লেখক পরিচিতি: সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) ছিলেন একজন বাঙালি লেখক ও কবি। তিনি ১৯ ও ২০ শতকে বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রবক্তাদের একজন। স্বাধীনতার জন্য লিখে উপমহাদেশের প্রথম কবি হিসেবে কারাবন্দি হয়েছিলেন। জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের সম্মানে নামের শেষের 'সিরাজী' পদবী যুক্ত করেন।
ছোটবেলা হইতে অ-মুসলমান শিক্ষক এবং গ্রন্থকারদিগের মুখে ও পুস্তকে আমাদের ছেলেরা অনবরত শুনিয়া এবং পড়িয়া থাকে যে, বাঙ্গালার মুসলমানেরা অধিকাংশই নিম্নশ্রেণির অস্পৃশ্য হিন্দুদিগের বংশধর। চণ্ডাল, বাগদী, পোদ, জেলে এবং মালী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাই কলেমা পড়িয়া মুসলমান হইয়াছে।
আজও একথা সর্বদাই অবাধে হিন্দুদিগের মুখে উচ্চারিত এবং পরিকীর্তিত হইতেছে। কথাটা এমনি ব্যাপক, গভীর এবং বদ্ধমূল হইয়া পড়িয়াছে যে, বহুসংখ্যক মুসলমান ভ্রাতাও একথা প্রাণের সহিত বিশ্বাস করিয়া থাকেন। অনেক অর্ধশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুবক পর্যন্ত বলিয়া থাকেন যে, “আহা! এ দেশের মুসলমানদের আর উন্নতি হইবে কি, ইহারা ত নিম্নশ্রেণির হিন্দু-বংশজ। প্রতিভা ইহাদের মধ্যে খেলিবে কী রূপে?”
একবার কোচবিহার কলেজের একটি মুসলমান যুবক নিজমুখে বলিয়াছিলেন যে, “আমাদের আর উন্নতি হইবে কেন? আমরা কোচদিগের বংশজ।” আমি তাহার মুখ-চোখের গঠন দেখিয়া দৃঢ়তার সহিত বলিলাম- “ইহা কে বলিল? তোমার নাক, গণ্ড এবং চক্ষুর গঠন ত আফগানদের মতো।” অনুসন্ধানে জানিলাম, কলেজের জনৈক হিন্দু প্রফেসার ক্লাশে পড়াইবার সময় মধ্যে মধ্যে কোচবিহারের মুসলমানদের পূর্বপুরুষ যে কোচ এবং ভুটিয়া ছিল, এ সম্বন্ধে নানা যুক্তি-তর্ক সমন্বিত মন্তব্য জাহির করিয়া ছেলেটির মনে এই মারাত্মক কুসংস্কার গভীরভাবে মুদ্রিত করিয়া দিয়াছেন।
বাঙ্গালাদেশের অ-মুসলমান ভ্রাতারা মুসলমানদিগের মনে যত প্রকার উপায়ে নীচ ধারণা জন্মাইয়া দিয়াছে তাহার মধ্যে “মুসলমানেরা নিম্নশ্রেণির হিন্দু-বংশজ” এই কথাটা সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক ক্ষতিকর। এই সাংঘাতিক বাক্যের উপর বিশ্বাস করিয়া জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিজয়ী আরব, ইরানী, তুর্কী এবং পাঠানের সন্তান ও অপরদিকে চিরদাস, চিরনগণ্য, অর্ধসভ্য নিম্নশ্রেণির হিন্দু বংশজ বলিয়া প্রাণের ভিতরে কোনও প্রকার জাতীয় গৌরব বা শ্রেষ্ঠত্বের উদ্বোধন বোধ করে না। এই হীনধারণা যতদিন পর্যন্ত দূরীভূত না হইবে, সে পর্যন্ত আমাদের ছাত্র ও যুবকদিগের মনে উচ্চ ধারণা প্রভুত্ব পরাক্রমের কল্পনার কিছুতেই সঞ্চার হইবে না। এই ধারণা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কী রূপ মহামারী কাণ্ডের সূচনা করিয়াছে, পাঠক-পাঠিকা তাহার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখুন:
বিগত ১৩২৪ সন ১৯শে অগ্রহায়ণ রাজশাহীতে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ‘কাশী চন্দ্র ঘোষাল’ মহাশয় বক্তৃতা করিতে করিতে দৃঢ়তার সহিত বলিয়া ফেলেন যে,
“পূর্ববঙ্গের মুসলমান-সংখ্যার আধিক্যের কারণ এই যে, পূর্ববঙ্গের নিম্নশ্রেণির হিন্দুগণ, হিন্দুধর্মের মহিমা বুঝিতে না পারিয়া মুসলমান হইয়া গিয়াছিল।”
এই সভায় কলেজের কতকগুলি মুসলমান ছাত্রও উপস্থিত ছিলেন। আর তাঁহারা প্রায় সকলেই পূর্ববঙ্গবাসী ছিলেন। কিন্তু কি গভীর পরিতাপ, লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয় যে তাঁহারা ব্রাহ্ম-প্রচারক কর্তৃক তাঁহাদের জগদ্বিজয়ী পূর্বপুরুষদিগের মস্তকে হীনতার এই দারুণ পদাঘাত নীরবে অম্লানবদনে সহ্য করিয়া লইয়াছিলেন। কি ভয়ানক অধঃপতন! কি নিদারুণ শোচনীয় অবস্থা! চিন্তা করিলে শরীর শিহরিয়া উঠে! পৃথিবীতে কোনও জাতির এরূপ অধঃপতন হইয়াছে বলিয়া, ইতিহাসে দেখিতে পাই না! বেশ্যা, চোর, দস্যু এবং মুচি-চামারের অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খ সন্তান সন্ততি পর্যন্ত পূর্বপুরুষের বা স্বীয় জনক-জননীর নীচতার উল্লেখ শ্রবণে বারুদের ন্যায় জ্বলিয়া উঠে। মৃত্যুর কথা ভুলিয়া গিয়া এইরূপ নিন্দাকারী হইতে প্রতিশোধ লইবার জন্য উদ্যত হইয়া থাকে!
কিন্তু হায়! হায়!! আমাদের কলেজের সোনার চাঁদগুলি— সমাজের আশা-ভরসাগুলি একটি টু শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করে নাই। কি বলিয়া ইহাদিগকে অভিহিত করিব, তাহার ভাষা খুঁজিয়া পাইতেছি না। পরে ঐ সভার শ্রোতা জনৈক ছাত্রবন্ধু দুঃখ করিয়া আমাকে সমস্ত ঘটনা পত্রযোগে অবগত করেন। এই ঘটনার পত্র পাঠে আমি অশ্রুসম্বরণ করিতে পারি নাই এবং সেই পত্রই আমাকে এই প্রবন্ধ রচনায় আশুলিপ্ত করিয়াছে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! রাজশাহীর ঘটনা হইতে বুঝিতে পারিতেছেন যে, এই “নীচ বংশ-জাত” হইবার ধারণা কিরূপ গভীরভাবে মুসলমান যুবকদিগের মনে সংস্কার জন্মাইয়া দিয়াছে। বাল্যকাল হইতে নানা বহি-পুস্তকে এবং বেভারিজ সাহেবের আদমশুমারীর রিপোর্টে বাঙ্গালী মুসলমানদিগের সম্বন্ধে এই প্রকার নিদারুণ কলঙ্কের কথা শুনিয়া সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বাঙ্গালী মুসলমানদিগের প্রকৃত তত্ত্ব জানিবার অত্যন্ত আগ্রহ জন্মে।
বিগত পঞ্চদশ বৎসর ধর্ম-প্রচারোপলক্ষে বাঙ্গালার নানা স্থান— জনপদ ও পল্লী পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটিয়াছে। তৎসঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমানদের ভাষা, অক্ষরের উচ্চারণ, শারীরিক গঠন, নাসিকা, চক্ষু, চিবুক ও মস্তকের গঠন বর্ণ ও আচার-ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে বিশেষরূপে আলোচনা করিয়াছি। কোন্ দেশ হইতে আসিয়া মুসলমানেরা উপনিবেশ স্থাপন করেন, তাহার প্রাচীনতত্ত্ব অনেকটা সংগৃহীত হইয়াছে।
আপাততঃ এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সংক্ষেপে বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয় আলোচনা করিব। বাঙ্গালার মুসলমান সংখ্যা কেন এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে, এই আলোচনার পূর্বে হিন্দুদিগের আরোপিত— বাঙ্গালার মুসলমানেরা প্রধানতঃ নীচ শ্রেণির হিন্দু বংশোদ্ভব- এ কথার আলোচনা করা আবশ্যক। আমার মতে এই হেতু একেবারেই ভিত্তিহীন। নিম্নে তাহার কয়েকটি কারণ বর্ণিত হইল:
১। সকল দেশের, সকল ধর্মের, সকল সময়ের এবং সকল জাতির নিম্নশ্রেণির লোকেরাই ধর্ম সম্বন্ধে অত্যন্ত গোঁড়া বা অন্ধ-বিশ্বাসী হয়। মানুষ যত শিক্ষিত— যত অভিজ্ঞ হয়, ততই উদার হইয়া পড়ে। পরধর্ম ও পর-জাতি বিদ্বেষ ততই কমিয়া যায়। হিন্দুসমাজের কথা লইয়া আলোচনা করিলেই ইহার সত্যতা বোঝা যাইবে। হিন্দু ভদ্র-সন্তানের অনেকেই প্রকাশ্যে বা লুকাইয়া মুসলমানের বাড়ী মুর্গী, খাসী এবং আরও বড় কিছু খাইতে দ্বিধা বোধ করেন না। কিন্তু সেই স্থলে একটি নমঃশুদ্র, বাগদী, মাঝি বা কৈবর্তের ছেলে এক গ্লাস জল খাইতেও কদাপি সম্মত হইবে না। এজন্য উচ্চশ্রেণির হিন্দুদিগের পক্ষে ধর্মান্তর গ্রহণ করা যত সহজ, নিম্নশ্রেণির হিন্দুর পক্ষে তত সহজ নহে।
২। উচ্চ-শ্রেণির লোকেরা সাধারণতঃ শিক্ষিত এবং উচ্চ-চিন্তাশীল। এ জন্য তাহারা নতুন ধর্মমতের বিশেষত্ব বা সারবত্বা যেমন সহজে ধারণ করিতে পারে, নিম্নশ্রেণির লোক কদাপি [কোনোকালে] তাহা বুঝিতে পারে না। তাহারা মূর্খ এবং কুসংস্কারান্ধ বলিয়া সহসা অন্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিতে পারে না। নিম্নশ্রেণির হিন্দুর পক্ষে এ জন্যও মুসলমান হওয়া কঠিন।
৩। নিম্নশ্রেণির লোকেরা সকল দেশেই সঙ্ঘবদ্ধ, তাহাদের সামাজিকতা অত্যন্ত বেশী। এ জন্য ইহারা সমাজ ছাড়িয়া চলিতে পারে না। মুসলমান হইলে, দল বাঁধিয়াই মুসলমান হইত। ফিরোজশাহ তোগলকের সময় বাঙ্গালাদেশের নিকারী, পাটুয়া এবং কলু এই তিন শ্রেণির হিন্দু মুসলমান হয়। বাঙ্গালার এই তিন শ্রেণির লোকের মধ্যে হিন্দু অতি বিরল। অধিকাংশই মুসলমান। নিম্নশ্রেণির ধারাই এই। যদি নিম্নশ্রেণির হিন্দুগণই মুসলমান বেশী হইত, তাহা হইলে হিন্দুদিগের মধ্যে ধোপা, নাপিত, তেলী, মালী, মুচী, বাগদী, চাঁড়াল, ডোম, ছুতার, তাঁতি, যোগী, কৈবর্ত, জেলে, পাটনী, পোদ, গোয়ালা প্রভৃতি এত অধিক দেখা যাইত না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঐ ঐ শ্রেণির সমস্ত লোকই হিন্দু-সমাজভুক্ত রহিয়াছে।
৪। কোনও শ্রেণির দুই একজন, জাতিগত ব্যবসায় ত্যাগ করিয়া অবশ্যই নূতন ব্যবসায় অবলম্বন করিতে পারে বটে; কিন্তু সমস্ত লোকের পক্ষে সেরূপ করা কদাপি সম্ভবপর নহে। সুতরাং নিম্নশ্রেণির হিন্দুই যদি মুসলমান বেশী হইত তাহা হইলে মুসলমান সমাজে নিম্নশ্রেণির ব্যবসায়ভুক্ত মুসলমান অনেক বেশী দেখা যাইত। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাঙ্গালার মুসলমানদিগের মধ্যে দুই একটি নিম্নশ্রেণির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ব্যতীত আর কোনো প্রকারের হীন ব্যবসায়ী বা নীচ-জীবী মুসলমান একেবারেই দেখিতে পাওয়া যায় না।
কামার, কুমার, মালী, যুগী, ডোম, চাঁড়াল, বাগ্দী, পোদ, পাটনী, ধোপা, নাপিত, মেথর, শুঁড়ি, বেহারা প্রভৃতি শ্রেণির লোক মুসলমান মধ্যে নাই বলিলেই হয়। সুতরাং এই শ্রেণির হিন্দুরা যে মুসলমান হয় নাই, ইহা জ্বলন্ত সত্য। এই শ্রেণির যে তিন সম্প্রদায়ের লোক মুসলমান হইয়াছে, সেই তিন শ্রেণি— পাটুয়া, নিকারী, কলু মুসলমান হইয়াও তাহাদের পূর্ব-ব্যবসায়ের কোনও পরিবর্তন করে নাই।
৫। নিম্নশ্রেণির লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান হইয়া গেল; অথচ আশ্চর্য ব্যাপার এখনও হিন্দু সমাজে নিম্নশ্রেণির লোকসংখ্যা উচ্চশ্রেণির [তুলনায়] পাঁচ গুণেরও বেশী। উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ বৈশ্য, কায়স্থের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। ইহাতে কি ইহাই উপলব্ধি হইতেছে না যে, উচ্চশ্রেণির হিন্দুগণই খুব বেশী সংখ্যায় মুসলমান হইয়া গিয়াছিল, তাই তাহাদের সংখ্যা এত হ্রাস পাইয়াছে? বৌদ্ধ ধর্মের প্রাবল্য যুগেও দেখা যায়, ব্রাহ্মণেরাই সর্বপ্রথম বৌদ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। পরে আবার কুমারিল ভট্টের সমর [যুদ্ধের] ঘোষণায় তাঁহারাই পরে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া ব্রাহ্মণত্ব অবলম্বন করিয়াছিলেন। বঙ্গে বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণের অভাব ছিল বলিয়াই মহারাজ আদিশূর কনৌজ হইতে বিশুদ্ধ বংশীয় পঞ্চ-ব্রাহ্মণকে যজ্ঞের জন্য আনয়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
এই সব অকাট্য কারণ বিদ্যমান থাকিতে যাঁহারা বাঙ্গালার মুসলমান-প্রাচুর্য দেখিয়া মনে করেন যে, নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাই মুসলমান হইয়া সংখ্যাবৃদ্ধি করিয়াছে, তাঁহারা যে নিতান্ত ভ্রান্ত ও বিদ্বেষপরায়ণ, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
এক্ষণে আমরা বাঙ্গালাদেশে মুসলিম সংখ্যা অন্যান্য প্রদেশাপেক্ষা আপেক্ষিক বৃদ্ধির কারণ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইতেছি।
বঙ্গে মুসলমান সংখ্যার আধিক্যের কারণ:
৬। এই সমস্ত ফকির-দরবেশদিগের কৃপা ও সহানুভূতি লাভ করিয়া স্ব স্ব ভাগ্যকে দরিদ্রতার মেঘাবরণ হইতে মুক্ত করিবার জন্য দলে দলে মুসলমান বাঙ্গালায় আসিয়াছিলেন।
৭। বাঙ্গালার ন্যায় কোনও দেশের নবাবদিগের এমন ঘন ঘন বংশ পরিবর্ধন হয় নাই। বংশ পরিবর্ধনের জন্য যেমন নূতন নূতন বংশের লোক নবাব হইয়াছেন; অমনি সেই বংশের লোক চতুর্দিক হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে। এই জন্য বাঙ্গালায় খিলিজী, তুগলক, লোদী, সুর, শেখ, সৈয়দ, মির্জা, বেগ, খান প্রভৃতি সকল শ্রেণির তুর্কী, আরব, আফগান এবং ইরান দেশীয় বংশসমূহের লোক দেখা যায়।
৮। বাঙ্গালাদেশের ন্যায় পৃথিবীর কোনও দেশেই ঘন ঘন এত রাজধানীর পত্তন হয় নাই। এক বাঙ্গালার রাজধানী গৌড়, পাণ্ডুয়া, চাণ্ডা ছোট পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম, সোনারগাঁও, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, দেবকোট [ঘোড়াঘাট] এবং দশটি শহর। এই সমস্ত রাজধানীর নূতন শহরপত্তন করিবার সময় সর্বশ্রেণির বহু সংখ্যক শিল্পী, ব্যবসায়ী, সৈনিক, পণ্ডিত, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতির দরকার হইত। পুরাতন রাজধানী হইতে সর্বশ্রেণির লোকের অভাব পূর্ণ হইত না। কারণ, পুরাতন রাজধানী ত্যাগ করিয়া কোনও সময়েই সর্বশ্রেণির সর্বলোকের নূতন রাজধানীতে আগমন করা কদাপি সম্ভবপর হয় না। এজন্য নূতন রাজধানীতে ইরান, তুরান, আরব, আফগানিস্তানের সহস্র সহস্র শিল্পী, ব্যবসায়ী, যোদ্ধা এবং বোদ্ধার সমাবেশ হইত।
৯। বাঙ্গালাদেশ নদী-বহুল বলিয়া এখানে বাণিজ্য করা সুগম ছিল। বাণিজ্যের জন্য বহু নগর ও বন্দর প্রসিদ্ধ ছিল। হুগলী, সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, গৌড়, ফতেহবাদ, বর্ধমান প্রভৃতি নগর বিখ্যাত ছিল। বাণিজ্যপ্রিয় আরব ও মোগল সওদাগরগণ এজন্য দলে দলে আসিয়া এদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যে লিপ্ত হইয়াছিলেন। আজও চট্টগ্রাম ও ঢাকার বণিক সমাজে মুসলমান প্রাধান্য বিশেষরূপে বিরাজমান।
১০। মুসলমানদের সন্তান জন্মশক্তি সাধারণতঃ হিন্দুগণের অপেক্ষা অনেক বেশী। পূর্বে আরও অনেক বেশী ছিল। পুষ্টিকর খাদ্য এবং শারীরিক পরিশ্রমই ইহার প্রধান কারণ। আজও যেকোনো সমসংখ্যক অধিবাসী বিশিষ্ট হিন্দু ও মুসলমান গ্রামের শিশু-সংখ্যার শুমার [গণনা] করিলেই এই কথার সত্যতা উপলব্ধি হইবে। সেনসাস রিপোর্টও আমাদের অনুকূল।
১১। মুসলমান বিধবা রমণীদের পুনর্বিবাহ হয়। এজন্য তাহারা প্রায় সকলেই পুত্রবতী। কিন্তু হিন্দু বিধবাদিগের সে সুবিধা নাই।
১২। নূতন কোনও স্থানে বৃক্ষাদি রোপণ করিলে যেমন তাহা অত্যন্ত বংশবৃদ্ধি করে তেমনি কোনও জাতি নুতন দেশে যাইয়া প্রভুত্ব স্থাপন করিলে, তাহাদের বংশও দ্রুত বিস্তৃত হয়। মৃত্যুসংখ্যা তাহাদের মধ্যে কম হয় ।
১৩। প্রভু জাতি অপেক্ষা পরাধীন জাতির জননশক্তি নানা কারণে হ্রাস হয়। অনেক বন্য স্বাধীন জন্তু আবদ্ধ করিয়া গৃহে পালন করিলে তাহাদের শাবকাদি হয় না।
সেন্সাস্ রিপোর্টেও দেখা যায়, হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা মুসলমান অপেক্ষা ইংরাজের সন্তান সংখ্যা বেশী। যে জাতি যত দীর্ঘকাল অধীন থাকে, তাহাদের জীবনী শক্তিও ততই কম হইবে। প্রজনন-বিদ্যাবিদগণ ইহা সত্য বলিয়া স্বীকার করেন।
১৪। হিন্দুদিগের মধ্যে মোহান্ত, গোসাই, গিরি, সন্ন্যাসী প্রভৃতি অনেক শ্রেণির লোক চিরকাল দারপরিগ্রহ [বিবাহ] করিতে পারে না। কিন্তু মুসলমানদিগের সর্বশ্রেণির লোকই দারপরিগ্রহ করিয়া সন্তান উৎপাদন করিয়া থাকেন।
১৫। হিন্দুদিগের অপেক্ষা মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রথা অনেক বেশী ছিল এবং এখনও আছে; এজন্য তাহাদের সন্তান সংখ্যা হিন্দুদিগের অপেক্ষা খুব বেশী হইত এবং এখনও হয়।
১৬। বাঙ্গালাদেশের ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা, গঙ্গা, পদ্মা, ধলেশ্বরী, তিস্তা প্রভৃতি বহুসংখ্যক নদ-নদীতে যে সমস্ত নূতন চরের পত্তন হয়, তাহাতে শুধু মুসলমানেরাই উপনিবেশ স্থাপন করেন। এ সমস্ত চরের লোকজনের স্বাস্থ্য ভালো বলিয়া মৃত্যু সংখ্যা অতি সামান্য। অতি অল্পদিনেই এই সমস্ত চর মুসলমানদিগের দ্বারা পূর্ণ হইয়া যায়।
১৭। আজও আরব, আফগানিস্তান এবং হিন্দুস্থান হইতে দলে দলে মুসলমান আসিয়া বাঙ্গালার মুসলমান সমাজে মিশিয়া যাইতেছে। প্রতিবৎসর এইরূপে বাঙ্গালায় দশ হাজার করিয়া ভিন্ন দেশীয় মুসলমানের আমদানী হইতেছে। ইহারা এক পুরুষ পরেই বাঙ্গালী বনিয়া আসিতেছে।
১৮। আজও বাঙ্গালার সর্বত্রই প্রতিবৎসর বহু হিন্দু মুসলমান ধর্ম পরিগ্রহ করিতেছে। সমগ্র বঙ্গে এইরূপ হিন্দু হইতে মুসলমান হওয়ার লোকসংখ্যা দুই সহস্রের ন্যূন হইবে না। এক ময়মনসিংহ জেলাতেই প্রতিবৎসর তিনশত হিন্দু বিধবা গড়ে মুসলমানের গৃহে আশ্রয় লইতেছে।
১৯। মুসলমান অপেক্ষা হিন্দুদিগের মধ্যে বেশ্যার সংখ্যা তিনগুণ বেশী। সাধারণতঃ বেশ্যাদিগের প্রায়ই সন্তানাদি হয় না।
২০। প্রতিবৎসরেই অনেক হিন্দু যুবক এবং যুবতী খৃস্টান বা ব্রাহ্ম হইয়া যাইতেছে।
২১। মুসলমান-প্রধান উত্তর ও পূর্ববঙ্গ হইতে হিন্দু-প্রধান পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য, কৃষি শিল্পোৎপন্ন দ্রব্য হীন ও সামান্য। অবস্থার শোচনীয়তা এবং জলবায়ুর নিকৃষ্টতাও সংখ্যা হীনতার একটি প্রধান কারণ। পশ্চিমবঙ্গের যশোহর, নদীয়া, বর্ধমান প্রভৃতি জেলার লোকসংখ্যা সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী কমিয়া যাইতেছে। অন্যদিকে মুসলমান-প্রধান পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের লোকসংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িয়াই চলিয়াছে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! এক্ষণে উপরিউক্ত কারণাবলির বিষয়ে মনোনিবেশপূর্বক চিন্তা করিলে বাঙ্গালার মুসলমান সংখ্যার আধিক্য দেখিয়া আর কিছুমাত্র বিস্মিত হইতে হইবে না, বরং হিন্দুদিগের সংখ্যা যে আরও কেন কমিয়া যায় নাই তাহাই আশ্চর্য বলিয়া বোধ হইবে।
উপসংহার
আমরা বিশেষভাবে প্রদর্শন করিলাম যে, বাঙ্গালাদেশের মুসলমানগণ কোনও রূপেই নীচকুলোদ্ভব নিম্নশ্রেণির অস্পৃশ্য হিন্দুদিগের বংশধর নহে। নিম্নশ্রেণির হিন্দুজ মুসলমানের সংখ্যা অতি নগণ্য। আমরা যে সমস্ত যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছি, তাহাতে মুসলিম-বিদ্বেষী কোনো মহাপণ্ডিত আর বাঙ্গালার মুসলমানদিগকে সহজে নীচবংশ বলিয়া অভিহিত করিতে সাহসী হইবেন না। আমাদের নব্য-যুবক এবং ছাত্র-ছাত্রীগণ প্রাণের সহিত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করুন যে, তাঁহারা সেই সমস্ত জগদ্বিজয়ী জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশারদ, মহাপরাক্রান্ত বিশ্ব ধন্য আরব, তুর্কী ও পাঠানদিগের বংশধর। তাঁহাদের পূর্ব-পুরুষগণ বীর্যে-শৌর্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমস্ত পৃথিবীকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাদের পূর্ব পুরুষগণই হিন্দুদিগকে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া শাসন করিয়াছিলেন। উন্নত সভ্যতা এবং আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়াছিলেন। হিন্দুদিগের জাতীয় নাম “হিন্দু” শব্দটি পর্যন্ত মুসলমানেরই প্রদত্ত। তাঁহারা বিদ্যা-বুদ্ধি চরিত্র এবং শৌর্য-বীর্যে হিন্দুদিগের অপেক্ষা শতগুণ শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
সুতরাং হে বঙ্গের মুসলিম ছাত্রবৃন্দ এবং যুবকমণ্ডলী! তোমরা যদি আবার জ্ঞানচর্চায় এবং জাতীয় উন্নতিবিধানে গভীরভাবে মনোনিবেশ করো, তাহা হইলে অচিরে প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রে সকল কার্যেই অগ্রবর্তী এবং যশস্বী হইতে পারিবে; কেহই তোমাদিগকে বাধা দিতে পারিবে না। এক্ষণে চাই তোমাদের জ্বলন্ত জীবন্ত আত্ম-বিশ্বাস এবং কঠোর ও কঠিন সাধনা।
সাপ্তাহিক ছোলতান, ৮ম বর্ষ, ২৬শ সংখ্যা ৪, ৩০শে কার্তিক ১৩৩০ (১৬ই নভেম্বর ১৯২৩)।
প্রবন্ধ সমগ্র, জ্ঞান বিতরণী, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০, পৃ.২৩৮-২৪৬।
ছোটবেলা হইতে অ-মুসলমান শিক্ষক এবং গ্রন্থকারদিগের মুখে ও পুস্তকে আমাদের ছেলেরা অনবরত শুনিয়া এবং পড়িয়া থাকে যে, বাঙ্গালার মুসলমানেরা অধিকাংশই নিম্নশ্রেণির অস্পৃশ্য হিন্দুদিগের বংশধর। চণ্ডাল, বাগদী, পোদ, জেলে এবং মালী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাই কলেমা পড়িয়া মুসলমান হইয়াছে।
আজও একথা সর্বদাই অবাধে হিন্দুদিগের মুখে উচ্চারিত এবং পরিকীর্তিত হইতেছে। কথাটা এমনি ব্যাপক, গভীর এবং বদ্ধমূল হইয়া পড়িয়াছে যে, বহুসংখ্যক মুসলমান ভ্রাতাও একথা প্রাণের সহিত বিশ্বাস করিয়া থাকেন। অনেক অর্ধশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুবক পর্যন্ত বলিয়া থাকেন যে, “আহা! এ দেশের মুসলমানদের আর উন্নতি হইবে কি, ইহারা ত নিম্নশ্রেণির হিন্দু-বংশজ। প্রতিভা ইহাদের মধ্যে খেলিবে কী রূপে?”
একবার কোচবিহার কলেজের একটি মুসলমান যুবক নিজমুখে বলিয়াছিলেন যে, “আমাদের আর উন্নতি হইবে কেন? আমরা কোচদিগের বংশজ।” আমি তাহার মুখ-চোখের গঠন দেখিয়া দৃঢ়তার সহিত বলিলাম- “ইহা কে বলিল? তোমার নাক, গণ্ড এবং চক্ষুর গঠন ত আফগানদের মতো।” অনুসন্ধানে জানিলাম, কলেজের জনৈক হিন্দু প্রফেসার ক্লাশে পড়াইবার সময় মধ্যে মধ্যে কোচবিহারের মুসলমানদের পূর্বপুরুষ যে কোচ এবং ভুটিয়া ছিল, এ সম্বন্ধে নানা যুক্তি-তর্ক সমন্বিত মন্তব্য জাহির করিয়া ছেলেটির মনে এই মারাত্মক কুসংস্কার গভীরভাবে মুদ্রিত করিয়া দিয়াছেন।
বাঙ্গালাদেশের অ-মুসলমান ভ্রাতারা মুসলমানদিগের মনে যত প্রকার উপায়ে নীচ ধারণা জন্মাইয়া দিয়াছে তাহার মধ্যে “মুসলমানেরা নিম্নশ্রেণির হিন্দু-বংশজ” এই কথাটা সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক ক্ষতিকর। এই সাংঘাতিক বাক্যের উপর বিশ্বাস করিয়া জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিজয়ী আরব, ইরানী, তুর্কী এবং পাঠানের সন্তান ও অপরদিকে চিরদাস, চিরনগণ্য, অর্ধসভ্য নিম্নশ্রেণির হিন্দু বংশজ বলিয়া প্রাণের ভিতরে কোনও প্রকার জাতীয় গৌরব বা শ্রেষ্ঠত্বের উদ্বোধন বোধ করে না। এই হীনধারণা যতদিন পর্যন্ত দূরীভূত না হইবে, সে পর্যন্ত আমাদের ছাত্র ও যুবকদিগের মনে উচ্চ ধারণা প্রভুত্ব পরাক্রমের কল্পনার কিছুতেই সঞ্চার হইবে না। এই ধারণা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কী রূপ মহামারী কাণ্ডের সূচনা করিয়াছে, পাঠক-পাঠিকা তাহার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখুন:
বিগত ১৩২৪ সন ১৯শে অগ্রহায়ণ রাজশাহীতে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ‘কাশী চন্দ্র ঘোষাল’ মহাশয় বক্তৃতা করিতে করিতে দৃঢ়তার সহিত বলিয়া ফেলেন যে,
“পূর্ববঙ্গের মুসলমান-সংখ্যার আধিক্যের কারণ এই যে, পূর্ববঙ্গের নিম্নশ্রেণির হিন্দুগণ, হিন্দুধর্মের মহিমা বুঝিতে না পারিয়া মুসলমান হইয়া গিয়াছিল।”
এই সভায় কলেজের কতকগুলি মুসলমান ছাত্রও উপস্থিত ছিলেন। আর তাঁহারা প্রায় সকলেই পূর্ববঙ্গবাসী ছিলেন। কিন্তু কি গভীর পরিতাপ, লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয় যে তাঁহারা ব্রাহ্ম-প্রচারক কর্তৃক তাঁহাদের জগদ্বিজয়ী পূর্বপুরুষদিগের মস্তকে হীনতার এই দারুণ পদাঘাত নীরবে অম্লানবদনে সহ্য করিয়া লইয়াছিলেন। কি ভয়ানক অধঃপতন! কি নিদারুণ শোচনীয় অবস্থা! চিন্তা করিলে শরীর শিহরিয়া উঠে! পৃথিবীতে কোনও জাতির এরূপ অধঃপতন হইয়াছে বলিয়া, ইতিহাসে দেখিতে পাই না! বেশ্যা, চোর, দস্যু এবং মুচি-চামারের অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খ সন্তান সন্ততি পর্যন্ত পূর্বপুরুষের বা স্বীয় জনক-জননীর নীচতার উল্লেখ শ্রবণে বারুদের ন্যায় জ্বলিয়া উঠে। মৃত্যুর কথা ভুলিয়া গিয়া এইরূপ নিন্দাকারী হইতে প্রতিশোধ লইবার জন্য উদ্যত হইয়া থাকে!
কিন্তু হায়! হায়!! আমাদের কলেজের সোনার চাঁদগুলি— সমাজের আশা-ভরসাগুলি একটি টু শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করে নাই। কি বলিয়া ইহাদিগকে অভিহিত করিব, তাহার ভাষা খুঁজিয়া পাইতেছি না। পরে ঐ সভার শ্রোতা জনৈক ছাত্রবন্ধু দুঃখ করিয়া আমাকে সমস্ত ঘটনা পত্রযোগে অবগত করেন। এই ঘটনার পত্র পাঠে আমি অশ্রুসম্বরণ করিতে পারি নাই এবং সেই পত্রই আমাকে এই প্রবন্ধ রচনায় আশুলিপ্ত করিয়াছে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! রাজশাহীর ঘটনা হইতে বুঝিতে পারিতেছেন যে, এই “নীচ বংশ-জাত” হইবার ধারণা কিরূপ গভীরভাবে মুসলমান যুবকদিগের মনে সংস্কার জন্মাইয়া দিয়াছে। বাল্যকাল হইতে নানা বহি-পুস্তকে এবং বেভারিজ সাহেবের আদমশুমারীর রিপোর্টে বাঙ্গালী মুসলমানদিগের সম্বন্ধে এই প্রকার নিদারুণ কলঙ্কের কথা শুনিয়া সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বাঙ্গালী মুসলমানদিগের প্রকৃত তত্ত্ব জানিবার অত্যন্ত আগ্রহ জন্মে।
বিগত পঞ্চদশ বৎসর ধর্ম-প্রচারোপলক্ষে বাঙ্গালার নানা স্থান— জনপদ ও পল্লী পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটিয়াছে। তৎসঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমানদের ভাষা, অক্ষরের উচ্চারণ, শারীরিক গঠন, নাসিকা, চক্ষু, চিবুক ও মস্তকের গঠন বর্ণ ও আচার-ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে বিশেষরূপে আলোচনা করিয়াছি। কোন্ দেশ হইতে আসিয়া মুসলমানেরা উপনিবেশ স্থাপন করেন, তাহার প্রাচীনতত্ত্ব অনেকটা সংগৃহীত হইয়াছে।
আপাততঃ এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সংক্ষেপে বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয় আলোচনা করিব। বাঙ্গালার মুসলমান সংখ্যা কেন এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে, এই আলোচনার পূর্বে হিন্দুদিগের আরোপিত— বাঙ্গালার মুসলমানেরা প্রধানতঃ নীচ শ্রেণির হিন্দু বংশোদ্ভব- এ কথার আলোচনা করা আবশ্যক। আমার মতে এই হেতু একেবারেই ভিত্তিহীন। নিম্নে তাহার কয়েকটি কারণ বর্ণিত হইল:
১। সকল দেশের, সকল ধর্মের, সকল সময়ের এবং সকল জাতির নিম্নশ্রেণির লোকেরাই ধর্ম সম্বন্ধে অত্যন্ত গোঁড়া বা অন্ধ-বিশ্বাসী হয়। মানুষ যত শিক্ষিত— যত অভিজ্ঞ হয়, ততই উদার হইয়া পড়ে। পরধর্ম ও পর-জাতি বিদ্বেষ ততই কমিয়া যায়। হিন্দুসমাজের কথা লইয়া আলোচনা করিলেই ইহার সত্যতা বোঝা যাইবে। হিন্দু ভদ্র-সন্তানের অনেকেই প্রকাশ্যে বা লুকাইয়া মুসলমানের বাড়ী মুর্গী, খাসী এবং আরও বড় কিছু খাইতে দ্বিধা বোধ করেন না। কিন্তু সেই স্থলে একটি নমঃশুদ্র, বাগদী, মাঝি বা কৈবর্তের ছেলে এক গ্লাস জল খাইতেও কদাপি সম্মত হইবে না। এজন্য উচ্চশ্রেণির হিন্দুদিগের পক্ষে ধর্মান্তর গ্রহণ করা যত সহজ, নিম্নশ্রেণির হিন্দুর পক্ষে তত সহজ নহে।
২। উচ্চ-শ্রেণির লোকেরা সাধারণতঃ শিক্ষিত এবং উচ্চ-চিন্তাশীল। এ জন্য তাহারা নতুন ধর্মমতের বিশেষত্ব বা সারবত্বা যেমন সহজে ধারণ করিতে পারে, নিম্নশ্রেণির লোক কদাপি [কোনোকালে] তাহা বুঝিতে পারে না। তাহারা মূর্খ এবং কুসংস্কারান্ধ বলিয়া সহসা অন্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিতে পারে না। নিম্নশ্রেণির হিন্দুর পক্ষে এ জন্যও মুসলমান হওয়া কঠিন।
৩। নিম্নশ্রেণির লোকেরা সকল দেশেই সঙ্ঘবদ্ধ, তাহাদের সামাজিকতা অত্যন্ত বেশী। এ জন্য ইহারা সমাজ ছাড়িয়া চলিতে পারে না। মুসলমান হইলে, দল বাঁধিয়াই মুসলমান হইত। ফিরোজশাহ তোগলকের সময় বাঙ্গালাদেশের নিকারী, পাটুয়া এবং কলু এই তিন শ্রেণির হিন্দু মুসলমান হয়। বাঙ্গালার এই তিন শ্রেণির লোকের মধ্যে হিন্দু অতি বিরল। অধিকাংশই মুসলমান। নিম্নশ্রেণির ধারাই এই। যদি নিম্নশ্রেণির হিন্দুগণই মুসলমান বেশী হইত, তাহা হইলে হিন্দুদিগের মধ্যে ধোপা, নাপিত, তেলী, মালী, মুচী, বাগদী, চাঁড়াল, ডোম, ছুতার, তাঁতি, যোগী, কৈবর্ত, জেলে, পাটনী, পোদ, গোয়ালা প্রভৃতি এত অধিক দেখা যাইত না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঐ ঐ শ্রেণির সমস্ত লোকই হিন্দু-সমাজভুক্ত রহিয়াছে।
৪। কোনও শ্রেণির দুই একজন, জাতিগত ব্যবসায় ত্যাগ করিয়া অবশ্যই নূতন ব্যবসায় অবলম্বন করিতে পারে বটে; কিন্তু সমস্ত লোকের পক্ষে সেরূপ করা কদাপি সম্ভবপর নহে। সুতরাং নিম্নশ্রেণির হিন্দুই যদি মুসলমান বেশী হইত তাহা হইলে মুসলমান সমাজে নিম্নশ্রেণির ব্যবসায়ভুক্ত মুসলমান অনেক বেশী দেখা যাইত। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাঙ্গালার মুসলমানদিগের মধ্যে দুই একটি নিম্নশ্রেণির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ব্যতীত আর কোনো প্রকারের হীন ব্যবসায়ী বা নীচ-জীবী মুসলমান একেবারেই দেখিতে পাওয়া যায় না।
কামার, কুমার, মালী, যুগী, ডোম, চাঁড়াল, বাগ্দী, পোদ, পাটনী, ধোপা, নাপিত, মেথর, শুঁড়ি, বেহারা প্রভৃতি শ্রেণির লোক মুসলমান মধ্যে নাই বলিলেই হয়। সুতরাং এই শ্রেণির হিন্দুরা যে মুসলমান হয় নাই, ইহা জ্বলন্ত সত্য। এই শ্রেণির যে তিন সম্প্রদায়ের লোক মুসলমান হইয়াছে, সেই তিন শ্রেণি— পাটুয়া, নিকারী, কলু মুসলমান হইয়াও তাহাদের পূর্ব-ব্যবসায়ের কোনও পরিবর্তন করে নাই।
৫। নিম্নশ্রেণির লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান হইয়া গেল; অথচ আশ্চর্য ব্যাপার এখনও হিন্দু সমাজে নিম্নশ্রেণির লোকসংখ্যা উচ্চশ্রেণির [তুলনায়] পাঁচ গুণেরও বেশী। উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ বৈশ্য, কায়স্থের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। ইহাতে কি ইহাই উপলব্ধি হইতেছে না যে, উচ্চশ্রেণির হিন্দুগণই খুব বেশী সংখ্যায় মুসলমান হইয়া গিয়াছিল, তাই তাহাদের সংখ্যা এত হ্রাস পাইয়াছে? বৌদ্ধ ধর্মের প্রাবল্য যুগেও দেখা যায়, ব্রাহ্মণেরাই সর্বপ্রথম বৌদ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। পরে আবার কুমারিল ভট্টের সমর [যুদ্ধের] ঘোষণায় তাঁহারাই পরে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া ব্রাহ্মণত্ব অবলম্বন করিয়াছিলেন। বঙ্গে বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণের অভাব ছিল বলিয়াই মহারাজ আদিশূর কনৌজ হইতে বিশুদ্ধ বংশীয় পঞ্চ-ব্রাহ্মণকে যজ্ঞের জন্য আনয়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
এই সব অকাট্য কারণ বিদ্যমান থাকিতে যাঁহারা বাঙ্গালার মুসলমান-প্রাচুর্য দেখিয়া মনে করেন যে, নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাই মুসলমান হইয়া সংখ্যাবৃদ্ধি করিয়াছে, তাঁহারা যে নিতান্ত ভ্রান্ত ও বিদ্বেষপরায়ণ, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
এক্ষণে আমরা বাঙ্গালাদেশে মুসলিম সংখ্যা অন্যান্য প্রদেশাপেক্ষা আপেক্ষিক বৃদ্ধির কারণ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইতেছি।
বঙ্গে মুসলমান সংখ্যার আধিক্যের কারণ:
১। বাঙ্গালা অতি বৃহৎ প্রদেশ। মুসলমানী আমলেও বাঙ্গালার লোকসংখ্যা অন্যান্য প্রদেশাপেক্ষা বেশী ছিল। সুতরাং অন্যান্য প্রদেশাপেক্ষা হিন্দু হইতে দীক্ষিত মুসলমানের সংখ্যাও বেশী ছিল।
২। বাঙ্গালার ন্যায় শস্য-শ্যামলা এবং সুজলা-সুফলা ভূমি ভারতে আর নাই বলিলেও হয়। এখানে জীবন সংগ্রাম যারপর নাই সহজ ও সরল ছিল। এজন্য স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দভাবে নিরুদ্বেগে জীবিকা নির্বাহের সুবিধার জন্য দলে দলে মুসলমান যাহারা আরব-তুরস্ক-পারস্য ও আফগানিস্তান হইতে ভাগ্যান্বেষণে জন্য হিন্দুস্থানে আসিতেন তাঁহাদের অনেকেই বাঙ্গালাদেশে চলিয়া আসিতেন। দিল্লী, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি রাজধানীর নিকটবর্তী স্থান লোকপূর্ণ হইয়াছিল বলিয়া পশ্চিমদিক হইতে নবাগত মুসলমানগণ সেখানে স্থানাভাব দেখিয়া বাঙ্গালার দিকে উপনিবেশ-অন্বেষণে চলিয়া আসিত। বর্তমান ব্রহ্মদেশ ও আসাম তাহার দৃষ্টান্ত স্থান।
৩। বাঙ্গালাদেশে অনেক বড় বড় রাজা ও জমিদার ছিলেন। তাঁহাদের সকলেই যুদ্ধকালে নবাবকে নির্দ্দিষ্ট পরিমাণে সৈন্য যোগাইতে বাধ্য ছিলেন। তৎপর তাঁহাদের স্ব স্ব জমিদারী রক্ষার জন্য প্রচুর সৈন্যের আবশ্যক হইত। এজন্য দলে দলে মুসলমানগণ বাঙ্গালায় আসিয়া সৈনিক-বৃত্তি অবলম্বন করিতেন। পরে প্রৌঢ় বয়সে সৈনিক-বৃত্তি পরিহার করিয়া কৃষি-কার্যে মনোনিবেশ করিতেন।
৪। বাণিজ্য-প্রিয় আরবীয় মুসলমানগণ তদানীন্তন জগতের সমস্ত বন্দর আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিলেন। বাঙ্গালাদেশের চট্টগ্রাম দীর্ঘকাল হইতেই সামুদ্রিক বন্দর রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। চীন দেশের সঙ্গে আরবীয় মুসলমানদিগের বিস্তৃত নৌবাণিজ্য ছিল। এই সূত্রে চট্টগ্রাম আরব ও চীনের নৌপথের মধ্যবর্তী এবং বাঙ্গালাদেশেরও প্রসিদ্ধ বন্দর বলিয়া খলিফা হারুণ ও মামুনের সময় হইতেই দলে দলে আরবীয় বণিক ও লস্করগণ চট্টগ্রামে উপনিবেশ স্থাপন করেন। চট্টগ্রামের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দৃশ্য স্বাস্থ্যজনক ও মনোহর বলিয়া ক্রমশঃ এখানে আরবদিগের দলপুষ্টি হইতে থাকে।
চট্টগ্রামের শতকরা ৯০ জন মুসলমানই আরব-বংশজ, একথা বহু হিন্দু এবং ইংরেজ পণ্ডিত মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। চট্টগ্রামের ভাষায় আরবী শব্দের প্রাচুর্যও তাহার এক অকাট্য প্রমাণ। তদ্ব্যতীত আহার বিহার এবং সামাজিক আচার-ব্যবহারে আরবের সহিত চট্টগ্রামের মুসলমানগণের অতি ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। এক একটি বৃহৎ পাত্রে একাধিক লোকের একত্রে আহার চট্টগ্রাম ব্যতীত বঙ্গের অন্যত্র অল্পই দৃষ্ট হয়। কেহ কাহাকে ডাকিলে “লব্বয়” বলিয়া উত্তর দেওয়ার প্রথাও অন্যত্র দৃষ্ট হয় না। আরবেরা “লাব্বায়েক” বলে। এরূপ আরও বহু নিদর্শন পাওয়া যায়।
পরে এই সমস্ত আরব ঔপনিবেশিকদিগের বংশধরগণ নোয়াখালী জেলারও অনেক অংশ দখল করিয়া বসিয়াছেন। অথচ চট্টগ্রামে মুসলমান উপনিবেশ স্থাপনের কাল মহাবীর বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের ন্যূনাধিক দুইশত বৎসর পূর্ববর্তী।
৫। পশ্চিম এশিয়া হইতে বাঙ্গালায় যত ফকির-দরবেশ এবং তাপসের সমাগম হইয়াছিল; পৃথিবীর আর কোনও দেশে এত তাপস ও দরবেশের সমাগম হইয়াছিল বলিয়া দেখিতে পাওয়া যায় না। এখনও প্রবাদ আছে যে, বাঙ্গালাদেশে ৩৬০ জন আউলিয়ার সমাগম হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য শ্রেণির ফকির-দরবেশের সংখ্যা-বাহুল্যও অনেক ছিল।
বাঙ্গালার এমন কোনো প্রাচীন গ্রাম নাই, যেখানে দুই একজন তাপসের কবর নাই। এই সমস্ত তাপস-ফকিরদের সঙ্গে ২০০/৩০০ শত করিয়া যোদ্ধা-বোদ্ধা এবং ফকির-শিষ্য থাকিত। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তাঁহারা অসাধারণ তপশ্চর্যা অপরিসীম জ্ঞান এবং অজেয় ধর্ম-বিশ্বাস লইয়া বাঙ্গালায় আসিতেন। ধর্ম প্রচারের সঙ্গে তাঁহারা সকলেই লোকজন সহ এক একটি স্থান পছন্দ করিয়া এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হইয়াছিলেন।
৬। এই সমস্ত ফকির-দরবেশদিগের কৃপা ও সহানুভূতি লাভ করিয়া স্ব স্ব ভাগ্যকে দরিদ্রতার মেঘাবরণ হইতে মুক্ত করিবার জন্য দলে দলে মুসলমান বাঙ্গালায় আসিয়াছিলেন।
৭। বাঙ্গালার ন্যায় কোনও দেশের নবাবদিগের এমন ঘন ঘন বংশ পরিবর্ধন হয় নাই। বংশ পরিবর্ধনের জন্য যেমন নূতন নূতন বংশের লোক নবাব হইয়াছেন; অমনি সেই বংশের লোক চতুর্দিক হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে। এই জন্য বাঙ্গালায় খিলিজী, তুগলক, লোদী, সুর, শেখ, সৈয়দ, মির্জা, বেগ, খান প্রভৃতি সকল শ্রেণির তুর্কী, আরব, আফগান এবং ইরান দেশীয় বংশসমূহের লোক দেখা যায়।
৮। বাঙ্গালাদেশের ন্যায় পৃথিবীর কোনও দেশেই ঘন ঘন এত রাজধানীর পত্তন হয় নাই। এক বাঙ্গালার রাজধানী গৌড়, পাণ্ডুয়া, চাণ্ডা ছোট পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম, সোনারগাঁও, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, দেবকোট [ঘোড়াঘাট] এবং দশটি শহর। এই সমস্ত রাজধানীর নূতন শহরপত্তন করিবার সময় সর্বশ্রেণির বহু সংখ্যক শিল্পী, ব্যবসায়ী, সৈনিক, পণ্ডিত, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতির দরকার হইত। পুরাতন রাজধানী হইতে সর্বশ্রেণির লোকের অভাব পূর্ণ হইত না। কারণ, পুরাতন রাজধানী ত্যাগ করিয়া কোনও সময়েই সর্বশ্রেণির সর্বলোকের নূতন রাজধানীতে আগমন করা কদাপি সম্ভবপর হয় না। এজন্য নূতন রাজধানীতে ইরান, তুরান, আরব, আফগানিস্তানের সহস্র সহস্র শিল্পী, ব্যবসায়ী, যোদ্ধা এবং বোদ্ধার সমাবেশ হইত।
৯। বাঙ্গালাদেশ নদী-বহুল বলিয়া এখানে বাণিজ্য করা সুগম ছিল। বাণিজ্যের জন্য বহু নগর ও বন্দর প্রসিদ্ধ ছিল। হুগলী, সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, গৌড়, ফতেহবাদ, বর্ধমান প্রভৃতি নগর বিখ্যাত ছিল। বাণিজ্যপ্রিয় আরব ও মোগল সওদাগরগণ এজন্য দলে দলে আসিয়া এদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যে লিপ্ত হইয়াছিলেন। আজও চট্টগ্রাম ও ঢাকার বণিক সমাজে মুসলমান প্রাধান্য বিশেষরূপে বিরাজমান।
১০। মুসলমানদের সন্তান জন্মশক্তি সাধারণতঃ হিন্দুগণের অপেক্ষা অনেক বেশী। পূর্বে আরও অনেক বেশী ছিল। পুষ্টিকর খাদ্য এবং শারীরিক পরিশ্রমই ইহার প্রধান কারণ। আজও যেকোনো সমসংখ্যক অধিবাসী বিশিষ্ট হিন্দু ও মুসলমান গ্রামের শিশু-সংখ্যার শুমার [গণনা] করিলেই এই কথার সত্যতা উপলব্ধি হইবে। সেনসাস রিপোর্টও আমাদের অনুকূল।
১১। মুসলমান বিধবা রমণীদের পুনর্বিবাহ হয়। এজন্য তাহারা প্রায় সকলেই পুত্রবতী। কিন্তু হিন্দু বিধবাদিগের সে সুবিধা নাই।
১২। নূতন কোনও স্থানে বৃক্ষাদি রোপণ করিলে যেমন তাহা অত্যন্ত বংশবৃদ্ধি করে তেমনি কোনও জাতি নুতন দেশে যাইয়া প্রভুত্ব স্থাপন করিলে, তাহাদের বংশও দ্রুত বিস্তৃত হয়। মৃত্যুসংখ্যা তাহাদের মধ্যে কম হয় ।
১৩। প্রভু জাতি অপেক্ষা পরাধীন জাতির জননশক্তি নানা কারণে হ্রাস হয়। অনেক বন্য স্বাধীন জন্তু আবদ্ধ করিয়া গৃহে পালন করিলে তাহাদের শাবকাদি হয় না।
সেন্সাস্ রিপোর্টেও দেখা যায়, হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা মুসলমান অপেক্ষা ইংরাজের সন্তান সংখ্যা বেশী। যে জাতি যত দীর্ঘকাল অধীন থাকে, তাহাদের জীবনী শক্তিও ততই কম হইবে। প্রজনন-বিদ্যাবিদগণ ইহা সত্য বলিয়া স্বীকার করেন।
১৪। হিন্দুদিগের মধ্যে মোহান্ত, গোসাই, গিরি, সন্ন্যাসী প্রভৃতি অনেক শ্রেণির লোক চিরকাল দারপরিগ্রহ [বিবাহ] করিতে পারে না। কিন্তু মুসলমানদিগের সর্বশ্রেণির লোকই দারপরিগ্রহ করিয়া সন্তান উৎপাদন করিয়া থাকেন।
১৫। হিন্দুদিগের অপেক্ষা মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রথা অনেক বেশী ছিল এবং এখনও আছে; এজন্য তাহাদের সন্তান সংখ্যা হিন্দুদিগের অপেক্ষা খুব বেশী হইত এবং এখনও হয়।
১৬। বাঙ্গালাদেশের ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা, গঙ্গা, পদ্মা, ধলেশ্বরী, তিস্তা প্রভৃতি বহুসংখ্যক নদ-নদীতে যে সমস্ত নূতন চরের পত্তন হয়, তাহাতে শুধু মুসলমানেরাই উপনিবেশ স্থাপন করেন। এ সমস্ত চরের লোকজনের স্বাস্থ্য ভালো বলিয়া মৃত্যু সংখ্যা অতি সামান্য। অতি অল্পদিনেই এই সমস্ত চর মুসলমানদিগের দ্বারা পূর্ণ হইয়া যায়।
১৭। আজও আরব, আফগানিস্তান এবং হিন্দুস্থান হইতে দলে দলে মুসলমান আসিয়া বাঙ্গালার মুসলমান সমাজে মিশিয়া যাইতেছে। প্রতিবৎসর এইরূপে বাঙ্গালায় দশ হাজার করিয়া ভিন্ন দেশীয় মুসলমানের আমদানী হইতেছে। ইহারা এক পুরুষ পরেই বাঙ্গালী বনিয়া আসিতেছে।
১৮। আজও বাঙ্গালার সর্বত্রই প্রতিবৎসর বহু হিন্দু মুসলমান ধর্ম পরিগ্রহ করিতেছে। সমগ্র বঙ্গে এইরূপ হিন্দু হইতে মুসলমান হওয়ার লোকসংখ্যা দুই সহস্রের ন্যূন হইবে না। এক ময়মনসিংহ জেলাতেই প্রতিবৎসর তিনশত হিন্দু বিধবা গড়ে মুসলমানের গৃহে আশ্রয় লইতেছে।
১৯। মুসলমান অপেক্ষা হিন্দুদিগের মধ্যে বেশ্যার সংখ্যা তিনগুণ বেশী। সাধারণতঃ বেশ্যাদিগের প্রায়ই সন্তানাদি হয় না।
২০। প্রতিবৎসরেই অনেক হিন্দু যুবক এবং যুবতী খৃস্টান বা ব্রাহ্ম হইয়া যাইতেছে।
২১। মুসলমান-প্রধান উত্তর ও পূর্ববঙ্গ হইতে হিন্দু-প্রধান পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য, কৃষি শিল্পোৎপন্ন দ্রব্য হীন ও সামান্য। অবস্থার শোচনীয়তা এবং জলবায়ুর নিকৃষ্টতাও সংখ্যা হীনতার একটি প্রধান কারণ। পশ্চিমবঙ্গের যশোহর, নদীয়া, বর্ধমান প্রভৃতি জেলার লোকসংখ্যা সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী কমিয়া যাইতেছে। অন্যদিকে মুসলমান-প্রধান পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের লোকসংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িয়াই চলিয়াছে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! এক্ষণে উপরিউক্ত কারণাবলির বিষয়ে মনোনিবেশপূর্বক চিন্তা করিলে বাঙ্গালার মুসলমান সংখ্যার আধিক্য দেখিয়া আর কিছুমাত্র বিস্মিত হইতে হইবে না, বরং হিন্দুদিগের সংখ্যা যে আরও কেন কমিয়া যায় নাই তাহাই আশ্চর্য বলিয়া বোধ হইবে।
উপসংহার
আমরা বিশেষভাবে প্রদর্শন করিলাম যে, বাঙ্গালাদেশের মুসলমানগণ কোনও রূপেই নীচকুলোদ্ভব নিম্নশ্রেণির অস্পৃশ্য হিন্দুদিগের বংশধর নহে। নিম্নশ্রেণির হিন্দুজ মুসলমানের সংখ্যা অতি নগণ্য। আমরা যে সমস্ত যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছি, তাহাতে মুসলিম-বিদ্বেষী কোনো মহাপণ্ডিত আর বাঙ্গালার মুসলমানদিগকে সহজে নীচবংশ বলিয়া অভিহিত করিতে সাহসী হইবেন না। আমাদের নব্য-যুবক এবং ছাত্র-ছাত্রীগণ প্রাণের সহিত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করুন যে, তাঁহারা সেই সমস্ত জগদ্বিজয়ী জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশারদ, মহাপরাক্রান্ত বিশ্ব ধন্য আরব, তুর্কী ও পাঠানদিগের বংশধর। তাঁহাদের পূর্ব-পুরুষগণ বীর্যে-শৌর্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমস্ত পৃথিবীকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাদের পূর্ব পুরুষগণই হিন্দুদিগকে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া শাসন করিয়াছিলেন। উন্নত সভ্যতা এবং আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়াছিলেন। হিন্দুদিগের জাতীয় নাম “হিন্দু” শব্দটি পর্যন্ত মুসলমানেরই প্রদত্ত। তাঁহারা বিদ্যা-বুদ্ধি চরিত্র এবং শৌর্য-বীর্যে হিন্দুদিগের অপেক্ষা শতগুণ শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
সুতরাং হে বঙ্গের মুসলিম ছাত্রবৃন্দ এবং যুবকমণ্ডলী! তোমরা যদি আবার জ্ঞানচর্চায় এবং জাতীয় উন্নতিবিধানে গভীরভাবে মনোনিবেশ করো, তাহা হইলে অচিরে প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রে সকল কার্যেই অগ্রবর্তী এবং যশস্বী হইতে পারিবে; কেহই তোমাদিগকে বাধা দিতে পারিবে না। এক্ষণে চাই তোমাদের জ্বলন্ত জীবন্ত আত্ম-বিশ্বাস এবং কঠোর ও কঠিন সাধনা।
সাপ্তাহিক ছোলতান, ৮ম বর্ষ, ২৬শ সংখ্যা ৪, ৩০শে কার্তিক ১৩৩০ (১৬ই নভেম্বর ১৯২৩)।
প্রবন্ধ সমগ্র, জ্ঞান বিতরণী, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০, পৃ.২৩৮-২৪৬।
- সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী
PDF Link: বাংলা বই - বাঙ্গালী মুসলমানদের আত্মপরিচয় - PDF