সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।

বিদআত বিদ‘আত ও তার পরিণতি - পর্ব ৩

Habib Bin Tofajjal

If you're in doubt ask الله.
Forum Staff
Moderator
Generous
ilm Seeker
Uploader
Exposer
Q&A Master
Salafi User
LV
17
 
Awards
33
Credit
16,609
সুন্নাতের পরিচয়

সুন্নাতের আভিধানিক অর্থ : السنة (সুন্নাত) শব্দটি আরবী, একবচন। বহুবচনে السنن (সুনান)। এর আভিধানিক অর্থ হ’ল, الطريقة والسيرة حميدة كانت أو ذميمة অর্থাৎ পথ, পন্থা, পদ্ধতি, রীতি, নিয়ম ইত্যাদি; চাই তা ভাল হোক অথবা মন্দ হোক। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে এই অর্থে সুন্নাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন,
يُرِيْدُ اللهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوْبَ عَلَيْكُمْ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ-
‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের নিকট বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/২৬)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
سُنَّةَ اللهِ فِيْ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللهِ تَبْدِيْلاً
‘পূর্বে যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি। তুমি কখনো আল্লাহর রীতিতে কোন পরিবর্তন পাবে না’ (আহযাব ৩৩/৬২)।

এছাড়াও রাসূল (ছাঃ) একই অর্থে সুন্নাত শব্দের ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

مَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ-

‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন উত্তম রীতি চালু করবে সে তার প্রতিদান পাবে এবং তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান প্রতিদানও সে পাবে। তবে তাদের প্রতিদান থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতি চালু করবে সে তার কাজের পাপ ও তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান পাপের অধিকারী হবে। তবে তাদের পাপ থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না’।[1]

সুন্নাতের পরিভাষিক অর্থ : ইমাম শাতেবী (রহঃ) সুন্নাতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
مَا نُقِلَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ وَعَلَى مَا جَاءَ عَنِ الصَّحَابَةِ أَوْ الخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ
‘সুন্নাত হ’ল, নবী (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে যা বর্ণিত হয়েছে এবং যা ছাহাবায়ে কেরাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পক্ষ থেকে এসেছে’।[2]

আল্লামা ফায়ছাল ইবনু আব্দুল আযীয আলে মুবারক (রহঃ) বলেন,
السُّنَّةُ مَا وَرَدَ عَنِ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ
‘সুন্নাত হ’ল, যা নবী (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে বর্ণিত হয়েছে’।[3]

অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা করতে বলেছেন, তা করা সুন্নাত, যা তিনি নিজে করেছেন তা করা সুন্নাত এবং যা তিনি করতে বলেননি এবং নিজেও করেননি; কিন্তু অন্য কাউকে করতে দেখলে তাকে নিষেধ করেননি, তাঁর এরূপ মৌনসম্মতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যেহেতু বিদ‘আত সুন্নাতের বিপরীত সেহেতু রাসূল (ছাঃ) যে ইবাদত করতে বলেননি, নিজে করেননি এবং মৌনসম্মতি প্রদান করেননি, এরূপ কাজ যত ভাল কাজ বলে মনে হোক না কেন তা বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত।

সুন্নাতের প্রকারভেদ

রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতির অনুসরণ করা যেমন সুন্নাত, তেমনি এর বহির্ভূত কাজকে বর্জন করাও সুন্নাত। অতএব অনুসরণ ও বর্জনের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে সুন্নাত দুই প্রকার। যথা-

(ক) السنة الفعلية (সুন্নাতে ফে‘লিয়্যাহ) তথা কর্মে সুন্নাত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইবাদত হিসাবে যা করেছেন, করতে বলেছেন এবং সম্মতি প্রদান করেছেন তা পালন করা সুন্নাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ
‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর’ (হাশর ৫৯/৭)।

অত্র আয়াতে আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যতটুকু ইবাদত নিয়ে এসেছেন ততটুকুই গ্রহণীয় হবে। তাঁর আনীত বিধানের বাইরে কোন কাজই ইবাদত হিসাবে গ্রহণীয় হবে না। মানুষ তাকে যত ভাল কাজই বলে মনে করুক না কেন। আর তিনি ইবাদত হিসাবে যা নিয়ে এসেছেন, স্বয়ং তিনি ঐসবের উপর আমল করেছেন এবং করতে বলেছেন। তাই তো ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ছাঃ)-এর প্রত্যেকটি আমল প্রতি পদে মেনে চলেছেন। যেমন- আবু বকর (রাঃ) বলেন,
لَسْتُ تَارِكًا شَيْئًا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَعْمَلُ بِهِ إِلاَّ عَمِلْتُ بِهِ، فَإِنِّيْ أَخْشَى إِنْ تَرَكْتُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهِ أَنْ أَزِيْغَ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা আমল করতেন আমি তাই আমল করব। আমি তার কোন কিছুই ছেড়ে দিতে পারি না। কেননা আমি আশংকা করি যে, তার কোন নির্দেশ ছেড়ে দিয়ে আমি যেন পথভ্রষ্ট হয়ে না যাই’।[4]

(খ) السنة الةركية(সুন্নাতে তারকিয়্যাহ) তথা বর্জনে সুন্নাত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যে ইবাদত করেননি, করতে বলেননি এবং সম্মতি প্রদান করেননি এমন ইবাদত বর্জন করাই তাঁর সুন্নাত। যেমন- ‘একদা তিন সদস্য বিশিষ্ট একদল লোক রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদতকে কম মনে করলেন এবং বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে আমাদের কোন তুলনা চলে না। কেননা তাঁর পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনজনের একজন বললেন, নিশ্চয়ই আমি প্রতি রাতে সারা রাত জাগরণ করে ছালাত আদায় করব। অপর ব্যক্তি বলল, আমি প্রতি দিন ছিয়াম পালন করব, আমি ছিয়াম ত্যাগ করব না। অপর ব্যক্তি বলল, আমি কোন নারীর নিকটবর্তী হব না এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, তোমরাই কি তারা যারা এরূপ এরূপ মন্তব্য করেছ? সাবধান! নিশ্চয়ই আমি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করি এবং আমি সবচেয়ে বেশী পরহেযগার। কিন্তু আমি কোন কোন দিন ছিয়াম পালন করি এবং কোন কোন দিন ছিয়াম ত্যাগ করি। রাত্রের কিছু অংশ ছালাত আদায় করি এবং কিছু অংশ ঘুমাই। আর আমি বিবাহ করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সন্নাত হ’তে বিরাগ হবে (সুন্নাত পরিপন্থী আমল করবে) সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[5]

অত্র হাদীছে উল্লিখিত তিন জন ব্যক্তি এমন কিছু আমল করার ইচ্ছা পোষণ করলেন, যা রাসূল (ছাঃ) করেননি, করতে বলেননি এবং সমর্থন করেননি। আর এ কারণে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে সে সকল আমল পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। অতএব কুরআন ও ছহীহ হাদীছ পরিপন্থী আমল বর্জন কারাও সুন্নাত।

বিদ‘আতের পরিচয়

বিদ‘আতের শাব্দিক অর্থ : البِدْعَةُ শব্দটি মাছদার যা بَدَعَ ফে‘ল হ’তে নির্গত। এর শাব্দিক অর্থ হ’ল, আরম্ভ করা, সৃষ্টি করা, আবিষ্কার করা ইত্যাদি। যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে তাঁর নিজের সম্পর্কে এরশাদ করেছেন,
بَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
‘আসমান ও যমীনের নতুন উদ্ভাবনকারী (যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না)’ (বাক্বারাহ ২/১১৭)। অন্যত্র তিনি রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে বলেন,
قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ
‘আপনি বলুন, আমি এমন কোন রাসূল নই, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই’ (আহকাফ ৪৬/৯)। ইমাম নববী (রহঃ) বিদ‘আত শব্দের অর্থ লিখেছেন,
البِدْعَةُ كُلُّ شَيْءٍ عَمِلَ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ
অর্থাৎ এমন সব কাজ করা বিদ‘আত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।

অতএব বিদ‘আত হ’ল সুন্নাতের বিপরীত। কেননা যেহেতু রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে সুন্নাত বলা হয়, সেহেতু সুন্নাতের পূর্ব দৃষ্টান্ত রয়েছে। পক্ষান্তরে বিদ‘আত ইসলামী শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং বিদ‘আতের কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।

বিদ‘আতের পারিভাষিক অর্থ :

বিদ‘আতের শাব্দিক বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় যে, বিদ‘আত বলা হয় ঐ সকল নতুন সৃষ্টিকে যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। যেমন- বিমান, বাস, ট্রাক, ট্রেন, মাইক, ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি। এগুলো আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ‘আত হ’লেও পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ‘আত নয়। কেননা এগুলো ইসলামী শরী‘আতের সাথে সম্পৃক্ত কোন বিষয় নয়। বরং মানুষের জীবন পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপকরণ তৈরী হয়েছে মাত্র। এসব ক্ষেত্রে নেকীর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। মূলতঃ বিদ‘আত হ’ল, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়, এমন কোন কাজকে ইবাদত হিসাবে নেকী পাওয়ার আশায় পালন করা। যেমন রাসূল (ছাঃ) উটের পিঠে আরোহণ করে হজ্জ করতে মক্কায় গিয়েছেন। হজ্জ একটি ইবাদত যার প্রত্যেকটি কাজ কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী সম্পাদন করা ওয়াজিব। কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে উপেক্ষা করে নিজের মন মত হজ্জের কার্যাবলী সম্পাদন করলে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে। কিন্তু উটের পিঠে আরোহণ করে হজ্জে যাওয়া ইবাদত নয়। এটি একটি বাহন মাত্র। যেহেতু রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় বাহন হিসাবে উট ব্যবহার করা হ’ত, সেহেতু তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে হজ্জে গিয়েছেন। বর্তমানে উটের পরিবর্তে উন্নত বাহন হিসাবে বিমান তৈরী হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো উন্নতমানের বাহন তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব মানুষ তাদের সুবিধার্থে যে কোন বাহনে আরোহণ করতে পারে। কেননা এগুলো ইবাদতের অংশ নয়। যদি কেউ ধারণা করে যে, উটের পিঠে আরোহণ করে হজ্জে গেলে বেশী নেকী পাওয়া যাবে, তাহ’লে উটের পিঠে আরোহণ করাও বিদ‘আত হবে।

অনুরূপভাবে আযান দেওয়া একটি ইবাদত। কিন্তু এক্ষেত্রে মাইক ব্যবহার করা ইবাদতের কোন অংশ নয়। মাইক আযানের আওয়াজ উঁচু করার একটি মাধ্যম মাত্র। যদি কেউ বেশী নেকী পাওয়ার উদ্দেশ্যে মাইকে আযান দেয়, তাহ’লে মাইকে আযান দেওয়া বিদ‘আত হবে। অনুরূপভাবে যদি কেউ নেকী পাওয়ার আশায় বিমান, বাস, ট্রেন ইত্যাদিতে আরোহণ করে অথবা ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি পরিধান করে, তাহ’লে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে। কিন্তু এগুলোতে মানুষের নেকী পাওয়ার কোন আশা থাকে না, বিধায় এগুলো বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়। নিম্নে বিদ‘আতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণিত হ’ল :

(১) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ فِيْ الشَّرْعِ هِيَ إِحْدَاثُ مَا لَمْ يَكُنْ فِيْ عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه و سلم ‘শরী‘আতের মধ্যে বিদ‘আত হ’ল, নব আবিষ্কার, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় ছিল না’।[6]

(২) শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, فَكُلُّ مَنْ دَانَ بِشَيْءٍ لَمْ يَشْرَعْهُ اللهُ فَذَاكَ بِدْعَةٌ، وَ إِنْ كَانَ مُتَأَوَّلاً فِيْهِ ‘যে সকল কাজ দ্বীনের মধ্যে মিশ্রিত হয়েছে অথচ আল্লাহ তা‘আলা তা বৈধ করেননি, সেটাই বিদ‘আত, যদিও তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হয়’।[7]

তিনি অন্যত্র বলেন,اَلْبِدْعَةُ مَا خَالَفَتِ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ أَوْ إِجْمَاعَ سَلَفِ الْأُمَّةِ مِنَ الْاِعْتِقَادَاتِ وَالْعِبَادَاتِ ‘বিদ‘আত হ’ল, ইবাদত এবং বিশ্বাসের মধ্যে যা কিতাব (কুরআন), সুন্নাহ অথবা বিগত উম্মতের ইজমার বিপরীত’।[8]

(৩) আল্লামা জুরজানী (রহঃ) বলেন,

اَلْبِدْعَةُ هِيَ الْفِعْلَةُ الْمُخَالَفَةُ لِلسُّنَّةِ، سُمِّيَتْ بِالْبِدْعَةِ لِأَنَّ قَائِلَهَا اِبْتَدَعَهَا مِنْ غَيْرِ مَقَالِ إِمَامٍ، وَهِيَ الْأَمْرُ الْمُحْدَثُ اَلَّذِيْ لَمْ يَكُنْ عَلَيْهِ الْصَّحَابَةُ وَالْتَّابِعُوْنَ، وَلَمْ يَكُنْ مِمَّا اِقْتِضَاهُ الْدَّلِيْلَ الْشَّرْعِيْ

‘বিদ‘আত হ’ল সুন্নাতের বিপরীত কাজ। একে বিদ‘আত নামকরণ করা হয়েছে। কেননা বক্তা ইমামের (রাসূল) কথার বিপরীত কথা সৃষ্টি করেছে। আর এটাই নব আবিষ্কৃত কাজ যার উপর ছাহাবী ও তাবেঈগণ ছিলেন না এবং যা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়’।[9]

(৪) ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ عِبَارَةٌ عَنْ فِعْلَةٍ تُصَادِمُ الْشَّرِيْعَةَ بِالْمُخَالَفَةِ، أَوْ تُوْجِبُ الْتَعَاطِيْ عَلَيْهَا بِالْزِّيَادَةِ أَوْ الْنُّقْصَانِ ‘বিদ‘আত এমন কাজকে বলা হয় যা বিরোধিতার দ্বারা শরী‘আতকে আঘাত করা হয়। অথবা শরী‘আতের মধ্যে কম-বেশী করার অভ্যাসকে ওয়াজিব করে নেওয়া হয়’।[10]

(৫) ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ عِبَارَةٌ عَنْ طَرِيْقِةِ فِيْ الدِّيْنِ مُخْتَرَعَةُ تُضَاهِيْ الشَّرِيْعَةَ، يَقْصُدُ بِالسُّلُوْكِ عَلَيْهَا المُبَالَغَةُ فِيْ التَّعَبُّدِ لِلَّهِ سُبْحَانَهُ ‘বিদ‘আত বলা হয় দ্বীন-ইসলামের এমন কর্মনীতি বা কর্মপন্থা চালু করাকে, যা শরী‘আতের বিপরীত এবং যা করে আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে আতিশয্য ও বাড়াবাড়ি করাই লক্ষ্য হয়’।[11]

তিনি অন্যত্র বলেন,اَلْبِدْعَةُ الْمَذْمُوْمَةُ هِيَ الَّتِيْ خَالَفَتْ مَا وَضَعَ الشَّارِعُ مِنَ الْأَفْعَالِ أَوْ التُّرُوْكِ ‘ঘৃণিত বিদ‘আত হ’ল, আল্লাহ তা‘আলা যে সকল কাজ করার ও বর্জন করার বিধান দান করেছেন, তার ব্যতিক্রম করা’।[12]

বিদ‘আতের কুফল

(১) বিদ‘আত করলে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা হয় : বিদ‘আত করলে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلاَ تَقُوْلُوْا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلاَلٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوْا عَلَى اللهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ لاَ يُفْلِحُوْنَ- ‘আর তোমাদের জিহবা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য বল না যে, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে, তারা সফলকাম হবে না’ (নাহল ১৬/১১৬)।

অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, যারা বিদ‘আত করে, যার কোন ভিত্তি ইসলামী শরী‘আতে নেই, তারা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা নিজেদের মন মত আল্লাহর হারামকৃত বস্ত্তকে হালাল সাব্যস্ত করে এবং আল্লাহর হালালকৃত বস্ত্তকে হারাম সাব্যস্ত করে।[13]

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, আল্লাহ সম্পর্কে বিনা ইলমে কথা বলা হারাম কাজ সমূহের অন্যতম এবং সবচেয়ে বড় পাপ। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করা হয় এবং এমন কিছুকে তাঁর উপর সাব্যস্ত করা হয় যা তাঁর জন্য শোভা পায় না, শরী‘আতে যা সিদ্ধ তা অমান্য করা হয় এবং যা নিষিদ্ধ তা পালন করা হয়, বাতিলকে হক্ব বলা হয় এবং হক্বকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়।[14]

আল্লামা বারবাহারী (রহঃ) বলেন, وَاعْلَمْ أَنَّهُ مَنْ قَالَ فِيْ دِيْنِ اللهِ بِرَأْيِهِ وَقِيَاسِهِ وَتَأَوَّلَهُ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ مِنَ السُنَّةِ وَالجَمَاعَةِ فَقَدْ قَالَ عَلَى اللهِ مَا لاَيَعْلَمْ، وَمَنْ قَالَ عَلَى اللهِ مَا لاَيَعْلَمْ فَهُوَ مِنَ المُتَكَلَّفِيْنَ، وَالحَقُّ مَا جَاءَ بِهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- ‘জেনে রেখ! যে ব্যক্তি নিজেদের রায় ও ক্বিয়াসের ভিত্তিতে আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে কথা বলল এবং কুরআন ও সুন্নাত বহির্ভূত ব্যাখ্যা করল, সে আল্লাহ সম্পর্কে বিনা ইলমে কথা বলল। আর যে ব্যক্তি বিনা ইলমে আল্লাহ সম্পর্কে কথা বলবে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা নিয়ে এসেছেন (অহি-র বিধান) কেবলমাত্র সেটাই হক্ব’।[15]

(২) বিদ‘আত করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর খিয়ানতের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয় : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا- ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)।

অতএব ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়া সত্ত্বেও যারা ভাল কাজের দোহাই দিয়ে ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন ইবাদতের জন্ম দিয়েছে ও তাকে লালন করছে তাদের ভাবখানা এমন যেন ইসলাম অপূর্ণাঙ্গ। আর এরূপ বিশ্বাস আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করার শামিল। ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন,مَن اِبْتَدَعَ فِي الإِسْلاَمِ بِدْعَةً يَرَاهَا حَسَنَةً فَقَدْ زَعَمَ أَنَّ مُحَمَّدًا خَانَ الرِّسَالَةَ، لِأَنَّ اللهَ تَعَالَى يَقُوْلُ (الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ) فَمَا لَمْ يَكُنْ يَوْمَئِذٍ دِيْنًا فَلَيْسَ الْيَوْمَ دِيْنًا- ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করল এবং তাকে উত্তম মনে করল, সে যেন ধারণা করল যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) রিসালাতে খিয়ানত করেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (ইসলাম) পূর্ণাঙ্গ করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। সুতরাং সে যুগে (রাসূল ছাঃ ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে) যা দ্বীন হিসাবে গণ্য ছিল না, বর্তমানেও তা দ্বীন হিসাবে পরিগণিত হবে না’।[16]

অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি বলেন,مَا تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا أَمَرَكُمُ اللهُ بِهِ إِلاَّ وَقَدْ أَمَرْتُكُمْ بِهِ وَلاَ تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا نَهَاكُمُ اللهُ عَنْهُ إِلاَّ وَقَدْ نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ- ‘আমি এমন কোন জিনিসই ছাড়িনি যার হুকুম আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে দিয়েছেন; অবশ্যই আমি তার হুকুম তোমাদেরকে দিয়েছি। আর আমি এমন কোন জিনিসই ছাড়িনি যা আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন; অবশ্যই আমি তোমাদেরকে তা নিষেধ করেছি’।[17]

আবু যার (রাঃ) বলেন, مَا تَرَكَ النبي صلى الله عليه وسلّم طَائِراً يُقَلِّبُ جَنَاحَيْهِ فِي السَّمَاءِ إِلاَّ ذَكَرَ لَنَا مِنْهُ عِلْما-ً ‘আকাশে যে পাখি তার দু’ডানা ঝাপটায় তার জ্ঞান সম্পর্কেও নবী করীম (ছাঃ) আমাদের নিকট আলোচনা করেছেন’।[18]

অতএব যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উপর নাযিলকৃত রিসালাত পরিপূর্ণভাবে উম্মতে মুহাম্মাদীর নিকট পৌঁছে দিয়েছেন, সেহেতু তাঁর সুন্নাত অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবন পরিচালনা করতে হবে। তাঁর সুন্নাতকে উপেক্ষা করে দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন কাজকে ইবাদত হিসাবে পালন করলে তাঁর উপর খিয়ানতের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হবে।

(৩) বিদ‘আত করলে ছাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা হয় : বিদ‘আতের মাধ্যমে ছাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়। যেমন-

(ক) ছাহাবায়ে কেরামকে অলস ও ইবাদতের ক্ষেত্রে গাফেল মনে করা হয়। অর্থাৎ বিদ‘আতীরা যখন ইসলামী শরী‘আত বহির্ভূত কাজকে নেকীর উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে, তখন বিশ্বাস করা হয় যে, ছাহাবায়ে কেরাম ঐ সমস্ত কাজগুলি ইবাদত হিসাবে পালন না করে তাঁদের অলসতা ও গাফেলতীর পরিচয় দিয়েছেন।

(খ) ছাহাবায়ে কেরামকে অপূর্ণাঙ্গ ইবাদতকারী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম যেহেতু যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকান্ড থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রেখেছিলেন, সেহেতু বিদ‘আতীদের নিকট ছাহাবায়ে কেরাম অপূর্ণাঙ্গ ইবাদতকারী হিসাবে বিবেচিত হয়।

(গ) অনুসরণীয় ইমাম ও বুযুর্গানে দ্বীনকে ছাহাবায়ে কেরামের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ ছাহাবায়ে কেরামের কথা কিংবা আমল যাই থাক না কেন, বিদ‘আতীদের নিকট তাদের অনুসরণীয় ইমাম অথবা বুযুর্গানে দ্বীনের কথাই প্রণিধানযোগ্য হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ مِنْ بَعْدِيْ وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ- ‘তোমাদের উপর আমার সুন্নাত এবং আমার পরে হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তোমরা তা মাঢ়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে অাঁকড়ে ধরবে’।[19]

সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাঃ) বলেন, مَا لَمْ يَعْرِفْهُ الْبَدْرِيُّوْنَ فَلَيْسَ مِنَ الدِّيْنِ ‘বদরী ছাহাবীগণ (দ্বীনের ব্যাপারে) যা জানত না তা দ্বীন নয়’।[20]

আওযাঈ (রহঃ) বলেন,اَلْعِلْمُ مَا جَاءَ عَنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، وَمَا لَمْ يَجِئْ عَنْ وَاحِدٍ مِنْهُمْ فَلَيْسَ بِعِلْمٍ ‘(দ্বীনের ব্যাপারে) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের থেকে যা এসেছে তাই প্রকৃত ইলম, আর তাদের কোন একজনের থেকেও যা আসেনি তা ইলম নয়’।[21]

শা‘বী (রহঃ) বলেন,مَا حَدَّثُوْكَ عَنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَخُذْ بِهِ، وَمَا قَالُوْا فِيْهِ بِرَأْيِهِمْ فَبُلْ عَلَيْهِ ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের থেকে তোমাকে যা তারা বলে তুমি তা গ্রহণ কর, আর যা তারা তাদের রায়ের ভিত্তিতে বলে তুমি তার উপর পেশাব কর’।[22]

ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন,مَا جَاءَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ نَقْلِ الثِّقَاتِ، وَجَاءَ عَنِ الصَّحَابَةِ وَصَحَّ عَنْهُمْ فَهُوَ عِلْمٌ يُدَانُ بِهِ، وَمَا أُحْدِثَ بَعْدَهُمْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ أَصْلٌ فِيْمَا جَاءَ عَنْهُمْ فَبِدْعَةٌ وَضَلاَلَةٌ- ‘গ্রহণযোগ্য সূত্রে রাসূল (ছাঃ) হ’তে যা এসেছে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবী কর্তৃক যা ছহীহ প্রমাণিত হয়ে এসেছে তাই ইলম যা দ্বীন হিসাবে সাব্যস্ত। আর যা তাদের পরে আবিষ্কৃত হয়েছে যার কোন ভিত্তি তাদের (রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম) আনীত বিধানের মধ্যে নেই, তাই হচ্ছে বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতা’।[23]

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,وَأَمَّا أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ فَيَقُوْلُوْنَ فِيْ كُلِّ فِعْلٍ وَقَوْلٍ لَمْ يَثْبُتْ عَنِ الصَّحَابَةِ هُوَ بِدْعَةٌ؛ لِأَنَّهُ لَوْ كَانَ خَيْرًا لَسَبَقُوْنَا إِلَيْهِ، لِأَنَّهُمْ لَمْ يَتْرُكُوْا خَصْلَةً مِنْ خِصَالِ الْخَيْرِ إِلاَّ وَقَدْ بَادَرُوْا إِلَيْهَا- ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বলে, যে সকল কথা ও কর্ম ছাহাবায়ে কেরাম থেকে সাব্যস্ত নয়, তা বিদ‘আত। কেননা যদি তা (উক্ত কথা ও কর্ম) উত্তম হ’ত, তাহ’লে তাঁরা তা করতেন। কেননা তাঁরা কোন ভাল কাজ ত্যাগ করবেন না, হঠাৎ চলে আসা ব্যতীত’।[24]

(৪) বিদ‘আত করলে ইসলামের উপর অপূর্ণাঙ্গতার অপবাদ আরোপ করা হয় : আল্লাহ তা‘আলা অহি-র মাধ্যমে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই দ্বীন-ইসলামকে পূর্ণতা দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জে আরাফার ময়দানে ছাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে যখন তিনি বিদায় হজ্জ পালন করেছিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন,اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)।

অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূলুলল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই অহি-র বিধানের মাধ্যমে দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে, যাতে মানুষের সার্বিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগ পূর্ণাঙ্গরূপে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন,اَلمُبْتَدِعُ إِنَّمَا مَحْصُوْلُ قَوْلِهِ بِلِسَانِ حَالِهِ أَوْ مَقَالِهِ : إِنَّ الشَّرِيْعَةَ لَمْ تَتِمَّ، وَأَنَّهُ بَقِيَ مِنْهَا أَشْيَاءٌ يَجِبُ أَوْ يُسْتَحَبُّ اِسْتِدْرَاكَهَا، لِأَنَّهُ لَوْ كَانَ مُعْتَقِدًا كَمَالُهَا وَتَمَامُهَا مِنْ كُلِّ وَجْهٍ لَمْ يَبْتَدِعْ وَلاَ اسْتِدْرَكَ عَلَيْهَا- ‘বিদ‘আতীদের কথা ও বক্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, নিশ্চয়ই (ইসলামী) শরী‘আত অপূর্ণাঙ্গ এবং এর মধ্যে এমন কিছু জিনিস অপূর্ণ রয়ে গেছে যা পালন করা ওয়াজিব অথবা মুস্তাহাব। কেননা তারা (বিদ‘আতীরা) যদি ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ বলে বিশ্বাস করত, তাহ’লে তারা বিদ‘আত করত না’।[25]

অতএব ভাল কাজের দোহাই দিয়ে পূর্ণাঙ্গ এই দ্বীনের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত কোন বিধান জারী করলে দ্বীন-ইসলামের উপরে অপূর্ণাঙ্গতার মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হয়।

(৫) বিদ‘আত ইসলামী শরী‘আতকে ধ্বংস করে : বিদ‘আত ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে কোন কিছু সংযোজন, বিয়োজন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে তা ধ্বংসের কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ أَحَبُّ إِلَى الشَّيْطَانِ لِمُنَاقَضَتِهَا الْدِّيْنِ وَدَفْعِهَا لِمَا بَعَثَ اللهُ بِهِ رَسُوْلَهُ وَصَاحِبُهَا لاَ يَتُوْبُ مِنْهَا وَلاَ يَرْجِعُ عَنْهَا بَلْ يَدْعُوْ الْخَلْقَ إِلَيْهَا وَلِتَضَمُّنِهَا الْقَوْلُ عَلَى اللهِ بِلاَ عِلْمٍ- ‘শয়তানের নিকট সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত হ’ল বিদ‘আত। কেননা তা দ্বীনকে ধ্বংস করে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর আল্লাহর প্রেরিত বিধানকে নিষেধ করে। বিদ‘আতকারী কখনও তা থেকে তওবা করে না এবং তা থেকে ফিরে আসে না। বরং আল্লাহ সম্পর্কে ইলম বিহীন কথার মাধ্যমে মানুষকে বিদ‘আতের দিকে আহবান করে ও তার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে’।[26]

(৬) বিদ‘আত অন্তরকে কলূষিত করে : মানুষ যখন কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিদ‘আতের আনুগত্যে নিজেকে উৎসর্গ করে এবং সুন্নাতের অনুসরণকে যথেষ্ট বলে বিশ্বাস করে না, ঠিক তখনি মানুষের অন্তর ইসলাম ধ্বংসকারী কর্মকান্ড দ্বারা কলূষিত হয়।

শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, أَنَّ الشَّرَائِعَ أَغْذِيَةُ القُلُوْبِ، فَمَتَى اغْتَذَّتِ القُلُوْبُ بِالْبِدْعِ لَمْ يُبْقِ فِيْهَا فَضْلٌ لِلسُّنَنِ، فَتَكُوْنُ بِمَنْزِلَةٍ مَنْ اغْتَذَّى بِالطَّعَامِ الخَبِيْثِ- ‘নিশ্চয়ই (ইসলামী) শরী‘আতের বিধান সমূহ অন্তরের খাদ্য। কিন্তু যখন বিদ‘আত অন্তরের খাদ্য হয় তখন সেখানে সুন্নাতের জন্য অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। বরং তা নিকৃষ্ট খাদ্য ভক্ষণের স্থলাভিষিক্ত হয়।[27]

(৭) বিদ‘আতীর আমল আল্লাহর নিকট কবুল হয় না : মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের দরবারে ইবাদত কবুলের অন্যতম একটি শর্ত হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী ইবাদত করা। যখন ইবাদত সুন্নাত পরিপন্থী হয় তখন তা বিদ‘আতী আমলে পরিণত হয়, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকটে কবুল হয় না। যদিও মানুষ সেই আমলকে অত্যন্ত ভাল মনে করেই পালন করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِيْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا- ‘বল, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে সংবাদ দিব? ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্মই করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই শরী‘আতের মধ্যে নতুন এমন কিছু সৃষ্টি করল, যা তার (শরী‘আতের) অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত’।[28] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যাতে আমার নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[29]

(৮) বিদ‘আত ত্যাগ না করা পর্যন্ত বিদ‘আতীর তওবা কবুল হয় না : আল্লাহ রাববুল আলামীনের দরবারে তাওবা কবুলের শর্ত হ’ল, ১- সংশ্লিষ্ট পাপ কাজ বর্জন করা। ২- কৃত পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত বা লজ্জিত হওয়া। ৩- পরবর্তীতে কখনও এই পাপে লিপ্ত না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করা। অতএব যেহেতু বিদ‘আতীরা বিদ‘আতকে ভাল আমল হিসাবে পালন করে থাকে, সেহেতু তারা উক্ত গর্হিত পাপ থেকে বিরত থাকে না।

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ أَحَبُّ إِلَى إِبْلِيْسِ مِنَ الْمَعْصِيَةِ لِأَنَّ الْبِدْعَةَ لاَ يُتَابُ مِنْهَا وَالْمَعْصِيَةَ يُتَابُ مِنْهَا ‘ইবলীসের নিকট পাপের চেয়ে বিদ‘আত অধিক প্রিয়। কেননা পাপ থেকে মানুষ তওবা করে কিন্তু বিদ‘আত থেকে তওবা করে না। (কেননা সে বিদ‘আতকে ভাল কাজ বলে বিশ্বাস করে)’।[30]

আর বিদ‘আতকে বর্জন না করা পর্যন্ত তার তওবা কবুল হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ حَجَبَ التَّوْبَةَ عَنْ كُلِّ صَاحِبِ بِدْعَةٍ حَتَّى يَدَعَ بِدْعَتَهُ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিদ‘আতীর তওবা কবুল করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার বিদ‘আত থেকে বিরত না হয়’।[31]

(৯) বিদ‘আতী হাউযে কাউছারের পানি পান ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে : ক্বিয়ামতের সেই বিভীষিকাময় কঠিনতম দিনে যখন হাউযে কাউছারের পানি ব্যতীত কোন পানি থাকবে না, সেদিন প্রত্যেক বিদ‘আতীকে সেই হাউযে কাউছারের নিকট থেকে বিতাড়িত করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنِّيْ فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ، مَنْ مَرَّ عَلَىَّ شَرِبَ، وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا، لَيَرِدَنَّ عَلَىَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُوْنِيْ، ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَأَقُوْلُ إِنَّهُمْ مِنِّيْ فَيُقَالُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ فَأَقُوْلُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِيْ- ‘আমি তোমাদের পূর্বে হাউযের (হাউযে কাউছার) নিকটে পৌঁছে যাবে। যে আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করবে, সে হাউযের পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে সে আর কখনও পিপাসিত হবে না। নিঃসন্দেহে কিছু সম্প্রদায় আমার সামনে (হাউযে) উপস্থিত হবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারব, আর তারাও আমাকে চিনতে পারবে। এরপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেওয়া হবে। আমি তখন বলব, এরাতো আমারই উম্মত। তখন বলা হবে, তুমি জান না তোমার (মৃত্যুর) পরে এরা কি সব নতুন নতুন কথা ও কাজ সৃষ্টি করেছিল। তখন আমি বলব, দূর হোক দূর হোক (আল্লাহর রহমত থেকে), যারা আমার পরে দ্বীনের ভিতর পরিবর্তন এনেছে’।[32]

(১০) বিদ‘আতের দিকে আহবানকারী অন্যের পাপের অংশীদার হবে : যারা মানুষকে বিদ‘আতের দিকে আহবান করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা অন্যের পাপের অংশীদার হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لِيَحْمِلُوْا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِيْنَ يُضِلُّوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُوْنَ- ‘ক্বিয়ামত দিবসে তারা তাদের পাপভার পূর্ণমাত্রায় বহন করবে এবং তাদেরও পাপভার বহন করবে যাদেরকে তারা অজ্ঞতাহেতু বিভ্রান্ত করেছে। দেখ, তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট’ (নাহল ১৬/২৫)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا- ‘যে ব্যক্তি কাউকে সৎ পথের দিকে আহবান করে, তার জন্যও সেই পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে যা তাদের অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ এটা তাদের ছওয়াবের কোন অংশকেই কমাবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কাউকে গোমরাহীর দিকে আহবান করে, তার জন্য সেই পরিমাণ গুনাহ রয়েছে, যা তাদের অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ এটা তাদের গোনাহর কোন অংশকেই কমাবে না’।[33]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম রীতির প্রচলন করবে তার জন্য তার কাজের ছওয়াব রয়েছে এবং তার পরে যারা এ কাজ করবে তাদের ছওয়াবও রয়েছে। অথচ এতে তাদের ছওয়াবের কিছু কম করা হবে না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতির প্রচলন করবে, তার জন্যও তার কাজের গুনাহ এবং তার পরে যারা এ কাজ করবে তাদের গুনাহ রয়েছে। অথচ এটা দ্বারা তাদের গুনাহর কিছুই কম করা হবে না’।[34]

(১১) বিদ‘আতী অভিশপ্ত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,فَمَنْ أَحْدَثَ فِيْهَا حَدَثًا أَوْ آوَى فِيْهَا مُحْدِثًا، فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ، لاَ يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ- ‘যে ব্যক্তি এর মধ্যে (ইসলামে) বিদ‘আত সৃষ্টি করে কিংবা বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয়, তার উপর আল্লাহ, ফেরেশ্তা ও সকল মানুষের অভিসম্পাত। আললাহ তার কোন নফল ও ফরয ইবাদত কবুল করেন না’।[35]

(১২) বিদ‘আতের মাধ্যমে ইহুদী-খৃষ্টানদের স্বভাব ফুটে উঠে : ইহুদী-খৃষ্টানরা যেমন তাদের খেয়াল খুশিমত দুনিয়াতে বিচরণের জন্য তাওরাত ও ইঞ্জীলকে বিকৃত করেছে। যার মধ্যে আল্লাহর প্রকৃত কালাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিদ‘আতের অনুসারীরাও তেমনি নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করতে এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাক্বলীদের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ভাল কাজের দোহাই দিয়ে বিদ‘আতের প্রচলন করে থাকে। আর এ সকল বিদ‘আতের আবরণে প্রকৃত সুন্নাত ঢাকা পড়েছে। তাই বিদ‘আতকে শক্ত হস্তে দমন না করলে প্রকৃত ইসলাম বিদায় নিবে। আল্লাহ ইসলামকে হেফাযত করুন।- আমীন!

(১৩) বিদ‘আতের মাধ্যমে পিতৃপুরুষের অন্ধ অনুসরণের জাহেলী স্বভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটে : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মক্কার কাফিরদেরকে দেবদেবীর উপাসনা ছেড়ে এক আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহবান করতেন, তখন তারা তাদের বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে বলত, আমরা তারই অনুসরণ করব, যার উপর আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَلاَ يَهْتَدُوْنَ- وَمَثَلُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا كَمَثَلِ الَّذِيْ يَنْعِقُ بِمَا لاَ يَسْمَعُ إِلاَّ دُعَاءً وَنِدَاءً صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لاَ يَعْقِلُوْنَ- ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তারই অনুসরণ কর। তখন তারা বলে, না, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি তার অনুসরণ করব। যদিও তাদের পিতৃপুরুষগণ কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎপথেও পরিচালিত ছিল না, তথাপিও? যারা কুফরী করে তাদের উদাহরণ হ’ল, যেমন কোন ব্যক্তি এমন কিছুকে ডাকে যা হাঁক ডাক ছাড়া আর কিছুই শ্রবণ করে না- বধির, মূক, অন্ধ, সুতরাং তারা বুঝবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০-১৭১)।

অনুরূপভাবে বিদ‘আতের অনুসারীদেরকে তাদের লালনকৃত বিদ‘আতকে বর্জন করে সুন্নাতের অনুসরণের দিকে আহবান করলে তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদারা কি কিছুই বুঝত না? পূর্বেকার আলেমেরা কি কুরআন-হাদীছ বুঝতেন না? আজ আবার নতুন নতুন হাদীছ কোথা থেকে বের হচ্ছে? এই বলে তারা তাদের বাপ-দাদাদের অনুসরণীয় আমলের উপর অটল থাকে এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করে।

(১৪) বিদ‘আতের মাধ্যমে সুন্নাতের অপমৃত্যু ঘটে : মুসলিম সমাজে যখন কোন বিদ‘আত চালু হয় তখন সেখান থেকে সে পরিমাণ সুন্নাত বিলুপ্ত হয়। আর প্রচলিত বিদ‘আতই মানুষের নিকট সুন্নাত হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। যেমন- ফরয ছালাতের পরে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত বর্তমান সমাজে বহুল প্রচলিত একটি বিদ‘আত। যার মাধ্যমে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত ফরয ছালাতের পরে পঠনীয় সুন্নাতী দো‘আ সমূহের বিলুপ্তি ঘটেছে। ফরয ছালাতের পরে রাসূল (ছাঃ) যে দো‘আগুলো পাঠ করেছেন এবং ছাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন তা পাঠ করতে হ’লে ন্যূনতম ১০ মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাতের মত বিদ‘আতের মাধ্যমে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই মুনাজাতের পরিসমাপ্তি ঘটে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّهُ سَيَلِيْ أَمْرَكُمْ مِنْ بَعْدِيْ رِجَالٌ يُطْفِئُوْنَ السُّنَّةَ وَيُحْدِثُوْنَ بِدْعَةً وَيُؤَخِّرُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ مَوَاقِيْتِهَا. قَالَ ابْنُ مَسْعُوْدٍ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَيْفَ بِيْ إِذَا أَدْرَكْتُهُمْ قَالَ لَيْسَ طَاعَةٌ لِمَنْ عَصَى اللهَ قَالَهَا ثَلاَثَ مَرَّاتٍ-

‘নিশ্চয়ই তোমরা আমার (মৃত্যুর) পরে তোমাদের শরী‘আতকে এমন অবস্থায় পাবে- যখন মানুষ সুন্নাতকে বিলুপ্ত করবে, বিদ‘আত সৃষ্টি করবে এবং ছালাতের সময় ছালাত আদায় না করে দেরী করে আদায় করবে। তখন ইবনু মাসউদ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি যদি তাদেরকে পাই তাহ’লে আমি কি করব? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর অবাধ্যদের কোন আনুগত্য নেই। এ কথা তিনি তিনবার বললেন।[36]

অন্য হাদীছে এসেছে, مَا ابْتَدَعَ قَوْمٌ بِدْعَةً فِيْ دِيْنِهِمْ إِلاَّ نَزَعَ اللهُ مِنْ سُنَّتِهِمْ مِثْلَهَا، ثُمَّ لاَ يُعِيْدُهَا إِلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ- ‘যখন কোন জাতি তাদের দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করে তখন আল্লাহ তাদের মধ্যে থেকে সে পরিমাণ সুন্নাত বিদূরিত করেন। অতঃপর তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের নিকট ফিরিয়ে দেন না’।[37]

[চলবে]

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।​

[1]. মুসলিম হা/১০১৭; মিশকাত হা/২১০।
[2]. আল-মাকাছেদ ইনদাল ইমাম শাতেবী ১/৪৮৩ পৃঃ।
[3]. ফায়ছাল ইবনু আব্দুল আযীয আলে মুবারক, মাকামুর রাশাদ ১/২৫ পৃঃ।
[4]. বুখারী হা/৩০৯৩; মুসলিম হা/১৭৫৯।
[5]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫।
[6]. ইমাম নববী (রহঃ), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত ৩/২২ পৃঃ।
[7]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল-ইসতিক্বামাহ ১/৪২ পৃঃ।
[8]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, মাজমু ফাতাওয়া ৮/৩৪৬ পৃঃ।
[9]. জুরজানী, আত-তা‘রীফাত ১/৬২ পৃঃ।
[10]. ইমাম সুয়ূতী, আল-আমরু বিল ইত্তেবা ওয়ান নাহী আনিল ইবতিদা, ৮৮ পৃঃ।
[11]. ইমাম শাতেবী, আল-ই‘তিছাম ১/৩৭।
[12]. ইমাম শাতেবী, আল-মুয়াফাকাত ২/৩৪২ পৃঃ।
[13]. তাফসীর ইবনু কাছীর ২/৫৯১ পৃঃ।
[14]. ইবনুল কাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ১/৩৭২ পৃঃ।
[15]. বারবাহারী, শারহুস সুন্নাহ ৪৫ পৃঃ।
[16]. আশরাফ ইবরাহীম কাতকাত, আল-বুরহানুল মুবীন ফিত তাছাদ্দী লিল বিদ্ই ওয়াল আবাতীল ১/৪২ পৃঃ।
[17]. সিলসিলা ছহীহা হা/ ১৮০৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/১৩৮২৫, ইমাম শাফেঈ, কিতাবুর রিসালাহ, ১৫ পৃঃ।
[18]. মুসনাদে আহমাদ হা/২১৬৮৯, ২১৭৭০, ২১৭৭১, ২১৩৯৯, ৫ম খন্ড, পৃঃ ১৬৩; ছহীহাহ হা/১৮০৩।
[19]. তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ১/১২২ পৃঃ; আলবানী, সনদ ছহীহ।
[20]. ইবনু আব্দুল বার্র, জামেউ বায়ানি ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১৮১০ পৃঃ।
[21]. তদেব।
[22]. মুল্লা আলী ক্বারী, শাম্মুল আওয়ারেয ফী যাম্মির রাওয়াফেয ১/১৪৫।
[23]. জামেউ বায়ানি ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১৮১০ পৃঃ।
[24]. তাফসীর ইবনু কাছীর ৪/১৫৭ পৃঃ; সূরা আহকাফ ১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[25]. আবু ইসহাক আশ-শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম ১/৪৯ পৃঃ।
[26]. ইবনুল কাইয়িম, মাদারিকুছ ছালেহীন ১/২২৩ পৃঃ।
[27]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া, ইকতিযাউছ ছিরাতিল মুসতাকীম লি মুখালাফাতি আছহাবীল জাহীম ১/২১৭-২১৮ পৃঃ।
[28]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; মিশকাত হা/১৪০।
[29]. বুখারী ৯৬/২০ নং অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ৬/৪৬৭ পৃঃ; মুসলিম হা/১৭১৮।
[30]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯০০৯; ইবনুল কাইয়িম, মাদারিজুস সালেহীন ১/৩২২ পৃঃ।
[31]. তবারানী, ছহীহ তারগীব হা/৫৪; সিলসিলা ছহীহা হা/১৬২০।
[32]. বুখারী হা/৬৫৮৩-৮৪; মুসলিম হা/২২৯০; মিশকাত হা/৫৫৭১।
[33]. মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮।
[34]. মুসলিম হা/১০১৭; মিশকাত হা/২১০, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৯ পৃঃ।
[35]. বুখারী হা/৩১৭২; মুসলিম হা/১৩১৭; মিশকাত হা/২৭২৮।
[36]. মুসনাদে আহমাদ হা/৩৭৯০; সিলসিলা ছহীহা হা/২৮৬৪।
[37]. সুনানুদ দারেমী হা/৯৮; মিশকাত হা/১৮৮; আলবানী, সনদ ছহীহ, আত-তাওয়াস্সুল আনওয়াউহু ওয়া আহকামুহু ১/৪৬ পৃঃ।

🔵 বিদআত - বিদ‘আত ও তার পরিণতি - পর্ব ১
🔵 বিদআত - বিদ‘আত ও তার পরিণতি - পর্ব ২
 

Create an account or login to comment

You must be a member in order to leave a comment

Create account

Create an account on our community. It's easy!

Log in

Already have an account? Log in here.

Total Threads
13,357Threads
Total Messages
17,248Comments
Total Members
3,685Members
Latest Messages
Md. OheduzzamanLatest member
Top