If you're in doubt ask الله.
Forum Staff
Moderator
Generous
ilm Seeker
Uploader
Exposer
HistoryLover
Q&A Master
Salafi User
আল্লামা আলবানী রাহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কেন সালাফী নামকরণ করা হয়েছে? সালাফীরা কি মানুষকে দল, ফিরকা ও মাযহাবের দিকে দাওয়াত দেয়?’
তিনি জবাবে বলেন, ‘সালাফ’ শব্দটি আরবী ভাষায় সুপ্রসিদ্ধ। শরীআতের ভাষাতেও শব্দটি অনেক সুপরিচিত। আমরা এখানে শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তাঁর মৃত্যুশয্যায় সাইয়িদা ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বলেন, وَنِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ অর্থাৎ আমি তোমার উত্তম সালাফ।[1]
আলিমদের মাঝে এ শব্দের ব্যবহার অনেক; যা গণনার বাইরে। আমরা এখানে একটি উদাহরণ যথেষ্ট মনে করছি। বাক্যটি সালাফীরা বিদআতের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। বাক্যটি হলো :
তবে ইলমধারী কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা এই সম্বন্ধকে অস্বীকার করে। তারা মনে করে এই সম্বন্ধনের কোনো ভিত্তি নেই। তারা বলে, ‘আমি সালাফী’ এ কথা বলা কোনো মুসলিমের জন্য জায়েয নয়।
এসব লোকেরা যেন বলতে চাচ্ছে, কোনো মুসলিমের জন্য এ কথা বলা জায়েয নয় যে, সালাফগণ যে আকীদা, ইবাদত ও মানহাজের ওপর ছিলেন আমি তার অনুসারী।
এমন আপত্তি তোলা মানে নিঃসন্দেহে সে-সঠিক ইসলাম থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করা যে-ইসলামের ওপর আমাদের সালাফে সালিহীন ছিলেন। আর তাদের মূলে ছিলেন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যেমনটি তিনি বুখারী-মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে মুতাওয়াতির হাদীসে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার প্রজন্মের, তারপর যারা আসবে, তারপর যারা আসবে।’
অতএব, কোনো মুসলিমের জন্য জায়েয নয় যে, সে নিজেকে সালাফে সালিহীনদের দিকে সম্পৃক্ত করা থেকে মুক্ত ঘোষণা করবে। তবে কোনো মুসলিম যদি অন্যান্য যে-কোনো দিকে সম্পৃক্ত করা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করে, তাহলে তাকে কুফর অথবা ফিসকের দিকে সম্পৃক্ত করা কোনো বিদ্বানের জন্য জায়েয নয়।
যারা সালাফদের দিকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি তোলে, দেখা যায় তারাই কোনো না কোনো মাযহাবের দিকে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে; সে-মাযহাব হতে পারি ফিকহী অথবা আকাঈদী। দেখা যায়, সে আশআরী অথবা মাতুরিদী; কিংবা আহলুল হাদীস অথবা হানাফী বা শাফিয়ী কিংবা মালিকী অথবা হাম্বালী।
অথচ আশআরী বা চার মাযহাবের যেকোনো মাযহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা মানে নির্ভুল নন এমন ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা। যদিও তাদের মাঝে এমন আলিম রয়েছেন যারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। ইশ! তারা যদি নির্ভুল নন এমন ব্যক্তিদের দিকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি তুলতো!
যারা সালাফদের দিকে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত ও সম্বন্ধ করে তারা মূলত সামগ্রীকভাবে নির্ভুলতার দিকে সম্পৃক্ত করে। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দলের নিদর্শন হচ্ছে, তারা তা আঁকড়ে ধরে থাকে যার ওপর তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন। অতএব, যে ব্যক্তি তাদেরকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন তিনি নিঃসন্দেহে তার রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর অটল রয়েছেন।
সালাফদের দিকে সম্বন্ধের কারণে ব্যক্তি সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং তার জন্য মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পথে চলা সহজ হয়ে যায়। অন্য কোনো কিছুর দিকে সম্বন্ধ বা সম্পৃক্ত করলে এমন ফযীলত পাওয়া যায় না। কারণ, অন্য কোনোকিছু বা কোনো ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করলে তা দুই অবস্থা মুক্ত নয়:
ক. অনির্ভুল ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা হয়।
খ. এমন ব্যক্তিদের দিকে সম্পৃক্ত করা যারা অনির্ভুল ব্যক্তিদের অনুসরণ করে।
ফলে তারাও নির্ভুল থাকে না। কিন্তু সাহাবীদের নির্ভুলতার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ এর ব্যতিক্রম। কারণ, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ও অবর্তমানে তাঁর সাহাবীদের আঁকড়ে ধরতে আদেশ দিয়েছেন।
আমরা উচ্চকণ্ঠে বারবার বলি, আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ বুঝতে হবে সাহাবীদের বুঝ ও মানহাজে। তাহলে আমরা ডান-বামে বিচ্যুত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকবো এবং নিজেদের এমন বুঝের কারণে বিচ্যুত হবো না যার পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহ নেই।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কেন আমরা শুধু কুরআন ও সুন্নাহর দিকে সম্পৃক্ত করাকে যথেষ্ট মনে করি না। এর কারণ দুটি:
ক. শরীআতের স্পষ্ট দলীলের কারণে।
খ. ইসলামী দল ও ফিরকাগুলোর বাস্তব অবস্থা দেখে।
ক. প্রথম কারণ : আমরা শরীআতের দলীলে পাই যে, কিতাব ও সুন্নাহ ছাড়াও আরেকটি জিনিসের অনুসরণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
যদি কোনো শাসক থাকে এবং মুসলিমরা তার হাতে বাইয়াত করে, তাহলে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব, যেমনভাবে কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য করা ওয়াজিব। অথচ তিনি ও তার সভাসদের লোকেরা ভুল করতে পারেন। এরপরও তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব হওয়ার কারণ হচ্ছে, মতপার্থক্যের ক্ষতি রোধ করা। তবে শর্ত হচ্ছে ভালো কাজে আনুগত্য করতে হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘স্রষ্টার নাফারমানীমূলক কাজে সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’[3]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
আল্লাহ তাআলা অনর্থক কথা বলা থেকে পবিত্র। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে মুমিনদের যে পথের কথা উল্লেখ করেছেন, নিঃসন্দেহে তার পেছনে বিরাট প্রজ্ঞা ও মহা কল্যাণ রয়েছে। এ আয়াত প্রমাণ করে আমাদের এক বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। সে-দায়িত্বটি হলো, আমরা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করবো প্রথম যুগ তথা সাহাবী, তাদের পরবর্তী যুগ তথা তাবিয়ী এবং তাদের পরবর্তী যুগের লোকদের বুঝ ও মানহাজ অনুযায়ী। আর সালাফীরা এর-ই দাওয়াত দেয় এবং তাদের দাওয়াত ও মাসলাকের ভিত্তি এটাই।
প্রকৃতার্থে সালাফীরা উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাওয়াত দেয়। এর বিপরীতে অন্য সব দাওয়াত উম্মাহকে বিভক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
যারা কিতাব-সুন্নাহ ও সালাফদের মাঝে বিভাজন করে তারা কিছুতেই সত্যবাদী হতে পারে না।
খ. দ্বিতীয় কারণ : অধুনা দল ও ফিরকাগুলো সাধারণত ‘মুমিনদের পথে’র অনুসরণ করার ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করে না। অথচ উপরিউক্ত আয়াতে ‘মুমিনদের পথ’ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে এবং হাদীসেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপ্রদান করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ব্যতীত সবগুলো দল জাহান্নামে যাবে। সেই একটি দলের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে দলটি হলো, আজ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার ওপর রয়েছেন ঠিক তার ওপর থাকবে।’[6]
উপরিউক্ত আয়াতে মুমিনদের যে পথের কথা বলা হয়েছে, এ হাদীসেও একই কথা বলা হয়েছে।
ইরবায ইবন সারিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর আরেক হাদীসে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমার সুন্নাতকে এবং আমার পরে সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা।’[7]
অতএব, প্রমাণ হয়, সুন্নাত দুই প্রকার। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত।
আমাদের মতো পরবর্তীদের দায়িত্ব হচ্ছে, কিতাব, সুন্নাহ ও মুমিনদের পথে ফিরে যাওয়া। আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, সালাফে সালিহীনের বুঝের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমরা নিজেরাই কিতাব ও সুন্নাহ বুঝবো।
বর্তমান যুগে এমন একটি নাম প্রয়োজন যা সূক্ষ্মভাবে স্বতন্ত্রতা বহন করবে। বর্তমানে ‘আমি মুসলিম’ বা ‘আমার মাযহাব ইসলাম’ শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। কারণ, প্রতিটি ফিরকা ও দল একই কথা বলে। রাফিযী, ইবাযী, কাদিয়ানী-সহ প্রত্যেক ফিরকা নিজেদেরকে মুসলিম বলে। তাহলে কোন পরিচয়ের মাধ্যমে তাদের থেকে নিজেকে পৃথক করবেন?
যদি বলেন, ‘আমি কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী একজন মুসলিম’, তাহলে এটাও যথেষ্ট নয়। কারণ, আশআরী, মাতুরিদী, হিযবী-সহ সকল ফিরকা বলে, আমরা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী। অতএব, সবার থেকে অতিস্পষ্টভাবে নিজেকে স্বতন্ত্র করতে হলে বলতে হবে, ‘আমি কিতাব-সুন্নাহ ও সালাফে সালিহীনের মানহাজের অনুসারী মুসলিম’। আর এর সংক্ষিপ্তরূপ হলো, ‘আমি সালাফী’।
অতএব, বোধ, কল্পনা, ইলম, আমল, দাওয়াত ও জিহাদ-সহ সর্বক্ষেত্রে সালাফদের বুঝ বাদ দিয়ে শুধু কুরআন-সুন্নাহর ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়। এটি এমন এক ধ্রুবসত্য কথা যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
আমরা সবাই জানি যে, সালাফগণ নির্দিষ্ট কোনো মাযহাব বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে গোঁড়ামি করেননি। তাদের মাঝে বাকারী, উমারী, উসমানী বা আলীবী নামক কোনো মাযহাব ছিলো না। বরং তারা সুযোগ-সুবিধা মতো আবূ বাকর বা উমার বা আবূ হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে থেকে জেনে নিতেন। কারণ, তারা জানতেন, একজন ছাড়া অন্য কারো একনিষ্ঠ ও নিঃশর্ত অনুসরণ বৈধ নয়। আর তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি নিজের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে কোনো কথা বলেন না। যা বলেন সব ওহী।
যারা আমাদের সালাফী বলার ব্যাপারে আপত্তি তোলে তাদের কথা মেনে নিয়ে যদি আমরা নিজেদেরকে সালাফী না বলে শুধু মুসলিম বলি, তাহলে কি তারা নিজেদেরকে নিজেদের দল, ফিরকা, মাযহাব ও তরীকার দিকে সম্পৃক্ত করা থেকে বিরত রাখবে? অথচ সেসব দিকে সম্পৃক্ত করা শরীআতসম্মত নয় এবং সঠিক নয়। কিন্তু সালাফদের দিকে সম্পৃক্ত করা সঠিক ও গর্বের বিষয়।[8]
প্রখ্যাত মিসরীয় বিদ্বান ও ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে নারী স্বাধীনতা’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্দুল হালীম আবূ শুক্কাহ-এর সাথে তার এ বিষয়ে একটি চিত্তাকর্ষক সংলাপ রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।
আলবানী: হে আবূ শুক্কাহ, তোমাকে যদি বলা হয় যে, তোমার মাযহাব কী? তখন তুমি কী জবাব দিবে?
আবূ শুক্কাহ: বলব, আমি মুসলিম।
আলবানী: কিন্তু এটা তো যথেষ্ট নয়!
আবূ শুক্কাহ: কেন? আল্লাহ তো আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে নামকরণ করেছেন।
আলবানী: এ জবাব সঠিক হতো যদি আমরা ইসলামের প্রথম যুগে অবস্থান করতাম। যখন বিভিন্ন মতবাদের প্রসার ঘটেনি। আর যে মতবাদগুলোর সাথে আমাদের মৌলিক আকীদাগত মতপার্থক্য রয়েছে, তাদেরকে আমরা যদি এই প্রশ্ন করি তোমার মাযহাব কী তখন তাদের জবাবও কিন্তু একই হবে। শীআ, রাফিযী, খারেজী, নুসাইরী, আলাবী-সহ সবাই বলবে ‘আমি মুসলিম’। অতএব, আজকের দিনে কেবল মুসলিম বলাই যথেষ্ট নয়।
আবূ শুক্কাহ: ঠিক আছে। তাহলে আমি বলব, আমি কিতাব ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম।
আলবানী: এটাও তো যথেষ্ট নয়!
আবূ শুক্কাহ: কেন?
আলবানী: শীআ, রাফিযী-সহ যাদের কথা আমি উদাহরণ স্বরূপ বললাম, তাদের কেউ কি বলে যে, আমি মুসলিম, তবে কিতাব ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত নই? কেউ কি বলে যে, আমি কিতাব ও সুন্নাহ অনুযায়ী চলি না?
(অতঃপর তিনি ‘সালাফে সালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণ’-এর গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন)
আবূ শুক্কাহ: ঠিক আছে। আমি সালাফে সালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী মুসলিম।
আলবানী: কেউ তোমার মাযহাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তুমি কি তাকে এ কথাই বলবে?
আবূ শুক্কাহ: হ্যাঁ।
আলবানী: আচ্ছা আমরা যদি এর ভাষাগত সংক্ষেপায়ন করে ‘সালাফী’ বলি, সেক্ষেত্রে তোমার মতামত কী? কেননা সর্বোত্তম বাক্য তো সেটাই, যেটা সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ।
আবূ শুক্কাহ: আমি আপনার প্রতি ভদ্রতা প্রদর্শনের খাতিরে ‘হ্যাঁ’ বলছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস পূর্বের মতোই। কারণ যখনই কোনো মানুষ শুনবে যে আপনি সালাফী, তখনই তার চিন্তাধারা ঘুরে যাবে কঠোরতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়া এমন অনেক অনুসৃত বিষয়ের দিকে, যার মধ্যে সালাফীগণ ডুবে আছেন।
আলবানী: ধরে নিলাম তোমার কথাই সঠিক। কিন্তু যদি তুমি নিজেকে মুসলিমও বলো, তবে কি সেটা শীআ রাফিযী বা ইসমাঈলীর দিকেও প্রত্যাবর্তিত হবে না?
আবূ শুক্কাহ: হতে পারে। তবে আমি কুরআনের ঐ আয়াতেরই অনুসরণ করতে চাই- ‘আর তিনি পূর্বেই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম’।[9]
আলবানী: না, হে ভাই, তুমি এই আয়াতে অনুসরণ করোনি। কেননা আয়াতটি দ্বারা সঠিক ও বিশুদ্ধ ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। তাছাড়া মানুষকে সম্বোধন করা উচিত তার জ্ঞানের পরিমাপ বুঝে। অথচ তোমার এই ‘মুসলিম’ পরিচয়দানের মাধ্যমে তুমি আয়াতটিতে উদ্দেশ্যকৃত মুসলিম কি না, তা কি কেউ বুঝবে?
ইতোপূর্বে সালাফী বলার ক্ষেত্রে তুমি যে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করলে, সেটা সঠিক হতে পারে বা নাও হতে পারে। কেননা সালাফীদের কঠোরতার ব্যাপারে তোমার যে বক্তব্য, তা কোনো কোনো সালাফীর মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা সালাফীদের আকীদা ও জ্ঞানগত মানহাজ নয়। তুমি ব্যক্তির কথা ছেড়ে দাও। আমরা এখন কথা বলব মানহাজ নিয়ে। কেননা আমরা যদি শীআ, খারিজী, সূফী বা মুতাযিলীদের কথা বলি, তাহলে সেখানেও কিন্তু তুমি যে আশঙ্কার কথা বলছ, তা ফিরে আসবে।
অতএব, এটা আমাদের বিষয় নয়। বরং আমরা এমন একটি নাম খুঁজব, যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল মাযহাবের দিকে নির্দেশ করে।
অতঃপর আলবানী বলেন, আচ্ছা, সাহাবায়ে কিরামের সবাই কি মুসলিম ছিলেন না?
আবূ শুক্কাহ: অবশ্যই।
আলবানী: কিন্তু তাদের মধ্যেও এমন কেউ ছিলেন যিনি চুরি করেছেন, জেনা করেছেন। তবুও তাদের কেউ কিন্তু একথা বলার অনুমতি দেননি যে, আমি মুসলিম ছিলাম না। বরং তিনি মানহাজ বা নীতিগতভাবে মুসলিম এবং আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণবিশ্বাসী। কিন্তু তিনি কখনো স্বীয় নীতির বিপরীত করে ফেলেছেন। কেননা তিনি তো নিষ্পাপ নন।
এ জন্যই আমরা এমন একটি শব্দ সম্পর্কে কথা বলছি, যা আমাদের আকীদা, চিন্তাধারা এবং যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ইবাদত করি এরূপ দ্বীন সংশ্লিষ্ট জীবনের সকল বিষয়কে নির্দেশ করবে। তবে যারা চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী, তাদের বিষয়টি আলাদা।
অতঃপর আলবানী বলেন, আমি চাই যে তুমি ‘সালাফী’ নামক সংক্ষিপ্ত এই শব্দটি নিয়ে চিন্তা গবেষণা করো, যাতে তোমার মধ্যে ‘মুসলিম’ শব্দ নিয়ে আর জিদ না থাকে। কেননা তুমি জানো যে, মুসলিম শব্দ দ্বারা তুমি যা বোঝাতে চাচ্ছ, তা বোঝার মতো কখনই কাউকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং মানুষের সাথে তাদের জ্ঞান মোতাবেক কথা বলো। আল্লাহ তোমাকে বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য তোমার চিন্তায় বরকত দিন![10]
- উস্তায আবদুল্লাহ মাহমুদ
[1] সহীহ মুসলিম, ২৪৫০
[2] সূরা নিসা, আয়াত : ৫৯
[3] মুসনাদ আহমাদ, ২০৬৫৩; মুজামুত তবারানী, ১৪৭৯৫, হাদীসটি সহীহ
[4] সূরা নিসা, আয়াত : ১১৫
[5] সূরা তাওবা, আয়াত : ১১৯
[6] সিলসিলাতুস সহীহাহ, ২০৩, ১৪৯২
[7] সুনানু আবী দাউদ, ৪৬০৭; সুনানুত তিরমিযী, ২৬৭৬; সুনানু ইবন মাজাহ, ৪৪, হাদীসটি সহীহ
[8] আল-মানহাজুল সালাফী ইনদাশ শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী, পৃ. ১৭-২১
[9] সূরা হজ্জ, আয়াত : ৭৮
[10] লিমাযা ইখতারতুল মানহাজাস সালাফী? পৃ. ৩৬-৩৮
তিনি জবাবে বলেন, ‘সালাফ’ শব্দটি আরবী ভাষায় সুপ্রসিদ্ধ। শরীআতের ভাষাতেও শব্দটি অনেক সুপরিচিত। আমরা এখানে শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তাঁর মৃত্যুশয্যায় সাইয়িদা ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বলেন, وَنِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ অর্থাৎ আমি তোমার উত্তম সালাফ।[1]
আলিমদের মাঝে এ শব্দের ব্যবহার অনেক; যা গণনার বাইরে। আমরা এখানে একটি উদাহরণ যথেষ্ট মনে করছি। বাক্যটি সালাফীরা বিদআতের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। বাক্যটি হলো :
وكل خير في اتباع من سلف وكل شر في ابتداع من خلف
অর্থাৎ যাবতীয় কল্যাণ সালাফদের অনুসরণে আর যাবতীয় অকল্যাণ খালাফদের নব-উদ্ভাবনে।তবে ইলমধারী কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা এই সম্বন্ধকে অস্বীকার করে। তারা মনে করে এই সম্বন্ধনের কোনো ভিত্তি নেই। তারা বলে, ‘আমি সালাফী’ এ কথা বলা কোনো মুসলিমের জন্য জায়েয নয়।
এসব লোকেরা যেন বলতে চাচ্ছে, কোনো মুসলিমের জন্য এ কথা বলা জায়েয নয় যে, সালাফগণ যে আকীদা, ইবাদত ও মানহাজের ওপর ছিলেন আমি তার অনুসারী।
এমন আপত্তি তোলা মানে নিঃসন্দেহে সে-সঠিক ইসলাম থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করা যে-ইসলামের ওপর আমাদের সালাফে সালিহীন ছিলেন। আর তাদের মূলে ছিলেন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যেমনটি তিনি বুখারী-মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে মুতাওয়াতির হাদীসে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার প্রজন্মের, তারপর যারা আসবে, তারপর যারা আসবে।’
অতএব, কোনো মুসলিমের জন্য জায়েয নয় যে, সে নিজেকে সালাফে সালিহীনদের দিকে সম্পৃক্ত করা থেকে মুক্ত ঘোষণা করবে। তবে কোনো মুসলিম যদি অন্যান্য যে-কোনো দিকে সম্পৃক্ত করা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করে, তাহলে তাকে কুফর অথবা ফিসকের দিকে সম্পৃক্ত করা কোনো বিদ্বানের জন্য জায়েয নয়।
যারা সালাফদের দিকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি তোলে, দেখা যায় তারাই কোনো না কোনো মাযহাবের দিকে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে; সে-মাযহাব হতে পারি ফিকহী অথবা আকাঈদী। দেখা যায়, সে আশআরী অথবা মাতুরিদী; কিংবা আহলুল হাদীস অথবা হানাফী বা শাফিয়ী কিংবা মালিকী অথবা হাম্বালী।
অথচ আশআরী বা চার মাযহাবের যেকোনো মাযহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা মানে নির্ভুল নন এমন ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা। যদিও তাদের মাঝে এমন আলিম রয়েছেন যারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। ইশ! তারা যদি নির্ভুল নন এমন ব্যক্তিদের দিকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি তুলতো!
যারা সালাফদের দিকে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত ও সম্বন্ধ করে তারা মূলত সামগ্রীকভাবে নির্ভুলতার দিকে সম্পৃক্ত করে। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দলের নিদর্শন হচ্ছে, তারা তা আঁকড়ে ধরে থাকে যার ওপর তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন। অতএব, যে ব্যক্তি তাদেরকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন তিনি নিঃসন্দেহে তার রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর অটল রয়েছেন।
সালাফদের দিকে সম্বন্ধের কারণে ব্যক্তি সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং তার জন্য মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পথে চলা সহজ হয়ে যায়। অন্য কোনো কিছুর দিকে সম্বন্ধ বা সম্পৃক্ত করলে এমন ফযীলত পাওয়া যায় না। কারণ, অন্য কোনোকিছু বা কোনো ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করলে তা দুই অবস্থা মুক্ত নয়:
ক. অনির্ভুল ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা হয়।
খ. এমন ব্যক্তিদের দিকে সম্পৃক্ত করা যারা অনির্ভুল ব্যক্তিদের অনুসরণ করে।
ফলে তারাও নির্ভুল থাকে না। কিন্তু সাহাবীদের নির্ভুলতার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ এর ব্যতিক্রম। কারণ, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ও অবর্তমানে তাঁর সাহাবীদের আঁকড়ে ধরতে আদেশ দিয়েছেন।
আমরা উচ্চকণ্ঠে বারবার বলি, আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ বুঝতে হবে সাহাবীদের বুঝ ও মানহাজে। তাহলে আমরা ডান-বামে বিচ্যুত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকবো এবং নিজেদের এমন বুঝের কারণে বিচ্যুত হবো না যার পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহ নেই।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কেন আমরা শুধু কুরআন ও সুন্নাহর দিকে সম্পৃক্ত করাকে যথেষ্ট মনে করি না। এর কারণ দুটি:
ক. শরীআতের স্পষ্ট দলীলের কারণে।
খ. ইসলামী দল ও ফিরকাগুলোর বাস্তব অবস্থা দেখে।
ক. প্রথম কারণ : আমরা শরীআতের দলীলে পাই যে, কিতাব ও সুন্নাহ ছাড়াও আরেকটি জিনিসের অনুসরণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির।[2]যদি কোনো শাসক থাকে এবং মুসলিমরা তার হাতে বাইয়াত করে, তাহলে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব, যেমনভাবে কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য করা ওয়াজিব। অথচ তিনি ও তার সভাসদের লোকেরা ভুল করতে পারেন। এরপরও তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব হওয়ার কারণ হচ্ছে, মতপার্থক্যের ক্ষতি রোধ করা। তবে শর্ত হচ্ছে ভালো কাজে আনুগত্য করতে হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘স্রষ্টার নাফারমানীমূলক কাজে সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’[3]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
হক স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যে ব্যক্তি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সেদিকে ফেরাবো সেদিকে সে ফিরতে চায় এবং তাকে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ করবো। আর তা নিকৃষ্ট গন্তব্য।[4]আল্লাহ তাআলা অনর্থক কথা বলা থেকে পবিত্র। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে মুমিনদের যে পথের কথা উল্লেখ করেছেন, নিঃসন্দেহে তার পেছনে বিরাট প্রজ্ঞা ও মহা কল্যাণ রয়েছে। এ আয়াত প্রমাণ করে আমাদের এক বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। সে-দায়িত্বটি হলো, আমরা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করবো প্রথম যুগ তথা সাহাবী, তাদের পরবর্তী যুগ তথা তাবিয়ী এবং তাদের পরবর্তী যুগের লোকদের বুঝ ও মানহাজ অনুযায়ী। আর সালাফীরা এর-ই দাওয়াত দেয় এবং তাদের দাওয়াত ও মাসলাকের ভিত্তি এটাই।
প্রকৃতার্থে সালাফীরা উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাওয়াত দেয়। এর বিপরীতে অন্য সব দাওয়াত উম্মাহকে বিভক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
আর তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।[5]যারা কিতাব-সুন্নাহ ও সালাফদের মাঝে বিভাজন করে তারা কিছুতেই সত্যবাদী হতে পারে না।
খ. দ্বিতীয় কারণ : অধুনা দল ও ফিরকাগুলো সাধারণত ‘মুমিনদের পথে’র অনুসরণ করার ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করে না। অথচ উপরিউক্ত আয়াতে ‘মুমিনদের পথ’ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে এবং হাদীসেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপ্রদান করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ব্যতীত সবগুলো দল জাহান্নামে যাবে। সেই একটি দলের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে দলটি হলো, আজ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার ওপর রয়েছেন ঠিক তার ওপর থাকবে।’[6]
উপরিউক্ত আয়াতে মুমিনদের যে পথের কথা বলা হয়েছে, এ হাদীসেও একই কথা বলা হয়েছে।
ইরবায ইবন সারিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর আরেক হাদীসে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমার সুন্নাতকে এবং আমার পরে সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা।’[7]
অতএব, প্রমাণ হয়, সুন্নাত দুই প্রকার। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত।
আমাদের মতো পরবর্তীদের দায়িত্ব হচ্ছে, কিতাব, সুন্নাহ ও মুমিনদের পথে ফিরে যাওয়া। আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, সালাফে সালিহীনের বুঝের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমরা নিজেরাই কিতাব ও সুন্নাহ বুঝবো।
বর্তমান যুগে এমন একটি নাম প্রয়োজন যা সূক্ষ্মভাবে স্বতন্ত্রতা বহন করবে। বর্তমানে ‘আমি মুসলিম’ বা ‘আমার মাযহাব ইসলাম’ শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। কারণ, প্রতিটি ফিরকা ও দল একই কথা বলে। রাফিযী, ইবাযী, কাদিয়ানী-সহ প্রত্যেক ফিরকা নিজেদেরকে মুসলিম বলে। তাহলে কোন পরিচয়ের মাধ্যমে তাদের থেকে নিজেকে পৃথক করবেন?
যদি বলেন, ‘আমি কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী একজন মুসলিম’, তাহলে এটাও যথেষ্ট নয়। কারণ, আশআরী, মাতুরিদী, হিযবী-সহ সকল ফিরকা বলে, আমরা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী। অতএব, সবার থেকে অতিস্পষ্টভাবে নিজেকে স্বতন্ত্র করতে হলে বলতে হবে, ‘আমি কিতাব-সুন্নাহ ও সালাফে সালিহীনের মানহাজের অনুসারী মুসলিম’। আর এর সংক্ষিপ্তরূপ হলো, ‘আমি সালাফী’।
অতএব, বোধ, কল্পনা, ইলম, আমল, দাওয়াত ও জিহাদ-সহ সর্বক্ষেত্রে সালাফদের বুঝ বাদ দিয়ে শুধু কুরআন-সুন্নাহর ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়। এটি এমন এক ধ্রুবসত্য কথা যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
আমরা সবাই জানি যে, সালাফগণ নির্দিষ্ট কোনো মাযহাব বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে গোঁড়ামি করেননি। তাদের মাঝে বাকারী, উমারী, উসমানী বা আলীবী নামক কোনো মাযহাব ছিলো না। বরং তারা সুযোগ-সুবিধা মতো আবূ বাকর বা উমার বা আবূ হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে থেকে জেনে নিতেন। কারণ, তারা জানতেন, একজন ছাড়া অন্য কারো একনিষ্ঠ ও নিঃশর্ত অনুসরণ বৈধ নয়। আর তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি নিজের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে কোনো কথা বলেন না। যা বলেন সব ওহী।
যারা আমাদের সালাফী বলার ব্যাপারে আপত্তি তোলে তাদের কথা মেনে নিয়ে যদি আমরা নিজেদেরকে সালাফী না বলে শুধু মুসলিম বলি, তাহলে কি তারা নিজেদেরকে নিজেদের দল, ফিরকা, মাযহাব ও তরীকার দিকে সম্পৃক্ত করা থেকে বিরত রাখবে? অথচ সেসব দিকে সম্পৃক্ত করা শরীআতসম্মত নয় এবং সঠিক নয়। কিন্তু সালাফদের দিকে সম্পৃক্ত করা সঠিক ও গর্বের বিষয়।[8]
প্রখ্যাত মিসরীয় বিদ্বান ও ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে নারী স্বাধীনতা’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্দুল হালীম আবূ শুক্কাহ-এর সাথে তার এ বিষয়ে একটি চিত্তাকর্ষক সংলাপ রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।
আলবানী: হে আবূ শুক্কাহ, তোমাকে যদি বলা হয় যে, তোমার মাযহাব কী? তখন তুমি কী জবাব দিবে?
আবূ শুক্কাহ: বলব, আমি মুসলিম।
আলবানী: কিন্তু এটা তো যথেষ্ট নয়!
আবূ শুক্কাহ: কেন? আল্লাহ তো আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে নামকরণ করেছেন।
আলবানী: এ জবাব সঠিক হতো যদি আমরা ইসলামের প্রথম যুগে অবস্থান করতাম। যখন বিভিন্ন মতবাদের প্রসার ঘটেনি। আর যে মতবাদগুলোর সাথে আমাদের মৌলিক আকীদাগত মতপার্থক্য রয়েছে, তাদেরকে আমরা যদি এই প্রশ্ন করি তোমার মাযহাব কী তখন তাদের জবাবও কিন্তু একই হবে। শীআ, রাফিযী, খারেজী, নুসাইরী, আলাবী-সহ সবাই বলবে ‘আমি মুসলিম’। অতএব, আজকের দিনে কেবল মুসলিম বলাই যথেষ্ট নয়।
আবূ শুক্কাহ: ঠিক আছে। তাহলে আমি বলব, আমি কিতাব ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম।
আলবানী: এটাও তো যথেষ্ট নয়!
আবূ শুক্কাহ: কেন?
আলবানী: শীআ, রাফিযী-সহ যাদের কথা আমি উদাহরণ স্বরূপ বললাম, তাদের কেউ কি বলে যে, আমি মুসলিম, তবে কিতাব ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত নই? কেউ কি বলে যে, আমি কিতাব ও সুন্নাহ অনুযায়ী চলি না?
(অতঃপর তিনি ‘সালাফে সালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণ’-এর গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন)
আবূ শুক্কাহ: ঠিক আছে। আমি সালাফে সালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী মুসলিম।
আলবানী: কেউ তোমার মাযহাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তুমি কি তাকে এ কথাই বলবে?
আবূ শুক্কাহ: হ্যাঁ।
আলবানী: আচ্ছা আমরা যদি এর ভাষাগত সংক্ষেপায়ন করে ‘সালাফী’ বলি, সেক্ষেত্রে তোমার মতামত কী? কেননা সর্বোত্তম বাক্য তো সেটাই, যেটা সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ।
আবূ শুক্কাহ: আমি আপনার প্রতি ভদ্রতা প্রদর্শনের খাতিরে ‘হ্যাঁ’ বলছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস পূর্বের মতোই। কারণ যখনই কোনো মানুষ শুনবে যে আপনি সালাফী, তখনই তার চিন্তাধারা ঘুরে যাবে কঠোরতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়া এমন অনেক অনুসৃত বিষয়ের দিকে, যার মধ্যে সালাফীগণ ডুবে আছেন।
আলবানী: ধরে নিলাম তোমার কথাই সঠিক। কিন্তু যদি তুমি নিজেকে মুসলিমও বলো, তবে কি সেটা শীআ রাফিযী বা ইসমাঈলীর দিকেও প্রত্যাবর্তিত হবে না?
আবূ শুক্কাহ: হতে পারে। তবে আমি কুরআনের ঐ আয়াতেরই অনুসরণ করতে চাই- ‘আর তিনি পূর্বেই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম’।[9]
আলবানী: না, হে ভাই, তুমি এই আয়াতে অনুসরণ করোনি। কেননা আয়াতটি দ্বারা সঠিক ও বিশুদ্ধ ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। তাছাড়া মানুষকে সম্বোধন করা উচিত তার জ্ঞানের পরিমাপ বুঝে। অথচ তোমার এই ‘মুসলিম’ পরিচয়দানের মাধ্যমে তুমি আয়াতটিতে উদ্দেশ্যকৃত মুসলিম কি না, তা কি কেউ বুঝবে?
ইতোপূর্বে সালাফী বলার ক্ষেত্রে তুমি যে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করলে, সেটা সঠিক হতে পারে বা নাও হতে পারে। কেননা সালাফীদের কঠোরতার ব্যাপারে তোমার যে বক্তব্য, তা কোনো কোনো সালাফীর মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা সালাফীদের আকীদা ও জ্ঞানগত মানহাজ নয়। তুমি ব্যক্তির কথা ছেড়ে দাও। আমরা এখন কথা বলব মানহাজ নিয়ে। কেননা আমরা যদি শীআ, খারিজী, সূফী বা মুতাযিলীদের কথা বলি, তাহলে সেখানেও কিন্তু তুমি যে আশঙ্কার কথা বলছ, তা ফিরে আসবে।
অতএব, এটা আমাদের বিষয় নয়। বরং আমরা এমন একটি নাম খুঁজব, যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল মাযহাবের দিকে নির্দেশ করে।
অতঃপর আলবানী বলেন, আচ্ছা, সাহাবায়ে কিরামের সবাই কি মুসলিম ছিলেন না?
আবূ শুক্কাহ: অবশ্যই।
আলবানী: কিন্তু তাদের মধ্যেও এমন কেউ ছিলেন যিনি চুরি করেছেন, জেনা করেছেন। তবুও তাদের কেউ কিন্তু একথা বলার অনুমতি দেননি যে, আমি মুসলিম ছিলাম না। বরং তিনি মানহাজ বা নীতিগতভাবে মুসলিম এবং আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণবিশ্বাসী। কিন্তু তিনি কখনো স্বীয় নীতির বিপরীত করে ফেলেছেন। কেননা তিনি তো নিষ্পাপ নন।
এ জন্যই আমরা এমন একটি শব্দ সম্পর্কে কথা বলছি, যা আমাদের আকীদা, চিন্তাধারা এবং যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ইবাদত করি এরূপ দ্বীন সংশ্লিষ্ট জীবনের সকল বিষয়কে নির্দেশ করবে। তবে যারা চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী, তাদের বিষয়টি আলাদা।
অতঃপর আলবানী বলেন, আমি চাই যে তুমি ‘সালাফী’ নামক সংক্ষিপ্ত এই শব্দটি নিয়ে চিন্তা গবেষণা করো, যাতে তোমার মধ্যে ‘মুসলিম’ শব্দ নিয়ে আর জিদ না থাকে। কেননা তুমি জানো যে, মুসলিম শব্দ দ্বারা তুমি যা বোঝাতে চাচ্ছ, তা বোঝার মতো কখনই কাউকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং মানুষের সাথে তাদের জ্ঞান মোতাবেক কথা বলো। আল্লাহ তোমাকে বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য তোমার চিন্তায় বরকত দিন![10]
- উস্তায আবদুল্লাহ মাহমুদ
[1] সহীহ মুসলিম, ২৪৫০
[2] সূরা নিসা, আয়াত : ৫৯
[3] মুসনাদ আহমাদ, ২০৬৫৩; মুজামুত তবারানী, ১৪৭৯৫, হাদীসটি সহীহ
[4] সূরা নিসা, আয়াত : ১১৫
[5] সূরা তাওবা, আয়াত : ১১৯
[6] সিলসিলাতুস সহীহাহ, ২০৩, ১৪৯২
[7] সুনানু আবী দাউদ, ৪৬০৭; সুনানুত তিরমিযী, ২৬৭৬; সুনানু ইবন মাজাহ, ৪৪, হাদীসটি সহীহ
[8] আল-মানহাজুল সালাফী ইনদাশ শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী, পৃ. ১৭-২১
[9] সূরা হজ্জ, আয়াত : ৭৮
[10] লিমাযা ইখতারতুল মানহাজাস সালাফী? পৃ. ৩৬-৩৮