ভূমিকা
সুন্নাত ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা দ্বিতীয় অহী বা অহীয়ে গাইরে মাতলু হিসাবে পরিগণিত। মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য সুন্নাতের জ্ঞান অপরিহার্য। মুসলিম জীবনের মধ্যকার উদ্ভূত নানা সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় হল কুরআন-সুন্নাতর পথনির্দেশ। এ সুন্নাতের মূল সূত্র ও উৎসই হল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁর অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্যের উপরেই সকল কর্ম ও জ্ঞানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক মুসলিমের আক্বীদার মূল ভিত্তিই হল, তার বিশ্বাস ও আক্বীদা যেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মত হয়। অনুরূপভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল কর্মকা-ও যেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মত হয়। সুতরাং জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রে সুন্নাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
‘সুন্নাত’ সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণ জীবনের কোন ক্ষেত্রেই তাঁর পদ্ধতি বা রীতি-নীতির সামান্যতম ব্যতিক্রম করা পসন্দ করতেন না। তাদের পরবর্তী দুই যুগে তাবেঈ ও তাবে‘-তাবেঈগণ সেভাবে সমাজকে পরিপূর্ণ সুন্নাতের উপর পরিচালনা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ, ইসলামের প্রসার, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম গ্রহণ এবং যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, রীতি পদ্ধতি প্রচলিত হতে থাকে। কখনো আবেগের বশবর্তী হয়ে, কখনো ধর্ম পালনে অতি-আগ্রহের কারণে, কখনো অজ্ঞতার ফলে, কখনো পূর্ববর্তী ধর্মের বা সমাজের আচার-অনুষ্ঠানের প্রভাবে এ সকল নতুন ধর্মীয় ও জাগতিক রীতিনীতি সমাজে উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ফলে এমন কিছু অবস্থার অবতারণা হয়েছে, যা কুরআনের বিপরীতে সুন্নাতের অবস্থান নিয়ে সংশয় বা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বলা হচ্ছে যে, ‘কুরআন যা বলে, তা আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে, আর যা কিছু সুন্নাত পাওয়া যায়, তা পালন করাটা উত্তম!’ এমনও শোনা যায় যে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআনে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, ততক্ষণ সেটাকে ফরয বলে মনে করা যাবে না। যদি তা কেবল সুন্নাতে পাওয়া যায়, তবে কেবল এটুকুই বলা যাবে যে, তা পালন করা পসন্দনীয় এবং কারো জন্য সেটা পালন করাটা অবশ্য করণীয় নয়।
সময়ের ব্যবধানে এমন দলেরও উৎপত্তি ঘটেছে, যারা দাবী করে যে, মুসলিমরা সুন্নাত অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে তারা কিছু মানুষকে বোকা বানাতেও সফল হয়েছে। আর সুন্নাতর উপর আধুনিকতাবাদীদের আক্রমণ সম্বন্ধে তো কমবেশী সবারই জানা। মূলত এই আক্রমণের উদ্দেশ্য হল- ইসলামকে তার ব্যবহারিক দিকগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল তাত্ত্বিক পর্যায়ের এক প্রতীকী ধর্মে পরিণত করা। তথাকথিত আধুনিকতার ধ্বজাধারীরা সুন্নাতের পরিচিতির ব্যাপারে অদ্ভুত নীরবতা অবলম্বন করে থাকেন। আসলে এই আধুনিকতা নতুন মোড়কে সুন্নাতের উপর সেই সনাতন আক্রমণের প্রতিচ্ছবি। তফাতটা শুধু এই যে, এখন তার সাথে রয়েছে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আর শিল্প ও প্রযুক্তির ইন্ধন। এমতাবস্থায় মনে হতেই পারে যে, কেবল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার শর্তে, ধর্মকে টিকে থাকতে দিয়ে যেন এক বিশাল দয়া দেখানো হয়েছে। অথচ ইসলাম ও তার রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে এই আধুনিকতা আজ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে বর্তমানে মুসলিম সমাজে সুন্নাত পরিত্যক্ত হয়ে বিদ‘আত শক্ত শিকড় গেড়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ফলে বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মস্তিষ্কপ্রসূত আমল মুসলিম জীবনের সামগ্রিক স্তরে এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, কোন্টি সুন্নাত আর কোন্টি বিদ‘আত তা বুঝার উপায় নেই। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, ‘সুন্নাত’ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট তথ্য এবং ‘সুন্নাত’ শব্দটির ব্যবহারবিধি ব্যক্তির কাছে অ¯পষ্টভাবে উপস্থাপিত হওয়া। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা ‘সুন্নাতের রূপরেখা’ নিয়ে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
‘সুন্নাত’ অর্থ
বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক ও প-িতগণ ‘সুন্নাত’ শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছেন। তারা দ্বীনী জ্ঞানের প্রতিটি শাখা, তার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সবচেয়ে প্রযোজ্য উপায়ে শব্দটির সংজ্ঞা দিয়েছেন এবং সেটিকে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং যদি কেউ ‘সুন্নাত’ সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে, এই দিকটাকে ধর্তব্যে না আনে, তাহলে সার্বিকভাবে সুন্নাতের অবস্থান নির্ণয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হতে পারে। নি¤েœ সুন্নাত-এর রূপরেখা প্রদান করা হল।
اَلسُّنَّةُ -এর আভিধানিক অর্থ:
সুন্নাত (اَلسُّنَّةُ) শব্দটি আরবী। এটি একবচন। বহুবচনে سُنَنٌ।[১] প্রখ্যাত মুফাস্সির ইমাম ফখরুদ্দীন আর-রাজী (মৃ. ৬০৬ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) اَلسُّنَّةُ শব্দের তিনটি উৎপত্তিস্থল উল্লেখ করেছেন। যেমন, প্রথমত : اَلسُّنَّةُ শব্দটি فُعْلَةٌ এর ওযনে مَفْعُوْلَةٌ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর উৎপত্তি হল, আরবদের উক্তি- سَنَّ الْمَاءَ يَسُنُّهُ থেকে। এ কথা তখন বলা হয়, যখন অবিরাম পানি প্রবাহিত করা হয়। আরবরা সরল-সোজা পথকে প্রবাহিত পানির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা পানি প্রবাহিত হওয়ার সময় তার অংশগুলো মিলিত হয়ে একই পথে প্রবাহিত হয়, যেন তা একই বস্তু।[২]
দ্বিতীয়ত : اَلسُّنَّةُ শব্দটি আরবদের উক্তি-
হতে গৃহীত। এ কথা তখন বলা হয়, যখন তরবারী ও দাঁত উত্তমরূপে ঘষামাজা করে ধারালো বা চোখা করা হয়।[৩]
তৃতীয়ত : اَلسُّنَّةُ শব্দটি আরবদের উক্তি- سَنَّ الْإِبِلَ থেকে গৃহীত। এ কথা তখন বলা হয়, যখন ভালভাবে উটকে যতœ করা হয়।[৪]
নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আক্বল বলেন, আরবী ভাষায় اَلسُّنَّةُ শব্দটির উৎপত্তি হল- سَنَّ يَسُنُّ سَنًّا হতে। سَنَّ অর্থ বর্ণনা করা। বলা হয়ে থাকে سَنَّ الْاَمْرَ بَيَّنَهُ ‘বিষয়টিকে বর্ণনা করা হয়েছে’।[৫]
‘সুন্নাত’ শব্দটির প্রয়োগের ভিন্নতার কারণে গবেষক ও প-িতগণ শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে এর কয়েকটি আভিধানিক অর্থ লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
১). اَلسِّيْرَةُ وَالطَّرِيْقَةُ তথা পথ ও পদ্ধতি
‘হুজিইয়্যাতুস সুন্নাত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
‘সুন্নাত শব্দের অর্থ পথ ও পদ্ধতি, তা ভাল হতে পারে বা মন্দও হতে পারে’।[৬] যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি ইসলামে একটি ভাল নিয়ম চালু করল সে এর নেকী পাবে এবং পরবর্তীতে যে সব লোক এ পন্থার অনুসরণ করবে সে তারও একটি নেকী পাবে। আর যে ব্যক্তি ইসলামে একটি মন্দ বা খারাপ নিয়ম চালু করবে সে এর গুনাহ পাবে এবং পরবর্তীতে যত লোক এর অনুসরণ করবে সে তার পাপের একটা অংশ পেতে থাকবে’।[৭] কবি খালিদ বিন উৎবা আল হুযালী এর উক্তি-
‘(হে আবু যুওয়াইব! প্রেমিকার নিকট প্রেরিত দূত হিসাবে বিশ্বাসঘাতকতার) যে পদ্ধতি তুমি চালু করেছিলে, সেই রীতি অনুযায়ী (আজ আমার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য) তুমি পেরেশান হয়ো না। কারণ যে ব্যক্তি এই পদ্ধতি চালু করেছে, সে প্রথমেই এতে রাযী ছিল’।[৮]
উল্লেখিত হাদীস ও পংক্তিতে سُنَّةٌ শব্দটি ‘পথ বা পদ্ধতি’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
অনুরূপভাবে ‘মানযিলাতুস সুন্নাত ফিত তাশরীঈল ইসলামী’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে,
‘ইহা একটি পথ, সেটা প্রশংসিত হতে পারে অথবা মন্দ হতে পারে’।[৯] খাত্ত্বাবী (মৃ. ৩৬১ হি.) বলেন,
‘সুন্নাতের মূল অর্থ হল- প্রশংসনীয় রীতি। যখন (সেটা) সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন (সেটা) উহার (মূলের) দিকে ফিরে যায়। তবে শর্তসাপেক্ষে অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়’।[১০] যেমন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী, وَمَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً ‘আর যে ব্যক্তি ইসলামে একটি মন্দ বা খারাপ নিয়ম চালু করবে’।[১১]
ইমাম কুরতুবী (৬০০-৬৭১ হি./১২০৪-১২৭৩ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَهِيَ الطَّرِيْقُ الْمُسْتَقِيْمُ ‘সুন্নাত হল সহজ-সরল পথ’।[১২] ইমাম শাওকানী (১১৭৩-১২৫০ হি./১৭৫৯-১৮৩৪ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, هِيَ الطَّرِيْقَةُ الْمَسْلُوْكَةُ ‘সুন্নাত হল প্রচলিত পদ্ধতি’।[১৩]
২). اَلْأُمَّةُ তথা গোষ্ঠী, জাতি
ইমাম কুরতুবী (মৃ. ৬৭১ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) মুফায্যল থেকে বর্ণনা করেন, أَنَّهَا الْأُمَّةُ ‘সুন্নাত’-এর অর্থ হল, اَلْأُمَّةُ ‘গোষ্ঠী, জাতি’। তিনি তার কবিতায় বলেছেন,
‘মানুষ নিজেদের সম্মানের মত অন্যের সম্মানে সহযোগিতা করে না এবং পূর্ববর্তী জাতিকে নিজেদের মত করে দেখে না’।[১৪] উল্লিখিত পংক্তিতে سُنَّةٌ শব্দটি ‘গোষ্ঠী বা জাতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩). اَلْإِمَامُ الْمُتَّبَعُ الْمُؤْتَمُّ بِهِ তথা অনুসরণীয় ইমাম
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘সুন্নাত’-এর অর্থ, এমন ইমাম বা নেতা, যার আদর্শ অনুসরণ করা হয়’। ‘মু‘আল্লাক্কা’র বিখ্যাত কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ আল-আমিরী বলেন,
‘(আমার প্রশংসিত গোত্রনেতার এটা কেবল ব্যক্তিগত গুণ নয় বরং) তিনি এমন এক বংশধারা থেকে এসেছেন, যাদের বাপ-দাদারা এই (সুন্দর) অনুসরণীয় আদর্শ চালু করেছিলেন। বস্তুত প্রত্যেক গোত্রেরই নিজস্ব আদর্শ ও অনুসরণীয় ইমাম রয়েছে’।[১৫]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবি হাসসান বিন ছাবিত আনছারী (মৃ. ৫৪ হি.) বনু তামীমের জওয়াবে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বংশের প্রশংসায় বলেন,
‘নিশ্চয় (আরব) নেতৃবৃন্দ ফিহ্র ও তার ভাইদের (অর্থাৎ কুরাইশদের) বংশধর। তারা লোকদের জন্য নিয়ম-নীতি চালু করেছেন, যা অনুসৃত হয়ে থাকে’।[১৬] উমাইয়া যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ‘ফারাযদাক্ব’ বলেন,
‘তিনি এলেন দুই ওমরের রীতির অনুসরণে। যা ছিল সকল রোগ হতে হৃদয়ের আরোগ্য স্বরূপ’।[১৭] অত্র পংক্তিগুলোতে سُنَّةٌ শব্দটি ‘অনুসরণীয় আদর্শ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪). اَلطَّبِيْعَةُ তথা স্বভাব-প্রকৃতি
اَلسُّنَّةُ এর আরেকটি অর্থ হল, اَلطَّبِيْعَةُ তথা স্বভাব-প্রকৃতি। যেমন কবি আল-আশার উক্তি-
‘ঐ ব্যক্তি সম্মানিত, যার আদর্শ সম্ভ্রান্ত প্রকৃতির গোত্র বনু মু‘আবিয়ার মত’।[১৮] এখানে سَنَّةٌ শব্দটি ‘স্বভাব-প্রকৃতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৫). اَلْوَجْهُ তথা চেহারা, রূপ, কপাল ও দুই ভ্রু
اَلسُّنَّةُ দ্বারা, اَلْوَجْهُ তথা ‘চেহারা, রূপ, কপাল ও দুই ভ্রু’ বুঝানো হয়। ইমাম সিবওয়াই বলেন-
‘আকৃতির গঠন যা মুখম-লের আকৃতিকে বুঝানো হয়, এর দ্বারা রূপ উদ্দেশ্য’। কবি যির রুম্মাহ এর উক্তি-
‘তোমার চেহারার রূপ এতই অসুন্দর এবং অমসৃণ, যে তাতে কেউ তোমাকে খেয়াল করে না এবং তোমার জন্য শোকায়িতও হয় না’।[১৯] কবি ছা‘লাব এর উক্তি -
‘রমণীর সৌন্দর্য তার চেহারায়। আর বাড়িতে স্পর্শের জায়গার নীচে সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে’।[২০] উল্লিখিত পংক্তিদ্বয়ে سُنَّةٌ শব্দটি ‘চেহারা, রূপ-সৌন্দর্য, গঠন-আকৃতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৬). اَلْخَطُّ الْأَسْوَدُ তথা কালো দাগ
اَلسُّنَّةُ এর অর্থ, اَلْخَطُّ الْأَسْوَدُ عَلٰى مَتْنِ الْحِمَارِ তথা উটের পিঠের কালো দাগ।
অর্থাৎ ‘মদিনার প্রসিদ্ধ কালো খেজুর’।[২১]
৭). ঘষা-মাজা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা
‘সুন্নাত’ শব্দের আরেকটি অর্থ হল- কোন জিনিসকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করা। যেমন, বলা হয়ে থাকে سَنَّ الشَّئَّ يَسُنُّهُ سَنًّا ‘জিনিসটিকে ঘষে-মেজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা’।[২২]
৮). الدَّوَامُ তথা নিয়মিত অবিরাম, ধারাবাহিকতা, চলমান
ইমাম শাওকানী, কিসাঈ (মৃত ১৮৯ হি.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, مَعْنَاهَا الدَّوَامُ ‘সুন্নাতের অর্থ হল- নিয়মিত, অবিরাম, ধারাবাহিকতা, চলমান’।[২৩] নিয়মিতভাবে কোন কাজ করলে তাকে সুন্নাত বলা হয়। যেমন আরবরা বলে থাকে سَنَنْتُ الْمَاءَ ‘আমি অবিরামভাবে পানি প্রবাহিত করেছি’।[২৪]
৯). البيان তথা বর্ণনা করা
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ মানুষের জন্য সুন্নাত করেছেন অর্থাৎ বর্ণনা করেছেন। ইবনুল মানযূর (৬৩০-৭১১ হি./১২৩২-১৩১১ খ্রি.) বলেছেন,
‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য সুন্নাত করেছেন। অর্থাৎ বর্ণনা করেছেন। আর সুন্নাত হল সীরাত বা এমন পথ ও পদ্ধতি। চাই তা ভাল হোক কিংবা মন্দ হোক’।[২৫]
১০). বলিয়ান ও শক্তি বৃদ্ধি করা
সুন্নাতের আরেকটি অর্থ হল- বলিয়ান করা ও শক্তি বৃদ্ধি করা। আরবরা বলে থাকে, টক উটকে বলিয়ান ও শক্তিশালী করে। যেমন শান দিলে ছুরি ধারাল হয়ে থাকে। বলা হয়, سَنَّ الْحَدِيْدَ سَنَّا ‘সে ছুরিতে শান দিয়ে তার ধার বা শক্তি বাড়িয়েছে’।[২৬]
১১). সুন্নাত অর্থ দাগ
حجَر يُحدَّد بِهِতথা ছুরি ধার করার উদ্দেশ্যে পাথরের উপর বারবার ঘর্ষণের ফলে সেখানে যে দাগ পড়ে যায়, সেটাই ‘সুন্নাত’।[২৭]
১২). اَلْعَادَةُ তথা অভ্যাস।[২৮]
১৩). الْمَسْلُوْكَةُ الْعَامَّةُ তথা সাধারণ রীতি
শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৩৩২-১৪২০ হি./১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘সমাজ জীবনে প্রচলিত সাধারণ রীতিকে সুন্নাত বলা হয়’।[২৯]
এতদ্ব্যতীত আরবদের পরিভাষায় ‘সুন্নাত’ অর্থ এমন রীতি যা ইতিপূর্বে কেউ চালু করেনি। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদের প্রাক্তন ডীন ড. উজাজ আল-খত্বীব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আরবদের পরিভাষা অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে,
‘আমি তোমাদের জন্য একটি রীতি চালু করেছি, তোমরা তা অনুসরণ কর’। (এ কথা ঐ সময় বলা হয়) যখন তুমি এমন কাজ কর, যা তোমার পূর্বে কেউ করেনি।[৩০]
মোট কথা, ‘সুন্নাত’ শাব্দটি- জীবন পদ্ধতি, রাস্তা, পথ, রীতি, ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।[৩১] এমনিভাবে ‘সুন্নাত’ অর্থ আকৃতি রূপরেখা, তরীক্বা। সেখান থেকে এসেছে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কর্ম পদ্ধতি, যা হাদীসের মাধ্যমে শাব্দিক রূপ লাভ করেছে।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল-ক্বাইয়ূমী, আল-মিছবাহুল মুনীর ফী গারীবিশ শারহিল কাবীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩৪৯।
[২]. ফখরুদ্দীন আর রাযী, মাফাতিহুল গাইব (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ৩য় সংস্করণ, ১৪২০ হি.) ৯ম খ-, পৃ. ৩৬৯।
[৩]. মাফাতিহুল গাইব, ৯ম খ-, পৃ. ৩৬৯-৩৭০।
[৪]. প্রাগুক্ত, ৯ম খ-, পৃ. ৩৪০।
[৫]. ড. নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আক্বল, অনুবাদ : মুহাম্মাদ শামাঊন আলী, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পরিচিতি (ঢাকা : ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ১৮।
[৬]. ড. আব্দুল গনী আব্দুল খালেক, হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ (দারুল ওফা-আল মা‘হাদ আল-আলামী লিল ফিকরিল ইসলামী, ১৯৮৭ খ্রি./ ১৪০৭ হি.) পৃ. ৪৫।
[৭]. সহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; নাসাঈ, হা/২৫৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৭৯; মিশকাত, হা/২১০।
[৮]. হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৫।
[৯]. মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিত তাশরীঈল ইসলামী, পৃ. ৭; মুহাম্মাদ আবু যাহূ, আল-হাদীসু ওয়াল মুহাদ্দিছূন (কায়রো : দারুল ফিকরিল আরাবী, ১৩৮৪ হি.), পৃ. ৮।
[১০]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী, ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ‘ইলমিল ঊছূল (দারুল কুতুবিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ১ম খ-, পৃ. ৯৫।
[১১] .সহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; নাসাঈ, হা/২৫৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৭৯; মিশকাত, হা/২১০।
[১২]. আবূ বকর শামসুদ্দীন আল-কুরতুবী, আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন (রিয়ায : দারু ‘আলিমিল কুতুব, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), ৪র্থ খ-, পৃ. ২১৬; মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর (দামেস্ক : দারু ইবনি কাছীর, ১ম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.), ১ম খ-, পৃ. ৪৩৯।
[১৩]. ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ইলমিল ঊছূল, ১ম খ-, পৃ. ৯৫।
[১৪] .আবূ বকর শামসুদ্দীন আল-কুরতুবী, আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন, তাহক্বীক্ব : আহমাদ আল-বারদূনী ও ইবরাহীম আতফীশ (কায়রো : দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ, ৩য় সংস্করণ ১৩৮৪ হি./১৯৬৪ খ্রি.) ৪র্থ খ-, পৃ. ২১৬।
[১৫]. প্রাগুক্ত।
[১৬]. বাহরুল মুহীত্ব, ৯ম খ-, পৃ.৫০৯।
[১৭]. শাইখাহ বিনতে মুর্ফারাজ আল-মুর্ফারাজ, আস-সুন্নাহ আন-নাববীয়্যাহ ওয়াহইয়ুন মিনাল্লাহ মাহফজাতুন কাল কুরআনিল কারীম (মাজমা‘আল মুলুক ফাহদ লি তবা‘আতিল মাসহাফিশ শারীফ বিল মাদিনাতিল মুনাওয়ারাহ্, তা.বি.) পৃ. ৮।
[১৮]. আব্দুল কারীম বিন আলী বিন মুহাম্মাদ, আল-মুহায্যাব ফী ইলমি উছূলিল ফিকহ আল-মুকারান (রিয়ায : মাকতাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.) ২য় খ-, পৃ. ৬৩৪; ফাৎহুল ক্বাদীর (দামেস্ক : দারু ইবনু কাছীর, ১ম সংস্করণ ১৪১৪ হি.) ৩য় খ-, পৃ. ১৫৬।
[১৯]. মুহাম্মাদ বিন মুর্কারাম বিন আলী, লিসানুল আরাব (বৈরূত : দারু ছাদের, ৩য় সংস্করণ, ১৪১৪ হি.) ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৪; ফাৎহুল কাদীর, ৩য় খ-, পৃ. ১৫৬।
[২০]. লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৪।
[২১]. ‘হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ্’, পৃ. ৪৭।
[২২]. আবুল হাসান আল-মুরসী, আল-মুহকামু ওয়াল মুহীতুল আ‘যম (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২১ হি./২০০০ খ্রি.), ৮ম খ-, পৃ. ৪১৬; লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৩; আবুল ফারয আল-হুসায়নী, তাজুল ঊরূসি মিন জাওয়াহিরিল ক্বামূস (দারুল হেদায়াহ, তা.বি.), ৩৫ তম খ-, পৃ. ২২৯।
[২৩] ‘হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ্’, পৃ. ৪৭।
[২৪]. ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ইলমিল ঊছূল, ১ম খ-, পৃ. ৯৫।
[২৫]. আল-মুহকামু ওয়াল মুহীতুল আ‘যম, ৮ম খ-, পৃ. ৪১৭; লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৫।
[২৬]. লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৩।
[২৭]. ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ইলমিল ঊছূল, ১ম খ-, পৃ. ৯৫, লিসানুল আরব, ১৩ তম খ-, পৃঃ ২২৩।
[২৮]. তাক্বীউদ্দীন আবুল আব্বাস আব্দুল হালীম ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১৩ তম খ-, পৃ. ২০।
[২৯]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, আল-হাদীসু হুজ্জিয়াতুন বি নাফসিহি ফিল আক্বাইদ ওয়াল আহকাম (কুয়েত : দারুস সালাফিইয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি.), পৃ. ১৫।
[৩০]. ড. উজাজ আল-খত্বীব, আল-মুখতাছারুল ওয়াজীয (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ১৫।
[৩১]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও তার সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (দারুদ দাওয়াহ, তা.বি.), ১ম খ-, পৃ. ৪৫৬; লিসানুল আরাব, ১৩তম খ-, পৃঃ ২২০।
সুন্নাত ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা দ্বিতীয় অহী বা অহীয়ে গাইরে মাতলু হিসাবে পরিগণিত। মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য সুন্নাতের জ্ঞান অপরিহার্য। মুসলিম জীবনের মধ্যকার উদ্ভূত নানা সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় হল কুরআন-সুন্নাতর পথনির্দেশ। এ সুন্নাতের মূল সূত্র ও উৎসই হল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁর অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্যের উপরেই সকল কর্ম ও জ্ঞানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক মুসলিমের আক্বীদার মূল ভিত্তিই হল, তার বিশ্বাস ও আক্বীদা যেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মত হয়। অনুরূপভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল কর্মকা-ও যেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মত হয়। সুতরাং জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রে সুন্নাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
‘সুন্নাত’ সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণ জীবনের কোন ক্ষেত্রেই তাঁর পদ্ধতি বা রীতি-নীতির সামান্যতম ব্যতিক্রম করা পসন্দ করতেন না। তাদের পরবর্তী দুই যুগে তাবেঈ ও তাবে‘-তাবেঈগণ সেভাবে সমাজকে পরিপূর্ণ সুন্নাতের উপর পরিচালনা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ, ইসলামের প্রসার, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম গ্রহণ এবং যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, রীতি পদ্ধতি প্রচলিত হতে থাকে। কখনো আবেগের বশবর্তী হয়ে, কখনো ধর্ম পালনে অতি-আগ্রহের কারণে, কখনো অজ্ঞতার ফলে, কখনো পূর্ববর্তী ধর্মের বা সমাজের আচার-অনুষ্ঠানের প্রভাবে এ সকল নতুন ধর্মীয় ও জাগতিক রীতিনীতি সমাজে উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ফলে এমন কিছু অবস্থার অবতারণা হয়েছে, যা কুরআনের বিপরীতে সুন্নাতের অবস্থান নিয়ে সংশয় বা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বলা হচ্ছে যে, ‘কুরআন যা বলে, তা আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে, আর যা কিছু সুন্নাত পাওয়া যায়, তা পালন করাটা উত্তম!’ এমনও শোনা যায় যে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআনে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, ততক্ষণ সেটাকে ফরয বলে মনে করা যাবে না। যদি তা কেবল সুন্নাতে পাওয়া যায়, তবে কেবল এটুকুই বলা যাবে যে, তা পালন করা পসন্দনীয় এবং কারো জন্য সেটা পালন করাটা অবশ্য করণীয় নয়।
সময়ের ব্যবধানে এমন দলেরও উৎপত্তি ঘটেছে, যারা দাবী করে যে, মুসলিমরা সুন্নাত অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে তারা কিছু মানুষকে বোকা বানাতেও সফল হয়েছে। আর সুন্নাতর উপর আধুনিকতাবাদীদের আক্রমণ সম্বন্ধে তো কমবেশী সবারই জানা। মূলত এই আক্রমণের উদ্দেশ্য হল- ইসলামকে তার ব্যবহারিক দিকগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল তাত্ত্বিক পর্যায়ের এক প্রতীকী ধর্মে পরিণত করা। তথাকথিত আধুনিকতার ধ্বজাধারীরা সুন্নাতের পরিচিতির ব্যাপারে অদ্ভুত নীরবতা অবলম্বন করে থাকেন। আসলে এই আধুনিকতা নতুন মোড়কে সুন্নাতের উপর সেই সনাতন আক্রমণের প্রতিচ্ছবি। তফাতটা শুধু এই যে, এখন তার সাথে রয়েছে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আর শিল্প ও প্রযুক্তির ইন্ধন। এমতাবস্থায় মনে হতেই পারে যে, কেবল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার শর্তে, ধর্মকে টিকে থাকতে দিয়ে যেন এক বিশাল দয়া দেখানো হয়েছে। অথচ ইসলাম ও তার রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে এই আধুনিকতা আজ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে বর্তমানে মুসলিম সমাজে সুন্নাত পরিত্যক্ত হয়ে বিদ‘আত শক্ত শিকড় গেড়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ফলে বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মস্তিষ্কপ্রসূত আমল মুসলিম জীবনের সামগ্রিক স্তরে এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, কোন্টি সুন্নাত আর কোন্টি বিদ‘আত তা বুঝার উপায় নেই। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, ‘সুন্নাত’ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট তথ্য এবং ‘সুন্নাত’ শব্দটির ব্যবহারবিধি ব্যক্তির কাছে অ¯পষ্টভাবে উপস্থাপিত হওয়া। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা ‘সুন্নাতের রূপরেখা’ নিয়ে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
‘সুন্নাত’ অর্থ
বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক ও প-িতগণ ‘সুন্নাত’ শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছেন। তারা দ্বীনী জ্ঞানের প্রতিটি শাখা, তার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সবচেয়ে প্রযোজ্য উপায়ে শব্দটির সংজ্ঞা দিয়েছেন এবং সেটিকে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং যদি কেউ ‘সুন্নাত’ সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে, এই দিকটাকে ধর্তব্যে না আনে, তাহলে সার্বিকভাবে সুন্নাতের অবস্থান নির্ণয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হতে পারে। নি¤েœ সুন্নাত-এর রূপরেখা প্রদান করা হল।
اَلسُّنَّةُ -এর আভিধানিক অর্থ:
সুন্নাত (اَلسُّنَّةُ) শব্দটি আরবী। এটি একবচন। বহুবচনে سُنَنٌ।[১] প্রখ্যাত মুফাস্সির ইমাম ফখরুদ্দীন আর-রাজী (মৃ. ৬০৬ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) اَلسُّنَّةُ শব্দের তিনটি উৎপত্তিস্থল উল্লেখ করেছেন। যেমন, প্রথমত : اَلسُّنَّةُ শব্দটি فُعْلَةٌ এর ওযনে مَفْعُوْلَةٌ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর উৎপত্তি হল, আরবদের উক্তি- سَنَّ الْمَاءَ يَسُنُّهُ থেকে। এ কথা তখন বলা হয়, যখন অবিরাম পানি প্রবাহিত করা হয়। আরবরা সরল-সোজা পথকে প্রবাহিত পানির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা পানি প্রবাহিত হওয়ার সময় তার অংশগুলো মিলিত হয়ে একই পথে প্রবাহিত হয়, যেন তা একই বস্তু।[২]
দ্বিতীয়ত : اَلسُّنَّةُ শব্দটি আরবদের উক্তি-
سَنَنْتُ النَّصْلَ وَالسِّنَانَ أَسُنُّهُ سَنًّا فَهُوَ مَسْنُوْنٌ
হতে গৃহীত। এ কথা তখন বলা হয়, যখন তরবারী ও দাঁত উত্তমরূপে ঘষামাজা করে ধারালো বা চোখা করা হয়।[৩]
তৃতীয়ত : اَلسُّنَّةُ শব্দটি আরবদের উক্তি- سَنَّ الْإِبِلَ থেকে গৃহীত। এ কথা তখন বলা হয়, যখন ভালভাবে উটকে যতœ করা হয়।[৪]
নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আক্বল বলেন, আরবী ভাষায় اَلسُّنَّةُ শব্দটির উৎপত্তি হল- سَنَّ يَسُنُّ سَنًّا হতে। سَنَّ অর্থ বর্ণনা করা। বলা হয়ে থাকে سَنَّ الْاَمْرَ بَيَّنَهُ ‘বিষয়টিকে বর্ণনা করা হয়েছে’।[৫]
‘সুন্নাত’ শব্দটির প্রয়োগের ভিন্নতার কারণে গবেষক ও প-িতগণ শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে এর কয়েকটি আভিধানিক অর্থ লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
১). اَلسِّيْرَةُ وَالطَّرِيْقَةُ তথা পথ ও পদ্ধতি
‘হুজিইয়্যাতুস সুন্নাত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
اَلسُّنَّةُ السِّيْرَةُ وَالطَّرِيْقَةُ حَسَنَةٌ كَانَتْ أَوْ قَبِيْحَةٌ
‘সুন্নাত শব্দের অর্থ পথ ও পদ্ধতি, তা ভাল হতে পারে বা মন্দও হতে পারে’।[৬] যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ
‘যে ব্যক্তি ইসলামে একটি ভাল নিয়ম চালু করল সে এর নেকী পাবে এবং পরবর্তীতে যে সব লোক এ পন্থার অনুসরণ করবে সে তারও একটি নেকী পাবে। আর যে ব্যক্তি ইসলামে একটি মন্দ বা খারাপ নিয়ম চালু করবে সে এর গুনাহ পাবে এবং পরবর্তীতে যত লোক এর অনুসরণ করবে সে তার পাপের একটা অংশ পেতে থাকবে’।[৭] কবি খালিদ বিন উৎবা আল হুযালী এর উক্তি-
فَلَا تَجْزَعَنْ مِنْ سِيْرَةٍ أَنْتَ سِرْتَهَا + فَأَوَّلُ رَاضٍ سُنَّةً مِّن يَّسِيْرُهَا
‘(হে আবু যুওয়াইব! প্রেমিকার নিকট প্রেরিত দূত হিসাবে বিশ্বাসঘাতকতার) যে পদ্ধতি তুমি চালু করেছিলে, সেই রীতি অনুযায়ী (আজ আমার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য) তুমি পেরেশান হয়ো না। কারণ যে ব্যক্তি এই পদ্ধতি চালু করেছে, সে প্রথমেই এতে রাযী ছিল’।[৮]
উল্লেখিত হাদীস ও পংক্তিতে سُنَّةٌ শব্দটি ‘পথ বা পদ্ধতি’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
অনুরূপভাবে ‘মানযিলাতুস সুন্নাত ফিত তাশরীঈল ইসলামী’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে,
هِيَ الطَّرِيْقَةُ سَوَاءٌ كَانَتْ مَحْمُوْدَةٌ أَوْ سَيِّئَةٌ
‘ইহা একটি পথ, সেটা প্রশংসিত হতে পারে অথবা মন্দ হতে পারে’।[৯] খাত্ত্বাবী (মৃ. ৩৬১ হি.) বলেন,
أَصْلُهَا الطَّرِيْقَةُ الْمَحْمُوْدَةُ فَإِذَا أُطْلِقَتِ انْصَرَفْتَ إِلَيْهَا
‘সুন্নাতের মূল অর্থ হল- প্রশংসনীয় রীতি। যখন (সেটা) সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন (সেটা) উহার (মূলের) দিকে ফিরে যায়। তবে শর্তসাপেক্ষে অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়’।[১০] যেমন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী, وَمَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً ‘আর যে ব্যক্তি ইসলামে একটি মন্দ বা খারাপ নিয়ম চালু করবে’।[১১]
ইমাম কুরতুবী (৬০০-৬৭১ হি./১২০৪-১২৭৩ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَهِيَ الطَّرِيْقُ الْمُسْتَقِيْمُ ‘সুন্নাত হল সহজ-সরল পথ’।[১২] ইমাম শাওকানী (১১৭৩-১২৫০ হি./১৭৫৯-১৮৩৪ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, هِيَ الطَّرِيْقَةُ الْمَسْلُوْكَةُ ‘সুন্নাত হল প্রচলিত পদ্ধতি’।[১৩]
২). اَلْأُمَّةُ তথা গোষ্ঠী, জাতি
ইমাম কুরতুবী (মৃ. ৬৭১ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) মুফায্যল থেকে বর্ণনা করেন, أَنَّهَا الْأُمَّةُ ‘সুন্নাত’-এর অর্থ হল, اَلْأُمَّةُ ‘গোষ্ঠী, জাতি’। তিনি তার কবিতায় বলেছেন,
مَا عَايَنَ النَّاسُ مِنْ فَضْلٍ كَفَضْلِهِمُ + وَلَا رَأَوْا مِثْلَهُمْ فِي سَالِفِ السُّنَنِ
‘মানুষ নিজেদের সম্মানের মত অন্যের সম্মানে সহযোগিতা করে না এবং পূর্ববর্তী জাতিকে নিজেদের মত করে দেখে না’।[১৪] উল্লিখিত পংক্তিতে سُنَّةٌ শব্দটি ‘গোষ্ঠী বা জাতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩). اَلْإِمَامُ الْمُتَّبَعُ الْمُؤْتَمُّ بِهِ তথা অনুসরণীয় ইমাম
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
اَلسُّنَّةُ الْإِمَامُ الْمُتَّبَعُ الْمُؤْتَمُّ بِهِ
‘সুন্নাত’-এর অর্থ, এমন ইমাম বা নেতা, যার আদর্শ অনুসরণ করা হয়’। ‘মু‘আল্লাক্কা’র বিখ্যাত কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ আল-আমিরী বলেন,
مِنْ مَعْشَرٍ سَنَّتْ لَهُمْ آبَاؤُهُمْ ... وَلِكُلِّ قَوْمٍ سُنَّةٌ وَإِمَامُهَا
‘(আমার প্রশংসিত গোত্রনেতার এটা কেবল ব্যক্তিগত গুণ নয় বরং) তিনি এমন এক বংশধারা থেকে এসেছেন, যাদের বাপ-দাদারা এই (সুন্দর) অনুসরণীয় আদর্শ চালু করেছিলেন। বস্তুত প্রত্যেক গোত্রেরই নিজস্ব আদর্শ ও অনুসরণীয় ইমাম রয়েছে’।[১৫]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবি হাসসান বিন ছাবিত আনছারী (মৃ. ৫৪ হি.) বনু তামীমের জওয়াবে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বংশের প্রশংসায় বলেন,
إِنَّ الذَّوَائِبَ مِنْ فِهْرٍ وَإِخْوَتِهِمْ + قَدْ شَرَعُوْا سُنَّةً لِلنَّاسِ تُتَّبَعُ
‘নিশ্চয় (আরব) নেতৃবৃন্দ ফিহ্র ও তার ভাইদের (অর্থাৎ কুরাইশদের) বংশধর। তারা লোকদের জন্য নিয়ম-নীতি চালু করেছেন, যা অনুসৃত হয়ে থাকে’।[১৬] উমাইয়া যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ‘ফারাযদাক্ব’ বলেন,
فَجَاءَ بِسُنَّةِ الْعُمَرَيْنِ فِيْهَا + شِفَاءً لِلصُّدُوْرِ مِنْ السَّقَامِ
‘তিনি এলেন দুই ওমরের রীতির অনুসরণে। যা ছিল সকল রোগ হতে হৃদয়ের আরোগ্য স্বরূপ’।[১৭] অত্র পংক্তিগুলোতে سُنَّةٌ শব্দটি ‘অনুসরণীয় আদর্শ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪). اَلطَّبِيْعَةُ তথা স্বভাব-প্রকৃতি
اَلسُّنَّةُ এর আরেকটি অর্থ হল, اَلطَّبِيْعَةُ তথা স্বভাব-প্রকৃতি। যেমন কবি আল-আশার উক্তি-
كَريْمًا شَمَائِلُهُ مِنْ بَنِي + مُعَاوِيَةَ الْأَكْرَمِيْنَ السُّنَنْ
‘ঐ ব্যক্তি সম্মানিত, যার আদর্শ সম্ভ্রান্ত প্রকৃতির গোত্র বনু মু‘আবিয়ার মত’।[১৮] এখানে سَنَّةٌ শব্দটি ‘স্বভাব-প্রকৃতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৫). اَلْوَجْهُ তথা চেহারা, রূপ, কপাল ও দুই ভ্রু
اَلسُّنَّةُ দ্বারা, اَلْوَجْهُ তথা ‘চেহারা, রূপ, কপাল ও দুই ভ্রু’ বুঝানো হয়। ইমাম সিবওয়াই বলেন-
اَلْمَسْنُوْنُ الْمُصَوَّرُ مَأْخُوْذٌ مِنْ سُنَّةِ الْوَجْهِ وَهِيَ صُوْرَتُهُ
‘আকৃতির গঠন যা মুখম-লের আকৃতিকে বুঝানো হয়, এর দ্বারা রূপ উদ্দেশ্য’। কবি যির রুম্মাহ এর উক্তি-
تُرِيْكَ سُنَّةَ وَجْهٍ غَيْرَ مُقْرِفَةٍ + مَلْسَاءَ لَيْسَ بِهَا خَالٌ وَلَا نَدَبُ
‘তোমার চেহারার রূপ এতই অসুন্দর এবং অমসৃণ, যে তাতে কেউ তোমাকে খেয়াল করে না এবং তোমার জন্য শোকায়িতও হয় না’।[১৯] কবি ছা‘লাব এর উক্তি -
بَيْضَاءُ فِي المِرْآةِ سُنَّتُهَا + فِي الْبَيْتِ تَحْتَ مَواضعِ اللَّمْسِ
‘রমণীর সৌন্দর্য তার চেহারায়। আর বাড়িতে স্পর্শের জায়গার নীচে সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে’।[২০] উল্লিখিত পংক্তিদ্বয়ে سُنَّةٌ শব্দটি ‘চেহারা, রূপ-সৌন্দর্য, গঠন-আকৃতি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৬). اَلْخَطُّ الْأَسْوَدُ তথা কালো দাগ
اَلسُّنَّةُ এর অর্থ, اَلْخَطُّ الْأَسْوَدُ عَلٰى مَتْنِ الْحِمَارِ তথা উটের পিঠের কালো দাগ।
اَلْخَطُّ الْأَسْوَدُ عَلٰى تَمْرٍ بِالْمَدِيْنَةِ مَعْرُوْفٌ
অর্থাৎ ‘মদিনার প্রসিদ্ধ কালো খেজুর’।[২১]
৭). ঘষা-মাজা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা
‘সুন্নাত’ শব্দের আরেকটি অর্থ হল- কোন জিনিসকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করা। যেমন, বলা হয়ে থাকে سَنَّ الشَّئَّ يَسُنُّهُ سَنًّا ‘জিনিসটিকে ঘষে-মেজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা’।[২২]
৮). الدَّوَامُ তথা নিয়মিত অবিরাম, ধারাবাহিকতা, চলমান
ইমাম শাওকানী, কিসাঈ (মৃত ১৮৯ হি.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, مَعْنَاهَا الدَّوَامُ ‘সুন্নাতের অর্থ হল- নিয়মিত, অবিরাম, ধারাবাহিকতা, চলমান’।[২৩] নিয়মিতভাবে কোন কাজ করলে তাকে সুন্নাত বলা হয়। যেমন আরবরা বলে থাকে سَنَنْتُ الْمَاءَ ‘আমি অবিরামভাবে পানি প্রবাহিত করেছি’।[২৪]
৯). البيان তথা বর্ণনা করা
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ মানুষের জন্য সুন্নাত করেছেন অর্থাৎ বর্ণনা করেছেন। ইবনুল মানযূর (৬৩০-৭১১ হি./১২৩২-১৩১১ খ্রি.) বলেছেন,
وَسَنَّهَا اللهُ لِلنَّاسِ بَيَّنَهَا والسُّنَّةُ السِّيْرَةُ حَسَنَةً كَانَتْ أَوْ قَبِيْحَةً
‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য সুন্নাত করেছেন। অর্থাৎ বর্ণনা করেছেন। আর সুন্নাত হল সীরাত বা এমন পথ ও পদ্ধতি। চাই তা ভাল হোক কিংবা মন্দ হোক’।[২৫]
১০). বলিয়ান ও শক্তি বৃদ্ধি করা
সুন্নাতের আরেকটি অর্থ হল- বলিয়ান করা ও শক্তি বৃদ্ধি করা। আরবরা বলে থাকে, টক উটকে বলিয়ান ও শক্তিশালী করে। যেমন শান দিলে ছুরি ধারাল হয়ে থাকে। বলা হয়, سَنَّ الْحَدِيْدَ سَنَّا ‘সে ছুরিতে শান দিয়ে তার ধার বা শক্তি বাড়িয়েছে’।[২৬]
১১). সুন্নাত অর্থ দাগ
حجَر يُحدَّد بِهِতথা ছুরি ধার করার উদ্দেশ্যে পাথরের উপর বারবার ঘর্ষণের ফলে সেখানে যে দাগ পড়ে যায়, সেটাই ‘সুন্নাত’।[২৭]
১২). اَلْعَادَةُ তথা অভ্যাস।[২৮]
১৩). الْمَسْلُوْكَةُ الْعَامَّةُ তথা সাধারণ রীতি
শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৩৩২-১৪২০ হি./১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
اَلطَّرِيْقَةُ الْمَسْلُوْكَةُ وَالْمُعْتَدَةُ فِي الْحَيَاةِ
‘সমাজ জীবনে প্রচলিত সাধারণ রীতিকে সুন্নাত বলা হয়’।[২৯]
এতদ্ব্যতীত আরবদের পরিভাষায় ‘সুন্নাত’ অর্থ এমন রীতি যা ইতিপূর্বে কেউ চালু করেনি। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদের প্রাক্তন ডীন ড. উজাজ আল-খত্বীব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আরবদের পরিভাষা অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে,
سَنَنْتُ لَكُمْ سُنَّةً فَاتَّبِعُوْهَا إِذَا عَمِلْتَ عَمَلًا لَمْ تَسْتَبِقُ إِلَيْهِ
‘আমি তোমাদের জন্য একটি রীতি চালু করেছি, তোমরা তা অনুসরণ কর’। (এ কথা ঐ সময় বলা হয়) যখন তুমি এমন কাজ কর, যা তোমার পূর্বে কেউ করেনি।[৩০]
মোট কথা, ‘সুন্নাত’ শাব্দটি- জীবন পদ্ধতি, রাস্তা, পথ, রীতি, ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।[৩১] এমনিভাবে ‘সুন্নাত’ অর্থ আকৃতি রূপরেখা, তরীক্বা। সেখান থেকে এসেছে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কর্ম পদ্ধতি, যা হাদীসের মাধ্যমে শাব্দিক রূপ লাভ করেছে।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল-ক্বাইয়ূমী, আল-মিছবাহুল মুনীর ফী গারীবিশ শারহিল কাবীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩৪৯।
[২]. ফখরুদ্দীন আর রাযী, মাফাতিহুল গাইব (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ৩য় সংস্করণ, ১৪২০ হি.) ৯ম খ-, পৃ. ৩৬৯।
[৩]. মাফাতিহুল গাইব, ৯ম খ-, পৃ. ৩৬৯-৩৭০।
[৪]. প্রাগুক্ত, ৯ম খ-, পৃ. ৩৪০।
[৫]. ড. নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আক্বল, অনুবাদ : মুহাম্মাদ শামাঊন আলী, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পরিচিতি (ঢাকা : ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ১৮।
[৬]. ড. আব্দুল গনী আব্দুল খালেক, হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ (দারুল ওফা-আল মা‘হাদ আল-আলামী লিল ফিকরিল ইসলামী, ১৯৮৭ খ্রি./ ১৪০৭ হি.) পৃ. ৪৫।
[৭]. সহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; নাসাঈ, হা/২৫৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৭৯; মিশকাত, হা/২১০।
[৮]. হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৫।
[৯]. মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিত তাশরীঈল ইসলামী, পৃ. ৭; মুহাম্মাদ আবু যাহূ, আল-হাদীসু ওয়াল মুহাদ্দিছূন (কায়রো : দারুল ফিকরিল আরাবী, ১৩৮৪ হি.), পৃ. ৮।
[১০]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী, ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ‘ইলমিল ঊছূল (দারুল কুতুবিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ১ম খ-, পৃ. ৯৫।
[১১] .সহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; নাসাঈ, হা/২৫৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৭৯; মিশকাত, হা/২১০।
[১২]. আবূ বকর শামসুদ্দীন আল-কুরতুবী, আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন (রিয়ায : দারু ‘আলিমিল কুতুব, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), ৪র্থ খ-, পৃ. ২১৬; মুহাম্মাদ ইবনু আলী আশ-শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর (দামেস্ক : দারু ইবনি কাছীর, ১ম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.), ১ম খ-, পৃ. ৪৩৯।
[১৩]. ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ইলমিল ঊছূল, ১ম খ-, পৃ. ৯৫।
[১৪] .আবূ বকর শামসুদ্দীন আল-কুরতুবী, আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন, তাহক্বীক্ব : আহমাদ আল-বারদূনী ও ইবরাহীম আতফীশ (কায়রো : দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ, ৩য় সংস্করণ ১৩৮৪ হি./১৯৬৪ খ্রি.) ৪র্থ খ-, পৃ. ২১৬।
[১৫]. প্রাগুক্ত।
[১৬]. বাহরুল মুহীত্ব, ৯ম খ-, পৃ.৫০৯।
[১৭]. শাইখাহ বিনতে মুর্ফারাজ আল-মুর্ফারাজ, আস-সুন্নাহ আন-নাববীয়্যাহ ওয়াহইয়ুন মিনাল্লাহ মাহফজাতুন কাল কুরআনিল কারীম (মাজমা‘আল মুলুক ফাহদ লি তবা‘আতিল মাসহাফিশ শারীফ বিল মাদিনাতিল মুনাওয়ারাহ্, তা.বি.) পৃ. ৮।
[১৮]. আব্দুল কারীম বিন আলী বিন মুহাম্মাদ, আল-মুহায্যাব ফী ইলমি উছূলিল ফিকহ আল-মুকারান (রিয়ায : মাকতাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.) ২য় খ-, পৃ. ৬৩৪; ফাৎহুল ক্বাদীর (দামেস্ক : দারু ইবনু কাছীর, ১ম সংস্করণ ১৪১৪ হি.) ৩য় খ-, পৃ. ১৫৬।
[১৯]. মুহাম্মাদ বিন মুর্কারাম বিন আলী, লিসানুল আরাব (বৈরূত : দারু ছাদের, ৩য় সংস্করণ, ১৪১৪ হি.) ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৪; ফাৎহুল কাদীর, ৩য় খ-, পৃ. ১৫৬।
[২০]. লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৪।
[২১]. ‘হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ্’, পৃ. ৪৭।
[২২]. আবুল হাসান আল-মুরসী, আল-মুহকামু ওয়াল মুহীতুল আ‘যম (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২১ হি./২০০০ খ্রি.), ৮ম খ-, পৃ. ৪১৬; লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৩; আবুল ফারয আল-হুসায়নী, তাজুল ঊরূসি মিন জাওয়াহিরিল ক্বামূস (দারুল হেদায়াহ, তা.বি.), ৩৫ তম খ-, পৃ. ২২৯।
[২৩] ‘হুজিইয়্যাতুস সুন্নাহ্’, পৃ. ৪৭।
[২৪]. ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ইলমিল ঊছূল, ১ম খ-, পৃ. ৯৫।
[২৫]. আল-মুহকামু ওয়াল মুহীতুল আ‘যম, ৮ম খ-, পৃ. ৪১৭; লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৫।
[২৬]. লিসানুল আরাব, ১৩ তম খ-, পৃ. ২২৩।
[২৭]. ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্কি মিন ইলমিল ঊছূল, ১ম খ-, পৃ. ৯৫, লিসানুল আরব, ১৩ তম খ-, পৃঃ ২২৩।
[২৮]. তাক্বীউদ্দীন আবুল আব্বাস আব্দুল হালীম ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১৩ তম খ-, পৃ. ২০।
[২৯]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, আল-হাদীসু হুজ্জিয়াতুন বি নাফসিহি ফিল আক্বাইদ ওয়াল আহকাম (কুয়েত : দারুস সালাফিইয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি.), পৃ. ১৫।
[৩০]. ড. উজাজ আল-খত্বীব, আল-মুখতাছারুল ওয়াজীয (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ১৫।
[৩১]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও তার সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (দারুদ দাওয়াহ, তা.বি.), ১ম খ-, পৃ. ৪৫৬; লিসানুল আরাব, ১৩তম খ-, পৃঃ ২২০।
মাইনুল ইসলাম মঈন
Last edited: