আবু ত্বহা আদনানের ফতোয়া - হারামের অনুমোদনদাতা সবাই কাফির!

Joynal Bin TofajjalVerified member

Student Of Knowledge
Forum Staff
Moderator
Uploader
Exposer
HistoryLover
Salafi User
Joined
Nov 25, 2022
Threads
344
Comments
475
Reactions
5,289
বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান বলেছেন, “গতকালকে নিউজ দেখলাম। এটা একটা মজার নিউজ যে, আমাদের ডিবি পুলিশরা ঢাকায় অনেকগুলো মদের বার জব্দ করেছে। অপরাধ হচ্ছে, ওদের অপরাধটা শুনেন, করোনাকালীন সময়ে তারা নাকি মদ হোম-ডেলিভারি দিচ্ছিল। হোম-ডেলিভারি বোঝেন? মানে অর্ডার করবেন, বাসায় এসে মদ দিয়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ! কোন দেশে বাস করেন! তো আল্লাহ পাক যেটা হারাম করেছেন, আমরা সেটা হালাল করেছি। ওদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে এই অপরাধে যে, ওদের লাইসেন্স নাই। আর লাইসেন্স থাকলে, ইটস ওকে, এটা ঠিক ছিল। নাউজুবিল্লাহ। তো আল্লাহর হালালকে কেউ যদি হারাম করে, ভাই, আর আল্লাহর হারামকে কেউ যদি হালাল করে, ব্যক্তি হোক, পরিবার হোক, সমাজ হোক, আর রাষ্ট্র হোক, সে মুশরেক! সুস্পষ্ট শির্ক!” [দেখুন: https://youtu.be/3Zde83wG0xQ (১১:৫৬ মিনিট থেকে ১২:৪০ মিনিট)]

সুপ্রিয় ভ্রাতৃমণ্ডলী, বক্তা আদনানের ফতোয়া অনুযায়ী হারাম কাজের অনুমোদনদাতা সবাই কাফির। শুধু রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স দেওয়া হলেই হারামকে হালাল করা হয়, হারামের অনুমোদন দেওয়া হয়—ব্যাপারটি এমন নয়। বরং যে কেউ হারামের অনুমোদন দিলে সেটাও হারামকে হালাল করা হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন ধরুন, আপনি একটি পরিবারের কর্তা। আপনার পরিবারে হারাম নাটক-সিরিয়াল, বেগানা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, স্ত্রীর বেপর্দা চলাফেরা প্রভৃতির অনুমোদন দিয়ে রেখেছেন আপনি। এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনি হারামকে হালাল করেছেন। এর মানে কি আপনি কাফির? আদনান সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী আপনি মুশরিক! অফিসের প্রধান কর্মচারীদের কাজে ফাঁকি দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন, অফিসের ক্যান্টিনে নেশাদার দ্রব্য গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছেন। হারামকে হালাল করার এই অপরাধে অফিসের বস কি কাফির? আদনান সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী অবশ্যই কাফির!

কিন্তু শরিয়ত কী বলছে? এসব কাজ করলে কি কেউ বাস্তবেই কাফির হয়ে যায়? এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব— হারামের অনুমোদন দেওয়া মাত্রই কেউ কাফির হয়ে যায় না। তবে কেউ যদি শরিয়তের সেই হারাম কাজটিকে হালাল বিশ্বাস রেখে হারাম কাজটির অনুমোদন দেয়, তাহলে কাফির হয়ে যায়। হালাল-বিশ্বাস করে অনুমোদনদানকারী ব্যক্তি রাষ্ট্র-প্রশাসনের কেউ হোক, চাই পরিবারের কর্তা হোক, আর চাই অফিসের বস হোক, সে কাফির। পক্ষান্তরে হারাম কাজকে হারাম বিশ্বাস রেখে কাজটির অনুমোদনদাতা কাফির নয়, বরং একজন পাপী মুসলিম, তার কাজটি বড়ো কুফর নয়।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেউ হারামকে হালাল বলে বিশ্বাস করে কিনা তা বুঝব কীভাবে? এটা বুঝতে হলে অবশ্যই লিখিত কিংবা মৌখিক স্টেটমেন্ট লাগবে। অনুমোদনদাতাকে প্রকাশ করতে হবে, আমি এ কাজকে হালাল মনে করি। কেবল তখনই জানা যাবে, সে হারামকে হালাল বলে বিশ্বাস করে এবং তখন ‘কাফির বলার মূলনীতি’ অনুযায়ী তাকে কাফির বলা হবে। যদি কারও এরকম স্টেটমেন্ট জানা না যায়, তাহলে বাহ্যিকতার ভিত্তিতে তাকে মুসলিম হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। কাফির বলা যাবে না। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু ভয়ংকর কুফরি কাজ আছে, যা করামাত্র জানা যায়, সে উক্ত কাজকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। যেমন ধরুন, কেউ কুরআনকে লাত্থি মারল, কিংবা আল্লাহকে গালি দিল, অথবা নবিজিকে গালি দিল। এগুলো সত্তাগত কুফরি কাজ; কবিরা গুনাহের পর্যায়ভুক্ত পাপ নয়। এ জাতীয় কাজ থেকেই প্রমাণিত হয় কাজের সম্পাদক কাফির, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মদের লাইসেন্স দিলেই, কিংবা বউকে বেপর্দা চলতে দিলেই কেউ কাফির হয় না।

আমরা এখানে সংক্ষেপে হালালকে হারাম করার স্বরূপ নিয়ে যা বললাম, তার প্রমাণস্বরূপ পর্যায়ক্রমে পাঁচটি ধাপে আমরা খুবই প্রমাণ্য একটি আলোচনা পেশ করব, ইনশাআল্লাহ। তার আগে বলে রাখি, হালালকে হারাম করাকে আরবিতে ‘ইস্তিহলাল’ বা ‘তাহলিল’ বলে অভিহিত করা হয়। হারামকে হালাল বিশ্বাস করলে যেই ইস্তিহলাল হয়, তা বড়ো কুফর হওয়ার বিষয়টি সর্ববাদিসম্মত অভিমত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ঐক্যমত অনুসারে উক্ত কাজের কাজি কাফির। এই ইজমার পক্ষে দলিল হচ্ছে সুরা তওবার ৩১ নং আয়াত, যে আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির বিগত পরিচ্ছেদে সাহাবি আদি বিন হাতিম রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে। [দেখুন: ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৬৭; ইবনু তাইমিয়া কৃত আস-সারিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রসুল; পৃষ্ঠা: ৫২১; শাইখ ইবনু বায কৃত মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতিম মুতানাওয়্যাআহ; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১১৯-১২০]

প্রথম ধাপ: কুফরি ইস্তিহলাল তথা হারামকে হালাল করার মানে— অন্তরে হারামকে হালাল মনে করা।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেছেন, والاستحلال : اعتقاد أنها حلال له “ইস্তিহলাল হচ্ছে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, এটা তার জন্য হালাল।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়া কৃত আস-সারিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রসুল; পৃষ্ঠা: ৫২১; সৌদিয়ান ন্যাশনাল গার্ড কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪০৩ হি./১৯৮৩ খ্রি.]

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭৫১ হি.) বলেছেন, فإن المستحل للشيء هو : الذي يفعله معتقداً حله “কোনো কিছুকে হালাল গণ্যকারী (মুস্তাহিল) সে, যে তা হালাল বিশ্বাস করে সম্পাদন করে।” [ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বিরচিত ইগাসাতুল লাহফান ফি মাসায়িদিশ শাইতান; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৮২]

আর বলাই বাহুল্য যে, বিশ্বাসের স্থান হচ্ছে অন্তর। আর অন্তরস্থ বিষয় মৌখিক বা লিখিত স্বীকৃতি ছাড়া জানা সম্ভব নয়। সুতরাং কোনো ব্যক্তির অন্তরস্থ বিষয় কুফরি ইস্তিহলালও মৌখিক বা লিখিত স্বীকৃতি ছাড়া জানা সম্ভব নয়। বিষয়টি আরও সুন্দর করে বোঝার জন্য আমি ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর একটি ফতোয়া পেশ করছি।
বিগত শতাব্দীর জগৎশ্রেষ্ঠ বিদ্বান, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.) প্রদত্ত ফতোয়া—
السؤال: ﻓﻀﻴﻠﺔ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﻣﺎ ﻫﻮ ﺿﺎﺑﻂ ﺍﻻﺳﺘﺤﻼﻝ ﺍﻟﺬﻱ ﻳﻜﻔﺮ ﺑﻪ ﺍﻟﻌﺒﺪ؟
ﺍﻟﺠﻮﺍﺏ : ﺍﻻﺳﺘﺤﻼﻝ : ﻫﻮ ﺃﻥ ﻳﻌﺘﻘﺪ ﺣِﻞَّ ﻣﺎ ﺣﺮﻣﻪ ﺍﻟﻠﻪ .
ﻭﺃﻣﺎ ﺍﻻﺳﺘﺤﻼﻝ ﺍﻟﻔﻌﻠﻲ ﻓﻴﻨﻈﺮ : ﺇﻥ ﻛﺎﻥ ﻫﺬﺍ ﺍﻻﺳﺘﺤﻼﻝ ﻣﻤﺎ ﻳﻜﻔِّﺮ ﻓﻬﻮ ﻛﺎﻓﺮ ﻣﺮﺗﺪ ، ﻓﻤﺜﻠًﺎ : ﻟﻮ ﺃﻥ ﺍﻹﻧﺴﺎﻥ ﺗﻌﺎﻣﻞ ﺑﺎﻟﺮﺑﺎ ، ﻭﻻ ﻳﻌﺘﻘﺪ ﺃﻧﻪ ﺣﻼﻝ ﻟﻜﻨﻪ ﻳﺼﺮ ﻋﻠﻴﻪ ، ﻓﺈﻧﻪ ﻻ ﻳﻜﻔﺮ؛ ﻷﻧﻪ ﻻ ﻳﺴﺘﺤﻠُّﻪ ، ﻭﻟﻜﻦ ﻟﻮ ﻗﺎﻝ : ﺇﻥ ﺍﻟﺮﺑﺎ ﺣﻼﻝ ، ﻭﻳﻌﻨﻲ ﺑﺬﻟﻚ ﺍﻟﺮﺑﺎ ﺍﻟﺬﻱ ﺣﺮﻣﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﺈﻧﻪ ﻳﻜﻔﺮ؛ ﻷﻧﻪ ﻣﻜﺬﺏ ﻟﻠﻪ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ . ﺍﻻﺳﺘﺤﻼﻝ ﺇﺫَﻥ : ﺍﺳﺘﺤﻼﻝٌ ﻓﻌﻠﻲٌّ ، ﻭﺍﺳﺘﺤﻼﻝٌ ﻋﻘﺪﻱٌّ ﺑﻘﻠﺒﻪ .
ﻓﺎﻻﺳﺘﺤﻼﻝ ﺍﻟﻔﻌﻠﻲ : ﻳﻨﻈﺮ ﻓﻴﻪ ﻟﻠﻔﻌﻞ ﻧﻔﺴﻪ ، ﻫﻞ ﻳﻜﻔﺮ ﺃﻡ ﻻ؟ ﻭﻣﻌﻠﻮﻡ ﺃﻥ ﺃﻛﻞ ﺍﻟﺮﺑﺎ ﻻ ﻳﻜﻔﺮ ﺑﻪ ﺍﻹﻧﺴﺎﻥ ، ﻟﻜﻨﻪ ﻣﻦ ﻛﺒﺎﺋﺮ ﺍﻟﺬﻧﻮﺏ ، ﺃﻣﺎ ﻟﻮ ﺳﺠﺪ ﻟﺼﻨﻢ ﻓﻬﺬﺍ ﻳﻜﻔﺮ ﻟﻤﺎﺫﺍ؟ ﻷﻥ ﺍﻟﻔﻌﻞ ﻳﻜﻔﺮ؛ ﻫﺬﺍ ﻫﻮ ﺍﻟﻀﺎﺑﻂ؛ ﻭﻟﻜﻦ ﻻﺑﺪ ﻣﻦ ﺷﺮﻁ ﺁﺧﺮ ﻭﻫﻮ : ﺃﻟَّﺎ ﻳﻜﻮﻥ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻤﺴﺘﺤﻞُّ ﻣﻌﺬﻭﺭًﺍ ﺑﺠﻬﻠﻪ ، ﻓﺈﻥ ﻛﺎﻥ ﻣﻌﺬﻭﺭًﺍ ﺑﺠﻬﻠﻪ؛ ﻓﺈﻧﻪ ﻻ ﻳﻜﻔﺮ ، ﻣﺜﻞ ﺃﻥ ﻳﻜﻮﻥ ﺇﻧﺴﺎﻥٌ ﺣﺪﻳﺚ ﻋﻬﺪ ﺑﺎﻹﺳﻼﻡ ، ﻻ ﻳﺪﺭﻱ ﺃﻥ ﺍﻟﺨﻤﺮ ﺣﺮﺍﻡ ، ﻓﺈﻥ ﻫﺬﺍ - ﻭﺇﻥ ﺍﺳﺘﺤﻠﻪ - ﻓﺈﻧﻪ ﻻ ﻳﻜﻔﺮ ، ﺣﺘﻰ ﻳﻌﻠﻢ ﺃﻧﻪ ﺣﺮﺍﻡ؛ ﻓﺈﺫﺍ ﺃﺻﺮَّ ﺑﻌﺪ ﺗﻌﻠﻴﻤﻪ ، ﺻﺎﺭ ﻛﺎﻓﺮًﺍ.
প্রশ্ন: “সম্মানিত শাইখ, ইস্তিহলালের মানদণ্ড কী, যেকারণে বান্দা কাফির হয়ে যায়?”
উত্তর: “আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল বলে বিশ্বাস করাই হলো ইস্তিহলাল। পক্ষান্তরে কর্মগত ইস্তিহলালের ক্ষেত্রে লক্ষ করা হবে, যদি এই ইস্তিহলাল কাফিরকারী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে সে কাফির মুরতাদ (দিন থেকে খারিজ)। উদাহরণস্বরূপ যদি কোনো ব্যক্তি সুদি লেনদেন করে, যদিও সে তা (সুদ) হালাল বলে বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই পাপকাজে সে অটল থাকে, তবে সে কাফির হবে না। কেননা সে ওই হারাম কাজকে ইস্তিহলাল তথা হালাল গণ্য করেনি। কিন্তু সে যদি বলে, নিশ্চয়ই সুদ হালাল। সে এর দ্বারা আল্লাহর হারামকৃত সুদকে উদ্দেশ্য করে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে। কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। তাহলে ইস্তিহলাল দুই ধরনের: কর্মগত ইস্তিহলাল এবং অন্তর দ্বারা কৃত বিশ্বাসগত ইস্তিহলাল।

কর্মগত ইস্তিহলালের ক্ষেত্রে লক্ষ করা হবে, কর্মটি নিজেই মুকাফফির তথা কাফিরকারী কি না। আর এটা সুবিদিত যে, সুদ খেলে ব্যক্তি কাফির হয় না। কিন্তু তা কবিরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে সে যদি মূর্তিকে সিজদাহ করে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে। কেনো? কারণ, কর্মটি (নিজেই) কাফিরকারী। এটাই হলো মানদণ্ড। কিন্তু অবশ্যই আরেকটা শর্ত থাকতে হবে। আর তা হল এই ইস্তিহলালকারী ব্যক্তি স্বীয় অজ্ঞতার কারণে ওজরগ্রস্ত হতে পারবে না। সে যদি নিজের অজ্ঞতার কারণে ওজরগ্রস্ত হয়, তবে সে কাফির হবে না। যেমন একজন ব্যক্তি নতুন ইসলামে দীক্ষিত হতে পারে। সে জানে না, ইসলামে মদ হারাম। তাহলে সে কাফির হবে না, যদিও সে মদকে ইস্তিহলাল তথা হালাল গণ্য করে; যতক্ষণ না সে জানছে যে, মদ হারাম। তাকে জানানোর পরেও যদি সে তাতে (হালাল মনে করার ওপরে) অটল থাকে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে।” [লিকাউল বাবিল মাফতুহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৯৭; লিকা নং: ৫০; প্রশ্ন নং: ১১৯৮]

দ্বিতীয় ধাপ: মানুষের অন্তরে কী আছে তা আমাদের জানা সম্ভব নয়, তাই হুকুম দিতে হবে বাহ্যিকতার ভিত্তিতে।
সাহাবি উসামা ইবনু যাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে হুরকা গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমরা প্রত্যুষে গোত্রটিকে আক্রমণ করি এবং তাদেরকে পরাজিত করে ফেলি। এ সময়ে আনসারদের এক ব্যক্তি ও আমি তাদের (হুরকাদের) একজনের পিছু ধাওয়া করলাম। আমরা যখন তাকে ঘিরে ফেললাম তখন সে বলে ওঠল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এ বাক্য শুনে আনসারি ব্যক্তি তাঁর অস্ত্র সামলে নিলেন। কিন্তু আমি তাকে আমার বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে ফেললাম। মদিনায় ফেরার পর এ সংবাদ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, يَا أُسَامَةُ أَقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘উসামা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরেও তুমি তাকে হত্যা করেছ?’ আমি বললাম, ‘সে তো জান বাঁচানোর জন্য কালিমা পড়েছিল।’ এর পরেও তিনি এ কথাটি ‘উসামা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরেও তুমি তাকে হত্যা করেছ!’ বারবার বলতে থাকলেন। এতে আমার মন চাচ্ছিল, হায়, যদি সেই দিনটির পূর্বে আমি ইসলামই গ্রহণ না করতাম!” [সহিহ বুখারি, হা: ৪২৬৯; সহিহ মুসলিম, হা: ৯৬]

সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবি উসামাকে বলেছিলেন, أَفَلاَ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ حَتَّى تَعْلَمَ أَقَالَهَا أَمْ لا؟ “তুমি তার অন্তর চিড়ে কেন দেখলে না, যাতে তুমি জানতে পারতে, সে কালিমা অন্তর থেকে বলেছে, না বলেনি?” [সহিহ মুসলিম, হা: ৯৬; ইমান অধ্যায় (১); পরিচ্ছেদ: ৪১]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‏قَالَ: فَكَيْفَ تَصْنَعُ بِلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ إِذَا جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‏.‏ قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ اسْتَغْفِرْ لِي ‏.‏ قَالَ :‏ وَكَيْفَ تَصْنَعُ بِلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ إِذَا جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‏.‏ قَالَ فَجَعَلَ لاَ يَزِيدُهُ عَلَى أَنْ يَقُولَ ‏:‏ كَيْفَ تَصْنَعُ بِلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ إِذَا جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَة “নবিজি বললেন, কেয়ামতের দিন যখন সে কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নিয়ে হাজির হবে, তখন তুমি কী করবে? তিনি আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল, আমার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে দিন। নবিজি বলতে থাকলেন, কেয়ামতের দিন যখন সে কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নিয়ে হাজির হবে, তখন তুমি কী করবে? তারপর তিনি কেবল এ কথাই বলছিলেন, কেয়ামতের দিন যখন সে কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নিয়ে হাজির হবে, তখন তুমি কী করবে? তিনি এর অতিরিক্ত কিছু বলেননি।” [সহিহ মুসলিম, হা: ৯৭; ইমান অধ্যায় (১); পরিচ্ছেদ: ৪১]

হাদিস থেকে বোঝা যায়, বান্দা অন্তরস্থ বিষয় জানার জন্য আদিষ্ট হয়নি। অন্তরের বিষয় আল্লাহর ওপর অর্পিত। অতএব ব্যক্তিকে তার বাহ্যিকতার ওপর ভিত্তি করে হুকুম দেওয়া হবে। অন্তরে অবস্থিত ইস্তিহলাল তথা হারামকে হালাল বিশ্বাসের হুকুম ব্যক্তির মৌখিক বা লিখিত স্বীকৃতি ছাড়া দেওয়া যাবে না।

এজন্য হাদিসের খ্যাতনামা ব্যাখ্যাকার ইমাম খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৩৮৮ হি.) বলেন, وفي قوله (هلّا شققت عن قلبه) دليل على أن الحكم إنما يجري على الظاهر ، وأن السرائر موكولة إلى الله سبحانه “নবিজির কথা— “তুমি তার অন্তর চিড়ে কেনো দেখলে না”– এতে দলিল রয়েছে যে, হুকুম চলে বাহ্যিকতার ওপর ভিত্তি করে। আর গুপ্ত বিষয়গুলো অর্পিত আল্লাহর ওপর।” [মাআলিমুস সুনান, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৩৪]

জগদ্বিখ্যাত হাদিসের ভাষ্যকার ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৬৭৬ হি.) হাদিসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, وَمَعْنَاهُ أَنَّك إِنَّمَا كُلِّفْت بِالْعَمَلِ بِالظَّاهِرِ وَمَا يَنْطِق بِهِ اللِّسَان، وَأَمَّا الْقَلْب فَلَيْسَ لَك طَرِيقٌ إِلَى مَعْرِفَة مَا فِيهِ، فَأَنْكَرَ عَلَيْهِ اِمْتِنَاعه مِنْ الْعَمَل بِمَا ظَهَرَ بِاللِّسَانِ . وَقَالَ : أَفَلَا شَقَقْت عَنْ قَلْبه لِتَنْظُر هَلْ قَالَهَا الْقَلْب وَاعْتَقَدَهَا وَكَانَتْ فِيهِ أَمْ لَمْ تَكُنْ فِيهِ بَلْ جَرَتْ عَلَى اللِّسَان فَحَسْب يَعْنِي وَأَنْتَ لَسْت بِقَادِرٍ عَلَى هَذَا فَاقْتَصِرْ عَلَى اللِّسَان فَحَسْب ، يَعْنِي وَلَا تَطْلُب غَيْره . وَقَوْله صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( أَفَلَا شَقَقْت عَنْ قَلْبه ) فِيهِ دَلِيل لِلْقَاعِدَةِ الْمَعْرُوفَة فِي الْفِقْه وَالْأُصُول أَنَّ الْأَحْكَام يُعْمَل فِيهَا بِالظَّوَاهِرِ ، وَاَللَّه يَتَوَلَّى السَّرَائِر “অর্থাৎ, তোমাকে বাহ্যিকতা এবং জবানের কথার ভিত্তিতে আমল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে অন্তরে কী আছে, তা জানার কোনো রাস্তা নেই। জবানের থেকে প্রকাশিত বিষয় অনুযায়ী আমল না করার কারণে তিনি তাঁকে (সাহাবি উসামাকে) তিরস্কার করেছেন। বলেছেন, তার অন্তর তুমি কেন চিড়লে না, যাতে তুমি দেখতে পারতে, তার অন্তর কালিমা বলে তার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করেছে কিনা এবং তার অন্তরে কালিমা আছে কিনা? বরং তার জবানে কালিমা এসেছে, এটাই যথেষ্ট। অর্থাৎ তুমি এ কাজে (অন্তর চিড়ে দেখতে) সক্ষম নও। সুতরাং কেবল জবানের ওপরই তুমি ক্ষান্ত থাক। মানে এর বাইরে অন্যকিছু তুমি তালাশ কোরো না। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বলেছেন, ‘তুমি তার অন্তর কেনো চিড়লে না’– এতে ফিকহ ও উসুলের প্রসিদ্ধ মূলনীতিটির পক্ষে দলিল রয়েছে যে, ‘বিধিবিধানের ক্ষেত্রে বাহ্যিকতার ভিত্তিতে আমল করতে হবে, আর আভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহের দায়িত্ব মহান আল্লাহর’।” [ইমাম নববি কৃত আল-মিনহাজ শারহু মুসলিম, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০৪; সহিহ মুসলিমের ৯৬ নং হাদিসের ব্যাখ্যা]

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোন, মদের লাইসেন্স দেওয়া প্রশাসনের অন্তর চিড়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়নি। তাই এরূপ হারামের অনুমোদনদাতাদের কাফির-মুশরিক বলা মুমিনের কাজ নয়। এগুলো আবু ত্বহা আদনানের মতো উগ্রবাদী খারেজিদের কথা। দেখুন না, মুত্তাকি ইমাম শাইখ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.) কী প্রজ্ঞার সাথে গাইরুল্লাহর আইন দিয়ে বিচারকারীর ব্যাপারে বলেছেন, لو ادعى أنه لا يستحله فنأخذ بظاهر كلامه ولا نحكم بكفره “সে যদি দাবি করে যে, সে বিষয়টিকে ইস্তিহলাল করে না তথা হালাল মনে করে না, তাহলে আমরা তার কথার বাহ্যিক দিকটি গ্রহণ করব। আমরা তাকে কাফির বলব না।” [শাইখ বুনদার আল-উতাইবি বিরচিত আল-হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ, পৃষ্ঠা: ১৩; মাকতাবাতুল মালিক ফাহাদ (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৭ হিজরি (২য় প্রকাশ)]

তৃতীয় ধাপ: অন্তরস্থ ইস্তিহলালের কথা স্রেফ মৌখিক বা লিখিত স্বীকৃতির মাধ্যমে জানা সম্ভব, অন্য কোনো মাধ্যমে নয়।
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাকিহ, মুজ্জাদিদ ইমাম, শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আল-আলবানি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.) বলেছেন, إذا الكفر الاعتقادي ليس له علاقة أساسية بمجرد العمل إنما علاقته الكبرى بالقلب ونحن لا نستطيع أن نعلم ما في قلب الفاسق والفاجر والسارق والزاني والمرابي . . . ومن شابههم إلا إذا عبر عما في قلبه بلسانه أما عمله فيبنئ أنه خالف الشرع مخالفة عملية، فنحن نقول: إنك خالفت، وإنك فسقت، وإنك فجرت، لكن لا نقول: إنك كفرت واتددت عن دينك “স্রেফ আমলের সাথে বিশ্বাসগত কুফরির বুনিয়াদি সম্পর্ক নেই। তার বৃহৎ সম্পর্ক শুধু অন্তরের সাথে। ফাসেক, পাপাচারী, চোর, ব্যভিচারী, সুদের কারবারী প্রমুখের অন্তরে কী আছে, আমরা তা জানতে সক্ষম নই। তবে সে যদি তার অন্তরস্থ বিষয় জবান দ্বারা ব্যক্ত করে, তবে সেকথা ভিন্ন। পক্ষান্তরে তার আমল থেকে কেবল জানা যায়, সে আমলগতভাবে শরিয়তের বিরোধিতা করেছে। এজন্য আমরা বলি, তুমি শরিয়তের বিরোধিতা করেছ, ফাসেকি কাজ করেছ এবং পাপাচারে লিপ্ত হয়েছ। আমরা বলি না, তুমি কাফির হয়ে গেছ এবং দিন থেকে বেরিয়ে গেছ।” [ইমাম আলবানি রাহিমাহুল্লাহ কৃত ফিতনাতুত তাকফির; পৃষ্ঠা: ৩৩; দারু ইবনি খুযাইমাহ কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪১৮ হি./১৯৯৭ খ্রি. (২য় প্রকাশ); গ্রন্থটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা অধ্যয়ন করেছেন ও তাতে ভূমিকা লিখে দিয়েছেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ এবং গ্রন্থটির টিকা লিখেছেন ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ]

দক্ষিণ সৌদি আরবের মুফতি, আশ-শাইখুল আল্লামা, আল-ফাকিহুল মুহাদ্দিস, ইমাম আহমাদ বিন ইয়াহইয়া আন-নাজমি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২৯ হি./২০০৮ খ্রি.) ‘ইস্তিহলাল’ বিষয়ক আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, فبأي شيء نعرف الاستحلال؟ الجواب: نعرفه بالنطق؛ بأن يقول مثلاً بأن الخمر حلال؛ أو الربا حلال؛ أو الزنا حلال، أو أن يكتب ذلك في كتاب نقطع بصحة نسبته إليه؛ أما بدون ذلك، فلا، لأن الاستحلال من عمل القلوب، والقلوب لا يطلع على ما فيها إلا الله وحده، وقد بطلت بهذا التحقيق حجة من يكفر بفعل الكبيرة، ولو تكرر “আমরা কীসের মাধ্যমে ইস্তিহলাল জানতে পারব? উত্তর: আমরা তা (ইস্তিহলাল) জানতে পারব, উচ্চারণের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ ব্যক্তি বলে, মদ হালাল, বা সুদ হালাল, বা ব্যভিচার হালাল। অথবা সে তা কোনো বইয়ে লিখবে, যে বইটি সত্যিকারার্থেই তার বলে আমরা নিশ্চিত থাকব। অন্যথায় আমাদের পক্ষে তা (ইস্তিহলাল) জানা সম্ভব নয়। কেননা ইস্তিহলাল হলো অন্তরের কর্ম। আর অন্তরস্থ বিষয় কী, তা এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ওয়াকিবহাল নয়। এই নিরীক্ষার মাধ্যমে ওই ব্যক্তির দলিল বাতিল সাব্যস্ত হলো, যে কবিরা গুনাহ করার কারণে (মুসলিমকে) কাফির বলে, যদিও সে (মুসলিম) তা করে থাকে বারবার।” [ইমাম আহমাদ আন-নাজমি রাহিমাহুল্লাহ কৃত আল-ফাতাওয়া আল-জালিয়্যা আনিল মানাহিজিদ দাআউয়িয়্যা; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৭৫; তাহকিক: শাইখ হাসান আদ-দাগরিরি; দারুল মিনহাজ (কায়রো) কর্তৃক প্রকাশিত]

বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ফাকিহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ (জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.) বলেছেন, ﺍﻟﻀﻮﺍﺑﻂ ﺍﻟﺘﻲ ﺗﺪﻝ ﻋﻠﻰ ﺍﺳﺘﺤﻼﻝ ﺍﻟﻤﻌﺼﻴﺔ : ﺃﻥ ﻳﺼﺮﺡ ﺍﻟﺸﺨﺺ ﺑﺄﻧﻬﺎ ﺣﻼﻝٌ؛ ﺇﻣﺎ ﺑﻠﺴﺎﻧﻪ ، ﻭﺇﻣﺎ ﺑﻘﻠﻤﻪ ، ﺑﺄﻥ ﻳﻜﺘﺐ ﺑﺄﻧﻬﺎ ﺣﻼﻝ ، ﺃﻭ ﻳﻘﻮﻝ : ﺇﻧﻬﺎ ﺣﻼﻝ ، ﺃﻭ ﻳﺸﻬﺪ ﻋﻠﻴﻪ ﺷﺎﻫﺪﺍﻥ ﻋﺪﻻﻥ ﻓﺄﻛﺜﺮ ﺑﺄﻧﻪ ﻳﻘﻮﻝ : ﺑﺤﻞِّ ﺍﻟﺰﻧﺎ ، ﺃﻭ ﺑﺤﻞِّ ﺍﻟﺨﻤﺮ ، ﺃﻭ ﺣﻞِّ ﺍﻟﺮﺑﺎ ، ﺃﻭ ﻣﺎ ﺃﺷﺒﻪ ﺫﻟﻚ؛ ﺣﻴﻨﺌﺬ ﻳُﺤﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﺑﺎﻻﺳﺘﺤﻼﻝ؛ ﺇﻣﺎ ﺑﺈﻗﺮﺍﺭﻩ ﻛﻼﻣﻴًﺎ ، ﺃﻭ ﻛﺘﺎﺑﻴًﺎ ، ﻭ ﺇﻣﺎ ﺑﺎﻟﺸﻬﺎﺩﺓ ﻋﻠﻴﻪ “যে নীতিমালার আলোকে পাপকাজকে হালাল গণ্য করা (ইস্তিহলাল) প্রমাণিত হয়, তা হলো— ব্যক্তি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করবে যে, এটা হালাল। হয় তার জবান দিয়ে, আর নাহয় তার লিখনের মাধ্যমে। অর্থাৎ সে লিখবে, এটা হালাল, অথবা বলবে, এটা হালাল। অথবা তার ব্যাপারে দুই বা ততোধিক ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, সে বলেছে, ব্যভিচার হালাল, বা মদ হালাল, বা সুদ হালাল, বা অনুরূপ কিছু। তখন তার ওপরে ইস্তিহলালের হুকুম আরোপ করা হবে। হয় মৌখিক বা লিখিতভাবে তার স্বীকৃতির মাধ্যমে, আর নাহয় তার ব্যাপারে সাক্ষ্যের মাধ্যমে।” [শাইখ সালিহ আল-ফাওযান কৃত মুহাদারাতুন ফিল আকিদাতি ওয়াদ দাওয়াহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১৩; দারুল ইফতা (সৌদি আরব) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২২ হিজরি]

চতুর্থ ধাপ: হারাম কাজ করা বা তার অনুমোদন দিলেই প্রমাণিত হয় না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি ইস্তিহলাল (হারামকে হালাল মনে করা) করেছে।
কারণ পুরো ব্যাপারটি অন্তরের স্বীকৃতি তথা বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা ইতঃপূর্বে শাইখুল ইসলাম, ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম-সহ আরও অনেক ইমামের বক্তব্য থেকে এ বিষয়টি প্রমাণ করেছি। তাঁরা কেউই বলেননি, হারাম কাজ করা বা হারাম কাজের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে ইস্তিহলাল। সুতরাং কোনো হারাম কাজের অনুমোদনদানকারী ব্যক্তির ওপর কুফরি ইস্তিহলালের হুকুম দেওয়া, মদের লাইসেন্স দেওয়া প্রশাসনকে কাফির ফতোয়া দেওয়া সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন ও বাতিল।

এজন্য ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ সেকুলার আইন দিয়ে দেশ পরিচালনাকারী শাসকের ব্যাপারে বলেছেন, ﻭﺇﺫﺍ ﻛﺎﻥ ﻳﻌﻠﻢ ﺍﻟﺸﺮﻉ، ﻭﻟﻜﻨﻪ ﺣﻜﻢ ﺑﻬﺬﺍ، ﺃﻭ ﺷﺮﻉ ﻫﺬﺍ، ﻭﺟﻌﻠﻪ ﺩﺳﺘﻮﺭﺍ ﻳﻤﺸﻲ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻋﻠﻴﻪ، ﻳﻌﺘﻘﺪ ﺃﻧﻪ ﻇﺎﻟﻢ ﻓﻲ ﺫﻟﻚ، ﻭﺃﻥ ﺍﻟﺤﻖ ﻓﻴﻤﺎ ﺟﺎﺀ ﺑﻪ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ ﻭﺍﻟﺴﻨﺔ، ﻓﺈﻧﻨﺎ ﻻ ﻧﺴﺘﻄﻴﻊ ﺃﻥ ﻧﻜﻔﺮ ﻫﺬﺍ “আর সে যদি শরিয়ত সম্পর্কে জানে কিন্তু এই আইন (অর্থাৎ সেক্যুলার আইন) দিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করে অথবা এই আইন প্রণয়ন করে এবং এটাকে জনগণের জন্য অনুসরণীয় আইনবিধি বানায়। (কিন্তু) এটা বিশ্বাস করে যে, এসব করার কারণে সে নিজে একজন জালিম এবং প্রকৃত হক রয়েছে কিতাব ও সুন্নাহ আনীত বিধানের মধ্যে, তাহলে আমরা এই ব্যক্তিকে কাফির বলতে সক্ষম নই।” [শাইখ বুনদার আল-উতাইবি বিরচিত আল-হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ; পৃষ্ঠা: ৭২]

এ ব্যাপারে আমরা যুগশ্রেষ্ঠ ফাকিহ ইমাম সালিহ আল-ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] প্রদত্ত একটি সুস্পষ্ট ফতোয়া উল্লেখ করছি। ইমাম ফাওযানকে প্রশ্ন করা হয়েছে, “কোনো হারাম কাজ সম্পাদন করা কি প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি এই কাজকে হালাল সাব্যস্ত করেছে এবং এর মাধ্যমে কুফর সংঘঠিত হয়েছে? এমন পানশালা যেখানে খরিদ্দাররা মদ্যপান করে, অথবা ডিসকো, অথবা সিনেমা, কিংবা থিয়েটার, অথবা সুদি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া কি কাজগুলো করার মাধ্যমে এসব কাজকে হালাল সাব্যস্ত করা এবং এর মাধ্যমে কুফর সংঘটিত হওয়া বলে বিবেচিত হবে?”
তিনি উত্তরে বলেছেন, “না। কোনো কাজ সম্পাদন করা এটা প্রমাণ করে না যে, ব্যক্তি সেটাকে হালাল সাব্যস্ত করেছে। কাজটিকে সে হারাম মনে করতে পারে এবং একই সময়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে অথবা সম্পদের ভালোবাসায় এই কাজ করতে পারে। তাই এটা গুনাহর কাজ করা বলে গণ্য হয়, এটা কুফর হিসেবে গণ্য হয় না। কোনোকিছুকে হালাল সাব্যস্ত করা হয় বিবৃতির মাধ্যমে। সে যদি স্পষ্টভাবে এটি বিবৃত করে এবং বলে, “এই জিনিসটি হালাল।” এটিকে কুফর হিসেবে গণ্য করা হয়। কোনো কাজে নিছক রত হওয়াই ব্যক্তির এটিকে হালাল সাব্যস্ত করার প্রমাণ বহন করে না। কারণ এমন হতে পারে যে, সে এই কাজকে হারাম বলে বিশ্বাস করার পরও এই কাজের দিকে ধাবিত হয়েছে সম্পদের লোভে, অথবা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে অথবা অন্য কোনো কারণে, অথবা অসৎ সঙ্গীদের কারণে।” [দেখুন: https://youtu.be/HYRQgLkAuQQ.]

পঞ্চম ধাপ: কখনো কখনো আমল দেখেই অন্তরের কুফর বুঝা যায়।
খারেজিরা বলতে পারে, কোনো ব্যক্তি ‘তার অন্তরে কুফরি আছে’ এটা স্বীকার করার আগ পর্যন্ত আমরা তাকে কাফির বলি না এবং তার অন্তরে কুফর আছে তা স্বীকার করি না। অথচ ব্যাপারটা এমন না। বরং কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক আমল দেখেই অন্তরের কুফরের ব্যাপারে জানা যায়। কিন্তু এসব আমল হলো সত্তাগত কুফর, এরচেয়ে নিম্নপর্যায়ের কোনো হারাম কাজ তথা কবিরা গুনাহ নয়। সত্তাগত কুফরের আমল আমলকারীর অন্তরে যে কুফরের অস্তিত্ব আছে, তা জানিয়ে দেয়। যেমন: কুরআনকে লাথি মারা, নবিকে গালি দেওয়া, কবরে সিজদা দেওয়া ইত্যাদি। পক্ষান্তরে কবিরা গুনাহের আমল আমলকারীর অন্তরে কুফরের অস্তিত্ব আছে কিনা তা জানায় না। যেমন: মদ্যপান, ব্যভিচার, সুদ খাওয়া, হারাম বিশ্বাস রেখে আল্লাহর আইনবিরোধী আইন দিয়ে বিচার-ফায়সালা করা ইত্যাদি।

এজন্য ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ পূর্বোদ্ধৃত ফতোয়ায় বলেছেন, “আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল বলে বিশ্বাস করাই হলো ইস্তিহলাল। পক্ষান্তরে কর্মগত ইস্তিহলালের ক্ষেত্রে লক্ষ করা হবে, যদি এই ইস্তিহলাল কাফিরকারী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে সে কাফির মুরতাদ (দিন থেকে খারিজ)। উদাহরণস্বরূপ যদি কোনো ব্যক্তি সুদি লেনদেন করে, যদিও সে তা (সুদ) হালাল বলে বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই পাপকাজে সে অটল থাকে, তবে সে কাফির হবে না। কেননা সে ওই হারাম কাজকে ইস্তিহলাল তথা হালাল গণ্য করেনি। কিন্তু সে যদি বলে, নিশ্চয়ই সুদ হালাল। সে এর দ্বারা আল্লাহর হারামকৃত সুদকে উদ্দেশ্য করে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে। কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। তাহলে ইস্তিহলাল দুই ধরনের: কর্মগত ইস্তিহলাল এবং অন্তর দ্বারা কৃত বিশ্বাসগত ইস্তিহলাল।

কর্মগত ইস্তিহলালের ক্ষেত্রে লক্ষ করা হবে, কর্মটি নিজেই মুকাফফির তথা কাফিরকারী কি না। আর এটা সুবিদিত যে, সুদ খেলে ব্যক্তি কাফির হয় না। কিন্তু তা কবিরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে সে যদি মূর্তিকে সিজদাহ করে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে। কেনো? কারণ, কর্মটি (নিজেই) কাফিরকারী। এটাই হলো মানদণ্ড। কিন্তু অবশ্যই আরেকটা শর্ত থাকতে হবে। আর তা হল এই ইস্তিহলালকারী ব্যক্তি স্বীয় অজ্ঞতার কারণে ওজরগ্রস্ত হতে পারবে না। সে যদি নিজের অজ্ঞতার কারণে ওজরগ্রস্ত হয়, তবে সে কাফির হবে না। যেমন একজন ব্যক্তি নতুন ইসলামে দীক্ষিত হতে পারে। সে জানে না, ইসলামে মদ হারাম। তাহলে সে কাফির হবে না, যদিও সে মদকে ইস্তিহলাল তথা হালাল গণ্য করে; যতক্ষণ না সে জানছে যে, মদ হারাম। তাকে জানানোর পরেও যদি সে তাতে (হালাল মনে করার ওপরে) অটল থাকে, তবে সে কাফির হয়ে যাবে।” [লিকাউল বাবিল মাফতুহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৯৭; লিকা নং: ৫০; প্রশ্ন নং: ১১৯৮]

সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের এই প্রামাণ্য আলোচনা থেকেও প্রমাণিত হয়ে গেল পথভ্রষ্ট বক্তা আবু ত্বহা আদনানের খারেজি বৈশিষ্ট্য। যে কিনা হারামের অনুমোদনদাতা সবাইকে কাফির ফতোয়া দেয়। এমনটি ঘটা মোটেও অসম্ভব নয় যে, আদনান-ভক্ত যুবসম্প্রদায়ের কেউ নিজের পিতামাতাকে কিংবা অফিসের বসকে ‘কাফির’ ফতোয়া দিয়ে বসবে, কোনো হারাম কাজকে বাসায় বা অফিসে অনুমোদন দেওয়ার কারণে! আল্লাহুল মুস্তাআন। এজন্য এমন বিপজ্জনক বক্তার বক্তব্য থেকে নিজেকে এবং পরিবারপরিজন ও বন্ধুবান্ধবকে বাঁচিয়ে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমান মুমিনের কাজ।

বর্ণিত আছে, একদা প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ি ইমাম ইবনু তাউস রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৩২ হি.) উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক বিদাতি মুতাযিলি এসে কথা বলা শুরু করল। বর্ণনকারী বলছেন, তখন ইবনু তাউস তাঁর দুকানে দুই আঙুল প্রবেশ করালেন এবং তাঁর ছেলেকে বললেন, “হে বৎস, তুমি তোমার দুকানে দুই আঙুল প্রবেশ করাও এবং চেপে ধরে থাক, তুমি তাঁর একটি কথাও শুনো না।” বর্ণনাকারী তাঁর এই কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘অর্থাৎ অন্তর খুবই দুর্বল (আমরা তার কথা শুনলে আমাদের অন্তরে তা গেঁথে যেতে পারে)’।” [ইবনু বাত্তাহ কৃত আল-ইবানাহ, বর্ণনা নং: ৪০০; লালাকায়ি কৃত শারহু উসুলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, বর্ণনা নং: ২৪৮]






লিখেছেন: মুহাম্মাদ আব্দুল্ললাহ মৃধা।​
 
Back
Top