Student Of Knowledge
Forum Staff
Moderator
Uploader
Exposer
HistoryLover
Salafi User
বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল-আইনু হাক্কুন” অর্থাৎ নজর দোষ একটি বাস্তব সত্য জিনিস। যদি কোন জিনিস অদৃশ্যের লিখন খন্ডন করতে পারত, তবে নজরদোষ তা খন্ডন করতে পারত। যখন (নজরদোষ হেতু) তােমাদেরকে কোন অঙ্গ ধৌত করার জন্য বলা হবে, তখন তােমরা তা ধৌত করে দাও।” (মুসলিম, মিশকাত ৩৮৮ পৃঃ)
নজর দোষের প্রভাবশতঃ মানুষ, পশু, ধন-সম্পত্তি বাগান-ক্ষেত ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। দুনিয়ার তাবৎ জিনিস আল্লাহর মীমাংসায় সংঘটিত হয়। আল্লাহর মীমাংসাকৃত কোন বিষয়ই খন্ডন করার কোন উপায় নেই। কিন্তু বদ-নজর এমন মারাত্মক জিনিস যে, যদি কোন জিনিসে উক্ত বিষয় খন্ডন করার মত কোন শক্তি থাকত, তাহলে বদ-নজরে তা থাকত। অর্থাৎ, বদ-নজর একটা বাস্তব সত্য জিনিস। এর কবলে পড়লে নজর গ্রস্থ ব্যাক্তি ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। ঔষধ-পথ্যের মাধ্যমে এর কোন প্রতিকার ব্যাবস্থা নেই। কাজেই ঔষধ-পথ্য গ্রহণ করলেও কোন উপকার আসে না। এর থেকে আরােগ্য লাভের একটাই ব্যবস্থা আছে। আর সে ব্যবস্থা হচ্ছে, দোয়া বা মন্ত্র পাঠ করতঃ ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা। এই অবস্থায় আল্লাহানুগ্রহে মানুষ উপকৃত হয়ে থাকে।
উপরােক্ত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে নজরদোষ কাটাবার নিমিত্তে একটি পদ্ধতির উল্লেখ এসেছে। ঐ সময়ে আরবের প্রথা ছিল যে, যখন কারাে উপর বদ-নজর হতাে তখন যার নজর লেগেছে তার দুই হাত, দুই পা এবং নাভীর তলদেশ ধৌত করতঃ সেই পানি দ্বারা বদ-নজরগ্রস্ত ব্যক্তিকে গােসল দেওয়া হতাে। আর এই পদ্ধতিকে তার দোষমুক্তির একটা উপায় মনে করত। নবী (ﷺ)-এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দান করতঃ বলেছেন যে, “যার বদ-নজর লেগেছে তাকে যদি হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ ধৌত করার জন্য বলা হয়, তবে সে যেন তাতে আপত্তি না করে; বরং সে যেন অঙ্গ ধৌত করা পানি নজরদোষগ্রস্ত ব্যক্তিকে দিয়ে উপকৃত করে।
এই প্রসঙ্গে আর একটি বিস্তৃত ঘটনা অন্য এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। পাঠকদের উপকারার্থে নিম্নে সেটি উদ্ধৃত করলাম।
একদা আমের বিন রাবিয়াহ (রাঃ) সহল বিন হুনাইফকে (রাঃ)-কে গােসল করতে দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে পড়লেন এবং মুখে বলতে লাগলেন, 'আল্লাহর কসম! সহলের মত অত সুন্দর রূপ-লাবণ্য আর কখনাে দেখি নি। এমন কি অন্দর মহলে অবস্থানরতা কোন রূপসী। নারীর ত্বক (চর্ম)ও অত সুন্দর আজ পর্যন্ত দেখতে পাই নি।'
আমেরের এ কথা বলাও ছিল আর অমনি সহল জমির উপরে টলে পড়ে গেলেন। অর্থাৎ, এমনভাবে বদ-নজর লাগল যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে ভূপতিত হয়ে পড়লেন। অতঃপর সহলকে উঠিয়ে হুযুর এক-এর সমীপে ধরাধরি করে আনা হলাে এবং অনুরােধ করে বলা হলাে, 'হে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এঁকে সারানাে যায় কি করে? আল্লাহর কসম, ইনি যে মাথা তুলতে সক্ষম নন।'
সহলের অবস্থা দেখে রাসূল (ﷺ) একি বললেন, “কারাে সম্পর্কে তােমাদের ধারণা আছে কি যে, তার বদ নজর এর প্রতি লেগেছে?”
লােকেরা বলল, 'জী হা! আমাদের ধারণা হচ্ছে যে আমের বিন রাবীআর বদনজর ঐকে আক্রান্ত করেছে।' ইহা শ্রবণ করতঃ রসুলুল্লাহ (ﷺ) আমেরকে ডেকে পাঠালেন এবং কড়া-মিঠ স্বরে বললেন, “তােমরা তােমাদের কোন ভাইকে মারবার তালে কেন থাকো? তুমি সহলের রূপ-লাবণ্য দেখে যখন অভিভূত হয়েছিলে, তখন তুমি ওকে বরকতের দোয়া দাওনি কেন? অর্থাৎ, 'বা-রাকাল্লাহু ফীক' (তােমার প্রতি আল্লাহ বরকত দান করেন) বাক্য কেন পাঠ করাে নাই? তাহলে ওর উপর বদনজর লাগত না।”
অতঃপর রাসূল (ﷺ) ঐ আমেরকে নির্দেশ দিলেন, “তুমি সহলের জন্য তােমার অঙ্গগুলি ধুয়ে ঐ পানি ওর উপরে বহে দাও।” এই নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে আমের (রাঃ) একটি পাত্রে নিজের মুখমন্ডল, হাত, কনুই, হাঁট, দুই পা ও পায়ের আঙ্গুলগুলি এবং নাভীর তলদেশ (লজ্জাস্থান) প্রভৃতি অঙ্গগুলি ধুয়ে দিলেন। অতঃপর সেই পানি সহলের উপরে ঢেলে দেওয়া হলাে। এইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বনে সহল এক সঙ্গে সঙ্গে সেরে উঠলেন। চাঙ্গা হয়ে উঠে সকলের সঙ্গে এমনভাবে চলাফেরা করতে লাগলেন যেন মনে হচ্ছিল, ওর কিছুই হয় নি। (মা-লে, শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৯০ পৃঃ)
বদ-নযরের প্রভাব দূর করার জন্য যেমন শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ধৌত করতঃ সেই পানি বদ-নজরগ্রস্ত ব্যক্তির শরীরে ঢেলে দেওয়ার কথা এসেছে -তেমনি ওর থেকে অব্যাহতি পাবার দোয়াও আছে। আর সে দোয়া খুব কঠিন নয়; বরং খুব সহজ ও সকলের জানা। অর্থাৎ, সূরা ফালাক, ও সূরা নাস পাঠ করে ফুক দেওয়া।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) জ্বিনদের আক্রমণ থেকে এবং মানুষের বদনজরের প্রভাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তারপর যখন ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক ও কুল আব্বযু বিরান্বিন্নাস সুরা দুটি অবতীর্ণ হলাে তখন তিনি ঐ সূরা দুটিই ধরে পড়লেন এবং ঐ দুটি ছাড়া অন্য সমস্ত দোয়া পরিত্যাগ করে দিলেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৩৯০ পৃঃ)
'সিফরুস সাআদাহ’ গ্রন্থের লেখক হাদীসের বরাত দিয়ে লিখেছেন, কোন ব্যক্তি যখন নিজের অথবা অপরের সন্তান-সন্ততি, ধন-দৌলত ইত্যাদি দর্শন করে খুব মুগ্ধ হয়ে পড়বে, তখন সে ব্যক্তি যদি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করে তবে ওই সব জিনিসে তার বদনজর লাগবে না। আয়াতটি এই,
বদ নজর যেমন মারাত্মক জিনিস, যাদু বিদ্যাও তেমনি সব ভয়ংকর বিষয়। এর ফলে মানুষের অনেক অঘটন ঘটে গিয়ে থাকে। ইসলামী শরীয়তে বহুবিধ বিদ্যাচর্চার অনুমতি আছে, কিন্তু যাদুবিদ্যার চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম ঘােষণা করা হয়েছে। এ মর্মে নিমের হাদীসটি প্রনিধান করুনঃ
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্যোতিষবিদ্যার এমন কোন বিষয় আয়ত্ব করল (যার স্বীকৃতি আল্লাহ দেন নি), সে যেন যাদুবিদ্যার কিয়দংশ আয়ত্ব করল এবং সে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ-বক্তা গণক-ঠাকুর সমতুল্য। আর ভবিষৎ-বক্তা গণক যাদুকর সমতুল্য আর যাদুকর ব্যক্তি কাফের সমতুল্য। (মিশকাত ৩৯৪ পৃঃ)
উপরােক্ত হাদীসের শেষােক্ত বাক্য (الساحر كافر) ‘আস-সা-হিরু কা-ফির’ অর্থাৎ, যাদুবিদ্যা চর্চাকারী কাফের, ঈমানের গন্ডী থেকে বহির্ভূত। অতএব ওর থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে তফাতে থাকা দরকার।
পক্ষান্তরে বদনজরের মত যাদু-মন্ত্রের কুফলজনিত মানুষের রকমারি অনিষ্ট সাধন হয়ে থাকে। এই অনিষ্টকর পরিস্থিতির মুকাবেলা করার মত ব্যবস্থা ঔষধপথ্যে অথবা কোন প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব হয় না। এর প্রতিকার একমাত্র বিশুদ্ধ দোয়া বা ইসলামী মন্ত্র দ্বারা করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে হযরত রসুলে করীম (ﷺ) একটি ঘটনার উল্লেখ করা সুসঙ্গত হবে বলে মনে করি। ঘটনাটি প্রসিদ্ধ ও বহু জনশ্রুত ঘটনা। যথাঃ
খয়বর যুদ্ধের পর বড় বড় ইয়াহুদী দলপতিগণ লাবীদ বিন আসেম নামক প্রখ্যাত যাদুকরের নিকটে এসে বলল, 'আমরা মুহাম্মদের ধ্বংস-সাধনের জন্য অনেক যাদুমন্ত্র করলাম। কিন্তু কোন কিছু করা গেল না। আপনি আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বড় যাদুবিদ। অতএব আপনি একবার যাদু-মন্ত্র দ্বারা তদবীর করে দেখুন। আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।
অতঃপর তাকে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করার কথা চুক্তি হলে সে তার তদবীর শুরু করে দিল। প্রথমতঃ সে একজন ইয়াহুদী ছেলেকে হাত করল। যে ছেলেটি নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমত (সেবা) করত। চিরুনী করার সময় যে চুলগুলি দাড়ি ও মাথা থেকে চিরুনীতে লেগে বের হয়ে আসত, সেই চুল কিছু সংগ্রহ করল ঐ ছেলেটির হাত দিয়ে। তারপর সেই চুলে যাদু-মন্ত্র দ্বারা এগারােটা গিরা বেঁধে একটা কূপে পাথর চাপা দিয়ে রাখল। বাস, এই যাদুর কুফলে নবী (ﷺ) প্রায় এক বছর কাল আক্রান্ত থাকেন। এবং ভীষণ কষ্ট ভােগ করেন। পরে করুণাময় আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-এর এই কষ্ট দূরীভূত করে দেন। যাদু-মন্ত্র কে করেছে, কোথায় কি ভাবে যাদু করেছে ইত্যাদি সমস্ত খবর রাসূল (ﷺ)-কে জ্ঞাত করানাে হলাে এবং ফালাক ও নাস সূরা দুটি অবতীর্ণ করা হলাে। সুতরাং রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নির্দেশ মুতাবেক যাদুকৃত চুলগুলি প্রথমে উদ্ধার করলেন। তারপর একটি করে যাদুকৃত গিরা খুলে দিতে লাগলেন। যেহেতু যাদুকৃত গিরা সংখ্যা ছিল ১১টি, সেই হেতু দেখা যাচ্ছে উপরােক্ত সূরা দুটিতেও আয়াতের সংখ্যা মােট ১১টি। যখন আয়াতগুলি পাঠ করতঃ সব গিরা ক’টি খুলে দেওয়া হলাে তখন নবী করীম ও আরাম পেয়ে গেলেন। মনে হলাে যেন তাকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এক্ষণে তিনি বন্ধনমুক্ত হয়ে নিজেকে খুব হালকা মনে করতে লাগলেন। (ফালিল্লাহিল হামদ) (বিস্তারিত বিবরণের জন্য তফসীর জালালাইনের ৫০৮ পৃষ্ঠায় তফসীর ও টীকা দ্রষ্টব্য)
বদ-নজর, যাদু-মন্ত্র, জ্বিন-ভুতের আক্রমণাদি থেকে নিষ্কৃতি পাবার নিমিত্তে উত্তম ঝাড়ফুঁক হচ্ছে সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা। এই সূরা দুটি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (ﷺ) একটি হাদীসে বলেন, “আজকের রাত্রে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যে, ঐ রকম আর কোন আয়াত (আশ্রয় প্রার্থনা মূলক) পরিদৃষ্ট হয় না। আর সে আয়াতগুলি হচ্ছে ‘ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিল ফালাক ও ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিন্না-স।” (মুসলিম, মিশকাত ১৮৬ পৃঃ)
অন্যত্রে জননী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ কে যখন রাত্রে শয্যা গ্রহণ করতেন তখন প্রত্যহ শােবার আগে তিনি দুই হাতের তালু দুটি একত্রিত করে তাতে নিম্নের সূরা তিনটি পড়ে ফুক দিতেন। তারপর হাত দুটি দেহে যতটা পারতেন ফিরিয়ে নিতেন। আরম্ভ করতেন মস্তক, মুখমন্ডল এবং শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে। এইভাবে তিনি তিনবার করে করতেন। সূরা তিনটি এই ১. কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ। ২. ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিল ফালাক্ব। ৩. ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিন্না-স। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৮৬ পৃঃ)
নজর দোষের প্রভাবশতঃ মানুষ, পশু, ধন-সম্পত্তি বাগান-ক্ষেত ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। দুনিয়ার তাবৎ জিনিস আল্লাহর মীমাংসায় সংঘটিত হয়। আল্লাহর মীমাংসাকৃত কোন বিষয়ই খন্ডন করার কোন উপায় নেই। কিন্তু বদ-নজর এমন মারাত্মক জিনিস যে, যদি কোন জিনিসে উক্ত বিষয় খন্ডন করার মত কোন শক্তি থাকত, তাহলে বদ-নজরে তা থাকত। অর্থাৎ, বদ-নজর একটা বাস্তব সত্য জিনিস। এর কবলে পড়লে নজর গ্রস্থ ব্যাক্তি ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। ঔষধ-পথ্যের মাধ্যমে এর কোন প্রতিকার ব্যাবস্থা নেই। কাজেই ঔষধ-পথ্য গ্রহণ করলেও কোন উপকার আসে না। এর থেকে আরােগ্য লাভের একটাই ব্যবস্থা আছে। আর সে ব্যবস্থা হচ্ছে, দোয়া বা মন্ত্র পাঠ করতঃ ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা। এই অবস্থায় আল্লাহানুগ্রহে মানুষ উপকৃত হয়ে থাকে।
উপরােক্ত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে নজরদোষ কাটাবার নিমিত্তে একটি পদ্ধতির উল্লেখ এসেছে। ঐ সময়ে আরবের প্রথা ছিল যে, যখন কারাে উপর বদ-নজর হতাে তখন যার নজর লেগেছে তার দুই হাত, দুই পা এবং নাভীর তলদেশ ধৌত করতঃ সেই পানি দ্বারা বদ-নজরগ্রস্ত ব্যক্তিকে গােসল দেওয়া হতাে। আর এই পদ্ধতিকে তার দোষমুক্তির একটা উপায় মনে করত। নবী (ﷺ)-এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দান করতঃ বলেছেন যে, “যার বদ-নজর লেগেছে তাকে যদি হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ ধৌত করার জন্য বলা হয়, তবে সে যেন তাতে আপত্তি না করে; বরং সে যেন অঙ্গ ধৌত করা পানি নজরদোষগ্রস্ত ব্যক্তিকে দিয়ে উপকৃত করে।
এই প্রসঙ্গে আর একটি বিস্তৃত ঘটনা অন্য এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। পাঠকদের উপকারার্থে নিম্নে সেটি উদ্ধৃত করলাম।
একদা আমের বিন রাবিয়াহ (রাঃ) সহল বিন হুনাইফকে (রাঃ)-কে গােসল করতে দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে পড়লেন এবং মুখে বলতে লাগলেন, 'আল্লাহর কসম! সহলের মত অত সুন্দর রূপ-লাবণ্য আর কখনাে দেখি নি। এমন কি অন্দর মহলে অবস্থানরতা কোন রূপসী। নারীর ত্বক (চর্ম)ও অত সুন্দর আজ পর্যন্ত দেখতে পাই নি।'
আমেরের এ কথা বলাও ছিল আর অমনি সহল জমির উপরে টলে পড়ে গেলেন। অর্থাৎ, এমনভাবে বদ-নজর লাগল যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে ভূপতিত হয়ে পড়লেন। অতঃপর সহলকে উঠিয়ে হুযুর এক-এর সমীপে ধরাধরি করে আনা হলাে এবং অনুরােধ করে বলা হলাে, 'হে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এঁকে সারানাে যায় কি করে? আল্লাহর কসম, ইনি যে মাথা তুলতে সক্ষম নন।'
সহলের অবস্থা দেখে রাসূল (ﷺ) একি বললেন, “কারাে সম্পর্কে তােমাদের ধারণা আছে কি যে, তার বদ নজর এর প্রতি লেগেছে?”
লােকেরা বলল, 'জী হা! আমাদের ধারণা হচ্ছে যে আমের বিন রাবীআর বদনজর ঐকে আক্রান্ত করেছে।' ইহা শ্রবণ করতঃ রসুলুল্লাহ (ﷺ) আমেরকে ডেকে পাঠালেন এবং কড়া-মিঠ স্বরে বললেন, “তােমরা তােমাদের কোন ভাইকে মারবার তালে কেন থাকো? তুমি সহলের রূপ-লাবণ্য দেখে যখন অভিভূত হয়েছিলে, তখন তুমি ওকে বরকতের দোয়া দাওনি কেন? অর্থাৎ, 'বা-রাকাল্লাহু ফীক' (তােমার প্রতি আল্লাহ বরকত দান করেন) বাক্য কেন পাঠ করাে নাই? তাহলে ওর উপর বদনজর লাগত না।”
অতঃপর রাসূল (ﷺ) ঐ আমেরকে নির্দেশ দিলেন, “তুমি সহলের জন্য তােমার অঙ্গগুলি ধুয়ে ঐ পানি ওর উপরে বহে দাও।” এই নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে আমের (রাঃ) একটি পাত্রে নিজের মুখমন্ডল, হাত, কনুই, হাঁট, দুই পা ও পায়ের আঙ্গুলগুলি এবং নাভীর তলদেশ (লজ্জাস্থান) প্রভৃতি অঙ্গগুলি ধুয়ে দিলেন। অতঃপর সেই পানি সহলের উপরে ঢেলে দেওয়া হলাে। এইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বনে সহল এক সঙ্গে সঙ্গে সেরে উঠলেন। চাঙ্গা হয়ে উঠে সকলের সঙ্গে এমনভাবে চলাফেরা করতে লাগলেন যেন মনে হচ্ছিল, ওর কিছুই হয় নি। (মা-লে, শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৯০ পৃঃ)
বদ-নযরের প্রভাব দূর করার জন্য যেমন শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ধৌত করতঃ সেই পানি বদ-নজরগ্রস্ত ব্যক্তির শরীরে ঢেলে দেওয়ার কথা এসেছে -তেমনি ওর থেকে অব্যাহতি পাবার দোয়াও আছে। আর সে দোয়া খুব কঠিন নয়; বরং খুব সহজ ও সকলের জানা। অর্থাৎ, সূরা ফালাক, ও সূরা নাস পাঠ করে ফুক দেওয়া।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) জ্বিনদের আক্রমণ থেকে এবং মানুষের বদনজরের প্রভাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তারপর যখন ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক ও কুল আব্বযু বিরান্বিন্নাস সুরা দুটি অবতীর্ণ হলাে তখন তিনি ঐ সূরা দুটিই ধরে পড়লেন এবং ঐ দুটি ছাড়া অন্য সমস্ত দোয়া পরিত্যাগ করে দিলেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৩৯০ পৃঃ)
'সিফরুস সাআদাহ’ গ্রন্থের লেখক হাদীসের বরাত দিয়ে লিখেছেন, কোন ব্যক্তি যখন নিজের অথবা অপরের সন্তান-সন্ততি, ধন-দৌলত ইত্যাদি দর্শন করে খুব মুগ্ধ হয়ে পড়বে, তখন সে ব্যক্তি যদি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করে তবে ওই সব জিনিসে তার বদনজর লাগবে না। আয়াতটি এই,
مَا شَاءَ اللّٰهُ، لَا قُوَّةَ إلاَّ باللّٰه.
"মা- শা-আল্লাহ, লা ক্বুওয়্যাতা ইল্লা- বিল্লা-হ।' (মাযাহেরে হক জাদীদ চতুর্থ, খন্ড ১ম কিস্তি ১০ পৃষ্টা)বদ নজর যেমন মারাত্মক জিনিস, যাদু বিদ্যাও তেমনি সব ভয়ংকর বিষয়। এর ফলে মানুষের অনেক অঘটন ঘটে গিয়ে থাকে। ইসলামী শরীয়তে বহুবিধ বিদ্যাচর্চার অনুমতি আছে, কিন্তু যাদুবিদ্যার চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম ঘােষণা করা হয়েছে। এ মর্মে নিমের হাদীসটি প্রনিধান করুনঃ
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্যোতিষবিদ্যার এমন কোন বিষয় আয়ত্ব করল (যার স্বীকৃতি আল্লাহ দেন নি), সে যেন যাদুবিদ্যার কিয়দংশ আয়ত্ব করল এবং সে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ-বক্তা গণক-ঠাকুর সমতুল্য। আর ভবিষৎ-বক্তা গণক যাদুকর সমতুল্য আর যাদুকর ব্যক্তি কাফের সমতুল্য। (মিশকাত ৩৯৪ পৃঃ)
উপরােক্ত হাদীসের শেষােক্ত বাক্য (الساحر كافر) ‘আস-সা-হিরু কা-ফির’ অর্থাৎ, যাদুবিদ্যা চর্চাকারী কাফের, ঈমানের গন্ডী থেকে বহির্ভূত। অতএব ওর থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে তফাতে থাকা দরকার।
পক্ষান্তরে বদনজরের মত যাদু-মন্ত্রের কুফলজনিত মানুষের রকমারি অনিষ্ট সাধন হয়ে থাকে। এই অনিষ্টকর পরিস্থিতির মুকাবেলা করার মত ব্যবস্থা ঔষধপথ্যে অথবা কোন প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব হয় না। এর প্রতিকার একমাত্র বিশুদ্ধ দোয়া বা ইসলামী মন্ত্র দ্বারা করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে হযরত রসুলে করীম (ﷺ) একটি ঘটনার উল্লেখ করা সুসঙ্গত হবে বলে মনে করি। ঘটনাটি প্রসিদ্ধ ও বহু জনশ্রুত ঘটনা। যথাঃ
খয়বর যুদ্ধের পর বড় বড় ইয়াহুদী দলপতিগণ লাবীদ বিন আসেম নামক প্রখ্যাত যাদুকরের নিকটে এসে বলল, 'আমরা মুহাম্মদের ধ্বংস-সাধনের জন্য অনেক যাদুমন্ত্র করলাম। কিন্তু কোন কিছু করা গেল না। আপনি আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বড় যাদুবিদ। অতএব আপনি একবার যাদু-মন্ত্র দ্বারা তদবীর করে দেখুন। আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।
অতঃপর তাকে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করার কথা চুক্তি হলে সে তার তদবীর শুরু করে দিল। প্রথমতঃ সে একজন ইয়াহুদী ছেলেকে হাত করল। যে ছেলেটি নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমত (সেবা) করত। চিরুনী করার সময় যে চুলগুলি দাড়ি ও মাথা থেকে চিরুনীতে লেগে বের হয়ে আসত, সেই চুল কিছু সংগ্রহ করল ঐ ছেলেটির হাত দিয়ে। তারপর সেই চুলে যাদু-মন্ত্র দ্বারা এগারােটা গিরা বেঁধে একটা কূপে পাথর চাপা দিয়ে রাখল। বাস, এই যাদুর কুফলে নবী (ﷺ) প্রায় এক বছর কাল আক্রান্ত থাকেন। এবং ভীষণ কষ্ট ভােগ করেন। পরে করুণাময় আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-এর এই কষ্ট দূরীভূত করে দেন। যাদু-মন্ত্র কে করেছে, কোথায় কি ভাবে যাদু করেছে ইত্যাদি সমস্ত খবর রাসূল (ﷺ)-কে জ্ঞাত করানাে হলাে এবং ফালাক ও নাস সূরা দুটি অবতীর্ণ করা হলাে। সুতরাং রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নির্দেশ মুতাবেক যাদুকৃত চুলগুলি প্রথমে উদ্ধার করলেন। তারপর একটি করে যাদুকৃত গিরা খুলে দিতে লাগলেন। যেহেতু যাদুকৃত গিরা সংখ্যা ছিল ১১টি, সেই হেতু দেখা যাচ্ছে উপরােক্ত সূরা দুটিতেও আয়াতের সংখ্যা মােট ১১টি। যখন আয়াতগুলি পাঠ করতঃ সব গিরা ক’টি খুলে দেওয়া হলাে তখন নবী করীম ও আরাম পেয়ে গেলেন। মনে হলাে যেন তাকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এক্ষণে তিনি বন্ধনমুক্ত হয়ে নিজেকে খুব হালকা মনে করতে লাগলেন। (ফালিল্লাহিল হামদ) (বিস্তারিত বিবরণের জন্য তফসীর জালালাইনের ৫০৮ পৃষ্ঠায় তফসীর ও টীকা দ্রষ্টব্য)
বদ-নজর, যাদু-মন্ত্র, জ্বিন-ভুতের আক্রমণাদি থেকে নিষ্কৃতি পাবার নিমিত্তে উত্তম ঝাড়ফুঁক হচ্ছে সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা। এই সূরা দুটি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (ﷺ) একটি হাদীসে বলেন, “আজকের রাত্রে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যে, ঐ রকম আর কোন আয়াত (আশ্রয় প্রার্থনা মূলক) পরিদৃষ্ট হয় না। আর সে আয়াতগুলি হচ্ছে ‘ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিল ফালাক ও ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিন্না-স।” (মুসলিম, মিশকাত ১৮৬ পৃঃ)
অন্যত্রে জননী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ কে যখন রাত্রে শয্যা গ্রহণ করতেন তখন প্রত্যহ শােবার আগে তিনি দুই হাতের তালু দুটি একত্রিত করে তাতে নিম্নের সূরা তিনটি পড়ে ফুক দিতেন। তারপর হাত দুটি দেহে যতটা পারতেন ফিরিয়ে নিতেন। আরম্ভ করতেন মস্তক, মুখমন্ডল এবং শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে। এইভাবে তিনি তিনবার করে করতেন। সূরা তিনটি এই ১. কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ। ২. ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিল ফালাক্ব। ৩. ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিন্না-স। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৮৬ পৃঃ)