- Views: 561
- Replies: 1
ইমাম মোহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহু-তায়ালা)। তিনি হলেন বিগত শতাব্দীর যুগ শ্রেষ্ঠ মুজ্জাদ্দেদ, মুহাদ্দিস, ফ্বকিহ এবং দ্বাই ইলাল্লাহ।
বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। হাদীস গবেষণায় যিনি বর্তমান পৃথিবীতে একজন আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহান ব্যক্তি। ইলম চর্চায় তার জীবনীতে আমাদের প্রেরণার যথেষ্ট খোরাক রয়েছে। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অসীম সাহস, সুদৃঢ় মনোবল আর ইখলাস ভরা প্রত্যয় থাকলে কিভাবে একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সাধারণ ঘড়ির মেকার থেকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদে পরিণত করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন আল্লামা আলাবানী।
পিতার সাথে বিরোধ:
শায়খ আলবানী কট্টর হানাফী পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলবেনীয় ও সার্বীয় আলেমদের মধ্যে হানাফী ফিকহ সম্পর্কে সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম। তাঁর নিকটে সবাই ফৎওয়া নিতে আসত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার। বিশেষতঃ কুরআন-হাদীসের গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তাঁর নিকটে সমকালীন বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্রুটিসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুঁজে পান কুরআন-হাদীসের সাথে বহু মাসআলা-মাসায়েলের যোজন যোজন দূরের ব্যবধান। বিভিন্ন মসজিদে তখন হানাফী এবং শাফেঈদের দু’টি করে জামা‘আত হ’ত। হানাফী জামা‘আতের পর শাফেঈদের জামা‘আত হ’ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিরিয়ায় একজন শাফেঈ শাসক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি হানাফীদের পূর্বে শাফেঈদের ছালাত আদায় করার নির্দেশ জারী করেন। এমতাবস্থায় শায়খ আলবানী দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায়ের কোন দলীল না পেয়ে শাফেঈদের সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা শুরু করলেন।
একদিন হানাফীদের ইমাম শায়খ বুরহানী হজ্জের সফরে গমনের কারণে শায়খ আলবানীর পিতাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন হ’ল যে, শায়খ আলবানী প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করছেন, আর তাঁর পিতা দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করছেন। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ল, যেদিন তাঁর পিতা তার ব্যক্তিগত সফরে যাওয়ার কারণে উপলক্ষে আলবানীকে দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। স্পষ্টভাষী আলবানী স্বীয় পিতাকে বললেন, এ বিষয়ে আপনি আমার মতামত জানেন যে, আমি প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করি। এমতাবস্থায় স্বীয় মত বিরোধী কাজ করা আমার জন্য খুবই কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ তীব্রতর হ’ল। অতঃপর একদিন পিতা তাকে গৃহকোণে ডেকে বললেন, তাহ’লে এটাই কি সত্য যে, তুমি তোমার মাযহাব পরিত্যাগ করেছ? ক্রোধান্বিত পিতার কণ্ঠ ঊঁচু হ’তে লাগল। একপর্যায়ে বললেন, হয় তোমাকে একমত হ’তে হবে, অন্যথায় পৃথক হ’তে হবে। শায়খ আলবানী পিতার নিকট থেকে তিনদিন সময় চেয়ে নিলেন। অবশেষে মাত্র ২৫ সিরীয় লিরা হাতে নিয়ে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিলেন পরবর্তীকালের বিশ্ববিশ্রুত এই মুহাদ্দিছ। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি অতিক্রম করেছিল। সেই বয়সেই তিনি الروض النضير في ترتيب وتخريج معجم الطبراني الصغير নামক একটি তাখরীজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যদিও তা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
পেশাজীবী আলবানী:
শায়খ আলবানীর পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। আলবানী পিতার দোকানে কাজ করেই একাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, ঘড়ি মেরামতের কাজই আমাকে সূক্ষ্মতা শিখিয়েছে। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি কর্মজীবনের শুরুতে দু’বছর কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। অতঃপর কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় তিনি পুরাতন গৃহ সংস্কারের পেশা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবার ঘড়ি মেরামতের পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁর নিজস্ব ঘড়ির দোকান ছিল।
তিনি বলতেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার তাওফীক্ব দান করেছিলেন। এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীসে বুৎপত্তি অর্জনে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করি। এই পরিমাণ কাজ করাই আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ এর বেশী আর প্রয়োজন নেই। কেননা রাসূল (ﷺ) এ দো‘আই করতেন যে, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য এমন রিযিক দান কর যা পরিমিত। অর্থাৎ প্রয়োজনের কম নয় বা বেশীও নয় (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
দারিদ্রক্লিষ্ট আলবানী:
প্রথম জীবনে শায়খ আলবানীকে চরম দারিদ্রের মুকাবিলা করতে হয়েছিল। শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, শায়খ আলবানী আমাকে সিলসিলা যঈফাহ ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্বে এর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপি গ্রহণ করে যখন ব্যাগ থেকে বের করলাম, দেখলাম তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির প্যাকেটসহ মানুষের ফেলে দেয়া লাল রঙের পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন! অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললাম। শায়খ আমার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে তখন ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না (ইসতামে‘ ইলাইহে মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত)।
তার আরেক ছাত্র আবু মু‘আবিয়া বৈরূতীর ভাষায় তিনি দারিদ্রের কারণে কাগজ ক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে নিতেন এবং তাতেই তাঁর অমূল্য লেখনীর প্রকাশ ঘটাতেন। একদিন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সস্তা হওয়ার কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ কেজি দরে ক্রয় করতাম’ (শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ১/৪৩)।
বইয়ের পোকা আলবানী:
তিনি হাদীসের মুদ্রিত গ্রন্থাবলী ও দুর্লভ পান্ডুলিপি অধ্যয়নের জন্য দামেশকের সুপ্রাচীন যাহেরিয়া লাইব্রেরীতে প্রত্যেক দিন ৬/৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা অবধি চলত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। অনেক সময় লাইব্রেরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে কেটে যেত। কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন এবং সার্বক্ষণিক উপকৃত হওয়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি চাবি তাঁকে প্রদান করেন। তিনি ইবনু আবিদ দুনয়ার ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপির বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি পৃষ্ঠা উদ্ধারের জন্য উক্ত লাইব্রেরীর প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ২৩-২৫ পৃঃ)।
জহূরী জহর চেনে:
হজ্জের মওসুম। শায়খ আলবানী হজ্জে গিয়েছেন। এদিকে মিশকাতের প্রসিদ্ধ আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক স্বনামধন্য সালাফী বিদ্বান ভারতগুরু শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও হজ্জে গিয়েছেন। ইন্ডিয়ার আহলেহাদীস নেতা শায়খ মুখতার আহমাদ নাদভী মিনাতে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে আল্লামা মুবারকপুরীকে নিয়ে গেলেন। কেবল নামটি বলার অপেক্ষা। আর যাবেন কোথায়! শায়খ আলবানী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। যেন কতদিনের স্বপ্ন আজ স্বার্থক হ’ল। শায়খ মুখতার বলেন, ইসলামী দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক:
(১) শায়খ আলবানীর প্রিয় ছাত্র শায়খ আলী হালাবী বলেন, একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীসে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
(২) মিসরীয় আলেম শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী তাঁর উস্তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভুলতে পারি না সেদিনের কথা যেদিন আমি উস্তাদ আলবানীকে আমার তাখরীজকৃত ইমাম আবুদাঊদ রচিত البعث নামক বইটি উপহার দিলাম। তিনি যখন বইয়ের কভারে خرج أحاديثه الشيخ الحويني السلفي লেখা দেখলেন, তখন বিস্মিত হয়ে الشيخ শব্দের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কেন? আমি ওযর পেশ করে বললাম, শায়খ! এটা আমার কাজ নয় বরং প্রকাশকের ভুল। কিন্তু তিনি আমার ওযর গ্রহণ করলেন না। আললাহর কসম! আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। বরং এরপর থেকে আমি তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় শ্রদ্ধা করতে লাগলাম এবং আমার হৃদয়ে তিনি যেন একটি বিশেষ স্থানে আসীন হ’লেন। কারণ হাদীস শাস্ত্রের অবিসংবাদিত ইমাম হিসাবে যাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তিনি যে নিজেই স্বীয় গ্রন্থে কেবল নাম ব্যতীত কিছুই লিখতেন না! (আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী, বাযালুল ইহসান বিতাকরীবি সুনান নাসাঈ)।
(৩) শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তাঁর সাথে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজে হাতে খাবার এনে আমাদের খাওয়াচ্ছিলেন। আমি উঠে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি বিব্রতভাবে বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে শায়খ আলবানী মনের রাখার মত যে কথাটি বললেন, ‘দেখ, الامتثال هو الأدب، بلهو خير من الأدب ‘রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণ করাই হ’ল ভদ্রতা। বরং ভদ্রতার চাইতেও উত্তম’ (বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম)।
নিজের দোষ-ত্রুটি শিকারে দ্ব্যর্থহীন:
একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ক্রটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, আলবানীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ৮২/৩:৭)। তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ/পরামর্শ প্রাপ্ত হয়।
তিন মনীষীর মহামিলন:
শায়খ আলবানী জীবনের শেষ হজব্রত পালনকালে মিনায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনিসহ আরো রয়েছেন শায়খ বিন বায এবং শায়খ উছায়মীন। তাদের উপস্থিতিতে বিরাট মজলিসে প্রশ্নোত্তর বৈঠক শুরু হ’ল। সভাপতি হিসাবে শায়খ বিন বায প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য হাদীস সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শায়খ আলবানীকে, ফিক্বহী প্রশ্নের উত্তর শায়খ উছায়মীনকে এবং আক্বীদাগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। অতঃপর যোহরের সময় হ’ল। শায়খ বিন বায শায়খ আলবানীকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আজ আপনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করবেন, আপনি আমাদের ইমাম। শায়খ আলবানী অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, না না শায়খ, বরং আপনাকেই ইমামতি করতে হবে, আপনি আমাদের শায়খ। শায়খ বিন বায বললেন, আমরা কুরআনের ক্ষেত্রে সকলেই সমান হ’তে পারি। কিন্তু রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের মাঝে সর্বাধিক অবগত। সুতরাং আপনিই ইমামতি করুন। অবশেষে শায়খ আলবানী ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে শায়খ! আমি কি রাসূল (ﷺ)-এর ন্যায় ছালাত আদায় করব, না সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করব? শায়খ বিন বায বললেন, রাসূল (ﷺ)-এর অনুরূপ ছালাত আদায় করুন এবং আমাদেরকে শিখিয়ে দিন কিভাবে রাসূল (ﷺ) ছালাত আদায় করতেন।
গাড়িচালক আলবানী:
শায়খ আলবানী একদিন নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জনৈক ছাত্র তাঁর গাড়িতে উঠলো। শায়খ আলবানী তখন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ছাত্রটি ভয় পেয়ে তাঁকে বলল, শায়খ! গাড়ির গতি ধীর করুন। শায়খ বিন বায বলেছেন, জোরে গাড়ি চালানো নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। উত্তরে শায়খ আলবানী বললেন, এই ফৎওয়া গাড়ি চালনায় অদক্ষদের জন্য, আমার জন্য নয়। ছাত্রটি বলল, আমি কি আপনার এই কথাটি শায়খ বিন বাযকে শোনাবো? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁকে বল। পরে ছাত্রটি একথা শায়খ বিন বাযকে জানালে তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, তাঁকে বল এই ফৎওয়া তাদের জন্য যাদের এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি (সঊদী আরবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই যাদের একবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা এমনিতেই সাবধানে গাড়ি চালায়) (তরজমাতুস সাদহান লিশ শায়খ বিন বায)।
খেলাধুলায় আলবানী:
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ (মৃত্যু ১৪৩২হিঃ) বলেন, মদীনায় অনেক বিখ্যাত আলেম-ওলামার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে শায়খ আলবানী ছিলেন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা একত্রে বহুবার সফর করেছি। তিনি একাধারে আমার উস্তাদ এবং বন্ধু ছিলেন। যে বিষয়েই তাঁর সাথে কথা বলা হোক না কেন, তিনি হাদীস দিয়ে কথা বলতেন এবং সনদের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করতেন। কুরআন থেকে তিনি এমনভাবে দলীল দিতেন যেন কুরআন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। একবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল। শায়খ আলবানীও নিজের পোষাক পরিহিত অবস্থাতেই মাঝে মাঝে তাদের সাথে খেলছিলেন। আমি বললাম, আপনি করছেন কি? আপনি ফুটবল খেলছেন, অথচ আপনি আলবানী! উত্তরে তিনি বললেন, أتقوى بها على الطاعة وهي لا تلهيني عن ذكر ربي ‘এর দ্বারা আমি আল্লাহ্র আনুগত্যে শক্তি অর্জন করছি। আর এটি আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ থেকে উদাসীন করছে না।’
সৃজনশীল কারিগর:
শায়খ আলবানী ইলমে হাদীসে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
(১) অধ্যাপক মাহমূদ রেযা বলেন, একবার শায়খ আলবানী আমাকে তাঁর গৃহের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র দেখালেন, যা সূর্যের কিরণে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গরম হ’ত। সালফার, আলকাতরা ইত্যাদি পদার্থের মিশ্রণে নির্মিত এই জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি শীতকালে তাঁর ঘরের উষ্ণতা ধরে রাখত (মুহাম্মাদ রেযা মুরাদ, মাসিক আদ-দাওয়াহ, ১৮১৮ সংখ্যা, শা‘বান ১৪২০ হিঃ)।
(২) তিনি সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছালাতের সঠিক সময় নির্ণয়কারী একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। তবে তাঁর বাড়িতে ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বিস্মিত হ’ত তাঁর স্বনির্মিত লিফটটি দেখে, যার মাধ্যমে তিনি উপর তলায় উঠতেন। স্থুল স্বাস্থ্যের কারণে উপরে পায়ে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হ’ত। তাঁর এই লিফটটির সাথে একটি ডায়নামা সদৃশ যন্ত্র যুক্ত করা ছিল। সুইচ টিপ দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠা-নামা করত। এছাড়া তিনি বই-পত্র রাখার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান র্যাক তৈরী করেছিলেন, যেখানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বইসমূহ রাখতেন। বিশেষতঃ জারাহ-তা‘দীল এবং রিজাল শাস্ত্রের বইগুলো তিনি এই র্যাকে রাখতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। এমনকি স্বীয় সন্তান মুহাম্মাদের প্রসবকার্যে তিনি একাই স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন (ইছাম হাদী, আলবানী কামা ‘আরাফতুহু ১০৪ পৃঃ)।
(৩) বৈদ্যুতিক কাজসহ গাড়ি মেরামতেও তাঁর দক্ষতা ছিল আশ্চর্য ধরনের। একাধিক দাওয়াতী সফরে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁকে নিজেই তা মেরামত করতে দেখা গেছে। তাঁর ছাত্র শায়খ আদনান স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একবার তিনি শায়খ আলবানীর সাথে রেডিও কিনতে গিয়েছিলেন। আলবানী দোকানীকে রেডিও সম্পর্কে দক্ষ বিশেষজ্ঞের মত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। যেমন, রেডিও তরঙ্গ কয়টি? কয়টি ব্যাটারী প্রয়োজন হয়? পাওয়ার কত? কোন দেশে তৈরী ইত্যাদি। তিনি শায়খকে বললেন, এগুলিতো রেডিওর খুব সূক্ষ্ম বিষয়, আপনি বোঝেন কিভাবে? আলবানী বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আমাদেরকে কেবল ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রেই সূক্ষ্মতা অবলম্বন করতে হবে? না, বরং সর্বক্ষেত্রেই এ নীতি প্রযোজ্য। আমরা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রেই তাক্বলীদকে অস্বীকার করি না। বরং যে কোন বিষয়েই অন্যের তাক্বলীদকে অস্বীকার করি।
(৪) অনুরূপভাবে ইয়ারমূক বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারূক সামেরাঈ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শায়খ আলবানীর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাড়িতে হাঁস-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি পালন করতেন। একবার তিনি সপরিবারে ওমরা করতে যাবেন। দুই সপ্তাহ বাড়ি খালি থাকবে। কিন্তু এসব প্রাণীর খাদ্য-পানীয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর যথারীতি নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি একটি চমৎকার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পানীয় প্রত্যেক খাঁচায় ঢেলে দেবে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল। সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন সব পশু-পাখি সুন্দরভাবে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছে। কোন সমস্যা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই হয়েছে।
(৫) ড. আব্দুল আযীয সাদহান লিখেছেন, শায়খ আলবানীর বাসায় অনেক পাখি ছিল। পাখিদের বাসা ছিল তাঁর বারান্দা থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে। তাই প্রতিদিন পাখির খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বারান্দা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে দেন। যার অপর মুখটি ছিল পাখির বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ। তিনি প্রতিদিন ঐ পাইপটি পাখিদের খাবার দিয়ে ভরে রাখতেন। ফলে অপর মুখ থেকে পাখিরা যখনই কিছু খাবার খেত, তখনই পাইপের মুখে বাকি খাবার অল্প অল্প করে নেমে আসত। ফলে বার বার খাবার দেয়ার পরিশ্রম করতে হত না। এভাবে তাঁর সবকিছুতেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ছাপ (ইমাম আলবানী দুরূস ওয়া মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১১১ পৃঃ)।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব:
একদিন শায়খ সাম‘আনী শায়খ আলবানীকে তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি চমৎকার এক উদাহরণ পেশ করে বললেন, এই জামা‘আতের মত ইখলাছপূর্ণ এবং আমলসমৃদ্ধ কোন জামা‘আত আজ পর্যন্ত আমার নযরে পড়েনি। কিন্তু তাদের অবস্থা হ’ল ঐ অতি উৎসাহী কুর্দী ব্যক্তির মত, যে ইসলাম প্রচারের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর সামনে একজন ইহুদীকে পেয়ে খঞ্জর উঁচিয়ে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে আত্মসমর্পণ করে বলল, ঠিক আছে ইসলাম গ্রহণ করব। এখন বল, কি বলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুর্দী তখন বলল, হায় হায় এটা তো আমার জানা নেই! (অর্থাৎ তারা দ্বীনের তাবলীগ করে বটে; কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই)।
প্রচারবিমুখতা:
১৯৮৪ সালে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এটাও বললেন, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী বেঁকে বসলেন এবং বারংবার নিবেদন সত্ত্বেও কোনক্রমে রাযী হলেন না। বাসায় ফিরে আসলে তার এক সাথী দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة আমি আমার উপর ফিতনার আশংকা করছি (অর্থাৎ এতে আমার মধ্যে আত্মগর্বের সৃষ্টি হতে পারে)।
একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتربإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কারণে আত্মপ্রবঞ্চিত না হওয়া (ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১২৬ পৃঃ)।
আধুনিক যুগের ইলমে হাদীসের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ড সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি!
কারাজীবনে আলবানী:
শায়খ আলবানীকে বিনা অপরাধে সন্দেহের বশে কয়েকজন আলেমের সাথে কারান্তরীণ হতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনি সিরিয়ার বিখ্যাত কেল‘আ কারাগারে কয়েকমাসের জন্য বন্দী ছিলেন। এই কারাগারেই একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ইং)।
আলবানী বাইরের ন্যায় কারাভ্যন্তরেও দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের প্রতি সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-এর পরে সর্বপ্রথম কেল‘আ কারাগারে একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মুক্তির কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং প্রায় আট মাস কারাবাস করেন। এসময় তিনি মুনযেরী কর্তৃক সংকলিত মুখতাছার সহীহ মুসলিমের তাহকীক সম্পন্ন করেন।
বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। হাদীস গবেষণায় যিনি বর্তমান পৃথিবীতে একজন আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহান ব্যক্তি। ইলম চর্চায় তার জীবনীতে আমাদের প্রেরণার যথেষ্ট খোরাক রয়েছে। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অসীম সাহস, সুদৃঢ় মনোবল আর ইখলাস ভরা প্রত্যয় থাকলে কিভাবে একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সাধারণ ঘড়ির মেকার থেকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদে পরিণত করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন আল্লামা আলাবানী।
পিতার সাথে বিরোধ:
শায়খ আলবানী কট্টর হানাফী পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলবেনীয় ও সার্বীয় আলেমদের মধ্যে হানাফী ফিকহ সম্পর্কে সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম। তাঁর নিকটে সবাই ফৎওয়া নিতে আসত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার। বিশেষতঃ কুরআন-হাদীসের গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তাঁর নিকটে সমকালীন বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্রুটিসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুঁজে পান কুরআন-হাদীসের সাথে বহু মাসআলা-মাসায়েলের যোজন যোজন দূরের ব্যবধান। বিভিন্ন মসজিদে তখন হানাফী এবং শাফেঈদের দু’টি করে জামা‘আত হ’ত। হানাফী জামা‘আতের পর শাফেঈদের জামা‘আত হ’ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিরিয়ায় একজন শাফেঈ শাসক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি হানাফীদের পূর্বে শাফেঈদের ছালাত আদায় করার নির্দেশ জারী করেন। এমতাবস্থায় শায়খ আলবানী দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায়ের কোন দলীল না পেয়ে শাফেঈদের সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা শুরু করলেন।
একদিন হানাফীদের ইমাম শায়খ বুরহানী হজ্জের সফরে গমনের কারণে শায়খ আলবানীর পিতাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন হ’ল যে, শায়খ আলবানী প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করছেন, আর তাঁর পিতা দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করছেন। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ল, যেদিন তাঁর পিতা তার ব্যক্তিগত সফরে যাওয়ার কারণে উপলক্ষে আলবানীকে দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। স্পষ্টভাষী আলবানী স্বীয় পিতাকে বললেন, এ বিষয়ে আপনি আমার মতামত জানেন যে, আমি প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করি। এমতাবস্থায় স্বীয় মত বিরোধী কাজ করা আমার জন্য খুবই কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ তীব্রতর হ’ল। অতঃপর একদিন পিতা তাকে গৃহকোণে ডেকে বললেন, তাহ’লে এটাই কি সত্য যে, তুমি তোমার মাযহাব পরিত্যাগ করেছ? ক্রোধান্বিত পিতার কণ্ঠ ঊঁচু হ’তে লাগল। একপর্যায়ে বললেন, হয় তোমাকে একমত হ’তে হবে, অন্যথায় পৃথক হ’তে হবে। শায়খ আলবানী পিতার নিকট থেকে তিনদিন সময় চেয়ে নিলেন। অবশেষে মাত্র ২৫ সিরীয় লিরা হাতে নিয়ে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিলেন পরবর্তীকালের বিশ্ববিশ্রুত এই মুহাদ্দিছ। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি অতিক্রম করেছিল। সেই বয়সেই তিনি الروض النضير في ترتيب وتخريج معجم الطبراني الصغير নামক একটি তাখরীজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যদিও তা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
পেশাজীবী আলবানী:
শায়খ আলবানীর পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। আলবানী পিতার দোকানে কাজ করেই একাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, ঘড়ি মেরামতের কাজই আমাকে সূক্ষ্মতা শিখিয়েছে। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি কর্মজীবনের শুরুতে দু’বছর কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। অতঃপর কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় তিনি পুরাতন গৃহ সংস্কারের পেশা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবার ঘড়ি মেরামতের পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁর নিজস্ব ঘড়ির দোকান ছিল।
তিনি বলতেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার তাওফীক্ব দান করেছিলেন। এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীসে বুৎপত্তি অর্জনে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করি। এই পরিমাণ কাজ করাই আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ এর বেশী আর প্রয়োজন নেই। কেননা রাসূল (ﷺ) এ দো‘আই করতেন যে, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য এমন রিযিক দান কর যা পরিমিত। অর্থাৎ প্রয়োজনের কম নয় বা বেশীও নয় (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
দারিদ্রক্লিষ্ট আলবানী:
প্রথম জীবনে শায়খ আলবানীকে চরম দারিদ্রের মুকাবিলা করতে হয়েছিল। শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, শায়খ আলবানী আমাকে সিলসিলা যঈফাহ ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্বে এর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপি গ্রহণ করে যখন ব্যাগ থেকে বের করলাম, দেখলাম তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির প্যাকেটসহ মানুষের ফেলে দেয়া লাল রঙের পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন! অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললাম। শায়খ আমার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে তখন ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না (ইসতামে‘ ইলাইহে মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত)।
তার আরেক ছাত্র আবু মু‘আবিয়া বৈরূতীর ভাষায় তিনি দারিদ্রের কারণে কাগজ ক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে নিতেন এবং তাতেই তাঁর অমূল্য লেখনীর প্রকাশ ঘটাতেন। একদিন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সস্তা হওয়ার কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ কেজি দরে ক্রয় করতাম’ (শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ১/৪৩)।
বইয়ের পোকা আলবানী:
তিনি হাদীসের মুদ্রিত গ্রন্থাবলী ও দুর্লভ পান্ডুলিপি অধ্যয়নের জন্য দামেশকের সুপ্রাচীন যাহেরিয়া লাইব্রেরীতে প্রত্যেক দিন ৬/৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা অবধি চলত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। অনেক সময় লাইব্রেরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে কেটে যেত। কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন এবং সার্বক্ষণিক উপকৃত হওয়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি চাবি তাঁকে প্রদান করেন। তিনি ইবনু আবিদ দুনয়ার ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপির বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি পৃষ্ঠা উদ্ধারের জন্য উক্ত লাইব্রেরীর প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ২৩-২৫ পৃঃ)।
জহূরী জহর চেনে:
হজ্জের মওসুম। শায়খ আলবানী হজ্জে গিয়েছেন। এদিকে মিশকাতের প্রসিদ্ধ আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক স্বনামধন্য সালাফী বিদ্বান ভারতগুরু শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও হজ্জে গিয়েছেন। ইন্ডিয়ার আহলেহাদীস নেতা শায়খ মুখতার আহমাদ নাদভী মিনাতে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে আল্লামা মুবারকপুরীকে নিয়ে গেলেন। কেবল নামটি বলার অপেক্ষা। আর যাবেন কোথায়! শায়খ আলবানী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। যেন কতদিনের স্বপ্ন আজ স্বার্থক হ’ল। শায়খ মুখতার বলেন, ইসলামী দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক:
(১) শায়খ আলবানীর প্রিয় ছাত্র শায়খ আলী হালাবী বলেন, একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীসে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
(২) মিসরীয় আলেম শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী তাঁর উস্তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভুলতে পারি না সেদিনের কথা যেদিন আমি উস্তাদ আলবানীকে আমার তাখরীজকৃত ইমাম আবুদাঊদ রচিত البعث নামক বইটি উপহার দিলাম। তিনি যখন বইয়ের কভারে خرج أحاديثه الشيخ الحويني السلفي লেখা দেখলেন, তখন বিস্মিত হয়ে الشيخ শব্দের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কেন? আমি ওযর পেশ করে বললাম, শায়খ! এটা আমার কাজ নয় বরং প্রকাশকের ভুল। কিন্তু তিনি আমার ওযর গ্রহণ করলেন না। আললাহর কসম! আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। বরং এরপর থেকে আমি তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় শ্রদ্ধা করতে লাগলাম এবং আমার হৃদয়ে তিনি যেন একটি বিশেষ স্থানে আসীন হ’লেন। কারণ হাদীস শাস্ত্রের অবিসংবাদিত ইমাম হিসাবে যাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তিনি যে নিজেই স্বীয় গ্রন্থে কেবল নাম ব্যতীত কিছুই লিখতেন না! (আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী, বাযালুল ইহসান বিতাকরীবি সুনান নাসাঈ)।
(৩) শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তাঁর সাথে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজে হাতে খাবার এনে আমাদের খাওয়াচ্ছিলেন। আমি উঠে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি বিব্রতভাবে বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে শায়খ আলবানী মনের রাখার মত যে কথাটি বললেন, ‘দেখ, الامتثال هو الأدب، بلهو خير من الأدب ‘রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণ করাই হ’ল ভদ্রতা। বরং ভদ্রতার চাইতেও উত্তম’ (বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম)।
নিজের দোষ-ত্রুটি শিকারে দ্ব্যর্থহীন:
একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ক্রটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, আলবানীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ৮২/৩:৭)। তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ/পরামর্শ প্রাপ্ত হয়।
তিন মনীষীর মহামিলন:
শায়খ আলবানী জীবনের শেষ হজব্রত পালনকালে মিনায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনিসহ আরো রয়েছেন শায়খ বিন বায এবং শায়খ উছায়মীন। তাদের উপস্থিতিতে বিরাট মজলিসে প্রশ্নোত্তর বৈঠক শুরু হ’ল। সভাপতি হিসাবে শায়খ বিন বায প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য হাদীস সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শায়খ আলবানীকে, ফিক্বহী প্রশ্নের উত্তর শায়খ উছায়মীনকে এবং আক্বীদাগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। অতঃপর যোহরের সময় হ’ল। শায়খ বিন বায শায়খ আলবানীকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আজ আপনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করবেন, আপনি আমাদের ইমাম। শায়খ আলবানী অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, না না শায়খ, বরং আপনাকেই ইমামতি করতে হবে, আপনি আমাদের শায়খ। শায়খ বিন বায বললেন, আমরা কুরআনের ক্ষেত্রে সকলেই সমান হ’তে পারি। কিন্তু রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের মাঝে সর্বাধিক অবগত। সুতরাং আপনিই ইমামতি করুন। অবশেষে শায়খ আলবানী ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে শায়খ! আমি কি রাসূল (ﷺ)-এর ন্যায় ছালাত আদায় করব, না সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করব? শায়খ বিন বায বললেন, রাসূল (ﷺ)-এর অনুরূপ ছালাত আদায় করুন এবং আমাদেরকে শিখিয়ে দিন কিভাবে রাসূল (ﷺ) ছালাত আদায় করতেন।
গাড়িচালক আলবানী:
শায়খ আলবানী একদিন নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জনৈক ছাত্র তাঁর গাড়িতে উঠলো। শায়খ আলবানী তখন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ছাত্রটি ভয় পেয়ে তাঁকে বলল, শায়খ! গাড়ির গতি ধীর করুন। শায়খ বিন বায বলেছেন, জোরে গাড়ি চালানো নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। উত্তরে শায়খ আলবানী বললেন, এই ফৎওয়া গাড়ি চালনায় অদক্ষদের জন্য, আমার জন্য নয়। ছাত্রটি বলল, আমি কি আপনার এই কথাটি শায়খ বিন বাযকে শোনাবো? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁকে বল। পরে ছাত্রটি একথা শায়খ বিন বাযকে জানালে তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, তাঁকে বল এই ফৎওয়া তাদের জন্য যাদের এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি (সঊদী আরবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই যাদের একবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা এমনিতেই সাবধানে গাড়ি চালায়) (তরজমাতুস সাদহান লিশ শায়খ বিন বায)।
খেলাধুলায় আলবানী:
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ (মৃত্যু ১৪৩২হিঃ) বলেন, মদীনায় অনেক বিখ্যাত আলেম-ওলামার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে শায়খ আলবানী ছিলেন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা একত্রে বহুবার সফর করেছি। তিনি একাধারে আমার উস্তাদ এবং বন্ধু ছিলেন। যে বিষয়েই তাঁর সাথে কথা বলা হোক না কেন, তিনি হাদীস দিয়ে কথা বলতেন এবং সনদের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করতেন। কুরআন থেকে তিনি এমনভাবে দলীল দিতেন যেন কুরআন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। একবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল। শায়খ আলবানীও নিজের পোষাক পরিহিত অবস্থাতেই মাঝে মাঝে তাদের সাথে খেলছিলেন। আমি বললাম, আপনি করছেন কি? আপনি ফুটবল খেলছেন, অথচ আপনি আলবানী! উত্তরে তিনি বললেন, أتقوى بها على الطاعة وهي لا تلهيني عن ذكر ربي ‘এর দ্বারা আমি আল্লাহ্র আনুগত্যে শক্তি অর্জন করছি। আর এটি আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ থেকে উদাসীন করছে না।’
সৃজনশীল কারিগর:
শায়খ আলবানী ইলমে হাদীসে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
(১) অধ্যাপক মাহমূদ রেযা বলেন, একবার শায়খ আলবানী আমাকে তাঁর গৃহের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র দেখালেন, যা সূর্যের কিরণে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গরম হ’ত। সালফার, আলকাতরা ইত্যাদি পদার্থের মিশ্রণে নির্মিত এই জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি শীতকালে তাঁর ঘরের উষ্ণতা ধরে রাখত (মুহাম্মাদ রেযা মুরাদ, মাসিক আদ-দাওয়াহ, ১৮১৮ সংখ্যা, শা‘বান ১৪২০ হিঃ)।
(২) তিনি সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছালাতের সঠিক সময় নির্ণয়কারী একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। তবে তাঁর বাড়িতে ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বিস্মিত হ’ত তাঁর স্বনির্মিত লিফটটি দেখে, যার মাধ্যমে তিনি উপর তলায় উঠতেন। স্থুল স্বাস্থ্যের কারণে উপরে পায়ে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হ’ত। তাঁর এই লিফটটির সাথে একটি ডায়নামা সদৃশ যন্ত্র যুক্ত করা ছিল। সুইচ টিপ দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠা-নামা করত। এছাড়া তিনি বই-পত্র রাখার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান র্যাক তৈরী করেছিলেন, যেখানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বইসমূহ রাখতেন। বিশেষতঃ জারাহ-তা‘দীল এবং রিজাল শাস্ত্রের বইগুলো তিনি এই র্যাকে রাখতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। এমনকি স্বীয় সন্তান মুহাম্মাদের প্রসবকার্যে তিনি একাই স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন (ইছাম হাদী, আলবানী কামা ‘আরাফতুহু ১০৪ পৃঃ)।
(৩) বৈদ্যুতিক কাজসহ গাড়ি মেরামতেও তাঁর দক্ষতা ছিল আশ্চর্য ধরনের। একাধিক দাওয়াতী সফরে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁকে নিজেই তা মেরামত করতে দেখা গেছে। তাঁর ছাত্র শায়খ আদনান স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একবার তিনি শায়খ আলবানীর সাথে রেডিও কিনতে গিয়েছিলেন। আলবানী দোকানীকে রেডিও সম্পর্কে দক্ষ বিশেষজ্ঞের মত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। যেমন, রেডিও তরঙ্গ কয়টি? কয়টি ব্যাটারী প্রয়োজন হয়? পাওয়ার কত? কোন দেশে তৈরী ইত্যাদি। তিনি শায়খকে বললেন, এগুলিতো রেডিওর খুব সূক্ষ্ম বিষয়, আপনি বোঝেন কিভাবে? আলবানী বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আমাদেরকে কেবল ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রেই সূক্ষ্মতা অবলম্বন করতে হবে? না, বরং সর্বক্ষেত্রেই এ নীতি প্রযোজ্য। আমরা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রেই তাক্বলীদকে অস্বীকার করি না। বরং যে কোন বিষয়েই অন্যের তাক্বলীদকে অস্বীকার করি।
(৪) অনুরূপভাবে ইয়ারমূক বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারূক সামেরাঈ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শায়খ আলবানীর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাড়িতে হাঁস-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি পালন করতেন। একবার তিনি সপরিবারে ওমরা করতে যাবেন। দুই সপ্তাহ বাড়ি খালি থাকবে। কিন্তু এসব প্রাণীর খাদ্য-পানীয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর যথারীতি নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি একটি চমৎকার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পানীয় প্রত্যেক খাঁচায় ঢেলে দেবে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল। সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন সব পশু-পাখি সুন্দরভাবে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছে। কোন সমস্যা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই হয়েছে।
(৫) ড. আব্দুল আযীয সাদহান লিখেছেন, শায়খ আলবানীর বাসায় অনেক পাখি ছিল। পাখিদের বাসা ছিল তাঁর বারান্দা থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে। তাই প্রতিদিন পাখির খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বারান্দা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে দেন। যার অপর মুখটি ছিল পাখির বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ। তিনি প্রতিদিন ঐ পাইপটি পাখিদের খাবার দিয়ে ভরে রাখতেন। ফলে অপর মুখ থেকে পাখিরা যখনই কিছু খাবার খেত, তখনই পাইপের মুখে বাকি খাবার অল্প অল্প করে নেমে আসত। ফলে বার বার খাবার দেয়ার পরিশ্রম করতে হত না। এভাবে তাঁর সবকিছুতেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ছাপ (ইমাম আলবানী দুরূস ওয়া মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১১১ পৃঃ)।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব:
একদিন শায়খ সাম‘আনী শায়খ আলবানীকে তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি চমৎকার এক উদাহরণ পেশ করে বললেন, এই জামা‘আতের মত ইখলাছপূর্ণ এবং আমলসমৃদ্ধ কোন জামা‘আত আজ পর্যন্ত আমার নযরে পড়েনি। কিন্তু তাদের অবস্থা হ’ল ঐ অতি উৎসাহী কুর্দী ব্যক্তির মত, যে ইসলাম প্রচারের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর সামনে একজন ইহুদীকে পেয়ে খঞ্জর উঁচিয়ে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে আত্মসমর্পণ করে বলল, ঠিক আছে ইসলাম গ্রহণ করব। এখন বল, কি বলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুর্দী তখন বলল, হায় হায় এটা তো আমার জানা নেই! (অর্থাৎ তারা দ্বীনের তাবলীগ করে বটে; কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই)।
প্রচারবিমুখতা:
১৯৮৪ সালে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এটাও বললেন, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী বেঁকে বসলেন এবং বারংবার নিবেদন সত্ত্বেও কোনক্রমে রাযী হলেন না। বাসায় ফিরে আসলে তার এক সাথী দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة আমি আমার উপর ফিতনার আশংকা করছি (অর্থাৎ এতে আমার মধ্যে আত্মগর্বের সৃষ্টি হতে পারে)।
একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتربإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কারণে আত্মপ্রবঞ্চিত না হওয়া (ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১২৬ পৃঃ)।
আধুনিক যুগের ইলমে হাদীসের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ড সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি!
কারাজীবনে আলবানী:
শায়খ আলবানীকে বিনা অপরাধে সন্দেহের বশে কয়েকজন আলেমের সাথে কারান্তরীণ হতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনি সিরিয়ার বিখ্যাত কেল‘আ কারাগারে কয়েকমাসের জন্য বন্দী ছিলেন। এই কারাগারেই একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ইং)।
আলবানী বাইরের ন্যায় কারাভ্যন্তরেও দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের প্রতি সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-এর পরে সর্বপ্রথম কেল‘আ কারাগারে একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মুক্তির কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং প্রায় আট মাস কারাবাস করেন। এসময় তিনি মুনযেরী কর্তৃক সংকলিত মুখতাছার সহীহ মুসলিমের তাহকীক সম্পন্ন করেন।
সংকলনে : আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব