আন্দোলনধর্মী সংঘবদ্ধ দা‘ওয়াতী কার্যক্রম যদি সালাফে ছালেহীনের মূলনীতি এবং সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আপনার(ইমাম আলবানী) মতামত কি?
উত্তর: বর্তমান প্রচলিত সংগঠন এবং প্রচলিত সুবিন্যস্ত দা‘ওয়াতী কার্যক্রমে আমরা বিশ্বাস করি না। কেননা সংগঠন মুসলিমদেরকে তাদের দ্বীনী দায়িত্ব পালনে অক্ষম করে ফেলে। উল্লেখ্য যে, التنظيم ‘আত-তানযীম’ শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়; প্রথমত: এটি ব্যাপক অর্থে গোপন কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয়ত: সংক্ষিপ্ত পরিসরে এটি তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ, আরবী ব্যকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে মুসলিমদেরকে পাঠদানের সুবিন্যস্ত বন্দোবস্তকে বুঝায়। তবে এই ধরনের প্রশ্নে সাধারণতঃ দ্বিতীয় অর্থটি উদ্দেশ্য নয়; বরং দলাদলি সম্পর্কে জানতে চাওয়াই এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য। বর্তমানে বিভিন্ন জামা‘আত ও সংগঠনের অবস্থা হচ্ছে, তারা পরস্পরে বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করছে, প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন কর্মপদ্ধতি ও মূলনীতি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি জামা‘আতের পৃথক পৃথক অনুসরণীয় দলপ্রধান রয়েছেন। মনে রাখতে হবে, ইসলামের সাথে এসব সংগঠনের কোনই সম্পর্ক নেই। এমনিতেই আমরা দলাদলির মধ্যে বসবাস করছি, এর পরে যদি আমরা আবার নতুন নতুন দল গঠন করি, তাহলে এর মানে হচ্ছে আমরা দলাদলি ও মতানৈক্যের পরিমণ্ডল আরো লম্বা করলাম। সেজন্য আমরা প্রচলিত এসব সাংগঠনিক কার্যক্রমকে সমর্থন করি না।
এখানে আমি একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যে বিষয়ে বিশেষ করে ভাল মনের অনেক মানুষ সজাগ নন; বর্তমান ইসলামী বিশ্বে বিপ্লব ও জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা ২০/৩০ বছর আগে ছিল না। আমার মত বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা বলতে পারবেন যে, আগে এসব ছিল না। বর্তমান এই জাগরণের সাথে একই ধাঁচে যুক্ত হয়েছে কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফে ছালেহীনের মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতির দিকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান। ইদানীং শেষোক্ত দা‘ওয়াতের ব্যাপক সাড়া পড়েছে এবং অন্যান্য দলের লোকেরা মনে করছে, দেশ এখন সালাফী দা‘ওয়াতের দখলে। সেকারণে প্রচলিত সালাফী দা‘ওয়াত এখন ‘সালাফী’ নাম দিয়ে বিভিন্ন দল গঠনের সুযোগ গ্রহণ করছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সালাফী দা‘ওয়াত এসব দলাদলির অনেক ঊর্ধ্বে। সালাফে ছালেহীন কি এমন দলাদলির সৃষ্টি করেছিলেন?! কখনই না। এসব দলাদলি তো দূরের কথা তারা এমনকি রাজনৈতিক দলাদলিতেও বিশ্বাসী ছিলেন না। এসব দলাদলি ইসলাম পরিপন্থী। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَا تَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٣١ مِنَ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗاۖ كُلُّ حِزۡبِۢ بِمَا لَدَيۡهِمۡ فَرِحُونَ ٣٢ ﴾ [الروم: ٣١، ٣٢]
‘আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত’ (আর-রূম ৩১-৩২)। সত্যিকার অর্থে এটিই হচ্ছে বর্তমান দলাদলির বাস্তব চিত্র। আমার মতে, কোনো দলের সাথে ‘সালাফী’ শব্দটির ব্যবহার বিদ‘আতের সাথে ‘ইসলামী’ শব্দটি ব্যবহারের মত। যাহোক, সালাফী দা‘ওয়াতে বিশ্বাসীদের মন কাড়ার জন্য এখন এই শব্দটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ প্রকৃত সালাফী দা‘ওয়াত কখনই কোনো প্রকার দলাদলি সমর্থন করে না, যদিও বিশ্ব সেরা মানুষটিও সেই দলাদলির পুরোধা হন।
কেউ দলাদলির দিকে আহ্বান করলেই বুঝতে হবে, সে সরল-সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করেছে। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবায়ে কেরামের সাথে বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় তিনি মাটির উপর সোজা একটি দাগ টেনে নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করেন,
﴿ وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ﴾ [الانعام: ١٥٣]
‘নিশ্চয়ই এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথেই চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে’ (আল-আন‘আম ১৫৩)। অতঃপর সোজা দাগটির পাশে ছোট ছোট আরো কিছু দাগ টেনে বললেন, ‘এই সোজা দাগটিই হচ্ছে আল্লাহ্র পথ এবং এর দু’পাশের দাগগুলি এমন পথ, যেগুলির প্রত্যেকটির শেষ প্রান্তে শয়তান রয়েছে। সে মানুষদেরকে তার দিকে ডাকছে’। সরল-সোজা পথটির আশপাশের পথগুলি শুধুমাত্র প্রাচীন ছূফীদের পথ নয়; বরং আধুনিক নতুন নতুন দলগুলিও উক্ত পথের অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে বিভ্রান্ত যেসব পথের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটি আগে ভিন্ন আক্বীদা পোষণ করত এবং রাজনীতির সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। যেমন: মু‘তাযিলা, মুরজিয়া ইত্যাদি। আবার সেসব দলের কোনো কোনটি সরাসরি রাজনৈতিক দল ছিল। যেমন: খারেজী মতবাদ, যার মূলনীতিই হচ্ছে মুসলিম সরকারের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ। পরিশেষে বলব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট ছোট যেসব পথের কথা বলেছেন, সেগুলো তাঁর আঁকা সোজা পথের বাইরের সব পথ, মত ও পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
যদি কেউ বলে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব দলের প্রয়োজন রয়েছে। জবাবে আমরা বলব, শরী‘আত বিরোধী কোনো কাজ করে কোনো প্রকার কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। তাছাড়া এসব মুসলিমদেরকে দলে-উপদলে বিভক্ত করে ফেলছে, প্রত্যেকটি দল নিজের মূলনীতি নিয়ে খুশী থাকছে।([1])
([1]) ‘আল-হুদা ওয়ান নূর’ ক্যাসেট সিরিজের ১/৩৪০ নং ক্যাসেট থেকে সংগৃহীত।
বইঃ দল, সংগঠন, ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বক্তব্য