Student Of Knowledge
Forum Staff
Moderator
Uploader
Exposer
HistoryLover
Salafi User
আবু ত্বহা আদনান বলেছেন, “জাহান্নামে কেন অনেক নারী থাকবে, জানেন? কারণ তারা শুধু নিজেরা অপরাধ করে না, হাজারও মুমিন মানুষের নুর তারা কেড়ে নেয়। দ্যাট ইজ হোয়াই তারা জাহান্নামে বেশি থাকবে। আরেকটা মেজর কারণ হচ্ছে, তাদের এই উদ্ধত মাথা, মেয়েদেরকে বলছি স্পেশালি, হয়তো এই কথাগুলো মেয়েদের কাছেও যাবে। তাদের এই উদ্ধত মাথা আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করতে চায় না। একারণে তারা জাহান্নামে বেশি থাকবে।” [দেখুন: https://youtu.be/U8d3G7lpjd4 (শুরু থেকে ০:৩১ মিনিট)]
আবু ত্বহা আদনান যেই কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা কোনো বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়নি, বরং সেটা একান্তই তাঁর মস্তিকপ্রসূত। আসুন, আমরা সরাসরি নবিজির কথা থেকে জেনে নিই, অধিকাংশ নারী জাহান্নামে থাকার প্রকৃত কারণ। সাহাবি আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي أَضْحًى ـ أَوْ فِطْرٍ ـ إِلَى الْمُصَلَّى، فَمَرَّ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ : يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ، فَإِنِّي أُرِيتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ. فَقُلْنَ وَبِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ : تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ، وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ “একবার ইদুল আজহা অথবা ইদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মহিলাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘হে নারী-সম্প্রদায়, তোমরা সদাকা করতে থাক। কারণ আমাকে দেখানো হয়েছে, জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমাদের সংখ্যাই অধিক।’ তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কারণে, হে আল্লাহর রসুল?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা অধিক পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাক, আর স্বামীর অকৃতজ্ঞতা করে থাক’।” [সহিহুল বুখারি, হা: ৩০৪; সহিহ মুসলিম, হা: ৭৯, ৮০]
উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করার পর ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি.) মন্তব্য করেছেন, فبين النبي- صلى الله عليه وسلم-أسباب كثرتهن في النار؛ لأنهن يكثرن السب، واللعن، والشتم، ويكفرن العشير، الذي هو الزوج، فصرن بذلك أكثر أهل النار “নারীরা জাহান্নামে বেশি থাকার কারণগুলো নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিলেন। কারণ তারা বেশি পরিমাণে গালিগালাজ ও অভিশাপ দিয়ে থাকে, আর স্বামীর (দয়া-অনুগ্রহের) অকৃতজ্ঞতা করে থাকে। এ কারণে তারা হবে জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী।” [শাইখ ইবনু উসাইমিনের মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িল, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬২; দারুস সুরাইয়্যা (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]
এ থেকে বোঝা গেল, আবু ত্বহা আদনান এ বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এ জাতীয় আরও অনেক ভুল ব্যাখ্যা যে তিনি দিয়ে থাকেন, এর কারণ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি একটি বিষয়কে। বিষয়টি হলো— নিজেদের ইচ্ছামতো কুরআন-সুন্নাহ ব্যাখ্যা করার দরজা খোলা আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি তার একটি বক্তব্যে বলেছেন, “প্রতিটা আয়াতকে নিয়ে গবেষণা করবেন। একটা তাফসির কেন? একটা কথা যখন একটা আয়াত থেকে বলা হয়, সে যে তাফসিরটা পড়ছে, সে তাফসিরে যদি না থাকে, তাহলে বলে, তাফসিরের সাথে মিলতেছে না। কয়টা তাফসির পড়ছেন আপনি, ভাই? শুধু ইবনু কাসির পড়লে সেখানেই সবকিছু থাকে? অন্যান্য তাফসিরগুলো নাই? অনেক স্কলার ছিলেন, যাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন। তাঁরা আয়াতগুলোকে নিয়ে গবেষণা করতেন। আর তাঁরা যদি গবেষণা না করতেন, তাহলে আমরা কেমন করে সালাফ থেকে নিতাম? তাঁরা নিজেদের প্রজ্ঞা খাটিয়ে গবেষণা করেছিলেন বলেই তো আমরা নিতে পারি। তো ওই গবেষণার দরজা কি বন্ধ এখন? ইজতিহাদের দরজাটা কি বন্ধ হয়ে গেছে? ভুলও হতে পারে, সঠিকও হতে পারে। ভুল হলে আমার পক্ষ থেকে আমরা বলব, সঠিক হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে।” [দেখুন: https://youtu.be/EqPfyv8Sjt8 (০:৩২ মিনিট থেকে ১:১৮ মিনিট)]
তার এই কথা শুনে বহু মানুষ ধোঁকা খাবে। ধরুন একজন কাদিয়ানি গবেষক এসে বলল, ‘কুরআন-সুন্নাহ পড়ে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানি একজন সত্য নবি, কুরআন-সুন্নাহয় কোথাও বলা হয়নি কাদিয়ানি মিথ্যা নবি!’ কিংবা একজন ইবনু সিনার মতো কাফির দার্শনিক এসে বলল, ‘কবরের আজাব ও পুনরুত্থানের ব্যাপারে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, এগুলো সব মনে মনে হবে। শারীরিকভাবে পরলৌকিক কোনো কিছু সংঘটিত হবে না!’ অথবা আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকারকারী কোনো সুফি জাহমি এসে বলল, ‘আল্লাহ ওপরে নাই। তিনি সবকিছুর মাঝে বিরাজ করছেন!’ এগুলোও তাদের ব্যাখ্যা। আপনি কি ইজতিহাদের দরজা খোলা আছে বলে জনমানুষের মাঝে এসব ব্যাখ্যা প্রচার করার অনুমতি দিবেন? দেবেন না। কারণ ইজতিহাদ বা গবেষণা করে মত দেওয়া সব বিষয়ে করা জায়েজ নেই। যেসব বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর উলামাদের মধ্যে ইজমা তথা সর্ববাদিসম্মত ঐক্য সংঘটিত হয়েছে, সেসব বিষয়ে ইজতিহাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই এবং উলামাদের সর্ববাদিসম্মত অভিমতের বিপরীতে রায় দেওয়াও জায়েজ নেই। এরকম সর্ববাদিসম্মত বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর বিরোধিতা করার কারণেই ব্যক্তিকে বিদাতি আখ্যা দেওয়া হয়, যেমনটি আমরা সপ্তম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে আলোচনা করেছি।
তবে শরিয়তের কিছু হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিবর্গ ইজতিহাদ করতে পারেন, যেসব বিধানে উলামাদের সর্ববাদিসম্মত অভিমত নেই, কিংবা বিধানগুলো নতুন আগত। নতুন আগত বিষয়াবলিকে ‘মাসায়িলুন নাওয়াযিল তথা নাওয়াযিলের মাসায়েল’ বলা হয়। যেমন ধরুন, করোনার সময় কাতারে বড়ো বড়ো ফাঁকা রেখে জামাতে নামাজ পড়া যাবে কিনা, কিংবা করোনাকালীন ইদের নামাজ বাসায় পড়া যাবে কিনা এগুলো নতুন বিষয়। এসব বিষয়ে প্রাজ্ঞ ফাকিহ বিদ্বানগণ ফতোয়া দিবেন, যাঁদের আসলেই ইজতিহাদ তথা শরিয়ত গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার মতো যোগ্যতা আছে। এটা যে সাধারণ কোনো যোগ্যতা না, সেটা বোঝানোর জন্য ইজতিহাদ করতে কী কলকব্জা আর যোগ্যতা লাগে, সেটা বলে দিচ্ছি। তার আগে বলে রাখি, আমাদের উলামাগণ নাওয়াযিলের মাসায়েলে মত দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করেন।
করোনাকালীন সময়ে বাড়িতে ইদের নামাজ পড়লে তাতে খুতবা দিতে হবে কিনা সে বিষয়ে মদিনার ফাকিহ, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উসুলুল ফিকহ ডিপার্টমেন্টের হায়ার স্টাডিজের সিনিয়র প্রফেসর এবং মসজিদে কুবার ইমাম ও খতিব আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ বলেছিলেন, “পূর্ববর্তীগণের বক্তব্য হচ্ছে, খুতবা দিবে না। কিন্তু তাঁদের এ কথা সে অবস্থার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যখন ইমাম খুতবা দেয়। পক্ষান্তরে যখন জামাত-সহকারে ইদের নামাজ কায়েম করা হয় না, তখন কী করতে হবে তা নিয়ে আমি আমাদের উলামাদের মত এখন অবধি জানতে পারিনি। আমরা এমন কোনো কথা বলব না, যে ব্যাপারে আমাদের উলামাদের মধ্য থেকে আমাদের কোনো ইমাম নেই। সুতরাং এই মাসআলাহ গবেষণার দাবি রাখে।” [দেখুন: শাইখের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টের ৭ই মে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের টুইট]
আর তাইতো ইজতিহাদের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। স্রেফ ইজতিহাদের যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদই ইজতিহাদ করতে পারবেন, সাধারণ মানুষ ইজতিহাদ করবে না, চাইলে করতে পারবেও না। ইজতিহাদ করার জন্য বেশ কিছু শর্ত আছে, যে শর্তগুলো পূরণ হলে একজন ব্যক্তি মুজতাহিদ হতে পারেন। যার মধ্যে ইজতিহাদের একটি শর্তেরও অবিদ্যমানতা পাওয়া যাবে, তিনি মুজতাহিদ বলে গণ্য হবেন না।
ইমাম বাগাবি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৫১৬ হি.) বলেন—
“যে ব্যক্তি (নিজের মধ্যে) পাঁচ প্রকার ইলম একত্র করেছেন তিনি মুজতাহিদ। ইলমগুলো হলো: আল্লাহর কিতাবের ইলম, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ইলম, উলামায়ে সালাফের ইজমা (মতৈক্য) ও ইখতিলাফের (মতানৈক্য) ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্যসমূহের ইলম, ভাষার ইলম এবং কিয়াসের ইলম। এটা হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে (আল্লাহর) বিধান উদ্ঘাটন করার পদ্ধতি। যখন তিনি কুরআন, সুন্নাহ, বা ইজমার সুস্পষ্ট বক্তব্যের মধ্যে (আল্লাহর) বিধানকে স্পষ্টভাবে পাবেন না, তখন তাঁর জন্য কুরআন থেকে এই বিষয়গুলো জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে—নাসিখ (রহিতকারী), মানসুখ (রহিত), মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), মুফাসসাল (বিস্তৃত), খাস (নির্দিষ্ট), আম (ব্যাপক), মুহকাম (দ্ব্যর্থহীন), মুতাশাবিহ (দ্ব্যর্থবোধক), মাকরুহ (অপছন্দনীয়), হারাম (নিষিদ্ধ), মুবাহ (বৈধ), মানদুব (পছন্দনীয়), ওয়াজিব (আবশ্যকীয়)। অনুরূপভাবে সুন্নাহ থেকেও এই বিষয়গুলো জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে। তাঁর জন্য সুন্নাহ থেকে সহিহ ও জইফ এবং মুসনাদ ও মুরসাল সম্পর্কে জানা, কুরআনের ওপর সুন্নাহর বিন্যাস এবং সুন্নাহর ওপর কুরআনের বিন্যাস সম্পর্কে জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
যাতে করে তিনি যদি এমন হাদিস পান, যার বাহ্যিক অর্থ কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে হাদিসটির প্রায়োগিক দিকের সন্ধান লাভ করতে পারেন। কেননা সুন্নাহ হলো কুরআনের ব্যাখ্যা, কুরআনের বিরোধী নয়। অবশ্যই তাঁর জন্য শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে যে সুন্নাহ বর্ণিত হয়েছে তা জানা ওয়াজিব; বিধিবিধান ছাড়া এতে যে ঘটনাবলি, খবরাখবর ও উপদেশসমূহ রয়েছে তা এর আওতাভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে কুরআন-সুন্নাহয় বিধিবিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে যে ভাষাবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে জানাও তাঁর জন্য আবশ্যক; আরবদের সমগ্র ভাষা সম্পর্কে জানা এর আওতাভুক্ত নয়। তবে তাঁর জন্য ভাষা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা বাঞ্ছনীয়; যাতে করে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে আরবদের কথা যে উদ্দেশ্যের অর্থ দেয়, সে উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি অবগত হতে পারেন। কেননা (শরিয়তের) সম্বোধন আরবদের ভাষার মাধ্যমেই বর্ণিত হয়েছে; তাই যে ব্যক্তি তা জানে না, সে শরিয়তপ্রণেতার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানবে না।
তাঁর জন্য বিধিবিধানের ক্ষেত্রে সাহাবি ও তাবেয়িগণের বক্তব্যসমূহ জানা এবং উম্মাহর ফাকিহদের অধিকাংশ ফতোয়া জানা আবশ্যক, যাতে করে তাঁর উদ্ঘাটিত বিধান তাঁদের বক্তব্যের বিরোধী না হয়, যার ফলে কোনো বিধানে ইজমা লঙ্ঘিত হয়। যখন তিনি এই প্রত্যেক প্রকার ইলমের অধিকাংশই জানবেন, তখন তিনি মুজতাহিদ হিসেবে গণ্য হবেন। উল্লিখিত প্রত্যেক প্রকার ইলমের সমগ্র অংশ জানাকে শর্ত করা হবে না, তবে কোনো শাস্ত্রের জ্ঞানই অপর্যাপ্ত থাকা যাবে না। যখন কেউ এই প্রকারগুলোর মধ্য থেকে কোনো এক প্রকার ইলম সম্পর্কে জানবে না, তখন তার (অবলম্বন করার) রাস্তাই হলো তাকলিদ।” [ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি রাহিমাহুল্লাহ, ইকদুল জিদ ফি আহকামিল ইজতিহাদি ওয়াত তাকলিদ; পৃষ্ঠা: ২১-২৩; দারুল ফাতহ (শারিকা) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.) বলেছেন—
“ইজতিহাদের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যথা:
১. শরয়ি দলিল থেকে যা তার ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে তা জানা থাকা। যেমন: বিধিবিধানের আয়াত ও হাদীসসমূহ।
২. হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতার সাথে যা সংশ্লিষ্ট তা জানা থাকা। যেমন: সনদ ও তার বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জানা।
৩. নাসিখ (রহিতকারী), মানসুখ (রহিত), ইজমা (মতৈক্য) সংঘটিত হওয়ার স্থান সম্পর্কে জানা থাকা। যাতে করে সে মানসুখ বিধান বা ইজমা-বিরোধী বিধান অনুযায়ী ফায়সালা দিয়ে না দেয়।
৪. দলিলসমূহ থেকে যার কারণে বিধান ভিন্নতর হয় তথা খাসকরণ (নির্দিষ্টকরণ), মুকাইয়্যাদকরণ (শর্তযুক্তকরণ) প্রভৃতি সম্পর্কে জানা থাকা। যাতে করে সে এগুলোর বিরোধী বিষয়ের দ্বারা ফায়সালা না দেয়।
৫. ভাষা ও ফিকহের মূলনীতি থেকে যা কিছু শব্দের মর্মার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট তা জানা থাকা। যেমন: আম (ব্যাপক), খাস (নির্দিষ্ট), মুতলাক (শর্তহীন), মুকাইয়্যাদ (শর্তযুক্ত), মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), মুবাইয়্যান (বিস্তৃত) প্রভৃতি। যাতে করে সে ওই মর্মার্থের দাবি অনুযায়ী ফায়সালা দেয়।
৬. তার কাছে এমন সক্ষমতা থাকা, যার দ্বারা সে দলিল থেকে (শরিয়তের) বিধান উদ্ঘাটন করতে পারে।” [ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ, আল-উসুল মিন ইলমিল উসুল; পৃষ্ঠা: ৮৫-৮৬; দারু ইবনিল জাওজি (দাম্মাম) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৬ হিজরি]
এজন্য সাধারণ মানুষ হিসেবে এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা জরুরি। শরিয়তের বিধান কোনো ছেলেখেলা নয় যে, যার তার নিকট থেকে শরিয়তের জ্ঞান নেওয়া যাবে। বরং সত্যিকারের মুজতাহিদ বিদ্বানের নিকট থেকে আমাদের শরিয়তের হুকুম-আহকাম জেনে নেওয়া উচিত, যাতে আবু ত্বহা আদনানের মতো বক্তারা আমাদের বিভ্রান্ত করতে না পারে। আমাদের মনে রাখা দরকার, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেছেন, الناس في حقائق الإيمان متفاضلون تفاضلا عظيما، فأهل الطبقة العليا يعلمون حال أهل السفلى من غير عكس، كما أن أهل الجنة في الجنة ينزل الأعلى إلى الأسفل، ولا يصعد الأسفل إلى الأعلى، والعالم يعرف الجاهل؛ لأنه كان جاهلا والجاهل لا يعرف العالم لأنه لم يكن عالماً “ইমানের প্রকৃতত্বের ক্ষেত্রে মানুষ বিশাল (মর্যাদাগত) পার্থক্যে শ্রেষ্ঠত্বের হকদার। সর্বোচ্চ স্তরের অধিবাসীরা বৈপরীত্য ব্যতিরেকে নিচের স্তরের অধিবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে জানে। যেমনভাবে জান্নাতে জান্নাতবাসীদের মধ্যে উঁচু স্তরের অধিবাসী নিচু স্তরের অধিবাসীর নিকট নামতে পারবে, কিন্তু নিচু স্তরের অধিবাসী উঁচু স্তরের অধিবাসীর নিকট উঠতে পারবে না। একজন আলিম জাহিলকে চিনতে পারেন, কেননা তিনি একসময় জাহিল ছিলেন। কিন্তু জাহিল আলিমকে চিনতে পারে না, কারণ সে কখনো আলিম ছিল না।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ২৩৫; কিং ফাহাদ গ্লোরিয়াস কুরআন ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.]
সুতরাং হকপ্রত্যাশী ভাই ও বোনদের বলব, আপনারা দিন শেখার জন্য বড়ো বড়ো উলামাদের সাহায্য নিন, যাঁদের অটলতা, সততা ও জ্ঞান সর্বজনবিদিত। তাঁদের বিপরীত পথে অবস্থানরত বক্তা ও লেখকদের থেকে সাবধান থাকুন। এই নীতি নিয়ে পথ চলতে থাকলে আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য জান্নাতই হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দিন। আমিন।
আবু ত্বহা আদনান যেই কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা কোনো বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়নি, বরং সেটা একান্তই তাঁর মস্তিকপ্রসূত। আসুন, আমরা সরাসরি নবিজির কথা থেকে জেনে নিই, অধিকাংশ নারী জাহান্নামে থাকার প্রকৃত কারণ। সাহাবি আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي أَضْحًى ـ أَوْ فِطْرٍ ـ إِلَى الْمُصَلَّى، فَمَرَّ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ : يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ، فَإِنِّي أُرِيتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ. فَقُلْنَ وَبِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ : تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ، وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ “একবার ইদুল আজহা অথবা ইদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মহিলাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘হে নারী-সম্প্রদায়, তোমরা সদাকা করতে থাক। কারণ আমাকে দেখানো হয়েছে, জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমাদের সংখ্যাই অধিক।’ তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কারণে, হে আল্লাহর রসুল?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা অধিক পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাক, আর স্বামীর অকৃতজ্ঞতা করে থাক’।” [সহিহুল বুখারি, হা: ৩০৪; সহিহ মুসলিম, হা: ৭৯, ৮০]
উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করার পর ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি.) মন্তব্য করেছেন, فبين النبي- صلى الله عليه وسلم-أسباب كثرتهن في النار؛ لأنهن يكثرن السب، واللعن، والشتم، ويكفرن العشير، الذي هو الزوج، فصرن بذلك أكثر أهل النار “নারীরা জাহান্নামে বেশি থাকার কারণগুলো নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিলেন। কারণ তারা বেশি পরিমাণে গালিগালাজ ও অভিশাপ দিয়ে থাকে, আর স্বামীর (দয়া-অনুগ্রহের) অকৃতজ্ঞতা করে থাকে। এ কারণে তারা হবে জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী।” [শাইখ ইবনু উসাইমিনের মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িল, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬২; দারুস সুরাইয়্যা (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]
এ থেকে বোঝা গেল, আবু ত্বহা আদনান এ বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এ জাতীয় আরও অনেক ভুল ব্যাখ্যা যে তিনি দিয়ে থাকেন, এর কারণ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি একটি বিষয়কে। বিষয়টি হলো— নিজেদের ইচ্ছামতো কুরআন-সুন্নাহ ব্যাখ্যা করার দরজা খোলা আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি তার একটি বক্তব্যে বলেছেন, “প্রতিটা আয়াতকে নিয়ে গবেষণা করবেন। একটা তাফসির কেন? একটা কথা যখন একটা আয়াত থেকে বলা হয়, সে যে তাফসিরটা পড়ছে, সে তাফসিরে যদি না থাকে, তাহলে বলে, তাফসিরের সাথে মিলতেছে না। কয়টা তাফসির পড়ছেন আপনি, ভাই? শুধু ইবনু কাসির পড়লে সেখানেই সবকিছু থাকে? অন্যান্য তাফসিরগুলো নাই? অনেক স্কলার ছিলেন, যাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন। তাঁরা আয়াতগুলোকে নিয়ে গবেষণা করতেন। আর তাঁরা যদি গবেষণা না করতেন, তাহলে আমরা কেমন করে সালাফ থেকে নিতাম? তাঁরা নিজেদের প্রজ্ঞা খাটিয়ে গবেষণা করেছিলেন বলেই তো আমরা নিতে পারি। তো ওই গবেষণার দরজা কি বন্ধ এখন? ইজতিহাদের দরজাটা কি বন্ধ হয়ে গেছে? ভুলও হতে পারে, সঠিকও হতে পারে। ভুল হলে আমার পক্ষ থেকে আমরা বলব, সঠিক হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে।” [দেখুন: https://youtu.be/EqPfyv8Sjt8 (০:৩২ মিনিট থেকে ১:১৮ মিনিট)]
তার এই কথা শুনে বহু মানুষ ধোঁকা খাবে। ধরুন একজন কাদিয়ানি গবেষক এসে বলল, ‘কুরআন-সুন্নাহ পড়ে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানি একজন সত্য নবি, কুরআন-সুন্নাহয় কোথাও বলা হয়নি কাদিয়ানি মিথ্যা নবি!’ কিংবা একজন ইবনু সিনার মতো কাফির দার্শনিক এসে বলল, ‘কবরের আজাব ও পুনরুত্থানের ব্যাপারে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, এগুলো সব মনে মনে হবে। শারীরিকভাবে পরলৌকিক কোনো কিছু সংঘটিত হবে না!’ অথবা আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকারকারী কোনো সুফি জাহমি এসে বলল, ‘আল্লাহ ওপরে নাই। তিনি সবকিছুর মাঝে বিরাজ করছেন!’ এগুলোও তাদের ব্যাখ্যা। আপনি কি ইজতিহাদের দরজা খোলা আছে বলে জনমানুষের মাঝে এসব ব্যাখ্যা প্রচার করার অনুমতি দিবেন? দেবেন না। কারণ ইজতিহাদ বা গবেষণা করে মত দেওয়া সব বিষয়ে করা জায়েজ নেই। যেসব বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর উলামাদের মধ্যে ইজমা তথা সর্ববাদিসম্মত ঐক্য সংঘটিত হয়েছে, সেসব বিষয়ে ইজতিহাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই এবং উলামাদের সর্ববাদিসম্মত অভিমতের বিপরীতে রায় দেওয়াও জায়েজ নেই। এরকম সর্ববাদিসম্মত বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর বিরোধিতা করার কারণেই ব্যক্তিকে বিদাতি আখ্যা দেওয়া হয়, যেমনটি আমরা সপ্তম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে আলোচনা করেছি।
তবে শরিয়তের কিছু হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিবর্গ ইজতিহাদ করতে পারেন, যেসব বিধানে উলামাদের সর্ববাদিসম্মত অভিমত নেই, কিংবা বিধানগুলো নতুন আগত। নতুন আগত বিষয়াবলিকে ‘মাসায়িলুন নাওয়াযিল তথা নাওয়াযিলের মাসায়েল’ বলা হয়। যেমন ধরুন, করোনার সময় কাতারে বড়ো বড়ো ফাঁকা রেখে জামাতে নামাজ পড়া যাবে কিনা, কিংবা করোনাকালীন ইদের নামাজ বাসায় পড়া যাবে কিনা এগুলো নতুন বিষয়। এসব বিষয়ে প্রাজ্ঞ ফাকিহ বিদ্বানগণ ফতোয়া দিবেন, যাঁদের আসলেই ইজতিহাদ তথা শরিয়ত গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার মতো যোগ্যতা আছে। এটা যে সাধারণ কোনো যোগ্যতা না, সেটা বোঝানোর জন্য ইজতিহাদ করতে কী কলকব্জা আর যোগ্যতা লাগে, সেটা বলে দিচ্ছি। তার আগে বলে রাখি, আমাদের উলামাগণ নাওয়াযিলের মাসায়েলে মত দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করেন।
করোনাকালীন সময়ে বাড়িতে ইদের নামাজ পড়লে তাতে খুতবা দিতে হবে কিনা সে বিষয়ে মদিনার ফাকিহ, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উসুলুল ফিকহ ডিপার্টমেন্টের হায়ার স্টাডিজের সিনিয়র প্রফেসর এবং মসজিদে কুবার ইমাম ও খতিব আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ বলেছিলেন, “পূর্ববর্তীগণের বক্তব্য হচ্ছে, খুতবা দিবে না। কিন্তু তাঁদের এ কথা সে অবস্থার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যখন ইমাম খুতবা দেয়। পক্ষান্তরে যখন জামাত-সহকারে ইদের নামাজ কায়েম করা হয় না, তখন কী করতে হবে তা নিয়ে আমি আমাদের উলামাদের মত এখন অবধি জানতে পারিনি। আমরা এমন কোনো কথা বলব না, যে ব্যাপারে আমাদের উলামাদের মধ্য থেকে আমাদের কোনো ইমাম নেই। সুতরাং এই মাসআলাহ গবেষণার দাবি রাখে।” [দেখুন: শাইখের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টের ৭ই মে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের টুইট]
আর তাইতো ইজতিহাদের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। স্রেফ ইজতিহাদের যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদই ইজতিহাদ করতে পারবেন, সাধারণ মানুষ ইজতিহাদ করবে না, চাইলে করতে পারবেও না। ইজতিহাদ করার জন্য বেশ কিছু শর্ত আছে, যে শর্তগুলো পূরণ হলে একজন ব্যক্তি মুজতাহিদ হতে পারেন। যার মধ্যে ইজতিহাদের একটি শর্তেরও অবিদ্যমানতা পাওয়া যাবে, তিনি মুজতাহিদ বলে গণ্য হবেন না।
ইমাম বাগাবি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৫১৬ হি.) বলেন—
“যে ব্যক্তি (নিজের মধ্যে) পাঁচ প্রকার ইলম একত্র করেছেন তিনি মুজতাহিদ। ইলমগুলো হলো: আল্লাহর কিতাবের ইলম, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ইলম, উলামায়ে সালাফের ইজমা (মতৈক্য) ও ইখতিলাফের (মতানৈক্য) ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্যসমূহের ইলম, ভাষার ইলম এবং কিয়াসের ইলম। এটা হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে (আল্লাহর) বিধান উদ্ঘাটন করার পদ্ধতি। যখন তিনি কুরআন, সুন্নাহ, বা ইজমার সুস্পষ্ট বক্তব্যের মধ্যে (আল্লাহর) বিধানকে স্পষ্টভাবে পাবেন না, তখন তাঁর জন্য কুরআন থেকে এই বিষয়গুলো জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে—নাসিখ (রহিতকারী), মানসুখ (রহিত), মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), মুফাসসাল (বিস্তৃত), খাস (নির্দিষ্ট), আম (ব্যাপক), মুহকাম (দ্ব্যর্থহীন), মুতাশাবিহ (দ্ব্যর্থবোধক), মাকরুহ (অপছন্দনীয়), হারাম (নিষিদ্ধ), মুবাহ (বৈধ), মানদুব (পছন্দনীয়), ওয়াজিব (আবশ্যকীয়)। অনুরূপভাবে সুন্নাহ থেকেও এই বিষয়গুলো জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে। তাঁর জন্য সুন্নাহ থেকে সহিহ ও জইফ এবং মুসনাদ ও মুরসাল সম্পর্কে জানা, কুরআনের ওপর সুন্নাহর বিন্যাস এবং সুন্নাহর ওপর কুরআনের বিন্যাস সম্পর্কে জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
যাতে করে তিনি যদি এমন হাদিস পান, যার বাহ্যিক অর্থ কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে হাদিসটির প্রায়োগিক দিকের সন্ধান লাভ করতে পারেন। কেননা সুন্নাহ হলো কুরআনের ব্যাখ্যা, কুরআনের বিরোধী নয়। অবশ্যই তাঁর জন্য শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে যে সুন্নাহ বর্ণিত হয়েছে তা জানা ওয়াজিব; বিধিবিধান ছাড়া এতে যে ঘটনাবলি, খবরাখবর ও উপদেশসমূহ রয়েছে তা এর আওতাভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে কুরআন-সুন্নাহয় বিধিবিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে যে ভাষাবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে জানাও তাঁর জন্য আবশ্যক; আরবদের সমগ্র ভাষা সম্পর্কে জানা এর আওতাভুক্ত নয়। তবে তাঁর জন্য ভাষা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা বাঞ্ছনীয়; যাতে করে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে আরবদের কথা যে উদ্দেশ্যের অর্থ দেয়, সে উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি অবগত হতে পারেন। কেননা (শরিয়তের) সম্বোধন আরবদের ভাষার মাধ্যমেই বর্ণিত হয়েছে; তাই যে ব্যক্তি তা জানে না, সে শরিয়তপ্রণেতার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানবে না।
তাঁর জন্য বিধিবিধানের ক্ষেত্রে সাহাবি ও তাবেয়িগণের বক্তব্যসমূহ জানা এবং উম্মাহর ফাকিহদের অধিকাংশ ফতোয়া জানা আবশ্যক, যাতে করে তাঁর উদ্ঘাটিত বিধান তাঁদের বক্তব্যের বিরোধী না হয়, যার ফলে কোনো বিধানে ইজমা লঙ্ঘিত হয়। যখন তিনি এই প্রত্যেক প্রকার ইলমের অধিকাংশই জানবেন, তখন তিনি মুজতাহিদ হিসেবে গণ্য হবেন। উল্লিখিত প্রত্যেক প্রকার ইলমের সমগ্র অংশ জানাকে শর্ত করা হবে না, তবে কোনো শাস্ত্রের জ্ঞানই অপর্যাপ্ত থাকা যাবে না। যখন কেউ এই প্রকারগুলোর মধ্য থেকে কোনো এক প্রকার ইলম সম্পর্কে জানবে না, তখন তার (অবলম্বন করার) রাস্তাই হলো তাকলিদ।” [ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি রাহিমাহুল্লাহ, ইকদুল জিদ ফি আহকামিল ইজতিহাদি ওয়াত তাকলিদ; পৃষ্ঠা: ২১-২৩; দারুল ফাতহ (শারিকা) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.) বলেছেন—
“ইজতিহাদের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যথা:
১. শরয়ি দলিল থেকে যা তার ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে তা জানা থাকা। যেমন: বিধিবিধানের আয়াত ও হাদীসসমূহ।
২. হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতার সাথে যা সংশ্লিষ্ট তা জানা থাকা। যেমন: সনদ ও তার বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জানা।
৩. নাসিখ (রহিতকারী), মানসুখ (রহিত), ইজমা (মতৈক্য) সংঘটিত হওয়ার স্থান সম্পর্কে জানা থাকা। যাতে করে সে মানসুখ বিধান বা ইজমা-বিরোধী বিধান অনুযায়ী ফায়সালা দিয়ে না দেয়।
৪. দলিলসমূহ থেকে যার কারণে বিধান ভিন্নতর হয় তথা খাসকরণ (নির্দিষ্টকরণ), মুকাইয়্যাদকরণ (শর্তযুক্তকরণ) প্রভৃতি সম্পর্কে জানা থাকা। যাতে করে সে এগুলোর বিরোধী বিষয়ের দ্বারা ফায়সালা না দেয়।
৫. ভাষা ও ফিকহের মূলনীতি থেকে যা কিছু শব্দের মর্মার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট তা জানা থাকা। যেমন: আম (ব্যাপক), খাস (নির্দিষ্ট), মুতলাক (শর্তহীন), মুকাইয়্যাদ (শর্তযুক্ত), মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), মুবাইয়্যান (বিস্তৃত) প্রভৃতি। যাতে করে সে ওই মর্মার্থের দাবি অনুযায়ী ফায়সালা দেয়।
৬. তার কাছে এমন সক্ষমতা থাকা, যার দ্বারা সে দলিল থেকে (শরিয়তের) বিধান উদ্ঘাটন করতে পারে।” [ইমাম ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ, আল-উসুল মিন ইলমিল উসুল; পৃষ্ঠা: ৮৫-৮৬; দারু ইবনিল জাওজি (দাম্মাম) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৬ হিজরি]
এজন্য সাধারণ মানুষ হিসেবে এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা জরুরি। শরিয়তের বিধান কোনো ছেলেখেলা নয় যে, যার তার নিকট থেকে শরিয়তের জ্ঞান নেওয়া যাবে। বরং সত্যিকারের মুজতাহিদ বিদ্বানের নিকট থেকে আমাদের শরিয়তের হুকুম-আহকাম জেনে নেওয়া উচিত, যাতে আবু ত্বহা আদনানের মতো বক্তারা আমাদের বিভ্রান্ত করতে না পারে। আমাদের মনে রাখা দরকার, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেছেন, الناس في حقائق الإيمان متفاضلون تفاضلا عظيما، فأهل الطبقة العليا يعلمون حال أهل السفلى من غير عكس، كما أن أهل الجنة في الجنة ينزل الأعلى إلى الأسفل، ولا يصعد الأسفل إلى الأعلى، والعالم يعرف الجاهل؛ لأنه كان جاهلا والجاهل لا يعرف العالم لأنه لم يكن عالماً “ইমানের প্রকৃতত্বের ক্ষেত্রে মানুষ বিশাল (মর্যাদাগত) পার্থক্যে শ্রেষ্ঠত্বের হকদার। সর্বোচ্চ স্তরের অধিবাসীরা বৈপরীত্য ব্যতিরেকে নিচের স্তরের অধিবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে জানে। যেমনভাবে জান্নাতে জান্নাতবাসীদের মধ্যে উঁচু স্তরের অধিবাসী নিচু স্তরের অধিবাসীর নিকট নামতে পারবে, কিন্তু নিচু স্তরের অধিবাসী উঁচু স্তরের অধিবাসীর নিকট উঠতে পারবে না। একজন আলিম জাহিলকে চিনতে পারেন, কেননা তিনি একসময় জাহিল ছিলেন। কিন্তু জাহিল আলিমকে চিনতে পারে না, কারণ সে কখনো আলিম ছিল না।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ২৩৫; কিং ফাহাদ গ্লোরিয়াস কুরআন ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.]
সুতরাং হকপ্রত্যাশী ভাই ও বোনদের বলব, আপনারা দিন শেখার জন্য বড়ো বড়ো উলামাদের সাহায্য নিন, যাঁদের অটলতা, সততা ও জ্ঞান সর্বজনবিদিত। তাঁদের বিপরীত পথে অবস্থানরত বক্তা ও লেখকদের থেকে সাবধান থাকুন। এই নীতি নিয়ে পথ চলতে থাকলে আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য জান্নাতই হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দিন। আমিন।
লিখেছেন: মুহাম্মাদ আব্দুল্ললাহ মৃধা।