ভূমিকা :
সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালনকারী। সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর, যিনি নবী ও রাসূলকুলের শ্রেষ্ঠ। সেই সঙ্গে সালাত ও সালাম তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের উপর।
অতঃপর আমাদের এই ‘তাওয়াক্কুল’ (আল্লাহর উপরে ভরসা) পুস্তিকাটি ‘অন্তরের আমল সমূহ’ সিরিজের দ্বিতীয় রচনা। কোন এক জ্ঞান-গবেষণা মজলিসে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এটি উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এটি তৈরীতে একদল নিবেদিতপ্রাণ বিদ্যানুরাগী আমাকে সহায়তা করেছেন। এখন আল্লাহর রহমতে এটি পুস্তক আকারে মুদ্রিত হ’তে যাচ্ছে।
আল্লাহর উপর ভরসা মানব জীবনে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্তর। এর প্রভাব-প্রতিপত্তিও সুদূরপ্রসারী। ঈমানের যেসব বিষয় ফরয বা আবশ্যকীয়, এটি তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দয়াময় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে যে সকল আমল ও ইবাদত রয়েছে তন্মধ্যে এটি উত্তম। আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতিদানে তাওয়াক্কুলের মত উঁচু স্তর দ্বিতীয়টি মেলে না। কেননা যাবতীয় কাজ আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর সাহায্য ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।
এই ছোট্ট পুস্তিকায় আমরা চেষ্টা করব তাওয়াক্কুলের অর্থ ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে এবং তাওয়াক্কুল ও তাওয়াকুলের (ভানের) পার্থক্য তুলে ধরতে। তারপর আমরা আলোচনা করব তাওয়াক্কুলের উপকারিতা, তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কাজকর্ম এবং শেষ করব আল্লাহর উপর ভরসাকারী কিছু লোকের ঘটনার বিবরণ দিয়ে।
আমরা এ কাজে মহান আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা করছি আর সালাত ও সালাম পেশ করছি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সঙ্গী-সাথী মহান সাহাবীগণের উপর।
তাওয়াক্কুলের পরিচয় :
অভিধানে তাওয়াক্কুল : ‘তাওয়াক্কুল’ শব্দটি যখন আল্লাহর সঙ্গে যোগ করে বলা হবে তখন তার অর্থ হবে আল্লাহতে সম্পূর্ণ ভরসা করা। আরবীতে এ শব্দ سَمِعَ (সামি‘আ), تَفَعُّلٌ (তাফা‘উল) ও اِفْتِعَالٌ (ইফতি‘আল) বাব থেকে উক্ত একই অর্থে আসে। বলা হয়,
وَكِلَ بالله، وتوكَّل عليه، واتَّكل
সবগুলো শব্দের অর্থ ‘সে আল্লাহর নিকট দায়িত্ব অর্পণ করল’। কোন কাজের সাথে তাওয়াক্কুল যোগ করলে তা সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেওয়া অর্থে আসে। যেমন تَوَكَّلَ بِالْأَمْرِ অর্থাৎ ‘সে কাজটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করার দায়িত্ব নিয়েছে’।
তাওয়াক্কুল (توكل)-এর অনুসর্গ إلى হরফ হ’লে অর্থ হয় কোন কাজে অন্যের উপর নির্ভর করা। যেমন وَكَّلْتُ أَمْرِيْ إِلَى فُلاَنٍ ‘আমার কাজটিতে আমি অমুকের উপর ভরসা করেছি’। যদি অনুসর্গ (حرف جر) ছাড়াই সরাসরি কর্মকারকের সাথে তাওয়াক্কুল যোগ হয় তাহ’লে তার অর্থ হবে নিজের কাজ নিজে করতে অক্ষম হয়ে অন্যকে তা করার দায়িত্ব দেওয়া তথা উকিল (Agent) বা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া। সে কাজটা করে দিবে বলে তার উপর ভরসা করা।[1] সুতরাং ‘তাওয়াক্কুল’ শব্দের অর্থهو إظهار العجز والاعتماد على الغير ‘নিজের অক্ষমতা যাহির করা এবং অন্যের উপর ভরসা করা’।
পারিভাষিক অর্থে তাওয়াক্কুল :
বিদ্বানগণ তাওয়াক্কুলের নানা সংজ্ঞা দিয়েছেন।
১. ইবনু রজব (রহঃ) বলেছেন,
‘দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে মঙ্গল লাভ ও অমঙ্গল প্রতিহত করতে আন্তরিকভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।[2]
২. হাসান (রহঃ) বলেছেন,
‘মালিকের উপর বান্দার তাওয়াক্কুলের অর্থ, আল্লাহই তার নির্ভরতার স্থান- একথা সে মনে রাখবে’।[3]
৩. আয্-যুবায়দী (রহঃ) বলেন,
‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট যা আছে তার উপর নির্ভর করা এবং মানুষের হাতে যা আছে তার প্রতি আশাহত থাকাকে তাওয়াক্কুল বলে’।[4]
৪. ইবনু উছায়মীন (রহঃ) বলেন,
‘কল্যাণ অর্জনে ও অকল্যাণ দূরীকরণে সত্যিকারভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং এতদসঙ্গে আল্লাহ যে সকল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে বলেছেন তা অবলম্বন করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।[5] এই সংজ্ঞাটি তাওয়াক্কুলের উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা, যার মধ্যে সব দিকই শামিল রয়েছে। (এতে একদিকে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা এবং অন্যদিকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার কথা রয়েছে)।
বিষয়ের গুরুত্ব :
সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রহঃ) বলেছেন,
‘আল্লাহর উপর ভরসা ঈমানের সামষ্টিক রূপ’।[6]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,
‘তাওয়াক্কুল দ্বীনের অর্ধেক; বাকী অর্ধেক হ’ল ইনাবা’। কেননা দ্বীন হ’ল সাহায্য কামনা ও ইবাদতের নাম। এই সাহায্য কামনা হ’ল তাওয়াক্কুল এবং ইবাদত-বন্দেগী হ’ল ইনাবা। আরবী ‘ইনাবা’ (الإنابة) অর্থ আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ ও তওবা করে ফিরে আসা।
আল্লাহর উপর ভরসার মর্যাদা ও গুরুত্ব ব্যাপক জায়গা জুড়ে রয়েছে। তাওয়াক্কুল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপকতা এবং বিশ্ববাসীর প্রয়োজনের আধিক্যের ফলে তাওয়াক্কুলকারীদের দ্বারা এর আঙিনা সদাই ভরপুর থাকে।[7]
সুতরাং তাওয়াক্কুল জড়িয়ে আছে ওয়াজিব (ফরয), মুস্তাহাব, মুবাহ সবকিছুরই সাথে। এমনকি যেসব নাস্তিক আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে ক্ষেত্রবিশেষে তারাও নিজেদের লক্ষ্য পূরণে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করে। আসলে মানুষের প্রয়োজনের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কাজেই প্রয়োজন পূরণার্থে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হয়।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, বান্দা যদি কোন পাহাড় সরাতে আদিষ্ট হয় আর যদি সে কাজে সে আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পারে, তবে সে পাহাড়ও সরিয়ে দিতে পারবে।[8]
সুতরাং একজন মুসলিম তার যাবতীয় কাজে আল্লাহর উপর ভরসাকে একটা মুস্তাহাব বিষয় ভাবতে পারে না; বরং সে তাওয়াক্কুলকে একটি দ্বীনী দায়িত্ব বা আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করবে।
শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, যে মূল থেকে ইবাদতের নানা শাখা-প্রশাখা উদগত হয়েছে তা হ’ল : আল্লাহর উপর ভরসা, তাঁর নিকট সত্য দিলে আশ্রয় নেওয়া এবং আন্তরিকভাবে তাঁর উপর নির্ভর করা। তাওয়াক্কুলই আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকারোক্তির সারকথা। এর মাধ্যমেই তাওহীদের চূড়ান্তরূপ নিশ্চিত হয়। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালবাসা, ভয়, রব ও উপাস্য হিসাবে তাঁর নিকট আশা-ভরসা এবং তাঁর নির্ধারিত তাকদীর বা ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকার মত মহতী বিষয়গুলো তাওয়াক্কুল থেকেই উৎপত্তি লাভ করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুল বান্দার নিকট বালা-মুছীবতকে পর্যন্তউপভোগ্য বিষয় করে তোলে, সে তখন বালা-মুছীবতকে আল্লাহর দেওয়া নে‘মত মনে করতে থাকে। বস্ত্ততঃ পবিত্র সেই মহান সত্তা তিনি যাকে যা দিয়ে ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন। তিনি মহা অনুগ্রহশীল।[9]
আল্লাহর উপর ভরসার তাৎপর্য :
তাওয়াক্কুলের হাকীকত বা মূল কথা হ’ল অন্তর থেকে আল্লাহর উপর ভরসা করা, সেই সাথে পার্থিব নানা উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহই রিযিকদাতা, তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, জীবন ও মৃত্যু দাতা। তিনি ছাড়া যেমন কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই, তেমনি তিনি ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই।
তাওয়াক্কুল শব্দটি ইসতি‘আনাহ (الاسةعانة) থেকে ব্যাপক অর্থবোধক। কেননা ইসতি‘আনাহ (সাহায্য প্রার্থনা) হ’ল, যে কোন কাজে আল্লাহ তা‘আলা যাতে বান্দাকে সাহায্য করেন সেজন্য তাঁর দরবারে সাহায্যের আবেদন-নিবেদন করা।
পক্ষান্তরে তাওয়াক্কুলের মধ্যে যেমন আমাদের যাবতীয় কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা শামিল আছে, তদ্রূপ সব রকম কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ প্রতিহত করতে আল্লাহর উপর ভরসাও শামিল আছে। অন্যান্য বিষয়ও তাওয়াক্কুলের আওতাভুক্ত।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, যে কাজ করতে আল্লাহ হুকুম করেছেন তাতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া তাওয়াক্কুল। আবার যে কাজ বান্দার সামর্থ্যের বাইরে আল্লাহ যাতে তা যুগিয়ে দেন সে নিবেদনও তাওয়াক্কুল। সুতরাং ইসতি‘আনাহ বা সাহায্য প্রার্থনা বান্দার নানা আমলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু তাওয়াক্কুল তার থেকেও কিছু বেশী। মানুষ যাতে কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারে সেজন্যও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে হয়।
আল্লাহ বলেন,
‘কতই না ভাল হ’ত যদি তারা সন্তুষ্ট হ’ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদের যা দিয়েছেন তার উপরে এবং বলত, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। সত্বর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে দান করবেন। আর আমরা আল্লাহর প্রতি নিরত হ’লাম’ (তওবা ৯/৫৯)।[10]
সুতরাং কল্যাণ লাভ এবং ক্ষতি দূরীকরণের জন্য তাওয়াক্কুল এবং ইবাদত-বন্দেগীর জন্য ইসতি‘আনাহ (সাহায্য প্রার্থনা)। তবে তাওয়াক্কুলের পরিধি ইসতি‘আনাহ থেকে বেশী। এই দু’টি মূল বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফাতিহার পাঁচ নং আয়াতে একত্রিত করেছেন-
‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং একমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৫)।
সুতরাং ইবাদতও তাঁর করতে হবে, সাহায্যও তাঁর কাছে চাইতে হবে এবং তাওয়াক্কুল বা ভরসাও তাঁর উপর করতে হবে। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই।
কবি শরীফ মুরতাযা বলেন :
‘ভয় যদি পাও কোন কিছুর সামনে রাখ রবকে তোমার,
দূর হবে যে সকল বাধা, বিপত্তি কভু থাকবে না আর।
সমর্পিত যে আল্লাহতে তার তরে নেই কোন ডর
উপায় একটা হবেই হবে চিন্তা কভু করো না আর।
আল্লাহর যা ফায়ছালা হয় তাতে থাক শোকরগুযার
যদিও তাতে কখনও কখনও পূরণ না হয় আরয তোমার।
কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের আমি (কবি) হব যামিন তার,
আল্লাহ ছেড়ে অন্যেরে যেচে কখনই রাত কাটে না যার’।
সুতরাং অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে গেলে তাতেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, অন্য কাউকে ভয় করা চলবে না। তোমার যে কোন কাজ যখন তুমি আল্লাহর নিকট ন্যস্ত করবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে তাঁর দিকে ফিরে যাবে তখন আল্লাহর মর্যি মোতাবেক তিনি তোমাকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন।
উপায়-উপকরণ বা মাধ্যম গ্রহণ :
যে কোন চাহিদা পূরণে উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম গ্রহণ না করা কোন অবস্থাতেই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসার মর্মার্থ নয়। তাওয়াক্কুলের বরং দু’টি দিক রয়েছে। এক. আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা। দুই. তাঁর সাথে কাজের উপকরণ অবলম্বন করা।
আসলে লক্ষণীয় যা তা হ’ল- শুধুই উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর না করা। বান্দাকে জানতে ও বুঝতে হবে যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে চাহিদা পূরণ ও সমস্যা সমাধান কেবল জাগতিক নিয়ম মাত্র। উপকারকারী ও অপকারকারী কেবলই আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,
‘তাওয়াক্কুলের রহস্য ও তাৎপর্য হ’ল- বান্দার অন্তর এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া; জাগতিক উপায়-উপকরণের প্রতি অন্তরের মোহশূন্য থাকা, তার প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া। এসব উপায়-উপকরণের সরাসরি ক্ষতি কিংবা উপকার করার কোনই ক্ষমতা নেই’।[11]
আল্লাহর উপর প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারী এবং তাওয়াক্কুলের মৌখিক দাবীদারদের মধ্যে এটাই বুনিয়াদী পার্থক্য। কেননা প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারীর উপায়-উপকরণ যদি হাতছাড়া হয়েও যায় তবুও তার কিছু যায় আসে না, সে তো ভাল করেই জানে, যে আল্লাহর উপর সে নির্ভর করে তিনি নিত্য ও চিরস্থায়ী। কিন্তু তাওয়াক্কুলের মৌখিক দাবীদারের জাগতিক উপায়-উপকরণ হাতছাড়া হওয়ার সাথে সাথে সে ভেঙ্গে পড়ে। আল্লাহর উপর ভরসার মাত্রা দুর্বল হওয়ার কারণেই তার এমনটা হয়।
নবী করীম (ﷺ)-এর উপায়-উপকরণ গ্রহণ :
নবী করীম (ﷺ) ছিলেন আল্লাহর উপর সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী। তা সত্ত্বেও তিনি বহুক্ষেত্রে জাগতিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন করেছেন তাঁর উম্মতকে একথা বুঝানোর জন্য যে, উপায়-উকরণ গ্রহণ তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।
ওহোদ যুদ্ধে তিনি একটার পর একটা করে দু’টো বর্ম গায়ে দিয়েছিলেন। সায়েব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে,
‘ওহোদ যুদ্ধের দিনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’টি বর্ম পরে জনসমক্ষে এসেছিলেন’।[12] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মতের জন্যও যুদ্ধের পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন।[13]
মক্কা বিজয়ের দিনে তিনি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেছিলেন। আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা বিজয় দিবসে যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথায় শিরস্ত্রাণ ছিল’।[14]
হিজরতের সময় তিনি একজন পথপ্রদর্শক সাথে নিয়েছিলেন, যে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যাত্রাপথে কোন পদচিহ্ন যাতে না থাকে তিনি সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। তিনি যাত্রার জন্য এমন সময় বেছে নিয়েছিলেন যখন লোকজন সাধারণতঃ সজাগ থাকে না। আবার জনগণ সচরাচর যে পথে চলাচল করে তিনি তা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা ধরেছিলেন।
এসব কিছুই উপায় ও মাধ্যম অবলম্বনের অন্তর্গত। তিনি তাঁর উম্মতকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর উপর ভরসাকারী কোন মুসলিমই উপায়-উপকরণ গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে পারে না।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে তাহ’লে পাখ-পাখালির মতই তোমরা জীবিকা পেতে। তারা ভোর বেলায় ওঠে ক্ষুধার্ত অবস্থায় আর সন্ধ্যায় ভরাপেটে নীড়ে ফেরে’।[15]
এ হাদীসে উপায়-উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। যে পাখির খাবার যোগাড়ের দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন সে তো তার কাছে খাবার আপনা থেকে আসবে সেই আশায় তার বাসায় বসে থাকে না। বরং খুব ভোরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। আল্লাহ তার ইচ্ছে পূরণ করে দেন। ফলে সে যখন বাসায় ফিরে তখন তার পেট ভরা ও পরিতৃপ্ত থাকে।
অবশ্য মুসলমানকে জাগতিক কোন উপকরণ ও পন্থা অবলম্বন করতে হ’লে প্রথমেই তাকে দেখতে হবে শরী‘আতের নিরিখে তা বৈধ কি-না। আমরা কিছু লোককে দেখি, তারা তাদের উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য কর্মচারীদের ঘুষ প্রদান করে আর বলে, এটা তাওয়াক্কুলের অংশ। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় নকল করে অথচ বলে এটাও তাওয়াক্কুল। অথচ এর কোনটাই আদৌ তাওয়াক্কুল নয়। বরং এগুলো তাওয়াক্কুলের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধী। এহেন মুসলিম যদি আল্লাহর উপর প্রকৃতই ভরসা করত তাহ’লে তারা কখনই শরী‘আত গর্হিত কোন কাজ করত না।
তাওয়াক্কুল ও তাওয়াকুলের (ভানের) মধ্যে পার্থক্য :
পূর্বেই বলা হয়েছে তাওয়াক্কুলের জন্য বিভিন্ন উপায়-উপকরণ ও কাজের পথ অবলম্বন অপরিহার্য। কিন্তু কোন কিছু না করে নিশ্চেষ্ট বসে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়; বরং তা তাওয়াক্কুলের ভান। আরবীতে একে ‘তাওয়াকুল’ (تواكل) বলে। তাওয়াকুল বা নিশ্চেষ্ট বসে থেকে আল্লাহর উপর ভরসা যাহির করা আল্লাহর দ্বীনের কোন কিছুতেই পড়ে না।
বলা হয়ে থাকে, যে তাওয়াক্কুল ছেড়ে দেয় তার তাওহীদে খুঁত তৈরী হয়, আর যে জাগতিক উপায়-উপকরণ বা কাজকর্ম ছেড়ে দেয় তার বিবেক-বুদ্ধি বিনষ্ট হয়ে যায়। মুসলিম জাতির দুর্বলতার অন্যতম কারণ এই তাওয়াকুল বা নিশ্চেষ্ট বসে থেকে সময় পার করা। লোকে বাড়ি বসে থেকে জীবিকা লাভের আশা করে, একটু নড়েচড়ে দেখে না; আবার দাবী করে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। লোকেরা আশায় থাকে যে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন অথচ সেজন্য তাদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, যুদ্ধের প্রস্ত্ততিজনিত অস্ত্র-শস্ত্র এবং আনুষঙ্গিক জিনিসের কোনই ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেই।
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
‘ইয়ামানবাসীরা হজ্জ করতে আসত কিন্তু পথখরচ আনত না। তারা বলত, আমরা আল্লাহর উপর ভরসাকারী। তারপর যখন তারা মক্কায় পৌঁছত তখন মানুষের কাছে হাত পাতত’। এতদপ্রেক্ষিতে আল্লাহ নাযিল করেন,
‘আর (হজ্জের জন্য) তোমরা পাথেয় সাথে নাও। নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পাথেয় হ’ল আল্লাহভীতি’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)।[16]
দেখুন, কিভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওয়াক্কুলের দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন; অথচ তারা তো হজ্জের কাজে লাগতে পারে এমন কোন পাথেয়ই সাথে না এনে কেবলই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছিল। আবার তাওয়াক্কুলের ঈপ্সিত লক্ষ্য এটাও নয় যে, বান্দা উপকরণের পেছনে তার জীবনপাত করবে এবং সাধ্যাতীত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে। বরং কখনো কখনো তার জন্য সহজ ও লঘু উপকরণও যথেষ্ট হ’তে পারে। তার প্রমাণ মারইয়াম (আঃ)-এর ঘটনা। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে খেজুর গাছ ধরে ঝাঁকি দিতে বলেছিলেন, যাতে তাঁর সামনে খেজুর ঝরে পড়ে। আল্লাহ বলেন,
‘আর তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দাও। সেটি তোমার উপর পাকা খেজুর নিক্ষেপ করবে’ (মারিয়াম ১৯/২৫)।
অনেকের মনে বিস্ময় জাগে- এহেন দুর্বল গর্ভবতী মহিলা কিভাবে মযবূত ও শক্ত খেজুর গাছ ধরে এমনভাবে ঝাঁকি দিল যে টপটপ করে খেজুর ঝড়ে পড়ল? আমরা বলি, হ্যাঁ, এই মহীয়সী মহিলার ঘটনা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব শিক্ষা দিয়েছেন- চাই সেসব উপকরণ লঘু ও দুর্বল হৌক। কেননা এই সতী-সাধ্বী মহিলার সেই মুহূর্তে এরূপ দুর্বল ধরনের কাজ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোন মাধ্যম ছাড়াই খেজুর নীচে ফেলানো অবশ্যই সম্ভব ছিল। কিন্তু যেহেতু কোন কিছু পেতে হ’লে মাধ্যম একটি জাগতিক নিয়ম হিসাবে রয়েছে, সেহেতু আল্লাহ মারিয়াম (আঃ)-কে কান্ড ধরে ঝাঁকি দিতে বলেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আল্লাহর উপর যথাযথভাবে ভরসা করেছিলেন এবং তাঁর দুর্বল পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলেন তখন আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা ফলবতী করেছিলেন এবং ফলগুলোকে তাঁর নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছিলেন। কবি বলেছেন,
توكَّل على الرَّحمن في كلِّ حاجةٍ + ولا تؤثرنّ العجز يوماً على الطّلبْ
ألم تر أن الله قال لمريم + إليك فهزِّي الجذع يسَّاقط الرُّطبْ
ولو شاء أن تجنيه من غير هزِّها + جنته ولكن كلُّ شيءٍ له سببْ
ভরসা কর সকল কাজে আল্লাহ দয়াময়ের পরে
প্রাধান্য দিও না অক্ষমতাকে চেষ্টার পরে মুহূর্ত তরে।
তুমি কি দেখনি, বলেছেন আল্লাহ মারিয়ামকে
খেজুর পেতে নাড়া দাও তুমি খেজুর গাছের কান্ডটাকে
চাইলে তিনি দিতেন খেজুর ঝাঁকি ছাড়াই
কিন্তু কিছু পাইতে হ’লে উপকরণ বিনে উপায় নাই।[17]
যখন মানুষ সম্ভাব্য সব উপকরণ হারিয়ে ফেলে তখন যেন সে সবচেয়ে মহান ও শক্তিশালী উপকরণের কথা ভুলে না যায়। তাহ’ল মহান আল্লাহর সমীপে দো‘আ ও ফরিয়াদ।
তাওয়াক্কুলের হুকুম :
নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা শীর্ষস্তরের ফরযসমূহের অন্তর্গত একটি বড় ফরয। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
‘আল্লাহর উপর ভরসা করা ফরয। এটি উচ্চাঙ্গের ফরয সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহর জন্য ইখলাছ বা বিশুদ্ধচিত্তে কাজ করা ফরয। ওযূ ও অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতার জন্য গোসলের ব্যাপারে যেখানে আল্লাহ তা‘আলা একটি আয়াতে একবার বলে তা ফরয সাব্যস্ত করেছেন, সেখানে একাধিক আয়াতে তিনি তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করতে নিষেধ করেছেন’।[18]
বরং তাওয়াক্কুল ঈমানের শর্ত। এজন্য আল্লাহর বাণী
‘আর আল্লাহর উপরে তোমরা ভরসা কর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (মায়েদাহ ৫/২৩) এই আয়াতের মর্মার্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, বান্দার থেকে তাওয়াক্কুল দূর হয়ে গেলে সাথে সাথে ঈমানও দূর হয়ে যাবে।
তাওয়াক্কুল তাওহীদে উলূহিয়্যা বা উপাস্যের একত্ববাদের যেসব ভিত্তি রয়েছে তন্মধ্যে একটি। সূরা ফাতিহার পাঁচ নং আয়াত একথার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ বলেন,
‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং
একমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৫)।
তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধকরণমূলক আয়াত সমূহ :
তাওয়াক্কুল শব্দটি কুরআন মাজীদে ৪২ জায়গায় এসেছে। কখনো তা একবচনে, কখনো বহুবচনে, কখনো অতীতকালের শব্দে, কখনো বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের শব্দে, কখনোবা আদেশবাচক শব্দে। সবগুলো শব্দই আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা এবং তাঁর নিকট কার্যভার অর্পণ অর্থে এসেছে।
তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে কুরআন মাজীদের বর্ণনাভঙ্গি নানারূপ ধারণ করেছে। এখানে তার কিছু তুলে ধরা হ’ল।
(ক) আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবীকে তাওয়াক্কুলের আদেশ :
কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে তাঁর নবীকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন :
‘অতএব তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর। তুমি তো স্পষ্ট সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (নামল ২৭/৭৯)।
আল্লাহ বলেন,
‘অতএব তুমি তাঁর ইবাদত কর ও তাঁর উপরেই ভরসা কর’ (হূদ ১১/১২৩)। আল্লাহ আরও বলেন,
‘আর তুমি ভরসা কর সেই চিরঞ্জীব সত্তার উপর, যাঁর মৃত্যু নেই এবং তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর। বস্ত্ততঃ জান্নাতী বান্দাদের পাপসমূহের খবর রাখার ব্যাপারে তিনিই যথেষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৫৮)।
আল্লাহ বলেন,
‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
মহান আল্লাহ বলেন,
‘এতদসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। আর তিনিই হচ্ছেন মহান আরশের মালিক’ (তওবা ৯/১২৯)।
আল্লাহ আরো বলেন,
‘তুমি বল, তিনি তো সেই দয়াময় (আল্লাহ)। আমরা তাঁর উপর ঈমান এনেছি এবং ভরসা করেছি। অতঃপর কারা সুস্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল তা অচিরেই তোমরা জানতে পারবে’ (মুলক ৬৭/২৯)।
আর আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবীকে তাওয়াক্কুল করার হুকুম দেওয়ার অর্থ তাঁর উম্মতকে হুকুম দেওয়া।
(খ) আল্লাহ কর্তৃক তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ : আল্লাহ তা‘আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর উপর ভরসা করতে আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
‘আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ৩/১২২)।
(গ) মুমিনরা তাদের রবের উপর ‘তাওয়াক্কুলকারী’ বিশেষণে বিশেষিত : আল্লাহর উপর ভরসা করা দয়াময় আল্লাহর বান্দাদের একটি বড় গুণ। এটি তাদের এমন একটি প্রতীক, যা দ্বারা অন্যদের থেকে তাদের পৃথক করা যায়। মুমিনদের জন্য এটি একটি সুস্পষ্ট চিহ্ন।
আল্লাহ বলেন,
‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)।
‘তারা তাদের মালিকের উপরই ভরসা করে’- বাক্যটির মর্মার্থ হ’ল- তারা আল্লাহকে ছাড়া কাউকে আকাঙ্ক্ষা করে না; তিনি ছাড়া কেউ তাদের উদ্দেশ্য নয়; তারা তাঁর নিকট ছাড়া কোথাও আশ্রয় নেয় না; তারা কেবলই তাঁর নিকট তাদের প্রয়োজন পূরণের আবেদন জানায়; তারা তাকে ছাড়া আর কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না। তারা জানে যে, তিনি যা চান তাই হয় এবং তিনি যা চান না তা হয় না। তিনিই ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রয়োগকারী, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর হুকুম রদ করার শক্তিও কারো নেই এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ)।[19]
(ঘ) নবীগণের তাওয়াক্কুলের কতিপয় উদাহরণ :
আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণের জন্য আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৬০/৪)।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাদের নিকট তাদের সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা তাদের ঈমানী শক্তির কারণে বলেছিল,
‘হে আমাদের মালিক! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। আর তোমার নিকটেই তো প্রত্যাবর্তন স্থল’ (মুমতাহিনা ৬০/৪)। অর্থাৎ আমাদের যাবতীয় কাজে আমরা তোমারই উপর ভরসা করি এবং তোমারই নিকট সব কাজ সমর্পণ ও সোপর্দ করেছি। এমনিভাবে তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন এবং যাবতীয় কাজ আল্লাহর কাছে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করেছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তারা তাওয়াক্কুলকে সাথী করে নিয়েছিলেন। দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তারা তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-কে তো তাঁর জাতি পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিল। এজন্য তারা প্রচুর জ্বালানী কাঠ যোগাড় করেছিল। সুদ্দী বলেন, সে সময় একজন মহিলা অসুস্থ হ’লে সে মানত করত যদি সে সুস্থ হয়ে ওঠে তাহ’লে ইবরাহীমকে পোড়ানোর জন্য এক বোঝা কাঠ সে বয়ে দিয়ে আসবে।[20]
তারপর তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে পোড়ানোর জন্য বড় একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে কাঠ জমা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন যখন খুব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তার লেলিহান শিখা বিস্তার করতে থাকে, তখন মিনজানীক নামক এক ধরনের যন্ত্রে করে তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে ঐ আগুনে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার সময় ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন,
‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে এসেছে তিনি বলেন, ‘ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে ফেলা হয় তখন তিনি বলেছিলেন
‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’।[21]
মূসা (আঃ)-কে দেখুন, কিভাবে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন এবং তাঁর জাতিকে তার উপর ভরসা করতে হুকুম দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,
‘আর মূসা (তার নির্যাতিত কওমকে সান্ত্বনা দিয়ে) বলল, হে আমার কওম! যদি তোমরা (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহর উপর ঈমান এনে থাক, তাহ’লে তাঁর উপরেই তোমরা ভরসা কর। যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হয়ে থাক’ (ইউনুস ১০/৮৪)।
শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, আয়াতের অর্থ এই যে, মূসা (আঃ) তাঁর উম্মাতকে আল্লাহ কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, তারা যেন স্বৈরাচারীদের ভয়ে পিছটান না দেয়; বরং সামনে এগিয়ে যায়, তাদের ভয় না করে, তাদের দেখে তটস্থ ও সন্ত্রস্ত না হয়। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে তারা যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে। তারা যেন বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার সত্যি-সত্যিই বাস্তবায়ন করবেন, যদি তারা মুমিন হয়।[22]
উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। ওহোদ যুদ্ধের প্রাক্কালের ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন,
‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্ম বিধায়ক’- বাক্যটি ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন, আর মুহাম্মাদ (ﷺ) এটি বলেছিলেন যখন কাফিররা বলেছিল, ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।[23]
সুতরাং যখন ইসলাম বিরোধীরা মুসলমানদের হুমকি দেয় এবং শত্রুপক্ষের জনশক্তি ও অস্ত্র শক্তির ভয় দেখায়, তখন এই তাওয়াক্কুলই মুমিনদের একমাত্র অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। কবি বলেন,
খুব নিকটে আছেন, তিনি দো‘আ কবুলকারী,
সুখে-দুঃখে তাঁরই কাছে এস আরয করি।
বল সবে আমার তরে আল্লাহ যথেষ্ট,
মা‘বূদ আমার, ভরসা আমার সকলের ইষ্ট।
[1]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১১/৭৩৪।
[2]. ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ৪৩৬।
[3]. ঐ, পৃঃ ৪৩৭।
[4]. মুরতাযা আয্-যুবায়দী, তাজুল ‘আরূস শীর্ষ শব্দ (وكل)।
[5]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ও রাসাইলু ইবনে উছায়মীন ১/৬৩।
[6]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা ৭/২০২।
[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ২/১১৩।
[8]. ঐ, ১/৮১।
[9]. শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ, তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ৮৬।
[10]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৭/১৭৭।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, পৃঃ ৮৭।
[12]. আহমাদ হা/১৫৭৬০, শু‘আইব আল-আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ গণ্য করেছেন।
[13]. সহীহ ইবনু হিববান হা/৭০২৮।
[14]. বুখারী হা/৪২৮৬; মুসলিম হা/১৩৫৭; মিশকাত হা/২৭১৮।
[15]. তিরমিযী হা/২৩৪৪; ইবনু মাজাহ হা/৪১৬৪; হাকেম হা/৭৮৯৪, ৪/৩৫৪; মিশকাত হা/৫২৯৯।
[16]. বুখারী হা/১৫২৩; মিশকাত হা/২৫৩৩।
[17]. ইবনু আব্দিল বার্র, বাহজাতুল মাজালিস ওয়া উনসুল মাজালিস, ১/২৬ পৃঃ।
[18]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ৭/১৬।
[19]. তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৩৭৯।
[20]. ঐ, ৩/২৭৪।
[21]. সহীহ বুখারী হা/৪৫৬৩।
[22]. তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ৪৩৮।
[23]. বুখারী হা/৪৫৬৩।
সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালনকারী। সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর, যিনি নবী ও রাসূলকুলের শ্রেষ্ঠ। সেই সঙ্গে সালাত ও সালাম তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের উপর।
অতঃপর আমাদের এই ‘তাওয়াক্কুল’ (আল্লাহর উপরে ভরসা) পুস্তিকাটি ‘অন্তরের আমল সমূহ’ সিরিজের দ্বিতীয় রচনা। কোন এক জ্ঞান-গবেষণা মজলিসে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এটি উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এটি তৈরীতে একদল নিবেদিতপ্রাণ বিদ্যানুরাগী আমাকে সহায়তা করেছেন। এখন আল্লাহর রহমতে এটি পুস্তক আকারে মুদ্রিত হ’তে যাচ্ছে।
আল্লাহর উপর ভরসা মানব জীবনে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্তর। এর প্রভাব-প্রতিপত্তিও সুদূরপ্রসারী। ঈমানের যেসব বিষয় ফরয বা আবশ্যকীয়, এটি তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দয়াময় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে যে সকল আমল ও ইবাদত রয়েছে তন্মধ্যে এটি উত্তম। আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতিদানে তাওয়াক্কুলের মত উঁচু স্তর দ্বিতীয়টি মেলে না। কেননা যাবতীয় কাজ আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর সাহায্য ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।
এই ছোট্ট পুস্তিকায় আমরা চেষ্টা করব তাওয়াক্কুলের অর্থ ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে এবং তাওয়াক্কুল ও তাওয়াকুলের (ভানের) পার্থক্য তুলে ধরতে। তারপর আমরা আলোচনা করব তাওয়াক্কুলের উপকারিতা, তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কাজকর্ম এবং শেষ করব আল্লাহর উপর ভরসাকারী কিছু লোকের ঘটনার বিবরণ দিয়ে।
আমরা এ কাজে মহান আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা করছি আর সালাত ও সালাম পেশ করছি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সঙ্গী-সাথী মহান সাহাবীগণের উপর।
তাওয়াক্কুলের পরিচয় :
অভিধানে তাওয়াক্কুল : ‘তাওয়াক্কুল’ শব্দটি যখন আল্লাহর সঙ্গে যোগ করে বলা হবে তখন তার অর্থ হবে আল্লাহতে সম্পূর্ণ ভরসা করা। আরবীতে এ শব্দ سَمِعَ (সামি‘আ), تَفَعُّلٌ (তাফা‘উল) ও اِفْتِعَالٌ (ইফতি‘আল) বাব থেকে উক্ত একই অর্থে আসে। বলা হয়,
وَكِلَ بالله، وتوكَّل عليه، واتَّكل
সবগুলো শব্দের অর্থ ‘সে আল্লাহর নিকট দায়িত্ব অর্পণ করল’। কোন কাজের সাথে তাওয়াক্কুল যোগ করলে তা সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেওয়া অর্থে আসে। যেমন تَوَكَّلَ بِالْأَمْرِ অর্থাৎ ‘সে কাজটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করার দায়িত্ব নিয়েছে’।
তাওয়াক্কুল (توكل)-এর অনুসর্গ إلى হরফ হ’লে অর্থ হয় কোন কাজে অন্যের উপর নির্ভর করা। যেমন وَكَّلْتُ أَمْرِيْ إِلَى فُلاَنٍ ‘আমার কাজটিতে আমি অমুকের উপর ভরসা করেছি’। যদি অনুসর্গ (حرف جر) ছাড়াই সরাসরি কর্মকারকের সাথে তাওয়াক্কুল যোগ হয় তাহ’লে তার অর্থ হবে নিজের কাজ নিজে করতে অক্ষম হয়ে অন্যকে তা করার দায়িত্ব দেওয়া তথা উকিল (Agent) বা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া। সে কাজটা করে দিবে বলে তার উপর ভরসা করা।[1] সুতরাং ‘তাওয়াক্কুল’ শব্দের অর্থهو إظهار العجز والاعتماد على الغير ‘নিজের অক্ষমতা যাহির করা এবং অন্যের উপর ভরসা করা’।
পারিভাষিক অর্থে তাওয়াক্কুল :
বিদ্বানগণ তাওয়াক্কুলের নানা সংজ্ঞা দিয়েছেন।
১. ইবনু রজব (রহঃ) বলেছেন,
هو صدق اعةماد القلب على الله عز وجل في اسةجلاب المصالح ودفع المضار من أمور الدنيا والآخرة
‘দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে মঙ্গল লাভ ও অমঙ্গল প্রতিহত করতে আন্তরিকভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।[2]
২. হাসান (রহঃ) বলেছেন,
إن توكل العبد على ربه أن يعلم أن الله هو ثقته
‘মালিকের উপর বান্দার তাওয়াক্কুলের অর্থ, আল্লাহই তার নির্ভরতার স্থান- একথা সে মনে রাখবে’।[3]
৩. আয্-যুবায়দী (রহঃ) বলেন,
التوكل : الثقة بما عند الله واليأس مما في أيدي الناس
‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট যা আছে তার উপর নির্ভর করা এবং মানুষের হাতে যা আছে তার প্রতি আশাহত থাকাকে তাওয়াক্কুল বলে’।[4]
৪. ইবনু উছায়মীন (রহঃ) বলেন,
التوكل هو صدق الاعتماد على الله عز وجل في جلب المنافع ودفع المضار مع فعل الأسباب التي أمر الله بها-
‘কল্যাণ অর্জনে ও অকল্যাণ দূরীকরণে সত্যিকারভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং এতদসঙ্গে আল্লাহ যে সকল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে বলেছেন তা অবলম্বন করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।[5] এই সংজ্ঞাটি তাওয়াক্কুলের উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা, যার মধ্যে সব দিকই শামিল রয়েছে। (এতে একদিকে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা এবং অন্যদিকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার কথা রয়েছে)।
বিষয়ের গুরুত্ব :
সাঈদ ইবনু জুবায়ের (রহঃ) বলেছেন,
التوكل على الله جماع الإيمان
‘আল্লাহর উপর ভরসা ঈমানের সামষ্টিক রূপ’।[6]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,
الةوكل نصف الدين والنصف الثاني الإنابة
‘তাওয়াক্কুল দ্বীনের অর্ধেক; বাকী অর্ধেক হ’ল ইনাবা’। কেননা দ্বীন হ’ল সাহায্য কামনা ও ইবাদতের নাম। এই সাহায্য কামনা হ’ল তাওয়াক্কুল এবং ইবাদত-বন্দেগী হ’ল ইনাবা। আরবী ‘ইনাবা’ (الإنابة) অর্থ আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ ও তওবা করে ফিরে আসা।
আল্লাহর উপর ভরসার মর্যাদা ও গুরুত্ব ব্যাপক জায়গা জুড়ে রয়েছে। তাওয়াক্কুল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপকতা এবং বিশ্ববাসীর প্রয়োজনের আধিক্যের ফলে তাওয়াক্কুলকারীদের দ্বারা এর আঙিনা সদাই ভরপুর থাকে।[7]
সুতরাং তাওয়াক্কুল জড়িয়ে আছে ওয়াজিব (ফরয), মুস্তাহাব, মুবাহ সবকিছুরই সাথে। এমনকি যেসব নাস্তিক আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে ক্ষেত্রবিশেষে তারাও নিজেদের লক্ষ্য পূরণে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করে। আসলে মানুষের প্রয়োজনের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কাজেই প্রয়োজন পূরণার্থে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হয়।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, বান্দা যদি কোন পাহাড় সরাতে আদিষ্ট হয় আর যদি সে কাজে সে আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পারে, তবে সে পাহাড়ও সরিয়ে দিতে পারবে।[8]
সুতরাং একজন মুসলিম তার যাবতীয় কাজে আল্লাহর উপর ভরসাকে একটা মুস্তাহাব বিষয় ভাবতে পারে না; বরং সে তাওয়াক্কুলকে একটি দ্বীনী দায়িত্ব বা আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করবে।
শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, যে মূল থেকে ইবাদতের নানা শাখা-প্রশাখা উদগত হয়েছে তা হ’ল : আল্লাহর উপর ভরসা, তাঁর নিকট সত্য দিলে আশ্রয় নেওয়া এবং আন্তরিকভাবে তাঁর উপর নির্ভর করা। তাওয়াক্কুলই আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকারোক্তির সারকথা। এর মাধ্যমেই তাওহীদের চূড়ান্তরূপ নিশ্চিত হয়। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালবাসা, ভয়, রব ও উপাস্য হিসাবে তাঁর নিকট আশা-ভরসা এবং তাঁর নির্ধারিত তাকদীর বা ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকার মত মহতী বিষয়গুলো তাওয়াক্কুল থেকেই উৎপত্তি লাভ করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুল বান্দার নিকট বালা-মুছীবতকে পর্যন্তউপভোগ্য বিষয় করে তোলে, সে তখন বালা-মুছীবতকে আল্লাহর দেওয়া নে‘মত মনে করতে থাকে। বস্ত্ততঃ পবিত্র সেই মহান সত্তা তিনি যাকে যা দিয়ে ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন। তিনি মহা অনুগ্রহশীল।[9]
আল্লাহর উপর ভরসার তাৎপর্য :
তাওয়াক্কুলের হাকীকত বা মূল কথা হ’ল অন্তর থেকে আল্লাহর উপর ভরসা করা, সেই সাথে পার্থিব নানা উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহই রিযিকদাতা, তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, জীবন ও মৃত্যু দাতা। তিনি ছাড়া যেমন কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই, তেমনি তিনি ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই।
তাওয়াক্কুল শব্দটি ইসতি‘আনাহ (الاسةعانة) থেকে ব্যাপক অর্থবোধক। কেননা ইসতি‘আনাহ (সাহায্য প্রার্থনা) হ’ল, যে কোন কাজে আল্লাহ তা‘আলা যাতে বান্দাকে সাহায্য করেন সেজন্য তাঁর দরবারে সাহায্যের আবেদন-নিবেদন করা।
পক্ষান্তরে তাওয়াক্কুলের মধ্যে যেমন আমাদের যাবতীয় কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা শামিল আছে, তদ্রূপ সব রকম কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ প্রতিহত করতে আল্লাহর উপর ভরসাও শামিল আছে। অন্যান্য বিষয়ও তাওয়াক্কুলের আওতাভুক্ত।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, যে কাজ করতে আল্লাহ হুকুম করেছেন তাতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া তাওয়াক্কুল। আবার যে কাজ বান্দার সামর্থ্যের বাইরে আল্লাহ যাতে তা যুগিয়ে দেন সে নিবেদনও তাওয়াক্কুল। সুতরাং ইসতি‘আনাহ বা সাহায্য প্রার্থনা বান্দার নানা আমলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু তাওয়াক্কুল তার থেকেও কিছু বেশী। মানুষ যাতে কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারে সেজন্যও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে হয়।
আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوْا مَا آتَاهُمُ اللهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوْا حَسْبُنَا اللهُ سَيُؤْتِينَا اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللهِ رَاغِبُوْنَ-
‘কতই না ভাল হ’ত যদি তারা সন্তুষ্ট হ’ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদের যা দিয়েছেন তার উপরে এবং বলত, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। সত্বর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে দান করবেন। আর আমরা আল্লাহর প্রতি নিরত হ’লাম’ (তওবা ৯/৫৯)।[10]
সুতরাং কল্যাণ লাভ এবং ক্ষতি দূরীকরণের জন্য তাওয়াক্কুল এবং ইবাদত-বন্দেগীর জন্য ইসতি‘আনাহ (সাহায্য প্রার্থনা)। তবে তাওয়াক্কুলের পরিধি ইসতি‘আনাহ থেকে বেশী। এই দু’টি মূল বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফাতিহার পাঁচ নং আয়াতে একত্রিত করেছেন-
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ
‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং একমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৫)।
সুতরাং ইবাদতও তাঁর করতে হবে, সাহায্যও তাঁর কাছে চাইতে হবে এবং তাওয়াক্কুল বা ভরসাও তাঁর উপর করতে হবে। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই।
কবি শরীফ মুরতাযা বলেন :
إذا ما حَذرتَ الأمرَ فاجعَلْ إِزاءَه + رجوعاً إلى ربٍّ يقيك الْمَحَاذِرَا
ولا تخشَ أمرًا أنت فيه مُفَوِّضٌ + إلى الله غاياتٍ له ومصادرا
وكُنْ للذي يقضي به اللهُ وحدَه + وإنْ لم توافقه الأمانيُّ شاكرا
وإني كفيلٌ بالنجاء من الأذى + لمن لم يبتْ يدعو سوى الله ناصرا
ولا تخشَ أمرًا أنت فيه مُفَوِّضٌ + إلى الله غاياتٍ له ومصادرا
وكُنْ للذي يقضي به اللهُ وحدَه + وإنْ لم توافقه الأمانيُّ شاكرا
وإني كفيلٌ بالنجاء من الأذى + لمن لم يبتْ يدعو سوى الله ناصرا
‘ভয় যদি পাও কোন কিছুর সামনে রাখ রবকে তোমার,
দূর হবে যে সকল বাধা, বিপত্তি কভু থাকবে না আর।
সমর্পিত যে আল্লাহতে তার তরে নেই কোন ডর
উপায় একটা হবেই হবে চিন্তা কভু করো না আর।
আল্লাহর যা ফায়ছালা হয় তাতে থাক শোকরগুযার
যদিও তাতে কখনও কখনও পূরণ না হয় আরয তোমার।
কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের আমি (কবি) হব যামিন তার,
আল্লাহ ছেড়ে অন্যেরে যেচে কখনই রাত কাটে না যার’।
সুতরাং অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে গেলে তাতেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, অন্য কাউকে ভয় করা চলবে না। তোমার যে কোন কাজ যখন তুমি আল্লাহর নিকট ন্যস্ত করবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে তাঁর দিকে ফিরে যাবে তখন আল্লাহর মর্যি মোতাবেক তিনি তোমাকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন।
উপায়-উপকরণ বা মাধ্যম গ্রহণ :
যে কোন চাহিদা পূরণে উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম গ্রহণ না করা কোন অবস্থাতেই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসার মর্মার্থ নয়। তাওয়াক্কুলের বরং দু’টি দিক রয়েছে। এক. আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা। দুই. তাঁর সাথে কাজের উপকরণ অবলম্বন করা।
আসলে লক্ষণীয় যা তা হ’ল- শুধুই উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর না করা। বান্দাকে জানতে ও বুঝতে হবে যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে চাহিদা পূরণ ও সমস্যা সমাধান কেবল জাগতিক নিয়ম মাত্র। উপকারকারী ও অপকারকারী কেবলই আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,
سر التوكل وحقيقته هو اعتماد القلب على الله وحده، فلا يضره مباشرة الأسباب مع خلو القلب من الاعتماد عليها والركون إليها-
‘তাওয়াক্কুলের রহস্য ও তাৎপর্য হ’ল- বান্দার অন্তর এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া; জাগতিক উপায়-উপকরণের প্রতি অন্তরের মোহশূন্য থাকা, তার প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া। এসব উপায়-উপকরণের সরাসরি ক্ষতি কিংবা উপকার করার কোনই ক্ষমতা নেই’।[11]
আল্লাহর উপর প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারী এবং তাওয়াক্কুলের মৌখিক দাবীদারদের মধ্যে এটাই বুনিয়াদী পার্থক্য। কেননা প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারীর উপায়-উপকরণ যদি হাতছাড়া হয়েও যায় তবুও তার কিছু যায় আসে না, সে তো ভাল করেই জানে, যে আল্লাহর উপর সে নির্ভর করে তিনি নিত্য ও চিরস্থায়ী। কিন্তু তাওয়াক্কুলের মৌখিক দাবীদারের জাগতিক উপায়-উপকরণ হাতছাড়া হওয়ার সাথে সাথে সে ভেঙ্গে পড়ে। আল্লাহর উপর ভরসার মাত্রা দুর্বল হওয়ার কারণেই তার এমনটা হয়।
নবী করীম (ﷺ)-এর উপায়-উপকরণ গ্রহণ :
নবী করীম (ﷺ) ছিলেন আল্লাহর উপর সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী। তা সত্ত্বেও তিনি বহুক্ষেত্রে জাগতিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন করেছেন তাঁর উম্মতকে একথা বুঝানোর জন্য যে, উপায়-উকরণ গ্রহণ তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।
ওহোদ যুদ্ধে তিনি একটার পর একটা করে দু’টো বর্ম গায়ে দিয়েছিলেন। সায়েব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে,
أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ظَاهَرَ بَيْنَ دِرْعَيْنِ يَوْمَ أُحُدٍ-
‘ওহোদ যুদ্ধের দিনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’টি বর্ম পরে জনসমক্ষে এসেছিলেন’।[12] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মতের জন্যও যুদ্ধের পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন।[13]
মক্কা বিজয়ের দিনে তিনি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেছিলেন। আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلَ مَكَّةَ يَوْمَ الْفَتْحِ وَعَلَى رَأْسِهِ الْمِغْفَرُ
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা বিজয় দিবসে যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথায় শিরস্ত্রাণ ছিল’।[14]
হিজরতের সময় তিনি একজন পথপ্রদর্শক সাথে নিয়েছিলেন, যে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যাত্রাপথে কোন পদচিহ্ন যাতে না থাকে তিনি সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। তিনি যাত্রার জন্য এমন সময় বেছে নিয়েছিলেন যখন লোকজন সাধারণতঃ সজাগ থাকে না। আবার জনগণ সচরাচর যে পথে চলাচল করে তিনি তা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা ধরেছিলেন।
এসব কিছুই উপায় ও মাধ্যম অবলম্বনের অন্তর্গত। তিনি তাঁর উম্মতকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর উপর ভরসাকারী কোন মুসলিমই উপায়-উপকরণ গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে পারে না।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُوْنَ عَلَى اللهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا تُرْزَقُ الطَّيْرُ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوْحُ بِطَانًا-
‘তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে তাহ’লে পাখ-পাখালির মতই তোমরা জীবিকা পেতে। তারা ভোর বেলায় ওঠে ক্ষুধার্ত অবস্থায় আর সন্ধ্যায় ভরাপেটে নীড়ে ফেরে’।[15]
এ হাদীসে উপায়-উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। যে পাখির খাবার যোগাড়ের দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন সে তো তার কাছে খাবার আপনা থেকে আসবে সেই আশায় তার বাসায় বসে থাকে না। বরং খুব ভোরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। আল্লাহ তার ইচ্ছে পূরণ করে দেন। ফলে সে যখন বাসায় ফিরে তখন তার পেট ভরা ও পরিতৃপ্ত থাকে।
অবশ্য মুসলমানকে জাগতিক কোন উপকরণ ও পন্থা অবলম্বন করতে হ’লে প্রথমেই তাকে দেখতে হবে শরী‘আতের নিরিখে তা বৈধ কি-না। আমরা কিছু লোককে দেখি, তারা তাদের উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য কর্মচারীদের ঘুষ প্রদান করে আর বলে, এটা তাওয়াক্কুলের অংশ। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় নকল করে অথচ বলে এটাও তাওয়াক্কুল। অথচ এর কোনটাই আদৌ তাওয়াক্কুল নয়। বরং এগুলো তাওয়াক্কুলের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধী। এহেন মুসলিম যদি আল্লাহর উপর প্রকৃতই ভরসা করত তাহ’লে তারা কখনই শরী‘আত গর্হিত কোন কাজ করত না।
তাওয়াক্কুল ও তাওয়াকুলের (ভানের) মধ্যে পার্থক্য :
পূর্বেই বলা হয়েছে তাওয়াক্কুলের জন্য বিভিন্ন উপায়-উপকরণ ও কাজের পথ অবলম্বন অপরিহার্য। কিন্তু কোন কিছু না করে নিশ্চেষ্ট বসে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়; বরং তা তাওয়াক্কুলের ভান। আরবীতে একে ‘তাওয়াকুল’ (تواكل) বলে। তাওয়াকুল বা নিশ্চেষ্ট বসে থেকে আল্লাহর উপর ভরসা যাহির করা আল্লাহর দ্বীনের কোন কিছুতেই পড়ে না।
বলা হয়ে থাকে, যে তাওয়াক্কুল ছেড়ে দেয় তার তাওহীদে খুঁত তৈরী হয়, আর যে জাগতিক উপায়-উপকরণ বা কাজকর্ম ছেড়ে দেয় তার বিবেক-বুদ্ধি বিনষ্ট হয়ে যায়। মুসলিম জাতির দুর্বলতার অন্যতম কারণ এই তাওয়াকুল বা নিশ্চেষ্ট বসে থেকে সময় পার করা। লোকে বাড়ি বসে থেকে জীবিকা লাভের আশা করে, একটু নড়েচড়ে দেখে না; আবার দাবী করে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। লোকেরা আশায় থাকে যে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন অথচ সেজন্য তাদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, যুদ্ধের প্রস্ত্ততিজনিত অস্ত্র-শস্ত্র এবং আনুষঙ্গিক জিনিসের কোনই ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেই।
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
كَانَ أَهْلُ الْيَمَنِ يَحُجُّوْنَ وَلاَ يَتَزَوَّدُوْنَ وَيَقُوْلُوْنَ نَحْنُ الْمُتَوَكِّلُوْنَ، فَإِذَا قَدِمُوْا مَكَّةَ سَأَلُوْا النَّاسَ
‘ইয়ামানবাসীরা হজ্জ করতে আসত কিন্তু পথখরচ আনত না। তারা বলত, আমরা আল্লাহর উপর ভরসাকারী। তারপর যখন তারা মক্কায় পৌঁছত তখন মানুষের কাছে হাত পাতত’। এতদপ্রেক্ষিতে আল্লাহ নাযিল করেন,
وَتَزَوَّدُوْا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى
‘আর (হজ্জের জন্য) তোমরা পাথেয় সাথে নাও। নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পাথেয় হ’ল আল্লাহভীতি’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)।[16]
দেখুন, কিভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওয়াক্কুলের দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন; অথচ তারা তো হজ্জের কাজে লাগতে পারে এমন কোন পাথেয়ই সাথে না এনে কেবলই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছিল। আবার তাওয়াক্কুলের ঈপ্সিত লক্ষ্য এটাও নয় যে, বান্দা উপকরণের পেছনে তার জীবনপাত করবে এবং সাধ্যাতীত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে। বরং কখনো কখনো তার জন্য সহজ ও লঘু উপকরণও যথেষ্ট হ’তে পারে। তার প্রমাণ মারইয়াম (আঃ)-এর ঘটনা। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে খেজুর গাছ ধরে ঝাঁকি দিতে বলেছিলেন, যাতে তাঁর সামনে খেজুর ঝরে পড়ে। আল্লাহ বলেন,
وَهُزِّيْ إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا
‘আর তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দাও। সেটি তোমার উপর পাকা খেজুর নিক্ষেপ করবে’ (মারিয়াম ১৯/২৫)।
অনেকের মনে বিস্ময় জাগে- এহেন দুর্বল গর্ভবতী মহিলা কিভাবে মযবূত ও শক্ত খেজুর গাছ ধরে এমনভাবে ঝাঁকি দিল যে টপটপ করে খেজুর ঝড়ে পড়ল? আমরা বলি, হ্যাঁ, এই মহীয়সী মহিলার ঘটনা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব শিক্ষা দিয়েছেন- চাই সেসব উপকরণ লঘু ও দুর্বল হৌক। কেননা এই সতী-সাধ্বী মহিলার সেই মুহূর্তে এরূপ দুর্বল ধরনের কাজ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোন মাধ্যম ছাড়াই খেজুর নীচে ফেলানো অবশ্যই সম্ভব ছিল। কিন্তু যেহেতু কোন কিছু পেতে হ’লে মাধ্যম একটি জাগতিক নিয়ম হিসাবে রয়েছে, সেহেতু আল্লাহ মারিয়াম (আঃ)-কে কান্ড ধরে ঝাঁকি দিতে বলেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আল্লাহর উপর যথাযথভাবে ভরসা করেছিলেন এবং তাঁর দুর্বল পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলেন তখন আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা ফলবতী করেছিলেন এবং ফলগুলোকে তাঁর নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছিলেন। কবি বলেছেন,
توكَّل على الرَّحمن في كلِّ حاجةٍ + ولا تؤثرنّ العجز يوماً على الطّلبْ
ألم تر أن الله قال لمريم + إليك فهزِّي الجذع يسَّاقط الرُّطبْ
ولو شاء أن تجنيه من غير هزِّها + جنته ولكن كلُّ شيءٍ له سببْ
ভরসা কর সকল কাজে আল্লাহ দয়াময়ের পরে
প্রাধান্য দিও না অক্ষমতাকে চেষ্টার পরে মুহূর্ত তরে।
তুমি কি দেখনি, বলেছেন আল্লাহ মারিয়ামকে
খেজুর পেতে নাড়া দাও তুমি খেজুর গাছের কান্ডটাকে
চাইলে তিনি দিতেন খেজুর ঝাঁকি ছাড়াই
কিন্তু কিছু পাইতে হ’লে উপকরণ বিনে উপায় নাই।[17]
যখন মানুষ সম্ভাব্য সব উপকরণ হারিয়ে ফেলে তখন যেন সে সবচেয়ে মহান ও শক্তিশালী উপকরণের কথা ভুলে না যায়। তাহ’ল মহান আল্লাহর সমীপে দো‘আ ও ফরিয়াদ।
তাওয়াক্কুলের হুকুম :
নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা শীর্ষস্তরের ফরযসমূহের অন্তর্গত একটি বড় ফরয। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
فإن التوكل على الله واجب من أعظم الواجبات كما أن الإخلاص لله واجب وقد أمر الله بالتوكل في غير آية أعظم مما أمر بالوضوء وغسل الجنابة، ونهى عن التوكل على غيره سبحانه-
‘আল্লাহর উপর ভরসা করা ফরয। এটি উচ্চাঙ্গের ফরয সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহর জন্য ইখলাছ বা বিশুদ্ধচিত্তে কাজ করা ফরয। ওযূ ও অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতার জন্য গোসলের ব্যাপারে যেখানে আল্লাহ তা‘আলা একটি আয়াতে একবার বলে তা ফরয সাব্যস্ত করেছেন, সেখানে একাধিক আয়াতে তিনি তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করতে নিষেধ করেছেন’।[18]
বরং তাওয়াক্কুল ঈমানের শর্ত। এজন্য আল্লাহর বাণী
وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘আর আল্লাহর উপরে তোমরা ভরসা কর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (মায়েদাহ ৫/২৩) এই আয়াতের মর্মার্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, বান্দার থেকে তাওয়াক্কুল দূর হয়ে গেলে সাথে সাথে ঈমানও দূর হয়ে যাবে।
তাওয়াক্কুল তাওহীদে উলূহিয়্যা বা উপাস্যের একত্ববাদের যেসব ভিত্তি রয়েছে তন্মধ্যে একটি। সূরা ফাতিহার পাঁচ নং আয়াত একথার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ বলেন,
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং
একমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৫)।
তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধকরণমূলক আয়াত সমূহ :
তাওয়াক্কুল শব্দটি কুরআন মাজীদে ৪২ জায়গায় এসেছে। কখনো তা একবচনে, কখনো বহুবচনে, কখনো অতীতকালের শব্দে, কখনো বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের শব্দে, কখনোবা আদেশবাচক শব্দে। সবগুলো শব্দই আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা এবং তাঁর নিকট কার্যভার অর্পণ অর্থে এসেছে।
তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে কুরআন মাজীদের বর্ণনাভঙ্গি নানারূপ ধারণ করেছে। এখানে তার কিছু তুলে ধরা হ’ল।
(ক) আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবীকে তাওয়াক্কুলের আদেশ :
কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে তাঁর নবীকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন :
فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّكَ عَلَى الْحَقِّ الْمُبِينِ
‘অতএব তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর। তুমি তো স্পষ্ট সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (নামল ২৭/৭৯)।
আল্লাহ বলেন,
فَاعْبُدْهُ وَتَوَكَّلْ عَلَيْهِ
‘অতএব তুমি তাঁর ইবাদত কর ও তাঁর উপরেই ভরসা কর’ (হূদ ১১/১২৩)। আল্লাহ আরও বলেন,
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِيْ لاَ يَمُوْتُ وَسَبِّحْ بِحَمْدِهِ وَكَفَى بِهِ بِذُنُوْبِ عِبَادِهِ خَبِيرًا-
‘আর তুমি ভরসা কর সেই চিরঞ্জীব সত্তার উপর, যাঁর মৃত্যু নেই এবং তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর। বস্ত্ততঃ জান্নাতী বান্দাদের পাপসমূহের খবর রাখার ব্যাপারে তিনিই যথেষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৫৮)।
আল্লাহ বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ-
‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
মহান আল্লাহ বলেন,
فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ-
‘এতদসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। আর তিনিই হচ্ছেন মহান আরশের মালিক’ (তওবা ৯/১২৯)।
আল্লাহ আরো বলেন,
قُلْ هُوَ الرَّحْمَنُ آمَنَّا بِهِ وَعَلَيْهِ تَوَكَّلْنَا فَسَتَعْلَمُونَ مَنْ هُوَ فِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ-
‘তুমি বল, তিনি তো সেই দয়াময় (আল্লাহ)। আমরা তাঁর উপর ঈমান এনেছি এবং ভরসা করেছি। অতঃপর কারা সুস্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল তা অচিরেই তোমরা জানতে পারবে’ (মুলক ৬৭/২৯)।
আর আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবীকে তাওয়াক্কুল করার হুকুম দেওয়ার অর্থ তাঁর উম্মতকে হুকুম দেওয়া।
(খ) আল্লাহ কর্তৃক তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ : আল্লাহ তা‘আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর উপর ভরসা করতে আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ
‘আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ৩/১২২)।
(গ) মুমিনরা তাদের রবের উপর ‘তাওয়াক্কুলকারী’ বিশেষণে বিশেষিত : আল্লাহর উপর ভরসা করা দয়াময় আল্লাহর বান্দাদের একটি বড় গুণ। এটি তাদের এমন একটি প্রতীক, যা দ্বারা অন্যদের থেকে তাদের পৃথক করা যায়। মুমিনদের জন্য এটি একটি সুস্পষ্ট চিহ্ন।
আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ-
‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)।
‘তারা তাদের মালিকের উপরই ভরসা করে’- বাক্যটির মর্মার্থ হ’ল- তারা আল্লাহকে ছাড়া কাউকে আকাঙ্ক্ষা করে না; তিনি ছাড়া কেউ তাদের উদ্দেশ্য নয়; তারা তাঁর নিকট ছাড়া কোথাও আশ্রয় নেয় না; তারা কেবলই তাঁর নিকট তাদের প্রয়োজন পূরণের আবেদন জানায়; তারা তাকে ছাড়া আর কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না। তারা জানে যে, তিনি যা চান তাই হয় এবং তিনি যা চান না তা হয় না। তিনিই ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রয়োগকারী, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর হুকুম রদ করার শক্তিও কারো নেই এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ)।[19]
(ঘ) নবীগণের তাওয়াক্কুলের কতিপয় উদাহরণ :
আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণের জন্য আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِيْ إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ
‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৬০/৪)।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাদের নিকট তাদের সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা তাদের ঈমানী শক্তির কারণে বলেছিল,
رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيْرُ
‘হে আমাদের মালিক! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। আর তোমার নিকটেই তো প্রত্যাবর্তন স্থল’ (মুমতাহিনা ৬০/৪)। অর্থাৎ আমাদের যাবতীয় কাজে আমরা তোমারই উপর ভরসা করি এবং তোমারই নিকট সব কাজ সমর্পণ ও সোপর্দ করেছি। এমনিভাবে তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন এবং যাবতীয় কাজ আল্লাহর কাছে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করেছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তারা তাওয়াক্কুলকে সাথী করে নিয়েছিলেন। দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তারা তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-কে তো তাঁর জাতি পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিল। এজন্য তারা প্রচুর জ্বালানী কাঠ যোগাড় করেছিল। সুদ্দী বলেন, সে সময় একজন মহিলা অসুস্থ হ’লে সে মানত করত যদি সে সুস্থ হয়ে ওঠে তাহ’লে ইবরাহীমকে পোড়ানোর জন্য এক বোঝা কাঠ সে বয়ে দিয়ে আসবে।[20]
তারপর তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে পোড়ানোর জন্য বড় একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে কাঠ জমা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন যখন খুব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তার লেলিহান শিখা বিস্তার করতে থাকে, তখন মিনজানীক নামক এক ধরনের যন্ত্রে করে তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে ঐ আগুনে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার সময় ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন,
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে এসেছে তিনি বলেন, ‘ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে ফেলা হয় তখন তিনি বলেছিলেন
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’।[21]
মূসা (আঃ)-কে দেখুন, কিভাবে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন এবং তাঁর জাতিকে তার উপর ভরসা করতে হুকুম দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَقَالَ مُوسَى يَا قَوْمِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِيْنَ-
‘আর মূসা (তার নির্যাতিত কওমকে সান্ত্বনা দিয়ে) বলল, হে আমার কওম! যদি তোমরা (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহর উপর ঈমান এনে থাক, তাহ’লে তাঁর উপরেই তোমরা ভরসা কর। যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হয়ে থাক’ (ইউনুস ১০/৮৪)।
শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, আয়াতের অর্থ এই যে, মূসা (আঃ) তাঁর উম্মাতকে আল্লাহ কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, তারা যেন স্বৈরাচারীদের ভয়ে পিছটান না দেয়; বরং সামনে এগিয়ে যায়, তাদের ভয় না করে, তাদের দেখে তটস্থ ও সন্ত্রস্ত না হয়। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে তারা যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে। তারা যেন বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার সত্যি-সত্যিই বাস্তবায়ন করবেন, যদি তারা মুমিন হয়।[22]
উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। ওহোদ যুদ্ধের প্রাক্কালের ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
الَّذِيْنَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوْا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيْمَانًا وَقَالُوْا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ-
‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন,
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্ম বিধায়ক’- বাক্যটি ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন, আর মুহাম্মাদ (ﷺ) এটি বলেছিলেন যখন কাফিররা বলেছিল, ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।[23]
সুতরাং যখন ইসলাম বিরোধীরা মুসলমানদের হুমকি দেয় এবং শত্রুপক্ষের জনশক্তি ও অস্ত্র শক্তির ভয় দেখায়, তখন এই তাওয়াক্কুলই মুমিনদের একমাত্র অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। কবি বলেন,
هو القريب المجيب المستغاث به + قل حسبي الله معبودي ومُتّكلي
খুব নিকটে আছেন, তিনি দো‘আ কবুলকারী,
সুখে-দুঃখে তাঁরই কাছে এস আরয করি।
বল সবে আমার তরে আল্লাহ যথেষ্ট,
মা‘বূদ আমার, ভরসা আমার সকলের ইষ্ট।
[1]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১১/৭৩৪।
[2]. ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ৪৩৬।
[3]. ঐ, পৃঃ ৪৩৭।
[4]. মুরতাযা আয্-যুবায়দী, তাজুল ‘আরূস শীর্ষ শব্দ (وكل)।
[5]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ও রাসাইলু ইবনে উছায়মীন ১/৬৩।
[6]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা ৭/২০২।
[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ২/১১৩।
[8]. ঐ, ১/৮১।
[9]. শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ, তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ৮৬।
[10]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৭/১৭৭।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, পৃঃ ৮৭।
[12]. আহমাদ হা/১৫৭৬০, শু‘আইব আল-আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ গণ্য করেছেন।
[13]. সহীহ ইবনু হিববান হা/৭০২৮।
[14]. বুখারী হা/৪২৮৬; মুসলিম হা/১৩৫৭; মিশকাত হা/২৭১৮।
[15]. তিরমিযী হা/২৩৪৪; ইবনু মাজাহ হা/৪১৬৪; হাকেম হা/৭৮৯৪, ৪/৩৫৪; মিশকাত হা/৫২৯৯।
[16]. বুখারী হা/১৫২৩; মিশকাত হা/২৫৩৩।
[17]. ইবনু আব্দিল বার্র, বাহজাতুল মাজালিস ওয়া উনসুল মাজালিস, ১/২৬ পৃঃ।
[18]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ৭/১৬।
[19]. তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৩৭৯।
[20]. ঐ, ৩/২৭৪।
[21]. সহীহ বুখারী হা/৪৫৬৩।
[22]. তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ৪৩৮।
[23]. বুখারী হা/৪৫৬৩।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: