ইমাম গাযালী একজন রক্ষণশীল, যুক্তিবাদী, খিলাফতপন্থী ছিলেন এবং বাস্তবতামুখী জীবনধারা ও দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন। তাঁর ‘মা‘আরিজুল কুদস’ নামক গ্রন্থে ইমাম গাযালী বলেন, ‘পারস্পরিক সহানুভূতি ও সমাজ ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। পারস্পরিক সহানুভূতি না থাকলে কোন মানুষ বাঁচতে পারে না, সমাজ ব্যবস্থা ও মান-ইয্যত কিছুই টিকে থাকতে পারে না। সমাজ ব্যবস্থা ও পারস্পরিক সহানুভূতির জন্য যে বিধি-বিধান ইসলামে রয়েছে, সেটাকেই বলে শরী‘আত’। তাই শরী‘আতের উদ্দেশ্য সহযোগিতামূলক ও সামাজিক।
আরো পরিষ্কার কথায়, আল্লামা শিবলী নো‘মানী ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও জান-মালের হেফাযতের জন্য দু’টি ব্যবস্থার প্রয়োজন। যথা- পারস্পরিক সাহায্য ও সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পারস্পরিক সাহায্য-সহায়তার মাধ্যমেই মানুষ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়। প্রতিরক্ষা বা প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ জান-মাল ও সন্তান-সন্ততির হেফাযত করে এবং বিপদাপদ থেকে রক্ষা পায়। অতএব পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা কল্পে ইমাম গাযালীর মতে একটি সংবিধান থাকা বাঞ্ছনীয়’।
তবে গাযালীর মতে, স্পষ্টতঃ যে কোন মানুষ বা ব্যক্তি এরূপ কার্যকর সংবিধান উদ্ভাবন বা রচনা করতে সক্ষম হয় না। বিশেষতঃ গোটা মানব জাতির অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাবার উপযুক্ত একটি সংবিধান কেবলমাত্র এমন লোকেই রচনা করতে পারে, যিনি আল্লাহর নিকট থেকে অহীর ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং যিনি আধ্যাত্মিক জগত থেকে সাহায্য গ্রহণ করতে পারঙ্গম ও যাঁর হাতে বিশ্ব শৃংখলার ডোর ন্যস্ত রয়েছে’। অধিকন্তু অহীর ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি ধর্মের রহস্যাদি সম্পর্কে অবহিত থাকেন। এরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি প্রতিটি কাজে ন্যায়-নীতির অনুসরণ করেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ জ্ঞানের মাত্রা অনুসারে সম্বোধন করে থাকেন। মানুষের কর্মক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জনগণের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। এরূপ বৈশিষ্ট্য নবী-রাসূলের হয়ে থাকে’।
ইমাম গাযালী নবী-রাসূলকে মানব জাতির সঠিক পথ প্রদর্শক রূপে বিবেচনা করেন। মানুষের জীবন সংগ্রামে সঠিক পথ প্রদর্শনকেই তিনি রাজনীতি তথা ইমামত বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি ‘মাক্বাছিদুল ফালাসিফা’ গ্রন্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেণী বিভাগ বিন্যাস করে বলেন, মানব জীবনের সহায়ক তিনটি প্রায়োগিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটি হ’ল রাজনীতি। এ তিনটি বিজ্ঞানকে তিনি এভাবে বিন্যাস করেন, যথা-
‘রাজনীতি, অর্থনীতি ও নীতি শাস্ত্র’।
এ তিনটি বিজ্ঞান পরস্পরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বিজড়িত। অর্থনীতি মানুষের প্রাণীসূলভ চিন্তার সাথে জড়িত। এর সাহায্যে মানুষ মস্তিষ্ক খাটিয়ে বস্ত্তগত লাভ-ক্ষতি চিন্তা করে। নীতি শাস্ত্র আত্মা, বিবেক ও অন্তরের সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে মানুষ ভাল-মন্দ বিচার করে এবং এর নৈতিক পরিণতি সম্বন্ধে ভাবে। আর রাজনীতি কোন বস্ত্ত বা পন্থা সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনার পর তা আহরণ বা বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উপায় উদ্ভাবন নিয়ে ব্যাপৃত থাকে। অধিকন্তু রাজনীতির প্রাথমিক গুরুত্বের কারণ, রাজনীতি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হ’লে, অর্থনীতি ও নীতি শাস্ত্র অচল হয়ে পড়ে এবং ধর্ম-কর্ম ও সমাজ জীবন বাধাগ্রস্ত হয়।
পক্ষান্তরে ইবনে সীনা, তার ‘আকসামুল উলূম’ (জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেণী বিভাগ) গ্রন্থে এ ত্রি-বিজ্ঞানকে ‘নীতি শাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি বিজ্ঞান’ রূপে শ্রেণী ভাগ করেন, যা এ্যরিষ্টটলের বিভক্তির অনুরূপ।
এ ব্যাপারে উভয়ের উপর এ্যরিষ্টটলের প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু এ্যরিষ্টটলের নিছক ইহ জাগতিক ভাবধারাকে সংশোধন করে আল-ফারাবী মানুষের জীবনের আদর্শকে ইহ ও পর জাগতিক বা উভয় জগতের সুখ অর্জনের লক্ষ্য রূপে স্থির করেছিলেন। ইমাম গাযালী, আল-ফারাবীর সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘রাজনীতি ত্রয়ী প্রায়োগিক বিজ্ঞানের প্রথম বিজ্ঞান হিসাবে ইহজগতে মানুষের কল্যাণ ও পরজগতে সুখ অর্জন করার লক্ষ্যে নিয়োজিত হয় এবং তা অর্জন করা সম্ভবপর হয় যখন সরকার শরী‘আতের শাস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ও রাজনীতি শাস্ত্রের দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে।
তাঁর ‘কিতাবুল ইক্বতিছাদ ফিল ই‘তিক্বাদ’ গ্রন্থে তিনি মুসলিম সমাজের চত্বরে রাজনীতির ভূমিকা সম্বন্ধে আলোচনা করেন এবং ইসলামের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকে নেতৃত্বের সাথে সম্পৃক্ত করেন। এতে তিনি ইমাম মাওয়ার্দীর মতই নেতৃত্ব বা ‘ইমামত’কে ‘খিলাফত’ রূপে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ‘ইমামত শরী‘আতের অঙ্গ, যা সাধারণ ব্যবহারিক বিষয়বস্ত্ত (মুহিম্মাত) থেকে স্বতন্ত্র এবং নিছক পদার্থ-অতীত অধিবিদ্যা সম্মত চিন্তার আওতাভুক্ত নয়। অতএব গ্রীকদের রাজনীতি চিন্তার আলোকে ইমামতের বিষয়াদি পরীক্ষা করার কোন অধিকার দার্শনিকদের নেই।
তিনি বলেন, ‘এটি নিছক যুক্তিলব্ধ (জ্ঞানপ্রসূত) নয়; বরং শরী‘আতসম্মত চিন্তার ফসল’। তাই তিনি তাঁর অনন্য গ্রন্থ ‘মাক্বাছিদুল ফালাসিফা’-তে বলেন, রাজনীতি ত্রয়ী প্রায়োগিক (সমাজ) বিজ্ঞানের প্রথম বিজ্ঞান রূপে ‘দুনিয়াতে মানুষের কল্যাণ সাধন ও পরকালে সুখ অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত, যা সরকারকে শরী‘আতের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান দ্বারা পূর্ণতা লাভের প্রচেষ্টার দ্বারা লাভ করা যায়’।
ইমাম গাযালীর শ্রেষ্ঠ অবদান এহইয়াউ উলূমিদ্দীন অর্থাৎ ধর্মীয় বিজ্ঞানাদির পুনরুজ্জীবন গ্রন্থে ধর্মকে প্রাণবন্ত ও সমাজকে সচল করতে গিয়ে তিনি সমাজে শৃংখলা রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার তাকীদে রাজনীতিকে বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পান। রোজেনথালের মতে, এক্ষেত্রে তাঁর ইমামত সম্পর্কীয় দৃষ্টিভঙ্গী অভিজ্ঞতাপ্রসূত বাস্তবতায় পর্যবসিত। তিনি যে সময়ে লিখেছিলেন, তখন বাগদাদে আববাসীয় খলীফা ছিলেন অল্প বয়স্ক আল-মুসতাযহির বিল্লাহ। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এ অবস্থায় তিনি খলীফাকে নিজস্ব খেয়াল খুশীমত শাসনকার্য পরিচালনা না করে আলেমদের সাথে পরামর্শ করে শাসনকার্য পরিচালনা করার উপদেশ দেন এবং এর ভিত্তিতে রাজনীতির বাস্তবতা স্বীকার করে অনুপেক্ষণীয় প্রয়োজনের খাতিরে খলীফার গুণাবলীর শর্তের ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা অবলম্বন করার উদ্যোগ নেন।
অবশেষে খলীফা মুসতাযহির-এর উপদেশের উদ্দেশ্যে রচিত তাঁর রাজনীতির গ্রন্থ ‘কিতাবুল-মুসতাযহিরী’তে তিনি ইমাম মাওয়ার্দী কর্তৃক প্রদত্ত ইমামত বা খিলাফতের শর্তাবলীতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী উপস্থাপন করেন।
প্রথমতঃ তিনি বলেন, এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, প্রশাসনিক দক্ষতা ব্যতিরেকে খিলাফত চলে না, কিন্তু খলীফা যদি নিজ হস্তে প্রশাসন নির্বাহ না করে কোন দক্ষ প্রশাসককে মন্ত্রী নিযুক্ত করে তাঁর হাতে প্রশাসনের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, তবে খলীফার নিজের প্রশাসনিক দক্ষতার পরিবর্তে মন্ত্রীর দক্ষতাই যথেষ্ট। এরূপ অবস্থায় খলীফার যোগ্যতাসম্পন্ন হ’তে প্রশাসনিক দক্ষতার শর্ত শিথিল করা যায়।
দ্বিতীয়তঃ অনুরূপভাবে খলীফা যদি জ্ঞানী নাও হন, কিন্তু শরী‘আতের হুকুম-আহকাম চালু করার ব্যাপারে যদি আলেমদের পরামর্শক্রমে সমস্ত কর্ম সমাধা করেন, তাতে তাঁর জ্ঞানী হওয়ার শর্ত আলেমদের জ্ঞানের দ্বারা পূর্ণ হবে। অতএব এমতাবস্থায় খলীফার যোগ্যতার ব্যাপারে জ্ঞানী হওয়ার শর্ত শিথিল করা যায়।
তৃতীয়তঃ যখন খলীফার শাসনকার্য, প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পন্ন ওয়াযীরের দ্বারা সমাধা হয় এবং শরী‘আতের হুকুম-আহকাম ও বিচারকার্য চালু করার কাজ শরী‘আতের জ্ঞানে সুদক্ষ আলেমদের দ্বারা নির্বাহ হয়, সে অবস্থায় খলীফার যোগ্যতার ব্যাপারে প্রাপ্ত বয়সের বাধ্য বাধকতার শর্ত শিথিল করা যায়।
এরূপ শর্ত-শিথিলতার পক্ষ অবলম্বন করার বিশেষ কারণ ছিল ইমাম গাযালীর সময়কালে যখন অল্প বয়ষ্ক ও দুর্বল মুসতাযহির বাগদাদে খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন একদিকে সেলজুক সুলতানেরা মহা পরাক্রমশালী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, যারা সুন্নী মতাবলম্বী ছিলেন এবং বাগদাদের আববাসীয় সুন্নী খিলাফতের সংরক্ষণের জন্য তৎপর ছিলেন। তাঁদের ছত্রছায়ায় মুসতাযহির নাম মাত্র খলীফার আসন অলংকৃত করছিলেন।
আর অন্যদিকে সাত ইমামী[1] শী‘আ মতাবলম্বী বাতেনী সম্প্রদায়, যারা বাগদাদের খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী কায়রোর সাত ইমামী শী‘আ মতাবলম্বী ফাতেমী খলীফাদের ভক্ত ছিল এবং সে সুবাদে আববাসীয় খিলাফতের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বসেছিল, এ অবস্থায় সেলজুক সুলতান মালিক শাহের অনুরোধে ইমাম গাযালী বাতেনীদের মতবাদ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাতেনীদের মতবাদ খন্ডন করে একটি পুস্তক রচনা করেন এবং তাঁর ‘কিতাবুল ইক্বতিছাদ ফিল-ই‘তিক্বাদ’ এ তিনি খলীফা ও সুলতানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার উপর জোর দেন।
লিউনার্ড বাইনার বলেন, ইমাম গাযালীর রাজনীতি চিন্তায় সুলতানের ক্ষমতার ভূমিকার অবতারণা করার কারণ হ’ল, যদিও ইমামত প্রতিষ্ঠার জন্য শরী‘আত অনুসারে ইজমা-ই যথেষ্ট, তবুও মান্যবর ইমাম অর্থাৎ যাঁকে লোকেরা স্বভাবতই মান্য করে বা মানতে বাধ্য হয় এমন ইমামের অবস্থিতি ছাড়া ইজমা কার্যকর হয় না। অতএব সুলতানের ক্ষমতার দাপট ও সমর্থন প্রয়োজন। তাই এহইয়াউ উলূমিদ্দীনের মধ্যেও তিনি সুলতানকে কার্যকরী শাসক হিসাবে গণ্য করেন।
অধিকন্তু ইমামের বৈধ ও অবৈধ কর্তৃত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ‘এহইয়া’-তে তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘আমীরে ইসতি‘লা’ বা সামরিক সরকার যদিও মূলতঃ ক্ষতিকর, তথাপি এদের সাথে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যাতে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা না দেয় ও সমাজকে গৃহ যুদ্ধে নিপাতিত না করে।
তিনি দৃঢ়ভাবে এমত পোষণ করেন যে, যেকোন মূল্যে সভ্য মানুষের পক্ষে গৃহযুদ্ধ ও অরাজকতা থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। কেননা এক দিনের অরাজকতা হাযার বছরের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে। অতএব তাঁর মতে, অরাজকতার ভয়াবহ পরিণতির চেয়ে স্বৈরাচারী শাসকের কিয়ৎ পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করা মন্দের ভাল হিসাবে শ্রেয়।
তাঁর শাসনকর্তাদের প্রতি উপদেশের গ্রন্থ ‘আত-তিবরুল মাসবূক’, যা জাহিয-এর কিতাবুত তাজ এবং নিযামুল-মুলক তূসীর ‘সিয়াসতনামা’র নমুনায় লিখিত, তাতে ইমাম গাযালী বাদশাহীত্ব বা রাজত্ব আল্লাহর দান ও ন্যায় বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রমাণ করেন এবং শত শত উপমা, উদাহরণ ও বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করে বাদশাদেরকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ন্যায়বিচারের দিকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পান।
লক্ষণীয় যে, ‘কিতাবুল ইক্বতিছাদ’-এ তাঁর আলোচ্য বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইমামত ও খিলাফত। ‘এহইয়াউ উলূম’ এবং ‘মুস্তাযহিরী’তে তিনি খলীফা ও সুলতানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা কামনা করেন। বিশেষতঃ সেলজুক সুলতানদের দ্বারা খিলাফতের প্রতিষ্ঠানকে মুসলিম সমাজের একতার প্রতীক স্বরূপ একটি সাংবিধানিক কেন্দ্রবিন্দুতে রূপায়িত করার প্রচেষ্টার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং সবার দৃষ্টি ইমামতের প্রতীকী প্রতিষ্ঠান থেকে, ইমাম বা খলীফার নিরাপত্তা বিধানকারী ক্ষমতাধর সুলতানের প্রতি ফিরাতে ও নিবদ্ধ করতে তিনি চেষ্টিত হন। আর ‘আত-তিবরুল মাসবূক’-এ তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সুলতান থেকে ‘মুলক’ বা রাজত্বে অর্থাৎ বাদশাহীতে পরিবর্তিত করেন। প্রণিধানযোগ্য যে, সুলতান মৌল অর্থে প্রাপ্ত ক্ষমতা, তথা আল্লাহর নিকট থেকে রাসূল কর্তৃক প্রাপ্ত এবং রাসূলের নিকট থেকে খলীফা কর্তৃক প্রাপ্ত ও খলীফার নিকট থেকে প্রশাসক বা শাসনকর্তা কর্তৃক প্রাপ্ত।
তাই এতে স্তরে স্তরে শাসনকার্য পরিচালনার শর্তাবলী থাকে। কিন্তু মুলক বা রাজ্যের বেলায় তথা বাদশাহীতে উক্ত শর্তাবলীর ইঙ্গিত নেই। রাজার বা বাদশার ক্ষমতা মৌলিক বলে মনে করা হয়।
তাঁর রাষ্ট্র দর্শন :
ইমাম গাযালী তার ‘ইক্বতিছাদ’-এ বলেন, ইমামত, তথা মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব, শরী‘আতের আওতাধীন বা নিছক অভিজ্ঞতালব্ধ বুদ্ধিগত ব্যাপার (মুহিম্মাত) অথবা যুক্তি ও অধিবিদ্যা ভিত্তিক। চিন্তা-ভাবনার ফলশ্রুতি থেকে স্বতন্ত্র।
অতএব গ্রীক দর্শনের আদলে ইমামতের স্বরূপ ও প্রকৃতি পরীক্ষা করার কোন অধিকার বা অবকাশ দার্শনিকদের নেই। কেননা ইমামত বা মুসলিম সমাজের ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব যুক্তির চিন্তালব্ধ নয়; বরং নবুঅতের ঐতিহ্য সূত্রে প্রাপ্ত ও শরী‘আতের অনুশাসন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
কিতাবুল মুসতাযহিরীতে তিনি একথার পুনরাবৃত্তি করে বাতেনী ও দার্শনিকদের এ দাবী যে, ইমামত একটি যুক্তিগত ভাবে অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, তথা যুক্তিলব্ধ প্রতিষ্ঠান। কেননা তাদের মতে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতই মুসলিম সমাজ যুক্তিগতভাবে নেতৃত্ব বা ইমামতের বাধ্য করার শক্তি সম্পন্ন নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠান ছাড়া শান্তিতে বসবাস করতে পারে না... এ ধারণাটি খন্ডন করেন।
ইমামত শরী‘আতের আওতাভুক্ত হওয়ার ধারণায় তিনি ইমাম মাওয়ার্দীর সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন। উভয়েই উল্লেখ করেন যে, ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর প্রথম যুগের মুসলমানরা হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে এমনকি নবী করীম (ﷺ)-এর মৃতদেহ দাফন করার পূর্বেই নেতা নির্বাচিত করেন। আর তখন থেকে ইজমা ভিত্তিক মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যমত চলে আসছে যে, সরকারী কর্মকান্ড ও বিচার-আচারের প্রক্রিয়ার বৈধতা একজন সর্বজন স্বীকৃত ইমামের নিকট থেকে উৎসারিত হ’তে হবে।
কিতাবুল মুসতাযহিরীতে ইমাম গাযালী বলেন, ‘মুসলিম সমাজের বা উম্মাহর নেতৃত্বের জন্য ইমামতের প্রয়োজন। কেননা এটা সুবিধাজনক ও কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান, যা এ দুনিয়ার জীবনে ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বরং এটা মুসলমানদের জীবনে একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। কারণ এটা উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রবর্তিত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থা কায়েম ও চালু রাখার জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করার অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দেয়’।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য যে, উম্মতের ইজমা বা ঐক্যমত, যা ইসলামে আইন-কানূনের একটি উৎস, তা একজন সর্বসাকুল্যে মান্যবর ইমামের নেতৃত্বে ছাড়া ইসলাম ধর্মকে ও এর কল্যাণকর জীবন ব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়’।
আদতে ধর্মের কল্যাণকর ব্যবস্থার সংরক্ষণ একমাত্র দুনিয়ার কল্যাণকর ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব, যা এমন একজন ইমাম বা নেতার ইমামতের, তথা এমন নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল, যাকে সবাই মান্য করে’।
তিনি একজন প্রখ্যাত গণিতবিদ ছিলেন এবং গাণিতিক যুক্তিতে অতুলনীয় দক্ষ ছিলেন, যা তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাহাফুত আল-ফালাসিফা’তে প্রতিভাত হয়। তিনি যুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি সূত্রায়ন করে বলেন, ‘ধর্ম হ’ল ভিত্তি এবং ক্ষমতা হ’ল অভিভাবক’। তাঁর কথায় ‘দ্বীন হ’ল ভিত্তি এবং সুলতান হ’লেন অভিভাবক’। এ সূত্রে তিনি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দ্বীন ও সুলতান জমজ’ তথা ধর্ম ও রাজনীতি জমজ। অর্থাৎ উভয়ই ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। উভয়ে একও নয়, ভিন্নও নয়। অন্য কথায়, ধর্ম ও রাজনীতি একই উৎস মূলে দু’টি সত্তা। কেননা ধর্মের মৌল বাহন হ’ল ইবাদত, যা তাক্বওয়ার উপর চলে এবং রাজনীতির মৌল বাহন হ’ল হিকমত, যা কৌশলের উপর চলে। ইবাদত কৌশলের ভিত্তিতে করা যায় না এবং রাজনীতি বা সিয়াসাত তাক্বওয়ার ভিত্তিতে অচল। কিন্তু উভয়ই সৎ উদ্দেশ্যের (মাওয়েযাতুল হাসানার) ভিত্তিতে পরিচালিত হ’তে হবে। তাই উভয়েরই উৎস এক তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
সুতরাং ইমাম গাযালীর প্রথম কথা হ’ল : মুসলিম উম্মাহর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইমামত অপরিহার্য এবং ইমাম নির্বাচন করা প্রত্যেক মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য। এই নির্বাচনকার্য একটি সম্মিলিত কর্তব্য বা ফরযে কিফায়াহ। যা ‘আহলুল হাল্লে ওয়াল-আক্দ’ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে জনসাধারণের বায়‘আত গ্রহণ করার মাধ্যমে, ইজমার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। তিনি এ ব্যাপারে ইমাম মাওয়ার্দীর সাথে একমত।
তাঁর দ্বিতীয় কথা হ’ল, ইমামত যেহেতু রাসূল (ﷺ)-এর খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ ‘খিলাফত নবুঅতের প্রতিনিধিত্ব হওয়ার কারণে খলীফার কতগুলি বিশেষ গুণের প্রয়োজন, যাতে তিনি তাঁর ক্ষমতাধীন জনসাধারণকে শরী‘আতের নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে তিনি নীতিগতভাবে ইমাম মাওয়ার্দীকে অনুসরণ করেন। কেবল তার যুগের চাহিদা পূরণ করার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে ইমামতের শর্তগুলি কিয়ৎ পরিমাণ শিথিল করেন মাত্র।
স্মর্তব্য যে, ৭৮৭ হিঃ/১০৯৪ খৃঃ আল-মুসতাযহির খেলাফতে আসীন হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। বাতেনীরা তাঁর নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বসে। এতদসত্ত্বেও ইমাম গাযালী তাঁকে বৈধ ইমাম বলে মতামত প্রদান করেন। কেননা তাঁর মতে, প্রকারান্তরে তিনি প্রয়োজনীয় সব গুণাগুণের অধিকারী ছিলেন। বিশেষতঃ মহা ক্ষমতাধর, কার্যকর সামরিক শক্তির অধিকারী, সেলজুক সুলতানের সমর্থন পুষ্ট হওয়ায় তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বীকৃতি লাভ করেন।
ইমাম মাওয়ার্দীর মতে, জনগণের বায়‘আত গ্রহণ করার মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি নিহিত আছে, যদ্বারা জনগণের প্রতি কতেক কর্তব্য সমাধা করার দায়িত্ব খলীফার উপর বর্তায় এবং অপর পক্ষে তাঁকে মান্য করার দায়িত্ব জনগণের উপর বর্তায়। ইমাম মাওয়ার্দী এ চুক্তিগত কর্তব্য সমাধা করার জন্য খলীফার মধ্যে সাতটি গুণ থাকার শর্ত আরোপ করেন, যেগুলি (১) ন্যায়বিচার (২) শরী‘আতের জ্ঞান (৩) দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তির সুস্থতা (৪) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতা (৫) কিফায়া অর্থাৎ প্রশাসনিক দক্ষতা (৬) জিহাদ বা যুদ্ধের উপযুক্ত সাহসিকতা ও সামর্থ্য (৭) কুরাইশ বংশীয় হওয়া। তদুপরি ইমাম মাওয়ার্দী খলীফার দশটি কর্তব্য নির্দেশ করেন। যথা- (১) ধর্মকে সমুচ্চ রাখা (২) শরী‘আতের রায় কার্যকরী করা (৩) মুসলিম সমাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করা (৪) কুরআনের দন্ডবিধি প্রয়োগ করা (৫) সীমান্ত রক্ষা করা (৬) ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করা (৭) বৈধ জিযিয়া, ফায় ও যাকাত সংগ্রহ করা (৮) কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ করা (৯) উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য লোককে কর্মকর্তা নিযুক্ত করা এবং (১০) সরকারী ও ধর্মীয় কার্যাদি ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করা।
কিতাব আল-মুসতাযহিরীতে ইমাম গাযালী অনুরূপ কতেক গুণাগুণ ও শর্তাবলীর অবতারণা করেন। তন্মধ্যে ছয়টি দৈহিক ও চারটি নৈতিক, যথা- (১) বয়োপ্রাপ্তি (২) সুস্থ মস্তিষ্ক (৩) স্বাধীনতা (৪) পুরুষ হওয়া (৫) কুরায়শী হওয়া (৬) সুস্থ দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন হওয়া এবং (১) সাহসিকতা (২) প্রশাসনিক দক্ষতা (৩) আল্লাহভীরুতা (৪) শরী‘আতের জ্ঞান।
তবুও আল-মুসতাযহিরের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও সেলজুকদের মোকাবিলায় দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ইমাম গাযালী জোর দিয়ে তাঁকে প্রকারান্তরে সবগুণের অধিকারী বলে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, প্রথমতঃ তাঁর কুরাইশী বংশ সঠিক, পক্ষান্তরে মিসরের ফাতেমী খলীফাদের কুরাইশী বংশ তালিকা মেকী।
দ্বিতীয়তঃ সাহসিকতা ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে, তিনি বলেন, সেলজুক সুলতানের আনুগত্য ও সামরিক শক্তির সহায়তা এবং খলীফার প্রতি সমর্থন এর জন্য যথেষ্ট। এমনকি কখনো কখনো খলীফার প্রতি তাদের অবাধ্যতা প্রদর্শন বা তাদের অধিকারের সীমালংঘন ঘটে থাকলেও খলীফার প্রতি তাদের আনুগত্য অবিচল। কেননা তারা খলীফাকে রক্ষা করা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিশ্বাস করেন। ইতিপূর্বে খলীফা কখনো এরূপ একটি সহায়ক শক্তি নিজেদের সান্নিধ্যে পাননি।
তৃতীয়তঃ প্রশাসনিক দক্ষতার ব্যাপারে তিনি বলেন, খলীফা মুসতাযহির বিচক্ষণতা ও দৃঢ় চিত্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং তাঁর মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের পরামর্শ গ্রহণ করার সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছেন।
চতুর্থতঃ আল্লাহভীরুতা বা ধর্মভীরুতার ব্যাপারে আন্তরিকতা যা মানুষের সর্বোচ্চ গুণ বলে পরিগণিত হয়, তা আল-মুসতাযহিরের মধ্যে সততই বিদ্যমান। তিনি পুণ্যময় রীতিনীতি ও কৃচ্ছতা সহকারে ব্যক্তিগত জীবন যাপন করেন এবং সক্রিয়ভাবে ইসলামী কর্তব্য ও অনুষ্ঠানাদি পালন করেন। তিনি সরকারী তহবিল, একমাত্র অনুমোদিত সরকারী ও ধর্মীয় খাতে ব্যয় করেন। তিনি বলেন, যদিও তাঁকে দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে বলা যায় না, যেমন বাতেনী সম্প্রদায় তাদের ইমামের নিকট প্রত্যাশা করে, যেরূপ প্রত্যাশা করা অবশ্যই মানব প্রকৃতির বিপরীত হবে। এমনকি বিজ্ঞ লোকেরা দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নবীদের পক্ষেও কি পরিমাণ সম্ভব তা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন।
পঞ্চমতঃ জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার ব্যাপারে ইমাম গাযালী ‘মুজতাহিদ’ হওয়ার জন্য অতি উচ্চ ধর্মীয় জ্ঞান ও ফিক্বহ বিদ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। বরং ইমামতের জন্য ফৎওয়া বা ফিক্বহ সম্মত রায় প্রদান করার যোগ্যতাই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করেন।
তিনি স্বীকার করেন যে, আল-মুসতাযহির একজন যুবক মাত্র এবং মুজতাহিদ-এর যোগ্যতা সম্পন্ন নন। কিন্তু তিনি প্রশ্ন করেন, কুরাইশ বংশীয় অনুরূপ মর্যাদা সম্পন্ন অন্য কোন প্রার্থী তাঁর মত আছে কি? অতএব আল-মুসতাযহির এর ইমামতের বৈধতা একদিকে জনগণের স্বীকার করে নেয়া উচিত এবং অন্যদিকে তাঁর পক্ষে সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়ে সর্বাধিক বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করা বিধেয়। যাতে তাঁর ধর্মীয় ও ফিক্বহ সম্পর্কীয় জ্ঞানের পরিসর বর্ধিত হয়।
ষষ্ঠতঃ ইমাম গাযালী, আল-মাওয়ার্দীর মত খলীফার করণীয় কর্তব্যাদির ফিরিস্তি প্রদান করেননি। আর এরূপ কর্তব্য পালনে মুসলিম সমাজের প্রতি খলীফার চুক্তিগত কর্তব্যের কথাও উল্লেখ করেননি। স্পষ্টতঃ ইমাম গাযালী খলীফার পদটিকে মুসলিম সমাজের একমাত্র প্রতীক হিসাবে গণ্য করেন এবং তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান করেন।
অতএব ইমাম গাযালীর যুক্তি তর্কে, ড. ব্যাগলীর (Bagley) মতে, খলীফার পক্ষে সামরিক বা প্রশাসনিক অথবা ধর্মীয় ব্যাপারে কোন প্রকার ক্ষমতাধর সরকারী কার্য নির্বাহ করার প্রত্যাশা তিনি করেন না। কারণ সাংবিধানিক উপায়ে তুর্কী সেলজূকরা, ক্ষমতাধর ওয়াযীরেরা, সচিবেরা এবং আলেমরা এসব প্রশাসনিক কর্ম নিষ্পন্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
সপ্তমতঃ ‘আত-তিবরুল মাসবূক’ বা নছীহাতুল মুলূক (রাজা-বাদশাদের প্রতি উপদেশ) গ্রন্থে ইমাম গাযালী সুলতান-এর উপর প্রাচীন ইরানী শাহদের ও বিগত যুগের খলীফাদের সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করেন এবং সুলতানকে উপদেশ দেন যেন তিনি ঐসব পূর্বসূরীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সমাজে কল্যাণকর ন্যায়নিষ্ঠ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এতদসঙ্গে তিনি সামরিক ক্ষমতাধারী, প্রশাসক ও আলেমদেরকে বৈধ খলীফার প্রতি আনুগত্য পোষণ করার ও সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ইসলামের খাতিরে একযোগে কাজ করার উপদেশ দেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ইমাম মাওয়ার্দীর মত সমসাময়িক খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে তিনি সুলতানকে আত-তিবরুল মসবূকে একটি কথাও বলেননি। অবশ্য কিতাব আল-মুসতাযহিরীতে তিনি খলীফাকে ‘শওকতের’ অধিকারী অর্থাৎ শক্তিধর সুলতানের নিকট এ শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে উপদেশ দেন যে, এর প্রতিদানে ক্ষমতা গ্রহণকারী সুলতান যেন তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। কেননা শাসন -প্রশাসনের চূড়ান্ত ক্ষমতা খলীফার হাতে ন্যস্ত, যিনি ‘আহলুল হাল্লে ওয়াল আক্দ’ এর সমর্থন ও আনুগত্যের দাবীদার।
তিনি খলীফাকে ফিক্বহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করার উপদেশ দেন। কেননা তিনি শরী‘আত অনুযায়ী জীবন-যাপন করলে ও শরী‘আত অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করলেই কেবল জনগণের আনুগত্য লাভ করতে পারেন।
তিনি পূর্ববর্তী ধর্মীয় শিক্ষক ও ইমামদের প্রদত্ত শাসকদের প্রতি উপদেশাবলীর প্রতি মনোযোগ প্রদান করার জন্যও খলীফাকে উপদেশ দেন।
বাস্তবতার উচ্চ স্তরে ইমাম গাযালী সুলতান কর্তৃক খলীফা মনোনয়ন করার সমসাময়িক প্রথার বৈধতা স্বীকার করেন।
‘এহইয়াউ উলূম’-এ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আববাসীয় খলীফাগণ ইমামতের চুক্তি মূলে বৈধ পদাধিকারী এবং এর সমগামী দায়িত্বের বাহক। কিন্তু সরকারের কাজকর্ম সুলতান কর্তৃক পরিচালিত, যিনি খলীফার প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন। কেননা সরকার হ’ল ওঁদের হাতে যাঁরা সামরিক শক্তির সমর্থনপুষ্ট এবং খলীফা হ’লেন যিনি ক্ষমতাধরের আনুগত্য লাভ করে থাকেন।
যে যাবত খলীফার ক্ষমতা সরকার স্বীকার করে নেয়, সে যাবত সরকার বৈধ। অন্যথায় সরকার যদি গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা অবৈধ, অরাজকতা সম্পন্ন ও আইন বহির্ভূত।
রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। সে কারণ তিনি এমনকি কোন স্বৈরতন্ত্রী সুলতানকেও ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতি খলীফা কিংবা জনগণকে উৎসাহ দিতে নারাজ ছিলেন।
বাস্তবে সুলতান হ’ল সার্বিক নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ সর্ব বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী, যিনি খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী এবং খলীফার বিশেষ ক্ষমতাবলীর অনুমোদনকারী, যিনি খলীফার নাম খুতবায় ঘোষণা করার ব্যবস্থা করেন ও টাকা-পয়সায় খচিত করেন। তিনি যেসব অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন, তাঁর আদেশ ও বিচার সেসব স্থানে যথার্থই বৈধ।
অতএব ইমাম মাওয়ার্দীর যুগে যে ক্ষমতাধারী আমীরকে, আমীরে ইস্তীলা উপাধি দিয়ে বৈধ করা হয়েছিল, ইমাম গাযালীর যুগে তাঁকে সুলতান উপাধি দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা বলে স্বীকৃতি দান করা হয়।
[প্রবন্ধটি ৭.২.১৯৯৩ তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ (আইবিএস)-এর সেমিনারে পঠিত।]
[1]. শী‘আরা প্রধানতঃ দু’টি শাখায় বিভক্ত। একটি শাখা ১২ ইমামে (اثنا عشرية) এবং অপরটি ৭ ইমামে (السبعية) বিশ্বাসী। সাত ইমামী শী‘আদের ৭ম ইমাম হ’লেন ৬ষ্ঠ ইমাম জা‘ফর ছাদিকের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল। তাঁর নামানুসারে এরা ইসমাঈলী শী‘আ (اسماعيلية) নামে পরিচিত। এরা ইছনা আশারিয়াহ বা ১২ ইমামে বিশ্বাসীদের ৭ম ইমাম মূসা আল-কাযিমকে স্বীকার করেন না। তারা মনে করেন, ইসমাঈলের পুত্র মুহাম্মাদ অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তিনিই হলেন তাদের প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী। এরা আল্লাহর একত্ববাদ, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাত এবং কুরআন মাজীদে বিশ্বাস করেন। তবে তারা মনে করেন, কুরআন মাজীদের অপ্রকাশ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। এজন্য এদেরকে ‘বাতেনী’ নামেও অভিহিত করা হয়। ইসমাঈলের পুত্র মুহাম্মাদের গায়েব হয়ে যাওয়ায় যারা বিশ্বাস করেন তারা ‘কারামতী’ (القرامطة) নামে এবং যারা তার মৃত্যুতে বিশ্বাস করেন ও তার বংশের সাথে ইমামত সম্পৃক্ত মনে করেন তারা ‘ফাতেমী’ (الفاطمية) বলে পরিচিত। ভারতবর্ষের খাজা ও আগা খানী শী‘আরা ইসমাঈলীদের দলভুক্ত (ইহসান ইলাহী যহীর রচিত ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ বই দ্র.)। -গবেষণা বিভাগ, হাফাবা।]
আরো পরিষ্কার কথায়, আল্লামা শিবলী নো‘মানী ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও জান-মালের হেফাযতের জন্য দু’টি ব্যবস্থার প্রয়োজন। যথা- পারস্পরিক সাহায্য ও সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পারস্পরিক সাহায্য-সহায়তার মাধ্যমেই মানুষ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়। প্রতিরক্ষা বা প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ জান-মাল ও সন্তান-সন্ততির হেফাযত করে এবং বিপদাপদ থেকে রক্ষা পায়। অতএব পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা কল্পে ইমাম গাযালীর মতে একটি সংবিধান থাকা বাঞ্ছনীয়’।
তবে গাযালীর মতে, স্পষ্টতঃ যে কোন মানুষ বা ব্যক্তি এরূপ কার্যকর সংবিধান উদ্ভাবন বা রচনা করতে সক্ষম হয় না। বিশেষতঃ গোটা মানব জাতির অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাবার উপযুক্ত একটি সংবিধান কেবলমাত্র এমন লোকেই রচনা করতে পারে, যিনি আল্লাহর নিকট থেকে অহীর ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং যিনি আধ্যাত্মিক জগত থেকে সাহায্য গ্রহণ করতে পারঙ্গম ও যাঁর হাতে বিশ্ব শৃংখলার ডোর ন্যস্ত রয়েছে’। অধিকন্তু অহীর ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি ধর্মের রহস্যাদি সম্পর্কে অবহিত থাকেন। এরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি প্রতিটি কাজে ন্যায়-নীতির অনুসরণ করেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ জ্ঞানের মাত্রা অনুসারে সম্বোধন করে থাকেন। মানুষের কর্মক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জনগণের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। এরূপ বৈশিষ্ট্য নবী-রাসূলের হয়ে থাকে’।
ইমাম গাযালী নবী-রাসূলকে মানব জাতির সঠিক পথ প্রদর্শক রূপে বিবেচনা করেন। মানুষের জীবন সংগ্রামে সঠিক পথ প্রদর্শনকেই তিনি রাজনীতি তথা ইমামত বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি ‘মাক্বাছিদুল ফালাসিফা’ গ্রন্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেণী বিভাগ বিন্যাস করে বলেন, মানব জীবনের সহায়ক তিনটি প্রায়োগিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটি হ’ল রাজনীতি। এ তিনটি বিজ্ঞানকে তিনি এভাবে বিন্যাস করেন, যথা-
‘রাজনীতি, অর্থনীতি ও নীতি শাস্ত্র’।
এ তিনটি বিজ্ঞান পরস্পরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বিজড়িত। অর্থনীতি মানুষের প্রাণীসূলভ চিন্তার সাথে জড়িত। এর সাহায্যে মানুষ মস্তিষ্ক খাটিয়ে বস্ত্তগত লাভ-ক্ষতি চিন্তা করে। নীতি শাস্ত্র আত্মা, বিবেক ও অন্তরের সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে মানুষ ভাল-মন্দ বিচার করে এবং এর নৈতিক পরিণতি সম্বন্ধে ভাবে। আর রাজনীতি কোন বস্ত্ত বা পন্থা সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনার পর তা আহরণ বা বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উপায় উদ্ভাবন নিয়ে ব্যাপৃত থাকে। অধিকন্তু রাজনীতির প্রাথমিক গুরুত্বের কারণ, রাজনীতি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হ’লে, অর্থনীতি ও নীতি শাস্ত্র অচল হয়ে পড়ে এবং ধর্ম-কর্ম ও সমাজ জীবন বাধাগ্রস্ত হয়।
পক্ষান্তরে ইবনে সীনা, তার ‘আকসামুল উলূম’ (জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেণী বিভাগ) গ্রন্থে এ ত্রি-বিজ্ঞানকে ‘নীতি শাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি বিজ্ঞান’ রূপে শ্রেণী ভাগ করেন, যা এ্যরিষ্টটলের বিভক্তির অনুরূপ।
এ ব্যাপারে উভয়ের উপর এ্যরিষ্টটলের প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু এ্যরিষ্টটলের নিছক ইহ জাগতিক ভাবধারাকে সংশোধন করে আল-ফারাবী মানুষের জীবনের আদর্শকে ইহ ও পর জাগতিক বা উভয় জগতের সুখ অর্জনের লক্ষ্য রূপে স্থির করেছিলেন। ইমাম গাযালী, আল-ফারাবীর সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘রাজনীতি ত্রয়ী প্রায়োগিক বিজ্ঞানের প্রথম বিজ্ঞান হিসাবে ইহজগতে মানুষের কল্যাণ ও পরজগতে সুখ অর্জন করার লক্ষ্যে নিয়োজিত হয় এবং তা অর্জন করা সম্ভবপর হয় যখন সরকার শরী‘আতের শাস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ও রাজনীতি শাস্ত্রের দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে।
তাঁর ‘কিতাবুল ইক্বতিছাদ ফিল ই‘তিক্বাদ’ গ্রন্থে তিনি মুসলিম সমাজের চত্বরে রাজনীতির ভূমিকা সম্বন্ধে আলোচনা করেন এবং ইসলামের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকে নেতৃত্বের সাথে সম্পৃক্ত করেন। এতে তিনি ইমাম মাওয়ার্দীর মতই নেতৃত্ব বা ‘ইমামত’কে ‘খিলাফত’ রূপে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ‘ইমামত শরী‘আতের অঙ্গ, যা সাধারণ ব্যবহারিক বিষয়বস্ত্ত (মুহিম্মাত) থেকে স্বতন্ত্র এবং নিছক পদার্থ-অতীত অধিবিদ্যা সম্মত চিন্তার আওতাভুক্ত নয়। অতএব গ্রীকদের রাজনীতি চিন্তার আলোকে ইমামতের বিষয়াদি পরীক্ষা করার কোন অধিকার দার্শনিকদের নেই।
তিনি বলেন, ‘এটি নিছক যুক্তিলব্ধ (জ্ঞানপ্রসূত) নয়; বরং শরী‘আতসম্মত চিন্তার ফসল’। তাই তিনি তাঁর অনন্য গ্রন্থ ‘মাক্বাছিদুল ফালাসিফা’-তে বলেন, রাজনীতি ত্রয়ী প্রায়োগিক (সমাজ) বিজ্ঞানের প্রথম বিজ্ঞান রূপে ‘দুনিয়াতে মানুষের কল্যাণ সাধন ও পরকালে সুখ অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত, যা সরকারকে শরী‘আতের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান দ্বারা পূর্ণতা লাভের প্রচেষ্টার দ্বারা লাভ করা যায়’।
ইমাম গাযালীর শ্রেষ্ঠ অবদান এহইয়াউ উলূমিদ্দীন অর্থাৎ ধর্মীয় বিজ্ঞানাদির পুনরুজ্জীবন গ্রন্থে ধর্মকে প্রাণবন্ত ও সমাজকে সচল করতে গিয়ে তিনি সমাজে শৃংখলা রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার তাকীদে রাজনীতিকে বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পান। রোজেনথালের মতে, এক্ষেত্রে তাঁর ইমামত সম্পর্কীয় দৃষ্টিভঙ্গী অভিজ্ঞতাপ্রসূত বাস্তবতায় পর্যবসিত। তিনি যে সময়ে লিখেছিলেন, তখন বাগদাদে আববাসীয় খলীফা ছিলেন অল্প বয়স্ক আল-মুসতাযহির বিল্লাহ। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এ অবস্থায় তিনি খলীফাকে নিজস্ব খেয়াল খুশীমত শাসনকার্য পরিচালনা না করে আলেমদের সাথে পরামর্শ করে শাসনকার্য পরিচালনা করার উপদেশ দেন এবং এর ভিত্তিতে রাজনীতির বাস্তবতা স্বীকার করে অনুপেক্ষণীয় প্রয়োজনের খাতিরে খলীফার গুণাবলীর শর্তের ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা অবলম্বন করার উদ্যোগ নেন।
অবশেষে খলীফা মুসতাযহির-এর উপদেশের উদ্দেশ্যে রচিত তাঁর রাজনীতির গ্রন্থ ‘কিতাবুল-মুসতাযহিরী’তে তিনি ইমাম মাওয়ার্দী কর্তৃক প্রদত্ত ইমামত বা খিলাফতের শর্তাবলীতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী উপস্থাপন করেন।
প্রথমতঃ তিনি বলেন, এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, প্রশাসনিক দক্ষতা ব্যতিরেকে খিলাফত চলে না, কিন্তু খলীফা যদি নিজ হস্তে প্রশাসন নির্বাহ না করে কোন দক্ষ প্রশাসককে মন্ত্রী নিযুক্ত করে তাঁর হাতে প্রশাসনের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, তবে খলীফার নিজের প্রশাসনিক দক্ষতার পরিবর্তে মন্ত্রীর দক্ষতাই যথেষ্ট। এরূপ অবস্থায় খলীফার যোগ্যতাসম্পন্ন হ’তে প্রশাসনিক দক্ষতার শর্ত শিথিল করা যায়।
দ্বিতীয়তঃ অনুরূপভাবে খলীফা যদি জ্ঞানী নাও হন, কিন্তু শরী‘আতের হুকুম-আহকাম চালু করার ব্যাপারে যদি আলেমদের পরামর্শক্রমে সমস্ত কর্ম সমাধা করেন, তাতে তাঁর জ্ঞানী হওয়ার শর্ত আলেমদের জ্ঞানের দ্বারা পূর্ণ হবে। অতএব এমতাবস্থায় খলীফার যোগ্যতার ব্যাপারে জ্ঞানী হওয়ার শর্ত শিথিল করা যায়।
তৃতীয়তঃ যখন খলীফার শাসনকার্য, প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পন্ন ওয়াযীরের দ্বারা সমাধা হয় এবং শরী‘আতের হুকুম-আহকাম ও বিচারকার্য চালু করার কাজ শরী‘আতের জ্ঞানে সুদক্ষ আলেমদের দ্বারা নির্বাহ হয়, সে অবস্থায় খলীফার যোগ্যতার ব্যাপারে প্রাপ্ত বয়সের বাধ্য বাধকতার শর্ত শিথিল করা যায়।
এরূপ শর্ত-শিথিলতার পক্ষ অবলম্বন করার বিশেষ কারণ ছিল ইমাম গাযালীর সময়কালে যখন অল্প বয়ষ্ক ও দুর্বল মুসতাযহির বাগদাদে খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন একদিকে সেলজুক সুলতানেরা মহা পরাক্রমশালী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, যারা সুন্নী মতাবলম্বী ছিলেন এবং বাগদাদের আববাসীয় সুন্নী খিলাফতের সংরক্ষণের জন্য তৎপর ছিলেন। তাঁদের ছত্রছায়ায় মুসতাযহির নাম মাত্র খলীফার আসন অলংকৃত করছিলেন।
আর অন্যদিকে সাত ইমামী[1] শী‘আ মতাবলম্বী বাতেনী সম্প্রদায়, যারা বাগদাদের খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী কায়রোর সাত ইমামী শী‘আ মতাবলম্বী ফাতেমী খলীফাদের ভক্ত ছিল এবং সে সুবাদে আববাসীয় খিলাফতের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বসেছিল, এ অবস্থায় সেলজুক সুলতান মালিক শাহের অনুরোধে ইমাম গাযালী বাতেনীদের মতবাদ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাতেনীদের মতবাদ খন্ডন করে একটি পুস্তক রচনা করেন এবং তাঁর ‘কিতাবুল ইক্বতিছাদ ফিল-ই‘তিক্বাদ’ এ তিনি খলীফা ও সুলতানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার উপর জোর দেন।
লিউনার্ড বাইনার বলেন, ইমাম গাযালীর রাজনীতি চিন্তায় সুলতানের ক্ষমতার ভূমিকার অবতারণা করার কারণ হ’ল, যদিও ইমামত প্রতিষ্ঠার জন্য শরী‘আত অনুসারে ইজমা-ই যথেষ্ট, তবুও মান্যবর ইমাম অর্থাৎ যাঁকে লোকেরা স্বভাবতই মান্য করে বা মানতে বাধ্য হয় এমন ইমামের অবস্থিতি ছাড়া ইজমা কার্যকর হয় না। অতএব সুলতানের ক্ষমতার দাপট ও সমর্থন প্রয়োজন। তাই এহইয়াউ উলূমিদ্দীনের মধ্যেও তিনি সুলতানকে কার্যকরী শাসক হিসাবে গণ্য করেন।
অধিকন্তু ইমামের বৈধ ও অবৈধ কর্তৃত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ‘এহইয়া’-তে তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘আমীরে ইসতি‘লা’ বা সামরিক সরকার যদিও মূলতঃ ক্ষতিকর, তথাপি এদের সাথে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যাতে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা না দেয় ও সমাজকে গৃহ যুদ্ধে নিপাতিত না করে।
তিনি দৃঢ়ভাবে এমত পোষণ করেন যে, যেকোন মূল্যে সভ্য মানুষের পক্ষে গৃহযুদ্ধ ও অরাজকতা থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। কেননা এক দিনের অরাজকতা হাযার বছরের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে। অতএব তাঁর মতে, অরাজকতার ভয়াবহ পরিণতির চেয়ে স্বৈরাচারী শাসকের কিয়ৎ পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করা মন্দের ভাল হিসাবে শ্রেয়।
তাঁর শাসনকর্তাদের প্রতি উপদেশের গ্রন্থ ‘আত-তিবরুল মাসবূক’, যা জাহিয-এর কিতাবুত তাজ এবং নিযামুল-মুলক তূসীর ‘সিয়াসতনামা’র নমুনায় লিখিত, তাতে ইমাম গাযালী বাদশাহীত্ব বা রাজত্ব আল্লাহর দান ও ন্যায় বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রমাণ করেন এবং শত শত উপমা, উদাহরণ ও বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করে বাদশাদেরকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ন্যায়বিচারের দিকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পান।
লক্ষণীয় যে, ‘কিতাবুল ইক্বতিছাদ’-এ তাঁর আলোচ্য বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইমামত ও খিলাফত। ‘এহইয়াউ উলূম’ এবং ‘মুস্তাযহিরী’তে তিনি খলীফা ও সুলতানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা কামনা করেন। বিশেষতঃ সেলজুক সুলতানদের দ্বারা খিলাফতের প্রতিষ্ঠানকে মুসলিম সমাজের একতার প্রতীক স্বরূপ একটি সাংবিধানিক কেন্দ্রবিন্দুতে রূপায়িত করার প্রচেষ্টার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং সবার দৃষ্টি ইমামতের প্রতীকী প্রতিষ্ঠান থেকে, ইমাম বা খলীফার নিরাপত্তা বিধানকারী ক্ষমতাধর সুলতানের প্রতি ফিরাতে ও নিবদ্ধ করতে তিনি চেষ্টিত হন। আর ‘আত-তিবরুল মাসবূক’-এ তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সুলতান থেকে ‘মুলক’ বা রাজত্বে অর্থাৎ বাদশাহীতে পরিবর্তিত করেন। প্রণিধানযোগ্য যে, সুলতান মৌল অর্থে প্রাপ্ত ক্ষমতা, তথা আল্লাহর নিকট থেকে রাসূল কর্তৃক প্রাপ্ত এবং রাসূলের নিকট থেকে খলীফা কর্তৃক প্রাপ্ত ও খলীফার নিকট থেকে প্রশাসক বা শাসনকর্তা কর্তৃক প্রাপ্ত।
তাই এতে স্তরে স্তরে শাসনকার্য পরিচালনার শর্তাবলী থাকে। কিন্তু মুলক বা রাজ্যের বেলায় তথা বাদশাহীতে উক্ত শর্তাবলীর ইঙ্গিত নেই। রাজার বা বাদশার ক্ষমতা মৌলিক বলে মনে করা হয়।
তাঁর রাষ্ট্র দর্শন :
ইমাম গাযালী তার ‘ইক্বতিছাদ’-এ বলেন, ইমামত, তথা মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব, শরী‘আতের আওতাধীন বা নিছক অভিজ্ঞতালব্ধ বুদ্ধিগত ব্যাপার (মুহিম্মাত) অথবা যুক্তি ও অধিবিদ্যা ভিত্তিক। চিন্তা-ভাবনার ফলশ্রুতি থেকে স্বতন্ত্র।
অতএব গ্রীক দর্শনের আদলে ইমামতের স্বরূপ ও প্রকৃতি পরীক্ষা করার কোন অধিকার বা অবকাশ দার্শনিকদের নেই। কেননা ইমামত বা মুসলিম সমাজের ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব যুক্তির চিন্তালব্ধ নয়; বরং নবুঅতের ঐতিহ্য সূত্রে প্রাপ্ত ও শরী‘আতের অনুশাসন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
কিতাবুল মুসতাযহিরীতে তিনি একথার পুনরাবৃত্তি করে বাতেনী ও দার্শনিকদের এ দাবী যে, ইমামত একটি যুক্তিগত ভাবে অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, তথা যুক্তিলব্ধ প্রতিষ্ঠান। কেননা তাদের মতে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতই মুসলিম সমাজ যুক্তিগতভাবে নেতৃত্ব বা ইমামতের বাধ্য করার শক্তি সম্পন্ন নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠান ছাড়া শান্তিতে বসবাস করতে পারে না... এ ধারণাটি খন্ডন করেন।
ইমামত শরী‘আতের আওতাভুক্ত হওয়ার ধারণায় তিনি ইমাম মাওয়ার্দীর সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন। উভয়েই উল্লেখ করেন যে, ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর প্রথম যুগের মুসলমানরা হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে এমনকি নবী করীম (ﷺ)-এর মৃতদেহ দাফন করার পূর্বেই নেতা নির্বাচিত করেন। আর তখন থেকে ইজমা ভিত্তিক মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যমত চলে আসছে যে, সরকারী কর্মকান্ড ও বিচার-আচারের প্রক্রিয়ার বৈধতা একজন সর্বজন স্বীকৃত ইমামের নিকট থেকে উৎসারিত হ’তে হবে।
কিতাবুল মুসতাযহিরীতে ইমাম গাযালী বলেন, ‘মুসলিম সমাজের বা উম্মাহর নেতৃত্বের জন্য ইমামতের প্রয়োজন। কেননা এটা সুবিধাজনক ও কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান, যা এ দুনিয়ার জীবনে ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বরং এটা মুসলমানদের জীবনে একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। কারণ এটা উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রবর্তিত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থা কায়েম ও চালু রাখার জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করার অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দেয়’।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য যে, উম্মতের ইজমা বা ঐক্যমত, যা ইসলামে আইন-কানূনের একটি উৎস, তা একজন সর্বসাকুল্যে মান্যবর ইমামের নেতৃত্বে ছাড়া ইসলাম ধর্মকে ও এর কল্যাণকর জীবন ব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়’।
আদতে ধর্মের কল্যাণকর ব্যবস্থার সংরক্ষণ একমাত্র দুনিয়ার কল্যাণকর ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব, যা এমন একজন ইমাম বা নেতার ইমামতের, তথা এমন নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল, যাকে সবাই মান্য করে’।
তিনি একজন প্রখ্যাত গণিতবিদ ছিলেন এবং গাণিতিক যুক্তিতে অতুলনীয় দক্ষ ছিলেন, যা তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাহাফুত আল-ফালাসিফা’তে প্রতিভাত হয়। তিনি যুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি সূত্রায়ন করে বলেন, ‘ধর্ম হ’ল ভিত্তি এবং ক্ষমতা হ’ল অভিভাবক’। তাঁর কথায় ‘দ্বীন হ’ল ভিত্তি এবং সুলতান হ’লেন অভিভাবক’। এ সূত্রে তিনি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দ্বীন ও সুলতান জমজ’ তথা ধর্ম ও রাজনীতি জমজ। অর্থাৎ উভয়ই ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। উভয়ে একও নয়, ভিন্নও নয়। অন্য কথায়, ধর্ম ও রাজনীতি একই উৎস মূলে দু’টি সত্তা। কেননা ধর্মের মৌল বাহন হ’ল ইবাদত, যা তাক্বওয়ার উপর চলে এবং রাজনীতির মৌল বাহন হ’ল হিকমত, যা কৌশলের উপর চলে। ইবাদত কৌশলের ভিত্তিতে করা যায় না এবং রাজনীতি বা সিয়াসাত তাক্বওয়ার ভিত্তিতে অচল। কিন্তু উভয়ই সৎ উদ্দেশ্যের (মাওয়েযাতুল হাসানার) ভিত্তিতে পরিচালিত হ’তে হবে। তাই উভয়েরই উৎস এক তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
সুতরাং ইমাম গাযালীর প্রথম কথা হ’ল : মুসলিম উম্মাহর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইমামত অপরিহার্য এবং ইমাম নির্বাচন করা প্রত্যেক মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য। এই নির্বাচনকার্য একটি সম্মিলিত কর্তব্য বা ফরযে কিফায়াহ। যা ‘আহলুল হাল্লে ওয়াল-আক্দ’ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে জনসাধারণের বায়‘আত গ্রহণ করার মাধ্যমে, ইজমার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। তিনি এ ব্যাপারে ইমাম মাওয়ার্দীর সাথে একমত।
তাঁর দ্বিতীয় কথা হ’ল, ইমামত যেহেতু রাসূল (ﷺ)-এর খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ ‘খিলাফত নবুঅতের প্রতিনিধিত্ব হওয়ার কারণে খলীফার কতগুলি বিশেষ গুণের প্রয়োজন, যাতে তিনি তাঁর ক্ষমতাধীন জনসাধারণকে শরী‘আতের নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে তিনি নীতিগতভাবে ইমাম মাওয়ার্দীকে অনুসরণ করেন। কেবল তার যুগের চাহিদা পূরণ করার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে ইমামতের শর্তগুলি কিয়ৎ পরিমাণ শিথিল করেন মাত্র।
স্মর্তব্য যে, ৭৮৭ হিঃ/১০৯৪ খৃঃ আল-মুসতাযহির খেলাফতে আসীন হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। বাতেনীরা তাঁর নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বসে। এতদসত্ত্বেও ইমাম গাযালী তাঁকে বৈধ ইমাম বলে মতামত প্রদান করেন। কেননা তাঁর মতে, প্রকারান্তরে তিনি প্রয়োজনীয় সব গুণাগুণের অধিকারী ছিলেন। বিশেষতঃ মহা ক্ষমতাধর, কার্যকর সামরিক শক্তির অধিকারী, সেলজুক সুলতানের সমর্থন পুষ্ট হওয়ায় তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বীকৃতি লাভ করেন।
ইমাম মাওয়ার্দীর মতে, জনগণের বায়‘আত গ্রহণ করার মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি নিহিত আছে, যদ্বারা জনগণের প্রতি কতেক কর্তব্য সমাধা করার দায়িত্ব খলীফার উপর বর্তায় এবং অপর পক্ষে তাঁকে মান্য করার দায়িত্ব জনগণের উপর বর্তায়। ইমাম মাওয়ার্দী এ চুক্তিগত কর্তব্য সমাধা করার জন্য খলীফার মধ্যে সাতটি গুণ থাকার শর্ত আরোপ করেন, যেগুলি (১) ন্যায়বিচার (২) শরী‘আতের জ্ঞান (৩) দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তির সুস্থতা (৪) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতা (৫) কিফায়া অর্থাৎ প্রশাসনিক দক্ষতা (৬) জিহাদ বা যুদ্ধের উপযুক্ত সাহসিকতা ও সামর্থ্য (৭) কুরাইশ বংশীয় হওয়া। তদুপরি ইমাম মাওয়ার্দী খলীফার দশটি কর্তব্য নির্দেশ করেন। যথা- (১) ধর্মকে সমুচ্চ রাখা (২) শরী‘আতের রায় কার্যকরী করা (৩) মুসলিম সমাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করা (৪) কুরআনের দন্ডবিধি প্রয়োগ করা (৫) সীমান্ত রক্ষা করা (৬) ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করা (৭) বৈধ জিযিয়া, ফায় ও যাকাত সংগ্রহ করা (৮) কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ করা (৯) উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য লোককে কর্মকর্তা নিযুক্ত করা এবং (১০) সরকারী ও ধর্মীয় কার্যাদি ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করা।
কিতাব আল-মুসতাযহিরীতে ইমাম গাযালী অনুরূপ কতেক গুণাগুণ ও শর্তাবলীর অবতারণা করেন। তন্মধ্যে ছয়টি দৈহিক ও চারটি নৈতিক, যথা- (১) বয়োপ্রাপ্তি (২) সুস্থ মস্তিষ্ক (৩) স্বাধীনতা (৪) পুরুষ হওয়া (৫) কুরায়শী হওয়া (৬) সুস্থ দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন হওয়া এবং (১) সাহসিকতা (২) প্রশাসনিক দক্ষতা (৩) আল্লাহভীরুতা (৪) শরী‘আতের জ্ঞান।
তবুও আল-মুসতাযহিরের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও সেলজুকদের মোকাবিলায় দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ইমাম গাযালী জোর দিয়ে তাঁকে প্রকারান্তরে সবগুণের অধিকারী বলে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, প্রথমতঃ তাঁর কুরাইশী বংশ সঠিক, পক্ষান্তরে মিসরের ফাতেমী খলীফাদের কুরাইশী বংশ তালিকা মেকী।
দ্বিতীয়তঃ সাহসিকতা ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে, তিনি বলেন, সেলজুক সুলতানের আনুগত্য ও সামরিক শক্তির সহায়তা এবং খলীফার প্রতি সমর্থন এর জন্য যথেষ্ট। এমনকি কখনো কখনো খলীফার প্রতি তাদের অবাধ্যতা প্রদর্শন বা তাদের অধিকারের সীমালংঘন ঘটে থাকলেও খলীফার প্রতি তাদের আনুগত্য অবিচল। কেননা তারা খলীফাকে রক্ষা করা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিশ্বাস করেন। ইতিপূর্বে খলীফা কখনো এরূপ একটি সহায়ক শক্তি নিজেদের সান্নিধ্যে পাননি।
তৃতীয়তঃ প্রশাসনিক দক্ষতার ব্যাপারে তিনি বলেন, খলীফা মুসতাযহির বিচক্ষণতা ও দৃঢ় চিত্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং তাঁর মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের পরামর্শ গ্রহণ করার সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছেন।
চতুর্থতঃ আল্লাহভীরুতা বা ধর্মভীরুতার ব্যাপারে আন্তরিকতা যা মানুষের সর্বোচ্চ গুণ বলে পরিগণিত হয়, তা আল-মুসতাযহিরের মধ্যে সততই বিদ্যমান। তিনি পুণ্যময় রীতিনীতি ও কৃচ্ছতা সহকারে ব্যক্তিগত জীবন যাপন করেন এবং সক্রিয়ভাবে ইসলামী কর্তব্য ও অনুষ্ঠানাদি পালন করেন। তিনি সরকারী তহবিল, একমাত্র অনুমোদিত সরকারী ও ধর্মীয় খাতে ব্যয় করেন। তিনি বলেন, যদিও তাঁকে দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে বলা যায় না, যেমন বাতেনী সম্প্রদায় তাদের ইমামের নিকট প্রত্যাশা করে, যেরূপ প্রত্যাশা করা অবশ্যই মানব প্রকৃতির বিপরীত হবে। এমনকি বিজ্ঞ লোকেরা দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নবীদের পক্ষেও কি পরিমাণ সম্ভব তা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন।
পঞ্চমতঃ জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার ব্যাপারে ইমাম গাযালী ‘মুজতাহিদ’ হওয়ার জন্য অতি উচ্চ ধর্মীয় জ্ঞান ও ফিক্বহ বিদ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। বরং ইমামতের জন্য ফৎওয়া বা ফিক্বহ সম্মত রায় প্রদান করার যোগ্যতাই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করেন।
তিনি স্বীকার করেন যে, আল-মুসতাযহির একজন যুবক মাত্র এবং মুজতাহিদ-এর যোগ্যতা সম্পন্ন নন। কিন্তু তিনি প্রশ্ন করেন, কুরাইশ বংশীয় অনুরূপ মর্যাদা সম্পন্ন অন্য কোন প্রার্থী তাঁর মত আছে কি? অতএব আল-মুসতাযহির এর ইমামতের বৈধতা একদিকে জনগণের স্বীকার করে নেয়া উচিত এবং অন্যদিকে তাঁর পক্ষে সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়ে সর্বাধিক বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করা বিধেয়। যাতে তাঁর ধর্মীয় ও ফিক্বহ সম্পর্কীয় জ্ঞানের পরিসর বর্ধিত হয়।
ষষ্ঠতঃ ইমাম গাযালী, আল-মাওয়ার্দীর মত খলীফার করণীয় কর্তব্যাদির ফিরিস্তি প্রদান করেননি। আর এরূপ কর্তব্য পালনে মুসলিম সমাজের প্রতি খলীফার চুক্তিগত কর্তব্যের কথাও উল্লেখ করেননি। স্পষ্টতঃ ইমাম গাযালী খলীফার পদটিকে মুসলিম সমাজের একমাত্র প্রতীক হিসাবে গণ্য করেন এবং তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান করেন।
অতএব ইমাম গাযালীর যুক্তি তর্কে, ড. ব্যাগলীর (Bagley) মতে, খলীফার পক্ষে সামরিক বা প্রশাসনিক অথবা ধর্মীয় ব্যাপারে কোন প্রকার ক্ষমতাধর সরকারী কার্য নির্বাহ করার প্রত্যাশা তিনি করেন না। কারণ সাংবিধানিক উপায়ে তুর্কী সেলজূকরা, ক্ষমতাধর ওয়াযীরেরা, সচিবেরা এবং আলেমরা এসব প্রশাসনিক কর্ম নিষ্পন্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
সপ্তমতঃ ‘আত-তিবরুল মাসবূক’ বা নছীহাতুল মুলূক (রাজা-বাদশাদের প্রতি উপদেশ) গ্রন্থে ইমাম গাযালী সুলতান-এর উপর প্রাচীন ইরানী শাহদের ও বিগত যুগের খলীফাদের সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করেন এবং সুলতানকে উপদেশ দেন যেন তিনি ঐসব পূর্বসূরীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সমাজে কল্যাণকর ন্যায়নিষ্ঠ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এতদসঙ্গে তিনি সামরিক ক্ষমতাধারী, প্রশাসক ও আলেমদেরকে বৈধ খলীফার প্রতি আনুগত্য পোষণ করার ও সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ইসলামের খাতিরে একযোগে কাজ করার উপদেশ দেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ইমাম মাওয়ার্দীর মত সমসাময়িক খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে তিনি সুলতানকে আত-তিবরুল মসবূকে একটি কথাও বলেননি। অবশ্য কিতাব আল-মুসতাযহিরীতে তিনি খলীফাকে ‘শওকতের’ অধিকারী অর্থাৎ শক্তিধর সুলতানের নিকট এ শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে উপদেশ দেন যে, এর প্রতিদানে ক্ষমতা গ্রহণকারী সুলতান যেন তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। কেননা শাসন -প্রশাসনের চূড়ান্ত ক্ষমতা খলীফার হাতে ন্যস্ত, যিনি ‘আহলুল হাল্লে ওয়াল আক্দ’ এর সমর্থন ও আনুগত্যের দাবীদার।
তিনি খলীফাকে ফিক্বহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করার উপদেশ দেন। কেননা তিনি শরী‘আত অনুযায়ী জীবন-যাপন করলে ও শরী‘আত অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করলেই কেবল জনগণের আনুগত্য লাভ করতে পারেন।
তিনি পূর্ববর্তী ধর্মীয় শিক্ষক ও ইমামদের প্রদত্ত শাসকদের প্রতি উপদেশাবলীর প্রতি মনোযোগ প্রদান করার জন্যও খলীফাকে উপদেশ দেন।
বাস্তবতার উচ্চ স্তরে ইমাম গাযালী সুলতান কর্তৃক খলীফা মনোনয়ন করার সমসাময়িক প্রথার বৈধতা স্বীকার করেন।
‘এহইয়াউ উলূম’-এ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আববাসীয় খলীফাগণ ইমামতের চুক্তি মূলে বৈধ পদাধিকারী এবং এর সমগামী দায়িত্বের বাহক। কিন্তু সরকারের কাজকর্ম সুলতান কর্তৃক পরিচালিত, যিনি খলীফার প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন। কেননা সরকার হ’ল ওঁদের হাতে যাঁরা সামরিক শক্তির সমর্থনপুষ্ট এবং খলীফা হ’লেন যিনি ক্ষমতাধরের আনুগত্য লাভ করে থাকেন।
যে যাবত খলীফার ক্ষমতা সরকার স্বীকার করে নেয়, সে যাবত সরকার বৈধ। অন্যথায় সরকার যদি গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা অবৈধ, অরাজকতা সম্পন্ন ও আইন বহির্ভূত।
রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। সে কারণ তিনি এমনকি কোন স্বৈরতন্ত্রী সুলতানকেও ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতি খলীফা কিংবা জনগণকে উৎসাহ দিতে নারাজ ছিলেন।
বাস্তবে সুলতান হ’ল সার্বিক নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ সর্ব বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী, যিনি খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী এবং খলীফার বিশেষ ক্ষমতাবলীর অনুমোদনকারী, যিনি খলীফার নাম খুতবায় ঘোষণা করার ব্যবস্থা করেন ও টাকা-পয়সায় খচিত করেন। তিনি যেসব অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন, তাঁর আদেশ ও বিচার সেসব স্থানে যথার্থই বৈধ।
অতএব ইমাম মাওয়ার্দীর যুগে যে ক্ষমতাধারী আমীরকে, আমীরে ইস্তীলা উপাধি দিয়ে বৈধ করা হয়েছিল, ইমাম গাযালীর যুগে তাঁকে সুলতান উপাধি দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা বলে স্বীকৃতি দান করা হয়।
[প্রবন্ধটি ৭.২.১৯৯৩ তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ (আইবিএস)-এর সেমিনারে পঠিত।]
[1]. শী‘আরা প্রধানতঃ দু’টি শাখায় বিভক্ত। একটি শাখা ১২ ইমামে (اثنا عشرية) এবং অপরটি ৭ ইমামে (السبعية) বিশ্বাসী। সাত ইমামী শী‘আদের ৭ম ইমাম হ’লেন ৬ষ্ঠ ইমাম জা‘ফর ছাদিকের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল। তাঁর নামানুসারে এরা ইসমাঈলী শী‘আ (اسماعيلية) নামে পরিচিত। এরা ইছনা আশারিয়াহ বা ১২ ইমামে বিশ্বাসীদের ৭ম ইমাম মূসা আল-কাযিমকে স্বীকার করেন না। তারা মনে করেন, ইসমাঈলের পুত্র মুহাম্মাদ অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তিনিই হলেন তাদের প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী। এরা আল্লাহর একত্ববাদ, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাত এবং কুরআন মাজীদে বিশ্বাস করেন। তবে তারা মনে করেন, কুরআন মাজীদের অপ্রকাশ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। এজন্য এদেরকে ‘বাতেনী’ নামেও অভিহিত করা হয়। ইসমাঈলের পুত্র মুহাম্মাদের গায়েব হয়ে যাওয়ায় যারা বিশ্বাস করেন তারা ‘কারামতী’ (القرامطة) নামে এবং যারা তার মৃত্যুতে বিশ্বাস করেন ও তার বংশের সাথে ইমামত সম্পৃক্ত মনে করেন তারা ‘ফাতেমী’ (الفاطمية) বলে পরিচিত। ভারতবর্ষের খাজা ও আগা খানী শী‘আরা ইসমাঈলীদের দলভুক্ত (ইহসান ইলাহী যহীর রচিত ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ বই দ্র.)। -গবেষণা বিভাগ, হাফাবা।]
ডঃ মুঈনুদ্দীন আহমদ খান
Last edited: