো এ ধরনের কাজ শিরকের দিকে ধাবিত করে। নাঊযুবিল্লাহ।
৫. জীবিকার খোঁজ না করে বেকার বসে থাকা : ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, উপায়-অবলম্বন গ্রহণ করা তাওয়াক্কুলের অন্যতম শর্ত। অবলম্বন গ্রহণ না করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী। আমাদের এ কালে যে বালা-মুছীবত ব্যাপকতা লাভ করছে সে সম্পর্কে আমরা এখানে কিছু আলোচনা করছি। এ মুছীবত হ’ল বেকারত্ব। অনেক লোকই তাদের খাওয়া-পরার জন্য কোন কাজকর্ম না করে অন্যের উপর ভরসা করে পড়ে থাকে। ছেলে খাবারের জন্য পিতার উপর এবং ভাই চাকুরিজীবী বোনের উপর ভরসা করে থাকে। যুবশ্রেণী কোন ফলপ্রসূ কাজ তালাশ করে না, বরং তারা যে কাজে কোন শ্রম নেই কিংবা থাকলেও সামান্য তেমন কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে ভালবাসে। জীবিকার জন্য শ্রম ও চেষ্টার উপর বেকার ও অলস সময় কাটানোকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অথচ কুরআন-সুন্নাহতে জীবিকা উপার্জনের অনেক পথের কথা বলা হয়েছে। আমরা তার কিছু এসব অলস বেকারদের জন্য তুলে ধরছি।
(ক) জীবিকার সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন এবং হালালের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হালাল জীবিকা হ’ল যুদ্ধলব্ধ গণীমত।
আল্লাহ বলেন,
فَكُلُوْا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلاَلاً طَيِّبًا
‘সুতরাং যুদ্ধে তোমরা যা কিছু গণীমত রূপে লাভ করেছ, তা হালাল ও পবিত্র হিসাবে ভক্ষণ কর’ (আনফাল ৮/৬৯)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
وَجُعِلَ رِزْقِىْ تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِى
‘আর আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে’।[11]
(খ) নিজ হাতে কামাই : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ-
‘কোন ব্যক্তি নিজ হাতের কামাইয়ের মাধ্যমে যা খায় তার থেকে উত্তম কোন খাদ্য সে কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাঊদ নিজ হাতের কামাই থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন’।[12] তিনি আরো বলেন,
لأَنْ يَحْتَطِبَ أَحَدُكُمْ حُزْمَةً عَلَى ظَهْرِهِ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ أَحَدًا، فَيُعْطِيَهُ أَوْ يَمْنَعَهُ-
‘তোমাদের কারো পিঠে করে কাঠের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া অপরের কাছে ভিক্ষা চাওয়া অপেক্ষা অনেক ভাল, সে লোকটা তাকে দিতেও পারে আবার নাও পারে’।[13]
(গ) ব্যবসা-বাণিজ্য : বহু আনছার ও মুহাজির সাহাবীর পেশা ছিল ব্যবসা। আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ)-কে দেখুন, তার আনছারী ভাই তাকে তার মালের অর্ধেক দিতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে বললেন, دُلُّونِى عَلَى السُّوقِ ‘তোমরা আমাকে বাজারের রাস্তা দেখিয়ে দাও’।[14]
(ঘ) চাষাবাদ ও ফল বাগান তৈরী : এগুলো জীবিকা অন্বেষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এগুলোতে যতটা আল্লাহর উপর ভরসা করতে দেখা যায়, অন্য কোন কাজে তা দেখা যায় না। এতে প্রকৃতই আল্লাহর উপর ভরসা করতে হয়। কেননা চাষী যখন বীজ বপন করে, পানি সেচ দেয় তখন তার খুব ভাল মতো জানা থাকে যে, বীজের অঙ্কুরোদগম হওয়া আল্লাহর মর্যির উপর নির্ভরশীল, আবার প্রাকৃতিক বিপদ-আপদ থেকে ফসলের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই আছে। কত ফসল যে পঙ্গপালের আক্রমণে নিঃশেষ হয়ে গেছে! আর কত ক্ষেত-খামার অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, প্রচন্ড তুষারপাতে ধ্বংস হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা আছে কি?
এজন্যই চাষী কৃষকরা শ্রমজীবী লোকদের মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে অধিক সম্পর্কযুক্ত মানুষ। তাকালেই তা নযরে আসবে।
৬. চিকিৎসার চেষ্টা না করা :
রোগশোক দেখা দিলে চিকিৎসার চেষ্টা না করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কাজ। নবী করীম (ﷺ) তো বলেছেন,
مَا أَنْزَلَ اللهُ دَاءً إِلاَّ أَنْزَلَ لَهُ شِفَاءً
‘আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন রোগ দেননি যার প্রতিষেধক বা চিকিৎসা তিনি দেননি’।[15]
একইভাবে তিনি রোগের চিকিৎসা করতেও আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, يَا عِبَادَ اللهِ تَدَاوَوْا ‘আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা চিকিৎসা করাও’।[16]
আর চিকিৎসাতো আল্লাহ কর্তৃক বিধেয় অবলম্বনের অন্তর্গত।
ভরসাকারীদের কাহিনী :
আল্লাহর উপর ভরসাকারী নেককারদের কাহিনী শুনলে বান্দা আল্লাহর উপর অবশ্যই তাওয়াক্কুলে উদ্বুদ্ধ হবে। আল্লাহর উপর সত্য ভরসা করে তারা কী ফল লাভ করেছে তা জানলে নিশ্চয়ই তার আগ্রহ বাড়বে। আর ভরসাকারীদের শিরোমণি তো আমাদের রাসূল (ﷺ)।
নবী করীম (ﷺ) ও তরবারিওয়ালা :
এক সফরে নবী করীম (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ এক মরু উপত্যকায় বিশ্রামের জন্য ডেরা ফেলেন। নবী করীম (ﷺ) একটা গাছে তাঁর তরবারি ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়েন। সাহাবীরাও যে যার মত ছায়াদার গাছ দেখে বিশ্রামে মশগুল হয়ে পড়েন। হঠাৎ করে নবী করীম (ﷺ)-এর গলার আওয়াযে তারা ঘাবড়িয়ে যান। তারা তাঁর কাছে এসে দেখেন তাঁর পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পাশে একটা তরবারি পড়ে আছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের বললেন,
إِنَّ رَجُلاً أَتَانِى وَأَنَا نَائِمٌ فَأَخَذَ السَّيْفَ فَاسْتَيْقَظْتُ وَهُوَ قَائِمٌ عَلَى رَأْسِى فَلَمْ أَشْعُرْ إِلاَّ وَالسَّيْفُ صَلْتًا فِىْ يَدِهِ فَقَالَ لِىْ مَنْ يَمْنَعُكَ مِنِّى قَالَ قُلْتُ اللهُ. ثُمَّ قَالَ فِى الثَّانِيَةِ مَنْ يَمْنَعُكَ مِنِّى قَالَ قُلْتُ اللهُ. قَالَ فَشَامَ السَّيْفَ فَهَا هُوَ ذَا جَالِسٌ-
‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, এমন সময় এই লোকটা এসে তরবারিটা হাতে করে। আমি জেগে দেখি, সে আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম তার হাতে তরবারির খাপ খোলা। সে আমাকে বলল, আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? আমি বললাম, আল্লাহ। দ্বিতীয়বার সে বলল, আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? আমি বললাম, আল্লাহ। এবার সে তরবারিটা খাপে পুরে ফেলল। এখন তো তাকে দেখছ, সে বসে পড়েছে’।[17] একেই বলে ভরসা, আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা।
নবী করীম (ﷺ) গিরিগুহায় :
আবুবকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
وَأَنَا فِى الْغَارِ لَوْ أَنَّ أَحَدَهُمْ نَظَرَ تَحْتَ قَدَمَيْهِ لأَبْصَرَنَا. فَقَالَ : مَا ظَنُّكَ يَا أَبَا بَكْرٍ بِاثْنَيْنِ اللهُ ثَالِثُهُمَا-
‘(ছাওর) গিরিগুহায় থাকাকালে আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বললাম, (হে আল্লাহর রাসূল!) কেউ যদি তার দু’পায়ের নিচ দিয়ে তাকায় তাহ’লে তো সে অবশ্যই আমাদের দেখে ফেলবে। তিনি বললেন, হে আবুবকর! দু’জন ভাবছ কি? আল্লাহ তো তাদের (আমাদের) তৃতীয়জন’।[18]
এই হ’ল ভরসা ও আল্লাহতে সমর্পণ, যা ভীষণ সঙ্কট কালে বান্দার থেকে খোলাখুলি ফুটে উঠেছে। বান্দা অন্তর থেকে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার উপর ভরসা করেছে এবং তার নিকটেই নিজের যাবতীয় কাজ অর্পণ করেছে, বিশেষ করে যখন আল্লাহর নিকট সমর্পণ ব্যতীত তার আর কোন অবলম্বন অবশিষ্ট নেই।
জনৈকা মহিলা ও তার ছাগপাল :
মহিলা ও তার ছাগল পালের ঘটনায় তাওয়াক্কুলের গুরুত্বের চূড়ান্ত রূপ ধরা পড়েছে। ভরসা করলে একজন মানুষ কী ফল লাভ করতে পারে সে কথাও এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) তাঁর গ্রন্থে নবী করীম (ﷺ)-এর যুগের এ ঘটনাটি সংকলন করেছেন।
إِنَّ امْرَأَةً كَانَتْ فِيْهِ فَخَرَجَتْ فِىْ سَرِيَّةٍ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَتَرَكَتْ ثِنْتَىْ عَشْرَةَ عَنْزاً لَهَا وَصِيْصِيَتَهَا كَانَتْ تَنْسِجُ بِهَا- قَالَ : فَفَقَدَتْ عَنْزاً مِنْ غَنَمِهَا وَصِيْصِيَتَهَا فَقَالَتْ يَا رَبِّ إِنَّكَ قَدْ ضَمِنْتَ لِمَنْ خَرَجَ فِى سَبِيلِكَ أَنْ تَحْفَظَ عَلَيْهِ وَإِنِّى قَدْ فَقَدْتُ عَنْزاً مِنْ غَنَمِى وَصِيصِيَتِى وَإِنِّى أَنْشُدُكَ عَنْزِى وَصِيصِيَتِى. قَالَ فَجَعَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَذْكُرُ شِدَّةَ مُنْاشَدَتِهَا لِرَبِّهَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَأَصْبَحَتْ عَنْزُهَا وَمِثْلُهَا وَصِيصِيَتُهَا وَمِثْلُهَا-
‘জনৈকা মহিলা মদীনায় বাড়ীতে ছিল। অতঃপর সে মুসলিম সেনাদলের সাথে যুদ্ধে যাত্রা করেছিল। বাড়ীতে সে ১২টা ছাগল এবং তার কাপড় বুননের একটা তাঁত/কাঁটা/মাকু রেখে গিয়েছিল। বাড়ী ফিরে এসে সে দেখে, তার ছাগপাল থেকে একটা ছাগল আর তার সেই তাঁত/কাঁটা/মাকু নেই। সে তখন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলল, হে আমার মালিক! তুমি তো তোমার রাস্তায় যে বের হবে তার হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছ। এদিকে আমি তোমার রাস্তায় বের হয়ে ফিরে এসে দেখছি আমার ছাগপাল থেকে একটা ছাগল আর আমার কাপড় বুননের তাঁত/কাঁটা/মাকু নেই। আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি, আমার ছাগল ও তাঁত/কাঁটা/মাকু ফিরিয়ে দাও। উক্ত মহিলা তার মালিকের নিকট কঠিনভাবে যে শপথ করেছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বার বার তার উল্লেখ করলেন। অবশেষে মহিলাটি সকাল বেলা তার ছাগল ও অনুরূপ একটা ছাগল আর তাঁত/কাঁটা/মাকু এবং অনুরূপ একটা তাঁত/ কাঁটা/মাকু ফিরে পেল’।[19] সুবহানাল্লাহ! কী ভীষণ ব্যাপার!!
এই মহিলা আল্লাহর উপর প্রকৃত অর্থে ভরসা করেছিল। ফলে আল্লাহ কেবল তার ছাগলই হেফাযত করেননি; বরং তাওয়াক্কুলের বরকতে তাকে দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।
জনৈকা মহিলা ও তার চুলা :
ইমাম আহমাদ (রহঃ) আরেকটি ঘটনা তাঁর সনদে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘অতীতকালে দু’জন স্বামী-স্ত্রী ছিল। ধন-সম্পদ বলতে তাদের কিছুই ছিল না। স্বামী বেচারা একদিন সফর করে বাড়ী ফিরে এল। সে ছিল প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে সে তার স্ত্রীর নিকটে বলল, তোমার কাছে খাবার মত কিছু আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ, সুসংবাদ শোন তোমার নিকট আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক এসেছে। [তার কাছে আসলে কিছুই ছিল না, কেবলই আল্লাহর উপর আশা-ভরসা ও নির্ভর করে সে একথা বলেছিল]। পুরুষ লোকটা বলল, তোমার ভাল হোক, তোমার কাছে কিছু থাকলে একটু জলদি কর। সে বলল, হ্যাঁ আছে বৈকি। একটু ছবর কর, আমরা আল্লাহর রহমতের আশা করছি। এভাবে যখন তার ক্ষুধা দীর্ঘায়িত হয়ে চলল তখন সে তার স্ত্রীকে বলল, তোমার উপর রহম হোক, ওঠো, দেখ, তোমার কাছে রুটি-টুটি থাকলে তা নিয়ে এস। আমি তো ক্ষুধায় একবারে শেষ হয়ে গেলাম। স্ত্রী বলল, এই তো চুলা পেকে এল বলে, তাড়াহুড়ো কর না। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলে যখন স্বামীটা আবার কথা বলবে বলবে এমন সময় স্ত্রী মনে মনে বলল, আমি উঠে গিয়ে আমার চুলাটা দেখি না। সে গিয়ে দেখল, চুলা ছাগলের সিনার/রানের গোশতে ভরপুর হয়ে আছে, আর তার যাঁতা দু’টো থেকে আটা বের হয়ে চলেছে। সে যাঁতার নিকট গিয়ে তা ঝেড়ে মুছে আটা বের করে নিল এবং চুলা থেকে ছাগলের সিনার/রানের গোশত বের করে আনল। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, যাঁর হাতে আবুল কাসেম মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জীবন তাঁর শপথ! মহিলাটি যদি তার দু’যাঁতায় যা আটা ছিল এবং ঝাড়ামুছা না করত তাহ’লে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত যাঁতাটি তাকে আটা দিয়ে যেত’।[20]
ওমর (রাঃ) ও কুষ্ঠরোগী এবং খালিদ (রাঃ) ও বিষ :
হাদীসের গ্রন্থগুলোতে দু’টি ঘটনার উল্লেখ আছে কিছু লোক যা দুষ্কর মনে করে।
একটি ঘটনা ইবনু ওমর (রাঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। তিনি একজন কুষ্ঠরোগীর সাথে বসে খেয়েছিলেন।[21]
দ্বিতীয় ঘটনা হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর বিষ পানের সাথে জড়িত। আবুস সাফার থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার খালিদ বিন ওয়ালীদ হিরা নগরে অবস্থান করছিলেন। তখন লোকেরা তাকে বলল,
احْذَرِ السُّمَّ لاَ يَسْقِيَكَهُ الْأَعَاجِمُ، فَقَالَ: إِيتُوْنِيْ بِهِ فَأُتِيَ بِهِ، فَأَخَذَهُ بِيَدِهِ ثُمَّ اقْتَحَمَهُ وَقَالَ: بِسْمِ اللهِ فَلَمْ يَضُرَّهُ شَيْئًا-
‘আপনি কিন্তু সাবধানে থাকবেন, অনারবরা যেন আপনাকে বিষ পান না করিয়ে দেয়। তিনি তখন বললেন, তোমরা আমার নিকট বিষ নিয়ে এস। তাঁর নিকট বিষ নিয়ে আসা হ’ল। তিনি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তা পান করে নিলেন। বিষে তার মোটেও কোন ক্ষতি হ’ল না’।[22]
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ঘটনায় আল্লাহ তা‘আলার উপর তাঁর কঠিন তাওয়াক্কুলের নিদর্শন মেলে।
আলেমগণ এ ঘটনার বেশ কিছু দিক উল্লেখ করেছেন। যেমন-
(১) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) রোগ সংক্রমণের বিষয়কে দৃঢ়ভাবে নাকচ করতে চেয়েছেন এবং কুষ্ঠরোগী থেকে নবী করীম (ﷺ)-এর দূরে থাকার আদেশ লঙ্ঘন করতে চাননি।
(২) ওমর (রাঃ) কুষ্ঠ রোগীকে সমবেদনা জানাতে এরূপ করেছিলেন।
(৩) যে আল্লাহর উপর শক্তিশালী ভরসা রাখে সে হাদীসلاَ عَدْوَى ‘রোগ সংক্রমণ বলে কিছু নেই’-এর উপর আমল করবে; আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলে দুর্বল সে ‘কুষ্ঠরোগী থেকে পালিয়ে যাও’ (فِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ) হাদীসেরউপর আমল করবে।[23]
আর খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর ঘটনা থেকে বুঝা যায় তিনি আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থ ভরসা করেছিলেন বলেই বিষ তাঁর উপর কোনই ক্রিয়া করতে পারেনি। তাই বলে অন্য কারো জন্য বিষ পানে খালিদ (রাঃ)-এর অনুকরণ আদেŠ সিদ্ধ হবে না। বিদ্বানগণ তাঁর ঘটনারও বেশ কিছু দিক তুলে ধরেছেন। যেমন-
(১) এটি ছিল খালিদ (রাঃ)-এর কারামত। তাই অন্য কারো পক্ষে তার অনুসরণ বৈধ হবে না। নচেৎ বিষের প্রভাবে সে নিহত হ’তে পারে।
(২) হ’তে পারে যে, নবী করীম (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে খালিদের জন্য এমন কোন অঙ্গীকার ছিল যে, বিষ তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই খালিদ (রাঃ) আল্লাহর উপর ভরসা করে তা পান করে নিয়েছিলেন।[24]
(৩) কিছু বর্ণনায় এসেছে, শত্রুপক্ষ যাতে এ দৃশ্য দেখে তার অনুগত হয় এবং মুসলমানদের জান-মালের কোন ক্ষতি না করে সেজন্য তিনি বিষ পান করেছিলেন।
শেষ কথা :
প্রিয় ভাই আমার! উপরের আলোচনা থেকে আপনার কাছে আল্লাহর উপর ভরসা করার শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমরা আপনাকে ব্যাখ্যা করেছি যে, ভরসা উপায়-উপকরণ অবলম্বনে বাধা দেয় না এবং উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করাকে ভরসা (توكل) বলে না; বরং তাওয়াকুল (التواكل) বা তাওয়াক্কুলের ভান বলে। তাওয়াকুল বাতিলের পূজারী ও কুঁড়েদের দর্শন।
আমরা আপনার সামনে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের হুকুম বা বিধান এবং যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ তাওয়াক্কুলের আদেশ দিয়েছেন তেমন কিছু ক্ষেত্রও আলোচনা করেছি।
আমরা আল্লাহর উপর যথার্থ ভরসাকারী কিছু লোকের ঘটনা এবং তাদের অর্জিত ফলাফলের কথাও আপনার সামনে তুলে ধরেছি। ভরসা বিষয়ে আল্লাহর সহযোগিতায় আমাদের সামান্য কিছু আলোচনা এখানেই শেষ করছি।
আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমাদের একান্ত প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে এবং আপনাদেরকে তাঁর উপর ভরসাকারীদের শ্রেণীভুক্ত করেন, আমাদেরকে একত্ববাদীদের দলভুক্ত করেন এবং আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা হক কথা বলে এবং হক মত বিচার করে। আর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হৌক আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর।
[1]. বুখারী হা/৭৪০৫; মুসলিম হা/২৬৭৫।
[2]. শিহাবুদ্দীন আল-আবশীহী, আল-মুস্তাতরাফ ২/১৫১।
[3]. আল-মু‘জামুল কাবীর, ৯/১৩৩, হা/৮৬৫৯।
[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ২/১২২।
[5]. বুখারী হা/১১৬২; তিরমিযী হা/৪৮০; নাসাঈ হা/৩২৫৩।
[6]. তিরমিযী হা/২৫১৭, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
[7]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস, পৃঃ ৩৪৮।
[8]. বুখারী হা/৫৭৫৪; মুসলিম হা/২২২৩; মিশকাত হা/৪৫৭৬।
[9]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা ১/৫৭।
[10]. তিরমিযী হা/২০৭২; নাসাঈ হা/৪০৭৯, শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী। মিশকাত হা/৪৫৫৬।
[11]. আহমাদ হা/৫১১৪; ইরওয়া হা/২৬৯১, আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন।
[12]. বুখারী হা/২০৭২; মিশকাত হা/২৭৫৯।
[13]. বুখারী হা/২০৭৪।
[14]. বুখারী হা/৫০৭২।
[15]. বুখারী হা/৫৬৭৮।
[16]. তিরমিযী হা/২০৩৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৪৩৬; হাদীস সহীহ।
[17]. মুসলিম হা/৮৪৩।
[18]. বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৭১।
[19]. আহমাদ হা/২০৬৮৩; সহীহাহ হা/২৯৩৫, হাদীস সহীহ।
[20]. আহমাদ হা/৯৪৪৫, হায়ছামী মাজমাউয যাওয়ায়েদ গ্রন্থে (হা/১৭৮৭৪)এর বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্য আখ্যা দিয়েছেন। তবে শায়খ আলবানী ও শু‘আয়েব আরনাউত যঈফ বলেছেন। সহীহাহ হা/২৯৩৭-এর আলোচনা দ্রঃ।
[21]. তিরমিযী হা/১৮১৭, সনদ যঈফ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হা/২৫০২২; মূল বইয়ে ভুলবশতঃ ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ছাপা হয়েছে।
[22]. মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৭১৮৬।
[23]. বুখারী হা/৫৭০৭; মিশকাত হা/৪৫৭৭।
[24]. ঐ, ১০/২৪৮।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: