প্রশ্ন হ’ল জিরাফের ৮ ফুট দীর্ঘ ঘাড় যদি ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-এর ফল হয়ে থাকে, আর তা যদি ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’-এর একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে, তাহ’লে মাত্র কয়েক ইঞ্চি ঘাড় বিশিষ্ট ভেড়া সম্পর্কে কী বলবার আছে?...একটি অপরটির তুলনায় যোগ্যতম হ’ল কি করে? একটি যোগ্যতম তার দীর্ঘ ঘাড়ের কারণে, অপরটি যোগ্যতম তার খাটো ঘাড়ের কারণে?
ভেড়া সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তার শিং সম্পর্কে কথা ওঠে। ক্লাসিক্যাল মত হ’ল, ওগুলি খামখেয়ালীভাবে বাড়তে থাকে। পরে ওগুলি যখন ভেড়ার জীবনসংগ্রামে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা প্রমাণ করল, প্রকৃতি শিং বিশিষ্ট জন্তু ও শিংহীন জন্তুগুলির মধ্যে বাছাই অভিযান শুরু করল। ফলে শিং বিশিষ্ট জন্তুকে বাঁচাল ও শিংহীনগুলি মরে গেল’। কিন্তু সত্যিই কি তা ঘটেছিল? এখনকার দুনিয়ায়ও তো শিংহীন ও শিংওয়ালা উভয় শ্রেণীর ভেড়া পাশাপাশি রয়েছে বিপুল সংখ্যায়। তাহ’লে ওদের মধ্যে যোগ্যতম হ’ল কোনগুলি? আর কোনগুলি যোগ্যতম নয়, যা ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধরে নিতে হবে? (৪৩-৪৪)।
প্রশ্ন হ’ল প্রকৃতি কি বস্তু? সে কিভাবে বাছাই অভিযান শুরু করার ক্ষমতা ও নির্দেশনা পেল? আরও বলা যায়, জেব্রার গায়ের ডোরাগুলি এবং মানুষের আঙ্গুলের ছাপগুলি (Finger print) কারু সাথে কারু মিল নেই কেন? ক্রমবিকাশ বা
বিবর্তন এগুলিকে স্পষ্ট করেনি কেন? দেহে জ্বর কেন আসে? তাতে দেহ কেন ভেঙে পড়ে? আবার কিভাবে জ্বর চলে যায় ও দেহ সুস্থ হয়?
বিবর্তনবাদীরা এর কোন সদুত্তর দিতে পারবেন কি?
Modern Science and the natural life-Gi Science News Letter (1966)-তে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ তোমাকে এসে বলে যে, একটি আকাশচুম্বী প্রাসাদ নিজে নিজেই গড়ে উঠেছে ইট-সিমেন্ট ও লোহা-লক্কড় দিয়ে এক শূন্যভূমির উপর; কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব হ’ল, কখন হ’ল, কোথায় হ’ল এবং কেনইবা হ’ল, আর সে পদ্ধতিটির কার্যকারিতার সময় তা কি রকম দেখাচ্ছিল তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থাকে, তখন এই রূপান্তরকে কি তুমি বাস্তব সত্য এবং সঠিক বক্তব্য বলে স্বীকার করে নিতে রাযী হবে?’ (৩২-৩৩)।
এই কারণেই বিখ্যাত ক্রমবিকাশবাদী W. Legros Clark স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘মানুষের চূড়ান্ত মৌল কি ছিল?... দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এই প্রশ্নের যে উত্তর বর্তমানে দেয়া যেতে পারে তা পরোক্ষ প্রমাণের উপর ভিত্তিশীল। যার বেশীর ভাগই অনুমান মাত্র’ (৩৩)।
আদম সৃষ্টির কুরআনী বিবরণ :
মানব জাতির আদি পিতা আদমকে সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে ‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে তোমাদের বক্তব্য কি? তারা (সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে সৃষ্ট জিন জাতির তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে) বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে আবাদ করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি’। এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য আপত্তির জন্য ছিল না, বরং জানার জন্য ছিল। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না (বাক্বারাহ ২/৩০)। অর্থাৎ আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল বাধ্যগতভাবে হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।
অতঃপর আদমকে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেওয়ার সময় আল্লাহ তাদের বললেন, ‘আমরা বললাম, তোমরা সবাই জান্নাত থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে কোন হেদায়াত পৌঁছবে, তখন যারা আমার হেদায়াতের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’। ‘পক্ষান্তরে যারা অবিশ্বাস করবে এবং আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা সেখানে চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসাবে সৃষ্টি করেন (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭০)। অতঃপর তার শ্রেষ্ঠত্ব যাচাইয়ের জন্য সাথে সাথে ইবলীসকে সৃষ্টি করেন অতঃপর তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত হায়াত দীর্ঘ করে দেন। মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করা ও তাকে ধোঁকা দেওয়াই হ’ল শয়তানের একমাত্র কাজ। অন্যদিকে আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূল ও কিতাব সমূহ পাঠিয়ে মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন (বাক্বারাহ ২/২১৩)। আদম থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত এক লক্ষ চব্বিশ হাযার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন
২ এবং বর্তমানে সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক মুসলিম ওলামায়ে কেরাম শেষনবীর ‘ওয়ারিছ’ হিসাবে
৩ আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান সমূহ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন (মায়েদাহ ৫/৬৭)। পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংস তথা ক্বিয়ামতের অব্যবহিত কাল পূর্ব পর্যন্ত এই নিয়ম জারী থাকবে।
ইবলীস জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হ’লেও মানুষের রগ-রেশায় ঢুকে ধোঁকা দেওয়ার ও বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন।
৪ শয়তানের ধোঁকার বিরুদ্ধে জিততে পারলেই মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে ধন্য হবে। নইলে ইহকাল ও পরকালে ব্যর্থকাম হবে। মানুষের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদা করা ও ইবলীসের সিজদা না করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে এ বিষয়ে যে, মানুষ যেন প্রতি পদে পদে শয়তানের ব্যাপারে সাবধান থাকে এবং সর্বদা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখে।
উল্লেখ্য যে, আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট (সাজদাহ ৩২/৭-৯)। এভাবেই জগত সংসারে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা এগিয়ে চলেছে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই কেবল আল্লাহর হুকুম
ব্যতীত। যেমন তাঁর হুকুমে বিনা বাপে ঈসা (আঃ)-এর জন্ম হয়েছে কেবল মায়ের মাধ্যমে’ (আম্বিয়া ২১/৯১; তাহরীম ৬৬/১২)।
নুযূলে কুরআনের যুগের ও বর্তমান যুগের নাস্তিক্যবাদ :
নুযূলে কুরআনের যুগে আরবদের মধ্যে নাস্তিক্যবাদের অস্তিত্ব ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা বলে, আমাদের এই পার্থিব জীবন ভিন্ন আর কিছু নেই। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি। কালের আবর্তনই আমাদেরকে ধ্বংস করে। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কোনই জ্ঞান নেই। তারা স্রেফ ধারণা ভিত্তিক কথা বলে’ (জাছিয়াহ ৪৫/২৪)। তারা বলত, ‘আমরা জানি না ক্বিয়ামত কি? আমরা স্রেফ ধারণা করি মাত্র। এ বিষয়ে আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী নই’ (জাছিয়াহ ৪৫/৩২)। এ যুগের ডারউইনবাদে তাই নতুনত্ব কিছুই নেই। বরং প্রাচীন যুগের কুফরী দর্শনের নব্য সংস্করণ মাত্র। এরা আল্লাহর হেদায়াতকে অস্বীকার করার কারণে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
সে যুগের নাস্তিকরা স্রেফ নাস্তিক ছিল। কিন্তু এ যুগের নাস্তিকরা আল্লাহতে অবিশ্বাসী হওয়ার সাথে সাথে নিজেদেরকে বানরের উত্তরসুরী বলে দাবী করে। সে যুগের নাস্তিকরা নিজেদেরকে মানুষ মনে করত এবং তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব ছিল। কিন্তু এ যুগের নাস্তিকরা নিজেদেরকে পশুর বংশধর মনে করে এবং সর্বদা পশুর ন্যায় আগ্রাসী থাকে। সে যুগের নাস্তিকরা নিজেদের পক্ষে কোন যুক্তি দিতে পারত না। কিন্তু এ যুগের নাস্তিকরা অলীক ও ভিত্তিহীন বিষয়গুলিকে বিজ্ঞানের নামে মানুষকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করে। ফলে নুযূলে কুরআনের যুগের নাস্তিকরা ছিল কেবলই নাস্তিক। কিন্তু এ যুগের শিক্ষিত নাস্তিকরা হ’ল ভান সর্বস্ব ‘কপট নাস্তিক’।
চলবে...
২. হাকেম হা/৩০৩৯, ২/২৬২, ২৮৮; আহমাদ হা/২২৩৪২; মিশকাত হা/৫৭৩৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/২৬৬৮।
৩. তিরমিযী হা/২৬৮২; আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২১২ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
৪. মুসলিম হা/২১৭৪; বুখারী হা/৩২৮১; মিশকাত হা/৬৮ ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘খটকা’ অনুচ্ছেদ।