- Joined
- Jul 24, 2023
- Threads
- 520
- Comments
- 533
- Reactions
- 5,567
- Thread Author
- #1
অল্পে তুষ্টি অর্জনে অন্তরায়সমূহ :
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সফলতা হ’ল অল্পে তুষ্টির গুণ লাভ করা। যারা এই বৈশিষ্ট্য লাভ করে সুখ-শান্তির জন্য তাদেরকে হাপিত্যেশ করতে হয় না। অনাবিল প্রশান্তিতে তাদের হৃদয় জগৎ সর্বদা ভরপুর থাকে। পক্ষান্তরে অল্পে তুষ্ট থাকতে না পারা চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক। মানুষের প্রত্যেক পরাজয় ও ব্যর্থতার পিছনে যেমন মূখ্য ও গৌণ কিছু কারণ থাকে। তেমনি অল্পে তুষ্ট থাকতে না পারারও কিছু কারণ আছে। পরিতুষ্ট জীবন গঠনের জন্য এই কারণগুলো জানা উচিত, যেন তা আমাদের সুখ ও সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। নিম্নে কারণগুলো আলোকপাত করা হ’ল-
১. তাক্বদীরের প্রতি দুর্বল বিশ্বাস :
অল্পে তুষ্ট না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল তাক্বদীরের প্রতি দুর্বল বিশ্বাস। ঈমানের অন্যান্য শাখার প্রতি স্বচ্ছ বিশ্বাস থাকলেও, তাক্বদীরের মন্দ ফায়ছালার ক্ষেত্রে অনেক ধার্মিক মানুষের ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সেই হাদীসটি সর্বদা মনে রাখা উচিত, যেখানে তিনি বলেছেন,
‘আল্লাহ আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে সকল মাখলূক্বের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন’।[1] অর্থাৎ আমাদের জীবনের সকল কিছু পূর্ব নির্ধারিত। যেমন আমরা জীবনে কত টাকা উপার্জন করব, ধনী না-কি গরীব হব, কি পানাহার করব সব কিছুই আল্লাহ আগে থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। কোন প্রাণী তার তাক্বদীরে বণ্টিত রিযিক পরিপূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। এমনকি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিলম্ব হ’লেও সে তা পেয়ে যাবে।[2]
তাক্বদীরের এই বিষয়গুলোর প্রতি মানুষের বিশ্বাস যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন সে অল্পে তুষ্ট থাকতে পারে না এবং জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও বিপদাপদে অস্থির হয়ে পড়ে। আবার কখনো নিজের মন্দ ভাগ্যকে দোষারোপ করে থাকে। ফুযাইল ইবনু ইয়ায (রহঃ) বলেন, ‘আমি সেই ব্যক্তিকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই, যে তাক্বদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, আবার রিযিকের ব্যাপারে পেরেশান হয়ে পড়ে’।[3]
২. আখেরাতের উপর পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া :
যারা তাদের পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে চলেন, কেবল তারাই অল্পে তুষ্ট থাকতে সক্ষম হন। কেননা তারা দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাতের জীবন বিনষ্ট করেন না। ফলে জীবন ধারণের জন্য সামান্য কিছু পেয়েই তারা খুশি থাকেন। পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেন, তারা অল্পে তুষ্ট থাকতে পারেন না। কেননা তাদের চিন্তা-চেতনা দুনিয়া কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন,
‘বস্ত্ততঃ তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক। অথচ আখেরাত হ’ল উত্তম ও চিরস্থায়ী’ (আ‘লা ৮৭/১৬-১৭)।
আওন ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,
‘আমাদের সালাফগণ দুনিয়ার জন্য তা-ই রাখতেন, যা তাদের আখেরাত নিশ্চিত হওয়ার পরে অবশিষ্ট থাকত। অন্যদিকে তোমরা তোমাদের আখেরাতের জন্য তা-ই রেখে দাও, যা দুনিয়া নিশ্চিত হওয়ার পরে অবশিষ্ট থাকে’।[4]
সালাফগণ আরো বলেন,
‘দুনিয়া অন্বেষণকারীর উপমা হ’ল সাগরের (লোনা) পানি পানকারীর মত। সে যতই পান করে, তার তৃষ্ণা ততই বেড়ে যায়। তাই সে পান করতেই থাকে। অবশেষে সেই লবণাক্ত পানি তাকে হত্যা করে ফেলে’।[5] সুতরাং মানুষ পার্থিব জীবনকে যত অগ্রাধিকার দিবে, দুনিয়ার প্রতি তার আসক্তি ততটাই তীব্রতর হবে। ফলে তার জন্য অল্পে তুষ্ট থাকাও সুদূর পরাহত হবে।
৩. মৃত্যুকে কম স্মরণ করা :
অল্পে তুষ্ট না থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল মৃত্যুকে কম স্মরণ করা। কেননা যিনি তার চিন্তা-চেতনায় মৃত্যুর কথা মনে রাখেন, মৃত্যুর ভাবনায় নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন, তার মাঝে না থাকে না পাওয়ার আক্ষেপ এবং অধিক পাওয়ার তৃষ্ণা। অপরদিকে যার মধ্যে মৃত্যুর ভাবনা যত কম, দুনিয়া কেন্দ্রীক তার আশা-আকাঙক্ষাও বেশী। ফলে অল্পে তুষ্ট থাকা তার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা দুনিয়ার স্বাদ হরণকারী মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ কর’।[6]
মৃত্যুর চিন্তাই একজন মানুষের জীবনাচারকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করতে পারে। আর মরণের ভয় থেকে যারা গাফেল থাকে, তাদের জীবন হয় বল্গাহীন এবং তারা পার্থিব সামান্য ধন-সম্পদে কখনো পরিতুষ্ট থাকতে পারে না।
৪. বিত্তশালী ও বিলাসী লোকদের সাথে অধিক মেলামেশা করা :
অল্পে তুষ্ট না থাকার আরেকটি কারণ হ’ল অধিক বিলাসী এবং নিজের চেয়ে বিত্তশালী লোকদের সাথে ওঠাবসা ও মেলামেশা করা। সাধারণ পরিবারের কোন ব্যক্তি যদি বিত্তশালী লোকের বাসায় বেশী যাতায়াত করে এবং অধিক মেলামেশা করে, তখন তার জন্য অল্পে তুষ্ট থাকা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা তখন সে তার বন্ধুর ঘরের আসবাব পত্র, পোষাক-পরিচ্ছদ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, গাড়ি-বাড়ি প্রভৃতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয় এবং নিজের জন্য সেরকম কামনা করতে থাকে। ফলে সে তার বন্ধুর মতো বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে এবং অল্পে তুষ্টির রাস্তা থেকে অনেক দূরে সরে যায়।
ইবনুল মুবারক নিজে সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও সব সময় গরীব মানুষদের সাথে মিশতেন এবং বলতেন, ‘যখন আমি কোন ধনী ব্যক্তির বাড়িতে প্রবেশ করি এবং তার ঘরে আমার ঘরের চেয়ে দামী কার্পেট বিছানো দেখি, তখন নিজ গৃহের কার্পেটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। আবার যখন কোন গরীর লোকের বাড়িতে প্রবেশ করি, তখন নিজ গৃহের আসবাবপত্রের জন্য সহসাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারি’। সেজন্য নিজের শ্রেণীভুক্ত বা তার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে মিশলে এবং চলাফেরা করলে অল্পে তুষ্ট থাকা সহজ হয়। কিন্তু এর বিপরীতটা ঘটলে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা ছাড়া খুব কম সংখ্যক মানুষের পক্ষে অল্পে তুষ্ট থাকা সম্ভব হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, নিজের চেয়ে ধনী ও বিত্তশালী লোকদের সাথে মেশা যাবে না। বরং তাদের সাথে মেলামেশা হবে সীমিত এবং প্রয়োজন মাফিক।
একদিন আলী (রাঃ) ভাষণ দেওয়ার প্রাক্কালে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,
‘হে লোক সকল! তোমরা সেই ব্যক্তির মতো হয়ো না, যে আমল না করেই আখেরাতের জীবন প্রত্যাশা করে, দীর্ঘ আশা -আকাঙক্ষার কারণে তওবা করতে বিলম্ব করে, দুনিয়াদার হয়ে দুনিয়া বিমুখ ব্যক্তির মতো কথা বলে, (বাহ্যিকভাবে) অতি আগ্রহী ব্যক্তিদের মতো আমল করে। তাকে কিছু দেওয়া হ’লে পরিতৃপ্ত হয় না। আবার কিছু না দেওয়া হ’লেও পরিতুষ্ট থাকতে পারে না। আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে সে অপারগ হয়ে যায় এবং তার কাছে পর্যাপ্ত সম্পদ অবশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও আরো অধিক কামনা করে। আর তোমরা সেই ব্যক্তির মতোও হয়ো না, গরীবদের সাথে যিকর করার চেয়ে ধনীদের সাথে আনন্দ-বিনোদন করা যার কাছে অধিক পসন্দনীয়’।[7]
৫. দুনিয়াদারদের সাথে মেশা :
মানুষের মধ্যে অনুকরণ ও অনুসরণের প্রবণতা রয়েছে। সে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অন্যের অনুকরণ করে থাকে। ফলে ভালো মানুষের সাহচর্যে থাকলে, তার মাঝে ভালো গুণের সমাবেশ ঘটে। আর মন্দ লোকের সান্নিধ্যে গেলে, চরিত্রে ও চিন্তা-চেতনায় খারাপ গুণের প্রভাব পড়ে। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মন্দ লোকের সঙ্গী হওয়া থেকে আমাদের সতর্ক করেছেন। কেননা কেউ যদি পরহেযগার দ্বীনদার মানুষের সাথে মেশে, তার জীবন আখেরাতমুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু সে যদি দুনিয়াদার মানুষের সাথে মেশে, তার জীবনটা দুনিয়ামুখী হয়ে যায়। তাই অল্পে তুষ্ট থাকার জন্য দুনিয়াসক্ত মানুষের সংশ্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখা ঈমানী দায়িত্ব। তাই তো ওমর ফারূক (রাঃ) প্রায়ই উপদেশ দিয়ে বলতেন,
‘তোমরা দুনিয়াদার লোকদের কাছে যেয়ো না। কেননা এটা রিযিকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ’।[8] সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘যখন দেখি, কোন লোক দুনিয়ার প্রতি আসক্ত লোকদের সাথে বেশী মেলামেশা করছে, তখন বুঝতে পারি এই দুনিয়ার জীবনকেই সে ভালোবাসে’।[9] আর দুনিয়াদার লোকেরা যে কখনো অল্পে তুষ্ট থাকতে পারে না, তা সহজেই অনুমেয়।
৬. অধিক সম্পদ সঞ্চয়ের মানসিকতা :
সম্পদ সঞ্চয়ের প্রবল চিন্তা মানুষকে অল্পে তুষ্ট থাকতে দেয় না। মানুষের আয়-রোযগার যত বাড়ে, তার ব্যাংক-ব্যালেন্স সমৃদ্ধ করার চাহিদাও তত বেড়ে যায়। লক্ষ-কোটি টাকা রোযগার করার পরেও সে কামনা করে ইনকামটা যদি আরেকটু বাড়ানো যেত! মূলতঃ দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষের মাঝে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ জমানোর মানসিকতা সৃষ্টি হয়। ফলে তার অল্পে তুষ্ট থাকার পথটাও রুদ্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অল্পে তুষ্ট মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখাতে নিরুৎসাহিত করেছেন।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেলাল (রাঃ)-এর নিকট এলেন এবং তার ঘরে খেজুরের বড় স্তূপ দেখতে পেয়ে বললেন,
مَا هَذَا يَا بِلَالُ؟ ‘বেলাল এসব কি?’ বেলাল বললেন, شَيْءٌ ادَّخَرْتُهُ لِغَدٍ، ‘এসব আমি ভবিষ্যতের জন্য জমা করে রেখেছি’। এ কথা শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন,
‘তুমি কি কাল ক্বিয়ামতের দিনে এর থেকে জাহান্নামের তাপ অনুভবের ভয় করছ না? বেলাল! এসব তুমি দান করে দাও। আরশের মালিকের কাছে ভূখা-নাঙা থাকার ভয় করো না’।[10]
সুতরাং প্রয়োজনে শর্ত সাপেক্ষে এবং সীমিত পরিসরে সম্পদ সঞ্চয় করা বৈধ হ’লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ ধন-সম্পদ জমানোর তীব্র নেশায় দুনিয়ামুখী ও বস্ত্তবাদী হয়ে পড়ে এবং অল্পে পরিতুষ্ট থাকতে ব্যর্থ হয়।
৭. আল্লাহর অনুগ্রহকে উপলব্ধি না করা :
আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে তা-ই দিয়ে থাকেন, যেটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তার স্থূল দৃষ্টি দিয়ে সেই কল্যাণ দেখতে পায় না। ফলে আল্লাহর অনুগ্রহরাজিকে উপলব্ধি করতে এবং অল্পে তুষ্ট থাকতে সে অপারগ হয়ে যায়। আল্লাহ কোন বান্দার জন্য দারিদ্রের মাঝে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন, আবার কারো জন্য কল্যাণ রেখেছেন সম্পদের মাঝে। তিনি কাউকে ধন-দৌলত দিয়ে এবং কারো কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন। কিন্তু বান্দা যদি আল্লাহর অনুগ্রহ উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয়, তাহ’লে সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হ’তে পারে না। উপরন্তু হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে। কেননা সে শুধু ধন-সম্পদ অর্জন করতে পারলেই ভীষণ আনন্দিত হয়। ধন-সম্পদ না থাকাও যে আল্লাহর অনুগ্রহ হ’তে পারে, এটা সে কল্পনা করতে পারে না।
এ ব্যাপারে সালামাহ ইবনে দীনার (রহঃ)-এর উক্তিটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন,
‘আল্লাহ আমাকে এই দুনিয়ার বহুবিধ সম্ভার থেকে বঞ্চিত করে আমার উপর যে অনুগ্রহ করেছেন, সেটা ঐ অনুগ্রহের চেয়েও বড়, যা তিনি আমাকে দিয়েছেন। কেননা আমি এমন সম্প্রদায়কে দেখেছি, যাদেরকে আল্লাহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ দিয়েছেন, তারা (সেই সম্পদের কারণে) ধ্বংস হয়ে গেছে’।[11]
অতএব আমরাও যদি নিজেদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা না করি, তাহ’লে কখনোই আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারব না এবং অল্পে তুষ্ট থাকতে পারব না।
৮. মুবাহ ও অপ্রয়োজনীয় কাজে অধিক আত্মনিয়োগ করা :
হালাল বা বৈধ কাজকে মুবাহ বলা হয়। পানাহার, ঘুমানো, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, সাধ্যের মধ্যে উন্নত পোষাক পরিধান করা ইত্যাদি ‘মুবাহ’ কাজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কেউ যদি বিনা প্রয়োজনে বৈধ কাজে অত্যধিক আত্মনিয়োগ করে, তাহ’লে এটা তার জীবনে কুফল বয়ে আনে। যেমন পরিবারের ভরণ-পোষণ এবং জীবন ধারণের জন্য যতটুকু সম্পদ প্রয়োজন হয়, তার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য আল্লাহ ব্যবস্থা করেছেন। এক্ষণে কেউ যদি নিজের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় রোযগার করার পরেও সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য ইবাদত-বন্দেগী বাদ দিয়ে ব্যবসায় অত্যধিক সময় ব্যয় করে, তাহ’লে এই ব্যবসা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং তাকে আখেরাত থেকে বিমুখ করতে পারে। তাই তো প্রথম খলীফা আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বলেছেন,
‘আমরা সত্তরটি হালালের দরজা বন্ধ করে দিতাম, এই ভয়ে যে, যদি হারামের কোন একটি দরজায় ঢুকে পড়ি’।[12] সুতরাং কোন কিছু বৈধ হ’লেই যে সেটা ভোগ করতে হবে, এমন ধারণা পরিহার করা উচিত। বরং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ভোগ করা কর্তব্য।
কোন ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্টি এবং কোন ক্ষেত্রে নয় :
অল্পে তুষ্ট থাকার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র আছে এবং এটা স্থায়ী হ’তে পারে, আবার অস্থায়ীও হ’তে পারে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা (পার্থিব বিষয়ে) তোমাদের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকদের দিকে তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকিয়ো না, যে তোমাদের চেয়ে উঁচু পর্যায়ের। তাহ’লে তোমাদের জন্য এই পন্থা অবলম্বনই হ’বে আল্লাহর নে‘মতকে অবজ্ঞা না করার উপযুক্ত মাধ্যম’।[13]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণ বলেন, ‘মানুষের স্বভাব হ’ল সে যখন কারো মাঝে দুনিয়ার কল্যাণ দেখতে পায়, তখন সে নিজের মধ্যে অনুরূপ কল্যাণ কামনা করে। আর নিজের কাছে থাকা আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতকে সে কম মনে করে থাকে। ফলে তার নে‘মতের সাথে আরো যুক্ত হয়ে অপরের চেয়ে বেশী কিংবা সমান সমান হোক এটা সে কামনা করে। এটা অধিকাংশ লোকের স্বভাব বা প্রকৃতি। কিন্তু মানুষ যদি তার নিচের দিকে তাকাত, তাহ’লে তার নিজের ওপর আল্লাহর দেয়া নে‘মতরাজির বিষয়টি প্রকাশ পেত। ফলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করত এবং আল্লাহর কাছে নত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করত’।[14]
উপরোক্ত হাদীসে পার্থিব জীবনের ধন-সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি, স্ত্রী-সন্তান, বংশ-মর্যাদা, শারীরিক সৌন্দর্য-সুস্থতা, আয়-রোযগার প্রভৃতি বিষয়ে নিজের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের লোকদের দিকে তাকিয়ে অল্পে তুষ্ট থাকতে বলা হয়েছে। উপর পর্যায়ের লোকদের দিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব কুরআন ও হাদীসে যে অল্পে তুষ্টির কথা বলা হয়েছে, তার ক্ষেত্র মূলত এগুলোই। অর্থাৎ দুনিয়া কেন্দ্রীক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্ট থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অপর দিকে ইবাদত-বন্দেগী এবং আমল সম্পাদনের ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্ট থাকতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন কেউ যদি সালাত-ছিয়াম, কুরআন তেলাওয়াত, সামর্থ্য থাকা সত্তেও দান-ছাদাক্বাহ কম করে এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকে অথবা একেবারেই ইবাদত না করে খুশী থাকে, তাহ’লে এই অল্পে তুষ্টি রীতিমতো নিন্দনীয়। আবার কেউ যদি যথারীতি ফরয-নফল ইবাদত সম্পাদন করে, নিজের আমলে আত্মতুষ্ট হয়, তাহ’লে সেই আত্মতুষ্টিও ভৎর্সনাযোগ্য। কেননা মানুষ শুধু তার ইবাদতের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَنْ يُدْخِلَ أَحَدًا عَمَلُهُ الْجَنَّةَ، ‘তোমাদের কোন ব্যক্তিকে তার নেক আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না’। লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনাকেও কি নয়’? তিনি বললেন,
‘না, আমাকেও নয়। যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে তাঁর করুণা ও দয়া দিয়ে আবৃত করবেন। সুতরাং তোমরা (ইবাদতে) মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও’।[SUP][SUP][15][/SUP][/SUP]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে ক্ষমা ও রহমতের মাধ্যমে আবৃত করবেন’।[SUP][SUP][16][/SUP][/SUP]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘কোন বান্দা যদি মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকে অতিবৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদতে সিজদায় পড়ে থাকে, তবুও ক্বিয়ামতের দিন সারা জীবনের এই ইবাদত তার কাছে খুবই নগণ্য মনে হবে। তখন সে কামনা করবে, যদি তাকে আবার দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো হ’ত, তাহ’লে আরো বেশী প্রতিদান ও ছওয়াব লাভ করা যেত’।[17]
সুতরাং বান্দার আবশ্যিক কর্তব্য হ’ল নিজের আমলের ব্যাপারে মুগ্ধ ও তুষ্ট না থেকে সাধ্যানুযায়ী নেক আমল অব্যাহত রাখা। ভয় ও আশার মাঝে অবস্থান করে আল্লাহর আনুগত্য করে যাওয়া। কারণ আল্লাহ হয়তো তাকে আমল করার তাওফীক্ব দিয়েছেন, কিন্তু সেটা কবুলের দরজা বন্ধ রেখেছেন। তাই নিজের সম্পাদিত আমলের উপর পরিতুষ্ট থাকার কোন সুযোগ নেই।
আর নিজের আমলকে বড় মনে করা এবং তাতে তুষ্ট থাকাকে আরবীতে ‘উজব’ (العُجْبُ) মুগ্ধতা বলা হয়। সালাফে ছালেহীন এই উজব-এর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছেন। একবার আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল,متى يكون الرجل مسيئاً؟ ‘মানুষ কখন পাপী ব্যক্তিতে পরিণত হয়’। তিনি বললেন, إذا ظن أنه محسن، ‘যখন সে নিজেকে নেককার মনে করে’। কেননা আল্লাহ বলেছেন,
‘হে বিশ্বাসীগণ! খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪)। এখানে খোঁটা দেওয়ার অর্থ হ’ল- নিজের আমল ও দানকে বড় মনে করা। আর সেটাই ‘উজব’।[18]
আব্দুললাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,
‘দু’টি কাজে মুক্তি রয়েছে- তাক্বওয়া ও একনিষ্ঠ নিয়ত। আর ধ্বংস হ’ল দু’টি কাজে- (আল্লাহর রহমত থেকে) নিরাশ হওয়া এবং আত্মতুষ্টি বা নিজের আমল নিয়ে আত্মগরিমা’।[19]
একবার আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল- ‘আত্মতুষ্টি’ কি জিনিস?’ তিনি বললেন,
‘এরকম অনুভব করা যে, তোমার এমন আমল আছে, যা অন্যের কাছে নেই (অর্থাৎ তুমি মনে মনে ভাবো যে, তুমি এমন আমল করো, যা অন্যেরা করে না)। মুছল্লীদের জন্য আত্মতুষ্টির চেয়ে অধিক ক্ষতিকর কোন কিছু আছে বলে আমার জানা নেই’।[20]
মুত্বাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,
‘রাত জেগে নফল ইবাদত করে সকাল বেলা তা নিয়ে আত্মমুগ্ধ হওয়ার চেয়ে আমার নিকটে প্রিয় ইবাদত হ’ল- রাত জেগে নফল ইবাদত না করার কারণে সকাল বেলা অনুতপ্ত হওয়া’।[21]
সুতরাং অল্পে তুষ্টি কেবল পার্থিব ভোগ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যা মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন উপহার দেয়। অল্পে তুষ্টির মাধ্যমে দুনিয়ার উপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে এর মাধ্যমে নেকী অর্জিত হয় এবং বিপরীতে পাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অপরদিকে আখেরাত ও ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আত্মতুষ্ট না থাকা ও আত্মগরিমা না করাই শরী‘আতের নির্দেশ। কেননা এই আত্মমুগ্ধতা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) এটাকে ছোট শিরকের পর্যায়ভুক্ত গণ্য করেছেন।[22]
জীবনের যাবতীয় প্রতিকূল পরিবেশে মহান আল্লাহ আমাদেরকে অল্পে তুষ্ট থাকার তাওফীক দান করুন এবং পরকালে এর উত্তম পারিতোষিক দান করুন- আমীন! [ক্রমশঃ]
[1]. মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২১৪৪; সহীহুত তারগীব হা/১৬৯৮; সনদ সহীহ।
[3]. গাযালী, ইহ্ইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ৩/২০৯।
[4]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৫৮।
[5]. তুওয়াইজিরী, মাওসূ‘আতু ফিক্বহিল কুলূব (রিয়াদ: বায়তুল আফকার আদ-দুওয়ালিইয়াহ, তাবি) ৪/৩৩৯৬।
[6]. তিরমিযী হা/২৩০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৮; মিশকাত হা/১৬০৭, সনদ হাসান।
[7]. ইবনু আবীল হাদীদ, শারহু নাহ্জিল বালাগাহ, ১৮/৩৭৫; মাও‘ইযাতুল হাবীব ওয়া তুহফাতুল খাত্বীব, পৃ. ৯৭।
[8]. ইবনু আবীদ্দুন্ইয়া, আল-ক্বানা‘আতু ওয়াত তা‘আফ্ফুফ, পৃ. ৬৩।
[9]. আবূ নু‘আইম ইসফাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৩৭।
[10]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩০৬৭; সহীহুত তারগীব হা/৯২২; মিশকাত হা/১৮৮৫و সনদ সহীহ।
[11]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৩/২৩৩।
[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/২৫; আর-রিসালাতুল কুশাইরিইয়াহ ১/২৩৩।
[13]. তিরমিযী হা/২৫১৩; ইবনু মাজাহ হা/৪১৪২; মিশকাত হা/৫২৪২।
[14]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৮/৩২৮১; শারহুন নববী ১৮/৭৭।
[15]. বুখারী হা/৫৬৩৭; মিশকাত হা/৫৬৭৩।
[16]. মুসলিম হা/২৮১৬।
[17]. আহমাদ হা/১৭৬৫০; সনদ সহীহ।
[18]. ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন ৩/৩৭০।
[19]. আবুল লায়েছ সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, তাহ্ক্বীক্ব ও তা’লীক্ব: ইউসূফ আলী বাদাউয়ী (দামেশ্ক: দারু ইবনি কাছীর, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২১হি./২০০০খ্রি.) পৃ. ৪৮৫।
[20]. শামসুদ্দীন যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, মুহাক্বিক্ব : শু‘আইব আরনাউত্ব ও অন্যান্য (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৫হি./১৯৮৫খ্রি.) ৮ম খন্ড, পৃ. ৪০৭।
[21]. আবুল আববাস, আয-যাওয়াজির ‘আন ইক্বতিরাফিল কাবায়ের (বৈরূত: দারুল ফিকর, প্রথম প্রকাশ, ১৪০৭হি./১৯৮৭খ্রি.) ১/১২২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/১৯০।
[22]. ইবনে তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৫/২৪৭।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সফলতা হ’ল অল্পে তুষ্টির গুণ লাভ করা। যারা এই বৈশিষ্ট্য লাভ করে সুখ-শান্তির জন্য তাদেরকে হাপিত্যেশ করতে হয় না। অনাবিল প্রশান্তিতে তাদের হৃদয় জগৎ সর্বদা ভরপুর থাকে। পক্ষান্তরে অল্পে তুষ্ট থাকতে না পারা চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক। মানুষের প্রত্যেক পরাজয় ও ব্যর্থতার পিছনে যেমন মূখ্য ও গৌণ কিছু কারণ থাকে। তেমনি অল্পে তুষ্ট থাকতে না পারারও কিছু কারণ আছে। পরিতুষ্ট জীবন গঠনের জন্য এই কারণগুলো জানা উচিত, যেন তা আমাদের সুখ ও সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। নিম্নে কারণগুলো আলোকপাত করা হ’ল-
১. তাক্বদীরের প্রতি দুর্বল বিশ্বাস :
অল্পে তুষ্ট না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল তাক্বদীরের প্রতি দুর্বল বিশ্বাস। ঈমানের অন্যান্য শাখার প্রতি স্বচ্ছ বিশ্বাস থাকলেও, তাক্বদীরের মন্দ ফায়ছালার ক্ষেত্রে অনেক ধার্মিক মানুষের ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সেই হাদীসটি সর্বদা মনে রাখা উচিত, যেখানে তিনি বলেছেন,
كَتَبَ اللهُ مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ،
‘আল্লাহ আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে সকল মাখলূক্বের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন’।[1] অর্থাৎ আমাদের জীবনের সকল কিছু পূর্ব নির্ধারিত। যেমন আমরা জীবনে কত টাকা উপার্জন করব, ধনী না-কি গরীব হব, কি পানাহার করব সব কিছুই আল্লাহ আগে থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। কোন প্রাণী তার তাক্বদীরে বণ্টিত রিযিক পরিপূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। এমনকি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিলম্ব হ’লেও সে তা পেয়ে যাবে।[2]
তাক্বদীরের এই বিষয়গুলোর প্রতি মানুষের বিশ্বাস যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন সে অল্পে তুষ্ট থাকতে পারে না এবং জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও বিপদাপদে অস্থির হয়ে পড়ে। আবার কখনো নিজের মন্দ ভাগ্যকে দোষারোপ করে থাকে। ফুযাইল ইবনু ইয়ায (রহঃ) বলেন, ‘আমি সেই ব্যক্তিকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই, যে তাক্বদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, আবার রিযিকের ব্যাপারে পেরেশান হয়ে পড়ে’।[3]
২. আখেরাতের উপর পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া :
যারা তাদের পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে চলেন, কেবল তারাই অল্পে তুষ্ট থাকতে সক্ষম হন। কেননা তারা দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাতের জীবন বিনষ্ট করেন না। ফলে জীবন ধারণের জন্য সামান্য কিছু পেয়েই তারা খুশি থাকেন। পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেন, তারা অল্পে তুষ্ট থাকতে পারেন না। কেননা তাদের চিন্তা-চেতনা দুনিয়া কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন,
بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى،
‘বস্ত্ততঃ তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক। অথচ আখেরাত হ’ল উত্তম ও চিরস্থায়ী’ (আ‘লা ৮৭/১৬-১৭)।
আওন ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,
إن من كان قبلنا كانوا يـجعلون للدنيا ما فضل عن آخرتهم، وإنكم تـجعلون لآخرتكم ما فضل عن دنياكم،
‘আমাদের সালাফগণ দুনিয়ার জন্য তা-ই রাখতেন, যা তাদের আখেরাত নিশ্চিত হওয়ার পরে অবশিষ্ট থাকত। অন্যদিকে তোমরা তোমাদের আখেরাতের জন্য তা-ই রেখে দাও, যা দুনিয়া নিশ্চিত হওয়ার পরে অবশিষ্ট থাকে’।[4]
সালাফগণ আরো বলেন,
مثل طالب الدنيا كمثل شارب ماء البحر، كلما ازداد شرباً ازداد عطشاً، فلا يزال يشرب حتى يقتله الماء الـمالـح،
‘দুনিয়া অন্বেষণকারীর উপমা হ’ল সাগরের (লোনা) পানি পানকারীর মত। সে যতই পান করে, তার তৃষ্ণা ততই বেড়ে যায়। তাই সে পান করতেই থাকে। অবশেষে সেই লবণাক্ত পানি তাকে হত্যা করে ফেলে’।[5] সুতরাং মানুষ পার্থিব জীবনকে যত অগ্রাধিকার দিবে, দুনিয়ার প্রতি তার আসক্তি ততটাই তীব্রতর হবে। ফলে তার জন্য অল্পে তুষ্ট থাকাও সুদূর পরাহত হবে।
৩. মৃত্যুকে কম স্মরণ করা :
অল্পে তুষ্ট না থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল মৃত্যুকে কম স্মরণ করা। কেননা যিনি তার চিন্তা-চেতনায় মৃত্যুর কথা মনে রাখেন, মৃত্যুর ভাবনায় নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন, তার মাঝে না থাকে না পাওয়ার আক্ষেপ এবং অধিক পাওয়ার তৃষ্ণা। অপরদিকে যার মধ্যে মৃত্যুর ভাবনা যত কম, দুনিয়া কেন্দ্রীক তার আশা-আকাঙক্ষাও বেশী। ফলে অল্পে তুষ্ট থাকা তার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
أَكْثِرُوْا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ،
‘তোমরা দুনিয়ার স্বাদ হরণকারী মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ কর’।[6]
মৃত্যুর চিন্তাই একজন মানুষের জীবনাচারকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করতে পারে। আর মরণের ভয় থেকে যারা গাফেল থাকে, তাদের জীবন হয় বল্গাহীন এবং তারা পার্থিব সামান্য ধন-সম্পদে কখনো পরিতুষ্ট থাকতে পারে না।
৪. বিত্তশালী ও বিলাসী লোকদের সাথে অধিক মেলামেশা করা :
অল্পে তুষ্ট না থাকার আরেকটি কারণ হ’ল অধিক বিলাসী এবং নিজের চেয়ে বিত্তশালী লোকদের সাথে ওঠাবসা ও মেলামেশা করা। সাধারণ পরিবারের কোন ব্যক্তি যদি বিত্তশালী লোকের বাসায় বেশী যাতায়াত করে এবং অধিক মেলামেশা করে, তখন তার জন্য অল্পে তুষ্ট থাকা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা তখন সে তার বন্ধুর ঘরের আসবাব পত্র, পোষাক-পরিচ্ছদ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, গাড়ি-বাড়ি প্রভৃতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয় এবং নিজের জন্য সেরকম কামনা করতে থাকে। ফলে সে তার বন্ধুর মতো বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে এবং অল্পে তুষ্টির রাস্তা থেকে অনেক দূরে সরে যায়।
ইবনুল মুবারক নিজে সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও সব সময় গরীব মানুষদের সাথে মিশতেন এবং বলতেন, ‘যখন আমি কোন ধনী ব্যক্তির বাড়িতে প্রবেশ করি এবং তার ঘরে আমার ঘরের চেয়ে দামী কার্পেট বিছানো দেখি, তখন নিজ গৃহের কার্পেটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। আবার যখন কোন গরীর লোকের বাড়িতে প্রবেশ করি, তখন নিজ গৃহের আসবাবপত্রের জন্য সহসাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারি’। সেজন্য নিজের শ্রেণীভুক্ত বা তার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে মিশলে এবং চলাফেরা করলে অল্পে তুষ্ট থাকা সহজ হয়। কিন্তু এর বিপরীতটা ঘটলে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা ছাড়া খুব কম সংখ্যক মানুষের পক্ষে অল্পে তুষ্ট থাকা সম্ভব হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, নিজের চেয়ে ধনী ও বিত্তশালী লোকদের সাথে মেশা যাবে না। বরং তাদের সাথে মেলামেশা হবে সীমিত এবং প্রয়োজন মাফিক।
একদিন আলী (রাঃ) ভাষণ দেওয়ার প্রাক্কালে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,
يا أيها الناس لا تكونوا ممن يرجو الآخرة بغير العمل، ويؤخر التوبة لطول الأمل، يقولُ في الدنيا قول الزاهدين، ويعمل فيها عمل الراغبيْن، إن أعطي منها لم يشبع، وإن منع منها لم يقنع، يعجز عن شكر ما أوتي، ويبتغي الزيادة فيما بقي،... اللغو مع الاغنياء أحب إليه من الذكر مع الفقراء،
‘হে লোক সকল! তোমরা সেই ব্যক্তির মতো হয়ো না, যে আমল না করেই আখেরাতের জীবন প্রত্যাশা করে, দীর্ঘ আশা -আকাঙক্ষার কারণে তওবা করতে বিলম্ব করে, দুনিয়াদার হয়ে দুনিয়া বিমুখ ব্যক্তির মতো কথা বলে, (বাহ্যিকভাবে) অতি আগ্রহী ব্যক্তিদের মতো আমল করে। তাকে কিছু দেওয়া হ’লে পরিতৃপ্ত হয় না। আবার কিছু না দেওয়া হ’লেও পরিতুষ্ট থাকতে পারে না। আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে সে অপারগ হয়ে যায় এবং তার কাছে পর্যাপ্ত সম্পদ অবশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও আরো অধিক কামনা করে। আর তোমরা সেই ব্যক্তির মতোও হয়ো না, গরীবদের সাথে যিকর করার চেয়ে ধনীদের সাথে আনন্দ-বিনোদন করা যার কাছে অধিক পসন্দনীয়’।[7]
৫. দুনিয়াদারদের সাথে মেশা :
মানুষের মধ্যে অনুকরণ ও অনুসরণের প্রবণতা রয়েছে। সে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অন্যের অনুকরণ করে থাকে। ফলে ভালো মানুষের সাহচর্যে থাকলে, তার মাঝে ভালো গুণের সমাবেশ ঘটে। আর মন্দ লোকের সান্নিধ্যে গেলে, চরিত্রে ও চিন্তা-চেতনায় খারাপ গুণের প্রভাব পড়ে। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মন্দ লোকের সঙ্গী হওয়া থেকে আমাদের সতর্ক করেছেন। কেননা কেউ যদি পরহেযগার দ্বীনদার মানুষের সাথে মেশে, তার জীবন আখেরাতমুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু সে যদি দুনিয়াদার মানুষের সাথে মেশে, তার জীবনটা দুনিয়ামুখী হয়ে যায়। তাই অল্পে তুষ্ট থাকার জন্য দুনিয়াসক্ত মানুষের সংশ্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখা ঈমানী দায়িত্ব। তাই তো ওমর ফারূক (রাঃ) প্রায়ই উপদেশ দিয়ে বলতেন,
لا تَدْخُلُوا عَلَى أَهْلِ الدُّنْيَا فَإِنَّهَا مَسْخَطَةٌ لِلرِّزْقِ،
‘তোমরা দুনিয়াদার লোকদের কাছে যেয়ো না। কেননা এটা রিযিকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ’।[8] সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘যখন দেখি, কোন লোক দুনিয়ার প্রতি আসক্ত লোকদের সাথে বেশী মেলামেশা করছে, তখন বুঝতে পারি এই দুনিয়ার জীবনকেই সে ভালোবাসে’।[9] আর দুনিয়াদার লোকেরা যে কখনো অল্পে তুষ্ট থাকতে পারে না, তা সহজেই অনুমেয়।
৬. অধিক সম্পদ সঞ্চয়ের মানসিকতা :
সম্পদ সঞ্চয়ের প্রবল চিন্তা মানুষকে অল্পে তুষ্ট থাকতে দেয় না। মানুষের আয়-রোযগার যত বাড়ে, তার ব্যাংক-ব্যালেন্স সমৃদ্ধ করার চাহিদাও তত বেড়ে যায়। লক্ষ-কোটি টাকা রোযগার করার পরেও সে কামনা করে ইনকামটা যদি আরেকটু বাড়ানো যেত! মূলতঃ দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষের মাঝে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ জমানোর মানসিকতা সৃষ্টি হয়। ফলে তার অল্পে তুষ্ট থাকার পথটাও রুদ্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অল্পে তুষ্ট মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখাতে নিরুৎসাহিত করেছেন।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেলাল (রাঃ)-এর নিকট এলেন এবং তার ঘরে খেজুরের বড় স্তূপ দেখতে পেয়ে বললেন,
مَا هَذَا يَا بِلَالُ؟ ‘বেলাল এসব কি?’ বেলাল বললেন, شَيْءٌ ادَّخَرْتُهُ لِغَدٍ، ‘এসব আমি ভবিষ্যতের জন্য জমা করে রেখেছি’। এ কথা শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন,
أَمَا تَخْشَى أَنْ تَرَى لَهُ غَدًا بخارا فِي نَار جَهَنَّمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ أَنْفِقْ بِلَالُ وَلَا تَخْشَ من ذِي الْعَرْش إقلالا،
‘তুমি কি কাল ক্বিয়ামতের দিনে এর থেকে জাহান্নামের তাপ অনুভবের ভয় করছ না? বেলাল! এসব তুমি দান করে দাও। আরশের মালিকের কাছে ভূখা-নাঙা থাকার ভয় করো না’।[10]
সুতরাং প্রয়োজনে শর্ত সাপেক্ষে এবং সীমিত পরিসরে সম্পদ সঞ্চয় করা বৈধ হ’লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ ধন-সম্পদ জমানোর তীব্র নেশায় দুনিয়ামুখী ও বস্ত্তবাদী হয়ে পড়ে এবং অল্পে পরিতুষ্ট থাকতে ব্যর্থ হয়।
৭. আল্লাহর অনুগ্রহকে উপলব্ধি না করা :
আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে তা-ই দিয়ে থাকেন, যেটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তার স্থূল দৃষ্টি দিয়ে সেই কল্যাণ দেখতে পায় না। ফলে আল্লাহর অনুগ্রহরাজিকে উপলব্ধি করতে এবং অল্পে তুষ্ট থাকতে সে অপারগ হয়ে যায়। আল্লাহ কোন বান্দার জন্য দারিদ্রের মাঝে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন, আবার কারো জন্য কল্যাণ রেখেছেন সম্পদের মাঝে। তিনি কাউকে ধন-দৌলত দিয়ে এবং কারো কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন। কিন্তু বান্দা যদি আল্লাহর অনুগ্রহ উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয়, তাহ’লে সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হ’তে পারে না। উপরন্তু হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে। কেননা সে শুধু ধন-সম্পদ অর্জন করতে পারলেই ভীষণ আনন্দিত হয়। ধন-সম্পদ না থাকাও যে আল্লাহর অনুগ্রহ হ’তে পারে, এটা সে কল্পনা করতে পারে না।
এ ব্যাপারে সালামাহ ইবনে দীনার (রহঃ)-এর উক্তিটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন,
نِعْمَةُ اللهِ فِيمَا زَوَى عَنِّي مِنَ الدُّنْيَا أَعْظَمُ مِنْ نِعْمَتِهِ عَلَيَّ فِيمَا أَعْطَانِي مِنْهَا، إِنِّي رَأَيْتُهُ أَعْطَاهَا قَوْمًا فَهَلَكُوا،
‘আল্লাহ আমাকে এই দুনিয়ার বহুবিধ সম্ভার থেকে বঞ্চিত করে আমার উপর যে অনুগ্রহ করেছেন, সেটা ঐ অনুগ্রহের চেয়েও বড়, যা তিনি আমাকে দিয়েছেন। কেননা আমি এমন সম্প্রদায়কে দেখেছি, যাদেরকে আল্লাহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ দিয়েছেন, তারা (সেই সম্পদের কারণে) ধ্বংস হয়ে গেছে’।[11]
অতএব আমরাও যদি নিজেদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা না করি, তাহ’লে কখনোই আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারব না এবং অল্পে তুষ্ট থাকতে পারব না।
৮. মুবাহ ও অপ্রয়োজনীয় কাজে অধিক আত্মনিয়োগ করা :
হালাল বা বৈধ কাজকে মুবাহ বলা হয়। পানাহার, ঘুমানো, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, সাধ্যের মধ্যে উন্নত পোষাক পরিধান করা ইত্যাদি ‘মুবাহ’ কাজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কেউ যদি বিনা প্রয়োজনে বৈধ কাজে অত্যধিক আত্মনিয়োগ করে, তাহ’লে এটা তার জীবনে কুফল বয়ে আনে। যেমন পরিবারের ভরণ-পোষণ এবং জীবন ধারণের জন্য যতটুকু সম্পদ প্রয়োজন হয়, তার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য আল্লাহ ব্যবস্থা করেছেন। এক্ষণে কেউ যদি নিজের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় রোযগার করার পরেও সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য ইবাদত-বন্দেগী বাদ দিয়ে ব্যবসায় অত্যধিক সময় ব্যয় করে, তাহ’লে এই ব্যবসা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং তাকে আখেরাত থেকে বিমুখ করতে পারে। তাই তো প্রথম খলীফা আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বলেছেন,
كنا ندع سبعين بابًا من الحلال؛ مخافة أن نقع في بابٍ من الحرام،
‘আমরা সত্তরটি হালালের দরজা বন্ধ করে দিতাম, এই ভয়ে যে, যদি হারামের কোন একটি দরজায় ঢুকে পড়ি’।[12] সুতরাং কোন কিছু বৈধ হ’লেই যে সেটা ভোগ করতে হবে, এমন ধারণা পরিহার করা উচিত। বরং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ভোগ করা কর্তব্য।
কোন ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্টি এবং কোন ক্ষেত্রে নয় :
অল্পে তুষ্ট থাকার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র আছে এবং এটা স্থায়ী হ’তে পারে, আবার অস্থায়ীও হ’তে পারে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ، وَلَا تَنْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ، فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ لَا تَزْدَرُوْا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ-
‘তোমরা (পার্থিব বিষয়ে) তোমাদের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকদের দিকে তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকিয়ো না, যে তোমাদের চেয়ে উঁচু পর্যায়ের। তাহ’লে তোমাদের জন্য এই পন্থা অবলম্বনই হ’বে আল্লাহর নে‘মতকে অবজ্ঞা না করার উপযুক্ত মাধ্যম’।[13]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণ বলেন, ‘মানুষের স্বভাব হ’ল সে যখন কারো মাঝে দুনিয়ার কল্যাণ দেখতে পায়, তখন সে নিজের মধ্যে অনুরূপ কল্যাণ কামনা করে। আর নিজের কাছে থাকা আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতকে সে কম মনে করে থাকে। ফলে তার নে‘মতের সাথে আরো যুক্ত হয়ে অপরের চেয়ে বেশী কিংবা সমান সমান হোক এটা সে কামনা করে। এটা অধিকাংশ লোকের স্বভাব বা প্রকৃতি। কিন্তু মানুষ যদি তার নিচের দিকে তাকাত, তাহ’লে তার নিজের ওপর আল্লাহর দেয়া নে‘মতরাজির বিষয়টি প্রকাশ পেত। ফলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করত এবং আল্লাহর কাছে নত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করত’।[14]
উপরোক্ত হাদীসে পার্থিব জীবনের ধন-সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি, স্ত্রী-সন্তান, বংশ-মর্যাদা, শারীরিক সৌন্দর্য-সুস্থতা, আয়-রোযগার প্রভৃতি বিষয়ে নিজের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের লোকদের দিকে তাকিয়ে অল্পে তুষ্ট থাকতে বলা হয়েছে। উপর পর্যায়ের লোকদের দিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব কুরআন ও হাদীসে যে অল্পে তুষ্টির কথা বলা হয়েছে, তার ক্ষেত্র মূলত এগুলোই। অর্থাৎ দুনিয়া কেন্দ্রীক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্ট থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অপর দিকে ইবাদত-বন্দেগী এবং আমল সম্পাদনের ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্ট থাকতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন কেউ যদি সালাত-ছিয়াম, কুরআন তেলাওয়াত, সামর্থ্য থাকা সত্তেও দান-ছাদাক্বাহ কম করে এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকে অথবা একেবারেই ইবাদত না করে খুশী থাকে, তাহ’লে এই অল্পে তুষ্টি রীতিমতো নিন্দনীয়। আবার কেউ যদি যথারীতি ফরয-নফল ইবাদত সম্পাদন করে, নিজের আমলে আত্মতুষ্ট হয়, তাহ’লে সেই আত্মতুষ্টিও ভৎর্সনাযোগ্য। কেননা মানুষ শুধু তার ইবাদতের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَنْ يُدْخِلَ أَحَدًا عَمَلُهُ الْجَنَّةَ، ‘তোমাদের কোন ব্যক্তিকে তার নেক আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না’। লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনাকেও কি নয়’? তিনি বললেন,
لاَ، وَلاَ أَنَا إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِى اللهُ بِفَضْلٍ وَرَحْمَةٍ فَسَدِّدُواوَقَارِبُوا،
‘না, আমাকেও নয়। যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে তাঁর করুণা ও দয়া দিয়ে আবৃত করবেন। সুতরাং তোমরা (ইবাদতে) মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও’।[SUP][SUP][15][/SUP][/SUP]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
إِلَّا أَنْ يَتَغَمَّدَنِيَ اللهُ مِنْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَرَحْمَةٍ،
‘যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে ক্ষমা ও রহমতের মাধ্যমে আবৃত করবেন’।[SUP][SUP][16][/SUP][/SUP]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
لَوْ أَنَّ عَبْدًا خَرَّ عَلَى وَجْهِهِ مِنْ يَوْمِ وُلِدَ، إِلَى أَنْ يَمُوْتَ هَرَمًا فِي طَاعَةِ اللهِ، لَحَقَّرَهُ ذَلِكَ الْيَوْمَ، وَلَوَدَّ أَنَّهُ رُدَّ إِلَى الدُّنْيَا كَيْمَا يَزْدَادَ مِنَ الْأَجْرِ وَالثَّوَابِ-
‘কোন বান্দা যদি মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকে অতিবৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদতে সিজদায় পড়ে থাকে, তবুও ক্বিয়ামতের দিন সারা জীবনের এই ইবাদত তার কাছে খুবই নগণ্য মনে হবে। তখন সে কামনা করবে, যদি তাকে আবার দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো হ’ত, তাহ’লে আরো বেশী প্রতিদান ও ছওয়াব লাভ করা যেত’।[17]
সুতরাং বান্দার আবশ্যিক কর্তব্য হ’ল নিজের আমলের ব্যাপারে মুগ্ধ ও তুষ্ট না থেকে সাধ্যানুযায়ী নেক আমল অব্যাহত রাখা। ভয় ও আশার মাঝে অবস্থান করে আল্লাহর আনুগত্য করে যাওয়া। কারণ আল্লাহ হয়তো তাকে আমল করার তাওফীক্ব দিয়েছেন, কিন্তু সেটা কবুলের দরজা বন্ধ রেখেছেন। তাই নিজের সম্পাদিত আমলের উপর পরিতুষ্ট থাকার কোন সুযোগ নেই।
আর নিজের আমলকে বড় মনে করা এবং তাতে তুষ্ট থাকাকে আরবীতে ‘উজব’ (العُجْبُ) মুগ্ধতা বলা হয়। সালাফে ছালেহীন এই উজব-এর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছেন। একবার আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল,متى يكون الرجل مسيئاً؟ ‘মানুষ কখন পাপী ব্যক্তিতে পরিণত হয়’। তিনি বললেন, إذا ظن أنه محسن، ‘যখন সে নিজেকে নেককার মনে করে’। কেননা আল্লাহ বলেছেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى،
‘হে বিশ্বাসীগণ! খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪)। এখানে খোঁটা দেওয়ার অর্থ হ’ল- নিজের আমল ও দানকে বড় মনে করা। আর সেটাই ‘উজব’।[18]
আব্দুললাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,
النَّجَاةُ فِي اثْنَتَيْنِ: التَّقْوَى، وَالنِّيَّةِ، وَالْهَلَاكُ فِي اثْنَتَيْنِ: الْقُنُوطُ، وَالْإِعْجَابُ،
‘দু’টি কাজে মুক্তি রয়েছে- তাক্বওয়া ও একনিষ্ঠ নিয়ত। আর ধ্বংস হ’ল দু’টি কাজে- (আল্লাহর রহমত থেকে) নিরাশ হওয়া এবং আত্মতুষ্টি বা নিজের আমল নিয়ে আত্মগরিমা’।[19]
একবার আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল- ‘আত্মতুষ্টি’ কি জিনিস?’ তিনি বললেন,
أَنْ تَرَى أَنَّ عِنْدَكَ شَيْئاً لَيْسَ عِنْدَ غَيْرِك، لاَ أَعْلَمُ فِي الـمُصَلِّيْنَ شَيْئاً شَرّاً مِنَ العُجْبِ،
‘এরকম অনুভব করা যে, তোমার এমন আমল আছে, যা অন্যের কাছে নেই (অর্থাৎ তুমি মনে মনে ভাবো যে, তুমি এমন আমল করো, যা অন্যেরা করে না)। মুছল্লীদের জন্য আত্মতুষ্টির চেয়ে অধিক ক্ষতিকর কোন কিছু আছে বলে আমার জানা নেই’।[20]
মুত্বাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,
لَأَنْ أَبِيتَ نَائِمًا وَأُصْبِحَ نَادِمًا أَحَبُّ إلَيَّ مِنْ أَنْ أَبِيتَ قَائِمًا وَأُصْبِحَ مُعْجَبًا،
‘রাত জেগে নফল ইবাদত করে সকাল বেলা তা নিয়ে আত্মমুগ্ধ হওয়ার চেয়ে আমার নিকটে প্রিয় ইবাদত হ’ল- রাত জেগে নফল ইবাদত না করার কারণে সকাল বেলা অনুতপ্ত হওয়া’।[21]
সুতরাং অল্পে তুষ্টি কেবল পার্থিব ভোগ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যা মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন উপহার দেয়। অল্পে তুষ্টির মাধ্যমে দুনিয়ার উপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে এর মাধ্যমে নেকী অর্জিত হয় এবং বিপরীতে পাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অপরদিকে আখেরাত ও ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আত্মতুষ্ট না থাকা ও আত্মগরিমা না করাই শরী‘আতের নির্দেশ। কেননা এই আত্মমুগ্ধতা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) এটাকে ছোট শিরকের পর্যায়ভুক্ত গণ্য করেছেন।[22]
জীবনের যাবতীয় প্রতিকূল পরিবেশে মহান আল্লাহ আমাদেরকে অল্পে তুষ্ট থাকার তাওফীক দান করুন এবং পরকালে এর উত্তম পারিতোষিক দান করুন- আমীন! [ক্রমশঃ]
[1]. মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২১৪৪; সহীহুত তারগীব হা/১৬৯৮; সনদ সহীহ।
[3]. গাযালী, ইহ্ইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ৩/২০৯।
[4]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৫৮।
[5]. তুওয়াইজিরী, মাওসূ‘আতু ফিক্বহিল কুলূব (রিয়াদ: বায়তুল আফকার আদ-দুওয়ালিইয়াহ, তাবি) ৪/৩৩৯৬।
[6]. তিরমিযী হা/২৩০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৮; মিশকাত হা/১৬০৭, সনদ হাসান।
[7]. ইবনু আবীল হাদীদ, শারহু নাহ্জিল বালাগাহ, ১৮/৩৭৫; মাও‘ইযাতুল হাবীব ওয়া তুহফাতুল খাত্বীব, পৃ. ৯৭।
[8]. ইবনু আবীদ্দুন্ইয়া, আল-ক্বানা‘আতু ওয়াত তা‘আফ্ফুফ, পৃ. ৬৩।
[9]. আবূ নু‘আইম ইসফাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৩৭।
[10]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩০৬৭; সহীহুত তারগীব হা/৯২২; মিশকাত হা/১৮৮৫و সনদ সহীহ।
[11]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৩/২৩৩।
[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/২৫; আর-রিসালাতুল কুশাইরিইয়াহ ১/২৩৩।
[13]. তিরমিযী হা/২৫১৩; ইবনু মাজাহ হা/৪১৪২; মিশকাত হা/৫২৪২।
[14]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৮/৩২৮১; শারহুন নববী ১৮/৭৭।
[15]. বুখারী হা/৫৬৩৭; মিশকাত হা/৫৬৭৩।
[16]. মুসলিম হা/২৮১৬।
[17]. আহমাদ হা/১৭৬৫০; সনদ সহীহ।
[18]. ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন ৩/৩৭০।
[19]. আবুল লায়েছ সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, তাহ্ক্বীক্ব ও তা’লীক্ব: ইউসূফ আলী বাদাউয়ী (দামেশ্ক: দারু ইবনি কাছীর, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২১হি./২০০০খ্রি.) পৃ. ৪৮৫।
[20]. শামসুদ্দীন যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, মুহাক্বিক্ব : শু‘আইব আরনাউত্ব ও অন্যান্য (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৫হি./১৯৮৫খ্রি.) ৮ম খন্ড, পৃ. ৪০৭।
[21]. আবুল আববাস, আয-যাওয়াজির ‘আন ইক্বতিরাফিল কাবায়ের (বৈরূত: দারুল ফিকর, প্রথম প্রকাশ, ১৪০৭হি./১৯৮৭খ্রি.) ১/১২২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/১৯০।
[22]. ইবনে তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৫/২৪৭।
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম. এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এম. এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Last edited: