[মাওলানা আব্দুস সাত্তার দেহলভী ভারতীয় উপমহাদেশের একজন উঁচুদরের আলেম, মুফাসসির ও মুহাদ্দিছ ছিলেন। তিনি ১৩২৩ হিঃ/১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় বছর বয়সে তাঁর শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেন। অতঃপর তিনি দিল্লীর ছদর বাযারে অবস্থিত দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ মাদরাসায় স্বীয় পিতা মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভীর নিকট তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উছূলে ফিকহ, নাহু, ছরফ, মানতিক, আরবী সাহিত্য প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করে ১৯২৭ সালে ফারেগ হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। অতঃপর উক্ত মাদরাসায় শায়খুল হাদীস পদে বরিত হন এবং ২০ বছর যাবৎ সেখানে ইলমে হাদীসের দরস প্রদান করেন। ১৯৩২ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীস’-এর আমীর নিযুক্ত হন এবং ৩৪ বছর যাবৎ এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন এ জামা‘আতের দ্বিতীয় আমীর। ১৯৪৭ সালে তিনি দিল্লী থেকে করাচীতে হিজরত করেন। তাফসীরে সাত্তারী (৬ খন্ড), সহীহ বুখারীর উর্দূ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা নুছরাতুল বারী এবং ফাতাওয়া সাত্তারিয়াহ (৪ খন্ড) তাঁর অন্যতম রচনা। তিনি ১৯৬৬ সালের ৯ই আগস্ট করাচীতে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।][1]
খাতামুন নাবিইয়ীন (সর্বশেষ নবী), সাইয়িদুল মুরসালীন (রাসূলগণের নেতা) হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাদের জন্য একটি পরিপূর্ণ কর্মসূচী বর্ণনা করেছেন। যার উপর চলে আমরা শুধু পাক-ভারতকে নয়; বরং সারা বিশ্বকে অনন্ত জীবনের পয়গাম দিতে পারি। ইসলামী জামা‘আতের ক খ হ’ল সালাত ও যাকাত। যদি মানুষ একটু চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতই তাকে জামা‘আতী যিন্দেগীর জোরালো সবক দিচ্ছে। জামা‘আতী যিন্দেগীকে অাঁকড়ে ধরা এবং বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নবী করীম (ﷺ) উম্মতকে নিম্নোক্ত শব্দে অছিয়ত করেছেন-
‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি- (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। কেননা যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন করল। যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। আর যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহবান জানাল, সে জাহান্নামীদের দলভুক্ত হ’ল। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন মুসলিম’।[2]
ইসলাম ও জামা‘আতী যিন্দেগী :
এই হাদীস থেকে কিছু বিষয় সুস্পষ্টভাবে জানা গেল।-
১. মুসলমানের জন্য সবচেয়ে অগ্রগণ্য জিনিস হল জামা‘আতী যিন্দেগী। ইসলাম ও জামা‘আত একই বস্ত্ত।
২. জামা‘আতী যিন্দেগীকে পরিত্যাগ করা ইসলামী যিন্দেগীকে পরিত্যাগ করার নামান্তর। অহীর ভাষ্যকার, রিসালাতের প্রত্যাবর্তনস্থল মুহাম্মাদ (ﷺ) যার ব্যাখ্যা এটা দিয়েছেন যে, মুসলমান যদি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণও বেরিয়ে যায়, তাহ’লে সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন করল।
৩. যেসব মোল্লা-মৌলভী জামা‘আতী যিন্দেগী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দাওয়াত দেন এবং শরী‘আত বিরোধী সন্দেহ-সংশয় পেশ করে জামা‘আতে ফাটল ও বিভেদ সৃষ্টি করেন, জামা‘আত থেকে লোকদেরকে দূরে সরিয়ে রাখেন, আনুগত্যের পরিবর্তে অবাধ্যতার সবক দেন, তিনি আসলে জাহেলিয়াতের জীবনের দিকে মানুষকে আহবান করেন। যার পরিণাম জাহান্নাম।
৪. জামা‘আতী যিন্দেগী থেকে পৃথক হয়ে জীবন যাপনকারীদের জন্য এতে কঠিন ধমকি রয়েছে যে, এমন অবস্থায় না শুধু সালাত ও ছিয়াম মুক্তির কারণ হতে পারে, না তার নিজেকে মুসলমান বলা এবং মনে করা জাহান্নামের আযাব হ’তে তাকে মুক্তি দিতে পারে। এমন ব্যক্তি যত বড় দ্বীনদারই হোক, ছওম ও সালাতের পাবন্দ হোক, তাহাজ্জুদগুযার হোক, চেহারা-ছূরতে শরী‘আত পালনকারী হোক, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত জামা‘আতে ফাটল সৃষ্টি করা থেকে বিরত না হবে, ততক্ষণ মুক্তি নেই। বরং সে জাহান্নামের খড়-কুটো।
৫. জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরার পর অর্থাৎ জামা‘আতী যিন্দেগীতে প্রবেশ করা মাত্রই তার মর্যাদাগত, ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব হল জামা‘আতী নির্দেশ সমূহ শ্রবণ করা এবং তা মেনে নেয়া।
৬. জামা‘আতী যিন্দেগীর এটা আবশ্যকীয় ও অপরিহার্য দাবী হ’ল, স্বীয় আমীর ও ইমামের নির্দেশের পরিপূর্ণরূপে আনুগত্য করবে এবং তা বাস্তবায়ন করা ও মেনে নেয়ার মধ্যে ব্যস্ত থাকাকে নিজের দায়িত্ব মনে করবে।
৭. জামা‘আতী উদ্দেশ্য হাছিল করার জন্য সব রকমের আত্মত্যাগ করতে হবে। এ পথে অবস্থাভেদে হিজরত ও জিহাদের পরীক্ষা সামনে এলেও।
একটি লক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :
উক্ত হাদীসে এ বিষয়টিও লক্ষণীয় যে, সর্বপ্রথম এই হুকুম দেয়ার পরে যে, মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এটা রয়েছে যে, তারা জামা‘আতী যিন্দেগী যাপন করবে। সাথে সাথে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের উপর নেতার আদেশ শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। এটা এ বিষয়ের দলীল যে, জামা‘আতের জন্য আমীর থাকা শরী‘আতের দৃষ্টিতে একটি প্রমাণিত সত্য। এজন্য আমীর ও ইমামের উল্লেখ না করে জামা‘আতের পরে একসাথে শোনা ও আনুগত্য করার কথা বর্ণনা করেছেন। কেননা জামা‘আত প্রতিষ্ঠা তথা ইমারত ও ইমামতের উপকারিতা, শ্রবণ করা ও মান্য করা কেবল আমীরের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হতে পারে। আর উক্ত হাদীসে এই নির্দেশকে মুতলাক বা সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ নির্দেশ হ’ল এই যে, মুসলমান দারুল ইসলামে বসবাস করুক বা দারুল কুফরে, সর্বাবস্থায় সে জামা‘আত প্রতিষ্ঠা করার জন্য শরী‘আত কর্তৃক আদিষ্ট। আর এটাই হ’ল সেই বাস্তবতা যার ঘোষণা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারূক (রাঃ) অত্যন্ত সুস্পষ্ট শব্দে দিয়েছিলেন যে, لاَ إِسْلاَمَ إِلاَّ بِجَمَاعَةٍ، وَلاَ جَمَاعَةَ إِلاَّ بِإِمَارَةٍ، وَلاَ إِمَارَةَ إِلاَّ بِطَاعَةٍ- ‘ইসলাম হয় না জামা‘আত ছাড়া, জামা‘আত হয় না আমীর ছাড়া এবং ইমারত হয় না আনুগত্য ছাড়া’।[3] অর্থাৎ আমীর ও ইমামের আনুগত্য ওয়াজিব।
অতঃপর জামা‘আতী যিন্দেগী যেটা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর ভাষ্য মতে ইমারতের শারঈ ব্যাখ্যা, তার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা স্পষ্ট করার জন্য যে এটাই ইসলামী জীবন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাথে সাথে এটাও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি জামা‘আতী যিন্দেগী থেকে নিজেকে বের করে নিল এবং বিচ্ছিন্নতাকে বেছে নিল, সে ইসলামের গন্ডীকে নিজের গর্দান থেকে ছিন্ন করল। আর যে জামা‘আত থেকে বিছিন্ন থাকল এবং বিচ্ছিন্ন থাকার দাওয়াত দিতে থাকল, তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যদিও সে সালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে এবং নিজেকে মুসলমান মনে করে। অতএব আমীর বিহীন জীবন যে ধরনেরই জীবন হোক সেটা ইসলামী এবং জামা‘আতী যিন্দেগী হবে না। নিম্নোক্ত হাদীসে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা মওজুদ রয়েছে-
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (আমীরের) আনুগত্য হতে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, অতঃপর মারা যায়, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করে’।[4]
অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা, বিক্ষিপ্ততা, বিশৃঙ্খলা, লাগামহীনতা, নেতা বিহীন এবং জামা‘আত থেকে আলাদা থাকা ইসলামী যিন্দেগী নয়। বরং এটা জাহেলিয়াতের যিন্দেগী। সুতরাং যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাগামহীন জীবন যাপন করল এবং সেই অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল। অন্য একটি হাদীসে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকেও এরূপ বর্ণিত হয়েছে,
‘যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল’।[5]
বুখারী ও মুসলিমের এই বর্ণনাগুলি বিশুদ্ধতার মোহর দ্বারা মোহরাঙ্কিত। কার ক্ষমতা রয়েছে যে, এগুলির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে কথা বলে। সনদ ও মতন উভয় দিক থেকেই এগুলির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে। উপরন্তু তালখীছুল হাবীর গ্রন্থে ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, যেটি ব্যাখ্যামূলক। যার শব্দগুলি এরূপ-
‘যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন করল। যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। আর যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে, তার কোন আমীরে জামা‘আত নেই, তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু হল’।[6] এ সকল বর্ণনা সন্দেহাতীতভাবে আমীরের প্রয়োজনীয়তার উপর বিশ্বস্ত সাক্ষী। এগুলির মাধ্যমে আমীর থাকার তাকীদ পরিপূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝুন এবং গভীরভাবে চিন্তা করুন।
[1]. মুহাম্মাদ রামাযান ইউসুফ সালাফী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী আওর উনকা খান্দান (করাচী : মারকাযী দারুল ইমারত, জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীস, জানুয়ারী ২০১০), পৃঃ ১২৭-২৭৯; আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুন নুবালা ফী তারাজুমিল ওলামা (লাহোর : বায়তুল হিকমাহ, ২০০৪), পৃঃ ২৮৫-২৮৭।
[2]. তিরমিযী হা/২৮৬৩; আহমাদ হা/১৭৮১৩; সহীহুল জামে‘ হা/১৭২৪; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৮৯৫; হাকেম হা/১৫৩৪; সহীহ আত-তারগীব হা/১৪৯৮; মিশকাত হা/৩৬৯৪।
[3]. দারেমী হা/২৫১, সনদ যঈফ।
[4]. মুসলিম হা/১৮৪৮; মিশকাত হা/৩৬৬৯।
[5]. বুখারী হা/৭০৫৪; মুসলিম হা/১৮৪৯; মিশকাত হা/৩৬৬৮।
[6]. হাকেম হা/২৫৯, হাদীস সহীহ।
খাতামুন নাবিইয়ীন (সর্বশেষ নবী), সাইয়িদুল মুরসালীন (রাসূলগণের নেতা) হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাদের জন্য একটি পরিপূর্ণ কর্মসূচী বর্ণনা করেছেন। যার উপর চলে আমরা শুধু পাক-ভারতকে নয়; বরং সারা বিশ্বকে অনন্ত জীবনের পয়গাম দিতে পারি। ইসলামী জামা‘আতের ক খ হ’ল সালাত ও যাকাত। যদি মানুষ একটু চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতই তাকে জামা‘আতী যিন্দেগীর জোরালো সবক দিচ্ছে। জামা‘আতী যিন্দেগীকে অাঁকড়ে ধরা এবং বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নবী করীম (ﷺ) উম্মতকে নিম্নোক্ত শব্দে অছিয়ত করেছেন-
آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِى سَبِيلِ اللهِ وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلاَمِ مِنْ عُنُقِهِ إِلاَّ أَنْ يُّرَاجَعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَى جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ-
‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি- (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। কেননা যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন করল। যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। আর যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহবান জানাল, সে জাহান্নামীদের দলভুক্ত হ’ল। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন মুসলিম’।[2]
ইসলাম ও জামা‘আতী যিন্দেগী :
এই হাদীস থেকে কিছু বিষয় সুস্পষ্টভাবে জানা গেল।-
১. মুসলমানের জন্য সবচেয়ে অগ্রগণ্য জিনিস হল জামা‘আতী যিন্দেগী। ইসলাম ও জামা‘আত একই বস্ত্ত।
২. জামা‘আতী যিন্দেগীকে পরিত্যাগ করা ইসলামী যিন্দেগীকে পরিত্যাগ করার নামান্তর। অহীর ভাষ্যকার, রিসালাতের প্রত্যাবর্তনস্থল মুহাম্মাদ (ﷺ) যার ব্যাখ্যা এটা দিয়েছেন যে, মুসলমান যদি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণও বেরিয়ে যায়, তাহ’লে সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন করল।
৩. যেসব মোল্লা-মৌলভী জামা‘আতী যিন্দেগী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দাওয়াত দেন এবং শরী‘আত বিরোধী সন্দেহ-সংশয় পেশ করে জামা‘আতে ফাটল ও বিভেদ সৃষ্টি করেন, জামা‘আত থেকে লোকদেরকে দূরে সরিয়ে রাখেন, আনুগত্যের পরিবর্তে অবাধ্যতার সবক দেন, তিনি আসলে জাহেলিয়াতের জীবনের দিকে মানুষকে আহবান করেন। যার পরিণাম জাহান্নাম।
৪. জামা‘আতী যিন্দেগী থেকে পৃথক হয়ে জীবন যাপনকারীদের জন্য এতে কঠিন ধমকি রয়েছে যে, এমন অবস্থায় না শুধু সালাত ও ছিয়াম মুক্তির কারণ হতে পারে, না তার নিজেকে মুসলমান বলা এবং মনে করা জাহান্নামের আযাব হ’তে তাকে মুক্তি দিতে পারে। এমন ব্যক্তি যত বড় দ্বীনদারই হোক, ছওম ও সালাতের পাবন্দ হোক, তাহাজ্জুদগুযার হোক, চেহারা-ছূরতে শরী‘আত পালনকারী হোক, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত জামা‘আতে ফাটল সৃষ্টি করা থেকে বিরত না হবে, ততক্ষণ মুক্তি নেই। বরং সে জাহান্নামের খড়-কুটো।
৫. জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরার পর অর্থাৎ জামা‘আতী যিন্দেগীতে প্রবেশ করা মাত্রই তার মর্যাদাগত, ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব হল জামা‘আতী নির্দেশ সমূহ শ্রবণ করা এবং তা মেনে নেয়া।
৬. জামা‘আতী যিন্দেগীর এটা আবশ্যকীয় ও অপরিহার্য দাবী হ’ল, স্বীয় আমীর ও ইমামের নির্দেশের পরিপূর্ণরূপে আনুগত্য করবে এবং তা বাস্তবায়ন করা ও মেনে নেয়ার মধ্যে ব্যস্ত থাকাকে নিজের দায়িত্ব মনে করবে।
৭. জামা‘আতী উদ্দেশ্য হাছিল করার জন্য সব রকমের আত্মত্যাগ করতে হবে। এ পথে অবস্থাভেদে হিজরত ও জিহাদের পরীক্ষা সামনে এলেও।
একটি লক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :
উক্ত হাদীসে এ বিষয়টিও লক্ষণীয় যে, সর্বপ্রথম এই হুকুম দেয়ার পরে যে, মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এটা রয়েছে যে, তারা জামা‘আতী যিন্দেগী যাপন করবে। সাথে সাথে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের উপর নেতার আদেশ শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। এটা এ বিষয়ের দলীল যে, জামা‘আতের জন্য আমীর থাকা শরী‘আতের দৃষ্টিতে একটি প্রমাণিত সত্য। এজন্য আমীর ও ইমামের উল্লেখ না করে জামা‘আতের পরে একসাথে শোনা ও আনুগত্য করার কথা বর্ণনা করেছেন। কেননা জামা‘আত প্রতিষ্ঠা তথা ইমারত ও ইমামতের উপকারিতা, শ্রবণ করা ও মান্য করা কেবল আমীরের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হতে পারে। আর উক্ত হাদীসে এই নির্দেশকে মুতলাক বা সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ নির্দেশ হ’ল এই যে, মুসলমান দারুল ইসলামে বসবাস করুক বা দারুল কুফরে, সর্বাবস্থায় সে জামা‘আত প্রতিষ্ঠা করার জন্য শরী‘আত কর্তৃক আদিষ্ট। আর এটাই হ’ল সেই বাস্তবতা যার ঘোষণা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারূক (রাঃ) অত্যন্ত সুস্পষ্ট শব্দে দিয়েছিলেন যে, لاَ إِسْلاَمَ إِلاَّ بِجَمَاعَةٍ، وَلاَ جَمَاعَةَ إِلاَّ بِإِمَارَةٍ، وَلاَ إِمَارَةَ إِلاَّ بِطَاعَةٍ- ‘ইসলাম হয় না জামা‘আত ছাড়া, জামা‘আত হয় না আমীর ছাড়া এবং ইমারত হয় না আনুগত্য ছাড়া’।[3] অর্থাৎ আমীর ও ইমামের আনুগত্য ওয়াজিব।
অতঃপর জামা‘আতী যিন্দেগী যেটা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর ভাষ্য মতে ইমারতের শারঈ ব্যাখ্যা, তার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা স্পষ্ট করার জন্য যে এটাই ইসলামী জীবন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাথে সাথে এটাও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি জামা‘আতী যিন্দেগী থেকে নিজেকে বের করে নিল এবং বিচ্ছিন্নতাকে বেছে নিল, সে ইসলামের গন্ডীকে নিজের গর্দান থেকে ছিন্ন করল। আর যে জামা‘আত থেকে বিছিন্ন থাকল এবং বিচ্ছিন্ন থাকার দাওয়াত দিতে থাকল, তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যদিও সে সালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে এবং নিজেকে মুসলমান মনে করে। অতএব আমীর বিহীন জীবন যে ধরনেরই জীবন হোক সেটা ইসলামী এবং জামা‘আতী যিন্দেগী হবে না। নিম্নোক্ত হাদীসে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা মওজুদ রয়েছে-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً-
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (আমীরের) আনুগত্য হতে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, অতঃপর মারা যায়, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করে’।[4]
অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা, বিক্ষিপ্ততা, বিশৃঙ্খলা, লাগামহীনতা, নেতা বিহীন এবং জামা‘আত থেকে আলাদা থাকা ইসলামী যিন্দেগী নয়। বরং এটা জাহেলিয়াতের যিন্দেগী। সুতরাং যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাগামহীন জীবন যাপন করল এবং সেই অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল। অন্য একটি হাদীসে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকেও এরূপ বর্ণিত হয়েছে,
لَيْسَ أَحَدٌ يُفَارِقُ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَيَمُوْتُ إِلاَّ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً-
‘যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল’।[5]
বুখারী ও মুসলিমের এই বর্ণনাগুলি বিশুদ্ধতার মোহর দ্বারা মোহরাঙ্কিত। কার ক্ষমতা রয়েছে যে, এগুলির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে কথা বলে। সনদ ও মতন উভয় দিক থেকেই এগুলির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে। উপরন্তু তালখীছুল হাবীর গ্রন্থে ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, যেটি ব্যাখ্যামূলক। যার শব্দগুলি এরূপ-
مَنْ خَرَجَ عَنِ الْجَمَاعَةِ قِيْدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلاَمِ مِنْ عُنُقِهِ حَتَّى يُرَاجِعَهُ وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ عَلَيْهِ إِمَامُ جَمَاعَةٍ فَإِنَّ مَوْتَتَهُ مَوْتَةٌ جَاهِلِيَّةٌ-
‘যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন করল। যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। আর যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে, তার কোন আমীরে জামা‘আত নেই, তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু হল’।[6] এ সকল বর্ণনা সন্দেহাতীতভাবে আমীরের প্রয়োজনীয়তার উপর বিশ্বস্ত সাক্ষী। এগুলির মাধ্যমে আমীর থাকার তাকীদ পরিপূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝুন এবং গভীরভাবে চিন্তা করুন।
[1]. মুহাম্মাদ রামাযান ইউসুফ সালাফী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী আওর উনকা খান্দান (করাচী : মারকাযী দারুল ইমারত, জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীস, জানুয়ারী ২০১০), পৃঃ ১২৭-২৭৯; আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুন নুবালা ফী তারাজুমিল ওলামা (লাহোর : বায়তুল হিকমাহ, ২০০৪), পৃঃ ২৮৫-২৮৭।
[2]. তিরমিযী হা/২৮৬৩; আহমাদ হা/১৭৮১৩; সহীহুল জামে‘ হা/১৭২৪; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৮৯৫; হাকেম হা/১৫৩৪; সহীহ আত-তারগীব হা/১৪৯৮; মিশকাত হা/৩৬৯৪।
[3]. দারেমী হা/২৫১, সনদ যঈফ।
[4]. মুসলিম হা/১৮৪৮; মিশকাত হা/৩৬৬৯।
[5]. বুখারী হা/৭০৫৪; মুসলিম হা/১৮৪৯; মিশকাত হা/৩৬৬৮।
[6]. হাকেম হা/২৫৯, হাদীস সহীহ।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: