কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। এর সবচেয়ে বড় মু‘জিযা হল, এটি আল্লাহর কালাম। তাই এর প্রত্যেকটি অক্ষর, শব্দ, বাক্য ও আয়াত রহমত, বরকত, হেদায়াত, প্রশান্তি ও নেকীতে পরিপূর্ণ। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী কুরআনের সাথে অসংখ্য বিদ‘আতের প্রচলন করেছে এবং একে ব্যবসার পুঁথি বানিয়েছে। আর এই নোংরা বিদ‘আতই কষ্টের সৎ আমলগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। কারণ হল শিরক-বিদ‘আত আর যত মিথ্যা-জাল আমল সমাজে প্রচলিত আছে, সবই ইবলীস শয়তানের কুমন্ত্রণায় সৃষ্টি হয়েছে।[১] সৎ আমলের সাথে অপবিত্র ইবলীসী আমল মিশ্রিত হলে কস্মিনকালেও আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না (সূরা বাক্বারাহ ৪২; মায়েদাহ ৫)।
কারণ আল্লাহর কাছে কেবল পবিত্র আমলই কবুল হয়।[২]
(১) বাংলা উচ্চারণ করে কুরআন তেলাওয়াত করা :
কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে না এমন অবসরপ্রাপ্ত ও বৃদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যেই বাংলা কিংবা ইংরেজী ভাষায় উচ্চারণ করা কুরআন পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে ধর্মব্যবসায়ীরা তাদেরকে উৎসাহিত করে থাকে। অথচ তারা নেকী তো পাবেই না, বরং হারাম কাজ করার কারণে পাপী হবে। কারণ কুরআন মাজীদ সরাসরি আল্লাহর কালাম। অন্য কোন ভাষায় উচ্চারণ করে তেলাওয়াত করা হারাম। এতে সঠিক উচ্চারণ প্রকাশ পায় না। ফলে অর্থ বিকৃত হয়ে যায়। কুরআনুল কারীমকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। তাই আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় তিলাওয়াত করা যাবে না। তবে অন্য ভাষায় অনুবাদ করাতে কোন সমস্যা নেই।[৩]
ইমাম যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কুরআনুল কারীমকে তিলাওয়াত করা হারাম’।[৪]
ইমাম ইবনু হাজার আল-হাইছামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কুরআনুল কারীমকে আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষার অক্ষরে লেখা হারাম’।[৫]
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র কুরআনকে আরবী ভাষাতেই অবতীর্ণ করেছেন। এটি আরবী কুরআন। সুতরাং এটিকে আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় পাঠ করা জায়েয নয়। সালাতের মধ্যে এবং বাইরে উভয় অবস্থাতেই কুরআনুল কারীম আরবীতেই তিলাওয়াত করতে হবে। তবে যেকোন ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করা যাবে। যাতে কুরআনের মূলভাব ও বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হতে পারে।[৬]
শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আরবী ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় কুরআনকে প্রকাশ করা অবৈধ।[৭]
উল্লেখ্য যে, শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), শাযখ আব্দুর রাযযাক আফিফী (রাহিমাহুল্লাহ) এবং আরো অনেক বড় বড় আলিমের উপস্থিতিতে এ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে পরবর্তীতে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যার নামকরণ করা হয়েছে,
‘কুরআনুল কারীমকে আরবী ভাষার অক্ষর ব্যতীত অন্য ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হারাম’ নামে। সেখানে বলা হয়েছে, উক্ত বিষয়ে অধ্যয়ন, আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর ঊলামা পরিষদের ঐকমত্যানুসারে এই সিদ্ধান্ত সংগৃহীত হল যে, ‘ল্যাটিন অক্ষরে বা অন্য কোন ভাষার অক্ষরে কুরআনুল কারীমকে লিপিবদ্ধ করা হারাম’।[৮]
যারা উচ্চারণ করা কুরআন প্রিন্ট করে বাজারে ব্যবসা করছে তারা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ করছে।[৯]
আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত দান করুন! প্রত্যেক মুসলিমের উচিত এ সমস্ত প্রকাশনীকে প্রত্যাখ্যান করা।
তাই প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব হল, কুরআন শিক্ষা করা, বেশী বেশী তেলাওয়াত করা এবং এর অর্থ ও ভাব বুঝার চেষ্টা করা। অন্যথা কবরে ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হবে না।[১০]
(২) কুরআন দিয়ে তাবীযের ব্যবসা :
দেশের অধিকাংশ প্রকাশনী কুরআনের শুরুতে বা শেষে তাবীযের নকশা সংযুক্ত করে কুরআন ছাপিয়েছে। আর বিদ‘আতী খত্বীব ও মোল্লারা এই তাবীয দিয়ে ব্যবসা করছে এবং মানুষকে ধোঁকা দেয়। মসজিদের ইমাম ও খত্বীবরা হারাম উপার্জন করে থাকে। এমনিতেই তাবীয বাঁধা শিরক। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনকে ব্যবসার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে এবং এই অপবিত্র আবর্জনাকে কুরআনের সাথে সংযুক্ত করেছে আরো জঘন্য অপরাধ। এজন্য ঈমান-আমল সবই নষ্ট বাতিল হয়ে যাবে। শরীরে তাবীয থাকা অবস্থায় সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাতসহ কোন ইবাদতই কবুল হবে না। এই অবস্থায় মারা গেলে শিরককারী হিসাবে আল্লাহর ক্ষমাও পাবে না। অথচ এই তাবীযকে কুরআনের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিম্নের হাদীসগুলো বুঝার অনুরোধ করছি-
উক্ববা বিন আমের আল-জুহানী বলেন, একদা রাসূল (ﷺ)-এর কাছে একটি কাফেলা আগমন করল। অতঃপর তিনি নয়জনকে বায়‘আত করালেন আর একজনকে বাদ দিলেন। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! নয়জনকে বায়‘আত করালেন আর একে ছেড়ে দিলেন কেন? রাসূল (ﷺ) বললেন, তার শরীরে তাবীয বাঁধা আছে। অতঃপর লোকটি শরীরের ভিতরে হাত দিয়ে তাবীয ছিঁড়ে ফেলল। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে বায়‘আত করালেন এবং বললেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয বাঁধল সে শিরক করল’।[১১]
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে শরীরে তাবীয বেঁধে রাখা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। ইসলাম গ্রহণ করারও সুযোগ থাকে না। অন্য হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন,
‘নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক করা, তাবীয বাঁধা, যাদুটোনা শিরক’।[১২]
রাসূল (ﷺ) আরো বলেন,
‘কোন উটের গলায় যদি মালা বা বালা জাতীয় কিছু থাকে, তাহলে তা কেটে ফেলতে হবে’।[১৩] তিনি আরো বলেন,
‘যে ব্যক্তি তার দাড়িতে গিঁঠ দিল বা পেচিয়ে রাখল অথবা সূতার মালা পরিধান করল অথবা পশুর মল বা হাড্ডি দিয়ে ইস্তিনজা করল, মুহাম্মাদ (ﷺ) তার জিম্মাদারী থেকে মুক্ত’।[১৪] অন্য হাদীসে এসেছে,
ঈসা বিন হামযা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি একদা আব্দুল্লাহ বিন উকাইম-এর কাছে গেলাম। তখন তার শরীরের লাল রঙের তাবীয বাঁধা ছিল। আমি বললাম, তুমি তাবীয বেঁধে রেখেছ? আমরা আল্লাহর কাছে এটা থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শরীরে কোনকিছু বাঁধবে, তাকে সে দিকেই সোপর্দ করা হবে’। অর্থাৎ আল্লাহর নিরাপত্তা থেকে সে বেরিয়ে যাবে।[১৫]
উল্লেখ্য যে, কুরআনের আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত দু‘আ দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা শরী‘আত সম্মত। এছাড়া শিরক মিশ্রিত কোন মন্ত্র দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হারাম।[১৬]
রাসূল (ﷺ) সূরা ফাতেহা, সূরা ফালাক্ব, নাস প্রভৃতি সূরা ও আয়াত দ্বারা ফুঁক দিয়েছেন, শরীর মাসাহ করেছেন এবং ক্ষতস্থান হলে তাতে থুথু দিয়েছেন।[১৭]
(৩) ‘কুরআন শরীফ’ বলে প্রচার করা :
৫৫ থেকে ৯০টি নাম রয়েছে কুরআনের। কিন্তু ‘কুরআন শরীফ’ নেই। বিদ‘আতীরা আল্লাহ প্রদত্ত নামগুলো বর্জন করে নিজেরা নামকরণ করেছে ‘কুরআন শরীফ’। আল-কুরআনুল কারীম, কুরআন মাজীদ, আল-কুরআনুল হাকীম, আল-কুরআনুল আযীম, ফুরক্বান, তানযীল, যিকর, কিতাব ইত্যাদি সুন্দর নামগুলো তাদের পসন্দ হয়নি। তাই আমাদের দায়িত্ব হবে আল্লাহ প্রদত্ত নামেই কুরআনকে সম্বোধন করা।
(৪) কুরআনের মধ্যে রুকূ‘ সংযোজন :
কুরআন মাজীদের মধ্যে ৫৪০টি রুকূ‘র চিহ্ন নির্দেশ করা হয়েছে। এটা অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য যুক্ত করা হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে ২০ রাক‘আত তারাবীহকে বৈধ করার এটি একটি সূক্ষ্ম নীল নকশা। প্রতি রাক‘আতে ১ রুকূ পড়া এবং ২৭ রাত্রিতে কুরআন খতম করার বিদ‘আতী প্রথাকে জায়েয করার জন্য (২০´২৭) ৫৪০টি রুকূ সংযোগ করা হয়েছে।[১৮]
অথচ রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে যেমন নির্দিষ্ট ২০ রাক‘আত তারাবীহর প্রমাণিত নয়, তেমনি রামাযানের ২৭ তারিখের রাত্রিতে কুরআন খতমেরও কোন দলীল নেই।[১৯]
সঊদী আরবের মুছহাফে উক্ত রুকূ নেই। এটা চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর শুরুর দিকে বুখারা অঞ্চলের হানাফী আলেমগণ কুরআনের মধ্যে যুক্ত করেছে।[২০] তাই কুরআন তেলাওয়াত করার সময় রুকূ চিহ্নের অনুসরণ করা যাবে না। মনে রাখা আবশ্যক যে, কুরআনের উপর অত্যাচার করে রামাযানে কুরআন খতম দেয়া যাবে না। কুরআন মাজীদকে তারতীলসহ তেলাওয়াত করতে বলা হয়েছে। আর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী তারাবীহ্র সালাত বিতরসহ ১১ রাক‘আতই আদায় করতে হবে। আবু সালামা ইবনু আবদুর রহমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রামাযানের রাতের[২১]
সালাত কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রামাযান মাসে এবং রামাযানের বাইরে ১১ রাক‘আতের বেশী সালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে (২+২) চার রাক‘আত পড়তেন। তুমি (আবু সালামা) তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি তিন রাক‘আত (বিতর) পড়তেন।[২২]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি
‘তারাবীহর সালাত’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।[২৩] তিনি ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়ের ‘রামাযান ও অন্য মাসে রাসূল (ﷺ)-এর রাত্রির সালাত’ অনুচ্ছেদেও হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।[২৪] এছাড়াও অন্য আরেকটি অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।[২৫]
উল্লেখ্য যে, ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত শিরোনাম উল্লেখ করলেও ভারত উপমহাদেশের ছাপা সহীহ বুখারী থেকে সেই শিরোনাম উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ২০ রাক‘আতের যে বর্ণনা এসেছে, জাল।
(৫) তেলাওয়াতে সিজদায় কাটছাঁট :
পবিত্র কুরআনে ১৫টি আয়াতে সিজদা আছে।[২৬] কিন্তু বাংলাদেশী ছাপা কুরআনে ১৪টি উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিমরা তেলাওয়াত করার সময় এর প্রতিই আমল করে থাকে। সূরা হজ্জের দ্বিতীয় সিজদাকে সিজদা হিসাবেই গণ্য করা হয়নি। এখানে ‘ইমাম শাফেঈর মত’ বলে লিখে দেয়া হয়েছে। রাসূল (ﷺ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই কুরআন নাযিল সম্পন্ন হয়েছে। আর ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) -এর জন্ম হয়েছে ১৫০ হিজরীতে। ইমাম শাফেঈর নাম এখানে উল্লেখ করার কোন যুক্তিকতা আছে কি? এটাই মাযহাবের কুপ্রভাব। এটা জঘন্য অপরাধ। কুরআন মাজীদের সাথে এটা চরম বিয়াদবী। কুরআনের সাজদাগুলো হল,
(১) সূরা আ‘রাফ আয়াত-২০৪. (২) সূরা রা‘দ আয়াত-১৫. (৩) সূরা নাহল আয়াত-৫০. (৪) সূরা বানী ইসরাঈল আয়াত-১০৯, (৫) সূরা মারইয়াম আয়াত-৫৮, (৬) সূরা হজ্জ আয়াত-১৮. (৭) সূরা হজ্জ আয়াত-৭৭. (৮) সূরা ফুরক্বান আয়াত-৬০. (৯) সূরা নামল আয়াত-২৬. (১০) সূরা সাজদাহ আয়াত-১৫. (১১) সূরা ছোয়াদ আয়াত-২৪. (১২) সূরা হামীম সাজদাহ আয়াত-৩৮. (১৩) সূরা নাজম আয়াত-৬২. (১৪) সূরা ইনশিক্বাক্ব আয়াত-২১. (১৫) সূরা আলাক্ব আয়াত-১৯।
(৬) কুরআন তেলাওয়াত শেষে বিদ‘আতী দু‘আ পাঠ করা ও বখশানোর আয়োজন করা :
(ক) কুরআন তেলাওয়াতের পর নিম্নের দু‘আ পড়ার প্রচলন খুবই প্রসিদ্ধ। এই দু‘আ রাসূল (ﷺ) পড়েছেন মর্মে প্রচার করা হলেও এর কোন সনদ নেই।[২৭] তাই তেলাওয়াত শেষে নি¤েœর দু‘আ পড়া যাবে না।
(খ) অনুরূপ ‘ছাদাক্বাল্লাহুল আযীম’ (صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمُ) বলার যে প্রথা সমাজে প্রচলিত আছে, তার শারঈ কোন ভিত্তি নেই। সেই সাথে ‘দু‘আউ খতমিল কুরআন’ নামে যে সমস্ত নির্দিষ্ট দু‘আ কুরআনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোরও কোন ভিত্তি নেই। মানুষের রচনা করা।[২৮] এ সমস্ত বিদ‘আতী দু‘আ পাঠ করা যাবে না।[২৯] মুহাদ্দিছ উলামায়ে কেরাম এই প্রথাকে বিদ‘আত বলেছেন।[৩০]
কুরআন খতমের নিয়ম হিসাবে সূরা ফাহিতা ও বাক্বারার শুরু থেকে ‘মুফলিহূন’ পর্যন্ত পড়ার যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তারও সহীহ কোন দলীল নেই।[৩১] তাই আমাদেরকে তেলাওয়াত শেষে হাদীসে বর্ণিত সুন্নাতী দু‘আ পাঠ করতে হবে। যেমন রাসূল (ﷺ) পড়তেন-
উচ্চারণ : সুব্হা-নাকা ওয়া বিহাম্দিকা লা ইলা-হা ইল্লা আংতা আস্তাগ্ফিরুকা ওয়া আতূবু ইলায়কা।
অর্থ : ‘পবিত্রতা সহ আপনার প্রশংসা বর্ণনা করছি। আপনি ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তওবা করছি’।[৩২]
উল্লেখ্য, কুরআন খতমের পর আনুষ্ঠানিক কোন দু‘আর আয়োজন করা যাবে না। কোন কোন সাহাবী থেকে দু‘আ করার কথা পাওয়া যায়। তবে নির্দিষ্ট কোন দু‘আ নয়।[৩৩]
তাই কুরআন মাজীদ খতমের পর সৎ আমল হিসাবে অসীলা করে আল্লাহর কাছে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং মুসলিম উম্মাহ্র দু‘আ করতে পারে, রহমত ও ক্ষমা চাইতে পারে।[৩৪] কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা, আয়োজন ও বখশানোর কোন সুযোগ নেই।
(৭) তেলাওয়াতের জবাবে অতিরিক্ত সংযোজন :
(ক) সূরা জুম‘আ শেষে ‘আল্ল-হুম্মারযুক্বনা রিযক্বান হাসানাহ’ বলার কোন ভিত্তি নেই। (খ) সূরা বাণী ইসরাঈল শেষ করে ‘আল্লাহু আকবার কাবীরা’ বলা (গ) সূরা ওয়াক্বিয়াহ ও হাক্কাহ শেষে ‘সুবহা-না রব্বিয়াল আযীম’ বলা। (ঘ) মুলক শেষে ‘আল্লাহু ইয়া’তীনা ওয়া হুয়া রাব্বুল আলামীন’ বলার কোন দলীল নেই। এগুলো মোল্লাদের তৈরি বিদ‘আতী প্রথা।
উল্লেখ্য যে, (ক) সূরা ত্বীনের শেষে ‘বালা ওয়া আনা ‘আলা যা-লিকা মিনাশ শা-হেদীন’ বলা (খ) সূরা মুরসালাত-এর শেষে ‘আ-মান্না বিল্লাহ’ বলা এবং (গ) সূরা ক্বিয়ামাহ শেষে ‘বালা’ বলার যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। এর সনদে একজন রাবী আছে, যার কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি।[৩৫] তবে এর শেষে বলবে سُبْحَانَكَ فَبَلَى (সুবহা-নাকা ফা বালা)।[৩৬] (ঘ) সূরা বাক্বারাহ শেষে ‘আমীন’ বলার বর্ণনা যঈফ।[৩৭] (ঙ) সূরা যোহা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত সকল সূরা শেষে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার যে বর্ণনা এসেছে, তা মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য।[৩৮] অতএব সূরার জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
(৮) মৃত্যুর পর মাইয়েতের জন্য কুরআন তেলাওয়াত করা :
মানুষ বেঁচে থাকা অবস্থায় বিদ‘আতী ইমাম ও খত্বীবরা দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মানুষের দ্বারে যায় না। কিন্তু মরার পর তারা দলবদ্ধভাবে কুরআন পড়তে যায়। এতে মাইয়েতের যেমন কোন লাভ হয় না, তেমনি যারা পড়তে যায় তাদেরও কোন উপকার হয় না। কারণ এটা বিদ‘আতী প্রথা। বিশেষ করে রামাযান মাসে মৃত্যু ব্যক্তির নামে কুরআন পড়ার প্রতিযোগিতা চলে। সারা রাত তেলাওয়াত অব্যাহত থাকে। জন্ম ও মৃত্যু দিবসেও কুরআনখানীর অনুষ্ঠান করা হয়। এগুলো সবই বিদ‘আতী প্রথা।
(৯) কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা :
কবরস্থানে গিয়ে মোল্লাদের কুরআন তেলাওয়াত করার বিদ‘আতী সংস্কৃতি বহু প্রাচীন। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এই বিদ‘আতী প্রথা চালু আছে।
(১০) উদ্ভট সাংকেতিক চিহ্ন :
(ক) -ص(وقف النبى صلى الله عليه وسلم) । অর্থাৎ এই চিহ্ন যেখানে আছে সেখানে ওয়াক্ব্ফ করা সুন্নাত। কারণ এখানে রাসূল (ﷺ) ওয়াক্ব্ফ করতেন। এটা উদ্ভট কথা। এর কোন ভিত্তি নেই।
(খ) (وقف جبريل عليه السلام)। এই স্থানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ওয়াক্বফ করতেন। কারণ এই স্থানে ওয়াক্বফ করলে বরকত হয়। এটাও মিথ্যা কথা।
(গ) ن (وقف غفران) এ স্থানে ওয়াক্বফ করলে পাপ মাফ হয়। এ কথার শারঈ কোন ভিত্তি নেই।
(ঘ) (وقف منزل) ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জুম‘আর দিন থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। প্রতিদিন এক মঞ্জিল করে পড়তেন। তাই সমগ্র কুরআনে ৭ মঞ্জিল আছে। এই নিয়মে পাঠ করা ভাল। এটাও উদ্ভট দাবী। এর ভিত্তি নেই। এ ধরনের আরো অনেক উদ্ভট চিহ্ন দেয়া আছে। এগুলো থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
(১১) মিথ্যা ও জাল ফযীলত বর্ণনা করা :
কুরআন মাজীদের ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ বর্ণনা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে মিথ্যা ও উদ্ভট কথা কুরআন সম্পর্কে প্রচার করা হয়। ইলিয়াসী তাবলীগের ‘ফাজায়েলে আমল’ ও ‘নিয়ামুল কুরআন’-এর মত বহু বই বাজারে চালু আছে যার মধ্যে অসংখ্য মিথ্যা কাহিনী উল্লেখ করা আছে। এগুলো সাধারণ মানুষকে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
সুধী পাঠক! উচিত ছিল কুরআন মাজীদকে সার্বিক জীবনের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করা। কুরআনের আইন ও বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা। কিন্তু আমরা সেটা না করে কুরআনকে তাবীযের পুস্তক বানিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন মাজীদের হক্ব আদায় করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
তথ্যসূত্র :
[১]. সূরা আন‘আম ১১২ ও ১২১; বুখারী হা/৩২১০, ৪৭০১, ৬২১৩।
[২]. সূরা ফাত্বির ১০; মুসলিম হা/১০১৫।
[৩]. ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩/১২০-১২১ পৃ.।
[৪]. আল-ইতক্বান, ২/১৭১ পৃ.।
[৫]. ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩২৩০০।
[৬]. ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব ইবনু বায, তাঁর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, https://binbay.org.sa/fatwas/29156।
[৭]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৯১৪৯৭।
[৮]. তাহরীমু কিতাবাতিল কুরআনিল কারীম বি হুরূফি গাইরি আরাবিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬।
[৯]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ ৫/৩৩০ পৃঃ; নববী, আল-মাজমূ‘উ ৩/৩৭৯।
[১০]. আবুদাঊদ হা/৪৭৫৩, সনদ সহীহ।
[১১]. আহমাদ হা/১৭৪৫৮; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৪৯২।
[১২]. আবুদাঊদ হা/৩৮৮৩; মিশকাত হা/৪৫৫২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৫৩, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৭২-২৭৩, ‘চিকিৎসা ও মন্ত্র’ অনুচ্ছেদ।
[১৩]. সহীহ বুখারী হা/৩০০৫।
[১৪]. আবুদাঊদ হা/৩; মিশকাত হা/৩৫১।
[১৫]. তিরমিযী হা/২০৭২; সনদ হাসান, সহীহ তারগীব হা/৩৪৫৬; মিশকাত হা/৪৫৫৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৫৭, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৭৪।
[১৬]. সহীহ মুসলিম হা/২২০০, ২/২২৪ পৃঃ, ‘সালাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২২; মিশকাত হা/৪৫৩০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৩১, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৬৭।
[১৭]. সহীহ বুখারী হা/৫৭৩৫-৫৭৩৭, ২/৮৫৪ পৃঃ, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩২, ৩৩, ৩৪।
[১৮]. মুছত্বলাহুর রুকূ‘ ফিল মাছাহেফ, পৃঃ ৩৯-৪০।
[১৯]. এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ‘তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ বইটি পড়ুন।
[২০]. মুছত্বলাহুর রুকূ‘ ফিল-মাছাহেফ, পৃঃ ৩৯।
[২১]. তিরমিযী হা/৪৩৯, সনদ সহীহ; মুসলিম হা/৭৩৮; ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৫৫; উক্ত হাদীসে ‘রাত’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে।
[২২]. সহীহ বুখারী হা/২০১৩, ১১৪৭ ও ৩৫৬৯, ১/২৬৯, পৃঃ ‘তারাবীহর সালাত’ অধ্যায়-৩১; আরো দ্রঃ ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৪ ও ৫০৪; বঙ্গানুবাদ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাপা ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২৯৩, হা/১৮৮৬ (১৮৮৩); মুসলিম হা/১৭২৩ ও ১৭২০, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৫৪।
[২৩]. সহীহ বুখারী হা/২০১৩, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৬৯।
[২৪]. সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৪, হা/১১৪৭।
[২৫]. সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫০৪, হা/৩৫৬৯, ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪।
[২৬]. আলবানী, সহীহ আবুদাঊদ হা/১২৬৫-এর আলোচনা দ্রঃ, মুরসাল সূত্রে সহীহ; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৫৪৫-৩৫৫৬; ফাতাওয়া শায়খ বিন বায ২৪/৪০৬ পৃঃ।
[২৭]. তাখরীজু আহাদীসিল ইহইয়া হা/৮৭৩।
[২৮]. গুনইয়াতুত ত্বালেবীন ৩/২৯৬-৩১৫ পৃঃ; সিলসিলাহ যঈফাহ হা/৬১৩৫; তাখরীজ আহাদীসিল ইহইয়া হা/৮৭৩।
[২৯]. ফাতাওয়া শায়খ বিন বায ৬/২৯৪।
[৩০]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৪/১৪৯ পৃঃ, ফৎওয়া নং ৩৩০৩; ফাতাওয়া উছায়মীন ৩৯/১-৬ পৃ.।
[৩১]. তিরমিযী হা/২৯৪৮; ই‘লামুল মুয়ক্কেঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৯।
[৩২]. ইমাম নাসাঈ, আল-কুবরা হা/১০১৪০; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ হা/৩০৮, সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৩১৬৪; দ্রঃ নাসাঈ (বৈরুত : দারুল মা‘আরিফাহ ১৯৯৭), হা/১৩৪৪-এর টীকা দ্রঃ, পৃঃ ৩/৮১।
[৩৩]. শু‘আবুল ঈমান হা/১৯০৭।
[৩৪]. সহীহ বুখারী হা/৫৯৭৪; রওযাতুল মুহাদ্দিছীন হা/৪৬৬১।
[৩৫]. আবুদাঊদ হা/৮৮৭, ১/১২৯ পৃঃ; মিশকাত হা/৮৬০; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪২৪৫।
[৩৬]. আবুদাঊদ হা/৮৮৪, ১/১২৮ পৃঃ, সনদ সহীহ।
[৩৭]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৮০৬২; তাহক্বীক্ব তাফসীরে ইবনে কাছীর ২/৩৭৪।
[৩৮]. হাকেম হা/৫৩২৫; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১৩৩।
কারণ আল্লাহর কাছে কেবল পবিত্র আমলই কবুল হয়।[২]
(১) বাংলা উচ্চারণ করে কুরআন তেলাওয়াত করা :
কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে না এমন অবসরপ্রাপ্ত ও বৃদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যেই বাংলা কিংবা ইংরেজী ভাষায় উচ্চারণ করা কুরআন পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে ধর্মব্যবসায়ীরা তাদেরকে উৎসাহিত করে থাকে। অথচ তারা নেকী তো পাবেই না, বরং হারাম কাজ করার কারণে পাপী হবে। কারণ কুরআন মাজীদ সরাসরি আল্লাহর কালাম। অন্য কোন ভাষায় উচ্চারণ করে তেলাওয়াত করা হারাম। এতে সঠিক উচ্চারণ প্রকাশ পায় না। ফলে অর্থ বিকৃত হয়ে যায়। কুরআনুল কারীমকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। তাই আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় তিলাওয়াত করা যাবে না। তবে অন্য ভাষায় অনুবাদ করাতে কোন সমস্যা নেই।[৩]
ইমাম যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কুরআনুল কারীমকে তিলাওয়াত করা হারাম’।[৪]
ইমাম ইবনু হাজার আল-হাইছামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কুরআনুল কারীমকে আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষার অক্ষরে লেখা হারাম’।[৫]
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র কুরআনকে আরবী ভাষাতেই অবতীর্ণ করেছেন। এটি আরবী কুরআন। সুতরাং এটিকে আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় পাঠ করা জায়েয নয়। সালাতের মধ্যে এবং বাইরে উভয় অবস্থাতেই কুরআনুল কারীম আরবীতেই তিলাওয়াত করতে হবে। তবে যেকোন ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করা যাবে। যাতে কুরআনের মূলভাব ও বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হতে পারে।[৬]
শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আরবী ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় কুরআনকে প্রকাশ করা অবৈধ।[৭]
উল্লেখ্য যে, শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), শাযখ আব্দুর রাযযাক আফিফী (রাহিমাহুল্লাহ) এবং আরো অনেক বড় বড় আলিমের উপস্থিতিতে এ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে পরবর্তীতে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যার নামকরণ করা হয়েছে,
تحريم كتابة القرآن الكريم بحروف غير عربية
‘কুরআনুল কারীমকে আরবী ভাষার অক্ষর ব্যতীত অন্য ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হারাম’ নামে। সেখানে বলা হয়েছে, উক্ত বিষয়ে অধ্যয়ন, আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর ঊলামা পরিষদের ঐকমত্যানুসারে এই সিদ্ধান্ত সংগৃহীত হল যে, ‘ল্যাটিন অক্ষরে বা অন্য কোন ভাষার অক্ষরে কুরআনুল কারীমকে লিপিবদ্ধ করা হারাম’।[৮]
যারা উচ্চারণ করা কুরআন প্রিন্ট করে বাজারে ব্যবসা করছে তারা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ করছে।[৯]
আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত দান করুন! প্রত্যেক মুসলিমের উচিত এ সমস্ত প্রকাশনীকে প্রত্যাখ্যান করা।
তাই প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব হল, কুরআন শিক্ষা করা, বেশী বেশী তেলাওয়াত করা এবং এর অর্থ ও ভাব বুঝার চেষ্টা করা। অন্যথা কবরে ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হবে না।[১০]
(২) কুরআন দিয়ে তাবীযের ব্যবসা :
দেশের অধিকাংশ প্রকাশনী কুরআনের শুরুতে বা শেষে তাবীযের নকশা সংযুক্ত করে কুরআন ছাপিয়েছে। আর বিদ‘আতী খত্বীব ও মোল্লারা এই তাবীয দিয়ে ব্যবসা করছে এবং মানুষকে ধোঁকা দেয়। মসজিদের ইমাম ও খত্বীবরা হারাম উপার্জন করে থাকে। এমনিতেই তাবীয বাঁধা শিরক। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনকে ব্যবসার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে এবং এই অপবিত্র আবর্জনাকে কুরআনের সাথে সংযুক্ত করেছে আরো জঘন্য অপরাধ। এজন্য ঈমান-আমল সবই নষ্ট বাতিল হয়ে যাবে। শরীরে তাবীয থাকা অবস্থায় সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাতসহ কোন ইবাদতই কবুল হবে না। এই অবস্থায় মারা গেলে শিরককারী হিসাবে আল্লাহর ক্ষমাও পাবে না। অথচ এই তাবীযকে কুরআনের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিম্নের হাদীসগুলো বুঝার অনুরোধ করছি-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ৎ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ فَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ بَايَعْتَ تِسْعَةً وَتَرَكْتَ هَذَا قَالَ إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيْمَةً فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا فَبَايَعَهُ وَقَالَ مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ
উক্ববা বিন আমের আল-জুহানী বলেন, একদা রাসূল (ﷺ)-এর কাছে একটি কাফেলা আগমন করল। অতঃপর তিনি নয়জনকে বায়‘আত করালেন আর একজনকে বাদ দিলেন। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! নয়জনকে বায়‘আত করালেন আর একে ছেড়ে দিলেন কেন? রাসূল (ﷺ) বললেন, তার শরীরে তাবীয বাঁধা আছে। অতঃপর লোকটি শরীরের ভিতরে হাত দিয়ে তাবীয ছিঁড়ে ফেলল। তারপর রাসূল (ﷺ) তাকে বায়‘আত করালেন এবং বললেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয বাঁধল সে শিরক করল’।[১১]
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে শরীরে তাবীয বেঁধে রাখা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। ইসলাম গ্রহণ করারও সুযোগ থাকে না। অন্য হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন,
إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ
‘নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক করা, তাবীয বাঁধা, যাদুটোনা শিরক’।[১২]
রাসূল (ﷺ) আরো বলেন,
لاَ يُبْقَيَنَّ فِى رَقَبَةِ بَعِيرٍ قِلاَدَةٌ مِنْ وَتَرٍ وَلاَ قِلاَدَةٌ إِلاَّ قُطِعَتْ
‘কোন উটের গলায় যদি মালা বা বালা জাতীয় কিছু থাকে, তাহলে তা কেটে ফেলতে হবে’।[১৩] তিনি আরো বলেন,
أَنَّهُ مَنْ عَقَدَ لِحْيَتَهُ أَوْ تَقَلَّدَ وَتَرًا أَوْ اسْتَنْجَى بِرَجِيعِ دَابَّةٍ أَوْ عَظْمٍ، فَإِنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْهُ بَرِيءٌ
‘যে ব্যক্তি তার দাড়িতে গিঁঠ দিল বা পেচিয়ে রাখল অথবা সূতার মালা পরিধান করল অথবা পশুর মল বা হাড্ডি দিয়ে ইস্তিনজা করল, মুহাম্মাদ (ﷺ) তার জিম্মাদারী থেকে মুক্ত’।[১৪] অন্য হাদীসে এসেছে,
عَنْ عِيْسَى بْنِ حَمْزَةَ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى عَبْدِ اللهِ بْنِ عُكَيْمٍ وَبِهِ حُمْرَةٌ فَقُلْتُ أَلَا تُعَلِّقُ تَمِيْمَةً؟ فَقَالَ نَعُوْذُ بِاللَّهِ مِنْ ذَلِكَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ৎ مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ
ঈসা বিন হামযা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি একদা আব্দুল্লাহ বিন উকাইম-এর কাছে গেলাম। তখন তার শরীরের লাল রঙের তাবীয বাঁধা ছিল। আমি বললাম, তুমি তাবীয বেঁধে রেখেছ? আমরা আল্লাহর কাছে এটা থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শরীরে কোনকিছু বাঁধবে, তাকে সে দিকেই সোপর্দ করা হবে’। অর্থাৎ আল্লাহর নিরাপত্তা থেকে সে বেরিয়ে যাবে।[১৫]
উল্লেখ্য যে, কুরআনের আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত দু‘আ দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা শরী‘আত সম্মত। এছাড়া শিরক মিশ্রিত কোন মন্ত্র দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হারাম।[১৬]
রাসূল (ﷺ) সূরা ফাতেহা, সূরা ফালাক্ব, নাস প্রভৃতি সূরা ও আয়াত দ্বারা ফুঁক দিয়েছেন, শরীর মাসাহ করেছেন এবং ক্ষতস্থান হলে তাতে থুথু দিয়েছেন।[১৭]
(৩) ‘কুরআন শরীফ’ বলে প্রচার করা :
৫৫ থেকে ৯০টি নাম রয়েছে কুরআনের। কিন্তু ‘কুরআন শরীফ’ নেই। বিদ‘আতীরা আল্লাহ প্রদত্ত নামগুলো বর্জন করে নিজেরা নামকরণ করেছে ‘কুরআন শরীফ’। আল-কুরআনুল কারীম, কুরআন মাজীদ, আল-কুরআনুল হাকীম, আল-কুরআনুল আযীম, ফুরক্বান, তানযীল, যিকর, কিতাব ইত্যাদি সুন্দর নামগুলো তাদের পসন্দ হয়নি। তাই আমাদের দায়িত্ব হবে আল্লাহ প্রদত্ত নামেই কুরআনকে সম্বোধন করা।
(৪) কুরআনের মধ্যে রুকূ‘ সংযোজন :
কুরআন মাজীদের মধ্যে ৫৪০টি রুকূ‘র চিহ্ন নির্দেশ করা হয়েছে। এটা অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য যুক্ত করা হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে ২০ রাক‘আত তারাবীহকে বৈধ করার এটি একটি সূক্ষ্ম নীল নকশা। প্রতি রাক‘আতে ১ রুকূ পড়া এবং ২৭ রাত্রিতে কুরআন খতম করার বিদ‘আতী প্রথাকে জায়েয করার জন্য (২০´২৭) ৫৪০টি রুকূ সংযোগ করা হয়েছে।[১৮]
অথচ রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে যেমন নির্দিষ্ট ২০ রাক‘আত তারাবীহর প্রমাণিত নয়, তেমনি রামাযানের ২৭ তারিখের রাত্রিতে কুরআন খতমেরও কোন দলীল নেই।[১৯]
সঊদী আরবের মুছহাফে উক্ত রুকূ নেই। এটা চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর শুরুর দিকে বুখারা অঞ্চলের হানাফী আলেমগণ কুরআনের মধ্যে যুক্ত করেছে।[২০] তাই কুরআন তেলাওয়াত করার সময় রুকূ চিহ্নের অনুসরণ করা যাবে না। মনে রাখা আবশ্যক যে, কুরআনের উপর অত্যাচার করে রামাযানে কুরআন খতম দেয়া যাবে না। কুরআন মাজীদকে তারতীলসহ তেলাওয়াত করতে বলা হয়েছে। আর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী তারাবীহ্র সালাত বিতরসহ ১১ রাক‘আতই আদায় করতে হবে। আবু সালামা ইবনু আবদুর রহমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রামাযানের রাতের[২১]
সালাত কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রামাযান মাসে এবং রামাযানের বাইরে ১১ রাক‘আতের বেশী সালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে (২+২) চার রাক‘আত পড়তেন। তুমি (আবু সালামা) তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি তিন রাক‘আত (বিতর) পড়তেন।[২২]
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি
كِتَابُ صَلَاةِ التَّرَاوِيْحِ
‘তারাবীহর সালাত’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।[২৩] তিনি ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়ের ‘রামাযান ও অন্য মাসে রাসূল (ﷺ)-এর রাত্রির সালাত’ অনুচ্ছেদেও হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।[২৪] এছাড়াও অন্য আরেকটি অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।[২৫]
উল্লেখ্য যে, ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত শিরোনাম উল্লেখ করলেও ভারত উপমহাদেশের ছাপা সহীহ বুখারী থেকে সেই শিরোনাম উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ২০ রাক‘আতের যে বর্ণনা এসেছে, জাল।
(৫) তেলাওয়াতে সিজদায় কাটছাঁট :
পবিত্র কুরআনে ১৫টি আয়াতে সিজদা আছে।[২৬] কিন্তু বাংলাদেশী ছাপা কুরআনে ১৪টি উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিমরা তেলাওয়াত করার সময় এর প্রতিই আমল করে থাকে। সূরা হজ্জের দ্বিতীয় সিজদাকে সিজদা হিসাবেই গণ্য করা হয়নি। এখানে ‘ইমাম শাফেঈর মত’ বলে লিখে দেয়া হয়েছে। রাসূল (ﷺ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই কুরআন নাযিল সম্পন্ন হয়েছে। আর ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) -এর জন্ম হয়েছে ১৫০ হিজরীতে। ইমাম শাফেঈর নাম এখানে উল্লেখ করার কোন যুক্তিকতা আছে কি? এটাই মাযহাবের কুপ্রভাব। এটা জঘন্য অপরাধ। কুরআন মাজীদের সাথে এটা চরম বিয়াদবী। কুরআনের সাজদাগুলো হল,
(১) সূরা আ‘রাফ আয়াত-২০৪. (২) সূরা রা‘দ আয়াত-১৫. (৩) সূরা নাহল আয়াত-৫০. (৪) সূরা বানী ইসরাঈল আয়াত-১০৯, (৫) সূরা মারইয়াম আয়াত-৫৮, (৬) সূরা হজ্জ আয়াত-১৮. (৭) সূরা হজ্জ আয়াত-৭৭. (৮) সূরা ফুরক্বান আয়াত-৬০. (৯) সূরা নামল আয়াত-২৬. (১০) সূরা সাজদাহ আয়াত-১৫. (১১) সূরা ছোয়াদ আয়াত-২৪. (১২) সূরা হামীম সাজদাহ আয়াত-৩৮. (১৩) সূরা নাজম আয়াত-৬২. (১৪) সূরা ইনশিক্বাক্ব আয়াত-২১. (১৫) সূরা আলাক্ব আয়াত-১৯।
(৬) কুরআন তেলাওয়াত শেষে বিদ‘আতী দু‘আ পাঠ করা ও বখশানোর আয়োজন করা :
(ক) কুরআন তেলাওয়াতের পর নিম্নের দু‘আ পড়ার প্রচলন খুবই প্রসিদ্ধ। এই দু‘আ রাসূল (ﷺ) পড়েছেন মর্মে প্রচার করা হলেও এর কোন সনদ নেই।[২৭] তাই তেলাওয়াত শেষে নি¤েœর দু‘আ পড়া যাবে না।
اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي بالقُرْءَانِ وَاجْعَلهُ لِي إِمَاماً وَنُوراً وَهُدًى وَرَحْمَةً اللَّهُمَّ ذَكِّرْنِي مِنْهُ مَانَسِيتُ وَعَلِّمْنِي مِنْهُ مَاجَهِلْتُ وَارْزُقْنِي تِلاَوَتَهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ وَاجْعَلْهُ لِي حُجَّةً يَارَبَّ العَالَمِينَ
(খ) অনুরূপ ‘ছাদাক্বাল্লাহুল আযীম’ (صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمُ) বলার যে প্রথা সমাজে প্রচলিত আছে, তার শারঈ কোন ভিত্তি নেই। সেই সাথে ‘দু‘আউ খতমিল কুরআন’ নামে যে সমস্ত নির্দিষ্ট দু‘আ কুরআনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোরও কোন ভিত্তি নেই। মানুষের রচনা করা।[২৮] এ সমস্ত বিদ‘আতী দু‘আ পাঠ করা যাবে না।[২৯] মুহাদ্দিছ উলামায়ে কেরাম এই প্রথাকে বিদ‘আত বলেছেন।[৩০]
কুরআন খতমের নিয়ম হিসাবে সূরা ফাহিতা ও বাক্বারার শুরু থেকে ‘মুফলিহূন’ পর্যন্ত পড়ার যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তারও সহীহ কোন দলীল নেই।[৩১] তাই আমাদেরকে তেলাওয়াত শেষে হাদীসে বর্ণিত সুন্নাতী দু‘আ পাঠ করতে হবে। যেমন রাসূল (ﷺ) পড়তেন-
سُبْحَانَكَ وَبِحَمْدِكَ لَا إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ
উচ্চারণ : সুব্হা-নাকা ওয়া বিহাম্দিকা লা ইলা-হা ইল্লা আংতা আস্তাগ্ফিরুকা ওয়া আতূবু ইলায়কা।
অর্থ : ‘পবিত্রতা সহ আপনার প্রশংসা বর্ণনা করছি। আপনি ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তওবা করছি’।[৩২]
উল্লেখ্য, কুরআন খতমের পর আনুষ্ঠানিক কোন দু‘আর আয়োজন করা যাবে না। কোন কোন সাহাবী থেকে দু‘আ করার কথা পাওয়া যায়। তবে নির্দিষ্ট কোন দু‘আ নয়।[৩৩]
তাই কুরআন মাজীদ খতমের পর সৎ আমল হিসাবে অসীলা করে আল্লাহর কাছে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং মুসলিম উম্মাহ্র দু‘আ করতে পারে, রহমত ও ক্ষমা চাইতে পারে।[৩৪] কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা, আয়োজন ও বখশানোর কোন সুযোগ নেই।
(৭) তেলাওয়াতের জবাবে অতিরিক্ত সংযোজন :
(ক) সূরা জুম‘আ শেষে ‘আল্ল-হুম্মারযুক্বনা রিযক্বান হাসানাহ’ বলার কোন ভিত্তি নেই। (খ) সূরা বাণী ইসরাঈল শেষ করে ‘আল্লাহু আকবার কাবীরা’ বলা (গ) সূরা ওয়াক্বিয়াহ ও হাক্কাহ শেষে ‘সুবহা-না রব্বিয়াল আযীম’ বলা। (ঘ) মুলক শেষে ‘আল্লাহু ইয়া’তীনা ওয়া হুয়া রাব্বুল আলামীন’ বলার কোন দলীল নেই। এগুলো মোল্লাদের তৈরি বিদ‘আতী প্রথা।
উল্লেখ্য যে, (ক) সূরা ত্বীনের শেষে ‘বালা ওয়া আনা ‘আলা যা-লিকা মিনাশ শা-হেদীন’ বলা (খ) সূরা মুরসালাত-এর শেষে ‘আ-মান্না বিল্লাহ’ বলা এবং (গ) সূরা ক্বিয়ামাহ শেষে ‘বালা’ বলার যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। এর সনদে একজন রাবী আছে, যার কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি।[৩৫] তবে এর শেষে বলবে سُبْحَانَكَ فَبَلَى (সুবহা-নাকা ফা বালা)।[৩৬] (ঘ) সূরা বাক্বারাহ শেষে ‘আমীন’ বলার বর্ণনা যঈফ।[৩৭] (ঙ) সূরা যোহা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত সকল সূরা শেষে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার যে বর্ণনা এসেছে, তা মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য।[৩৮] অতএব সূরার জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
(৮) মৃত্যুর পর মাইয়েতের জন্য কুরআন তেলাওয়াত করা :
মানুষ বেঁচে থাকা অবস্থায় বিদ‘আতী ইমাম ও খত্বীবরা দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মানুষের দ্বারে যায় না। কিন্তু মরার পর তারা দলবদ্ধভাবে কুরআন পড়তে যায়। এতে মাইয়েতের যেমন কোন লাভ হয় না, তেমনি যারা পড়তে যায় তাদেরও কোন উপকার হয় না। কারণ এটা বিদ‘আতী প্রথা। বিশেষ করে রামাযান মাসে মৃত্যু ব্যক্তির নামে কুরআন পড়ার প্রতিযোগিতা চলে। সারা রাত তেলাওয়াত অব্যাহত থাকে। জন্ম ও মৃত্যু দিবসেও কুরআনখানীর অনুষ্ঠান করা হয়। এগুলো সবই বিদ‘আতী প্রথা।
(৯) কবরস্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা :
কবরস্থানে গিয়ে মোল্লাদের কুরআন তেলাওয়াত করার বিদ‘আতী সংস্কৃতি বহু প্রাচীন। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এই বিদ‘আতী প্রথা চালু আছে।
(১০) উদ্ভট সাংকেতিক চিহ্ন :
(ক) -ص(وقف النبى صلى الله عليه وسلم) । অর্থাৎ এই চিহ্ন যেখানে আছে সেখানে ওয়াক্ব্ফ করা সুন্নাত। কারণ এখানে রাসূল (ﷺ) ওয়াক্ব্ফ করতেন। এটা উদ্ভট কথা। এর কোন ভিত্তি নেই।
(খ) (وقف جبريل عليه السلام)। এই স্থানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ওয়াক্বফ করতেন। কারণ এই স্থানে ওয়াক্বফ করলে বরকত হয়। এটাও মিথ্যা কথা।
(গ) ن (وقف غفران) এ স্থানে ওয়াক্বফ করলে পাপ মাফ হয়। এ কথার শারঈ কোন ভিত্তি নেই।
(ঘ) (وقف منزل) ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জুম‘আর দিন থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। প্রতিদিন এক মঞ্জিল করে পড়তেন। তাই সমগ্র কুরআনে ৭ মঞ্জিল আছে। এই নিয়মে পাঠ করা ভাল। এটাও উদ্ভট দাবী। এর ভিত্তি নেই। এ ধরনের আরো অনেক উদ্ভট চিহ্ন দেয়া আছে। এগুলো থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
(১১) মিথ্যা ও জাল ফযীলত বর্ণনা করা :
কুরআন মাজীদের ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ বর্ণনা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে মিথ্যা ও উদ্ভট কথা কুরআন সম্পর্কে প্রচার করা হয়। ইলিয়াসী তাবলীগের ‘ফাজায়েলে আমল’ ও ‘নিয়ামুল কুরআন’-এর মত বহু বই বাজারে চালু আছে যার মধ্যে অসংখ্য মিথ্যা কাহিনী উল্লেখ করা আছে। এগুলো সাধারণ মানুষকে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
সুধী পাঠক! উচিত ছিল কুরআন মাজীদকে সার্বিক জীবনের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করা। কুরআনের আইন ও বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা। কিন্তু আমরা সেটা না করে কুরআনকে তাবীযের পুস্তক বানিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন মাজীদের হক্ব আদায় করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
তথ্যসূত্র :
[১]. সূরা আন‘আম ১১২ ও ১২১; বুখারী হা/৩২১০, ৪৭০১, ৬২১৩।
[২]. সূরা ফাত্বির ১০; মুসলিম হা/১০১৫।
[৩]. ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩/১২০-১২১ পৃ.।
[৪]. আল-ইতক্বান, ২/১৭১ পৃ.।
[৫]. ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩২৩০০।
[৬]. ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব ইবনু বায, তাঁর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, https://binbay.org.sa/fatwas/29156।
[৭]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৯১৪৯৭।
[৮]. তাহরীমু কিতাবাতিল কুরআনিল কারীম বি হুরূফি গাইরি আরাবিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬।
[৯]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ ৫/৩৩০ পৃঃ; নববী, আল-মাজমূ‘উ ৩/৩৭৯।
[১০]. আবুদাঊদ হা/৪৭৫৩, সনদ সহীহ।
[১১]. আহমাদ হা/১৭৪৫৮; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৪৯২।
[১২]. আবুদাঊদ হা/৩৮৮৩; মিশকাত হা/৪৫৫২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৫৩, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৭২-২৭৩, ‘চিকিৎসা ও মন্ত্র’ অনুচ্ছেদ।
[১৩]. সহীহ বুখারী হা/৩০০৫।
[১৪]. আবুদাঊদ হা/৩; মিশকাত হা/৩৫১।
[১৫]. তিরমিযী হা/২০৭২; সনদ হাসান, সহীহ তারগীব হা/৩৪৫৬; মিশকাত হা/৪৫৫৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৫৭, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৭৪।
[১৬]. সহীহ মুসলিম হা/২২০০, ২/২২৪ পৃঃ, ‘সালাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২২; মিশকাত হা/৪৫৩০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৩৩১, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ২৬৭।
[১৭]. সহীহ বুখারী হা/৫৭৩৫-৫৭৩৭, ২/৮৫৪ পৃঃ, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩২, ৩৩, ৩৪।
[১৮]. মুছত্বলাহুর রুকূ‘ ফিল মাছাহেফ, পৃঃ ৩৯-৪০।
[১৯]. এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ‘তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ বইটি পড়ুন।
[২০]. মুছত্বলাহুর রুকূ‘ ফিল-মাছাহেফ, পৃঃ ৩৯।
[২১]. তিরমিযী হা/৪৩৯, সনদ সহীহ; মুসলিম হা/৭৩৮; ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৫৫; উক্ত হাদীসে ‘রাত’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে।
[২২]. সহীহ বুখারী হা/২০১৩, ১১৪৭ ও ৩৫৬৯, ১/২৬৯, পৃঃ ‘তারাবীহর সালাত’ অধ্যায়-৩১; আরো দ্রঃ ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৪ ও ৫০৪; বঙ্গানুবাদ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাপা ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২৯৩, হা/১৮৮৬ (১৮৮৩); মুসলিম হা/১৭২৩ ও ১৭২০, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৫৪।
[২৩]. সহীহ বুখারী হা/২০১৩, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৬৯।
[২৪]. সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৪, হা/১১৪৭।
[২৫]. সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫০৪, হা/৩৫৬৯, ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪।
[২৬]. আলবানী, সহীহ আবুদাঊদ হা/১২৬৫-এর আলোচনা দ্রঃ, মুরসাল সূত্রে সহীহ; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৫৪৫-৩৫৫৬; ফাতাওয়া শায়খ বিন বায ২৪/৪০৬ পৃঃ।
[২৭]. তাখরীজু আহাদীসিল ইহইয়া হা/৮৭৩।
[২৮]. গুনইয়াতুত ত্বালেবীন ৩/২৯৬-৩১৫ পৃঃ; সিলসিলাহ যঈফাহ হা/৬১৩৫; তাখরীজ আহাদীসিল ইহইয়া হা/৮৭৩।
[২৯]. ফাতাওয়া শায়খ বিন বায ৬/২৯৪।
[৩০]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৪/১৪৯ পৃঃ, ফৎওয়া নং ৩৩০৩; ফাতাওয়া উছায়মীন ৩৯/১-৬ পৃ.।
[৩১]. তিরমিযী হা/২৯৪৮; ই‘লামুল মুয়ক্কেঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৯।
[৩২]. ইমাম নাসাঈ, আল-কুবরা হা/১০১৪০; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ হা/৩০৮, সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৩১৬৪; দ্রঃ নাসাঈ (বৈরুত : দারুল মা‘আরিফাহ ১৯৯৭), হা/১৩৪৪-এর টীকা দ্রঃ, পৃঃ ৩/৮১।
[৩৩]. শু‘আবুল ঈমান হা/১৯০৭।
[৩৪]. সহীহ বুখারী হা/৫৯৭৪; রওযাতুল মুহাদ্দিছীন হা/৪৬৬১।
[৩৫]. আবুদাঊদ হা/৮৮৭, ১/১২৯ পৃঃ; মিশকাত হা/৮৬০; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪২৪৫।
[৩৬]. আবুদাঊদ হা/৮৮৪, ১/১২৮ পৃঃ, সনদ সহীহ।
[৩৭]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৮০৬২; তাহক্বীক্ব তাফসীরে ইবনে কাছীর ২/৩৭৪।
[৩৮]. হাকেম হা/৫৩২৫; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১৩৩।
সূত্র: আল-ইখলাছ।
Last edited: