প্রথমত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের অর্থ
১. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই’ এ সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এ বিশ্বাস পোষণ করা ও এ স্বীকৃতি প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই ইবাদাতের উপযুক্ত নয় আর এ বিষয়টি দৃঢ়ভাবে মেনে নেওয়া এবং তদনুযায়ী আমল করা। সুতরাং ‘লা-ইলাহা’ এ কথাটি মূলতঃ আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু রয়েছে সবকিছু থেকে ইবাদাতের অধিকারকে অস্বীকার করার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে। আর ইবাদাত যে শুধুমাত্র আল্লাহরই অধিকার, ‘ইল্লাল্লাহ’ কথাটি সেটি সাব্যস্ত করছে। সংক্ষেপে এ কালেমার অর্থ হচ্ছে: ‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোনো মা‘বুদ নেই’।
এখানে ‘লা’ শব্দটির বিধেয় হিসেবে ‘বিহাক্কীন’ (প্রকৃত) কথাটি উহ্য রয়েছে এবং ‘বেমাওজুদিন’ (অস্তিত্বশীল) শব্দটিকে বিধেয় হিসেবে (উহ্য রয়েছে) উল্লেখ করা জায়েয নয়, কেননা এটা হচ্ছে বাস্তবতার বিপরীত। কারণ আল্লাহ ছাড়া অনেক উপাস্য বাস্তবে অস্তিত্বশীল রয়েছে। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় এসব কিছুর ইবাদাত আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদাতের শামিল। অথচ এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাতিল ও অসত্য বচন। আর এটি হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদীদের অভিমত ও নীতি, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যবিরোধী বলে বিবেচিত। এ কালেমাটির বিভিন্ন বাতিল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে যেমন,
ক. এর অর্থ হলো ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই’, এটা বাতিল। কেননা এ কথাটির অর্থ এই দাঁড়ায় যে, হক্ব ও বাতিল সকল উপাস্যই হচ্ছেন আল্লাহ, যেভাবে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে।
খ. এর অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো স্রষ্টা নেই’। মূলত: এ অর্থটি এ কালেমার মূল অর্থের অংশবিশেষ, যা কালেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা এর দ্বারা শুধুমাত্র তাওহীদুর রুবুবিয়্যাই সাব্যস্ত হয়ে থাকে। অথচ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য এ অংশটুকুই যথেষ্ট নয়। আর মুশরিকগণও এ ধরনের তাওহীদকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
গ. এর অর্থ হলো ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো আইনদাতা হুকুমদাতা নেই’। এটিও এ কালেমার মূল অর্থের অংশ মাত্র যা কালেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা শুধু এতটুকুই যথেষ্ট নয়। কারণ যদি কেউ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয় এবং পাশাপাশি সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে দো‘আ করে অথবা অন্য কারো জন্য কোনো ইবাদাত পালন করে থাকে তাহলে সে তাওহীদবাদী বলে বিবেচিত হবে না।
অতএব, কালেমার এ তিন প্রকারের ব্যাখ্যাই বাতিল অথবা ত্রুটিপূর্ণ। সালাফ ও মুহাক্কিক আলিমদের কাছে এ কালেমার সঠিক ব্যাখ্যা হলো এ কথা বলা যে, “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই”।
২. ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ -এ সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকাশ্যে ও গোপনে এ স্বীকৃতি প্রদান যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও সকল মানুষের কাছে তাঁর প্রেরিত রাসূল। আর এ স্বীকৃতির দাবী অনুযায়ী তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন সে ব্যাপারে তাঁর আনুগত্য করা, তিনি যে সংবাদ দিয়েছেন তাতে তাকে সত্য প্রতিপন্ন করা, তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন তা পরিহার করা এবং তিনি যা প্রচলন করেছেন কেবল সে পন্থায়ই আল্লাহর ইবাদাত করা।
দ্বিতীয়ত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের রুকনসমূহ
ক. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর দু’টো রুকন রয়েছে। একটি হচ্ছে না বাচক, আরেকটি হচ্ছে হ্যাঁ বাচক। প্রথম রুকনটি হচ্ছে না বাচক-‘লা ইলাহা’। এ না বাচক কথাটি সকল শির্ককে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে এবং আল্লাহ ছাড়া আর যত কিছুর ইবাদাত, আরাধনা ও উপাসনা করা হয় সে সকল কিছুর প্রতি অস্বীকৃতিকে অপরিহার্য করেছে। দ্বিতীয় রুকনটি হচ্ছে হ্যাঁ বাচক-‘ইল্লাল্লাহ’। এ রুকনটি দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুই ইবাদাতের হক্বদার ও অধিকারী নয় এবং সে অনুযায়ী আমল করাকে এ রুকন অপরিহার্য করে। এ দুটো অর্থে অনেকগুলো আয়াত আল-কুরআনে এসেছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
“যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে সে সুদৃঢ় রজ্জুকে আঁকড়ে ধরল।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৬] এখানে ‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে’ এটি প্রথম রুকন ‘লা-ইলাহা’ এর অর্থ। আর পরের ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে’ কথাটি দ্বিতীয় রুকন ‘ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ। অনুরূপভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
“নিশ্চয় আমি মুক্ত তোমরা যার ইবাদাত করছো তার থেকে, অবশ্য সেই সত্ত্বা ছাড়া যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৭] “নিশ্চয় আমি মুক্ত” এ কথাটি প্রথম রুকনের না বোধক বক্তব্যের অর্থ এবং “অবশ্য সেই সত্ত্বা ছাড়া যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন” কথাটি দ্বিতীয় রুকনের হাঁ বোধক বক্তব্যের অর্থ।
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল -এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়ার রুকন রয়েছে দু’টো। সেগুলো হলো- তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তিনি আল্লাহর রাসূল। এ দু’টো রুকন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে যে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি অথবা ত্রুটি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কেননা তিনি হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এ দু’টো মর্যাদাপূর্ণ গুণের মধ্য দিয়েই তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে উত্তম ও পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এখানে ‘আল্লাহর বান্দা’ কথাটির অর্থ হচেছ তিনি আল্লাহর অধিনস্থ ও আল্লাহর ইবাদাতকারী অর্থাৎ তিনি আল্লাহরই সৃষ্ট মানুষ এবং মানুষকে যা থেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁকেও তা থেকেই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের ক্ষেত্রে যা যা হয়ে থাকে তার ক্ষেত্রে সে একই বিষয়গুলো হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
“বল, নিশ্চয় আমি তো তোমাদের মতই একজন।” [সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ১১০, সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হক্ব ও দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছিলেন। আল্লাহ সে ব্যাপারে তাঁর প্রশংসাও করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আল্লাহ কি তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)এর জন্য যথেষ্ট নন?” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩৬]
“সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর বান্দার ওপর নাযিল করেছেন গ্রন্থ।” [সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ১]
“সেই সত্ত্বার প্রশংসা ও পবিত্রতা যিনি তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাত্রিকালে মসজিদুল হারাম থেকে ভ্রমণ করিয়েছেন।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১]
আর “রাসূল” অর্থ হচ্ছে সে ব্যক্তি যাকে সকল মানুষের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এ দু’টো গুণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশেষিত করে শাহাদাহ বা সাক্ষ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাকে নিষেধ করা এবং তাঁর বিষয়ে ত্রুটিপূর্ণ আচরণ করাকেও অগ্রাহ্য করা। কেননা তাঁর উম্মতের দাবীদার এমন বহু লোকই তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, এমনকি তাঁকে উবুদিয়াত বা বান্দার স্তর থেকে আল্লাহর পরিবর্তে উপাস্যের স্তরে উপনীত করেছে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর কাছেই তারা সাহায্য প্রার্থনা করেছে। নিজেদের প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে অথবা বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে তাঁর কাছেই তারা প্রার্থনা করেছে, অথচ আল্লাহ ছাড়া তা আর কেউ দিতে পারে না। আবার কেউ কেউ তাঁর রিসালাতকে অস্বীকার করেছে অথবা তাঁকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করার ব্যাপারে যথেষ্ট ত্রুটি দেখিয়েছে এবং তিনি যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন তাঁর বিপরীত কথা ও মতামতের ওপর নির্ভর করেছে। তাঁর বিধান ও তাঁর দেওয়া সংবাদকে ভিন্নার্থে প্রয়োগের অপচেষ্টা তারা করেছে।
তৃতীয়ত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের শর্তসমূহ
[ক] ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শর্তসমূহ:
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে সাতটি শর্ত পূরণ করা অপরিহার্য্য। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাক্ষ্যদানকারী এ সাতটি শর্ত একসাথে পূরণ না করলে তার এ বাণী উচ্চারণ তার কোনো উপকারে আসবে না। এ সাতটি শর্ত হচ্ছে নিম্নরূপ:
[১] এ ব্যাপারে এমন জ্ঞান থাকা যা সকল অজ্ঞতাকে দূর করে।
[২] এ বাণীর প্রতি এমন দৃঢ় প্রত্যয় থাকা যা যে কোনো সন্দেহকে অপনোদন করে।
[৩] সর্বান্তকরণে এ বাণীকে মেনে নেয়া এবং কোনো ধরনের প্রত্যাখ্যান না করা।
[৪] এ বাণীর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রদর্শন এবং কোনোভাবেই আনুগত্য ত্যাগ না করা।
[৫] এমন নিষ্ঠা ও ইখলাস যা সকল প্রকার শির্ককে প্রত্যাখ্যান করে।
[৬] এ বাণীর প্রতি এমন সত্যবাদিতা পোষণ, যা এ বাণীকে যে কোনো ধরনের মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
[৭] এ বাণীর প্রতি এমন ভালোবাসা ও মহব্বত যা এ বাণীর প্রতি যে কোনো ঘৃণাকে দূরীভুত করে।
এ শর্তগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নরূপ:
প্রথম শর্ত: এ বাণীর অর্থ ও উদ্দেশ্য জেনে নেওয়া এবং এ বাণী কী কী সাব্যস্ত করছে আর কোন কোন বিষয়কে অস্বীকার করছে সেটি এমনভাবে জেনে নেওয়া যাতে কোনো ধরনের অজ্ঞতা না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“ঐ ব্যক্তিগণ ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্যিকারভাবে সাক্ষ্য প্রদান করে।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]
‘সাক্ষ্য প্রদান করা’ বলতে এখানে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর প্রতি সাক্ষ্য প্রদান করা বুঝানো হয়েছে। আর ‘জেনে শুনে’ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের বাকযন্ত্রের মাধ্যমে তারা যে সাক্ষ্য প্রদান করেছে অন্তর দিয়ে তারা তা জানে। অতএব, যদি কেউ এ কালেমার অর্থ না জেনে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করে তাহলে এ কালেমা তার কোনো উপকারে আসবে না। কেননা এ কালেমা যে অর্থ বহন করছে সে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে নি।
দ্বিতীয় শর্ত: প্রত্যয় ও বিশ্বাস
এ কালেমা যিনি উচ্চারণ করবেন, এ কালেমার অর্থের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। যদি এ কালেমার অর্থের প্রতি তার কোনো ধরনের সন্দেহ থাকে তাহলে এ কালেমা তার কোনো উপকারে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“নিশ্চয় মুমিন হচ্ছে সে সব লোকেরাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে। তারপর তারা আর কোনো সন্দেহ করে নি।” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১৫]
অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি এ কালেমার প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে পড়ে সে হবে মুনাফিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“এ দেওয়ালের পেছনে যদি তোমরা এমন ব্যক্তির সাক্ষাত পাও যে হৃদয়ে দৃঢ় প্রত্যয় রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোনো ইলাহ নেই তাহলে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।”[1] অতএব, যার অন্তরে এ কালেমার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়নি সে জান্নাতে প্রবেশের অধিকার রাখে না।
তৃতীয় শর্ত: একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা ও তিনি ছাড়া আর সকল কিছুর ইবাদাত ও আরাধনা পরিত্যাগ করার বিষয়ে এ কালেমার যে দাবী তা পরিপূর্ণভাবে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া। অতএব, যে ব্যক্তি এ কালেমা উচ্চারণ করবে অথচ তা মেনে নেবে না এবং এ কালেমা অনুযায়ী চলবে না, সে ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন,
“তাদেরকে আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই বললে তারা অহংকার করত এবং বলত আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের ইলাহগণকে বর্জন করবো?” [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৩৫-৩৬]
আজ কবরপূজারীদের অবস্থাও এরকমই। কেননা তারা বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অথচ তারা কবরের ইবাদাত ও উপাসনাকে পরিত্যাগ করে না। সুতরাং তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর যে অর্থ রয়েছে সে অর্থকে সর্বান্তকরণে গ্রহণকারী নয়।
চতুর্থ শর্ত: এ কালেমার যে অর্থ রয়েছে তার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পোষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“যে কেহ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় সে তো দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক মজবুত হাতল।” [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২]
এখানে ‘মজবুত হাতল’ বলতে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে বুঝানো হয়েছে। আর ‘আত্মসমর্পণ করে’ কথাটির অর্থ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ইখলাস রেখে ও নিষ্ঠাবান হয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে।
পঞ্চম শর্ত: সত্যবাদিতা
এ বাণী যখন কেউ উচ্চারণ করবে, তখন হৃদয় দিয়ে সে এ বাণীকে সত্য প্রতিপন্ন করবে। যদি সে শুধু তার মুখে এ বাণী উচ্চারণ করে অথচ তার হৃদয় এ বাণীর সত্যতা প্রতিপন্ন করল না তাহলে সে হবে মিথ্যাবাদী মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছি, কিন্তু তারা মুমিন নয়। আল্লাহ এবং মুমিনগণকে তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজদের ভিন্ন অন্য কাউকে প্রতারিত করে না তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি; কারণ তারা মিথ্যাবাদী।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮-১০]
ষষ্ঠ শর্ত: ইখলাস বা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা রাখা
এর অর্থ হচ্ছে সকল প্রকার শির্কের উপাদান হতে আমলকে বিশুদ্ধ রাখা। যেমন, এ কালেমার সাক্ষ্য দিয়ে পৃথিবীর কোনো লোভ না করা অথবা লোক দেখানোর জন্যও তা উচ্চারণ না করা কিংবা এ কালেমা উচ্চারণ করে প্রসিদ্ধি অর্জনের ইচ্ছা পোষণ না করা; কেননা উতবান থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন সে ব্যক্তিকে, যে বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোনো ইলাহ নেই এমনভাবে যে, সে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির ইচ্ছাই পোষণ করে।”[2]
সপ্তম শর্ত: এ কালেমার প্রতি, তার অর্থের প্রতি এবং এ কালেমা অনুযায়ী যারা আমল করেন সে সব লোকদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মানুষের মধ্যে এমন একদল লোক রয়েছে যারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন অনেক সমকক্ষ স্থির করে যাদেরকে তারা আল্লাহকে ভালোবাসার মতই ভালোবেসে থাকে। অথচ যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাধিক ভালোবাসে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৬৫]
সুতরাং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর যারা অনুসারী বা প্রবক্তা তারা একনিষ্ঠ ও খালিসভাবে আল্লাহকে মহব্বত করে থাকে। পক্ষান্তরে যারা মুশরিক ও শির্কীতে লিপ্ত তারা আল্লাহকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকেও ভালোবাসে। আর এ বিষয়টি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর যে দাবী রয়েছে তার সাথে সংঘাতপূর্ণ।
[খ] ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দেওয়ার শর্তগুলো হলো নিম্নরূপ:
[১] মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের প্রতি ম্বীকৃতি প্রদান ও গোপনে হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ।
[২] এ শাহাদাত বাণী উচ্চারণ করা ও প্রকাশ্যে মুখে তার স্বীকৃতি দেওয়া।
[৩] ] মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ। তিনি যে সত্য নিয়ে এসেছেন সে সত্য অনুযায়ী আমল করা এবং তিনি যে বাতিল থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তা পরিত্যাগ করা।
[৪] তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের যে গায়েবের ব্যাপারে সংবাদ দিয়েছেন তা সত্য প্রতিপন্ন করা।
[৫] নিজের প্রাণ, সম্পদ, সন্তান, জনক ও সকল মানুষের মহববতের চেয়েও তাঁর প্রতি বেশি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করা।
[৬] তাঁর কথাকে সব ব্যক্তির কথার ওপর প্রাধান্য দেওয়া ও তাঁর সুন্নত অনুযায়ী আমল করা।
চতুর্থত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের চাহিদা বা দাবী
[ক] ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ শাহাদাত বাণীর দাবী হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া আর যত উপাস্য রয়েছে সকল উপাস্যের ইবাদাত, আরাধনা ও পূজা পরিত্যাগ করা। যা ‘লা-ইলাহা’ এ না বোধক কথাটি দ্বারা বুঝা যায়। আর আল্লাহর সাথে কোনো কিছুর শরীক না করে একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা যা ‘ইল্লাল্লাহ’ এ হ্যাঁ বাচক কথাটি দ্বারা বুঝা যায়। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় শাহাদাত বাণী উচ্চারণ করে থাকে এমন বহু লোকই এ শাহাদাত বাণীর দাবীর বিরোধিতা করে থাকে এবং এ ইলাহিয়্যা বা উপাস্য হওয়ার ব্যাপারটিকে তারা সৃষ্টিজগতের কারো কারো জন্য, কবরের জন্য, মাজারের জন্য, তাগুতের জন্য, গাছপালা ও পাথরের জন্য সাব্যস্ত করে থাকে। এদের ধারণা হলো যে তাওহীদ একটি বিদ‘আত এবং তারা ঐসব লোকদের বিরোধিতা করে থাকে যারা তাদেরকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানায়। আর তারা সেসব লোকদের ত্রুটিও বর্ণনা করে থাকে যারা ইবাদাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে।
[খ] ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ শাহাদাত বাণীর দাবী ও চাহিদা হচ্ছে তাঁর আনুগত্য করা, তাকে সত্য প্রতিপন্ন করা, তিনি যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করা এবং তাঁর সুন্নত অনুযায়ী আমলের মধ্যেই সকলে সীমাবদ্ধ থাকা। এছাড়া এর বাইরে যে বিদ‘আত ও অন্যান্য নতুন প্রথাসমূহের প্রচলন রয়েছে তা পরিত্যাগ করা এবং তাঁর কথাকে অন্য সব লোকের কথার ওপর প্রাধান্য দেওয়া।
পঞ্চমত: এ শাহাদাত বাণীদ্বয়কে বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ
এ বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ মূলত ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয় হিসেবেই পরিচিত। কেননা শাহাদাত বাণীদ্বয় এখানে হচ্ছে সে দু’টো বাণী যা উচ্চারণ করে কোনো ব্যক্তি ইসলামে অনুপ্রবেশ করে। এ বাণীদ্বয় উচ্চারণ করার মানে হচ্ছে সেগুলোর অর্থকে মেনে নেওয়া, সেগুলোর দাবী ও চাহিদা অনুযায়ী সব সময় কাজ করতে অভ্যস্ত হওয়া এবং এ বাণীদ্বয়ের চাহিদা অনুযায়ী ইসলামের বড় বড় ইবাদাতগুলো পালনে অভ্যস্ত হওয়া। যদি এ মূলনীতি পালনে কারো ত্রুটি দেখা যায় তাহলে শাহাদাত বাণী উচ্চারণের সময়ে যে প্রতিজ্ঞা সে করেছিল তা ভঙ্গ করে বসল।
ইসলাম ভঙ্গকারী অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। ফকীহ বা ইসলামী আইনবীদগণ ফিকহের গ্রন্থসমূহে এর জন্য একটি বিশেষ অধ্যায় রচনা করেছেন যার নাম তারা দিয়েছেন ‘বাব আর-রিদ্দা’ বা রিদ্দাত অধ্যায়। সেসব ভঙ্গকারী বিষয়গুলো মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো দশটি বিষয় যা শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব রহ. বর্ণনা করেছেন।
[১] আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে শির্ক করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এছাড়া যাকে ইচ্ছা তিনি যে কোনো পাপ ক্ষমা করে দিতে পারেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮, ১১৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
“নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৭২]
এর মধ্যে আরো রয়েছে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে যবেহ করা যেমন মাযারের উদ্দেশ্যে যবেহ করা কিংবা জ্বীনের উদ্দেশ্যে যবেহ করা।
[২] যে ব্যক্তি তার নিজের ও আল্লাহর মাঝখানে মাধ্যম স্থির করে, এরপর সে ঐ মাধ্যমসমূহকে আহ্বান করে, তাদের কাছে দো‘আ করে শাফা‘আত প্রার্থনা করে এবং তাদের ওপর সে তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতা স্থাপন করে। সকল মুসলিম আলিমদের সম্মতিক্রমে সে কাফির হয়ে যাবে।
[৩] যে ব্যক্তি মুশরিকদেরকে কাফির বলে না এবং তারা কাফির হবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে অথবা তাদের মতবাদকে বিশুদ্ধ মনে করে সে কাফির হয়ে যাবে।
[৪] যে ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কারো আদর্শ আরো বেশি পরিপূর্ণ অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম ও বিধানের চেয়ে অন্য কারো হুকুম ও বিধান উত্তম, যেমন ঐসব লোক যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধানের ওপর তাগুতের বিধানকে প্রাধান্য দেয় এবং ইসলামের হুকুমের ওপর অন্যবিধ হুকুমকে প্রাধান্য দেয় তারা কুফুরীর মধ্যে লিপ্ত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন তার কোনো কিছুর প্রতি যে ব্যক্তি ঘৃণা পোষণ করে, নিজে সে আমল করা সত্ত্বেও সে কাফির হয়ে যাবে।
[৬] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীন বা এ দীনের কোনো সাওয়াব বা শাস্তির কোনো কিছুর প্রতি যে ব্যক্তি উপহাস করবে সেও কুফুরী করল। এর ওপর দলীল হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
“তুমি বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি উপহাস করছ? তোমরা কোনো ওজর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানে পরে কুফুরী করেছ।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৫-৬৬]
[৭] জাদু: এর মধ্যে রয়েছে কাউকে কোনো কিছু থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য কিংবা কাউকে কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য জাদু করা। সম্ভবত: এ কথা দুটো দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কোনো ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা পোষণ থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য যে জাদু করা হয় অথবা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর মহব্বত বাড়ানোর জন্য যে জাদু করা হয়। যে ব্যক্তি তা করবে অথবা তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে সে কুফুরী করল। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
“আর এ দুই মালাঈকা কাউকে জাদু শিক্ষা দিত না এ কথা না বলা পর্যন্ত যে, নিশ্চয় আমরা ফিতনা। সুতরাং তোমরা কুফুরী করো না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১০২]
[৮] মুশরিকদের পক্ষপাতিত্ব করা এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা তাদেরই অন্তর্গত বলে বিবেচিত হবে। নিশ্চয় আল্লাহ এমন সত্ত্বাকে হিদায়াত দান করেন না যারা যালিম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫১]
[৯] যে ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, কিছু কিছু লোকের পক্ষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরী‘আত থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনমুতি রয়েছে বা বের হওয়া সম্ভব যেমন মূসা আলাইহিস সাল্লামের শরী‘আত থেকে খিদির বের হয়ে গিয়েছিলেন। যার এ বিশ্বাস হবে সে কাফির বলেই বিবেচিত হবে। একদল গোঁড়া ভন্ড সুফী যেমন বিশ্বাস পোষণ করে যে, তারা এমন এক স্তরে পৌঁছে যায় যে স্তরে পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না।
[১০] আল্লাহর দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। ফলে তাঁর দীনের শিক্ষা গ্রহণ না করা এবং সে শিক্ষা অনুযায়ী আমল না করা। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
“যারা কুফুরী করেছে তারা যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল সে বিষয় থেকে বিমুখ।” [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৩]
আল্লাহ আরো বলেন,
“ঐ ব্যক্তির চাইতে যালিম কে আছে যাকে আল্লাহর আয়াত স্মরণ করিয়ে দিলে তা থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে তার প্রতিশোধ অবশ্যই গ্রহণ করবো।” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ২২]
শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব বলেন, ‘তাওহীদ বিনষ্টকারী এ সব বিষয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, চাই বিনষ্টকারী ব্যক্তি সে হাস্যোচ্ছলেই করুক বা গুরুত্বের সাথেই বলুক কিংবা ভয়ে বলুক। অবশ্য যদি তাকে বাধ্য করা হয় তার ব্যাপারটি ভিন্ন। ইসলাম বিনষ্টকারী এ সকল বিষয়ই বিপদের দিক থেকে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং মানুষের মধ্যে খুব বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই মুসলিমের উচিত হবে এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজের ব্যাপারে এ বিষয়গুলোকে ভয় করে চলা। আমরা আল্লাহর কাছে তাঁর ক্রোধের অগ্নি থেকে এবং তাঁর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে পানাহ চাই’।[3]
[1] হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, হাদীস নং ১৫৬।
[2] হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪২৫, ১১৮৬, ৫৪০১, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫২৮।
[3] মাজমু‘আত-তাওহীদ আন-নাজদিয়াহ পৃ. ৩৭-৩৯।
১. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই’ এ সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এ বিশ্বাস পোষণ করা ও এ স্বীকৃতি প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই ইবাদাতের উপযুক্ত নয় আর এ বিষয়টি দৃঢ়ভাবে মেনে নেওয়া এবং তদনুযায়ী আমল করা। সুতরাং ‘লা-ইলাহা’ এ কথাটি মূলতঃ আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু রয়েছে সবকিছু থেকে ইবাদাতের অধিকারকে অস্বীকার করার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে। আর ইবাদাত যে শুধুমাত্র আল্লাহরই অধিকার, ‘ইল্লাল্লাহ’ কথাটি সেটি সাব্যস্ত করছে। সংক্ষেপে এ কালেমার অর্থ হচ্ছে: ‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোনো মা‘বুদ নেই’।
এখানে ‘লা’ শব্দটির বিধেয় হিসেবে ‘বিহাক্কীন’ (প্রকৃত) কথাটি উহ্য রয়েছে এবং ‘বেমাওজুদিন’ (অস্তিত্বশীল) শব্দটিকে বিধেয় হিসেবে (উহ্য রয়েছে) উল্লেখ করা জায়েয নয়, কেননা এটা হচ্ছে বাস্তবতার বিপরীত। কারণ আল্লাহ ছাড়া অনেক উপাস্য বাস্তবে অস্তিত্বশীল রয়েছে। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় এসব কিছুর ইবাদাত আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদাতের শামিল। অথচ এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাতিল ও অসত্য বচন। আর এটি হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদীদের অভিমত ও নীতি, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যবিরোধী বলে বিবেচিত। এ কালেমাটির বিভিন্ন বাতিল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে যেমন,
ক. এর অর্থ হলো ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই’, এটা বাতিল। কেননা এ কথাটির অর্থ এই দাঁড়ায় যে, হক্ব ও বাতিল সকল উপাস্যই হচ্ছেন আল্লাহ, যেভাবে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে।
খ. এর অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো স্রষ্টা নেই’। মূলত: এ অর্থটি এ কালেমার মূল অর্থের অংশবিশেষ, যা কালেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা এর দ্বারা শুধুমাত্র তাওহীদুর রুবুবিয়্যাই সাব্যস্ত হয়ে থাকে। অথচ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য এ অংশটুকুই যথেষ্ট নয়। আর মুশরিকগণও এ ধরনের তাওহীদকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
গ. এর অর্থ হলো ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো আইনদাতা হুকুমদাতা নেই’। এটিও এ কালেমার মূল অর্থের অংশ মাত্র যা কালেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা শুধু এতটুকুই যথেষ্ট নয়। কারণ যদি কেউ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয় এবং পাশাপাশি সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে দো‘আ করে অথবা অন্য কারো জন্য কোনো ইবাদাত পালন করে থাকে তাহলে সে তাওহীদবাদী বলে বিবেচিত হবে না।
অতএব, কালেমার এ তিন প্রকারের ব্যাখ্যাই বাতিল অথবা ত্রুটিপূর্ণ। সালাফ ও মুহাক্কিক আলিমদের কাছে এ কালেমার সঠিক ব্যাখ্যা হলো এ কথা বলা যে, “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই”।
২. ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ -এ সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকাশ্যে ও গোপনে এ স্বীকৃতি প্রদান যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও সকল মানুষের কাছে তাঁর প্রেরিত রাসূল। আর এ স্বীকৃতির দাবী অনুযায়ী তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন সে ব্যাপারে তাঁর আনুগত্য করা, তিনি যে সংবাদ দিয়েছেন তাতে তাকে সত্য প্রতিপন্ন করা, তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন তা পরিহার করা এবং তিনি যা প্রচলন করেছেন কেবল সে পন্থায়ই আল্লাহর ইবাদাত করা।
দ্বিতীয়ত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের রুকনসমূহ
ক. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর দু’টো রুকন রয়েছে। একটি হচ্ছে না বাচক, আরেকটি হচ্ছে হ্যাঁ বাচক। প্রথম রুকনটি হচ্ছে না বাচক-‘লা ইলাহা’। এ না বাচক কথাটি সকল শির্ককে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে এবং আল্লাহ ছাড়া আর যত কিছুর ইবাদাত, আরাধনা ও উপাসনা করা হয় সে সকল কিছুর প্রতি অস্বীকৃতিকে অপরিহার্য করেছে। দ্বিতীয় রুকনটি হচ্ছে হ্যাঁ বাচক-‘ইল্লাল্লাহ’। এ রুকনটি দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুই ইবাদাতের হক্বদার ও অধিকারী নয় এবং সে অনুযায়ী আমল করাকে এ রুকন অপরিহার্য করে। এ দুটো অর্থে অনেকগুলো আয়াত আল-কুরআনে এসেছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
“যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে সে সুদৃঢ় রজ্জুকে আঁকড়ে ধরল।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৬] এখানে ‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে’ এটি প্রথম রুকন ‘লা-ইলাহা’ এর অর্থ। আর পরের ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে’ কথাটি দ্বিতীয় রুকন ‘ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ। অনুরূপভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي﴾ [الزخرف: ٢٦، ٢٧]
“নিশ্চয় আমি মুক্ত তোমরা যার ইবাদাত করছো তার থেকে, অবশ্য সেই সত্ত্বা ছাড়া যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৭] “নিশ্চয় আমি মুক্ত” এ কথাটি প্রথম রুকনের না বোধক বক্তব্যের অর্থ এবং “অবশ্য সেই সত্ত্বা ছাড়া যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন” কথাটি দ্বিতীয় রুকনের হাঁ বোধক বক্তব্যের অর্থ।
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল -এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়ার রুকন রয়েছে দু’টো। সেগুলো হলো- তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তিনি আল্লাহর রাসূল। এ দু’টো রুকন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে যে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি অথবা ত্রুটি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কেননা তিনি হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এ দু’টো মর্যাদাপূর্ণ গুণের মধ্য দিয়েই তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে উত্তম ও পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এখানে ‘আল্লাহর বান্দা’ কথাটির অর্থ হচেছ তিনি আল্লাহর অধিনস্থ ও আল্লাহর ইবাদাতকারী অর্থাৎ তিনি আল্লাহরই সৃষ্ট মানুষ এবং মানুষকে যা থেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁকেও তা থেকেই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের ক্ষেত্রে যা যা হয়ে থাকে তার ক্ষেত্রে সে একই বিষয়গুলো হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ ﴾ [الكهف: ١١٠، فصلت: ٦]
“বল, নিশ্চয় আমি তো তোমাদের মতই একজন।” [সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ১১০, সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হক্ব ও দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছিলেন। আল্লাহ সে ব্যাপারে তাঁর প্রশংসাও করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَيۡسَ ٱللَّهُ بِكَافٍ عَبۡدَهُۥۖ ﴾
“আল্লাহ কি তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)এর জন্য যথেষ্ট নন?” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩৬]
﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ عَلَىٰ عَبۡدِهِ ٱلۡكِتَٰبَ ﴾ [الكهف: ١]
“সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর বান্দার ওপর নাযিল করেছেন গ্রন্থ।” [সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ১]
﴿سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلٗا مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ ﴾ [الاسراء: ١]
“সেই সত্ত্বার প্রশংসা ও পবিত্রতা যিনি তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাত্রিকালে মসজিদুল হারাম থেকে ভ্রমণ করিয়েছেন।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১]
আর “রাসূল” অর্থ হচ্ছে সে ব্যক্তি যাকে সকল মানুষের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এ দু’টো গুণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশেষিত করে শাহাদাহ বা সাক্ষ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাকে নিষেধ করা এবং তাঁর বিষয়ে ত্রুটিপূর্ণ আচরণ করাকেও অগ্রাহ্য করা। কেননা তাঁর উম্মতের দাবীদার এমন বহু লোকই তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, এমনকি তাঁকে উবুদিয়াত বা বান্দার স্তর থেকে আল্লাহর পরিবর্তে উপাস্যের স্তরে উপনীত করেছে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর কাছেই তারা সাহায্য প্রার্থনা করেছে। নিজেদের প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে অথবা বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে তাঁর কাছেই তারা প্রার্থনা করেছে, অথচ আল্লাহ ছাড়া তা আর কেউ দিতে পারে না। আবার কেউ কেউ তাঁর রিসালাতকে অস্বীকার করেছে অথবা তাঁকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করার ব্যাপারে যথেষ্ট ত্রুটি দেখিয়েছে এবং তিনি যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন তাঁর বিপরীত কথা ও মতামতের ওপর নির্ভর করেছে। তাঁর বিধান ও তাঁর দেওয়া সংবাদকে ভিন্নার্থে প্রয়োগের অপচেষ্টা তারা করেছে।
তৃতীয়ত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের শর্তসমূহ
[ক] ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শর্তসমূহ:
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে সাতটি শর্ত পূরণ করা অপরিহার্য্য। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাক্ষ্যদানকারী এ সাতটি শর্ত একসাথে পূরণ না করলে তার এ বাণী উচ্চারণ তার কোনো উপকারে আসবে না। এ সাতটি শর্ত হচ্ছে নিম্নরূপ:
[১] এ ব্যাপারে এমন জ্ঞান থাকা যা সকল অজ্ঞতাকে দূর করে।
[২] এ বাণীর প্রতি এমন দৃঢ় প্রত্যয় থাকা যা যে কোনো সন্দেহকে অপনোদন করে।
[৩] সর্বান্তকরণে এ বাণীকে মেনে নেয়া এবং কোনো ধরনের প্রত্যাখ্যান না করা।
[৪] এ বাণীর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রদর্শন এবং কোনোভাবেই আনুগত্য ত্যাগ না করা।
[৫] এমন নিষ্ঠা ও ইখলাস যা সকল প্রকার শির্ককে প্রত্যাখ্যান করে।
[৬] এ বাণীর প্রতি এমন সত্যবাদিতা পোষণ, যা এ বাণীকে যে কোনো ধরনের মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
[৭] এ বাণীর প্রতি এমন ভালোবাসা ও মহব্বত যা এ বাণীর প্রতি যে কোনো ঘৃণাকে দূরীভুত করে।
এ শর্তগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নরূপ:
প্রথম শর্ত: এ বাণীর অর্থ ও উদ্দেশ্য জেনে নেওয়া এবং এ বাণী কী কী সাব্যস্ত করছে আর কোন কোন বিষয়কে অস্বীকার করছে সেটি এমনভাবে জেনে নেওয়া যাতে কোনো ধরনের অজ্ঞতা না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦ ﴾ [الزخرف: ٨٦]
“ঐ ব্যক্তিগণ ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্যিকারভাবে সাক্ষ্য প্রদান করে।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]
‘সাক্ষ্য প্রদান করা’ বলতে এখানে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর প্রতি সাক্ষ্য প্রদান করা বুঝানো হয়েছে। আর ‘জেনে শুনে’ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের বাকযন্ত্রের মাধ্যমে তারা যে সাক্ষ্য প্রদান করেছে অন্তর দিয়ে তারা তা জানে। অতএব, যদি কেউ এ কালেমার অর্থ না জেনে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করে তাহলে এ কালেমা তার কোনো উপকারে আসবে না। কেননা এ কালেমা যে অর্থ বহন করছে সে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে নি।
দ্বিতীয় শর্ত: প্রত্যয় ও বিশ্বাস
এ কালেমা যিনি উচ্চারণ করবেন, এ কালেমার অর্থের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। যদি এ কালেমার অর্থের প্রতি তার কোনো ধরনের সন্দেহ থাকে তাহলে এ কালেমা তার কোনো উপকারে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ ﴾ [الحجرات: ١٥]
“নিশ্চয় মুমিন হচ্ছে সে সব লোকেরাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে। তারপর তারা আর কোনো সন্দেহ করে নি।” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১৫]
অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি এ কালেমার প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে পড়ে সে হবে মুনাফিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ لَقِيتَ مِنْ وَرَاءِ هَذَا الْحَائِطِ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ»
“এ দেওয়ালের পেছনে যদি তোমরা এমন ব্যক্তির সাক্ষাত পাও যে হৃদয়ে দৃঢ় প্রত্যয় রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোনো ইলাহ নেই তাহলে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।”[1] অতএব, যার অন্তরে এ কালেমার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়নি সে জান্নাতে প্রবেশের অধিকার রাখে না।
তৃতীয় শর্ত: একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা ও তিনি ছাড়া আর সকল কিছুর ইবাদাত ও আরাধনা পরিত্যাগ করার বিষয়ে এ কালেমার যে দাবী তা পরিপূর্ণভাবে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া। অতএব, যে ব্যক্তি এ কালেমা উচ্চারণ করবে অথচ তা মেনে নেবে না এবং এ কালেমা অনুযায়ী চলবে না, সে ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন,
﴿إِنَّهُمۡ كَانُوٓاْ إِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ يَسۡتَكۡبِرُونَ ٣٥ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦ ﴾ [الصافات: ٣٥، ٣٦]
“তাদেরকে আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই বললে তারা অহংকার করত এবং বলত আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের ইলাহগণকে বর্জন করবো?” [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৩৫-৩৬]
আজ কবরপূজারীদের অবস্থাও এরকমই। কেননা তারা বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অথচ তারা কবরের ইবাদাত ও উপাসনাকে পরিত্যাগ করে না। সুতরাং তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর যে অর্থ রয়েছে সে অর্থকে সর্বান্তকরণে গ্রহণকারী নয়।
চতুর্থ শর্ত: এ কালেমার যে অর্থ রয়েছে তার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পোষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَن يُسۡلِمۡ وَجۡهَهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰۗ ﴾ [لقمان: ٢٢]
“যে কেহ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় সে তো দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক মজবুত হাতল।” [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২]
এখানে ‘মজবুত হাতল’ বলতে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে বুঝানো হয়েছে। আর ‘আত্মসমর্পণ করে’ কথাটির অর্থ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ইখলাস রেখে ও নিষ্ঠাবান হয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে।
পঞ্চম শর্ত: সত্যবাদিতা
এ বাণী যখন কেউ উচ্চারণ করবে, তখন হৃদয় দিয়ে সে এ বাণীকে সত্য প্রতিপন্ন করবে। যদি সে শুধু তার মুখে এ বাণী উচ্চারণ করে অথচ তার হৃদয় এ বাণীর সত্যতা প্রতিপন্ন করল না তাহলে সে হবে মিথ্যাবাদী মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠ ﴾ [البقرة: ٨، ١٠]
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছি, কিন্তু তারা মুমিন নয়। আল্লাহ এবং মুমিনগণকে তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজদের ভিন্ন অন্য কাউকে প্রতারিত করে না তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি; কারণ তারা মিথ্যাবাদী।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮-১০]
ষষ্ঠ শর্ত: ইখলাস বা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা রাখা
এর অর্থ হচ্ছে সকল প্রকার শির্কের উপাদান হতে আমলকে বিশুদ্ধ রাখা। যেমন, এ কালেমার সাক্ষ্য দিয়ে পৃথিবীর কোনো লোভ না করা অথবা লোক দেখানোর জন্যও তা উচ্চারণ না করা কিংবা এ কালেমা উচ্চারণ করে প্রসিদ্ধি অর্জনের ইচ্ছা পোষণ না করা; কেননা উতবান থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَبْتَغِي بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ»
“নিশ্চয় আল্লাহ জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন সে ব্যক্তিকে, যে বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোনো ইলাহ নেই এমনভাবে যে, সে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির ইচ্ছাই পোষণ করে।”[2]
সপ্তম শর্ত: এ কালেমার প্রতি, তার অর্থের প্রতি এবং এ কালেমা অনুযায়ী যারা আমল করেন সে সব লোকদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ ﴾ [البقرة: ١٦٥]
“মানুষের মধ্যে এমন একদল লোক রয়েছে যারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন অনেক সমকক্ষ স্থির করে যাদেরকে তারা আল্লাহকে ভালোবাসার মতই ভালোবেসে থাকে। অথচ যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাধিক ভালোবাসে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৬৫]
সুতরাং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর যারা অনুসারী বা প্রবক্তা তারা একনিষ্ঠ ও খালিসভাবে আল্লাহকে মহব্বত করে থাকে। পক্ষান্তরে যারা মুশরিক ও শির্কীতে লিপ্ত তারা আল্লাহকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকেও ভালোবাসে। আর এ বিষয়টি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর যে দাবী রয়েছে তার সাথে সংঘাতপূর্ণ।
[খ] ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দেওয়ার শর্তগুলো হলো নিম্নরূপ:
[১] মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের প্রতি ম্বীকৃতি প্রদান ও গোপনে হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ।
[২] এ শাহাদাত বাণী উচ্চারণ করা ও প্রকাশ্যে মুখে তার স্বীকৃতি দেওয়া।
[৩] ] মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ। তিনি যে সত্য নিয়ে এসেছেন সে সত্য অনুযায়ী আমল করা এবং তিনি যে বাতিল থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তা পরিত্যাগ করা।
[৪] তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের যে গায়েবের ব্যাপারে সংবাদ দিয়েছেন তা সত্য প্রতিপন্ন করা।
[৫] নিজের প্রাণ, সম্পদ, সন্তান, জনক ও সকল মানুষের মহববতের চেয়েও তাঁর প্রতি বেশি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করা।
[৬] তাঁর কথাকে সব ব্যক্তির কথার ওপর প্রাধান্য দেওয়া ও তাঁর সুন্নত অনুযায়ী আমল করা।
চতুর্থত: শাহাদাত বাণীদ্বয়ের চাহিদা বা দাবী
[ক] ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ শাহাদাত বাণীর দাবী হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া আর যত উপাস্য রয়েছে সকল উপাস্যের ইবাদাত, আরাধনা ও পূজা পরিত্যাগ করা। যা ‘লা-ইলাহা’ এ না বোধক কথাটি দ্বারা বুঝা যায়। আর আল্লাহর সাথে কোনো কিছুর শরীক না করে একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা যা ‘ইল্লাল্লাহ’ এ হ্যাঁ বাচক কথাটি দ্বারা বুঝা যায়। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় শাহাদাত বাণী উচ্চারণ করে থাকে এমন বহু লোকই এ শাহাদাত বাণীর দাবীর বিরোধিতা করে থাকে এবং এ ইলাহিয়্যা বা উপাস্য হওয়ার ব্যাপারটিকে তারা সৃষ্টিজগতের কারো কারো জন্য, কবরের জন্য, মাজারের জন্য, তাগুতের জন্য, গাছপালা ও পাথরের জন্য সাব্যস্ত করে থাকে। এদের ধারণা হলো যে তাওহীদ একটি বিদ‘আত এবং তারা ঐসব লোকদের বিরোধিতা করে থাকে যারা তাদেরকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানায়। আর তারা সেসব লোকদের ত্রুটিও বর্ণনা করে থাকে যারা ইবাদাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে।
[খ] ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ শাহাদাত বাণীর দাবী ও চাহিদা হচ্ছে তাঁর আনুগত্য করা, তাকে সত্য প্রতিপন্ন করা, তিনি যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করা এবং তাঁর সুন্নত অনুযায়ী আমলের মধ্যেই সকলে সীমাবদ্ধ থাকা। এছাড়া এর বাইরে যে বিদ‘আত ও অন্যান্য নতুন প্রথাসমূহের প্রচলন রয়েছে তা পরিত্যাগ করা এবং তাঁর কথাকে অন্য সব লোকের কথার ওপর প্রাধান্য দেওয়া।
পঞ্চমত: এ শাহাদাত বাণীদ্বয়কে বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ
এ বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ মূলত ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয় হিসেবেই পরিচিত। কেননা শাহাদাত বাণীদ্বয় এখানে হচ্ছে সে দু’টো বাণী যা উচ্চারণ করে কোনো ব্যক্তি ইসলামে অনুপ্রবেশ করে। এ বাণীদ্বয় উচ্চারণ করার মানে হচ্ছে সেগুলোর অর্থকে মেনে নেওয়া, সেগুলোর দাবী ও চাহিদা অনুযায়ী সব সময় কাজ করতে অভ্যস্ত হওয়া এবং এ বাণীদ্বয়ের চাহিদা অনুযায়ী ইসলামের বড় বড় ইবাদাতগুলো পালনে অভ্যস্ত হওয়া। যদি এ মূলনীতি পালনে কারো ত্রুটি দেখা যায় তাহলে শাহাদাত বাণী উচ্চারণের সময়ে যে প্রতিজ্ঞা সে করেছিল তা ভঙ্গ করে বসল।
ইসলাম ভঙ্গকারী অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। ফকীহ বা ইসলামী আইনবীদগণ ফিকহের গ্রন্থসমূহে এর জন্য একটি বিশেষ অধ্যায় রচনা করেছেন যার নাম তারা দিয়েছেন ‘বাব আর-রিদ্দা’ বা রিদ্দাত অধ্যায়। সেসব ভঙ্গকারী বিষয়গুলো মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো দশটি বিষয় যা শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব রহ. বর্ণনা করেছেন।
[১] আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে শির্ক করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ ﴾ [النساء: ٤٨]
“নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এছাড়া যাকে ইচ্ছা তিনি যে কোনো পাপ ক্ষমা করে দিতে পারেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮, ১১৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ ٧٢ ﴾ [المائدة: ٧٢]
“নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৭২]
এর মধ্যে আরো রয়েছে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে যবেহ করা যেমন মাযারের উদ্দেশ্যে যবেহ করা কিংবা জ্বীনের উদ্দেশ্যে যবেহ করা।
[২] যে ব্যক্তি তার নিজের ও আল্লাহর মাঝখানে মাধ্যম স্থির করে, এরপর সে ঐ মাধ্যমসমূহকে আহ্বান করে, তাদের কাছে দো‘আ করে শাফা‘আত প্রার্থনা করে এবং তাদের ওপর সে তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতা স্থাপন করে। সকল মুসলিম আলিমদের সম্মতিক্রমে সে কাফির হয়ে যাবে।
[৩] যে ব্যক্তি মুশরিকদেরকে কাফির বলে না এবং তারা কাফির হবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে অথবা তাদের মতবাদকে বিশুদ্ধ মনে করে সে কাফির হয়ে যাবে।
[৪] যে ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কারো আদর্শ আরো বেশি পরিপূর্ণ অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম ও বিধানের চেয়ে অন্য কারো হুকুম ও বিধান উত্তম, যেমন ঐসব লোক যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধানের ওপর তাগুতের বিধানকে প্রাধান্য দেয় এবং ইসলামের হুকুমের ওপর অন্যবিধ হুকুমকে প্রাধান্য দেয় তারা কুফুরীর মধ্যে লিপ্ত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন তার কোনো কিছুর প্রতি যে ব্যক্তি ঘৃণা পোষণ করে, নিজে সে আমল করা সত্ত্বেও সে কাফির হয়ে যাবে।
[৬] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীন বা এ দীনের কোনো সাওয়াব বা শাস্তির কোনো কিছুর প্রতি যে ব্যক্তি উপহাস করবে সেও কুফুরী করল। এর ওপর দলীল হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ﴾ [التوبة: ٦٥، ٦٦]
“তুমি বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি উপহাস করছ? তোমরা কোনো ওজর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানে পরে কুফুরী করেছ।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৫-৬৬]
[৭] জাদু: এর মধ্যে রয়েছে কাউকে কোনো কিছু থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য কিংবা কাউকে কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য জাদু করা। সম্ভবত: এ কথা দুটো দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কোনো ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা পোষণ থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য যে জাদু করা হয় অথবা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর মহব্বত বাড়ানোর জন্য যে জাদু করা হয়। যে ব্যক্তি তা করবে অথবা তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে সে কুফুরী করল। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَا تَكۡفُرۡۖ ﴾ [البقرة: ١٠٢]
“আর এ দুই মালাঈকা কাউকে জাদু শিক্ষা দিত না এ কথা না বলা পর্যন্ত যে, নিশ্চয় আমরা ফিতনা। সুতরাং তোমরা কুফুরী করো না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১০২]
[৮] মুশরিকদের পক্ষপাতিত্ব করা এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَإِنَّهُۥ مِنۡهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥١ ﴾ [المائدة: ٥١]
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা তাদেরই অন্তর্গত বলে বিবেচিত হবে। নিশ্চয় আল্লাহ এমন সত্ত্বাকে হিদায়াত দান করেন না যারা যালিম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫১]
[৯] যে ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, কিছু কিছু লোকের পক্ষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরী‘আত থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনমুতি রয়েছে বা বের হওয়া সম্ভব যেমন মূসা আলাইহিস সাল্লামের শরী‘আত থেকে খিদির বের হয়ে গিয়েছিলেন। যার এ বিশ্বাস হবে সে কাফির বলেই বিবেচিত হবে। একদল গোঁড়া ভন্ড সুফী যেমন বিশ্বাস পোষণ করে যে, তারা এমন এক স্তরে পৌঁছে যায় যে স্তরে পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না।
[১০] আল্লাহর দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। ফলে তাঁর দীনের শিক্ষা গ্রহণ না করা এবং সে শিক্ষা অনুযায়ী আমল না করা। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ عَمَّآ أُنذِرُواْ مُعۡرِضُونَ ٣ ﴾ [الاحقاف: ٣]
“যারা কুফুরী করেছে তারা যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল সে বিষয় থেকে বিমুখ।” [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৩]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بَِٔايَٰتِ رَبِّهِۦ ثُمَّ أَعۡرَضَ عَنۡهَآۚ إِنَّا مِنَ ٱلۡمُجۡرِمِينَ مُنتَقِمُونَ ٢٢ ﴾ [السجدة: ٢٢]
“ঐ ব্যক্তির চাইতে যালিম কে আছে যাকে আল্লাহর আয়াত স্মরণ করিয়ে দিলে তা থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে তার প্রতিশোধ অবশ্যই গ্রহণ করবো।” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ২২]
শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব বলেন, ‘তাওহীদ বিনষ্টকারী এ সব বিষয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, চাই বিনষ্টকারী ব্যক্তি সে হাস্যোচ্ছলেই করুক বা গুরুত্বের সাথেই বলুক কিংবা ভয়ে বলুক। অবশ্য যদি তাকে বাধ্য করা হয় তার ব্যাপারটি ভিন্ন। ইসলাম বিনষ্টকারী এ সকল বিষয়ই বিপদের দিক থেকে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং মানুষের মধ্যে খুব বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই মুসলিমের উচিত হবে এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজের ব্যাপারে এ বিষয়গুলোকে ভয় করে চলা। আমরা আল্লাহর কাছে তাঁর ক্রোধের অগ্নি থেকে এবং তাঁর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে পানাহ চাই’।[3]
তাওহীদ পরিচিতি
ড. সালিহ ইবন ফাওযান আল-ফাওযান
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ড. সালিহ ইবন ফাওযান আল-ফাওযান
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
[1] হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, হাদীস নং ১৫৬।
[2] হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪২৫, ১১৮৬, ৫৪০১, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫২৮।
[3] মাজমু‘আত-তাওহীদ আন-নাজদিয়াহ পৃ. ৩৭-৩৯।