• আসসালামু আলাইকুম, খুব শীঘ্রই আমাদের ফোরামে মেজর কিছু চেঞ্জ আসবে যার ফলে ফোরামে ১-৩ দিন আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। উক্ত সময়ে আপনাদের সকলকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।

জীবনী রাসূল (ﷺ)-এর উপর শত্রুদের নির্যাতন ও পরিণাম

ভূমিকা : আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ)-কে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন (ছাফফাত ৩৭/৯, ফাতহ ৪৮/২৮)
তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সাবা ৩৪/২৮)
তিনি বলেন, ‘অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাক। কেননা তুমি উপদেশদাতা বৈ কিছুই নও। তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও’ (গাশিয়া ৮৩/২১-২২)। আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন ‘ইসলাম’কে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে রাসূল (ﷺ) অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অমানুষিক নির্যাতন ও অকথ্য নিপীড়ন নীরবে সহ্য করেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে রাসূল (ﷺ)-এর উপর শত্রুদের নির্যাতন ও এর পরিণতি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হ’ল।-

রাসূল (ﷺ)-এর চরিত্র-মাধুর্য : রাসূলূল্লাহ (ﷺ)-এর চরিত্র ও তাঁর আদর্শ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ​

‘আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত আছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তিনি আরো বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘অবশ্যই তুমি মহত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত’ (কলম ৬৮/৪)

রাসূল (ﷺ)-এর চরিত্র সম্পর্কে ফ্রান্সের প্রফেসর সেডইউ বলেন, নবী করীম (ﷺ) ছিলেন হাস্যমুখ ও মিশুক স্বভাবের। তিনি প্রায়ই নীরব থাকতেন এবং অধিকাংশ সময় আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকতেন। অনর্থক কথা হ’তে তিনি দূরে থাকতেন এবং অশ্লীলতাকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি ছিলেন সঠিক মত ও উত্তম জ্ঞানের অধিকারী।[1]

অধিকাংশ নবী-রাসূল বিভিন্ন প্রকার মুজিযা লাভ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্যতম মুজিযা ছিল তাঁর চরিত্র। তিনি মানুষের অন্তরসমূহ পরিবর্তন এবং আত্মাকে পবিত্র করে দিতেন চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে। এ সম্পর্কে শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহঃ) লিখেছেন, ‘কোন ব্যক্তি যখন নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে এক বার আসত, সে ভীত হয়ে পড়ত। আর যে কেউ তাঁর পাশে এসে বসতো সে মহববতে আকৃষ্ট হয়ে যেত।[2]

রাসূল (ﷺ)-এর উপরে কাফেরদের নির্যাতন : রাসূল (ﷺ)-এর উপরে কাফিরদের নির্যাতন ছিল দু’ধরনের। ১. মানসিক, ২. দৈহিক।

মানসিক নির্যাতন : কাফিররা পরিকল্পিতভাবে রাসূল (ﷺ)-এর উপরে নানা অপবাদ আরোপ করে মানসিকভাবে তাঁকে কষ্ট দিত। তাদের আরোপিত অপবাদসমূহ যেমন- (১) পাগল (তূর ৫২/২৯), (২) কবি (ছাফফাত ৩৭/৩৫-৩৬), (৩) জাদুকর ও (৪) মিথ্যাবাদী (ছোয়াদ ৩৮/৪), (৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী (আনফাল ৮/৩১; ফুরক্বান-২৫/৫), (৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী (ফুরক্বান-২৫/৪), (৭) মিথ্যা রটনাকারী (নাহল-১৬/১০১; ফুরক্বান-২৫/৪), (৮) ভবিষ্যদ্বক্তা (তূর ৫২/২৯), (৯) পথভ্রষ্ট (তাত্বফীফ ৮৩/৩২), (১০) বেদ্বীন[3], (১১) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী ও (১২) জামা‘আত বিভক্তকারী[4], (১৩) জাদুগ্রস্ত (বনী ইসরাঈল ১৭/৪৭), (১৪) মুযাম্মাম (নিন্দিত)।[5] কুরায়েশরা রাসূল (ﷺ)-কে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত।[6] (১৫) ‘রা‘ইনা’ (বাক্বারা ২/১০৪) প্রভৃতি।

এসব নির্যাতনের পরিণতিতে এরা দুনিয়াতে হেদায়াত বঞ্চিত হয় এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।

মহান আল্লাহ বলেন,

انْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ سَبِيْلاً​

‘দেখ, ওরা তোমার জন্য কেমন সব উপমা দেয়। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা পথ পেতে পারে না’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৪৮)

দৈহিক নির্যাতন : উপরোক্ত মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি এরা রাসূল (ﷺ)-এর উপর শারীরিক নির্যাতনও করত। নিম্নে কয়েকজনের নির্যাতন ও তাদের পরিণতি উল্লেখ করা হ’ল।-

১. আবু লাহাব ও তার পরিবার কর্তৃক নির্যাতন এবং পরিণতি :

রাসূল (ﷺ) কম-বেশী সকল কাফির- মুশরিক নেতাদের পক্ষ থেকে নির্যাতিত হয়েছেন। তন্মধ্যে আবু লাহাব অন্যতম। আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আব্দুল ওয্যা। সে ছিল আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। সে লালিমাযুক্ত গৌরবর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ায় তাকে ‘আবু লাহাব’ অর্থাৎ ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ওয়ালা’ বলা হ’ত। এছাড়া ‘আব্দুল ওযযা’ নাম কুরআনে থাকাটা তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। বিধায় পবিত্র কুরআনে তার আসল নাম বর্জন করা হয়েছে। তাছাড়া আবু লাহাব ডাক নামের মধ্যে জাহান্নামের সাথে বেশ মিলও রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আপন চাচা ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিল। তার পরেও সে নবী করীম (ﷺ)-কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ নানা রকম নির্যাতন করত।

একদা নবী করীম (ﷺ) ছাফা পাহাড়ে আরোহণ করে আহবান জানালেন, হে বনু ফিহর! হে বনু আদী! এভাবে কুরায়েশদের বিভিন্ন গোত্রকে। এতে সকল নেতৃস্থানীয় লোক একত্রিত হ’ল। যে পারেনি সে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল কি ব্যাপার জানার জন্য। কুরায়েশরা এসে হাযির হ’ল, আবু লাহাবও তাদের সাথে ছিল। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) বললেন, যদি আমি বলি যে, পাহাড়ের অপর প্রান্তে শত্রুসৈন্য অবস্থান করছে। ওরা যেকোন সময় তোমাদের উপর হামলা করতে প্রস্ত্তত, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে? সকলে বলল, হ্যাঁ বিশ্বাস করব। কারণ আপনাকে আমরা কখনও মিথ্যা বলতে শুনিনি। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে কঠিন আযাবের ভয় প্রদর্শন করছি। আবু লাহাব বলল, তুমি ধ্বংস হও। একথা বলার জন্য তুমি আমাদেরকে এখানে ডেকেছ? তখন আল্লাহ তা‘আলা সূরা লাহাব নাযিল করেন। যাতে বলা হয়, ‘আবু লাহাবের দু’টি হাত ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও’।[7]

অন্যত্র আছে, ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর রাসূল (ﷺ)-কে মারার জন্য আবু লাহাব একটি পাথরও তুলেছিল।[8] তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুওয়াত পূর্বকালে রাসূল (ﷺ)-এর দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু নবী হওয়ার পরে সে তার ছেলেদেরকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করে। পরবর্তীতে এই দুই মেয়ের সাথেই একের পর এক ওছমান (রাঃ)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়।[9]

রাসূল (ﷺ)-এর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ (উপনাম ত্বাইয়েব বা তাহের) মারা গেলে আবু লাহাব খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলে, মুহাম্মাদ এখন লেজকাটা নির্বংশ (الأبتر) হয়ে গেল। যার প্রেক্ষিতে সূরা কাওছার নাযিল হয়।

হজ্জের মৌসুমে আবু লাহাব রাসূল (ﷺ)-এর পিছে লেগে থাকত। যেখানেই রাসূল (ﷺ) দাওয়াত দিতেন, সেখানেই সে তাঁকে গালি দিয়ে লোকদেরকে ভাগিয়ে দিত এবং বলত, إِنَّهُ صَابِئِىْ كَذّابٌ فَلاَ تُصَدِّقُوْهُ ‘এ লোকটি বিধর্মী মিথ্যাবাদী তোমরা এর কথা বিশ্বাস করো না’।[10] এমনকি ‘যুল মাজায’ নামক বাজারে যখন তিনি লোকদের বলছিলেন, তোমরা বল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাহ’লে সফলকাম হবে’, তখন পিছন থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে সে পাথর ছুঁড়ে মারে। তাতে রাসূলের পায়ের গোঁড়ালী পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়।[11] এভাবে রাসূল (ﷺ)-এর উপর সে একের পর এক নির্যাতন অব্যাহত রাখে।

অবশেষে আবূ লাহাবের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াবী গযব নেমে আসে। আবু লাহাবের মৃত্যু অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও জঘন্যভাবে হয়। বদর যুদ্ধের সাত দিন পর তার গলায় প্লেগের ফোঁড়া দেখা দেয়। সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে নির্জন জায়গায় ফেলে আসে। সেখানে ধুকে ধুকে তার মৃত্যু হয়। তার লাশটি পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করেনি। শেষ পর্যন্ত দেহ পঁচতে শুরু করলে গর্ত খুঁড়ে চাকর দ্বারা পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে হেঁচড়ে সে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হয়।[12]

আবু লাহাবের স্ত্রী ছিল আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল অর্থাৎ সুন্দরের উৎস। সেও স্বামীর একান্ত সহযোগী ছিল এবং সর্বদা রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকত। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায় حمالة الحطب বা খড়িবাহক বলা হ’ত। অর্থাৎ ঐ শুষ্ক কাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন বিস্তার করে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করত আড়ালে থেকে। সেকারণ আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। আবু লাহবের স্ত্রী আরওয়া ওরফে উম্মে জামীল রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিল। সে রাসূল (ﷺ)-এর যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার সম্মুখে কাঁটা ছড়িয়ে বা পুঁতে রাখত। যাতে রাসূল (ﷺ) কষ্ট পান। এই মহিলা ছিল একজন কবি। সে রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলত। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে পাথর খন্ড নিয়ে রাসূল (ﷺ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (ﷺ) সামনে থাকা সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পায়নি। তাই পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসা মূলক কবিতা বলে ফিরে আসে। উক্ত কবিতায় সে ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলে। যেমন مُذَمَّمًا عَصَيْنَا- وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا- وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا ‘নিন্দিতের আমরা নাফরমানী করি। তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি। তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করি’।[13]

আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? জবাবে তিনি বললেন, না, দেখতে পায়নি। আল্লাহ আমার জন্য তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন।[14]

রাসূল (ﷺ) যখন সালাত আদায় করতেন তখন বকরীর নাড়িভুড়ি এমনভাবে ছুঁড়ে মারত যে, সেসব গিয়ে তাঁর গায়ে পড়ত। আবার কখনও কখনও উনুনের ওপর হাঁড়ি চাপানো হ’লে সে হাঁড়িতে নিক্ষেপ করত। রাসূল (ﷺ) তাদের অত্যাচারে ঘরের ভিতরে নিরাপদে সালাত আদায় করার জন্য একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন।[15]

মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিত। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, সে রাতের বেলায় একাজ করত। একদিন সে বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়ে। তখন ফেরেশতা তাকে পিছন থেকে টেনে ধরেন এবং হালাক করে দেয়’ (কুরতুবী)

একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (ﷺ)-এর নিকটবর্তী হয়ে বলল, আমি وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ‘নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সাথী পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি (নাজম ৫৩/১-২) এই আয়াত দু’টিকে অস্বীকার করি বলে একটা হেঁচকা টানে রাসূল (ﷺ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে দিল এবং থুথু নিক্ষেপ করল। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك ‘আল্লাহ তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’। কিছুদিন পরে উতায়বা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে ‘যারক্বা’ (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠল, هو والله يأكلنى كما دعا محمد علىّ ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিল’। পরদিন সকালে বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল।[16] এভাবে আবু লাহাব, তার স্ত্রী আরওয়া ওরফে উম্মে জামীল ও তাদের পুত্র উতায়বার নির্যাতনের প্রতিকার মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই কার্যকর হ’ল।

২. আবু জাহল কর্তৃক অত্যাচার ও পরিণতি : ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু ছিল আবু জাহল। তার মূল নাম আমর ইবনে হিশাম। জাহেলী যুগে তার উপাধি ছিল আবুল হাকাম। অর্থাৎ জ্ঞানের পিতা। তার আচরণের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নাম রাখেন আবু জাহল অর্থাৎ মূর্খের পিতা।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, কুরায়েশ সরদারদের নিকটে একদিন আবু জাহল বলল, মুহাম্মাদ আপনাদের সামনে নিজের চেহারায় ধূলো লাগিয়ে রাখে কি? কুরায়েশদের সরদাররা বলল, হ্যাঁ। আবু জাহল বলল, লাত ও ওয্যার শপথ! আমি যদি তাঁকে এ অবস্থায় দেখি, তবে তাঁর ঘাড় ভেঙ্গে দেব, তাঁর চেহারা মাটিতে হেঁচড়াব। এরপর রাসূল (ﷺ)-কে সালাত আদায় করতে দেখে তাঁর ঘাড় মটকে দেয়ার জন্য সে অগ্রসর হ’ল। কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখল যে, আবু জাহল চিৎপটাং হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছে এবং চিৎকার করে বলছে বাঁচাও বাঁচাও। তার পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আবুল হাকাম তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি দেখলাম, আমার ও মুহাম্মাদের মধ্যখানে আগুনের একটি পরিখা। ভয়াবহ সে আগুনের পরিখায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাসূল (ﷺ) এ কথা শুনে বললেন, যদি সে আমার কাছে আসত, তবে ফেরেশতা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিড়ে ফেলত’।[17]

একবার আবু জাহল বলল, হে কুরায়েশ ভাইয়েরা! তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, মুহাম্মাদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা ও উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না? আমাদের পিতা ও পিতামহকে সারাক্ষণ গালমন্দ করেই চলেছে। এ কারণে আমি আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আমি একটি ভারী পাথর নিয়ে বসে থাকব, মুহাম্মাদ যখন সিজদায় যাবে, তখন সে পাথর দিয়ে তাঁর মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিব। এরপর যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্ত্তত। ইচ্ছে হ’লে তোমরা আমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবে, ইচ্ছে হ’লে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। এরপর আবদে মানাফ আমার সাথে যেরূপ ইচ্ছে ব্যবহার করবে এতে আমার কোন পরোয়া নেই। কুরায়েশরা প্রস্তাব শুনার পর বলল, কোন্ ব্যাপারে আমরা তোমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় ফেলে রেখেছি? তোমাকে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তুমি যা করতে চাও করতে পার। সকালে আবু জাহল একটি ভারী পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অপেক্ষায় বসে থাকল। কুরায়েশরা একে একে সমবেত হয়ে আবু জাহলের তৎপরতা দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে রইল। রাসূল (ﷺ) যথারীতি হাযির হয়ে সালাত আদায় করতে শুরু করলেন। তিনি যখন সিজদায় গেলেন, তখন আবু জাহল পাথর নিয়ে অগ্রসর হ’ল। কিন্তু পরক্ষণে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এলো। তার হাত যেন পাথরের সাথে আটকে রইল। কুরায়েশদের কয়েকজন লোক তার কাছে এসে বলল, আবুল হাকাম! তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম, তা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম, মুহাম্মাদ এবং আমার মাঝখানে একটা উট এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর কসম! অত বড় লম্বা ঘাঁড় ও দাঁতবিশিষ্ট উট আমি কখনো দেখিনি। উটটি আমাকে হামলা করতে অগ্রসর হচ্ছিল। এ ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, উটের ছদ্মবেশে ছিলেন জিবরীল (আঃ)। আবু জাহল যদি কাছে আসত, তবে তাকে পাকড়াও করা হ’ত।[18]

আবু জাহল একদিন ছাফা পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে গালমন্দ করে ও শাসিয়ে দেয়। রাসূল (ﷺ) নীরব রইলেন, কোন কথা বললেন না। এরপর আবু জাহল নবী করীম (ﷺ)-এর মাথায় এক টুকরো পাথর নিক্ষেপ করল। এতে তাঁর মাথা ফেটে রক্ত বের হ’ল। এরপর আবু জাহল কা‘বার সামনে কুরায়েশদের মজলিসে গিয়ে বসল। আব্দুল্লাহ ইবনে জুদয়ানের একজন দাসী এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। ইতিমধ্যে হামযাহ শিকার করে ফিরছিলেন। সেই দাসী তাকে ঘটনা শুনালেন। হামযাহ ঘটনা শুনে ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি ছিলেন কুরায়েশদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক। তিনি দেরী না করে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আবু জাহলকে যেখানে পাব সেখানেই আঘাত করব। এরপর তিনি সোজা কা‘বা ঘরে আবু জাহলের সামনে গিয়ে বললেন, ওরে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু ত্যাগকারী! তুই আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছিস, অথচ আমিও তাঁর প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী?[19] এ কথা বলে হাতের ধনুক দিয়ে আবু জাহলের মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে, মাথায় বড় ধরনের জখম হয়ে গেল। এ ঘটনার সাথে সাথে আবু জাহলের গোত্র বনু মাখযূম এবং হামযাহ (রাঃ)-এর গোত্র বনু হাশেমের লোকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠলো। আবু জাহল সকলকে এই বলে থামিয়ে দিল যে, আবু আমরকে কিছু বল না, আমি তার ভাতিজাকে আসলেই খুব খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছিলাম।[20]

ইয়াসির বনু মাখযূমের ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও পুত্র মুসলমান হন। ফলে তাঁদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, তা অবর্ণনীয়। আবু জাহলের নির্দেশে বনু মাখযূমের এই ক্রীতদাস মুসলিম পরিবারের উপরে নৃশংসতম শাস্তি নেমে আসে। তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে ফেলে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের এই শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, صبرًا يا آل ياسر فإن موعدكم الجنة ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। ইয়াসিরের দুই পায়ে দু’টি রশি বেঁধে দু’দিকে দু’টি উটের পায়ে উক্ত রশির অন্য প্রান্ত বেঁধে দিয়ে উট দু’টিকে দু’দিকে জোরে হাঁকিয়ে নেওয়া হয়। তাতে জোরে হেঁচকা টানে ইয়াসিরের দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি শাহাদতবরণ করেন।[21]

অতঃপর পাষাণ হৃদয় আবু জাহল নিজ হাতে ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম মহিলা শহীদ। অতঃপর তাদের একমাত্র পুত্র আম্মারের উপরে শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতনের পালা। তাকে উত্তপ্ত কংকরময় বালুর উপরে হাত, পা বেঁধে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রেখে নির্যাতন করা হয়। একদিন আম্মারকে পানিতে চুবিয়ে আধামরা অবস্থায় উঠিয়ে বলা হ’ল, তুমি যতক্ষণ মুহাম্মাদকে গালি না দিবে এবং লাত, মানাত ও উযযা দেব-দেবীর প্রশংসা না করবে, ততক্ষণ তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন।

পরেই তিনি রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে গিয়ে কান্না-জড়িত কণ্ঠে সব ঘটনা খুলে বললেন ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-

مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إيْمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيْمَانِ-​

‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার জন্য কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)। পরে আবুবকর (রাঃ) আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরিদ করে নিয়ে মুক্ত করে দেন। আম্মার ঐ সময় আবুবকর (রাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতা বলেন, তার শুরু ছিল নিম্নরূপ :

جزى الله خيرا عن بلال وصحبه + عتيقا وأخزى فاكها وابا جهل​

‘আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দান করুন আবুবকর (রাঃ)-কে বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হ’তে এবং লাঞ্ছিত করুন আবু ফাকীহাহ ও আবু জাহলকে’।[22]

রাসূল (ﷺ) ও তাঁর সাথীদের বিভিন্নভাবে অত্যাচার করার পরিণাম বদর প্রান্তরে এমন ভয়াবহ হবে আবু জাহল তা ভাবতে পারেনি। দুর্বৃত্ত নেতার চারিদিকে ছিল তীর ও তলোয়ার বাহিনীর পাহারা। মুসলিম মুজাহিদের প্রচন্ড হামলায় সেই পাহারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মুসলমানরা লক্ষ্য করলেন যে, আবু জাহল একটি ঘোড়ার পিঠে আরোহী। তার মৃত্যু তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল।

আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, বদর যুদ্ধের দিনে আমি মুসলমানদের কাতারের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখি আমার ডানে ও বামে দু’জন আনছার কিশোর। তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আমি চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ একজন চুপিসারে বলল, চাচাজান আবু জাহল কে? আমাকে দেখিয়ে দিন। আমি বললাম, তুমি তার কি করবে? সে বলল, আমি শুনেছি সে নবী করীম (ﷺ)-কে গালি দিয়ে কষ্ট দেয়। সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জীবন থাকে ততক্ষণ আমি তার সাথে লড়াই করে যাব। বর্নণাকারী (আব্দুর রহমান বিন আওফ) একথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। অন্য আনছার কিশোরও চুপিসারে একই কথা বলল। কয়েক মহূর্ত পরে আমি আবু জাহলকে লোকদের মাঝে বিচরণ করতে দেখলাম। আমি আনছার কিশোরদ্বয়কে বললাম, ঐ দেখো তোমাদের শিকার। এ কথা শুনামাত্র উভয়ে আবু জাহলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে ফেলল।

এরপর তারা নবী করীম (ﷺ)-এর নিকটে এসে উপস্থিত হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আবু জাহলকে হত্যা করেছ? উভয়ে বলল, আমি হত্যা করেছি। তিনি (ﷺ) বললেন, তোমরা কি তলোয়ারের রক্ত মুছে ফেলেছ? তারা বলল, না। নবী করীম (ﷺ) তাদের তলোয়ার দেখে বললেন, তোমরা উভয়েই হত্যা করেছ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু জাহলের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র মু‘আয ইবনে আমর ইবনে জামূহকে প্রদান করলেন। তাদের একজনের নাম ছিল মু‘আয ইবনে আমর ইবনে জামূহ ও অপরজনের নাম মু‘আবিবয ইবনে আফরা।[23]

এরপর নবী করীম (ﷺ) বললেন, চলো আমাকে তার লাশ দেখাও। আমরা রাসূল (ﷺ)-কে আবু জাহলের লাশের নিকটে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, এ হচ্ছে এই উম্মাতের ফেরাঊন।[24]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু জাহল, ওতবা ইবনে রাবী‘আ, শায়বা ইবনে রাবী‘আ, ওয়ালীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং উকবা ইবনে আবু মুঈত্বসহ অন্যান্য কাফেরের নাম ধরে ধরে বদদো‘আ করেছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ﷺ) বায়তুল্লাহর পাশে সালাত আদায় করছিলেন। আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসেছিল। কিছুক্ষণ পর তার নির্দেশে ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই সময় কিভাবে এই দুঃসংবাদ ফাতেমার কানে পৌঁছল। তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে কষ্টকর অবস্থা থেকে রক্ষা করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,

اللَّهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللَّهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللَّهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ ثُمَّ سَمَّى اللَّهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ.​

‘হে আল্লাহ! তুমি কুরায়েশকে ধরো (তিনবার)! হে আল্লাহ! তুমি আমর ইবনে হিশাম অর্থাৎ আবু জাহলকে ধরো। হে আল্লাহ! তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, ওয়ালীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবী মু‘ঈত্ব এবং ওমারাহ বিন অলীদকে ধরো’। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।[25]

৩. খালাফের পুত্রদ্বয়ের কটূক্তি ও নিপীড়ন : উমাইয়া ও উবাই ছিল খালাফের পুত্র। তারা নানাভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দিত। উমাইয়ার অভ্যাস ছিল যে, যখন রাসূল (ﷺ)-কে দেখত, তখনই কটূক্তি করত, তাঁকে অভিশাপ দিত। মহান আল্লাহ বলেন,

وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ​

‘দুর্ভোগ প্রত্যক ঐ ব্যক্তির, যে সামনে ও পিছনে লোকের নিন্দা করে’ (হুমাযাহ ১০৪/১)। ইবনে হিশাম বলেন, হুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগালি করে এবং পশ্চাতে মানুষের নিন্দা করে এবং কষ্ট দেয়।[26]

উমাইয়া ইবনে খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন বেলাল (রাঃ)। ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া বেলালের গলায় দড়ি বেঁধে মক্কার উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত। বালকেরা তাঁকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেত। এরকম করার ফলে তাঁর গলায় দড়ির দাগ পড়ে যেত। উমাইয়া নিজে তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করত। এরপর উত্তপ্ত বালুর উপর জোর করে শুইয়ে রাখত। এ সময়ে তাঁকে অনাহারে রাখা হ’ত। এমনকি কখনো কখনো তাঁকে দুপুরের তীব্র রোদে মরু বালুকার উপর শুইয়ে বুকের উপর ভারী পাথর চাঁপা দিয়ে রাখত।[27]

একবার সা‘দ ইবনে মু‘আয (রাঃ) মক্কায় উমাইয়া ইবনে খালাফকে বলেছিলেন, হে উমাইয়া! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, মুসলমানরা তোমাকে হত্যা করবে। একথা শুনে উমাইয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এ ভয় তার সব সময় ছিল। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কখনও মক্কার বাইরে যাবে না। আবু জাহলের পীড়াপীড়িতে উমাইয়া বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সবচেয়ে দ্রুতগামী উট ক্রয় করে। যাতে করে বিপদের সময় খুব দ্রুত পালিয়ে আসতে পারে। যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সময় তার স্ত্রী তাকে বলছিল, আবু ছাফয়ান! আপনার ইয়াছরেবী ভাই যে কথা বলেছিলেন, আপনি কি সে কথা ভুলে গেছেন? সে বলল, না ভুলিনি, আমি তো ওদের সাথে কিছুদূর যাব।[28]

মক্কায় জাহেলী যুগ থেকেই আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ও উমাইয়া ইবনে খালাফের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। বদর যুদ্ধের দিনে উমাইয়া তার সন্তান আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কয়েকটি বর্ম নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে উমাইয়া বলল, আমি কি তোমার প্রয়োজনে লাগতে পারি? তোমার বর্মগুলোর চেয়ে আমরা উত্তম। আজকের মত দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। তোমাদের কি দুধের প্রয়োজন নেই?[29] এ কথা শুনে আব্দুর রহমান বর্মগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং উমাইয়া ও তার পুত্রকে বন্দী করে সামনের দিকে অগ্রসর হ’লেন।

আব্দুর রহমান ইবনে আওফ বলেন, আমি তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বেলাল (রাঃ) উমাইয়াকে দেখে ফেললেন। তিনি তাকে দেখে বললেন, ওহে কাফেরদের সরদার উমাইয়া ইবনে খালফ! হয় আমি বেঁচে থাকব নতুবা তুমি বেঁচে থাকবে। এরপর উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ওহে আনছাররা! এই দেখো কাফেরদের সরদার উমাইয়া ইবনে খালফ, এবার হয় আমি থাকব নতুবা সে থাকবে।

বর্ণনাকারী বলেন, ততক্ষণে লোকেরা আমাদেরকে ঘিরে ফেললেন। আমি তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু একজন সাহাবী তলোয়ার তুলে উমাইয়ার পুত্র আলীর পায়ে আঘাত করলেন। সাথে সাথে সে ঢলে পড়ল। এদিকে উমাইয়া এমন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে যে, আমি এত বিকট শব্দ কখনও শুনিনি। আমি বললাম, পালাও পালাও। কিন্তু আজতো পালানোর পথ নেই। আল্লাহর শপথ! আজ আমি তোমার কোন উপকারে আসতে পারব না। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, উত্তেজিত সাহাবাগণ উমাইয়া ও তার পুত্র আলীকে ঘিরে ফেলে আঘাতে আঘাতে হত্যা করে ফেলল।[30]

উবাই ইবনে খালাফ উমাইয়ার ভাই। উকবা ইবনে আবু মুঈত্বের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। উকবা উবাইয়ের কথা মত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। উবাই বিন খালাফ নিজে একবার মরা-পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূল (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মুখ ভর্তি হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধে বমি হবার উপক্রম হয়।[31] সে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে দেখে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত এবং হত্যার হুমকিও দিত। নবী করীম (ﷺ) মক্কায় থাকাকালে দেখা হ’লে সে গর্বভরে বলত, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার কাছে ‘আওদ’ নামের একটি ঘোড়া রয়েছে; ওকে আমি প্রতিদিন তিন ছা‘ (সাড়ে সাত কিলোগ্রাম) খাবার খাওয়াচ্ছি। সেই ঘোড়ার পিঠে বসে একদিন আপনাকে হত্যা করব। জবাবে রাসূল (ﷺ) বলতেন, উল্টাও হ’তে পারে। ইনশাআল্লাহ আমিই তোমাকে হত্যা করব।[32]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওহোদের যুদ্ধে ময়দানে পৌঁছার পর উবাই ইবনে খালাফ একথা বলে সামনে অগ্রসর হ’ল যে, মুহাম্মাদ কোথায়? হয়ত আমি থাকব নতুবা তিনি থাকবেন। সাহাবীগণ রাসূল (ﷺ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা কি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? নবী করীম (ﷺ) বললেন, ওকে আসতে দাও। এই দুর্বৃত্ত কাছে এলে রাসূল (ﷺ) হারেছ ইবনে সাম্মার (রাঃ) নিকট থেকে ছোট একটি বর্শা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। এটা ছিল ঠিক তেমনি, যেমন গায়ে মাছি বসলে উট একটুখানি ঝাঁকুনি দেয়, এতে মাছি উড়ে যায়। রাসূল (ﷺ) এরপর উবাইয়ের মুখোমুখি হ’লেন, ইবনে খালাফের শিরস্ত্রাণ ও বর্মের মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা (গলার কাছে) খালি ছিল। নবী করীম (ﷺ) সেই স্থান লক্ষ্য করে হাতের বর্শা নিক্ষেপ করলেন।

এতে উবাই ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল এবং তার মিত্রদের কাছে ফিরে গেল। তার গলার কাছে সামান্য কেটে গিয়েছিল বটে, কিন্তু রক্ত বের হয়নি। আঘাতও তেমন ছিল না। তবুও সে চিৎকার করে বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ আমাকে হত্যা করেছেন। লোকেরা তাকে বলল, কি বাজে বকছ? তোমার আঘাত তো তেমন গুরুতর নয়। গলায় সামান্য আঁচড় লাগার মত দেখা যাচ্ছে। উবাই বলল, তিনি মক্কায় আমাকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে হত্যা করব। কাজেই আল্লাহর শপথ! আমার প্রাণ চলে যাবে।[33]

সে গাভীর মত চিৎকার করে বলত, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! আমি যে যন্ত্রণা অনুভব করছি, সেই কষ্ট-যন্ত্রণা যদি যিল-মাযাযের অধিবাসীরা অনুভব করত, তাহ’লে তারা সবাই মারা যেত।[34] অন্যত্র আছে, সে বারবার বলছিল, মুহাম্মাদ মক্কায় বলছিলেন, আমিই তোমাকে হত্যা করব। তিনি যদি আমাকে থুথুও নিক্ষেপ করতেন, তবুও আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত।[35]

অবশেষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রু উবাই ইবনে খালাফ মক্কায় ফেরার পথে সারিফ নামক স্থানে মারা যায়।[36]


[1]. কাযী সুলাইমান মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল আলামীন, অনুবাদ: ড. মু. মুজীবুর রহমান (রাজশাহী : মুহাম্মদী প্রকাশনী সংস্থা, ১৯৯৭), ১/২২৫ পৃঃ।
[2]. রহমাতুল্লিল আলামীন ১/২২৬ পৃঃ।
[3]. আর-রাহীকুল মাখতূম, ১৭তম সংস্করণ ২০০৫ইং, পৃঃ ৮৬।
[4]. ঐ, পৃঃ ৯৫।
[5]. ঐ, পৃঃ ৮৭।
[6]. বুখারী, মিশকাত হা/৫৭৭৮।
[7]. বুখারী হা/৪৭৭০, ৪৮০১; মুসলিম হা/২০৮।
[8]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, ভাষান্তর: খাদিজা আখতার রেযায়ী (ঢাকা : আল-কোরআন একাডেমী লন্ডন, ১৯৯০), ১১০ পৃঃ।
[9]. সায়্যিদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলাযিল কুর‘আন, (মিশর: আল-মাকতাবাতুল ইসলামী), ৩/২৮২পৃঃ।
[10]. আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬০৬৯, সনদ হাসান; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, সনদ সহীহ।
[11]. সহীহ ইবনু হিববান, হাকেম ২/৬১১; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, সনদ হাসান; তফসীরে কুরতুবী।
[12]. আর-রাহীকুল মাখতূম, ২৫২-২৫৩ পৃঃ।
[13]. বুখারী, মিশকাত হা/৫৭৭৮।
[14]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৩৫-৩৩৬।
[15]. ইবনে হিশাম ১/৪১৬ পৃঃ।
[16]. শায়খ আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ, মুখতাছার সীরাতে রাসূল, ১/১৩৫ পৃঃ।
[17]. মুসলিম হা/২৭৯৭; মিশকাত হা/৫৮৫৬।
[18]. ইবনে হিশাম ১/২৯৮-২৯৯ পৃঃ।
[19]. নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ বছরের শেষ দিকে যিলহজ্জ মাসে হামযাহ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন।
[20]. রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৫৩ পৃঃ; ইবনে হিশাম ১/২৯১-২৯২ পৃঃ।
[21]. ইবনে হিশাম ১/৩২০ পৃঃ।
[22]. সুবুলুল হুদা, ২/৩৬২; সীরাতে ইবনে ইসহাক ১/১৯১।
[23]. মুসলিম হা/১৭৫২; মিশকাত হা/৪০২৮।
[24]. আর-রাহীকুল মাখতূম ২৪৭ পৃঃ।
[25]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূলের আবির্ভাব ও অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
[26]. ইবনে হিশাম ১/৩৫৬-৩৫৭ পৃঃ।
[27]. রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৪৫ পৃঃ।
[28]. বুখারী ২/৫৬৩, আর-রাহীকুল মাখতূম ১৪৮ পৃঃ।
[29]. যে ব্যক্তি আমাকে বন্দী করবে মুক্তিপণ হিসাবে আমি তাকে অনেক দুধেল উটনী দেব।
[30]. আর-রাহীকুল মাখতূম, ২৪৯ পৃঃ।
[31]. ইবনে হিশাম, ১/৩৬১-৩৬২ পৃঃ।
[32]. আর-রাহীকুল মাখতূম, ৪৮ নং টিকা, ৩০৪ পৃঃ।
[33]. যাদুল মা‘আদ, ২/০৭ পৃঃ।
[34]. মুখতাছার সীরাতুর রাসূল, ২৫০ পৃঃ।
[35]. আর-রাহীকুল মাখতূম, ১৪৭ পৃঃ।

[36]. ইবনে হিশাম, ২/৮৪ পৃঃ।


সূত্র: আত-তাহরীক।​
 
Last edited:
Top