জীবনী কঠিন নির্যাতনের শিকার আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

  • Thread Author

কঠিন নির্যাতনের শিকার আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)​

-আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস


সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এক চিরন্তন ব্যাপার। যুগে যুগে যখনই সত্যের প্রচার প্রসারে সমাজের ভাল মানুষরা উঠে দাঁড়িয়েছেন, তখনই বাতিল তার হিংস্র দন্ত-নখরে তাদেরকে অন্যায়ভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাদের উপর যে যুলম নির্যাতন করা হয়েছে তা যদি পাহাড়ের উপর করা হত, পাহাড় মাটির সাথে মিশে যেত। কিন্তু তারা সকল অত্যাচারের মুখে ছিলেন পাহাড়ের চেয়েও অটল অবিচল। তাঁরা তাদের রক্ত ও সম্পদ দিয়ে এসব মোকাবিলা করেছেন। যদিও এটা সত্য যে, প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী ছাহাবীদের মাঝে যারা দরিদ্র ও অসহায় ছিলেন তারাই কুরাইশদের দ্বারা বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তবে অনেক উঁচু শ্রেণী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছাহাবীও এ থেকে রেহাই পাননি। এমনকি একবার কুরাইশরা স্বয়ং আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে এত মারধর করেছিল যে, অল্পের জন্য তিনি মৃত্যুর হাত তেকে বেঁচে যান।

তখন মাত্র ৩৮ জন ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেছেন- এমন সময় আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পরামর্শ দিলেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশঙ্কা প্রকাশ করে বললেন, ‘আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমরা তো সংখ্যায় অনেক অল্প’। এভাবে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বারবার অনুরোধ করতে থাকলেন। অবশেষে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবীগণ কা‘বা চত্বরে গিয়ে নিজ নিজ গোত্রের লোকদের মাঝে অবস্থান নিলেন। এসময় নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বসে থাকলেন এবং আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়ে সকলকে ইসলামের দিকে আহ্বান করছেন। তাই প্রকাশ্যে ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী ব্যক্তি ছিলেন আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। কিন্তু মুশরিকরা তাঁর এ কাজে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এবং আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্য ছাহাবীদের উপর উপর্যুপরি আক্রমণ শুরু করল। তারা কা‘বা চত্বরের বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদেরকে প্রচণ্ড মারধর শুরু করল। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কেও বেদম প্রহার করল। এমনকি মাটিতে ফেলে পদপিষ্ট করল। পাপিষ্ঠ উতবা বিন রাবী‘আ আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর গায়ে-মুখে শক্ত এক পাটি জুতো দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগল। এতে তার মুখম-লে ছোপ ছোপ রক্ত জমে যায়, চেহারা এমন বিবর্ণ হয়ে যায় যে, তাকে চেনাই যাচ্ছিল না।

এমনটা আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে হয়ত তিনি সেদিন মারাই যেতেন; তবে তাঁর নিজ গোত্র বানু তাইমের লোকেরা দেরিতে হলেও তাঁকে উদ্ধার করে। ফলে আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান। তারা আক্রমণকারীদের কোনমতে সরিয়ে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে যখন তার বাড়িতে নিয়ে গেল, তখন তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁকে বাড়িতে রেখে তারা কা‘বা চত্বরে ফিরে এসে ঘোষণা দিল, ‘আল্লাহর কসম, যদি আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মারা যায়, তাহলে আমরা উতবা বিন রাবী‘আকেও হত্যা করব’।

এরপর তারা আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়ীতে গেল। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। তার বাবা আবু কুহাফা ও অন্যরা তাঁকে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন; এভাবে সারাদিনের সেবা শুশ্রুষা শেষে তিনি সম্বিত ফিরে পান। কিন্তু হুঁশ ফিরে পেয়েই নিজের করুণ অবস্থার কথা ভুলে তিনি বারংবার মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারেই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, তিনি কেমন আছেন? কোথায় আছেন? এদিকে তাঁর গোত্রের লোকেরা যেহেতু তখনও মুসলিম হয়নি; গোত্রপ্রীতির কারণে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কেই তারা অধিক ভালবাসত। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনার পরেও আবু বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর এরূপ ব্যবহারে তারা বেশ মনঃক্ষুণ্ন হল। তারা তাঁকে তাঁর নিজ জীবন হুমকির মুখে না ফেলতে সতর্ক করল।

জ্ঞান ফিরে এলেও প্রচণ্ড প্রহারের কারণে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখনও বেশ দুর্বল ছিলেন। তাঁকে খাবার খাওয়ানোর জন্য তার মা উম্মুল খাইরকে তাগাদা দিয়ে তার গোত্রের লোকেরা চলে গেল। উম্মুল খাইর তাকে খাওয়াতে এলে তিনি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবস্থা সম্পর্কে আবার জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু বানু তাইমের কারও পক্ষেই এই চরম গণ্ডগোলের মাঝে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জানা সম্ভব ছিল না। কেননা তিনিও তখন তাঁর গোত্র বানু হাশিমের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ছিলেন। উম্মুল খাইর বললেন, আল্লাহর শপথ, তোমার সাথীর খবর জানি না। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বললেন, খাত্ত্বাবের মেয়ে। (ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বোন) উম্মু জামীলের কাছে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে একটু জেনে আসুন।

উম্মুল খাইর জানতেন মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবন আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে তাঁর নিজের জীবনের চেয়েও প্রিয়। তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে উম্মু জামীলকে খুঁজতে বের হলেন। তাকে খুঁজে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জানতে চেয়েছে, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেমন আছেন?

উম্মু জামীল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) উত্তর দিলেন, আমি আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কিংবা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাউকেই চিনি না, অবশ্য আপনি চাইলে আমি আপনার পুত্রকে দেখতে যেতে পারি। উম্মুল খাইর বললেন, ঠিক আছে এসো। তারা দু’জন আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে ফিরে গেলেন। উম্মু জামীল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর এই করুণ অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম, আপনার সাথে যারা এরকম করেছে তারা বদমাশ এবং অবিশ্বাসী। আল্লাহর কাছে দু‘আ করছি, তিনি যেন এর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আবারও জিজ্ঞেস করলেন, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেমন আছেন? উম্মুল জামীল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, ‘আপনার মা শুনে ফেলবেন তো’! আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে মানা করলেন। উম্মু জামীল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নিশ্চিত হওয়ার পর বললেন, ‘তিনি নিরাপদ ও সুস্থ আছেন’। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনি এখন কোথায় আছেন’? উম্মু জামীল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, ‘আরকামের বাড়ীতে’।

নিজের এত অসুস্থতা ও বিশ্রামের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর শপথ করে বললেন যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাল আছেন, তা নিজ চোখে দেখে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি খাবার পানি ছুয়ে দেখবেন না। উম্মু জামীল ও উম্মুল খাইর পরিস্থিতি একটু শান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন। তারপর তাকে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে নিয়ে গেলেন। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অসুস্থ হওয়ায় তিনি দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে চললেন। আরকামের বাড়িতে ঢুকতেই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দিকে দ্রুত এগিয়ে এলেন এবং তাকে চুমু খেলেন। ঘরের অন্য মুসলিমরাও তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এই করুণ অবস্থা দেখে বড়ই কষ্ট পেলেন। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার জন্য আমার পিতামাতা কুরবান হোক। পাপিষ্ঠটা আমার মুখে যে আঘাত করেছিল, সে ব্যথা ছাড়া আমার কোন ব্যথা নেই। আর ইনি হলেন আমার মা, যিনি আমার উপর সর্বদা আস্থাশীল। আপনি তো এক বরকতময় ব্যক্তি, আপনি একটু তাকে ইসলামের পথে আহ্বান করুন; তার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন। হয়ত আপনার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন। অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মায়ের জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করেন এবং তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন’।

(আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, আস-সীরাতু নাবাবিইয়্যা, তাহক্বীক্ব : মুছত্বফা আব্দুল ওয়াহিদ (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফা, ১৩৯৬ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩৯-৪৪১; আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নাহিয়াহ (দারুল ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০-৪১)।

সুধী পাঠক! ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর অকথ্য নির্যাতনের ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তিনি তো ছিলেন তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন উচ্চ শিক্ষিত ধনী মানুষ। তবুও ইসলাম গ্রহণ ও প্রচারের জন্য তিনি কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, জুতার আঘাত পর্যন্ত সহ্য করেছেন। এভাবেই যুগে যুগে ইসলামের লড়াকু সৈনিকগণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার তাদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন। উক্ত ঘটনায় আধুনিক যুগের দাঈ ইলাল্লাহদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।



শিক্ষণীয় বিষয় :
ক. নিশ্চিত অপমান কিংবা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইসলামের প্রকৃত দাওয়াত থেকে পিছিয়ে থাকা যাবে না।
খ. রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ভালবাসা স্থাপনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন।
গ. প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতার প্রতি সম্মান, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ শতভাগ অক্ষুণ্ন রাখা।
ঘ. জাহেলী যুগে মক্কাবাসীদের মাঝে যে গোত্রপ্রীতি প্রবল আকারে প্রচলিত ছিল আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ব্যাপারে তাঁর গোত্রের মানুষদের প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার থেকে সেটা স্পষ্ট হয়।
ঙ. ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে সর্বদা বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা। যেমন উম্মু জামীল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) করেছিলেন।
চ. দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি থাকা বাঞ্ছনীয়। এগুলো অতি সাহসিকতার সাথে মাড়িয়েই সফলতার রক্তিম সূর্য উদিত হয়।
ছ. নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কিংবা তাদের অতি নিকটতম ব্যক্তিদের উপর পরীক্ষাটা সবার প্রথমেই আসে।
 
Back
Top