“প্রত্যেক উম্মতের একজন 'আমীন' থাকে। আর আমার উম্মাতের আমীন হচ্ছে, আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ্।”
– রাসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উক্তি
হালকা পাতলা গড়ন, লম্বাকৃতি দেহ, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, ধীর-স্থির শান্ত-শিষ্ট মেজাজ, লাজ-নম্র, অমায়িক ব্যবহার, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, সদালাপী ও মিষ্টভাষী, দ্রুতগামী এবং কর্মতৎপর হিসেবে খ্যাত এমন এক ব্যক্তি, যার মনে গর্ব ও অহঙ্কারের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু রণক্ষেত্রে তিনিই যেন ঝলসে ওঠা তীক্ষ্ণধার তরবারি ও গর্জে ওঠা এক সিংহ শার্দুল এবং প্রতিকূল পরিবেশে দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস খ্যাত এ ব্যক্তিই মুসলিম উম্মাহর 'আমীন' আমর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ আল ফেহরী আল কুরাইশী। যিনি ছোট-বড় সবার নিকট আবূ উবায়দা আল জাররাহ নামে পরিচিত।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর প্রশংসায় বলেছেন :
গভীর পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক মাধুর্য এবং শালীনতায় কুরাইশ বংশে তিন ব্যক্তি বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেন। তারা যদি আপনার প্রশংসা করেন, তাতে মিথ্যা অতিরঞ্জন থাকবে না এবং আপনিও যদি তাদের প্রশংসা করতে চান, তাতেও কোনো অসত্যের আশ্রয় নিতে হবে না। তাঁরা হলেন :
আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এবং আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু।
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহ সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ইসলাম গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে তারই প্রচেষ্টায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, ওসমান ইবনে মাযউন রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, আরকাম ইবনে আবিল আরকাম রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হন। তাঁরা কালেমা তাওহীদের ঘোষণার মাধ্যমে একই সাথে তাঁর হাতে বাই'আত গ্রহণ করেন। এ পাঁচ ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সাংগঠনিক কাঠামোই হলো পরবর্তী সময়ে ইসলামের সুমহান প্রাসাদের ভিত্তি।
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মাক্কী জীবন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই অগ্নিপরীক্ষার এক দুর্বিষহ জীবন। প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী অন্যসব সাহাবীদের মতো তিনিও আর্থিক সংকট, দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন; কিন্তু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ঈমানী পরীক্ষা ইতিহাসে আদর্শের যে কোনো অনুসারীর বিচারে এক বিরল ঘটনা।
প্রতিটি ঈমানী পরীক্ষাতেই তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে সমুন্নত করেছেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধে তাঁর অকল্পনীয় ঈমানী পরীক্ষা অতীতের সব পরীক্ষাকে ম্লান করে দিয়েছে।
বদর প্রান্তরে তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মৃত্যুর পরওয়া না করে প্রচণ্ড আক্রমণে শত্রুবাহিনীর দুর্ভেদ্য ব্যূহকে ছত্রভঙ্গ করতে সমর্থ হন, এতে মুশরিকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়। এ সুযোগে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে শত্রুবাহিনীকে ধরাশায়ী করতে করতে সম্মুখপানে অগ্রসর হচ্ছিলেন ও তাঁর চতুর্দিকে ঘুরেফিরে আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীও বার বার তাঁকে প্রতিরোধ করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এরই ফাঁকে শত্রুবাহিনীর ব্যূহ থেকে এক ব্যক্তি আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে বার বার চ্যালেঞ্জ করছিল। তিনিও আক্রমণের গতি পরিবর্তন করে প্রতিবারই তার সে চ্যালেঞ্জ যাচ্ছিলেন। আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহুর এ দুর্বলতার এক সুযোগে হঠাৎ সে তার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে বসল। তিনি তড়িৎ গতিতে পাশ কাটিয়ে গেলে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন। সে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে শত্রু নিধনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ধৈর্যহীনতার চরম পর্যায়ে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর তরবারির প্রচণ্ড এক আঘাতে তার শির দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল।
প্রিয় পাঠক। ভূলুষ্ঠিত এ ব্যক্তি কে? পূর্বেই আলোচনা করেছি, আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ঈমান সর্বকালের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় এমনভাবে উত্তীর্ণ যে, তা কোনো কল্পনাকারীর কল্পনারও উর্ধ্বে। স্তম্ভিত হবেন, ভূলুষ্ঠিত ব্যক্তির পরিচয়ে। সে আর কেউ নয়, সে হলো আবূ উবায়দার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহ।
এ ক্ষেত্রে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর পিতাকে হত্যা করেননি। তিনি হত্যা করেছেন, পিতার অবয়বে শিরকের প্রতিমূর্তিকে। মহান আল্লাহ তাঁর ও পিতার মাঝে সংঘটিত এ ঘটনা সম্পর্কে আল কুরআনের আয়াত নাযিল করলেন :
তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীদেরকে হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র ভ্রাতা অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তার পক্ষ হতে রূহ দ্বারা। এদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন, এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।
আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পক্ষ থেকে এমনটি ঘটা আশ্চর্যের কিছুই ছিল না। আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান, ইসলামী আদর্শের কল্যাণকামিতায় এবং উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য আমানতদার ও বিশ্বাসভাজন হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর স্থান ছিল শীর্ষে। যে কারণে অনেক মহান ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে তাঁর সমকক্ষ মর্যাদা পেতে আগ্রহী ছিলেন।
মুহাম্মদ ইবনে জাফর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এক সময় খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল :
হে আবুল কাশেম। আপনার সাহাবীদের মধ্য থেকে আমাদের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে মনোনীত করে দিন, যিনি আমাদের অর্থ-সম্পত্তির কিছু বিষয়ে সৃষ্ট বিবাদের সুষ্ঠু ফায়সালা করে দিতে পারবেন। আপনারা আমাদের কাছে খুবই আস্থাভাজন সম্প্রদায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন :
তোমরা বিকেলে এখানে এসো, আমি তোমাদের সাথে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ এক ব্যক্তিকে পাঠাব।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন :
সারা জীবনে শুধু এবারই ঐ গুণের অধিকারী হওয়ার জন্য আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। যদিও নেতৃত্ব লাভ কখনো আমি পছন্দ করিনি। তাই সে উদ্দেশ্যে একটু আগেভাগেই আমি যোহরের নামাযের জন্য মসজিদে গিয়ে হাজির হই। নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডানে ও বাঁয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। আমি সে মুহূর্তে একটু উঁচু হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নজরে পড়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। তিনি এদিক-সেদিক দেখতে লাগলেন। অবশেষে তিনি আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে দেখতে পেলেন এবং তাকে ডেকে বললেন :
”তুমি তাদের সাথে যাও এবং বিবাদটির সুষ্ঠু নিষ্পত্তি করে দাও।”
আমি মনে মনে বললাম, আবু উবায়দা এ গুণটির অধিকারী হয়ে গেল।
আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিই শুধু ছিলেন না; বিশ্বস্ততার সাথে ছিল শক্তি এবং একাধিক ক্ষেত্রে তিনি সেই শক্তির প্রমাণও দিয়েছেন। কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ আরম্ভের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে ধাওয়া করার উদ্দেশ্যে মুহাজির সাহাবীদের সমন্বয়ে সুসজ্জিত যোদ্ধাদের একটি বাহিনীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে, তাদের সিপাহসালার হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকেই মনোনীত করেন। ঐ অভিযানে তিনি ত্যাগ ও কষ্টসহিষ্ণুতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়কালে তাদের রসদবাবদ মাত্র এক ঝুড়ি খেজুর ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি। আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যেককে প্রতিদিন মাত্র একটি করে খেজুর রেশন হিসেবে বরাদ্দ করতেন। স্তন্য পানকারী শিশুদের মতো সারাদিনে তারা একটিমাত্র খেজুর চুষে খেতেন এবং তারপর পানি পান করতেন, এভাবে সবাই গোটা একটা দিন অতিবাহিত করতেন।
ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানগণ এক পর্যায়ে পরাজয়ের সম্মুখীন হলেও মুশরিক বাহিনীর একজন চিৎকার করে বলছিল :
“আমাকে দেখিয়ে দাও মুহাম্মদকে।”
সেই চরম মুহূর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে দশজন সাহাবী তাঁকে রক্ষা করার জন্য ঘিরে রেখেছিলেন, আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ছিলেন তাদের অন্যতম।
এ যুদ্ধে শত্রুদের আঘাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি দন্ত মোবারক শহীদ হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিরস্ত্রাণ ভেঙে এর দুটি পেরেক তাঁর মাথায় ঢুকে পড়ে। আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারক থেকে তা বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন; কিন্তু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন :
“আল্লাহর শপথ করে বলছি, আপনি কাজটি আমাকে করতে দিন।”
আবূ বকর ছিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাঁকেই কাজটি করার সুযোগ দিলেন। আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আশঙ্কাবোধ করছিলেন যে, যদি হাতের সাহায্যে পেরেক দু'টি টেনে বের করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীষণ কষ্ট পাবেন। তাই তিনি দাঁত দিয়ে তা টেনে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমবারে একটি বের হয়ে এলেও আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সামনের একটি দাঁত ভেঙে যায়, দ্বিতীয় বারে অপরটিও বেরিয়ে আসে; কিন্তু এবারও তাঁর সামনের অপর একটি দাঁত ভেঙে যায়। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন :
“আবূ উবায়দা ছিলেন সামনের দুটি দাঁত ভাঙা সর্বাপেক্ষা সুদর্শন ব্যক্তি।”
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পর্যন্ত তাঁর সাথে সমস্ত যুদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতী ও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের পর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতে খিলফাতের বাইআতের দিন উমর ফারূক রানিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে সম্বোধন করে বললেন :
আপনার হাতটা বাড়িয়ে দিন, যাতে আমি বাইআত করতে পারি। কারণ, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই একজন আমীন বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি থাকেন, এ উম্মতের মধ্যে আপনিই 'আমীন'। অতএব আপনিই এর একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। এ কথা শুনে আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন:
“এমন এক ব্যক্তিকে রেখে কখনোই নিজে খিলাফতের বাইআত নিতে পারি না, যাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশাতেই আমাদের জন্য নামাযের ইমাম নিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনিই আমাদের ইমামতি করেন।”
অতঃপর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতেই খিলাফতের বাইআত করা হয়। তাই হকের ব্যাপারে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহ আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর জন্য উত্তম উপদেশদাতা ও সর্বাপেক্ষা অধিক সহযোগিতা দানকারী ছিলেন।
আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ইনতিকালের পর আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতে খিলাফতের বাইআত গ্রহণ করেন। আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর একান্ত অনুগত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সারা জীবনে মাত্র একবার ছাড়া আর কখনো তিনি খালীফাতুল মুসলিমীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নির্দেশ পালনে অনীহা দেখাননি।
প্রিয় পাঠক! কী সেই নির্দেশ, যেটি পলন করতে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন?
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সিরিয়া বিজয়ের প্রাক্কালে যখন মুসলিম বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনছিলেন, তখন তিনি পূর্বে ফোরাত নদী এবং উত্তরে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত তাঁর বিজয়ের সীমানা বিস্তৃত করেন। অব্যাহত গতিতে এ বিজয় চলাকালে সিরিয়ায় হঠাৎ নজীরবিহীন মহামারি দেখা দেয় এবং তাতে ব্যাপকভাবে মানুষ মারা যেতে থাকে। এ সময় আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে একখানা পত্র দিয়ে একজন দূত প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি লিখেন :
“অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে আমি বিশেষভাবে মদীনায় আপনার উপস্থিতি কামনা করছি। আপনার নিকট এ নির্দেশনামা রাতে পৌঁছলে ভোর হওয়ার পূর্বে এবং দিনে পৌঁছলে সূর্যাস্তের পূর্বে অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে আমার কাছে চলে আসবেন বলে আশা করছি।”
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু খালীফাতুল মুসলিমীনের এ নির্দেশনামা পাঠ করে বললেন :
“আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের কী প্রয়োজন, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি এমন এক ব্যক্তিকে জীবিত রাখতে চাচ্ছেন, যার বেঁচে থাকার কথা নয়।”
অতঃপর তিনি আমীরুল মুমিনীনকে লিখলেন :
“আমীরুল মুমিনীন, আপনার সমীপে আমার প্রয়োজনীয় বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। আমি মুসলিম সৈন্যবাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা মহামারীতে আক্রান্ত। তাদেরকে বিপদে রেখে আমি নিজে নিরাপদ স্থানে যাওয়া মোটেই পছন্দ করছি না। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে মৃত্যু আমাকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন না করেছে; ততক্ষণ আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছি না। আমার এ পত্র আপনার কাছে পৌছার পর আমাকে ঐ নির্দেশ থেকে অব্যাহতি দান করবেন এবং আমাকে এখানে অবস্থান করার অনুমতি দান করবেন।”
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পত্র পাঠের পর উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকল, তাঁর এ অস্বাভাবিক কান্না দেখে তাঁর পাশে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা বললেন :
“হে আমীরুল মুমিনীন! আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কি মৃত্যুবরণ করেছেন?"
উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন :
“না, বরং মৃত্যু তাঁর অতি নিকটে এসে পৌঁছেছে।”
উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ধারণা মিথ্যা ছিল না, অল্পদিনের মধ্যে আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মহামারীতে আক্রান্ত হলেন! মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাঁর বাহিনীকে অন্তিম উপদেশ দিয়ে বললেন :
“আমি তোমাদেরকে অন্তিম কিছু উপদেশ দিতে চাই। যদি তা গ্রহণ কর তাহলে সর্বদা তোমাদের কল্যাণ হতে থাকবে। নামায কায়েম করবে, রমযান মাসে রোযা রাখবে, যাকাত দিবে, হজ্জ ও উমরাহ পালন করবে, পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে অসিয়ত করবে। আমীরদের পরামর্শ দান করবে, তাদেরকে ধোঁকা দেবে না এবং দুনিয়াদারী যেন তোমাদেরকে অন্য সবকিছু থেকে গাফেল করে না দেয়। কেননা, যদি কাউকে হাজার বছরও আয়ুষ্কাল দান করা হয় তবুও একথা নিশ্চিত যে, তাকেও একদিন এমনিভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে। যেভাবে এ মুহূর্তে তোমরা আমাকে হতে দেখছ।”
এরপর তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন :
'আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ'
অতঃপর তিনি মু'আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দিকে ফিরে বললেন :
“হে মুয়ায, মুসলিম বাহিনীর নামাযের ইমামতি করাও।”
এর অল্পক্ষণ পরেই তাঁর পবিত্র রূহ ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। তখন মুয়ায রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন :
“প্রিয় ভাইয়েরা! আপনারা এমন এক ব্যক্তিকে হারিয়েছেন, খোদার শপথ! যাঁর মতো প্রশস্ত অন্তরের মানুষ আমার জানা মতে আর নেই, তাঁর মন সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ থেকে ছিল পবিত্র। সঙ্গী-সাথীদের ভুল-ত্রুটিতে দয়াশীল ও ক্ষমাসুলভ আচরণে তাঁর কোনো জুড়ি ছিল না। তাঁর মতো জনগণের এতো বড় কল্যাণকামীও আর কেউ ছিল না, তাঁর প্রতি সদয় হোন। আল্লাহ আপনাদের প্রতি সদয় হবেন।”
– সাহাবীদের আলোকিত জীবন (১ম খন্ড), ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, সবুজপত্র পাবলিকেশন্স
– রাসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উক্তি
হালকা পাতলা গড়ন, লম্বাকৃতি দেহ, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, ধীর-স্থির শান্ত-শিষ্ট মেজাজ, লাজ-নম্র, অমায়িক ব্যবহার, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, সদালাপী ও মিষ্টভাষী, দ্রুতগামী এবং কর্মতৎপর হিসেবে খ্যাত এমন এক ব্যক্তি, যার মনে গর্ব ও অহঙ্কারের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু রণক্ষেত্রে তিনিই যেন ঝলসে ওঠা তীক্ষ্ণধার তরবারি ও গর্জে ওঠা এক সিংহ শার্দুল এবং প্রতিকূল পরিবেশে দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস খ্যাত এ ব্যক্তিই মুসলিম উম্মাহর 'আমীন' আমর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ আল ফেহরী আল কুরাইশী। যিনি ছোট-বড় সবার নিকট আবূ উবায়দা আল জাররাহ নামে পরিচিত।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর প্রশংসায় বলেছেন :
গভীর পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক মাধুর্য এবং শালীনতায় কুরাইশ বংশে তিন ব্যক্তি বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেন। তারা যদি আপনার প্রশংসা করেন, তাতে মিথ্যা অতিরঞ্জন থাকবে না এবং আপনিও যদি তাদের প্রশংসা করতে চান, তাতেও কোনো অসত্যের আশ্রয় নিতে হবে না। তাঁরা হলেন :
আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এবং আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু।
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহ সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ইসলাম গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে তারই প্রচেষ্টায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, ওসমান ইবনে মাযউন রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, আরকাম ইবনে আবিল আরকাম রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হন। তাঁরা কালেমা তাওহীদের ঘোষণার মাধ্যমে একই সাথে তাঁর হাতে বাই'আত গ্রহণ করেন। এ পাঁচ ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সাংগঠনিক কাঠামোই হলো পরবর্তী সময়ে ইসলামের সুমহান প্রাসাদের ভিত্তি।
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মাক্কী জীবন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই অগ্নিপরীক্ষার এক দুর্বিষহ জীবন। প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী অন্যসব সাহাবীদের মতো তিনিও আর্থিক সংকট, দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন; কিন্তু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ঈমানী পরীক্ষা ইতিহাসে আদর্শের যে কোনো অনুসারীর বিচারে এক বিরল ঘটনা।
প্রতিটি ঈমানী পরীক্ষাতেই তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে সমুন্নত করেছেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধে তাঁর অকল্পনীয় ঈমানী পরীক্ষা অতীতের সব পরীক্ষাকে ম্লান করে দিয়েছে।
বদর প্রান্তরে তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মৃত্যুর পরওয়া না করে প্রচণ্ড আক্রমণে শত্রুবাহিনীর দুর্ভেদ্য ব্যূহকে ছত্রভঙ্গ করতে সমর্থ হন, এতে মুশরিকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়। এ সুযোগে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে শত্রুবাহিনীকে ধরাশায়ী করতে করতে সম্মুখপানে অগ্রসর হচ্ছিলেন ও তাঁর চতুর্দিকে ঘুরেফিরে আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীও বার বার তাঁকে প্রতিরোধ করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এরই ফাঁকে শত্রুবাহিনীর ব্যূহ থেকে এক ব্যক্তি আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে বার বার চ্যালেঞ্জ করছিল। তিনিও আক্রমণের গতি পরিবর্তন করে প্রতিবারই তার সে চ্যালেঞ্জ যাচ্ছিলেন। আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহুর এ দুর্বলতার এক সুযোগে হঠাৎ সে তার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে বসল। তিনি তড়িৎ গতিতে পাশ কাটিয়ে গেলে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন। সে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে শত্রু নিধনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ধৈর্যহীনতার চরম পর্যায়ে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর তরবারির প্রচণ্ড এক আঘাতে তার শির দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল।
প্রিয় পাঠক। ভূলুষ্ঠিত এ ব্যক্তি কে? পূর্বেই আলোচনা করেছি, আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ঈমান সর্বকালের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় এমনভাবে উত্তীর্ণ যে, তা কোনো কল্পনাকারীর কল্পনারও উর্ধ্বে। স্তম্ভিত হবেন, ভূলুষ্ঠিত ব্যক্তির পরিচয়ে। সে আর কেউ নয়, সে হলো আবূ উবায়দার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহ।
এ ক্ষেত্রে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর পিতাকে হত্যা করেননি। তিনি হত্যা করেছেন, পিতার অবয়বে শিরকের প্রতিমূর্তিকে। মহান আল্লাহ তাঁর ও পিতার মাঝে সংঘটিত এ ঘটনা সম্পর্কে আল কুরআনের আয়াত নাযিল করলেন :
তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীদেরকে হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র ভ্রাতা অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তার পক্ষ হতে রূহ দ্বারা। এদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন, এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।
আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পক্ষ থেকে এমনটি ঘটা আশ্চর্যের কিছুই ছিল না। আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান, ইসলামী আদর্শের কল্যাণকামিতায় এবং উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য আমানতদার ও বিশ্বাসভাজন হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর স্থান ছিল শীর্ষে। যে কারণে অনেক মহান ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে তাঁর সমকক্ষ মর্যাদা পেতে আগ্রহী ছিলেন।
মুহাম্মদ ইবনে জাফর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এক সময় খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল :
হে আবুল কাশেম। আপনার সাহাবীদের মধ্য থেকে আমাদের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে মনোনীত করে দিন, যিনি আমাদের অর্থ-সম্পত্তির কিছু বিষয়ে সৃষ্ট বিবাদের সুষ্ঠু ফায়সালা করে দিতে পারবেন। আপনারা আমাদের কাছে খুবই আস্থাভাজন সম্প্রদায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন :
তোমরা বিকেলে এখানে এসো, আমি তোমাদের সাথে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ এক ব্যক্তিকে পাঠাব।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন :
সারা জীবনে শুধু এবারই ঐ গুণের অধিকারী হওয়ার জন্য আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। যদিও নেতৃত্ব লাভ কখনো আমি পছন্দ করিনি। তাই সে উদ্দেশ্যে একটু আগেভাগেই আমি যোহরের নামাযের জন্য মসজিদে গিয়ে হাজির হই। নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডানে ও বাঁয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। আমি সে মুহূর্তে একটু উঁচু হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নজরে পড়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। তিনি এদিক-সেদিক দেখতে লাগলেন। অবশেষে তিনি আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে দেখতে পেলেন এবং তাকে ডেকে বললেন :
”তুমি তাদের সাথে যাও এবং বিবাদটির সুষ্ঠু নিষ্পত্তি করে দাও।”
আমি মনে মনে বললাম, আবু উবায়দা এ গুণটির অধিকারী হয়ে গেল।
আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিই শুধু ছিলেন না; বিশ্বস্ততার সাথে ছিল শক্তি এবং একাধিক ক্ষেত্রে তিনি সেই শক্তির প্রমাণও দিয়েছেন। কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ আরম্ভের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে ধাওয়া করার উদ্দেশ্যে মুহাজির সাহাবীদের সমন্বয়ে সুসজ্জিত যোদ্ধাদের একটি বাহিনীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে, তাদের সিপাহসালার হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকেই মনোনীত করেন। ঐ অভিযানে তিনি ত্যাগ ও কষ্টসহিষ্ণুতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়কালে তাদের রসদবাবদ মাত্র এক ঝুড়ি খেজুর ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি। আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যেককে প্রতিদিন মাত্র একটি করে খেজুর রেশন হিসেবে বরাদ্দ করতেন। স্তন্য পানকারী শিশুদের মতো সারাদিনে তারা একটিমাত্র খেজুর চুষে খেতেন এবং তারপর পানি পান করতেন, এভাবে সবাই গোটা একটা দিন অতিবাহিত করতেন।
ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানগণ এক পর্যায়ে পরাজয়ের সম্মুখীন হলেও মুশরিক বাহিনীর একজন চিৎকার করে বলছিল :
“আমাকে দেখিয়ে দাও মুহাম্মদকে।”
সেই চরম মুহূর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে দশজন সাহাবী তাঁকে রক্ষা করার জন্য ঘিরে রেখেছিলেন, আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ছিলেন তাদের অন্যতম।
এ যুদ্ধে শত্রুদের আঘাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি দন্ত মোবারক শহীদ হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিরস্ত্রাণ ভেঙে এর দুটি পেরেক তাঁর মাথায় ঢুকে পড়ে। আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারক থেকে তা বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন; কিন্তু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন :
“আল্লাহর শপথ করে বলছি, আপনি কাজটি আমাকে করতে দিন।”
আবূ বকর ছিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাঁকেই কাজটি করার সুযোগ দিলেন। আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আশঙ্কাবোধ করছিলেন যে, যদি হাতের সাহায্যে পেরেক দু'টি টেনে বের করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীষণ কষ্ট পাবেন। তাই তিনি দাঁত দিয়ে তা টেনে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমবারে একটি বের হয়ে এলেও আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সামনের একটি দাঁত ভেঙে যায়, দ্বিতীয় বারে অপরটিও বেরিয়ে আসে; কিন্তু এবারও তাঁর সামনের অপর একটি দাঁত ভেঙে যায়। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন :
“আবূ উবায়দা ছিলেন সামনের দুটি দাঁত ভাঙা সর্বাপেক্ষা সুদর্শন ব্যক্তি।”
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পর্যন্ত তাঁর সাথে সমস্ত যুদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতী ও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের পর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতে খিলফাতের বাইআতের দিন উমর ফারূক রানিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে সম্বোধন করে বললেন :
আপনার হাতটা বাড়িয়ে দিন, যাতে আমি বাইআত করতে পারি। কারণ, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই একজন আমীন বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি থাকেন, এ উম্মতের মধ্যে আপনিই 'আমীন'। অতএব আপনিই এর একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। এ কথা শুনে আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন:
“এমন এক ব্যক্তিকে রেখে কখনোই নিজে খিলাফতের বাইআত নিতে পারি না, যাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশাতেই আমাদের জন্য নামাযের ইমাম নিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনিই আমাদের ইমামতি করেন।”
অতঃপর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতেই খিলাফতের বাইআত করা হয়। তাই হকের ব্যাপারে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহ আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর জন্য উত্তম উপদেশদাতা ও সর্বাপেক্ষা অধিক সহযোগিতা দানকারী ছিলেন।
আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ইনতিকালের পর আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতে খিলাফতের বাইআত গ্রহণ করেন। আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর একান্ত অনুগত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সারা জীবনে মাত্র একবার ছাড়া আর কখনো তিনি খালীফাতুল মুসলিমীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নির্দেশ পালনে অনীহা দেখাননি।
প্রিয় পাঠক! কী সেই নির্দেশ, যেটি পলন করতে আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন?
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সিরিয়া বিজয়ের প্রাক্কালে যখন মুসলিম বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনছিলেন, তখন তিনি পূর্বে ফোরাত নদী এবং উত্তরে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত তাঁর বিজয়ের সীমানা বিস্তৃত করেন। অব্যাহত গতিতে এ বিজয় চলাকালে সিরিয়ায় হঠাৎ নজীরবিহীন মহামারি দেখা দেয় এবং তাতে ব্যাপকভাবে মানুষ মারা যেতে থাকে। এ সময় আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে একখানা পত্র দিয়ে একজন দূত প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি লিখেন :
“অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে আমি বিশেষভাবে মদীনায় আপনার উপস্থিতি কামনা করছি। আপনার নিকট এ নির্দেশনামা রাতে পৌঁছলে ভোর হওয়ার পূর্বে এবং দিনে পৌঁছলে সূর্যাস্তের পূর্বে অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে আমার কাছে চলে আসবেন বলে আশা করছি।”
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু খালীফাতুল মুসলিমীনের এ নির্দেশনামা পাঠ করে বললেন :
“আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের কী প্রয়োজন, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি এমন এক ব্যক্তিকে জীবিত রাখতে চাচ্ছেন, যার বেঁচে থাকার কথা নয়।”
অতঃপর তিনি আমীরুল মুমিনীনকে লিখলেন :
“আমীরুল মুমিনীন, আপনার সমীপে আমার প্রয়োজনীয় বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। আমি মুসলিম সৈন্যবাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা মহামারীতে আক্রান্ত। তাদেরকে বিপদে রেখে আমি নিজে নিরাপদ স্থানে যাওয়া মোটেই পছন্দ করছি না। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে মৃত্যু আমাকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন না করেছে; ততক্ষণ আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছি না। আমার এ পত্র আপনার কাছে পৌছার পর আমাকে ঐ নির্দেশ থেকে অব্যাহতি দান করবেন এবং আমাকে এখানে অবস্থান করার অনুমতি দান করবেন।”
আবূ উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পত্র পাঠের পর উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকল, তাঁর এ অস্বাভাবিক কান্না দেখে তাঁর পাশে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা বললেন :
“হে আমীরুল মুমিনীন! আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কি মৃত্যুবরণ করেছেন?"
উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন :
“না, বরং মৃত্যু তাঁর অতি নিকটে এসে পৌঁছেছে।”
উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ধারণা মিথ্যা ছিল না, অল্পদিনের মধ্যে আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মহামারীতে আক্রান্ত হলেন! মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাঁর বাহিনীকে অন্তিম উপদেশ দিয়ে বললেন :
“আমি তোমাদেরকে অন্তিম কিছু উপদেশ দিতে চাই। যদি তা গ্রহণ কর তাহলে সর্বদা তোমাদের কল্যাণ হতে থাকবে। নামায কায়েম করবে, রমযান মাসে রোযা রাখবে, যাকাত দিবে, হজ্জ ও উমরাহ পালন করবে, পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে অসিয়ত করবে। আমীরদের পরামর্শ দান করবে, তাদেরকে ধোঁকা দেবে না এবং দুনিয়াদারী যেন তোমাদেরকে অন্য সবকিছু থেকে গাফেল করে না দেয়। কেননা, যদি কাউকে হাজার বছরও আয়ুষ্কাল দান করা হয় তবুও একথা নিশ্চিত যে, তাকেও একদিন এমনিভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে। যেভাবে এ মুহূর্তে তোমরা আমাকে হতে দেখছ।”
এরপর তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন :
'আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ'
অতঃপর তিনি মু'আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দিকে ফিরে বললেন :
“হে মুয়ায, মুসলিম বাহিনীর নামাযের ইমামতি করাও।”
এর অল্পক্ষণ পরেই তাঁর পবিত্র রূহ ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। তখন মুয়ায রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন :
“প্রিয় ভাইয়েরা! আপনারা এমন এক ব্যক্তিকে হারিয়েছেন, খোদার শপথ! যাঁর মতো প্রশস্ত অন্তরের মানুষ আমার জানা মতে আর নেই, তাঁর মন সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ থেকে ছিল পবিত্র। সঙ্গী-সাথীদের ভুল-ত্রুটিতে দয়াশীল ও ক্ষমাসুলভ আচরণে তাঁর কোনো জুড়ি ছিল না। তাঁর মতো জনগণের এতো বড় কল্যাণকামীও আর কেউ ছিল না, তাঁর প্রতি সদয় হোন। আল্লাহ আপনাদের প্রতি সদয় হবেন।”
– সাহাবীদের আলোকিত জীবন (১ম খন্ড), ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, সবুজপত্র পাবলিকেশন্স
Last edited: