Joynal Bin Tofajjal
Student Of Knowledge
Forum Staff
Moderator
Uploader
Exposer
HistoryLover
Salafi User
- Joined
- Nov 25, 2022
- Threads
- 344
- Comments
- 475
- Reactions
- 5,289
- Thread Author
- #1
বিভিন্ন সহিহ হাদিসে এসেছে, দাজ্জাল আগমনের প্রাক্কালে মুসলিমদের সাথে রোমান তথা খ্রিষ্টানদের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হবে। এ যুদ্ধকে ‘মালহামাতুল কুবরা বা রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ’ বলা হয়। রোমানদের সাথে তখন যুদ্ধবন্ধের শান্তিচুক্তি থাকবে মুসলিমদের। মুসলিমরা ও রোমানরা মিলে নিজেদের কমন প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করবে। যুদ্ধে বিজয় লাভের পর তারা ফিরে আসার সময় হঠাৎ একজন খ্রিষ্টান সৈন্য ক্রুশ তুলে ধরে বলবে, ক্রুশের জয় হয়েছে! এতে একজন মুসলিম সৈন্য রেগে যেয়ে খ্রিষ্টানটিকে মেরে ফেলবে। তখন রোমানরা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে সমবেত হবে যুদ্ধের জন্য। রোমানরা আশিটা ঝাণ্ডা নিয়ে বিরাট সৈন্যদল জমা করে ফেলবে, একেকটি ঝাণ্ডার নিচে থাকবে বারো হাজার করে সৈন্য।
সিরিয়ার দামেস্ক নগরীর পাশে সংঘটিতব্য সেই মহাযুদ্ধে মুসলিমরা জানবাজ সৈন্য পাঠাতে থাকবে, যারা সারাদিন যুদ্ধ করে প্রাণ নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারবে না। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ সেই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাবে, এদের তওবা আল্লাহ কবুল করবেন না। আরেক তৃতীয়াংশ যুদ্ধে শহিদ হয়ে যাবে। বাকি এক তৃতীয়াংশ সৈন্য যুদ্ধের চতুর্থ দিনে বিজয় লাভ করবে। তবে যুদ্ধ শেষে দেখা যাবে, কতক গোত্রের লোকসংখ্যা একশো ছিল, অবশিষ্ট রয়েছে কেবল একজন! বিভিন্ন বিশুদ্ধ হাদিস থেকে আমি খুবই সংক্ষেপে মহাযুদ্ধের বিবরণ দিলাম, যাতে আলোচনা বুঝতে সুবিধা হয়। [বিস্তারিত জানতে দেখুন: সহিহ বুখারি, হা: ৩১৬৭; সহিহ মুসলিম, হা: ২৮৯৭-২৮৯৯; আবু দাউদ, হা: ৪২৯২ ও ৪২৯৮; আহমাদ, হা: ১৬৮২৬; শাইখ ইউসুফ আল-ওয়াবিল কৃত আশরাতুস সাআহ, পৃষ্ঠা: ২০৯-২১৪; ড. মুহাম্মাদ গায়িস কৃত আহাদিসু আশরাতিস সাআহ ওয়া ফিকহুহা, পৃষ্ঠা: ৪৩৪-৪৪৩]
বক্তা আবু ত্বহা আদনানের বক্তব্য অনুযায়ী হাদিসে বর্ণিত এই মহাযুদ্ধ হবে পারমাণবিক বোমা দিয়ে। সোজাকথায় নিউক্লিয়ার ওয়ার বা পারমাণবিক যুদ্ধ হবে। আবু ত্বহা আদনান সাহেব বলেছে, “এটাতে নবিজি বলেছেন, এই যুদ্ধের নাম হচ্ছে মালহামা। এবং এই মালহামায় প্রতি একশজন সৈন্যের মধ্যে নাইন্টি নাইন পারসেন্ট সৈন্য মারা যাবে। তারমানে এটা হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধ, যেটা সামনে আসতে যাচ্ছে। নিউক্লিয়ার ওয়ার ইজ কামিং।” [দ্রষ্টব্য: https://youtu.be/G0Ccp4Veo3g (১:৪৯ মিনিট থেকে ২:০৫ মিনিট)]
আবু ত্বহা আদনান আরেক বক্তব্যে বলেছে, “মালহামা হচ্ছে এমন যুদ্ধ, যেই যুদ্ধে একশজন সৈনিকের মধ্যে নিরানব্বইজন সৈনিক মারা যাবে। নবিজি বলেছেন, এই মালহামায় আশিটা দেশ একত্রিত হবে, আশিটা পতাকা, মানে আশিটা দেশ। এবং প্রত্যেক পতাকার নিচে থাকবে বারো হাজার করে সৈন্য। এবং এই যুদ্ধে এমনকিছু অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, যা বিশ্ববাসী কখনো দেখেনি। একেকটা করে পারমাণবিক বোমা পড়বে, আর একটা করে দেশ ডেস্ট্রয় হয়ে যাবে।” [দেখুন: https://youtu.be/zPs_EVIKI_E (০:৩১ মিনিট থেকে ১:১৩ মিনিট)]
আরেক বক্তব্যে কেয়ামতের একটি বড়ো আলামত ব্যাপক ধোঁয়ার প্রকাশকে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মাশরুম-আকৃতির মেঘের সাথে তুলনা করে বলেছে, এ থেকে বোঝা যায়, মালহামা হবে পারমাণবিক বোমা দিয়ে! [দেখুন: https://youtu.be/TAnt5NNHXMk (শুরু থেকে ১:৩০ মিনিট)] এছাড়াও আরও কয়েকটি বক্তব্যে আবু ত্বহা আদনান পরমাণু দিয়ে মালহামা হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছে এবং স্পষ্টভাবেই বলেছে, এই যুদ্ধ কোনো প্রচলিত যুদ্ধ হবে না, পারমাণবিক যুদ্ধ হবে। এরকম কয়েকটি বক্তব্যের ইউটিউব লিংক আমি দিয়ে দিচ্ছি নিচে।
১. https://youtu.be/hEBD6kmxO2s (১৪:৪৭ মিনিট থেকে ১৫:১৪ মিনিট)
২. https://youtu.be/vkgq45QV7GU (৪ মিনিট থেকে)
৩. https://youtu.be/Y7XCauV_078 (১৭ মিনিট থেকে)
হাদিসে বর্ণিত ঘটিতব্য মালহামা গায়েবি বিষয়ের অন্তর্গত। এসব বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর বিনা দলিলে কথা বলা অপরাধ। ইমাম হামুদ আত-তুওয়াইজিরি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪১৩ হি.) বলেছেন, إن الإيمان بأنباء الغيب ليس مقصورًا على الأشياء التي تقع في زمان الإنسان، بل يجب الإيمان بكل ما جاء في الكتاب والسنة من أنباء الغيب، ما كان من ذلك فيما مضى من الزمان وما سيكون من ذلك في المستقبل، ومنه أحاديث الفتن والملاحم وأشراط الساعة “গায়েবি সংবাদের প্রতি ইমান রাখা সেসব বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেগুলো মানুষের সামসময়িক যুগে সংঘটিত হয়। বরং কুরআন-সুন্নাহয় গায়েবি সংবাদের যত বিষয় বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোর প্রতি ইমান রাখা ওয়াজিব। এসবের কতকগুলো পূর্ববর্তী যুগে গত হয়ে গেছে এবং কতকগুলো বিষয়ে ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে। নানাবিধ ফিতনা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ এবং কেয়ামতের আলামতসমূহ গায়েবি বিষয়েরই অন্তর্গত।” [হামুদ আত-তুওয়াইজিরি কৃত আল-ইহতিজাজ বিল আসার আলা মান আনকারাল মাহদিয়্যাল মুনতাযার, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২০১; গ্রন্থটির প্রশংসা-সূচনা লিখেছেন সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ; আর-রিয়াসাতুল আম্মাহ লি ইদারাতিল বুহুসিল ইলমিয়্যা (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪০৩ হি./১৯৮৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
কেউ বলতে পারেন, আবু ত্বহা আদনান ধোঁয়ার হাদিস থেকে গবেষণা করে বের করেছে, মালহামা হবে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে। এর জবাব হচ্ছে, মালহামার ব্যাপারে বর্ণিত কোনো হাদিসে পুরো আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়নি। তবে হ্যাঁ, আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়ার কথা স্বতন্ত্র হাদিসে এসেছে। এটা কেয়ামতের একটি বড়ো আলামত। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ السَّاعَةَ لاَ تَكُونُ حَتَّى تَكُونَ عَشْرُ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنٍ تَرْحَلُ النَّاسَ “ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না দশটি বিশেষ আলামত প্রকাশিত হবে। পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে ভূমিধ্বস, পশ্চিমপ্রান্তে ভূমিধ্বস, আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়া, দাজ্জালের আবির্ভাব, দাব্বাতুল আরদ তথা বিশেষ জন্তুর প্রকাশ, ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় এবং আদন অঞ্চলের প্রান্ত হতে আগুন নির্গমিত হওয়া যা লোকেদেরকে তাড়িয়ে এক স্থানে একত্রিত করবে।” বর্ণনাকারী দশম আরেকটি আলামত হিসেবে বলেছেন, ইসা আলাইহিস সালামের আগমন। [সহিহ মুসলিম, হা: ২৯০১; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ১৩]
আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়ার কথা কুরআনে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِينٍ * يَغْشَى النَّاسَ ۖ هَٰذَا عَذَابٌ أَلِيمٌ “অতএব তুমি অপেক্ষা কর সেই দিনের, যেদিন স্পষ্ট ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবে আকাশ এবং তা আবৃত করে ফেলবে পুরো মানবজাতিকে। এটা হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সুরা দুখান: ১০-১১] কিন্তু কেয়ামতের এই বড়ো আলামতের সাথে মালহামার সম্পর্ক আছে, এমন কথা হাদিসে বিবৃত হয়নি। সুতরাং বিনা দলিলে একটার সাথে অপরটিকে জোড়া লাগিয়ে গায়েবি বিষয়ে গবেষণাপ্রসূত মন্তব্য করে বক্তা আদনান বাতিল কাজ করেছে এবং জনমানুষকেও বাতিল কথা শিখিয়েছে।
আগামীতে ঘটিতব্য যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কে যে গবেষণা করে মত প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই, তা আমরা ইতঃপূর্বে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আবারও আলোচনাটি করতে হচ্ছে। যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮৫২ হি.) বলেছেন, والحق أن ضابط ما يخبره الصحابي إن كان مما لا مجال فيه للاجتهاد ولا منقول عن لسان العرب فحكمه الرفع وإلا فلا، كالإخبار عن الأمور الماضية من بدء الخلق وقصص الأنبياء وعن الأمور الآتية كالملاحم والفتن والبعث وصفة الجنة والنار والأخبار فهذه أشياء لا مجال للاجتهاد فيها “বাস্তবিক অর্থে একজন সাহাবির বক্তব্য যদি এমন বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত হয়, যেসব বিষয়ে ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার সুযোগ নেই এবং যেসব বিষয় আরবি ভাষা থেকেও বর্ণিত নয়, তাহলে সেই বক্তব্য মারফু (নবিজির প্রত্যক্ষ বক্তব্য এমন) হাদিসের মর্যাদা পাবে। অন্যথায় উক্ত মর্যাদা পাবে না। যেমন সৃষ্টির সূচনা ও নবিদের কাহিনীর মতো অতীতের ঘটনাবলি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হয়। আবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ, নানাবিধ ফিতনা, পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম, এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রভৃতির মতো আসন্ন বিষয়াবলি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হয়। এগুলো এমনসব বিষয়, যাতে গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার কোনো সুযোগ নেই।” [ইবনু হাজার বিরচিত আন-নুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৮৬; তাহকিক: শাইখ রাবি আল-মাদখালি; প্রকাশকাল: ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
হাফিয ইবনু হাজার আল-আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ এ ধরনের কথা নুখবাতুল ফিকারের ভাষ্যগ্রন্থেও বলেছেন। [দেখুন: ইবনু হাজার কৃত নুযহাতুন নাযর ফি তাওদিহি নুখবাতিল ফিকার, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১২৭; তাহকিক: ড. আব্দুল্লাহ আর-রুহাইলি; প্রকাশকাল: ১৪২৯ হি./২০০৮ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]
মক্কার মুহাদ্দিস ইমাম হামুদ আত-তুওয়াইজিরি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪১৩ হি.) বলেছেন, إن الأمور الغيبية لا تعلم بالاجتهاد ولا يسوغ الاجتهاد فيها، وإنما تعلم بخبر الصادق المصدوق -صلوات الله وسلامه عليه-، ومن هذا الباب خروج المهدي في آخر الزمان، وما سيقع فيه أيضًا من الفتن والملاحم وأشراط الساعة، فكل هذا لا مجال للاجتهاد فيه، وإنما يعتمد فيه على الأحاديث الثابتة عن النبي ﷺ “গায়েবি বিষয় ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে জানা যায় না এবং এসব বিষয়ে গবেষণা করে মত ব্যক্ত করাও বৈধ নয়। বরং সত্যায়িত সত্যবাদী রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংবাদের মাধ্যমেই কেবল গায়েবি বিষয় জানা যায়। শেষযুগে মাহদির আগমন, ঘটিতব্য নানাবিধ ফিতনা, যুদ্ধবিগ্রহ ও কেয়ামতের নিদর্শনাবলি এ বিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর কোনো বিষয়েই ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হবে কেবল নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হাদিসের ওপর।” [হামুদ আত-তুওয়াইজিরি কৃত আল-ইহতিজাজ বিল আসার আলা মান আনকারাল মাহদিয়্যাল মুনতাযার, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩০১]
সুপ্রিয় পাঠক, প্রশ্ন আসতে পারে, হাদিসে বর্ণিত মহাযুদ্ধ কি তাহলে ঢাল-তলোয়ারের চিরাচরিত যুদ্ধ হবে? এর উত্তরে আমরা বলব, আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হবে। তবে মালহামাতুল কুবরা তথা মহাযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উক্ত যুদ্ধে ঘোড়ায় আরোহণ করা হবে এবং তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুকের মতো প্রাচীন অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।
যেমন মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র মুসলিম সৈন্যদের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে যেয়ে সাহাবি ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ سَمِعُوا بِبَأْسٍ هُوَ أَكْبَرُ مِنْ ذَلِكَ فَجَاءَهُمُ الصَّرِيخُ إِنَّ الدَّجَّالَ قَدْ خَلَفَهُمْ فِي ذَرَارِيِّهِمْ فَيَرْفُضُونَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ وَيُقْبِلُونَ فَيَبْعَثُونَ عَشَرَةَ فَوَارِسَ طَلِيعَةً . قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : إِنِّي لأَعْرِفُ أَسْمَاءَهُمْ وَأَسْمَاءَ آبَائِهِمْ وَأَلْوَانَ خُيُولِهِمْ هُمْ خَيْرُ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الأَرْضِ يَوْمَئِذٍ “এমতাবস্থায় মুসলিমগণ আরেকটি ভয়ানক বিপদের খবর শুনতে পাবে এবং এ মর্মে একটি আওয়াজ তাদের কাছে পৌছবে যে, দাজ্জাল তাদের পেছনে তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ সংবাদ শুনেই তারা হাতের সমস্ত কিছু ফেলে দিয়ে রওয়ানা হয়ে যাবে এবং দশজন অশ্বারোহী ব্যক্তিকে সংবাদ-সংগ্রাহক দল হিসেবে প্রেরণ করবে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের খবর সংগ্রাহক দলের প্রতিটি লোকের নাম, তাদের পূর্বসূরির নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি। এ পৃথিবীর সর্বোত্তম অশ্বারোহী দল সেদিন তারাই হবে।” [সহিহ মুসলিম, হা: ২৯০১; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ১১]
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহাযুদ্ধের বিবরণ দিতে যেয়ে একপর্যায়ে বলেছেন, فَيُقَاتِلُونَهُمْ فَيَنْهَزِمُ ثُلُثٌ لاَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ أَبَدًا، وَيُقْتَلُ ثُلُثُهُمْ أَفْضَلُ الشُّهَدَاءِ عِنْدَ اللَّهِ، وَيَفْتَتِحُ الثُّلُثُ لاَ يُفْتَنُونَ أَبَدًا فَيَفْتَتِحُونَ قُسْطُنْطِينِيَّةَ. فَبَيْنَمَا هُمْ يَقْتَسِمُونَ الْغَنَائِمَ قَدْ عَلَّقُوا سُيُوفَهُمْ بِالزَّيْتُونِ إِذْ صَاحَ فِيهِمُ الشَّيْطَانُ إِنَّ الْمَسِيحَ قَدْ خَلَفَكُمْ فِي أَهْلِيكُمْ، فَيَخْرُجُونَ “পরিশেষে রোমানদের সাথে মুসলিমরা যুদ্ধ করবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশ সৈন্য পালিয়ে যাবে। আল্লাহ কক্ষনো তাদের তওবা গ্রহণ করবেন না। সৈন্যদের এক তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহর কাছে শহিদ ব্যক্তিবর্গের মাঝে সর্বোত্তম শহিদ। আর সৈন্যদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয়ী হবে। জীবনে আর কক্ষনো তারা ফিতনায় আক্রান্ত হবে না। তারাই কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। সৈন্যরা নিজেদের তলোয়ার জয়তুন বৃক্ষে লটকিয়ে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগ করতে থাকবে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে শয়তান উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকবে, ‘দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে।’ এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়বে।” [সহিহ মুসলিম, হা: ২৮৯৭; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ৯]
এরকম আরও হাদিস আছে। আমি কলেবর সংক্ষেপের জন্য সেগুলো উল্লেখ করছি না। মদিনার বিশিষ্ট ফাকিহ বিদ্বান, আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ এ বিষয়ে আলোচনা করতে যেয়ে বলেছেন, “রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দাজ্জালের খবর সংগ্রাহক দলের প্রতিটি লোকের নাম, তাদের পূর্বসূরির নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি।’ ভাইয়েরা, হাদিসের এই বাক্যটি থেকে প্রতিপন্ন হয়, যুদ্ধবিগ্রহ আবারও পূর্বের মতো ঘোড়ায় চড়ে সম্পন্ন হবে। কেয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালে কল্যাণ যুক্ত থাকবে। ভাইয়েরা, হাদিস থেকে এটাও বোঝা যায় যে, আমরা এই যুগে যেসব ডিভাইসের মাঝে আছি এবং এসব প্রত্যক্ষ করছি, এগুলো সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পুরো বিষয় এসব ডিভাইস ও ইন্সট্রুমেন্ট ব্যতিরেকে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে; যেমন: মোবাইল, কার, সাঁজোয়াযান প্রভৃতি।
কেননা রোমানদের সাথে যুদ্ধকারী মুসলিমদের কাছে যখন দাজ্জাল বের হওয়ার খবর আসবে, তখন তারা কী করবে? তারা ফিরে যাবে এবং সংবাদ-সংগ্রাহক দল পাঠাবে। এর মানে তাঁদের কাছে এমনকিছু থাকবে না, যা দিয়ে সংবাদ জানা যায়। এতদ্ব্যতীত তারা অশ্বারোহী হবে। এর মানে তাঁদের কাছে এসব মেশিনারিজ থাকবে না। এটা স্পষ্ট-প্রকাশ্য বিষয়। সুতরাং যুদ্ধবিগ্রহ আগের মতো ঘোড়া, তরবারি, তীর-ধনুক ও বর্শা দিয়ে সম্পন্ন হবে এবং এসব ডিভাইস ও মেশিনারিজ ধ্বংস হয়ে যাবে।” [দেখুন: https://youtu.be/KITcKvEFz5w]
এ আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হলো, বিভিন্ন বক্তব্যে আবু ত্বহা আদনানের ব্যক্তীকৃত— ‘হাদিসে বর্ণিত মালহামা হবে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে’ – কথাটি বাতিল। কারণ এসব গায়েবি বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর বাইরে নিজে থেকে গবেষণা করে মত প্রকাশ করা যায় না। আল্লাহ আমাদের সুমতি দিন। আমিন।
সিরিয়ার দামেস্ক নগরীর পাশে সংঘটিতব্য সেই মহাযুদ্ধে মুসলিমরা জানবাজ সৈন্য পাঠাতে থাকবে, যারা সারাদিন যুদ্ধ করে প্রাণ নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারবে না। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ সেই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাবে, এদের তওবা আল্লাহ কবুল করবেন না। আরেক তৃতীয়াংশ যুদ্ধে শহিদ হয়ে যাবে। বাকি এক তৃতীয়াংশ সৈন্য যুদ্ধের চতুর্থ দিনে বিজয় লাভ করবে। তবে যুদ্ধ শেষে দেখা যাবে, কতক গোত্রের লোকসংখ্যা একশো ছিল, অবশিষ্ট রয়েছে কেবল একজন! বিভিন্ন বিশুদ্ধ হাদিস থেকে আমি খুবই সংক্ষেপে মহাযুদ্ধের বিবরণ দিলাম, যাতে আলোচনা বুঝতে সুবিধা হয়। [বিস্তারিত জানতে দেখুন: সহিহ বুখারি, হা: ৩১৬৭; সহিহ মুসলিম, হা: ২৮৯৭-২৮৯৯; আবু দাউদ, হা: ৪২৯২ ও ৪২৯৮; আহমাদ, হা: ১৬৮২৬; শাইখ ইউসুফ আল-ওয়াবিল কৃত আশরাতুস সাআহ, পৃষ্ঠা: ২০৯-২১৪; ড. মুহাম্মাদ গায়িস কৃত আহাদিসু আশরাতিস সাআহ ওয়া ফিকহুহা, পৃষ্ঠা: ৪৩৪-৪৪৩]
বক্তা আবু ত্বহা আদনানের বক্তব্য অনুযায়ী হাদিসে বর্ণিত এই মহাযুদ্ধ হবে পারমাণবিক বোমা দিয়ে। সোজাকথায় নিউক্লিয়ার ওয়ার বা পারমাণবিক যুদ্ধ হবে। আবু ত্বহা আদনান সাহেব বলেছে, “এটাতে নবিজি বলেছেন, এই যুদ্ধের নাম হচ্ছে মালহামা। এবং এই মালহামায় প্রতি একশজন সৈন্যের মধ্যে নাইন্টি নাইন পারসেন্ট সৈন্য মারা যাবে। তারমানে এটা হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধ, যেটা সামনে আসতে যাচ্ছে। নিউক্লিয়ার ওয়ার ইজ কামিং।” [দ্রষ্টব্য: https://youtu.be/G0Ccp4Veo3g (১:৪৯ মিনিট থেকে ২:০৫ মিনিট)]
আবু ত্বহা আদনান আরেক বক্তব্যে বলেছে, “মালহামা হচ্ছে এমন যুদ্ধ, যেই যুদ্ধে একশজন সৈনিকের মধ্যে নিরানব্বইজন সৈনিক মারা যাবে। নবিজি বলেছেন, এই মালহামায় আশিটা দেশ একত্রিত হবে, আশিটা পতাকা, মানে আশিটা দেশ। এবং প্রত্যেক পতাকার নিচে থাকবে বারো হাজার করে সৈন্য। এবং এই যুদ্ধে এমনকিছু অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, যা বিশ্ববাসী কখনো দেখেনি। একেকটা করে পারমাণবিক বোমা পড়বে, আর একটা করে দেশ ডেস্ট্রয় হয়ে যাবে।” [দেখুন: https://youtu.be/zPs_EVIKI_E (০:৩১ মিনিট থেকে ১:১৩ মিনিট)]
আরেক বক্তব্যে কেয়ামতের একটি বড়ো আলামত ব্যাপক ধোঁয়ার প্রকাশকে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মাশরুম-আকৃতির মেঘের সাথে তুলনা করে বলেছে, এ থেকে বোঝা যায়, মালহামা হবে পারমাণবিক বোমা দিয়ে! [দেখুন: https://youtu.be/TAnt5NNHXMk (শুরু থেকে ১:৩০ মিনিট)] এছাড়াও আরও কয়েকটি বক্তব্যে আবু ত্বহা আদনান পরমাণু দিয়ে মালহামা হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছে এবং স্পষ্টভাবেই বলেছে, এই যুদ্ধ কোনো প্রচলিত যুদ্ধ হবে না, পারমাণবিক যুদ্ধ হবে। এরকম কয়েকটি বক্তব্যের ইউটিউব লিংক আমি দিয়ে দিচ্ছি নিচে।
১. https://youtu.be/hEBD6kmxO2s (১৪:৪৭ মিনিট থেকে ১৫:১৪ মিনিট)
২. https://youtu.be/vkgq45QV7GU (৪ মিনিট থেকে)
৩. https://youtu.be/Y7XCauV_078 (১৭ মিনিট থেকে)
হাদিসে বর্ণিত ঘটিতব্য মালহামা গায়েবি বিষয়ের অন্তর্গত। এসব বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর বিনা দলিলে কথা বলা অপরাধ। ইমাম হামুদ আত-তুওয়াইজিরি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪১৩ হি.) বলেছেন, إن الإيمان بأنباء الغيب ليس مقصورًا على الأشياء التي تقع في زمان الإنسان، بل يجب الإيمان بكل ما جاء في الكتاب والسنة من أنباء الغيب، ما كان من ذلك فيما مضى من الزمان وما سيكون من ذلك في المستقبل، ومنه أحاديث الفتن والملاحم وأشراط الساعة “গায়েবি সংবাদের প্রতি ইমান রাখা সেসব বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেগুলো মানুষের সামসময়িক যুগে সংঘটিত হয়। বরং কুরআন-সুন্নাহয় গায়েবি সংবাদের যত বিষয় বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোর প্রতি ইমান রাখা ওয়াজিব। এসবের কতকগুলো পূর্ববর্তী যুগে গত হয়ে গেছে এবং কতকগুলো বিষয়ে ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে। নানাবিধ ফিতনা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ এবং কেয়ামতের আলামতসমূহ গায়েবি বিষয়েরই অন্তর্গত।” [হামুদ আত-তুওয়াইজিরি কৃত আল-ইহতিজাজ বিল আসার আলা মান আনকারাল মাহদিয়্যাল মুনতাযার, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২০১; গ্রন্থটির প্রশংসা-সূচনা লিখেছেন সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ; আর-রিয়াসাতুল আম্মাহ লি ইদারাতিল বুহুসিল ইলমিয়্যা (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪০৩ হি./১৯৮৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
কেউ বলতে পারেন, আবু ত্বহা আদনান ধোঁয়ার হাদিস থেকে গবেষণা করে বের করেছে, মালহামা হবে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে। এর জবাব হচ্ছে, মালহামার ব্যাপারে বর্ণিত কোনো হাদিসে পুরো আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়নি। তবে হ্যাঁ, আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়ার কথা স্বতন্ত্র হাদিসে এসেছে। এটা কেয়ামতের একটি বড়ো আলামত। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ السَّاعَةَ لاَ تَكُونُ حَتَّى تَكُونَ عَشْرُ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنٍ تَرْحَلُ النَّاسَ “ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না দশটি বিশেষ আলামত প্রকাশিত হবে। পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে ভূমিধ্বস, পশ্চিমপ্রান্তে ভূমিধ্বস, আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়া, দাজ্জালের আবির্ভাব, দাব্বাতুল আরদ তথা বিশেষ জন্তুর প্রকাশ, ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় এবং আদন অঞ্চলের প্রান্ত হতে আগুন নির্গমিত হওয়া যা লোকেদেরকে তাড়িয়ে এক স্থানে একত্রিত করবে।” বর্ণনাকারী দশম আরেকটি আলামত হিসেবে বলেছেন, ইসা আলাইহিস সালামের আগমন। [সহিহ মুসলিম, হা: ২৯০১; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ১৩]
আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়ার কথা কুরআনে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِينٍ * يَغْشَى النَّاسَ ۖ هَٰذَا عَذَابٌ أَلِيمٌ “অতএব তুমি অপেক্ষা কর সেই দিনের, যেদিন স্পষ্ট ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবে আকাশ এবং তা আবৃত করে ফেলবে পুরো মানবজাতিকে। এটা হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সুরা দুখান: ১০-১১] কিন্তু কেয়ামতের এই বড়ো আলামতের সাথে মালহামার সম্পর্ক আছে, এমন কথা হাদিসে বিবৃত হয়নি। সুতরাং বিনা দলিলে একটার সাথে অপরটিকে জোড়া লাগিয়ে গায়েবি বিষয়ে গবেষণাপ্রসূত মন্তব্য করে বক্তা আদনান বাতিল কাজ করেছে এবং জনমানুষকেও বাতিল কথা শিখিয়েছে।
আগামীতে ঘটিতব্য যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কে যে গবেষণা করে মত প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই, তা আমরা ইতঃপূর্বে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আবারও আলোচনাটি করতে হচ্ছে। যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৮৫২ হি.) বলেছেন, والحق أن ضابط ما يخبره الصحابي إن كان مما لا مجال فيه للاجتهاد ولا منقول عن لسان العرب فحكمه الرفع وإلا فلا، كالإخبار عن الأمور الماضية من بدء الخلق وقصص الأنبياء وعن الأمور الآتية كالملاحم والفتن والبعث وصفة الجنة والنار والأخبار فهذه أشياء لا مجال للاجتهاد فيها “বাস্তবিক অর্থে একজন সাহাবির বক্তব্য যদি এমন বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত হয়, যেসব বিষয়ে ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার সুযোগ নেই এবং যেসব বিষয় আরবি ভাষা থেকেও বর্ণিত নয়, তাহলে সেই বক্তব্য মারফু (নবিজির প্রত্যক্ষ বক্তব্য এমন) হাদিসের মর্যাদা পাবে। অন্যথায় উক্ত মর্যাদা পাবে না। যেমন সৃষ্টির সূচনা ও নবিদের কাহিনীর মতো অতীতের ঘটনাবলি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হয়। আবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ, নানাবিধ ফিতনা, পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম, এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রভৃতির মতো আসন্ন বিষয়াবলি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হয়। এগুলো এমনসব বিষয়, যাতে গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার কোনো সুযোগ নেই।” [ইবনু হাজার বিরচিত আন-নুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৮৬; তাহকিক: শাইখ রাবি আল-মাদখালি; প্রকাশকাল: ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
হাফিয ইবনু হাজার আল-আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ এ ধরনের কথা নুখবাতুল ফিকারের ভাষ্যগ্রন্থেও বলেছেন। [দেখুন: ইবনু হাজার কৃত নুযহাতুন নাযর ফি তাওদিহি নুখবাতিল ফিকার, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১২৭; তাহকিক: ড. আব্দুল্লাহ আর-রুহাইলি; প্রকাশকাল: ১৪২৯ হি./২০০৮ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]
মক্কার মুহাদ্দিস ইমাম হামুদ আত-তুওয়াইজিরি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪১৩ হি.) বলেছেন, إن الأمور الغيبية لا تعلم بالاجتهاد ولا يسوغ الاجتهاد فيها، وإنما تعلم بخبر الصادق المصدوق -صلوات الله وسلامه عليه-، ومن هذا الباب خروج المهدي في آخر الزمان، وما سيقع فيه أيضًا من الفتن والملاحم وأشراط الساعة، فكل هذا لا مجال للاجتهاد فيه، وإنما يعتمد فيه على الأحاديث الثابتة عن النبي ﷺ “গায়েবি বিষয় ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে জানা যায় না এবং এসব বিষয়ে গবেষণা করে মত ব্যক্ত করাও বৈধ নয়। বরং সত্যায়িত সত্যবাদী রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংবাদের মাধ্যমেই কেবল গায়েবি বিষয় জানা যায়। শেষযুগে মাহদির আগমন, ঘটিতব্য নানাবিধ ফিতনা, যুদ্ধবিগ্রহ ও কেয়ামতের নিদর্শনাবলি এ বিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর কোনো বিষয়েই ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে মত ব্যক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হবে কেবল নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হাদিসের ওপর।” [হামুদ আত-তুওয়াইজিরি কৃত আল-ইহতিজাজ বিল আসার আলা মান আনকারাল মাহদিয়্যাল মুনতাযার, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩০১]
সুপ্রিয় পাঠক, প্রশ্ন আসতে পারে, হাদিসে বর্ণিত মহাযুদ্ধ কি তাহলে ঢাল-তলোয়ারের চিরাচরিত যুদ্ধ হবে? এর উত্তরে আমরা বলব, আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হবে। তবে মালহামাতুল কুবরা তথা মহাযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উক্ত যুদ্ধে ঘোড়ায় আরোহণ করা হবে এবং তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুকের মতো প্রাচীন অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।
যেমন মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র মুসলিম সৈন্যদের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে যেয়ে সাহাবি ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ سَمِعُوا بِبَأْسٍ هُوَ أَكْبَرُ مِنْ ذَلِكَ فَجَاءَهُمُ الصَّرِيخُ إِنَّ الدَّجَّالَ قَدْ خَلَفَهُمْ فِي ذَرَارِيِّهِمْ فَيَرْفُضُونَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ وَيُقْبِلُونَ فَيَبْعَثُونَ عَشَرَةَ فَوَارِسَ طَلِيعَةً . قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : إِنِّي لأَعْرِفُ أَسْمَاءَهُمْ وَأَسْمَاءَ آبَائِهِمْ وَأَلْوَانَ خُيُولِهِمْ هُمْ خَيْرُ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الأَرْضِ يَوْمَئِذٍ “এমতাবস্থায় মুসলিমগণ আরেকটি ভয়ানক বিপদের খবর শুনতে পাবে এবং এ মর্মে একটি আওয়াজ তাদের কাছে পৌছবে যে, দাজ্জাল তাদের পেছনে তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ সংবাদ শুনেই তারা হাতের সমস্ত কিছু ফেলে দিয়ে রওয়ানা হয়ে যাবে এবং দশজন অশ্বারোহী ব্যক্তিকে সংবাদ-সংগ্রাহক দল হিসেবে প্রেরণ করবে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের খবর সংগ্রাহক দলের প্রতিটি লোকের নাম, তাদের পূর্বসূরির নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি। এ পৃথিবীর সর্বোত্তম অশ্বারোহী দল সেদিন তারাই হবে।” [সহিহ মুসলিম, হা: ২৯০১; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ১১]
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহাযুদ্ধের বিবরণ দিতে যেয়ে একপর্যায়ে বলেছেন, فَيُقَاتِلُونَهُمْ فَيَنْهَزِمُ ثُلُثٌ لاَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ أَبَدًا، وَيُقْتَلُ ثُلُثُهُمْ أَفْضَلُ الشُّهَدَاءِ عِنْدَ اللَّهِ، وَيَفْتَتِحُ الثُّلُثُ لاَ يُفْتَنُونَ أَبَدًا فَيَفْتَتِحُونَ قُسْطُنْطِينِيَّةَ. فَبَيْنَمَا هُمْ يَقْتَسِمُونَ الْغَنَائِمَ قَدْ عَلَّقُوا سُيُوفَهُمْ بِالزَّيْتُونِ إِذْ صَاحَ فِيهِمُ الشَّيْطَانُ إِنَّ الْمَسِيحَ قَدْ خَلَفَكُمْ فِي أَهْلِيكُمْ، فَيَخْرُجُونَ “পরিশেষে রোমানদের সাথে মুসলিমরা যুদ্ধ করবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশ সৈন্য পালিয়ে যাবে। আল্লাহ কক্ষনো তাদের তওবা গ্রহণ করবেন না। সৈন্যদের এক তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহর কাছে শহিদ ব্যক্তিবর্গের মাঝে সর্বোত্তম শহিদ। আর সৈন্যদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয়ী হবে। জীবনে আর কক্ষনো তারা ফিতনায় আক্রান্ত হবে না। তারাই কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। সৈন্যরা নিজেদের তলোয়ার জয়তুন বৃক্ষে লটকিয়ে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগ করতে থাকবে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে শয়তান উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকবে, ‘দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে।’ এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়বে।” [সহিহ মুসলিম, হা: ২৮৯৭; বিভিন্ন ফিতনা ও কেয়ামতের আলামত অধ্যায় (৫৪); পরিচ্ছেদ: ৯]
এরকম আরও হাদিস আছে। আমি কলেবর সংক্ষেপের জন্য সেগুলো উল্লেখ করছি না। মদিনার বিশিষ্ট ফাকিহ বিদ্বান, আল্লামা সুলাইমান আর-রুহাইলি হাফিযাহুল্লাহ এ বিষয়ে আলোচনা করতে যেয়ে বলেছেন, “রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দাজ্জালের খবর সংগ্রাহক দলের প্রতিটি লোকের নাম, তাদের পূর্বসূরির নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি।’ ভাইয়েরা, হাদিসের এই বাক্যটি থেকে প্রতিপন্ন হয়, যুদ্ধবিগ্রহ আবারও পূর্বের মতো ঘোড়ায় চড়ে সম্পন্ন হবে। কেয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালে কল্যাণ যুক্ত থাকবে। ভাইয়েরা, হাদিস থেকে এটাও বোঝা যায় যে, আমরা এই যুগে যেসব ডিভাইসের মাঝে আছি এবং এসব প্রত্যক্ষ করছি, এগুলো সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পুরো বিষয় এসব ডিভাইস ও ইন্সট্রুমেন্ট ব্যতিরেকে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে; যেমন: মোবাইল, কার, সাঁজোয়াযান প্রভৃতি।
কেননা রোমানদের সাথে যুদ্ধকারী মুসলিমদের কাছে যখন দাজ্জাল বের হওয়ার খবর আসবে, তখন তারা কী করবে? তারা ফিরে যাবে এবং সংবাদ-সংগ্রাহক দল পাঠাবে। এর মানে তাঁদের কাছে এমনকিছু থাকবে না, যা দিয়ে সংবাদ জানা যায়। এতদ্ব্যতীত তারা অশ্বারোহী হবে। এর মানে তাঁদের কাছে এসব মেশিনারিজ থাকবে না। এটা স্পষ্ট-প্রকাশ্য বিষয়। সুতরাং যুদ্ধবিগ্রহ আগের মতো ঘোড়া, তরবারি, তীর-ধনুক ও বর্শা দিয়ে সম্পন্ন হবে এবং এসব ডিভাইস ও মেশিনারিজ ধ্বংস হয়ে যাবে।” [দেখুন: https://youtu.be/KITcKvEFz5w]
এ আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হলো, বিভিন্ন বক্তব্যে আবু ত্বহা আদনানের ব্যক্তীকৃত— ‘হাদিসে বর্ণিত মালহামা হবে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে’ – কথাটি বাতিল। কারণ এসব গায়েবি বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর বাইরে নিজে থেকে গবেষণা করে মত প্রকাশ করা যায় না। আল্লাহ আমাদের সুমতি দিন। আমিন।
লিখেছেন: মুহাম্মাদ আব্দুল্ললাহ মৃধা।