সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।
Mehebub Murshid

অন্যান্য তিনটিতে মুক্তি ও তিনটিতে ধংস

Mehebub Murshid

Active member

LV
4
 
Awards
17
Credit
12
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثٌ مُنْجِيَاتٌ وَثَلاَثٌ مُهْلِكَاتٌ- فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ : فَتَقْوَى اللهِ فِي السِّرِّ وَالْعَلاَنِيَةِ، وَالْقَوْلُ بِالْحَقِّ فِي الرِضَا وَالسَّخَطِ، وَالْقَصْدُ فِي الْغِنَى وَالْفَقْرِ، وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ : فَهَوًى مُتَّبَعٌ، وَشُحٌّ مُطَاعٌ، وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ، وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ- ‘তিনটি বস্ত্ত মুক্তিদানকারী ও তিনটি বস্ত্ত ধ্বংসকারী। মুক্তিদানকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল (১) গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা (২) সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে সত্য কথা বলা (৩) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক’।[1]

(১) তাক্বওয়া : অর্থ আল্লাহকে ভয় করা। যা শয়তানের আনুগত্য থেকে মানুষকে রক্ষা করে। একইভাবে এটি মানুষকে সকল অসৎকর্ম এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন,يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মরো না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)।

আল্লাহভীরুতা মানুষকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে সংযত রাখে। আল্লাহ বলেন,وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى- فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী হ’তে বিরত রাখে’ ‘জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। বিগত যুগে পাহাড়ের গুহায় আটকে পড়া বনু ইস্রাঈলের তিন যুবকের একজন তার প্রেমিকার সাথে অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মেয়েটি বলেছিল, يَا عَبْدَ اللهِ اتَّقِ اللهَ، ‘হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর’। এই কথায় যুবকটি আল্লাহ থেকে ভীত হয় এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত হয়। অতঃপর সে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বলে,اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّى فَعَلْتُ ذَالِكَ مِنْ خَشْيَتِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا، ‘হে আল্লাহ! যদি তুমি জানো যে আমি কেবল তোমার ভয়ে সেদিন উক্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত হয়েছিলাম, তাহ’লে তুমি আমাদেরকে এই কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি দাও’। তখন আল্লাহর হুকুমে পাথর সরে যায় এবং গুহার মুখ

খুলে যায়। অতঃপর তারা তিনজন বেরিয়ে আসে।[2]

বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَيُّهَا النَّاسُ... اتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ وَصُومُوا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيعُوا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ- ‘হে জনগণ!... তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর। রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর। তোমাদের মালের যাকাত দাও। তোমাদের আমীরের আনুগত্য কর। তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর’।[3]

বস্ত্ততঃ মুমিন সূদ-ঘুষ, যেনা-ব্যাভিচার এবং সকল প্রকার অন্যায় ও দুর্নীতি হ’তে বিরত থাকে কেবল আল্লাহর ভয়ে। তাই তাক্বওয়া হ’ল ব্যক্তি ও জাতীয় উন্নতির চাবিকাঠি।

(২) সদা সত্য কথা বলা : আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، ‘তোমাদের উপর সত্যবাদিতাকে অপরিহার্য করা হ’ল। কেননা সত্যবাদিতা সৎকর্মের দিকে চালিত করে। আর সৎকর্ম জান্নাতের পথে চালিত করে। আর ঐ ব্যক্তি সর্বদা সত্য বলে এবং সত্যকেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে। ফলে সে আল্লাহর নিকটে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়’।[4] যেমন মি‘রাজের অবিশ্বাস্য ঘটনায় কুরায়েশদের সন্দেহ আরোপের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন বিশ্বাস ঘোষণার জন্য রাসূল (ছাঃ) আবুবকর (রাঃ)-কে ‘ছিদ্দীক্ব’ উপাধি দান করেন।[5]

রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ يَّضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ، أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ- ‘যে ব্যক্তি আমার নিকট তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী বস্ত্ত দু’টির যামিন হবে, আমি তার জান্নাতের যামিন হব’।[6]

(৩) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা : আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ إِذَآ أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَالِكَ قَوَامًا- ‘(আল্লাহর বিনয়ী বান্দা তারাই) যখন তারা ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করেনা বা কৃপণতা করেনা। বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)। তিনি বলেন,إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوآ إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا- ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/২৭)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার বিষয়টি নির্ধারিত হয়ে গেছে। অতএব তোমরাسَدِّدُوا وَقَارِبُوا، فَإِنَّ صَاحِبَ الجَنَّةِ يُخْتَمُ لَهُ بِعَمَلِ أَهْلِ الجَنَّةِ وَإِنْ عَمِلَ أَيَّ عَمَلٍ، وَإِنَّ صَاحِبَ النَّارِ يُخْتَمُ لَهُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ وَإِنْ عَمِلَ أَيَّ عَمَلٍ- ‘মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সচেষ্ট হও। কেননা জান্নাতী ব্যক্তি জান্নাতী আমলের উপরেই মৃত্যুবরণ করবে, চাই সে যে আমলই করুক না কেন। আর জাহান্নামী ব্যক্তি জাহান্নামী আমলের উপরেই মৃত্যুবরণ করবে, চাই সে যে আমলই করুক না কেন’।[7]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا، وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا آتَاهُ- ‘সফলকাম হ’ল সেই ব্যাক্তি, যে ইসলাম গ্রহণ করল, তাকে প্রয়োজন মাফিক জীবিকা প্রদান করা হ’ল এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তার উপর সে সন্তুষ্ট থাকল’।[8]

ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল :

(১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া : আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللهِ قُلْ لآ أَتَّبِعُ أَهْوَآءَكُمْ قَدْ ضَلَلْتُ إِذًا وَّمَآ أَنَا مِنَ الْمُهْتَدِينَ- ‘তুমি কাফেরদের বলে দাও যে, আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা যাদের আহবান কর, তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। বলে দাও যে, আমি তোমাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করব না। তাতে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাব এবং সুপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকবো না’ (আন‘আম ৬/৫৬)।

আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে ধমক দিয়ে বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلاً؟ ‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে?’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩)। তিনি স্বীয় রাসূলকে নিষেধ করে বলেন, وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا- وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَآءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَآءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّآ أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا، ‘তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’। ‘তুমি বলে দাও যে, সত্য এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে। অতএব যে চায় তাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক। আর যে চায় তাতে অবিশ্বাস করুক; আমরা সীমালংঘনকারীদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহ্ফ ১৮/২৮-২৯)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করে বলতেন,اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُّنْكَرَاتِ الْأَخْلاَقِ وَالْأَعْمَالِ وَالْأَهْوَاءِ- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি অন্যায় চরিত্র, কর্ম ও প্রবৃত্তি পূজা হ’তে’।[9] হযরত আলী (রাঃ) বলেন,إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَتَخَوَّفُ عَلَيْكُمُ اثْنَتَانِ : طُولُ الْأَمَلِ، وَاتِّبَاعُ الْهَوَى، فَأَمَّا طُولُ الْأَمَلِ فَيُنْسِي الْآخِرَةَ، وَأَمَّا اتِّبَاعُ الْهَوَى فَيَصُدُّ عَنِ الْحَقِّ- ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে ভীত হই দু’টি বিষয়ে। দীর্ঘ আকাংখা ও প্রবৃত্তি পূজা। দীর্ঘ আকাংখা মানুষকে আখেরাত ভুলিয়ে দেয়। অতঃপর প্রবৃত্তি পূজা মানুষকে সত্য থেকে বিরত রাখে’।[10]

(২) লোভের দাস হওয়া : আল্লাহপাক ইহূদীদের সম্পর্কে বলেন,وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَّمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَّمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُّعَمَّرَ وَاللهُ بَصِيرٌم بِمَا يَعْمَلُونَ- ‘তুমি তাদেরকে পাবে পার্থিব জীবনের প্রতি অন্যদের চাইতে অধিক আসক্ত, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে যেন সে হাযার বছর বেঁচে থাকে। অথচ এরূপ দীর্ঘ আয়ু তাদেরকে (মৃত্যু বা আখেরাতের) শাস্তি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। বস্ত্ততঃ তারা যা করে, সবই আল্লাহ দেখেন’ (বাক্বারাহ ২/৯৬)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَوْ كَانَ لِابْنِ آدَمَ وَادِيَانِ مِنْ مَّالٍ لاَبْتَغَى ثَالِثًا، وَلاَ يَمْلَأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إِلاَّ التُّرَابُ، وَيَتُوبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ- ‘যদি আদম সন্তানকে এক ময়দান ভর্তি স্বর্ণ দেওয়া হয়, তাহ’লে সে দুই ময়দান ভর্তি স্বর্ণের আকাংখা করবে। আর তার মুখ কখনোই ভরবে না মাটি ব্যতীত (অর্থাৎ কবরে না যাওয়া পর্যন্ত)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করে থাকেন’।[11] অর্থাৎ অধিক পাওয়ার আকাংখা থেকে তওবা করতে হবে। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলতেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরোক্ত হাদীছকে কুরআনের অংশ মনে করতাম, যতক্ষণ না সূরা তাকাছুর নাযিল হয়’।[12]

(৩) আত্ম অহংকারী হওয়া : আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لاَ تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَآءِ وَلاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَالِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ- ‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে ও তা থেকে অহংকার ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য আকাশের দরজা সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে পর্যন্ত না সূঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করে থাকি’ (আ‘রাফ ৭/৪০)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِّنْ كِبْرٍ، فَقَالَ رَجُلٌ : إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَّكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنًا، قَالَ : إِنَّ اللهَ تَعَالَى جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبَرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ- ‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোষাক সুন্দর হৌক, তার জুতা সুন্দর হৌক। জবাবে তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অহংকার হ’ল সত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[13]

অহংকারীদের পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন,يُحْشُرُ الْمُتَكَبِّرُونَ أَمْثَالَ الذَّرِّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ يُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِي جَهَنَّمَ يُسَمَّى : بُولَسُ، تَعْلُوهُمْ نَارُ الْأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةَ الْخَبَالِ- ‘অহংকারী ব্যক্তিরা ক্বিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের রূপে পিঁপড়া সদৃশ অবস্থায়। চারদিক থেকে লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদেরকে ‘বূলাস’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদেরকে ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামীদের গলিত পুঁজ-রক্ত ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ পান করানো হবে’।[14]

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ- ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁর সাথে অন্যেরও করে’।[15]

আল্লাহ বলেন,وَلاَ تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلاَ تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ- ‘আর তুমি অহংকারবশে মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালবাসেন না’ (লোকমান ৩১/১৮)। তিনি বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ- ‘নিশ্চয় যারা আমার ইবাদত থেকে অহংকার প্রদর্শন করে। তারা সত্বর জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (মুমিন/গাফের ৪০/৬০)।

এখানে عَنْ عِبَادَتِي ‘আমার ইবাদত থেকে’ অর্থعَنْ دُعَائِي وَتَوْحِيدِي ‘আমার নিকট দো‘আ করা হ’তে ও আমার একত্ববাদ ঘোষণা করা হ’তে’ বিরত থাকে (ইবনু কাছীর)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ، ‘দো‘আ হ’ল ইবাদত’।[16]

এইসব লোকেরা আল্লাহর কাছে দো‘আ করার বদলে নিজেদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের ছবি-মূর্তির নিকটে গিয়ে অথবা কবরে গিয়ে দো‘আ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ؟ قَالُوا : بَلَى، قَالَ : كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُّسْتَكْبِرٍ- ‘আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সম্পর্কে অবহিত করব না? তারা হ’ল প্রত্যেক রূঢ় স্বভাব, কঠিন হৃদয় ও দাম্ভিক ব্যক্তি’।[17] তিনি বলেন,اِحْتَجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَقَالَتِ النَّارُ فِىَّ الْجَبَّارُونَ وَالْمُتَكَبِّرُونَ...وَإِنَّكِ النَّارُ عَذَابِى أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ- ‘জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে তর্ক-বির্তক হ’ল। জাহান্নাম বলল, যত স্বৈরাচারী যালেম ও অহংকারী আমার মধ্যে প্রবেশ করবে। ...আল্লাহ জাহান্নামকে বলেন, তুমি আমার আযাব। আমি তোমার দ্বারা যার থেকে ইচ্ছা প্রতিশোধ গ্রহণ করব।[18]

আল্লাহ বলেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَّالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ- ‘আখেরাতের এই গৃহ আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য ও বিপর্যয় কামনা করে না। বস্ত্ততঃ শুভ পরিণাম কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)। তিনি বলেন,فَالْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَبِمَا كُنْتُمْ تَفْسُقُونَ- ‘আজ তোমাদেরকে হীনকর শাস্তির বদলা দেওয়া হবে এ কারণে যে, তোমরা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে দম্ভ করতে এবং তোমরা পাপাচার করতে’ (আহক্বাফ ৪৬/২০)।

তিনি বলেন, وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى اللهِ وُجُوهُهُمْ مُسْوَدَّةٌ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْمُتَكَبِّرِينَ- ‘আর যারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে, ক্বিয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারা মসীলিপ্ত দেখবে। বস্ত্ততঃ দাম্ভিকদের ঠিকানা কি জাহান্নাম নয়?’ (যুমার ৩৯/৬০)।

নমরূদ ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে অহংকার দেখিয়ে তাঁকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে আগুন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল (আম্বিয়া ২১/৬৯)। ক্বারূণ ছিল মূসা (আঃ)-এর চাচাতো ভাই হওয়া সত্ত্বেও অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে সে অহংকারী হয়ে বলেছিল, এই সম্পদ আমি আমার নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছি। আল্লাহ তাকে তার সম্পদরাজি সহ মাটিতে ধ্বসিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।

ইহূদীরা নবী মূসার অবাধ্যতা করার কারণে আল্লাহ তাদেরকে নিকৃষ্ট বানরে রূপান্তরিত করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (বাক্বারাহ ২/৬৫)। আমাদের নবীর বিরুদ্ধে অহংকার দেখানোর কারণে বদরের যুদ্ধের দিন কুরায়েশদের ১১ জন নেতা একদিনেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যুগে যুগে এমনি করে অহংকারীদের পতন ঘটেছে। তাই এ বিষয়টিকেই দরসে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘সবচেয়ে মারাত্মক’ বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত থেকে রক্ষা করুন এবং মুক্তিদানকারী তিনটি বস্ত্ত অর্জনের তাওফীক দান করুন-আমীন!



[1]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৬৮৬৫; মিশকাত হা/৫১২২ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/১৮০২।

[2]. বুখারী হা/২৩৩৩, ৩৪৬৫।

[3]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৬৭, ৩২৩৩, রাবী আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ);সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ‘কুরবানীর দিনের ভাষণ’ অনুচ্ছেদ ৭১৮-১৯ পৃ.।

[4]. বুখারী হা/৬০৯৪; মুসলিম হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৪৮২৪, রাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)।

[5]. ইবনু হিশাম ১/৩৯৯; হাদীছ ছহীহ, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৯২)।

[6]. বুখারী হা/৬৪৭৪; মিশকাত হা/৪৮১২, রাবী সাহ্ল বিন সা‘দ (রাঃ)।

[7]. তিরমিযী হা/২১৪১; মিশকাত হা/৯৬ ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ, রাবী আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ)।

[8]. মুসলিম হা/১০৫৪; মিশকাত হা/৫১৬৫।

[9]. তিরমিযী হা/৩৫৯১; মিশকাত হা/২৪৭১, রাবী কুত্ববা বিন মালেক (রাঃ)।

[10]. ইমাম আহমাদ, ফাযায়েলুছ ছাহাবা ক্রমিক ৮৮১।

[11]. বুখারী হা/৬৪৩৯; মুসলিম হা/১০৪৮; মিশকাত হা/৫২৭৩, রাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)।

[12]. বুখারী হা/৬৪৪০ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ১০ অনুচ্ছেদ।

[13]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ, রাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)।

[14]. তিরমিযী হা/২৪৯২; মিশকাত হা/৫১১২, রাবী ‘আমর বিন শো‘আয়েব (রাঃ)।

[15]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ৩য় প্রকাশ ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খৃ.) ২/৩১৬।

[16]. আবুদাঊদ হা/১৪৭৯; তিরমিযী হা/২৯৬৯ প্রভৃতি; মিশকাত হা/২২৩০।

[17]. মুসলিম হা/২৮৫৩; মিশকাত হা/৫১০৬ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।

[18]. আহমাদ হা/১১৭৭১; ছহীহুত তারগীব হা/৩২০০।
 

Create an account or login to comment

You must be a member in order to leave a comment

Create account

Create an account on our community. It's easy!

Log in

Already have an account? Log in here.

Total Threads
12,913Threads
Total Messages
16,414Comments
Total Members
3,343Members
Latest Messages
tasrinLatest member
Top