প্রশ্নঃ সালাফীরা যদি নির্বাচনে না-ই যায়, তাহলে তো ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা পার্লামেন্ট দখল করবেই। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
উত্তরঃ আল্লাহর কসম, আমি দেখেছি ওরা পার্লামেন্টে গিয়েই ধর্মনিরপেক্ষদের ক্রিড়নকে পরিণত হয়েছে। যারা এটা মনে করে পার্লামেন্টে যায় যে, একবার শুধু যেয়ে নিই; সব ধর্ম নিরপেক্ষকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব, তাদেরই এই অবস্থা!!
কিন্তু এরকম কিছু ঘটেছে কি? (উক্ত মতবাদের) পার্লামেন্ট সদস্যরা ধর্মনিরপেক্ষদের বের করে করে দিতে পেরেছে কি?
বরং ঘটেছে ঠিক এর উল্টো। ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা আরো শক্তিশালী হয়েছে। কারণ, তারা ভোট করতে নামার সময়ই সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখে, -সেটা জনবল বা বাহুবল, যেটাই হোক-। তুমি তাকে হারাতে চাও, সে-ও তোমাকে পরাজিত করতে চায়। শেষমেষ তুমিই হেরে যাও!!
কেন? কারণ, তুমি শরয়ী পন্থা অবলম্বন করনি যেটাতে আল্লাহ সাহায্য করবেন। এটা জানা কথা।
ইখওয়ানুল মুসলিমূন কি সিরিয়া, ইরাক, মিশর সহ অন্যান্য দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল? তারা বিজয়ী হয়ে কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে? নাকি এদের নির্বাচনে যাওয়ার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট ইত্যাদি খৃষ্টীয় রীতির অনুসারীরা আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে?
এরা (ইসলামের নাম নেয়া দল) দূর্বল হচ্ছে, আর ওরা (অনৈসলামী) আরো শক্তিশালী হচ্ছে। বাস্তবে তারা (ইসলামিস্টরা) কি করেছে?
ভাই আমার! আমরা যেটা বলি, সেটা হলোঃ তোমরা নবীদের মতো হিকমাহ ও উত্তম পন্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান কর। মানুষকে এই চিন্তাধারার উপরেই গড়ে তোল।
নবীরা কাফের শাসকদের কাছে এসেছেন, সেইসব কাফেরদের মাঝে অনেকের আবার পার্লামেন্ট বা এই রকম কিছু থাকত। তাঁরা (কিন্তু কখনোই) শাসকদের সাথে পদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যাননি। জনগণের সংশোধনী ও হিদায়াতের জন্য তারা কখনোই এরকম কিছু বলেননি।
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন নবুওয়াত পান, তখন সেখানেও একজন কাফের সরকার ছিল। কিন্তু
তিনি কখনো বলেনা, আগে পার্লামেন্টে যেয়ে নিই, পরে হিদায়াতের দাওয়াত দেব।
আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মক্কার শাসন ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তিনি সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব আবেদন ও প্রস্তাবকে নাকচ করেছেন, প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি শুধুমাত্র আল্লাহর দিকে দাওয়াত এবং মানুষকে শিরক ও ভ্রষ্টতা থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ছিলেন।
তো তোমরা এইসব ধর্মনিরপেক্ষদের সাথে গিয়ে তাদের শিরকী ও কুফরী কাজে সহযোগী সাজছ না বিরোধী দলে থাকছ?
তুমি তো শুরুতেই কুফরী বিষয়ের উপরে কসম করছ! তুমি কসম করছ যে, তুমি এই কুফরী বিষয়গুলো সম্মান করবে, সে অনুযায়ী কাজ করবে, সত্যায়িত করবে!!! তুমি তো নিজেই এসবের মাধ্যমে শিরকের ভিতরে ঢুকছ -ওয়াল 'ইয়াযু বিল্লাহ-। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। এতো কিছুর পরেও তো তুমি ইসলামের জন্য কিছু করতে পারে না!!
আমি প্রশ্ন করছি: এই যে যারা মিসরে শাসন করেছে, তারা যদি কিছু করে থাকে, তাহলে আমাদের বল!! যাতে করে আমরা তাদেরকে নিজেদের জন্য আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।
তারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের উপরে বিজয়ী হয়েছে, তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা সেসব স্হান নিয়েছে; এগুলো করে থাকলে বলো, তাহলে আমরা এটা ভেবে দেখব, আমরা তাদের অনুসরণ করব। এবং তাদের ব্যাপারে বলব: তারা সেখানে সফল হয়েছে, আমরা সেখানে সফল হয়েছি।
কিন্তু আমরা তো শুধু ব্যর্থতাই দেখছি!! শুধু দ্বীন নষ্ট হতেই দেখছি!! শুধু যুবকদের কে আল্লাহর পথের দাওয়াত থেকে বিমুখ করাই দেখছি!! বরং, তাদের নিজেদের নির্বাচিত ভোটারের নামে মিথ্যা প্রচার করা শেখাচ্ছে!! এমনকি তাদের অনুসারী যুবকদের কে ঘুষ দেয়া-নেয়া শেখাচ্ছে!! এসবের মাধ্যমে তাদের চরিত্র নষ্ট করছে!! এ সমস্ত নির্বাচন, ভোট, বিরোধী দলে নেমে প্রার্থী হওয়ার মাধ্যমে যে কত চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!! এমনকি ঘুষ, মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদির মতো চরিত্র বিনাশী বিষয়ও শিক্ষা দেয়া হয়!!!
তারপরেও আরো ক্ষতিকর দিক হলো, এসবের মাধ্যমে দাওয়াত মরে যায়। আল্লাহর দিকে আহবান নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দায়ীরাই যখন মিথ্যাবাদী, ফিতনায় নিপতিত; তখন -আল্লাহর কসম- লোকজন তাদের কথা শুনবে না, তাদের উপর আস্থা রাখবে না। তবে তারা তোমাদের শুধু মানুষ হিসেবেই দেখবে।
আল্লাহ বলেনঃ "বলুন, আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না এবং আমি কৃত্রিমতাশ্রয়ীদের অন্তর্ভুক্তও নই।" তুমি কেন অভিনয়ের চেষ্টা করছ? তুমি তো একটা প্রতিদান চাচ্ছই। সেটা হলো: চেয়ার, ক্ষমতা। আর লোকজন এটা শুনে তোমার পাশে জড়ো হয়েছে, মাশাআল্লাহ!! এটাই তো দুনিয়াবি চাহিদা।
আল্লাহ তোমাদের প্রতি রহম করুন। আল্লাহর কোনো নবী কখনোই চেয়ারের দ্বন্দ্বে যাননি, আল্লাহর কসম। বরং তারা তো মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করেছেন, শিরক থেকে বিরত থাকার জন্য এবং সবধরনের পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিতেন।
ওয়াল্লাহি, তারা (গণতন্ত্র পন্থীরা) যে পথে চলছে, সেটাই যদি সঠিক পথ হতো; তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাঁর নবীদেরকে এ পথেরই নির্দেশ দিতেন, তাদেরকে রাজনীতি শেখাতেন এবং এমন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কলাকৌশল শিক্ষা দিতেন, যা একমাত্র আল্লাহই জানেন। ফলে নবীগণ খুব সহজেই ঐসব ধর্মনিরপেক্ষ ও মুশরিকদের থেকে চেয়ার নিয়ে নিতেন।(১)
কিন্তু সঠিক পথ তো হলোঃ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার দিকে সঠিকভাবে দাওয়াত দেয়া, আকীদা বিশুদ্ধ করা, মানুষকে কুরআন ও সুন্নাহর সাথে জুড়ে দেয়া। মানুষকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে যে, তুমি তাদের দুনিয়াবী কিছু চাও না। তুমি শুধু তাদের উপকার করতে চাও মাত্র।
এভাবে তুমি ঐ চেয়ারে বসা ধর্মনিরপেক্ষ লোকটির কাছে গিয়ে বলো যে, আমি কিছুই চাই না। আপনার চেয়ার আপনারই থাক। তার সাথে চেয়ার নিয়ে বিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব করার পরিবর্তে তুমি বরং তার বাড়িতে গিয়ে দলীলসহ তাকে উপদেশ দাও, বুঝাও। হতে পারে, আল্লাহ তোমার মাধ্যমে তাকে হিদায়াত দেবেন।
এটাই উৎকৃষ্টতর পন্থা তার সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে যাওয়ার চেয়ে, মিথ্যা ও ঘুষের মাঝে যাওয়ার চেয়ে। সেই ধর্মনিরপেক্ষ লোকটা তোমার থেকে এসব কখনোই গ্রহণ করবে না। কারণ, সে ভালো করেই জানে যে, তুমি তার গদি, চেয়ার, মাল, পদ ও পদবীর প্রতি লালায়িত।
কিন্তু যখন তাদের কাছে এমন একটা নিষ্কলুষ দাওয়াত আসবে: যা তাদের দুনিয়া চায় না, গদি চায় না, পদ পদবীর প্রতিও নেই কোনো আগ্রহ; বরং তাদের ভালো চায় এবং সত্যকে তাদের দিকে এগিয়ে দেয়। হয়তো আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে হিদায়াত দেবেন, ফলে তারা দুনিয়াতেও সফল হবে, আখিরাতেও মুক্তিপ্রাপ্ত হবে।
কিন্তু আমরা যদি গিয়ে ক্ষমতা নিয়ে কামড়াকামড়ি করি, তাহলে সে তো তোমাকে চাইবেই না। জনগণও যদি বুঝতে পারে যে, তুমি ক্ষমতার পিছনে দৌড়াচ্ছ, তারা তোমার কথা শুনবে না।
এই কুয়েতেই তথাকথিত সালাফীরা যখন নির্বাচন, পার্লামেন্ট ইত্যাদির দিকে আহবান করেছিল, তখন থেকেই কি এই দাওয়াত দূর্বল হয়ে পড়েনি?!!
কিন্তু তারা যদি তাদের প্রথম পরিকল্পনায় চলত, তাহলে হয়তো আজ তারাই ক্ষমতায় থাকত, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত না সত্যনিষ্ঠ শাসন (বলব)?!!
সুতরাং, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ দিয়ে বিচার করতে শেখো।
উত্তর প্রদানেঃ শায়খ রবী' বিন হাদী আল-মাদখালী হাফিযাহুল্লাহ।
উৎস: وقفات في المنهج শীর্ষক ক্যাসেট। শায়খ যেটা কুয়েতে ভাষণ দিয়েছিলেন ১৪২৩ হিজরীর সফর মাসে।