সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।
Joynal Bin Tofajjal

পীরতন্ত্র : সংশয় নিরসন (২)

  • Thread starter

পীরতন্ত্র : সংশয় নিরসন (২)​

.​


পঞ্চম দলীল :
আল্লাহ তা‘আলার বাণী- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের’ (নিসা ৪/৫৯)। অত্র আয়াতে বর্ণিত উলুল আমরের মধ্যে পীর ছাহেবরা অন্তর্গত। কারণ শারঈ বিষয়ে তারাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তাই আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পীরের আনুগত্য করা ফরয।

জবাব : প্রথমতঃ উলুল আমর কারা সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক। জগদ্বিখ্যাত মুফাসসির ইবনু কাছীর (রহঃ) তার তাফসীরে ‘উলুল আমর’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, فِيمَا أَمَرُوكُمْ بِهِ مِنْ طَاعَةِ اللهِ لَا فِي مَعْصِيَةِ اللهِ، فَإِنَّهُ لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ، ‘উলুল আমর তারাই, যারা তোমাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দেয়, অবাধ্যতার নির্দেশ দেয় না। কেননা আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই’।[1] প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন,هم الأمراء ‘তারা হ’লেন রাষ্ট্রনায়কগণ’।[2]

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তারা হ’লেন,أَهْلُ الْفِقْهِ وَالدِّيْنِ، وَأَهْلُ طَاعَةِ اللهِ الَّذِينَ يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ مَعَالِيَ دِينِهِمْ وَيَأْمُرُونَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ، وَيَنْهَوْنَهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ، فَأَوْجَبَ اللهُ طَاعَتَهُمْ، ‘(তারা হলেন) তাওহীদ ও ফিক্বহের অনুসারী এবং আল্লাহর আনুগত্যের অনুসারী, যারা মানুষকে তাদের দ্বীনের মর্যাদা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। আর মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের আনুগত্য করা বান্দার উপর ওয়াজিব করেছেন’।[3] মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, তারা হ’লেন الفقهاء والعلماء ‘ফক্বীহ ও ওলামায়ে কেরাম’।[4] জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ) বলেন, أولوا الفقه والخير، ‘তারা হ’লেন ফক্বীহ ও কল্যাণকারীগণ’।[5]

সম্মানিত পাঠক! উপরোক্ত মুফাসসিরগণের তাফসীরের সারাংশ এই যে, ‘উলুল আমর’ হচ্ছেন রাষ্ট্রনায়ক, দেশের শাসক, বাদশাহ, আলিম ও ফিক্বহবীদগণ। সুতরাং উলুল আমরের দোহাই দিয়ে তাওহীদপন্থী যোগ্য ওলামায়ে কেরাম ও ফক্বীহদের আনুগত্য ছেড়ে ইসলামের লেবাসধারী কিছু অযোগ্য লোকদের পীর সাব্যস্ত করে তার অন্ধ অনুসরণ করা আদৌ শরী‘আত সম্মত নয়।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য হবে বিনা শর্তে। কিন্তু উলুল আমর-এর আনুগত্য হবে শর্ত সাপেক্ষে। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর ও তদীয় রাসূলের আনুগত্যের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু উলুল আমর-এর আনুগত্যের ক্ষেত্রে أَطِيعُوا শব্দের ব্যবহার করেননি। এটা প্রমাণ করে যে, উলুল আমর-এর আনুগত্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের সাথে শর্তযুক্ত। কখনো উলুল আমর-এর কোন নির্দেশনা কিংবা তার কোন আমল কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর বিপরীত পরিলক্ষিত হ’লে সাথে সাথে তার আনুগত্য ছেড়ে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের আনুগত্যে ফিরে আসতে হবে। যেমন সিরিয়ার এক ব্যক্তি হজ্জে তামাত্তু‘-এর ইহরাম বাঁধলেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তরে বললেন যে, হজ্জে তামাত্তু‘ বৈধ। তখন সিরিয়াবাসী বললেন, আপনার পিতা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হজ্জে তামাত্তু‘ নিষেধ করেছেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন,

أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ أَبِى نَهَى عَنْهَا وَصَنَعَهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَأَمْرَ أَبِى نَتَّبِعُ أَمْ أَمْرَ رَسُولِ اللهِ (ص) فَقَالَ الرَّجُلُ بَلْ أَمْرَ رَسُولِ اللهِ (ص) فَقَالَ لَقَدْ صَنَعَهَا رَسُولُ اللهِ (ص) -

‘তুমি কি মনে কর, কোন বিষয় যদি আমার পিতা নিষেধ করেন আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা করে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে কি আমার পিতার অনুসরণ করা হবে, না রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা হবে? লোকটি বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা হবে। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জে তামাত্তু‘ করেছেন’।[6]

সম্মানিত পাঠক! উক্ত হাদীছের প্রতি লক্ষ্য করুন। আর নিজেকে প্রশ্ন করুন, কার মতকে অমান্য করা হচ্ছে? কে অমান্য করছেন এবং কেন অমান্য করছেন? আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর মতকে অমান্য করা হচ্ছে। অমান্য করছেন তাঁরই সন্তান আব্দুল্লাহ। আর কেবলমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের উপর অটল থাকার জন্যই এই অমান্য করা। আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যে দৃঢ় থাকতে গিয়ে যদি আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর মত বিশিষ্ট ছাহাবী পিতা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর মতের তোয়াক্কা না করেন, তবে কি আমরা পীরদের কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বিরোধী ও ঈমান বিধ্বংসী মতের অনুসরণ করতে পারি? কখনোই নয়।

সম্মানিত পাঠক! লক্ষ্য করুন পীরের মাযারগুলোর দিকে। যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারী মুরীদানদের সাথে পীর বাবার একান্ত মুলাকাত, যাবতীয় রোগ-ব্যাধি ও মনোবাসনা পূরণের তাবীয ব্যবসা, ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ-এর দোহাই দিয়ে গাঁজা সেবন, কারামাতে আউলিয়ার নামে মিথ্যা স্বপ্নের কাহিনী রচনা করে সাধারণ মানুষের ঈমান হরণ সহ অসংখ্য গর্হিত কাজের দৃষ্টান্ত রয়েছে সেখানে। সুতরাং সেখানে বসে থাকা ধোঁকাবাজ পীরেরা কি উলুল আমর-এর অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারে? আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

তৃতীয়তঃ উক্ত আয়াতে বর্ণিত وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ দ্বারা কোন মৃত পীরের অনুসরণ বুঝানো হয়নি। কারণ উলুল আমর-এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে مِنْكُمْ শব্দ; যার অর্থ হ’ল ‘তোমাদের মধ্যকার’। এর দ্বারা অতীত বুঝায় না। বরং বর্তমান উলুল আমরকে বুঝায়। যেমন আল্লাহ বলেন,فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘তোমাদের মধ্যেকার যে ব্যক্তি মাসটি (রামাযান মাস) পায়, সে যেন ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيْضًا ‘অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৪)।أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ ‘অথবা তোমাদের মধ্য হ’তে যদি কেউ পায়খানা থেকে আসে’ (নিসা ৪/৪৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا ‘তোমাদের মধ্যকার যে ব্যক্তি কোন গর্হিত কাজ দেখবে’।[7]

এভাবে কুরআনে ও হাদীছে যত জায়গায় مِنْكُمْ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সব জায়গায় জীবিত ও বর্তমান ব্যক্তিদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। অনুরূপভাবে أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ দ্বারা স্ব স্ব যুগের ওলামা-ফুক্বাহা বা শাসকবর্গকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ দ্বারা অতীতে মৃত্যুবরণকারী কোন পীর বা আউলিয়াকে বুঝানো হয়নি। অথচ মুসলিম নামধারী বুহু মানুষ আজ অতীতে মৃত্যুবরণকারী বহু পীরের অনুসরণ করে। তাদের বিশ্বাস, তারা তাদের মুরীদানদের উপকার করতে পারে, সন্তান দিতে পারে, বিপদ-মুছীবত থেকে রক্ষা করতে পারে ইত্যাদি। আর এজন্যই তারা তাদের সকল চাওয়া-পাওয়া সরাসরি আল্লাহর কাছে না চেয়ে তাদের অনুসরণীয় পীরের কাছে চেয়ে থাকে। অথচ মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া স্পষ্ট শিরক।

বরং কোন মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য তিনটি শর্ত লক্ষণীয়। (ক) أن يكون حيا জীবিত হওয়া : অর্থাৎ কোন মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না। (খ)أن يكون حاضرا উপস্থিত থাকা : অর্থাৎ কোন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না। হয় তার কাছে গিয়ে সরাসরি সাহায্য চাইতে হবে। অথবা ফোনের মাধ্যমে সাহায্য চাইতে হবে; যাতে সে আমার কথা শুনতে পায়। (গ) أن يكون قادرا সক্ষম হওয়া : অর্থাৎ এমন কিছু চাওয়া যাবে না যা দেওয়ার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। যেমন- সন্তান চাওয়া, সুস্থতা কামনা করা; যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ দিতে সক্ষম নয়। সুতরাং মানুষ দিতে সক্ষম এমন কোন জিনিস জীবিত ও উপস্থিত ব্যক্তির কাছে চাইতে পারে। অন্যথায় তা শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে অনাবৃষ্টি দেখা দিলে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) আববাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করেছিলেন।[8] মৃত কিংবা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া জায়েয হ’লে ওমর (রাঃ) আববাস (রাঃ)-এর মাধ্যমে দো‘আ না করে রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করতেন। তাই উলুল আমর-এর দোহাই দিয়ে মৃত মানুষের নিকটে সাহায্য চাওয়া যাবে না।

চতুর্থতঃ আল্লাহ তা‘আলা যেমন উলুল আমর-এর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনি তাদের আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিলে তা থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ ‘যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও’ (নিসা ৪/৫৯)।

সম্মানিত পাঠক! আমরা যদি উল্লিখিত আয়াতাংশের অনুসরণ করি তাহ’লে কোন পীরের অস্তিত্ব থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আল্লাহর যিকিরের কথা। যিকির কি দাঁড়িয়ে করব? না-কি বসে? উচ্চৈঃস্বরে, না-কি নিম্নস্বরে? যেমন একেক পীরের যিকিরের পদ্ধতি একেক রকম। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা নাচের তালে তালে, কেউবা আবার কবরে মুনকির নাকিরের প্রশ্ন ঠেকানোর জন্য যিকিরের পদ্ধতি চালু করেছে। ইসলামের বিধানে যিকিরের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই। কিন্তু যিকিরের পদ্ধতি নিয়ে যে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি সমাধানের জন্য উক্ত আয়াতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে যাই, তাহ’লে নব আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে যিকিরের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। কেননা যিকরের পদ্ধতি উল্লেখপূর্বক মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ، ‘তুমি তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কর তথা যিকির কর মনে মনে কাকুতি-মিনতি ও ভীতি সহকারে অনুচ্চস্বরে সকালে ও সন্ধ্যায়। আর তুমি উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আ‘রাফ ৭/২০৫)। এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে ফিরে গেলে মতভেদ দূরীভূত হবে।

সম্মানিত পাঠক! সূরা নিসার ৫৯নং আয়াতের প্রথমাংশে বর্ণিত উলুল আমরের অনুসরণের দোহাই দিয়ে পীরতন্ত্রে বিশ্বাসীরা তাদের পক্ষে দলীল উপস্থাপন করে। মাযহাব পন্থীরা মাযহাব মানা ফরয হওয়ার পক্ষে দলীল পেশ করে। অথচ আয়াতটির শেষাংশ গ্রহণ করে না। এক পীরের সাথে আরেক পীরের আক্বীদাহ আমলের মিল নেই। এক মাযহাবের সাথে আরেক মাযহাবের আমলের মিল নেই। এক্ষণে আমরা সবাই যদি নিজেদের হিংসা, অহংকার, গোঁড়ামি ছেড়ে মতভেদপূর্ণ বিষয়গুলো আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে ফিরিয়ে দিতাম তাহ’লে এতগুলো মাযহাব থাকত না এবং পীরদের নামে কোন মাযার সৃষ্টি হ’ত না। আমরা সবাই এক মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত হ’তাম। আর সেটা হ’ত রাসূল (ছাঃ)-এর মাযহাব। তাই আসুন আমরা কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা না করে পরিপূর্ণভাবে কুরআনের অনুসরণ করি।

ষষ্ঠ দলীল :
আল্লাহ তা‘আলার বাণী- اتَّبِعُوا مَنْ لَا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُمْ مُهْتَدُونَ، ‘অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোনরূপ প্রতিদান চান না এবং তারা সুপথ প্রাপ্ত (ইয়াসীন ৩৬/২১)। এখানে রাসূল (ছাঃ)-এর কথা বলা হয়েছে। দ্বীন প্রচারে পীর বা আল্লাহর ওলীগণ এই সিলসিলা জারী রেখেছেন। যেমন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর দাওয়াতে হিন্দুস্থানে ৯০ লক্ষ মানুষ ইসলাম কবুল করেছে। বাংলাদেশে কোন নবী ও ছাহাবী আসেননি। তারপরেও কোটি কোটি মানুষ ইসলাম কবুল করেছে পীরদের দাওয়াতে। তাই পীরতন্ত্র অস্বীকার করা ইসলামকে অস্বীকারের শামিল।

জবাব : উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন তাদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। (১) যারা দ্বীন প্রচারে কোন বিনিময় চান না। (২) যারা হেদায়াতপ্রাপ্ত।

সম্মানিত মুসলিম ভাই! প্রথমতঃ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করুন, উল্লিখিত আয়াতটি কি পীরবাদের পক্ষে দলীল হওয়ার কোন সুযোগ আছে? কখনো নয়; বরং আয়াতটি তাদের বিরুদ্ধে দলীল। কেননা মাযারগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রত্যেকটি পীরের মাযারে বেশ কিছু খাদেম রয়েছে যারা সেখানে আগত মুরীদানদের কাছে হাদিয়া চাওয়া ও গ্রহণের কাজে ব্যস্ত থাকে। শুধু তাই নয়, প্রাপ্ত হাদিয়া সমূহ নিয়ে রমরমা ব্যবসা চলে। এক মুরীদের প্রদত্ত হাদিয়া কিছুক্ষণ পরেই অন্য মুরীদের কাছে বিক্রি করা হয়। সেটাই আবার মাযারে আসে। পুনরায় সেটা বিক্রি করা হয়। এভাবে চলতে থাকে হাদিয়া কেনা-বেচার ব্যবসা। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, দাদা হুজুরের তাবীয ব্যবসা। বিশ্ব নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে মদীনায় বসবাস করলেন, মৃত্যুবরণ করলেন, যার কবর মদীনাতেই হ’ল। সেই মদীনাতে যমযম কূপের লাইন আসল না। অথচ সিলেটের শাহজালালের মাযারে যমযম কূপের লাইন আসল! সেই কূপের পানি নিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। এতো কিছুর পরেও কি বলা যায়, তারা বিনা প্রতিদানে দ্বীনের প্রচার করছে? না; বরং এরা মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। তাই বলা চলে, প্রতেকটি পীরের মাযার একেকটি প্রতারণা কেন্দ্র। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়’।[9]

দ্বিতীয়তঃ যারা মানুষকে শিরক ও বিদ‘আতের দিকে আহবান করছে, যাদের আক্বীদাহ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদার বিপরীত, তাদেরকে কি হেদায়াতপ্রাপ্ত বলা যায়? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ، ‘অতএব যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা নিশ্চয়ই যিদের মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। তাই শুধু ঈমানের দাবী করলেই ঈমানদার হওয়া যায় না। বরং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের ঈমানের সাথে নিজের ঈমানের মিল থাকতে হয়।

তৃতীয়তঃ কারো দাওয়াতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ইসলাম কবুল করা পীরদের আনুগত্য ফরয হওয়ার প্রমাণ বহন করে না। যদি বিষয়টি এমনই হয়, তাহ’লে কিছু নবী আছেন যাদের দাওয়াতে একজন মানুষও ইসলাম কবুল করেনি। আবার কিছু নবী আছেন যাদের দাওয়াতে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করেছে। তবে কি বলা যাবে যে, এমন নবীদের আনুসরণ করতে হবে না। কিংবা এসব নবীদের চেয়ে খাযা মইনুদ্দীন চিশতী উত্তম। নাউযুবিল্লাহ। যুগে যুগে বহু মনীষীর দাওয়াতে বহু সংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করেছে। বর্তমানে ড. যাকির নায়েকের দাওয়াতে লক্ষাধিক মানুষ ইসলাম কবুল করেছে; যা আমরা চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। এক্ষণে কি বলা যাবে যে, ড. যাকির নায়েককে পীর বলে বিশ্বাস করতে হবে? তা না হ’লে ইসলামকে অস্বীকার করা হবে। নাউযুবিল্লাহ। সুতরাং এ সমস্ত কথা বলে পীরতন্ত্রকে কায়েম করার চেষ্টা স্রেফ ধোঁকাবাজি এবং দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِى الدِّينِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِى الدِّينِ ‘হে মানব জাতি! দ্বীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে তোমরা সাবধান থাকো। কেননা তোমাদের পূর্বেকার লোকেদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের বাড়াবাড়ি ধ্বংস করেছে’।[10] সুতরাং আসুন! যুক্তি ও বাড়াবাড়ি পরিহার করে আমরা দলীল ভিত্তিক ইসলাম মানার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

(চলবে)
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলা্ব
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টাব্য।
[2]. সিলসিলাতুল আছার আছ-ছহীহাহ, আবু আব্দুল্লাহ দানী আলে যুহরী হা/৪৪৩, সনদ ছহীহ।
[3]. মুস্তাদরাক হাকেম হা/৪২৩; দুররুল মানছূর, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[4]. তদেব, হা/২০, সনদ ছহীহ।
[5]. তদেব, হা/১৯, সনদ ছহীহ।
[6]. তিরমিযী হা/৮২৩, সনদ ছহীহ।
[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯০৯ ‘সৎকাজের আদেশ’ অধ্যায়।
[8]. বুখারী হা/১০১০, ৩৭১০; মিশকাত হা/১৫০৯।
[9]. মুসলিম হা/১০২; তিরমিযী হা/১৩৩৫; ইবনু মাজাহ হা/২২২৪।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/৩০২৯; ছহীহাহ হা/১২৮৩।
 

Create an account or login to comment

You must be a member in order to leave a comment

Create account

Create an account on our community. It's easy!

Log in

Already have an account? Log in here.

Total Threads
12,909Threads
Total Messages
16,410Comments
Total Members
3,339Members
Latest Messages
fahad ahmedLatest member
Top