‼️ পোস্টটি সুন্দরভাবে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।‼️

প্রবন্ধ দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায়

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,544
Credits
2,602
আল্লাহ রব্বুল আলামীনের যাবতীয় প্রশংসা, যিনি আমাদেরকে সবচেয়ে বড় নে‘মত ইসলামকে দান করেছেন। যার উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ছেড়ে গেছেন। সেই ইসলামের মাধ্যমেই তিনি আমাদেরকে ঐক্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এই ইসলামের মাধ্যমেই মুসলিম জাতিকে একটি প্লাটফর্মে একত্রিত করা সম্ভব। কেননা ইসলামের রব এক, রাসূল এক, ক্বিবলা এক এবং আসমানী সিলেবাস আল-কুরআন এক। শুধু প্রয়োজন মুসলিম জাতির ঐক্য। সেটা হবে অহীর ভিত্তিতে অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক। আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে সেই তাওফীক্ব দান করেন। সালাত ও সালাম নাযিল হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর, যার মাধ্যমে আল্লাহ বিভক্ত আরবজাতিকে শত শত বছরের গোত্রীয় লড়াই থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

ফিতনার পরিচয়

মুসলিম জাতির মাঝে যেসব দ্বন্দ্ব, লড়াই, ঝগড়া-বিবাদ ও কলহ হয়ে থাকে, কুরআন এবং হাদীসের ভাষায় সেটাকে ‘ফিতনা’ বলা হয়।

ফিতনার অনেকগুলো ধরন রয়েছে। ফিতনার অর্থ ব্যাপক। কেউ ধর্মীয় ফিতনায় লিপ্ত, কেউ শিরকের ফিতনায় লিপ্ত, কেউ বিদ‘আতের ফিতনায় লিপ্ত, কেউ বিধর্মীয় ফিতনাই লিপ্ত, কেউ আবার পার্থিব ফিতনা, নারীর ফিতনা, সম্পদের ফিতনা, অর্থের ফিতনা, গদি ও নেতৃত্বের ফিতনা ইত্যাদিতে লিপ্ত। এ সমস্ত ফিতনার মধ্যে একটি ফিতনা হচ্ছে, মুসলিম মুসলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা, মুসলিম মুসলিমের সাথে মারপিট করা, মুসলিম মুসলিমকে গালমন্দ করা ও ষড়যন্ত্র করা। চাই সেগুলো ব্যক্তিপর্যায়ে হোক, পারিবারিক স্তরে হোক, সামাজিক স্তরে হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় স্তরে হোক। এগুলো সবই ফিতনা।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ফিতনাকারীদের জন্য মর্মান্তিক শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেন,

فَلۡیَحۡذَرِ الَّذِیۡنَ یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِہٖۤ اَنۡ تُصِیۡبَہُمۡ فِتۡنَۃٌ اَوۡ یُصِیۡبَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ​

‘অবশ্যই তারা যেন সতর্ক হয়, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শের বিরোধিতা করে, তাহলে বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (সূরা আন-নূর : ৬৩)।

উক্ত আয়াতে বর্ণিত یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِہٖۤ এর অর্থ হল- যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনীত বিধানের পুরোপুরি বিরোধী, আংশিক বিরোধী কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী। অনুরূপভাবে সালাতে ত্রুটি নেই কিন্তু তাওহীদের ক্ষেত্রে বিরোধী। শিরকী আক্বীদায় লিপ্ত। সুন্নাহর ক্ষেত্রে বিরোধী, বিদ‘আতে লিপ্ত। ফরয-ওয়াজিব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিরোধী। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন কিন্তু তিন ওয়াক্ত কিংবা চার ওয়াক্ত পড়েন, এটাই নবী করীম (ﷺ)-এর বিরোধী। এভাবে সকল ক্ষেত্রে বিরোধিতা করে। অনুরূপ যেভাবে ইসলামী পরিবার,, ইসলামী সমাজ এবং ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে বলা হয়েছে সেভাবে না করাও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরোধী। সুতরাং জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিয়ে আসা আদর্শের ব্যতিক্রম করলেই তাঁর বিরোধিতা করা হবে।

اَنۡ تُصِیۡبَہُمۡ فِتۡنَۃٌ অর্থাৎ ‘তাদের উপর আপতিত হবে ফিতনা’। এই ফিতনার একটি প্রসিদ্ধ প্রয়োগ হচ্ছে, পার্থিব আযাব তথা দুনিয়ার শাস্তি। কারণ মানুষের শাস্তি হচ্ছে দুই রকম। ইহজগতের শাস্তি আর পরজগতের শাস্তি। ইহজগতের শাস্তি হচ্ছে দুনিয়াবী যে কোন আযাব বা শাস্তি। যেমন, আল্লাহ মানুষকে দিয়ে মানুষকে শাসিত করেন এবং মানুষকে দিয়ে মানুষের পিটিয়ে শাস্তি দেন। অথবা আসমানী, যমীনী যে কোন শাস্তি দেন। এগুলো পার্থিব আযাব, যা ফিতনা।

ফিতনার আরেকটি ভয়ংকর প্রয়োগ হল- শিরক। এটি সবচেয়ে বড় ফিতনা। শিরক ও কুফুরীর চেয়ে বড় গুনাহ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। এর মধ্যে কাফের বা বিজাতীয়দের শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফিতনা। মুসলিম সমাজে ইসলামের নামে যে কবর ও মাযার পূজার শিরক চলছে, সেটাও বড় ফিতনা। অথচ এক শ্রেণীর মানুষ এই শিরকের বিরুদ্ধে কোনরকম ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিন্তু যেনা, মদ, জুয়া, সিনেমা হল কিভাবে বন্ধ করা যায় তারা সেটা নিয়ে চিন্তা করছে। কিন্তু বড় ফিতনা বন্ধ করার চেষ্টাও করছে না, চিন্তাও করছে না; বরং তারা বড় ফিতনা শিরকের সাথে জড়িত। যদিও তারা ইসলামের নামে রাজনীতি করে। অথচ তাদের শিরকের বিরুদ্ধে কোন আলোচনা নেই।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ قٰتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ​

‘যতক্ষণ পৃথিবীতে ফিতনা আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৩)।

অন্যত্র তিনি বলেন,

وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ​

‘হত্যার চেয়ে ফিতনা বড়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯১)। অতএব হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে ফিতনা। আর সেটা হল- শিরকের ফিতনা।

اَوۡ یُصِیۡبَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ​

‘অথবা তাদের উপর পতিত হবে মর্মান্তিক শাস্তি’। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সহ ওলামায়ে কেরাম বেশ কিছু উক্তি করেছেন। যেমন,

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে বুযুর্গদের কথা পেশ করে, বুযুর্গদের দোহাই দেয়। এমনকি তাদের সম্পর্কে তারা বলে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে সবচেয়ে বড় মানুষ’।[১]
উল্লেখ্য, বুুযুর্গ মানে বড় মানুষ। শব্দটা ফারসি। মূলত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে সবচেয়ে বড় ব্যক্তি ছিলেন আবু বকর, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত আছারটি খেয়াল করুন!

কতিপয় মানুষ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সাথে মুত‘আ বিবাহ নিয়ে তর্কবিতর্ক করে এবং বলে যে, আবু বকর ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এমনটি বলেছেন। তখন ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলছেন যে,

يُوْشِكُ أَنْ تَنْزِلَ عَلَيْكُمْ حِجَارَةٌ مِّنَ السَّمَاءِ أَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَتَقُوْلُوْنَ قَالَ أَبُوْ بَكْر وَعُمْرِ​

‘অচিরেই আশঙ্কা হচ্ছে, তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হবে। আমি তোমাদেরকে বলছি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন। আর তোমরা বলছ যে, আবু বকর ও ওমর বলেছেন’।[২]

সুধী পাঠক! এই উম্মতের এতবড় বুযুর্গ, যারা খুলাফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যাদের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন।[৩] আর নবী করীম (ﷺ) অহীর মাধ্যমে ভাল করে জানতেন যে, আমার খলীফা আবু বকর, ওমর, ওছমান, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) নতুন এমন কিছু করবেন না, যার ভিত্তি ইসলামে নেই। ফলে তিনি এই নিশ্চয়তা দেন যে, আমার সুন্নাতই আঁকড়ে ধরবে এবং আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে আঁকড়ে ধরবে। তাদের আদর্শই হচ্ছে আমার আদর্শ। অতএব যদি কোন জাতি, কোন দল কুরআন-হাদীসের সামনে বুযুর্গানে দ্বীনের দোহাই দেয় এবং এ মর্মে বলে যে, বড়রা এটাকে পসন্দ করেছেন, মুরুব্বিরা আমাদেরকে এটা বলেছেন; তাহলে প্রকারন্তরে খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদশকে অস্বীকার করা হচ্ছে।

প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আতের মূল থিওরি হল- তাদের বুযুর্গানে দ্বীন যেটা পসন্দ করেছেন সেটাই দ্বীন। আশ্চর্য! তারা কুরআন এবং হাদীসের পরোয়া করে না। যে কিতাব নিয়ে ৭০/৮০ বছর ভারত উপমহাদেশে তারা তাবলীগ করছে, সেই কিতাবে শিরক-বিদ‘আত, জাল-যঈফ হাদীস, উদ্ভট কিচ্ছা কাহিনীতে ভরপুর এবং ইসলামী আক্বীদা বিরোধী আলোচনায় ঠাসা। এমনকি বলা হচ্ছে, এত বড় বড় বুযুর্গানে দ্বীন ও ওলামায়ে হাক্কানীর চেয়ে বেশি বুঝেন? এভাবেই তারা জাতিকে গোমরাহ করে রেখেছেন। প্রশ্ন হল- এগুলো কি ফিতনা নয়? তাহলে কি তাদের জন্য আযাবের আশঙ্কা নেই? অবশ্যই শাস্তির আশঙ্কা আছে। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) (১৬৪-২৪১ হি./৭৮০-৮৫৫ খ্রি.) বলেছেন,

عجبت لقوم عرفوا الإسناد وصحته ويذهبون إلى رأى سفيان والله تعالى يقول (فَلۡیَحۡذَرِ الَّذِیۡنَ یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِہٖۤ اَنۡ تُصِیۡبَہُمۡ فِتۡنَۃٌ اَوۡ یُصِیۡبَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ)(النور:৬৩) أتدري ما الفتنة؟ الفتنة الشرك، لعله إذا رد بعض قوله أن يقع في قلبه شيء من الزيغ فيهلك​

‘আমি ঐ গোত্রের ব্যাপারে আশ্চর্য হই যে, যখন তারা হাদীসের সনদের বিশুদ্ধতা জানার পরেও সুফইয়ানের মতের দিকে ধাপিত হয়। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশের বিরোধিতা করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, তাদেরকে ফিতনা তথা বিপর্যয় স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (সূরা আন-নূর : ৬৩)। তুমি কি জান, ফিতনা কী? ফিতনা হল- শিরক। কখনো হয়তো কেউ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন একটি কথাকে প্রত্যাখ্যান করল। হতে পারে তখন তার অন্তরে বক্রতা চলে আসবে। অতঃপর সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’।[৪]

নবী করীম (ﷺ)-এর নাফরমানী করা, বিদ‘আতী কাজ করা, শিরকে লিপ্ত হওয়া, নিজেদের রচিত বইগুলোতে শিরক-বিদ‘আত ও ইসলামী আক্বীদাবিরোধী কিচ্ছা কাহিনী থাকার কারণে অন্তরে বক্রতা সৃষ্টি হবে। ফলে সে ধ্বংস হবে। মানুষ যখন নবী করীম (ﷺ)-এর পথ ছেড়ে দেয়, তখন শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া আজকে বিদ‘আতী কালকে শিরকপন্থী হয়ে যায়। এভাবেই বিদ‘আতীদের দিল মুশরিকে পরিণত হয়। আর যে বিদ‘আতমুক্ত সে কোনদিন শিরকের ধারে কাছে যাবে না। সুতরাং যে আজকে বিদ‘আতী সে কালকে মুশরিক। উল্লেখ্য, ধ্বংস হওয়া মানে শুধু মরে যাওয়া নয়, বরং ঈমান ধ্বংস হওয়া। আর যার ঈমান ধ্বংস তার সব ধ্বংস। এছাড়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে আপোসে কলহ বিবাদ, যে কোন রকমের অধঃপতন এবং যে কোন রকমের বালা-মুছীবতকেও বুঝানো হয়।

ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) (৭০১-৭৭৪ হি.) এই আয়াত সম্পর্কে বলেছেন,

فَلْيَحْذَرِ وليخْشَ من خالف شريعة الرسول باطنًا أو ظاهرًا { أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ} أي في قلوبهم من كفر أو نفاق أو بدعة {أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ} أي في الدنيا بقتل أو حَد أو حبس أو نحو ذلك​

‘ فَلْيَحْذَر‘সাবধান’ অর্থাৎ যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শরী‘আতের প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে বিরোধিতা করে, তাদের ভয় করা উচিত। أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ ‘তাদেরকে ফিতনা স্পষ্ট করবে’ অর্থাৎ তাদের অন্তরে কুফরী অথবা কপটতা অথবা বিদ‘আত স্পর্শ করবে। أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি গ্রাস করবে’ অর্থাৎ দুনিয়াতে হত্যা, দণ্ডবিধি, গ্রেফতার অথবা অন্য কিছুর মাধ্যমে’।[৫]

সুধী পাঠক! এই ফিতনা কখনো কখনো পারিবারিকও হয়। যেমন স্বামী-স্ত্রীতে মিল হয় না, ভাইয়ে ভাইয়ে মিল হয় না, পাড়া-প্রতিবেশির সাথে শত্রুতা-বিদ্বেষ, লড়াই-কলহ ইত্যাদি সবই ফিতনা। শাসক আর জনগণের মাঝে কলহ-বিবাদ, শত্রুতা-বিদ্বেষ সবই ফিতনা। এগুলো দুনিয়াবী আযাব। নিম্নে কয়েকটি দলীল উপস্থাপন করা হল-

প্রথম বিষয়

মুসলিমদের দলে দলে বিভক্ত হওয়া, একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করা। যেমনটা তাবলীগ জামা‘আত ও অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে বর্তমানে চলছে। এগুলো আযাব। নিম্নের হাদীসটি খেয়াল করুন-

عَنِ الزُّبَيْرِ بْنِ عَدِىٍّ رَحِمَهُ الله قَالَ أَتَيْنَا أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ فَشَكَوْنَا إِلَيْهِ مَا نَلْقَى مِنَ الْحَجَّاجِ فَقَالَ اصْبِرُوْا فَإِنَّهُ لَا يَأْتِىْ عَلَيْكُمْ زَمَانٌ إِلَّا الَّذِىْ بَعْدَهُ شَرٌّ مِنْهُ حَتَّى تَلْقَوْا رَبَّكُمْ سَمِعْتُهُ مِنْ نَبِيِّكُمْ ﷺ​

যুবায়র ইবনু ‘আদী (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আনাস বিন মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে আসলাম এবং হাজ্জাজের পক্ষ থেকে মানুষ যে নির্যাতন ভোগ করছে সে সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করলাম। তিনি বললেন, ধৈর্যধারণ কর। কেননা মহান প্রতিপালকের সাথে মিলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে তোমাদের উপর এমন কোন যুগ অতিবাহিত হবে না, যার পরবর্তী যুগ তার চেয়েও নিকৃষ্টতর নয়। তিনি বলেন, এ কথাটি আমি তোমাদের নবী করীম (ﷺ) থেকে শ্রবণ করেছি।[৬]

উল্লেখ্য, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন বায়তুল মাক্বদিছ এবং প্যালেস্টাইন বিজয় করলেন, তখন সেখানেও খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় ছিল। কিন্তু তিনি তা ভেঙ্গে দেননি। বর্তমানেও খ্রিষ্টান মিশনারী, তাদের কোন হাসপাতাল কিংবা তাদের ধর্ম প্রচারের যেসব কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোও মুসলিমরা ভাঙ্গেনি বা ভাঙ্গার ইচ্ছাটাও করেননি, তাহলে সহীহ আক্বীদার মসজিদ ভাঙ্গাটা আপনি জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম মনে করেছেন কেন? এই অপরাধের শাস্তি যেকোন সময় আসতে পারে। প্রখ্যাত তাবেঈ হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সম্পর্কে বলেছেন যে,

يا أهل العراق! إن الحجاج عذاب الله سلطه عليكم بذنوبكم فلا تدفع عذاب الله بايديكم ولكن توبوا إليه يرفع عذابه عنكم. فإن الله تعالى يقول {وَلَقَدْ أَخَذْنَاهُمْ بِالْعَذَابِ فَمَا اسْتَكَانُوْا لِرَبِّهِمْ وَمَا يَتَضَرَّعُوْنَ}​

‘হে ইরাকবাসী! হাজ্জাজ বিন ইউসুফ হচ্ছে আল্লাহর আযাব। তোমাদের পাপের কারণে আল্লাহ তোমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর আযাবকে হাত দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা কর না। বরং তওবা কর, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নিকট থেকে আযাব বা শাস্তি উঠিয়ে নিবেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদেরকে আমি আযাব দিয়ে পাকড়াও করে থাকি। অতঃপর তারা তাদের প্রতিপালকের সামনে নত হল না এবং কাকুতি-মিনতিও করছে না’ (সূরা আল-মুমিনুন :৭৬)’।[৭]

সুধী পাঠক! আল্লাহর আযাব আসলে কেউ যদি হাত দিয়ে ধাক্কা দেন, তাহলে প্রতিহত করতে পারবে? বন্যা, সুনামী হলে কিংবা আসমান থেকে পাথর বর্ষণ হলে রক্ষা করা কি সম্ভব? এটাও ঐ রকমই। যালেম অথবা এই বিভিন্ন আকারের আযাবগুলো আসছে, আপোসে লড়াইয়ের মাধ্যমে যে আযাবগুলো আসছে সেগুলোকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলে হবে না। প্রশ্ন হল- তাহলে কী দিয়ে প্রতিহত করতে হবে? সেটা হল- তওবাহ। সুতরাং এ আয়াতে আল্লাহ নত হওয়া ও কাকুতি-মিনতির সাথে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। এভাবে বলুন, হে আল্লাহ! আপনি সর্বশক্তিমান, আপনি মাফ করে দিন। এছাড়া শিরক ছেড়ে তাওহীদের দিকে আসার তওবাহ করতে হবে, বিদ‘আত ছেড়ে সুন্নাতের দিকে আসতে হবে, বিদ‘আতী সালাত ছেড়ে সহীহ সালাতের দিকে আসতে হবে, ইলিয়াসী তাবলীগ ছেড়ে কুরআন সুন্নাহর তাবলীগের দিকে আসতে হবে এবং যাবতীয় ফের্কাবন্দী ছেড়ে আহলেসুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের দিকে আসতে হবে।

কিন্তু পাপ করলে যে লজ্জিত হতে হবে, অনুতপ্ত হতে হবে, তওবা করতে হবে সেই অনুভূতিও নেই। মসজিদ ভেঙ্গে, কারো মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়ে চরম বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু একটুও লজ্জা লাগেনি? কেউ প্রতিবাদ করল না। অথচ যদি একটা মন্দির ভাঙ্গা হত, গির্জা ভাঙ্গা হত, যদিও এগুলো ভাঙ্গা হারাম; তাহলে কত যে প্রতিবাদের ঝড় উঠত। কিন্তু বাংলাদেশের ভোলায় আর ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে সহীহ আক্বীদার মসজিদ ভেঙ্গে দেয়া হল আবার জ্বালিয়েও দেয়া হল। কেউ একটু টুঁ শব্দও করল না। এদেরকে ‘শয়তানুল আখরাছ’ তথা বোবা শয়তান বলা হয়েছে। যারা প্রতিবাদ করোনি, বরং নীরব সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য তো কিছু আযাবের স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে।

দ্বিতীয় বিষয় : সমাজে ও পরিবারে যখন অসৎ লোকদের জন্য ফিতনা বা আযাব আসে, তখন ফিতনা সবাইকে ঘিরে ফেলে।[৮]

কোন ব্যক্তি সহীহ আক্বীদার অনুসারী, খুব ধার্মিক আল্লাহভীরু, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পাবন্দ এবং হারাম থেকে একেবারে সজাগ। কিন্তু তার বাপ-ভাই সবাই অসৎ। এরকম অবস্থায় যখন আযাব আসে, তখন সবাইকে আযাব শামিল করে নেয়। কেউ বাঁচতে পারে না। তাই নিজে যেমন ভাল হতে হবে, অনুরূপ নিজের পরিবার-পরিজনকে, তারপরে আপন আত্মীয়-স্বজনকে, তারপরে দেশবাসীকে, নিজের ভাষাভাষী মানুষকে এবং সারা বিশ্বের সমস্ত মানবতার হিতাকাঙক্ষী হয়ে তাদেরকে ভাল করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা ফিতনা সকলকে শামিল করে নেই। এ মর্মে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন,

وَ اتَّقُوۡا فِتۡنَۃً لَّا تُصِیۡبَنَّ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡکُمۡ خَآصَّۃً​

‘তোমরা সেই ফিতনা তথা পার্থিব আযাব থেকে বাঁচার চেষ্টা কর। যে ফিতনা বিশেষভাবে শুধু যালেমদের উপর আসবে না’ (সূরা আল-আনফাল : ২৫)।

এই আয়াত দিয়ে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনি বলেছেন,

وَمَا كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يُحَذِّرُ مِنَ الْفِتَنِ​

‘এবং নবী করীম (ﷺ) ফিতনা থেকে সতর্ক, সাবধান করেছন’।[৯] এই মর্মে নিম্নোক্ত হাদীসটি খেয়াল করুন-

عَنْ زَيْنَبَ ابْنَةِ جَحْشٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتِ اسْتَيْقَظَ النَّبِىُّ ﷺ مِنَ النَّوْمِ مُحْمَرًّا وَجْهُهُ يَقُوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَاجُوْجَ وَمَاجُوْجَ مِثْلُ هَذِهِ وَعَقَدَ سُفْيَانُ تِسْعِيْنَ أَوْ مِائَةً قِيْلَ أَنَهْلِكُ وَفِيْنَا الصَّالِحُوْنَ قَالَ نَعَمْ إِذَا كَثُرَ الْخَبَثُ​

যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবী করীম (ﷺ) রক্তবর্ণ চেহারা নিয়ে ঘুম থেকে জাগলেন এবং বলতে লাগলেন, لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘নেই কোন সত্য মা‘বূদ আল্লাহ ব্যতীত’, নিকটবর্তী এক দুর্যোগে আরব ধ্বংস হয়ে যাবে। ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর আজ এতটুকু পরিমাণ খুলে গেছে। ছুফিয়ান নব্বই কিংবা একশ’ রেখায় আঙ্গুল রেখে গিঁট বানিয়ে দেখালেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হল- আমরা কি ধ্বংস হয়ে যাব। অথচ আমাদের মাঝে কোন নেককার লোকও থাকবে? নবী করীম (ﷺ) বললেন, হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে।[১০]

إِذَا كَثُرَ الْخَبَثُ ‘যখন পাপাচার বেড়ে যাবে’ অর্থাৎ শিরক-বিদ‘আত বেড়ে যাওয়া, বেনামাজি বেড়ে যাওয়া, মুসলিম জাতির পারস্পরিক কলহ-বিবাদ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এভাবে নিম্নের বাস্তবতাগুলো খেয়াল করুন, যেখানে নিজেদের চেয়ে ভিন্ন কিছু কেউ করলে তার আর বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না।

সালাতে রফউল ইয়াদাইন করলে ধাক্কা দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দিচ্ছে। জোরে আমীন বললে মসজিদে আসতে নিষেধ করছে। জুমু‘আর খুৎবায় একজন অপরজনের বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত দিচ্ছে। যদি কেউ সুন্নাতী তরীকায় সালাত আদায় করিয়ে দেয় কিন্তু যদি বিদ‘আতী মুনাজাত না করে, তাহলে তার অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছে। সুতরাং যখন এরকম খাবাসাত বেড়ে যাবে, এইরকম নোংরামি সংকীর্ণতা বেড়ে যাবে, তখন সমস্ত জাতিকে ধ্বংস করা হবে। কিন্তু তাতে কিছু ভাল মানুষ ও ন্যায়পরায়ণও আছে। তারা কল্যাণ চায় কিন্তু তাদের মাঝে যেহেতু আছে, তাদেরকে বর্জন করতে পারেনি। সুতরাং তাদের উপরও আযাব আসবে।

তৃতীয় বিষয় : মুসলিম জাতির আপোসের লড়াই গোটা মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করে দেয়।

কোন মুসলিম চাইবে না যে, মুসলিম জাতি দুর্বল হয়ে যাক। কেউ কি চাইবে নিজের ভাই কিংবা বোনের সাথে মতবিরোধ থাকুক? কেউ কি চাইবে তার পরিবারটা দুর্বল হয়ে যাক? কখনোই চাইবে না। অনুরূপ মুসলিম ভাইয়েরাও পরস্পর পরস্পরে পরিবারের সদস্য। যদিও সে ফাসেক হোক, বিদ‘আতী হোক, তার সাথে মতবিরোধ থাকুক, সঠিক পদ্ধতিতে সালাত আদায় না করুক, তবুও সে একই পরিবারের সদস্য। কিন্তু দুঃখজনক হল, ভ্রান্ত মুফতিদের ভ্রান্ত ফৎওয়াবাজীর কারণে তাদের অনুগামীদের ফৎওয়া দিচ্ছে যে, এগুলো মসজিদে যিরার তথা মুনাফিকদের মসজিদ। সুতরাং এই মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা জায়েয। এই সমস্ত মসজিদ ভেঙ্গে দিলে সওয়াব হবে, জান্নাতে যাবে। এভাবেই ফিতনা বা আযাব শুরু হচ্ছে।

অতএব মুসলিম জাতি যদি আপোসে লড়াই করে, তাহলে কমজোর হয় আর বিজাতীয়রা শক্তিশালী হয় এবং তাদের সাহস বেড়ে যায়। চাই সেটা যেকোন যুগে হোক না কেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ لَا تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا اِنَّ اللّٰہَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ​

‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ো না। তাহলে তোমরা হেরে যাবে আর তোমাদের শক্তি চলে যাবে। অতএব তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৬)।

সহীহ আক্বীদার আলেম, দাঈ এবং সাংগঠনিক ও অসাংগঠনিক ভাইদের প্রতি আহ্বান যে, পরস্পর ঝগড়া করবেন না। অন্যকে দেখে যদি শিখতে পারেন, তাহলেই আপনারা জ্ঞানী। যদি দলীয় গোঁড়ামি প্রদর্শন করে আপোসে সংকীর্ণ চিন্তা এবং হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কোন দুনিয়াবী স্বার্থে হক্বকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসীদের ন্যায় আপনাদেরও ভয়ংকর পরিণতি হবে। অন্যকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। অতএব আপোসে লড়াই করলে বাইরের শত্রুরা সুযোগ পাবে এবং নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়বেন। উদারতার আজ বড়ই দরকার।

চতুর্থ বিষয় : দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

যারা মুসলিম জাতির পরস্পরের মাঝে ফাটল ধরায়, ঝগড়া-বিবাদ ও মারামারি সৃষ্টি করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا​

‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে মযবুত করে আঁকড়ে ধর’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।

সুধী পাঠক! উক্ত আয়াতে جَمِیۡعًا শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে একসাথে বা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে আঁকড়ে ধরার কথা বলা হয়েছে। আলাদা আলাদাভাবে নয়। অথচ সকল দলই বল থাকে যে, আমরাই আল্লাহর রশি ধরে আছি। সকল দলের পক্ষের দলীল হল এই আয়াত। যদি সহীহ আক্বীদার হয় তাদের দাবী হল- তারাই আল্লাহর রশি ধরেছে। অথচ তারা দলে দলে বিভক্ত। একপক্ষ অপরপক্ষকে ঘায়েল করার তৎপরতায় ব্যস্ত। মূলত এটাই হল দলীয় কোন্দল।

আর بِحَبۡلِ اللّٰہِ তথা ‘আল্লাহর রশি’ হল- কুরআনুল কারীম এবং তার ব্যাখ্যা নবী করীম (ﷺ)-এর সুন্নাহ তথা অহী। আর আল্লাহর রশি বলতে কোন বড় দল নয়। যদিও তারা শিরক-বিদ‘আতের উপর প্রতিষ্ঠিত। বলা হয়ে থাকে, আমাদের দল বড়। সুতরাং আপনারা আবার কেন ছোট ছোট দল খুলতে গেলেন অন্যদিকে ছোট ছোট দলের লোকেরা বলছে, আসেন আমরা তিনজন হলেও আল্লাহর? রশিকে আঁকড়ে ধরি। অথচ এটা ঠিক হয়নি। বরং এভাবে তারা উভয়েই আল্লাহ রশি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নিম্নের হাদীসটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করুন!

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيْرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ ﷺ عَلَى الْمِنْبَرِ مَنْ لَمْ يَشْكُرِ الْقَلِيْلَ لَمْ يَشْكُرِ الْكَثِيْرَ وَمَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللهَ وَالتَّحَدُّثُ بِنِعْمَةِ اللهِ شُكْرٌ وَتَرْكُهَا كُفْرٌ وَالْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ​

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলেন, যে ব্যক্তি অল্পতে পরিতুষ্ট হয়ে শুকরিয়া আদায় করল না সে বেশী পেয়েও শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না। আর যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না সে আল্লাহর যথাযথ শুকরিয়া আদায় করল না। আল্লাহর নে‘মতকে চর্চা করাই হল শুকরিয়া আর না করা কুফরী। ঐক্য হচ্ছে রহমত। আর বিচ্ছিন্নতা, বিভেদ সৃষ্টি হওয়া এবং ফাটল ধরা হল আযাব।[১১]

وَالْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ তথা ঐক্য হল রহমত। মুসলিম জাতি তথা সহীহ আক্বীদার মানুষ যদি এক হতে পারে, তাহলে এটা আল্লাহর রহমত। অনুরূপভাবে সারাবিশ্বের মুসলিম, চাই যেকোন ভাষাভাষি হোক না কেন, যদি এক হতে পারে, তাহলে সেটা আল্লাহর রহমত। শাসক আর জনগণ এক হতে পারে। জনগণ শাসককে ভালবাসে আর শাসক জনগণের হিতাকাঙ্ক্ষী, তাহলে এটাও আল্লাহর রহমত। সুতরাং ঐক্য হল আল্লাহর রহমত। وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ তথা বিচ্ছিন্নতা, বিভেদ, দলাদলি এবং ফাটল হল আযাব।

সুধী পাঠক! একশ্রেণীর মানুষ এই সহীহ হাদীসের চর্চাকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন জাল ও যঈফ হাদীসকে চর্চা করে থাকে। যদিও আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেম হাদীস জাল ও যঈফ কেন হয় সেটাও বুঝেন না। কেউ বুঝলেও প্রকাশ করেন না। কারণ তারা যে নেতৃত্ব ও গদি নিয়ে বসে আসে তাতে আঘাত লাগবে। একারণে তারা إختلاف أمتي رحمة তথা ‘ইখতিলাফ আমার উম্মতের রহমত’ জাল হাদীস বলে প্রশান্তির ঢেঁকুর তোলে। নাঊযুবিল্লাহ। তাদের এই হাদীস বলার উদ্দেশ্য হল- চার মাযহাব তথা হানাফী, শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলী চারটিই ঠিক। তবে একটি মানা ফরয। একটি থেকে আরেকটিতে যেতেই পারবে না। যদিও সহীহ হাদীস হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ- হানাফী মাযহাবের একটি মাসআলা যদি যঈফ হাদীসের ভিত্তিতে হয়, তবুও সেটা মানতে হবে। এছাড়া সকল হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা বলে থাকে যে, চার মাযহাব হওয়া আল্লাহর রহমত। আশ্চর্য! মাযহাবী গোঁড়ামি না-কি রহমত, এক উম্মতকে চারভাগে ভাগ করা না-কি রহমত! তাহলে ছূফীদের ৯৮০০০ হাযার তরীকাও রহমত? ইসলামী সংগঠনগুলোর বিভক্তিও কি রহমত? অতএব এই জাল হাদীস থেকে তওবা করে সহীহ হাদীসের দিকে আসতে হবে। অনুরূপভাবে সহীহ আক্বীদার ভাইয়েরা যারা বিভিন্ন সংগঠনের সাতে জড়িত, তাদেরকে বলব আপনারা দলের অন্ধ অনুসরণ করবেন না; ব্যক্তিপূজা করবেন না। নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাতে গিয়ে শিরকী তাক্বলীদের কাছে বন্দী হবেন না। বরং দলীলের অনুসরণ করুন, আল্লাহর ইবাদত করুন, তাহলে রহমত হবে। এছাড়া বর্তমানে ‘সাংগঠনিক ভাই’ বলেও পরস্পরকে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অথচ ইসলামী শরী‘আতে এর কোন অস্তিত্বই নেই; বরং মুসলিমরা পরস্পর ঈমানী ভাই, দ্বীনি ভাই।

বর্তমানে ইসলামী সম্মেলন ও প্রোগ্রাম নিয়ে এই ভাঙ্গন, দলাদলি ও অন্তরের শত্রুতা এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, বলা হচ্ছে- অমুক বক্তাকে দাওয়াত দিয়েছেন, সে আমাদের সংগঠনের নয়। সুতরাং মাহফিলে আমি যাব না। অথচ নিয়ম হল- সহীহ আক্বীদার যে কোন আলেমের দাওয়াতী কাজের সুযোগ রয়েছে। অনুরূপভাবে তার দাওয়াতও অন্যরা শ্রবণ করবেন।

সুধী পাঠক! উক্ত আলোচনায় বুঝা গেল যে, ঐক্য হল রহমত আর ভাঙ্গন হল আযাব। আর এই আযাবের কারণে মুসলিম জাতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তাদের শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং হে দলের পূজারীরা! মুসলিম জাতিকে দুর্বল করবেন না।

আরেকটি বিষয় হল, এক মুসলিম অপর এক মুসলিমকে অথবা একদল মুসলিম অপরদল মুসলিমকে যদি নাও মারে, শুধু লাঠি দেখায় তবুও সেটা নিষেধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلَاحَ فَلَيْسَ مِنَّا.​

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) নবী করীম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, কেউ যদি আমাদের উপর অস্ত্র উঠায় সে আমার দলভুক্ত নয়।[১২] উক্ত হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, যদি কোন মুসলিমের উপর কেউ অস্ত্র উত্তোলন করে যদিও সে বিদ‘আতী হোক কিংবা সহীহ আক্বীদার হোক, তাহলে সে মুহাম্মাদের উম্মত থেকে খারিজ।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) বলেন,

سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ​

‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী। আর তার সাথে লড়াই করা কুফরী’।[১৩]
অতএব পরস্পর লড়াই করা কুফরী কাজ। যা ছোট কুফরী থেকে শুরু হয়ে বড় কুফরীতে পৌঁছে দিতে পারে। যদি কেউ মনে করে যে, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তার রক্ত হালাল, তাহলে সে বড় কাফের। কারণ হারামকে সে হালাল মনে করল। অথচ কোন মুসলিমের রক্ত হালাল নয়। এটাই হল ইসলাম। তবে যে আপনার সাথে যুদ্ধ করছে বা করবে তার কথা ভিন্ন। উল্লেখ্য, মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকী কাজ। তাহলে সহীহ আক্বীদার আলেমকে গালি দেয়া, সঊদী আরবকে আমেরিকা ও ইহুদীদের দালাল বলে, দাজ্জাল, ফিতনাবাজ, শয়তান ইত্যাদি বলে গালি দেয়া সবই ফাসেকীর কাজ। এমনকি বিদ‘আতী, মাযারপন্থী এবং অমুসলিমকেও গালি দেয়া ফাসেকী কাজ। কেননা কাউকে গালি দিতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,

وَ لَا تَسُبُّوا الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ فَیَسُبُّوا اللّٰہَ عَدۡوًۢا بِغَیۡرِ عِلۡمٍ​

‘যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, তাহলে শত্রুরা অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহকে গালি দিবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১০৮)।

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ﷺ) মুসলিমের রক্তকে এত মূল্যবান বলেছেন, যেমন সম্মান আরাফার দিনের, কুরবানীর দিনের। এমনকি মক্কাতুল মুকাররমার যেমন সম্মান তেমন।

হাদীসে এসেছে, ‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান তোমাদের জন্য পবিত্র। যেমন তোমাদের এই দিনগুলো, এই মাস এবং এই শহর পবিত্র’।[১৪] মানব জীবনে কিছু দ্বন্দ্ব, মনোমালিন্য, মাসআলাগত ইখতিলাফ এবং অর্থের ইখতিলাফ রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে যতগুলো দলীয় লড়াই বা দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেগুলোর পিছনে হয় পয়সার দ্বন্দ্ব আছে অথবা নেতৃত্বের ফিতনা আছে। এছাড়া তৃতীয় কোন ফিতনা নেই। পক্ষান্তরে যাদের অর্থ নেই কিংবা নেতৃত্ব নেই তাদের দিল ছাফ আছে। তাদের কোন লোভই নেই।


তথ্যসূত্র :
[১]. উক্তিটি তিরমিযী এবং অন্যান্য তাফসীরের কেতাবাদিতেও রয়েছে।
[২]. ইবনু তায়মিইয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ২য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ২০ তম খণ্ড, পৃ. ২১৫; আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৭; মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-ওছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল (দারুল ওয়াত্বান, সর্বশেষ সংস্করণ, ১৪১৩ হি.), ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৪৯।
[৩]. আবু দাঊদ, হা/৪৬০৭; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; মিশকাত, হা/১৬৫, সনদ সহীহ।
[৪]. শায়খ বিন বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৯; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৪৯।
[৫]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (দারুল দাওয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৪২১ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৯০।
[৬]. সহীহ বুখারী, হা/৭০৬৮; তিরমিযী, হা/২২০৬; মিশকাত, হা/৫৩৯২। উল্লেখ্য, হাজাজ্জ বিন ইউসুফ বছরার এক যালেম গভর্নর ছিল। এই খুনির যুল্ম-অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ট হয়ে আনাস বিন মালিক প-এর কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, তাকে আর বরদাশত হচ্ছে না। একটু সন্দেহ হলেই মানুষকে ধরছে, নিয়ে যাচ্ছে আর যব্হ করছে, নিয়ে যাচ্ছে আর বেঁধে বেঁধে যব্হ করছে। এভাবে বেঁধে বেঁধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে।
[৭]. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ, মিনহাজুস সুন্নাহতিন নাবাবিয়্যাহ (মুওয়াস্সাসাতু কর্ডোভা, ১ম সংস্করণ, তাবি), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩১৫।।
[৮]. ত্বাবাক্বাতে ইবনু সা‘দ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪।
[৯]. সহীহ বুখারী, ‘ফিতনা’ অধ্যায়-৯২, অনুচ্ছেদ-১।
[১০]. সহীহ বুখারী, হা/৭০৫৯ ‘ফিতনা’ অধ্যায়-৯২, ‘নবী করীম (ﷺ)-এর বাণী-আরবরা অতি নিকটবর্তী এক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে যাবে’ অনুচ্ছেদ-৪।
[১১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৪৭২; সনদ হাসান, সিলসিলা সহীহাহ, হা/৬৬৭।
[১২]. সহীহ বুখারী, হা/৬৮৭৪; সহীহ মুসলিম, হা/৯৮।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/৭০৭৬; সহীহ মুসলিম, হা/৬৪।
[১৪]. সহীহ বুখারী, হা/৪৪০৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৭৯।


-শায়খ মতীউর রহমান মাদানী​

* দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক সেন্টার, সঊদী আরব।​
 
Last edited:

Share this page