ভূমিকা
ইসলাম প্রত্যেকটি ইবাদতের সঠিক পদ্ধতি বর্ণনার সাথে সাথে তার সুনির্দিষ্ট সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে। হজ্জের মৌসুমে হজ্জ, সিয়ামের মৌসুমে সিয়াম, কুরবানীর সময় কুরবানী ইত্যাদি। সর্বদা নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর আদর্শ ছিল। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ আজ কুরআন-সুন্নাহর ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যা, যঈফ ও জাল হাদীস এবং মাযহাবী গোঁড়ামির কারণে একই সালাত বিভিন্ন সময়ে আদায় করে থাকে। একই স্থানে একই সালাতের আযান পৃথক পৃথক সময়ে হয়। কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো আধা ঘণ্টা আগে-পরে। কোন স্থানে একাধিক মসজিদ থাকলেও আযান ও জামা‘আত এক সঙ্গে হয় না। এভাবে মানুষও দলে দলে বিভক্ত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জামা‘আতে সালাত আদায় করার যে গুরুত্বারোপ করেছেন, তা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। অত্র প্রবন্ধে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সঠিক সময় নিয়ে সমাজে যে বিভ্রান্তি রয়েছে সে বিষয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
বিভ্রান্তির কারণ
আউওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায়ের ব্যাপারে শরী‘আতে যেমন বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, তেমনি এর ব্যাপক ফযীলতের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রকৃত সুন্নাহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিক্হের নামে খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করত আওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় না করে বিলম্বে আদায় করাকেই উত্তম মনে করা হচ্ছে। হানাফী ফিকহ্ গ্রন্থ ‘হেদায়া’-তে বলা হয়েছে,
‘ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে সতর্কতার জন্য সকল সালাতে বিলম্বের নির্দেশ বর্ণিত আছে। কেননা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে (ক্বাযা হলেও) সালাত আদায় জায়েয আছে। কিন্তু সময়ের আগে জাযেয় নেই’।[১] উক্ত দাবী হাদীস বিরোধী। কোন প্রমাণ ছাড়াই ইমামের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অনেক মসজিদে ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বেই আযান দেয়া হয়। এটা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। উক্ত অভ্যাস বর্জন করতে হবে।
আল-কুরআনে বর্ণিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়
সালাতের সময় নির্ধারণের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কয়েকটি আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর আপনি সালাত কায়েম করুন দিবসের দু’প্রান্তে এবং রাতের প্রথম অংশে। নিশ্চয় ভালকাজ মন্দকাজকে মিটিয়ে দেয়। এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ’ (সূরা হূদ : ১১৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বাছরী (২১-১১০ হি./৬৪২-৭২৮ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
‘(দিনের দুই প্রান্তের সালাত হল) ফজর ও আছরের সালাত। (আর রাতের দুই অংশের সালাত হল) মাগরিব, এশার সালাত’।[২] আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘(দিবসের প্রথম প্রান্তে) অর্থাৎ দিবসের প্রথম ও শেষ প্রান্তের সালাত। এই সময়ে প্রবেশ করে ফজরের সালাত এবং দ্বিতীয় প্রান্তে যোহর ও আছরের সালাত। আর রাতের প্রথম অংশে মাগরিব ও এশার সালাত’।[৩]
(খ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘সূর্য হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন এবং ফজরের কুরআন। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৮)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সূর্য ঢলে পড়ার পর প্রথম ওয়াক্তেই যোহেরের সালাত আদায় করুন। এই সময়টা রাতের অন্ধকার শুরু হওয়া পর্যন্ত থাকে। এই সময়ের ভেতর আছর, মাগরিব ও এশা অন্তর্ভুক্ত। আর ফজরের কুরআন অর্থ ফজরের সালাত। সাক্ষী উপস্থিত থাকে অর্থ হল, রাতের ফেরেশতারা ও দিনের ফেরেশতারা সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকে’।[৪]
আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যথাসময়ে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেন। (সূর্য হেলে পড়া) অর্থ দ্বিপ্রহরে সূর্য ঢলার পর তা পূর্ব দিগন্তে ধাবিত হওয়া। এই সময়ের ভেতর যোহর ও আছর অন্তর্ভুক্ত। (রাতের অন্ধকার পর্যন্ত) দ্বারা রাতের আঁধারকে বুঝানো হয়েছে। এই সময়ের ভিতর মাগরিব ও এশা অন্তর্ভুক্ত। আর (ফজরের কুরআন) অর্থ ফজরের সালাত। এ সালাতে অন্য সালাতের তুলনায় দীর্ঘক্ষণ কুরআন পাঠ করার কারণে এবং এ সময়ে কুরআন পাঠের ফযীলত থাকায় একে ফজরের কুরআন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি এ সময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা এবং রাতের ও দিনের ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন’।[৫]
(গ) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
‘সুতরাং এরা যা বলে তার উপর ধৈর্যধারণ করুন এবং তাসবীহ পাঠ করুন আপনার রবের প্রশংসা বর্ণনার মাধ্যমে, সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং তাসবীহ পাঠ করুন রাতের কিছু অংশে ও দিনের প্রান্তসমূহে, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন’ (সূরা ত্বো-হা : ১৩০)।
আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায়ের গুরুত্ব
আল্লাহ তা‘আলা সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে বলেন,
‘নিশ্চয় মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে সালাত ফরয করা হয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১০৩)। হাদীসে এসেছে,
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু ফাযালা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,
‘একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে কিছু বিষয় শিক্ষা দান করেন। তার মধ্যে রয়েছে, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ব্যাপারে যত বান হও। আমি বললাম, এই সময়গুলো আমার জন্য খুব ব্যস্ততার। সুতরাং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাকে নির্দেশ দিন। যখন আমি তা পালন করব, তখন যেন আমার জন্য তা যথেষ্ট হয়। তিনি বললেন, তুমি দুই আছরকে যথাযথভাবে আদায় কর। এই ভাষা আমাদের জানা ছিল না। আমি বললাম, দুই আছর কী? তিনি বললেন, সূর্য উঠার পূর্বের সালাত এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বের সালাত’।[৬]
(খ) আবু ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি আপনার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছি। আর একটি অঙ্গীকার করেছি যে, নিশ্চয় যে ব্যক্তি সেগুলোকে ওয়াক্ত অনুযায়ী যথাযথভাবে আদায় করে উপস্থিত হবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। আর যে সেগুলোকে সংরক্ষণ করবে না, তার জন্য আমার কোন অঙ্গীকার নেই।[৭] উল্লেখ্য যে, উপমহাদেশীয় ছাপা আবূ দাঊদে উক্ত হাদীসটি নেই।
(গ) জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের রবকে অচিরেই দেখতে পাবে, যেভাবে তোমরা এই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাঁকে দেখতে তোমাদের কোন কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। সুতরাং সূর্যোদয়ের পূর্বের সালাত ও সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বের সালাতের প্রতি যত্নশীল হও। অতঃপর তিনি এই আয়াত পড়েন, ‘সুতরাং তোমরা প্রতিপালকের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ কর সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্য ডুবার পরে’ (সূরা ত্বো-হা : ১৩০)।[৮]
[১]. হেদায়া ফী শারহি বিদায়াতুল মুবতাদী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২।
[২]. সাইয়েদ সাবেক, ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৭ টীকা-২ দ্র.।
[৩] আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৩৯১।
[৪]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৭ টীকা-৪ দ্র.।
[৫]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৪৬৪।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৮; হাকিম, হা/৫১; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৮১৩; সহীহুল জামে‘, হা/৩১২২।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৪৩০, সনদ হাসান।
[৮]. সহীহ বুখারী, হা/৫৫৪ (ইফাবা হা/৫২৭, ২/১৭ পৃ.), ‘সালাতের ওয়াক্ত সমূহ’ অধ্যায়-১৩, ‘আছরের সালাতের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৫।
ইসলাম প্রত্যেকটি ইবাদতের সঠিক পদ্ধতি বর্ণনার সাথে সাথে তার সুনির্দিষ্ট সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে। হজ্জের মৌসুমে হজ্জ, সিয়ামের মৌসুমে সিয়াম, কুরবানীর সময় কুরবানী ইত্যাদি। সর্বদা নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর আদর্শ ছিল। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ আজ কুরআন-সুন্নাহর ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যা, যঈফ ও জাল হাদীস এবং মাযহাবী গোঁড়ামির কারণে একই সালাত বিভিন্ন সময়ে আদায় করে থাকে। একই স্থানে একই সালাতের আযান পৃথক পৃথক সময়ে হয়। কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো আধা ঘণ্টা আগে-পরে। কোন স্থানে একাধিক মসজিদ থাকলেও আযান ও জামা‘আত এক সঙ্গে হয় না। এভাবে মানুষও দলে দলে বিভক্ত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জামা‘আতে সালাত আদায় করার যে গুরুত্বারোপ করেছেন, তা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। অত্র প্রবন্ধে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সঠিক সময় নিয়ে সমাজে যে বিভ্রান্তি রয়েছে সে বিষয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
বিভ্রান্তির কারণ
আউওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায়ের ব্যাপারে শরী‘আতে যেমন বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, তেমনি এর ব্যাপক ফযীলতের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রকৃত সুন্নাহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিক্হের নামে খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করত আওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় না করে বিলম্বে আদায় করাকেই উত্তম মনে করা হচ্ছে। হানাফী ফিকহ্ গ্রন্থ ‘হেদায়া’-তে বলা হয়েছে,
عن أبي حنيفة رحمه الله تعالى التأخير في الكل للاحتياط ألا ترى أنه يجوز الأداء بعد الوقت لا قبله
‘ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে সতর্কতার জন্য সকল সালাতে বিলম্বের নির্দেশ বর্ণিত আছে। কেননা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে (ক্বাযা হলেও) সালাত আদায় জায়েয আছে। কিন্তু সময়ের আগে জাযেয় নেই’।[১] উক্ত দাবী হাদীস বিরোধী। কোন প্রমাণ ছাড়াই ইমামের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অনেক মসজিদে ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বেই আযান দেয়া হয়। এটা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। উক্ত অভ্যাস বর্জন করতে হবে।
আল-কুরআনে বর্ণিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়
সালাতের সময় নির্ধারণের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কয়েকটি আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّہَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ اِنَّ الۡحَسَنٰتِ یُذۡہِبۡنَ السَّیِّاٰتِ ذٰلِکَ ذِکۡرٰی لِلذّٰکِرِیۡنَ
‘আর আপনি সালাত কায়েম করুন দিবসের দু’প্রান্তে এবং রাতের প্রথম অংশে। নিশ্চয় ভালকাজ মন্দকাজকে মিটিয়ে দেয়। এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ’ (সূরা হূদ : ১১৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বাছরী (২১-১১০ হি./৬৪২-৭২৮ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّہَارِ) الفجر والعصر و (زُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ) قال هما زلفتان صلاة المغرب وصلاة العشاء)
‘(দিনের দুই প্রান্তের সালাত হল) ফজর ও আছরের সালাত। (আর রাতের দুই অংশের সালাত হল) মাগরিব, এশার সালাত’।[২] আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
طَرَفَیِ النَّہَارِ) أي أوله وآخره ويدخل في هذا صلاة الفجر وصلاتا الظهر والعصر (وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ) ويدخل في ذلك صلاة المغرب والعشاء)
‘(দিবসের প্রথম প্রান্তে) অর্থাৎ দিবসের প্রথম ও শেষ প্রান্তের সালাত। এই সময়ে প্রবেশ করে ফজরের সালাত এবং দ্বিতীয় প্রান্তে যোহর ও আছরের সালাত। আর রাতের প্রথম অংশে মাগরিব ও এশার সালাত’।[৩]
(খ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِدُلُوۡکِ الشَّمۡسِ اِلٰی غَسَقِ الَّیۡلِ وَ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ اِنَّ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ کَانَ مَشۡہُوۡدًا
‘সূর্য হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন এবং ফজরের কুরআন। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৮)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সূর্য ঢলে পড়ার পর প্রথম ওয়াক্তেই যোহেরের সালাত আদায় করুন। এই সময়টা রাতের অন্ধকার শুরু হওয়া পর্যন্ত থাকে। এই সময়ের ভেতর আছর, মাগরিব ও এশা অন্তর্ভুক্ত। আর ফজরের কুরআন অর্থ ফজরের সালাত। সাক্ষী উপস্থিত থাকে অর্থ হল, রাতের ফেরেশতারা ও দিনের ফেরেশতারা সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকে’।[৪]
আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যথাসময়ে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেন। (সূর্য হেলে পড়া) অর্থ দ্বিপ্রহরে সূর্য ঢলার পর তা পূর্ব দিগন্তে ধাবিত হওয়া। এই সময়ের ভেতর যোহর ও আছর অন্তর্ভুক্ত। (রাতের অন্ধকার পর্যন্ত) দ্বারা রাতের আঁধারকে বুঝানো হয়েছে। এই সময়ের ভিতর মাগরিব ও এশা অন্তর্ভুক্ত। আর (ফজরের কুরআন) অর্থ ফজরের সালাত। এ সালাতে অন্য সালাতের তুলনায় দীর্ঘক্ষণ কুরআন পাঠ করার কারণে এবং এ সময়ে কুরআন পাঠের ফযীলত থাকায় একে ফজরের কুরআন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি এ সময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা এবং রাতের ও দিনের ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন’।[৫]
(গ) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
فَاصۡبِرۡ عَلٰی مَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ قَبۡلَ طُلُوۡعِ الشَّمۡسِ وَ قَبۡلَ غُرُوۡبِہَا وَ مِنۡ اٰنَآیِٔ الَّیۡلِ فَسَبِّحۡ وَ اَطۡرَافَ النَّہَارِ لَعَلَّکَ تَرۡضٰی
‘সুতরাং এরা যা বলে তার উপর ধৈর্যধারণ করুন এবং তাসবীহ পাঠ করুন আপনার রবের প্রশংসা বর্ণনার মাধ্যমে, সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং তাসবীহ পাঠ করুন রাতের কিছু অংশে ও দিনের প্রান্তসমূহে, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন’ (সূরা ত্বো-হা : ১৩০)।
আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায়ের গুরুত্ব
আল্লাহ তা‘আলা সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে বলেন,
اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا
‘নিশ্চয় মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে সালাত ফরয করা হয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১০৩)। হাদীসে এসেছে,
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু ফাযালা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,
ألف) عَلَّمَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَكَانَ فِيْمَا عَلَّمَنِىْ وَحَافِظْ عَلَى الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ قَالَ قُلْتُ إِنَّ هَذِهِ سَاعَاتٌ لِىْ فِيْهَا أَشْغَالٌ فَمُرْنِىْ بِأَمْرٍ جَامِعٍ إِذَا أَنَا فَعَلْتُهُ أَجْزَأَ عَنِّىْ فَقَالَ حَافِظْ عَلَى الْعَصْرَيْنِ وَمَا كَانَتْ مِنْ لُغَتِنَا فَقُلْتُ وَمَا الْعَصْرَانِ فَقَالَ صَلاَةٌ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَصَلاَةٌ قَبْلَ غُرُوْبِهَا
‘একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে কিছু বিষয় শিক্ষা দান করেন। তার মধ্যে রয়েছে, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ব্যাপারে যত বান হও। আমি বললাম, এই সময়গুলো আমার জন্য খুব ব্যস্ততার। সুতরাং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাকে নির্দেশ দিন। যখন আমি তা পালন করব, তখন যেন আমার জন্য তা যথেষ্ট হয়। তিনি বললেন, তুমি দুই আছরকে যথাযথভাবে আদায় কর। এই ভাষা আমাদের জানা ছিল না। আমি বললাম, দুই আছর কী? তিনি বললেন, সূর্য উঠার পূর্বের সালাত এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বের সালাত’।[৬]
ب) عَنِ أَبِىْ قَتَادَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ اللهُ تَعَالَى إِنِّىْ فَرَضْتُ عَلَى أُمَّتِكَ خَمْسَ صَلَوَاتٍ وَعَهِدْتُ عِنْدِىْ عَهْدًا أَنَّهُ مَنْ جَاءَ يُحَافِظُ عَلَيْهِنَّ لِوَقْتِهِنَّ أَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَمْ يُحَافِظْ عَلَيْهِنَّ فَلاَ عَهْدَ لَهُ عِنْدِىْ
(খ) আবু ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি আপনার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছি। আর একটি অঙ্গীকার করেছি যে, নিশ্চয় যে ব্যক্তি সেগুলোকে ওয়াক্ত অনুযায়ী যথাযথভাবে আদায় করে উপস্থিত হবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। আর যে সেগুলোকে সংরক্ষণ করবে না, তার জন্য আমার কোন অঙ্গীকার নেই।[৭] উল্লেখ্য যে, উপমহাদেশীয় ছাপা আবূ দাঊদে উক্ত হাদীসটি নেই।
(ج) عَنْ جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رضى الله عنه قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةً يَعْنِى الْبَدْرَ فَقَالَ إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لَا تُضَامُّوْنَ فِىْ رُؤْيَتِهِ فَإِنْ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لَا تُغْلَبُوْا عَلَى صَلَاةٍ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا فَافْعَلُوْا ثُمَّ قَرَأَ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ قَبۡلَ طُلُوۡعِ الشَّمۡسِ وَ قَبۡلَ غُرُوۡبِہَا
(গ) জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের রবকে অচিরেই দেখতে পাবে, যেভাবে তোমরা এই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাঁকে দেখতে তোমাদের কোন কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। সুতরাং সূর্যোদয়ের পূর্বের সালাত ও সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বের সালাতের প্রতি যত্নশীল হও। অতঃপর তিনি এই আয়াত পড়েন, ‘সুতরাং তোমরা প্রতিপালকের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ কর সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্য ডুবার পরে’ (সূরা ত্বো-হা : ১৩০)।[৮]
[১]. হেদায়া ফী শারহি বিদায়াতুল মুবতাদী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২।
[২]. সাইয়েদ সাবেক, ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৭ টীকা-২ দ্র.।
[৩] আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৩৯১।
[৪]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৭ টীকা-৪ দ্র.।
[৫]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৪৬৪।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৮; হাকিম, হা/৫১; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৮১৩; সহীহুল জামে‘, হা/৩১২২।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৪৩০, সনদ হাসান।
[৮]. সহীহ বুখারী, হা/৫৫৪ (ইফাবা হা/৫২৭, ২/১৭ পৃ.), ‘সালাতের ওয়াক্ত সমূহ’ অধ্যায়-১৩, ‘আছরের সালাতের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৫।
মাইনুল ইসলাম মঈন
এম.ফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী
এম.ফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী
Last edited:
