প্রবন্ধ গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার

Joined
Jul 24, 2023
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,580
ভূমিকা :

গীবত একটি ভয়াবহ পাপ। সমাজে যেসব পাপের প্রচলন সবচেয়ে বেশী তন্মধ্যে গীবত অন্যতম। এই পাপটি নীরব ঘাতকের মতো। বান্দার অজান্তেই এটা তার নেকীর ভান্ডার নিঃশেষ করে দেয় এবং তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করে ছাড়ে। এটি চুরি-ডাকাতি, সূদ-ঘুষ, যিনা-ব্যভিচার ও মরা মানুষের পঁচা গোশত খাওয়ার চেয়েও মারাত্মক ও নিকৃষ্ট। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হ’ল এই জঘন্য পাপটি মানুষ হরহামেশাই করে থাকে। চায়ের আসর থেকে শুরু করে সোশাল মিডিয়া ও স্বাভাবিক আলাপচারিতায় এটা অনেকের স্বভাবসুলভ আচরণে পরিণত হয়ে গেছে। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদে বসেও অনেকে এই গর্হিত পাপ করতে কুণ্ঠিত হয় না। সমাজের পরিচিত নেককার বান্দাদের মধ্যেও খুব কম মানুষই গীবতের এই নোংরা পাপ থেকে বাঁচতে পারে। নবী-রাসূল ছাড়া পৃথিবীর কোন মানুষই দোষ-ত্রুটি ও ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ইসলাম সেই ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করাকে হারাম ঘোষণা করেছে। এমনকি সেই দোষচর্চা শ্রবণ করাকেও নিষিদ্ধ করেছে। বক্ষমাণ নিবদ্ধে আমরা গীবতের বিবিধ অনুসঙ্গ নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

গীবতের পরিচয়

‘গীবত’ (الغِيْبَةُ) আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হ’ল- পরনিন্দা করা, দোষচর্চা করা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা করা, দোষারোপ করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষগুলো অন্যের সামনে তুলে ধরা।[1]

গীবতের পারিভাষিক অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভাষায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ؟​

‘তোমরা কি জান গীবত কী? সাহাবীগণ বললেন, ‘(এ ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

‌ذِكْرُكَ ‌أَخَاكَ ‌بِمَا ‌يَكْرَهُ​

‘(গীবত হচ্ছে) তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কিছু বলা, যা সে অপসন্দ করে’। জিজ্ঞেস করা হ’ল-

أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ؟​

‘আমি যা বলছি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহ’লে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন,

إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ​

‘তুমি তার (দোষ-ত্রুটি) সম্পর্কে যা বলছ, সেটা যদি তার মধ্যে থাকে, তাহ’লে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি সেই (ত্রুটি) তার মধ্যে না থাকে, তাহ’লে তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে’।[2]

ইমাম মুহিউদ্দীন নববী (রহঃ) বলেন, ‘গীবত হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা, যা সে অপসন্দ করে। চাই সেই দোষ-ত্রুটির সম্পর্ক তার দেহ-সৌষ্ঠব, দ্বীনদারিতা, দুনিয়া, মানসিকতা, আকৃতি, চরিত্র, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা, স্ত্রী, চাকর-বাকর, পাগড়ি, পোষাক, চলাফেরা, ওঠা-বসা, আনন্দ-ফুর্তি, চরিত্রহীনতা, রূঢ়তা, প্রফুল্লতা-স্বেচ্ছাচারিতা বা অন্য যেকোন কিছুর সাথেই হোক না কেন। এসবের আলোচনা আপনি মুখে বলে, লিখে, আকার-ইঙ্গিতে, চোখের ইশারায়, হাত দিয়ে, মাথা দুলিয়ে বা অন্য যেকোন উপায়েই করুন না কেন, তা গীবত’।[3]

মোটকথা কারো মধ্যে যদি সত্যিকারার্থেই কোন দোষ-ত্রুটি থাকে, আর সেটা নিয়ে আলোচনা করা যদি তিনি অপসন্দ করেন, তাহ’লে সেই সত্যি কথাটা অপরকে বলে দেওয়ার নামই হ’ল গীবত বা পরনিন্দা। আর যদি সেই দোষ তার ভিতর না থাকে, তবে সেটা ‘বুহতান’ বা অপবাদ।

গীবতের কতিপয় পরিভাষা : হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, ‘গীবতের তিনটি ধরন আছে। যার প্রত্যেকটি আল্লাহর কিতাব কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে- গীবত, ইফ্ক এবং বুহতান।

১. গীবত (পরনিন্দা) : গীবত হচ্ছে তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কিছু দোষ-ত্রুটির কথা বলা, যা বাস্তবেই তার মাঝে বিদ্যমান আছে।

২. ইফ্ক (মিথ্যা রটনা) : তোমার কাছে কারো দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে যে সংবাদ পৌঁছেছে, সেটা বলে বেড়ানো বা যাচাই না করে অন্যকে বলে দেওয়া। (যেমন- মা আয়েশা (রাঃ)-এর ব্যাপারে ঘটেছিল)।

৩. বুহতান (অপবাদ) : রাসূলের উক্তি তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কিছু বলা, যা তার মাঝে নেই’।[4] তবে গীবতের আরো কিছু পরিভাষা আছে। যা পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

৪. নামীমাহ (চোগলখুরী) : পরস্পরের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অরেকজনকে বলা। এটাকে নামীমাহ বা চোগলখুরী বলা হয়।[5] ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, ‘অনেকে ইখতিলাফ করেন যে, ‘গীবত’ ও ‘নামীমাহ’ কি একই জিনিস নাকি ভিন্ন কিছু? এ ব্যাপারে সঠিক কথা হ’ল উক্ত দুই পরিভাষার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ‘নামীমাহ’ হ’ল ফাসাদ সৃষ্টি করার মানসিকতা নিয়ে একজনের অপসন্দনীয় কথা অন্যকে বলে দেওয়া, সেটা জেনে হোক বা না জেনে হোক। আর ‘গীবত’ হ’ল কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, যা সে অপসন্দ করে। এখানে সূক্ষ্ম পার্থক্য হ’ল- ‘নামীমাহ’-তে দ্বন্দ্ব বা অশান্তি সৃষ্টি করার হীন উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু ‘গীবতে’ সেই উদ্দেশ্য নাও থাকতে পারে’।[6] নামীমাহ ধরনগত দিক থেকে গীবতের মতো হ’লেও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটা গীবতের চেয়েও মারাত্মক ও সমাজবিধ্বংসী কর্মকান্ড। কেননা চোগলখুরীর মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ ও অশান্তির দাবানল জ্বলে ওঠে।

৬. হুমাযাহ ও লুমাযাহ : পবিত্র কুরআনের ‘সূরা হুমাযাহ’-তে এই দু’টি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। ‘হুমাযাহ’ শব্দের অর্থ হ’ল ‘সম্মুখে নিন্দাকারী’। আর ‘লুমাযাহ’ শব্দের অর্থ হ’ল ‘পিছনে নিন্দাকারী’। আবুল ‘আলিয়াহ, হাসান বাছরী, রবী‘ বিন আনাস, মুজাহিদ, আত্বা প্রমুখ বিদ্বান বলেন,

الْهُمَزَةُ: ‌الَّذِي ‌يَغْتَابُ ‌وَيَطْعَنُ فِي وَجْهِ الرَّجُلِ، وَاللُّمَزَةُ: الَّذِي يَغْتَابُهُ مِنْ خَلْفِهِ إِذَا غَابَ،​

‘হুমাযাহ’ হ’ল সেই ব্যক্তি, যে মানুষের মুখের উপর নিন্দা করে এবং দোষারোপ করে। আর ‘লুমাযাহ’ হ’ল সেই ব্যক্তি যে পিছনে তার অনুপস্থিতিতে নিন্দা করে’।[7]

৭. শাত্ম : ‘শাত্ম’-এর অর্থ হ’ল- তিরস্কার করা, ভৎর্সনা করা, গালি দেওয়া, ব্যঙ্গ করা, কটূক্তি করা। অর্থাৎ সত্য কথার বিপরীতে কারো দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, সেটা নিয়ে ঠাট্টা করা বা কটূক্তি করাকে ‘শাত্ম’ বলা হয়।[8] সাধারণ মানুষকে নিয়ে কটূক্তি করলে সেটা মহাপাপ। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নিয়ে যদি কেউ কটূক্তি করে, তাহ’লে তাকে হত্যা করা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে পৃথিবীর সকল মাযহাবের সকল আলেম একমত। রাসূলকে নিয়ে ব্যঙ্গকারীকে ‘শাতিমুর রাসূল’ বলা হয়।[9]

গীবতের মাধ্যমসমূহ

গীবতের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে মানুষ অপরের গীবত করে থাকে। আলেমদের মতে গীবতের মূল মাধ্যম চারটি :

১. জিহবার গীবত : গীবতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হ’ল জিহবা। আলাপচারিতা, কথা-বার্তা ও বক্তৃতায় যবানের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী গীবত হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

إِنَّ العَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ، مَا يَتَبَيَّنُ فِيهَا، يَزِلُّ بِهَا فِي النَّارِ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الـمَشْرِقِ،​

‘নিশ্চয়ই বান্দা কখনো কখনো এমন কথা বলে ফেলে, যার পরিণাম সে চিন্তা করে না। অথচ এ কথার মাধ্যমে সে জাহান্নামের গভীরে নিক্ষিপ্ত হবে, যার দূরত্ব পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্বের সমপরিমাণ’।[10] অন্যত্র তিনি বলেন,

إِنَّ العَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، لاَ يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ،​

‘বান্দা কখনো আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক এমন কথা বলে ফেলে, যার গুরুত্ব সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না। অথচ এ কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’।[11] আল্লাহর কিতাব ও রাসূলকে নিয়ে উপহাস করা, গীবত পরনিন্দা বা চোগলখুরি, গালি দিয়ে মুসলিমকে কষ্ট দেওয়াসহ প্রভৃতি কথার মাধ্যমে বান্দা গুরুতর পাপ করে ফেলে। তাই জিহবার হেফাযত অত্যন্ত যরূরী।[12]

২. অন্তরের গীবত : কুধারণা, হিংসা, অহংকার এবং কেউ গীবত করলে সেটা অন্তর দিয়ে মেনে নেওয়া বা তা সমর্থন করার মাধ্যমে অন্তরের গীবত হয়। ইবনে হাজার হায়তামী (রহঃ) বলেন,

الْغِيبَةُ ‌بِالْقَلْبِ هِيَ أَنْ تَظُنَّ بِهِ السُّوْءَ​

‘অন্তরের গীবত হচ্ছে কারো ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করা’।[13] ইমাম মাক্বদেসী (রহঃ) বলেন,

قد تحصل ‌الغيبة ‌بالقلب، وذلك سوء الظن بالمسلمين،​

‘মুসলিমদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করার মাধ্যমে অন্তরের গীবত সংঘটিত হয়’।[14]

ইমাম গাযালী বলেন, মুখের ভাষায় গীবত বা পরনিন্দা করার ন্যায় মনে মনে কুধারণা পোষণ করাও হারাম। অর্থাৎ ভাষার ব্যবহারে কারো গীবত করা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে মনে মনে কাউকে খারাপ বলা বা খারাপ ধারণা করাও হারাম’।

মহান আল্লাহ বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا​

‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কর না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত কর না’ (হুজুরাত ৪৯/১২)

মহান আল্লাহ একমাত্র গায়েব জানেন এবং মানুষের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের খবর রাখেন। আর ইবলীসের কাজ হচ্ছে বান্দাকে ধোকা দিয়ে তার মনের মধ্যে মন্দ ধারণা প্রোথিত করা। আর বান্দা যদি কারো প্রতি খারাপ ধারণা করে ফেলে, তাহ’লে ইবলীসকে সত্যায়ন করা হয়ে যায়। আর ইবলীসকে সত্যায়ন করা হারাম। ফলে কারো ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করাও হারাম। কারণ কুধারণার মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি বা গোয়েন্দাগিরি করার মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা আরেক ধরনের কাবীরা গুনাহ। তাই আল্লাহ অত্র আয়াতে কুধারণার মাধ্যমে অন্তরের গীবত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি ও ছিদ্রান্বেষণ করতে নিষেধ করেছে। তারপর বিশেষভাবে গীবত না করার আদেশ প্রদান করেছেন।[15]

৩. ইশারা-ইঙ্গিতের গীবত : কখনো কখনো চোখ, হাত ও মাথার ইশারার মাধ্যমেও গীবত হয়ে থাকে।

আয়েশা (রাঃ) বলেন,

دَخَلَت امْرَأَةٌ قَصِيرَةٌ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَالِسٌ فَقُلْتُ بِإِبْهَامِي هَكَذَا، وَأَشَرْتُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‌أَنَّهَا ‌قَصِيرَةٌ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اغْتَبْتِهَا،​

‘একজন খাটো মহিলা (আমাদের ঘরে) প্রবেশ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বসেছিলেন। আমি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রাসূল (ﷺ)-এর দিকে এভাবে ইশারা করে বললাম, أَنَّهَا ‌قَصِيرَةٌ ‘সে তো বেঁটে মহিলা’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তুমি তো তার গীবত করে ফেললে’।[16]

অপর বর্ণনায় সেই আগন্তুক মহিলার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। হুযাইফা (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বললাম,

حَسْبُكَ مِنْ صَفِيَّةَ كَذَا وَكَذَا، قَالَ غَيْرُ مُسَدَّدٍ: تَعْنِي قَصِيرَةً،​

‘ছাফিইয়াহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে এতটুকুই বলা যথেষ্ট যে, তিনি এরূপ অর্থাৎ খাটো প্রকৃতির। তিনি বললেন,

لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَتْ بِمَاءِ الْبَحْرِ لَمَزَجَتْهُ،​

‘তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যদি তা সমুদ্রে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে সমুদ্রের পানির রং পাল্টে যাবে’। আয়েশা (রাঃ) বলেন,

وَحَكَيْتُ لَهُ إِنْسَانًا، فَقَالَ: مَا أُحِبُّ أَنِّي حَكَيْتُ إِنْسَانًا وَأَنَّ لِي كَذَا وَكَذَا،​

‘(আরেক দিন) আমি এক ব্যক্তিকে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নকল করলাম। তিনি বললেন, আমাকে এতো এতো সম্পদ দেওয়া হ’লেও আমি কারো অনুকরণ পসন্দ করবো না’।[17]

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘আয়েশা (রাঃ) গীবত করার উদ্দেশ্যে ছাফিয়্যা (রাঃ)-এর দোষ বর্ণনা করেননি; বরং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তার ব্যাপারে খবর দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তথাপি সেটা গীবতের পর্যায়ভুক্ত ছিল’।[18] সুতরাং গীবতের প্রকাশ হচ্ছে সেই দোষ বর্ণনা দেওয়ার মতোই। সংকেত, অঙ্গভঙ্গি, চোখ টেপা, ইশারা-ইঙ্গিত এবং অপরকে হেয় করা বুঝায় এমন প্রত্যেক কিছুই গীবতের অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে গীবতকে সমর্থন দেওয়াও গীবত। কেননা গীবত শ্রবণকারীও গীবতের দায় এড়াতে পারবে না, যদি না সে অন্তর দিয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করে এবং মুখের ভাষায় সেটার প্রতিবাদ করে।[19]

৪. লেখার মাধ্যমে গীবত : মানুষের মনের ভাব ও মতামত প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হ’ল লেখা। গাযালী (রহঃ) বলেন,

وكذلك ‌الغيبة ‌بالكتابة فإن القلم أحد اللسانين​

‘লেখার মাধ্যমেও গীবত হয়ে থাকে। কেননা কলম দুই ভাষার একটি’।[20] ড. সাঈদ ইবনে ওয়াহফ আল-কাহত্বানী (রহঃ) বলেন, ‘গীবত শুধু মুখের ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং গীবতকারী যে কোন মাধ্যমে অপরের কুৎসা রটাতে পারেন। হ’তে পারে সেটা ইশারা-ইঙ্গিত, কাজ-কর্ম, অঙ্গ-ভঙ্গি, ভেংচানো, খোঁটা দেওয়া ও লেখালেখির মাধ্যমে অথবা যার নিন্দা করা হচ্ছে তিনি অপসন্দ করেন এমন যে কোন মাধ্যমে’।[21]

গীবতের ধরনসমূহ

গীবত বলা হয় অপরের এমন সমালোচনা, যা শুনলে তার খারাপ লাগবে বা মন খারাপ হবে। এই সমালোচনা অন্যের দৈহিক ত্রুটি, বংশগত দোষ, চারিত্রিক ত্রুটি, কাজ-কর্ম, পোষাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া সম্পর্কিত দোষ হ’লেও তা গীবত। গীবতের রকমভেদ সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণনা এসেছে। এখানে ইমাম নববী (রহঃ)-এর ‘আল-আযকার’, ইমাম গাযালী (রহঃ)-এর ‘ইহয়াউ উলূমিদ্দীন’ এবং ‘মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব’ থেকে একত্রে এবং সংক্ষিপ্তাকারে গীবতের ধরনগুলো তুলে ধরা হ’ল।-

১. শারীরিক গঠন বা অবয়বের গীবত : যেমন তাচ্ছিল্য করে বলা হয়- কানা, খোঁড়া, ল্যাংড়া, লম্বু, খাটো, বাঁটু, কালা, হলদে, ধলা, অন্ধ, ট্যারা, টেকো মাথা, চোখে ছানি পড়া, ঠোঁট মোটা, কান ছোট, নাক বোঁচা, ঠসা প্রভৃতি। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যদি এগুলো অপসন্দ করেন, তবে সেটা গীবত হয়ে যাবে।

২. চারিত্রিক আচার-আচরণের গীবত : যেমন কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা- ফাসেক্ব, খিয়ানতকারী, পিতামাতার অবাধ্য, গীবতকারী, পাক-নাপাকের ব্যাপারে উদাসীন, চোর, সালাত পরিত্যাগকারী, যাকাত অনাদায়কারী, ব্যভিচারী, অহংকারী, বদমেজাযী, কাপুরুষ, দুর্বল মনের অধিকারী, ঝগড়াটে, নির্লজ্জ, দুশ্চিরিত্র, স্বেচ্ছাচারী, তাড়াহুড়াপ্রবণ, ঢিলা, রূঢ়, লম্পট, বেয়াদব, অভদ্র, পেটুক, বাচাল, নিদ্রাকাতর, অবিবেচক, অলস, ধূর্ত, প্রবঞ্চক, ধূমপায়ী, বিড়িখোর, নেশাখোর ইত্যাদি।

৩. বংশের গীবত : যেমন অবজ্ঞা করে বলা- অজাত, ছোটলোক, নিগ্রো, মুচি, চামার, মেথর, কাঠমিস্ত্রি, ভ্যানচালক, কামার, তাঁতি, পাঠান, বিহারী, বাঙ্গাল প্রভৃতি। বংশের দিকে বা পিতামাতার দিকে সম্বন্ধ করে অপসন্দনীয় যাই বলা হবে, সেটাই গীবত।

৪. পোষাক-পরিচ্ছদের গীবত : যেমন কারো পোষাক সম্পর্কে বলা, চওড়া আস্তিন, দীর্ঘ অাঁচল, নোংরা পোষাক পরিধানকারী, লম্বা আঁচলওয়ালী ইত্যাদি।

৫. পরোক্ষ গীবত : পরোক্ষ গীবত বলতে এমন পরনিন্দাকে বুঝায়, যা সরাসরি না বলে ভিন্ন আঙ্গিকে বলা হয়ে থাকে। নিমেণ তার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হ’ল-

* কোন ব্যক্তির প্রসঙ্গ বলতে বলতে বা শুনতে শুনতে বলা- ‘আল্লাহ তার নির্লজ্জতা থেকে পানাহ দিন’ অথবা ‘গোমরাহী থেকে পানাহ চাই’ ইত্যাদি বলা। মূলতঃ এভাবে বলে আলোচিত ব্যক্তির নির্লজ্জতা ও গোমরাহীর কথা উল্লেখ হয়ে থাকে।

* ‘কিছু লোক এই করে’ বা ‘কিছু মানুষ এই বলে’ বলা। এই ‘কিছু’ শব্দের মাধ্যমে সম্বোধিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে বুঝানো হয়, তাহ’লে সেটা গীবত।

* ‘অমুক পন্ডিত’, ‘অমুক ছাহেব’, ‘অমুক নেতা’ ইত্যাদি তাচ্ছিল্যের সাথে বলা। অর্থাৎ দোষ বা ত্রুটি বর্ণনার সময় সম্বোধিত ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেও শ্রোতা বুঝে নিতে পারে কাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে।

* কোন ব্যক্তির ব্যাপারে বলা ‘অমুক ভাই/বন্ধু অপমানিত হওয়ার কারণে বা তার অমুক দোষ-ত্রুটির কারণে আমি কষ্ট পেয়েছি’। আলেমদের মতে, এখানে দো‘আর মাধ্যমে বর্ণিত ব্যক্তির গীবত করে ফেলা হয়। কারণ তার সেই ত্রুটি গোপন ছিল, কিন্তু সে দো‘আ করার মাধ্যমে সেটা সবার সামনে প্রকাশ করে দিল। যদি তার দো‘আ করার উদ্দেশ্য থাকতো, সে নির্জনে সেই ভাইয়ের জন্য দো‘আ করতে পারত।

পরোক্ষ গীবতের এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এগুলোকে গীবত মনে করে না। অথচ এগুলোও সর্বনাশা গীবত।

গীবতের প্রকারভেদ

ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় গীবত মূলতঃ তিন প্রকার।[22]

১. হারাম গীবত : কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটির বর্ণনা দেওয়া, যেটা সে পসন্দ করে না। এটা হারাম গীবত।

২. ওয়াজিব গীবত : মুসলিম সমাজকে বা ব্যক্তিকে সতর্ক ও সাবধান করার জন্য দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিব। যেমন- ইলমুল জারাহ ওয়াত তা‘দীলের ক্ষেত্রে যদি মুহাদ্দিছগণ রাবীদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করতেন, তাহ’লে সহীহ-যঈফ, গ্রহণযোগ্য-অগ্রহণযোগ্য হাদীসসমূহের মান নির্ধারণ করা কখনোই সম্ভব হ’ত না। তাই এক্ষেত্রে দোষ বর্ণনা করা ওয়াজিব। অনুরূপভাবে বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে যদি বর বা কনে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়, তাহ’লে তাদের দোষ-ত্রুটি স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া ওয়াজিব। কারণ দোষ বর্ণনা না করলে জিজ্ঞেসকারীকে ধোঁকা দেওয়া হবে। কোন ব্যক্তি যদি খিয়ানতকারী অসৎ লোকের সাথে ব্যবসা করতে চায়, সেই ব্যক্তিকে সতর্ক করার জন্য ঐ অসৎ লোকের দোষ বর্ণনা করা ওয়াজিব। কারণ সে না জেনে না বুঝে তার সাথে ব্যবসা করে ধোঁকায় পড়তে পারে। তাই তাকে সাবধান করা অপরিহার্য। এভাবে আরো কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে দোষ বর্ণনা করা হারাম নয়; বরং তখন দোষ বর্ণনা করা অপরিহার্য হয়ে যায়।

৩. মুবাহ বা জায়েয গীবত : যদি নিন্দা করার পিছনে যুক্তিসঙ্গত বা শরী‘আত সম্মত কোন কারণ থাকে, তবে সেই গীবত করা মুবাহ বা জায়েয। যেমন- যুলুমের বিচার প্রাপ্তির জন্য শাসকের কাছে নালিশ করার সময় গীবত করা। কোন ব্যক্তি যদি মযলূম হয়ে বিচারকের কাছে গিয়ে বলে, ‘অমুক ব্যক্তি আমার টাকা আত্মসাৎ করেছে, আমার প্রতি যুলুম করেছে, আমার বাড়িতে চুরি করেছে ইত্যাদি। তবে এটা হারাম গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। অনুরূপভাবে আলেম বা মুফতীর কাছে কোন বিষয়ে ফৎওয়া নেওয়ার জন্য অন্যায়কারীর গীবত করা জায়েয। অবজ্ঞা করার উদ্দেশ্য না করে স্রেফ পরিচয় দেওয়ার জন্য কারো ত্রুটি বর্ণনা করা জায়েয। যেমন- কানা, কালো, খোড়া ইত্যাদি।

গীবতের বিধান

গীবত করার বিধান দুই ভাগে বিভক্ত। (১) গীবত করার বিধান। (২) গীবত শোনার বিধান।

১. গীবত করার বিধান : গীবত একটি জঘন্য পাপ। গীবতের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ​

‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কর না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত কর না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১২)
এখানে মানব স্বভাবের তিনটি মারাত্মক ত্রুটি বর্ণনা করা হয়েছে। যা সমাজের শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট করে। প্রথমটি হ’ল ‘অহেতুক ধারণা’ (بَعْضَ الظَّنِّ) এবং দ্বিতীয়টি হ’ল ‘ছিদ্রান্বেষণ’ (وَلاَ تَجَسَّسُوا)। তৃতীয়টি হ’ল ‘গীবত’(وَلا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضاً) ।

ইমাম কুরতুবী বলেন,

لا خلاف أن الغِيبة من الكبائر، وأن مَن اغتاب أحدًا عليه أن يتوب إلى الله عز وجل​

‘গীবত কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, এতে কোন ইখতেলাফ নেই। যে ব্যক্তি কারো গীবত করবে, তার তওবা করা অপরিহার্য’।[23] ইমাম হায়তামী বলেন, অত্র আয়াত ও অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, গীবত করা কবীরা গুনাহ’।[24]
তাছাড়া বর্ণিত আয়াতে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর কারণ হ’ল- মৃত মানুষের গোশত খাওয়া হ’লে সে বুঝতে পারে না কে তার গোশত খাচ্ছে। অনুরূপ যার গীবত করা হয়, সেও বুঝতে পারে না কে তার গীবত করছে।[25]
হাদীসেও গীবতের ক্ষেত্রে মৃত ভক্ষণের কথা এসেছে এর নিকৃষ্টতা বুঝানোর জন্য। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন,

مَنْ أَكَلَ بِرَجُلٍ مُّسْلِمٍ أَكْلَةً فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُ مِثْلَهَا مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ كُسِىَ ثَوْبًا بِرَجُلٍ مُّسْلِمٍ فَإِنَّ اللهَ يَكْسُوهُ مِثْلَهُ مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ قَامَ بِرَجُلٍ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ فَإِنَّ اللهَ يَقُومُ بِهِ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ-​

‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের গীবতের বিনিময়ে এক গ্রাসও খাদ্য ভক্ষণ করবে, আল্লাহ তাকে সমপরিমাণ জাহানণামের আগুন ভক্ষণ করাবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে অপমান করার মাধ্যমে কোন কাপড় পরিধান করবে, আল্লাহ তাকে সমপরিমাণ জাহানণামের আগুন পরিধান করাবেন। আর যে ব্যক্তি কাকেও হেয় প্রতিপন্ন করে লোকদের নিকট নিজের বড়ত্ব যাহির করে এবং শ্রেষ্ঠত্ব দেখায়, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ স্বয়ং ঐ ব্যক্তির শ্রুতি ও রিয়া প্রকাশ করে দেবার জন্য দন্ডায়মান হবেন’।[26]

মূলতঃ গীবতের মাধ্যমে অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা হয়। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চিরদিনের জন্য এটা হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন,

إِنَّ دِمَاءَكُمْ، وَأَمْوَالَكُمْ، وَأَعْرَاضَكُمْ، بَيْنَكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِي شَهْرِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا، لِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الغَائِبَ، فَإِنَّ الشَّاهِدَ عَسَى أَنْ يُبَلِّغَ مَنْ هُوَ أَوْعَى لَهُ مِنْهُ​

‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকে তোমাদের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের কাছে মর্যাদা সম্পন্ন। এখানকার উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন (আমার এই কথা) অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। কারণ উপস্থিত ব্যক্তি সম্ভবত এমন ব্যক্তির কাছে এসব কথা পৌঁছাবে, যে এই বাণীকে তার চেয়েও অধিক আয়ত্তে রাখবে’।[27]

আমর ইবনুল আছ একদিন একটা মরা গাধার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। গাধাটির দিকে ইশারা করে তার সাথীদের বললেন,‌

لأَنْ ‌يأكُلَ ‌الرجلُ ‌مِنْ ‌هذا ‌حتى ‌يَمْلأ بَطْنَهُ، خيرٌ له مِنْ أنْ يأكُلَ لحْمَ رجلٍ مسْلِمَ،​

‘একজন মুসলিমের গোশত খাওয়া বা গীবত করার চেয়ে কোন মানুষের জন্য এই (মরা গাধার) গোশত খেয়ে পেট ভর্তি করা উত্তম’।[28] ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ.) বলেন, ‘অত্র হাদীস এটা প্রমাণ করে যে, গীবত করা কবীরা গুনাহ’।[29] গীবতকারীরা এই ঘৃণ্য পাপের কারণে সে পরকালেও ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে।[30] সালাফে ছালেহীন এই পাপকে এত বেশী ভয় করতেন যে, পরনিন্দা করা তো দূরের কথা, যারা পরনিন্দা করে তাদেরকেও ভয় করতেন, যেন তাদের সাথে মিশে এই পাপে না জড়িয়ে পড়েন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেছেন, فر من المغتاب ‌فرارك ‌من ‌الأسد ‘তুমি বাঘ থেকে যেভাবে পলায়ন কর, গীবতকারী থেকে সেভাবে পালিয়ে যাও’।[31]

২. গীবত শোনার বিধান : গীবত করা যেমন মহাপাপ তেমনি খুশি মনে পরনিন্দা শোনাও পাপ। মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন,

وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ​

‘তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন যেন তা উপেক্ষা করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৫)

ওলামায়ে কেরাম বলেন,

إن ‌سماع ‌الغيبة ‌والاستماع ‌إليها ‌لا ‌تجوز، فقائل الغيبة وسامعها في الإثم سواء،​

‘গীবত শোনা এবং এর দিকে কান পেতে থাকা বৈধ নয়। গীবতকারী এবং গীবত শ্রবণকারী উভয়ই সমান পাপী’।[32]

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,

أن الغِيبة كما يَحرُم على المغتاب ذِكرُها يحرُم على السامع استماعُها و إقرارها،​

‘গীবতকারীর উপরে মানুষের দোষ-ত্রুটির বর্ণনা দেওয়া যেমন হারাম, ঠিক তেমনি সেটার নিন্দা শ্রবণ করা এবং তার স্বীকৃতি দেওয়াও হারাম’।[33] তিনি বলেন,

أنه ينبغي لمن سَمِعَ الغِيبة أن يَرُدَّها، ويزجر قائلها، فإن لم ينزجر بالكلام زجره بيده، فإن لم يستطع باليد ولا باللسان، فارق ذلك المجلس، فإن سمع غيبة شيخه أو غيره ممَّن له عليه حق، أو من أهل الفضل والصلاح، كان الاعتناء بما ذكرناه أكثر،​

‘গীবত শ্রবণকারীর কর্তব্য হ’ল নিন্দাকারীকে প্রতিহত করা এবং তাকে ধমক দেওয়া। যদি কথার মাধ্যমে বিরত না রাখতে পারে, তবে হাত দিয়ে বাধা দিবে। যদি হাত বা মুখ দিয়ে বাধা দিতে না পারে, তাহ’লে সেই মজলিস পরিত্যাগ করবে। আর বয়স্ক লোক, বাধা দেওয়ার অধিকার আছে এমন ব্যক্তি, গণ্য-মান্য লোকের গীবত শোনার ব্যাপারে আলোচিত পরিস্থিতির চেয়ে আরো সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে’।[34]

সালাফগণ গীবতের ব্যাপারে এতটাই কঠোর ছিলেন যে, কোন বৈঠকে কারো নিন্দা করা হ’লে সেই বৈঠকই পরিত্যাগ করতেন। ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) দাওয়াতের মেহমান হয়ে এক খাবার মজলিসে হাযির হ’লেন। লোকজন বলল, ‘অমুক ব্যক্তি এখনো আসেনি’। একজন বলে উঠল, ‘সে একটু অলস প্রকৃতির লোক’। তখন ইবরাহীম (রহ.) বললেন, ‘যে বৈঠকে বসলে আমার মাধ্যমে কোন মুসলিম ভাইয়ের গীবত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, এমন মসলিসে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সমীচীন নয়’। একথা বলে তিনি না খেয়েই সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।[35]


[1]. ইবনু ফারেস, মু‘জামু মাক্বাঈসিল লুগাহ, ৪/৪০৩; ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৭৪০।
[2]. মুসলিম হা/২৫৮৯; আবূদাঊদ হা/৪৮৭৪; তিরমিযী হা/১৯৩৪।
[3]. নববী, আল-আয্কার, পৃ. ৩৩৬।
[4]. তাফসীরে কুরতুবী, ১৬/৩৩৫; মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব, ২/৪০১।
[5]. ইবনে মানযূর, লিসানুল আরব ১২/৫৯২; ইবনুল আছীর, আন-নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীস, ৫/২৫৬।
[6]. ফাৎহুল বারী ১০/৪৭৩।
[7]. তাফসীরে কুরতুবী, ২০/১৮১।
[8]. আব্দুর রঊফ মুনাভী, আত-তাওক্বীফ, পৃ.২৫৪; নাযরাতুন নাঈম, ১১/৫১৬৩।
[9]. এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রচিত ‘আছ-ছামিরুল মাসলূল ‘আলা শাতিমির রাসূল’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
[10]. বুখারী হা/৬৪৭৭; মুসলিম হা/২৯৮৮।
[11]. বুখারী হা/৬৪৭৮; মিশকাত হা/৪৮১৩।
[12]. আব্দুল আযীয রাজেহী, তাওফীকুর রাবিবল মুন‘ইম ৮/৪২০।
[13]. হায়তামী, আয-যাওয়াজির আন ইক্বতিরাফিল কাবায়ের ২/২৮।
[14]. নাজমুদ্দীন আল-মাক্বদেসী, মুখতাছার মিনহাজিল ক্বাছেদীন, পৃ.১৭২।
[15]. গাযালী, ইহ্য়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/১৫০।
[16]. মুসনাদে আহামাদ হা/২৫৭০৮; ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাত ওয়ান নামীমাহ, হা/৭০; পৃ.২৪, সনদ হাসান।
[17]. আবূদাঊদ হা/ ৪৮৭৫; তিরমিযী হা/২৫০২, সনদ সহীহ।
[18]. আসকালানী, ফাৎহুল বারী ১০/৪৬৯।
[19]. তাহানাওয়ী, কাশ্শাফু ইছত্বিলাহাতিল ফুনূন ওয়াল উলূম ২/১২৫৬।
[20]. ইহয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/১৪৫।
[21]. কাহত্বানী, আফাতুল লিসান, পৃ. ৯।
[22]. আল-মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব ২/৪০৯।
[23]. তাফসীরে কুরতুবী ১৬/৩৩৭।
[24]. হায়তামী, আয-যাওয়াখের ‘আন ইক্বতিরাফিল কাবায়ের, পৃ. ৩৭১।
[25]. তাফসীরে কুরতুবী ১৬/৩৩৫।
[26]. আবুদাঊদ হা/৪৮৮১; মিশকাত হা/৫০৪৭ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়; সহীহাহ হা/৯৩৪।
[27]. বুখারী হা/৬৭; মুসলিম হা/১৬৭৯।
[28]. সহীহুত তারগীব হা/২৮৩৮; সনদ সহীহ।
[29]. ফাৎহুল বারী ১০/৪৭০।
[30]. আবূদাঊদ হা/৪৮৭৮; মিশকাত হা/৫০৪৬; সনদ সহীহ।
[31]. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ ১/২৯২।
[32]. মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব ২/৪০৭।
[33]. নববী, আল-আযকার, পৃ.২৯১।
[34]. আল-আযকার, পৃ. ২৯৪।
[35]. সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ১৬৬।




আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।​
 
Last edited:
Similar threads Most view View more
Back
Top