ঈমানী তেজোদীপ্ত নির্যাতিত সাহাবী খাববাব বিন আল-আরাত (রাঃ)
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
খাববাব একটি নাম। একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস যালেমের বিরুদ্ধে জান্নাতপিয়াসী মযলূমের ছবরের ইতিহাস। যে ইতিহাস বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয়ের ইতিহাস। যে ইতিহাস আত্মত্যাগের বিশ্ব কাঁপানো ইতিহাস। ইসলামের সূচনালগ্নে পরাধীনতার শৃংখলে বন্দী থাকাবস্থায় ইসলামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন খাববাব ছিলেন তাদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের ফলে তার উপরে যেরূপ নির্যাতন নেমে এসেছিল তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তবুও আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান এসব নির্যাতনকেও হার মানিয়েছিল। ফলে শত যুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও তিনি দ্বীনের উপর অবিচল ছিলেন। ছিলেন আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল। নির্যাতিত এই ছাহাবীর ঘটনাবহুল জীবনীতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সেকারণ আলোচ্য নিবন্ধে পাঠকদের উদ্দেশ্যে এই জলীলুল কদর ছাহাবীর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তুলে ধরা হ’ল।-
.
.
তাঁর নাম খাববাব, পিতার নাম আল-আরাত, দাদার নাম জানদালাহ। তাঁর বংশধারা হচ্ছে- খাববাব বিন আল-আরাত বিন জান্দালাহ বিন সা‘দ বিন খুযায়মাহ বিন কা‘ব বিন সা‘দ বিন যায়েদ মানাহ। তিনি বনু তামীম গোত্রের সন্তান। তাঁর কুনিয়াত আবূ ইয়াহইয়া আত-তামীমী। তবে কারো কারো মতে তার কুনিয়াত আবু আব্দিল্লাহ।[1] তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
.
.
সমাজের আর দশটা কিশোরের ন্যায় খাববাবও স্বীয় পিতা-মাতার নিকটেই স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু আচমকা তাদের গোত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আরবের অন্য একটি গোত্র। অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তারা গৃহপালিত পশু ও সম্পদ লুট করে নেয়। তাদের পুরুষদের হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের বন্দী করে দাসে পরিণত করে। খাববাব ঐ আক্রমণের শিকার হয়ে বন্দীত্ব বরণ করেন। সেই থেকেই স্বাধীন বালক খাববাবের বুকের উপর চেপে বসে পরাধীনতার জগদ্দল পাথর। শুরু হয় গোলামী জীবনের বিভীষিকাময় অধ্যায়। এ হাত ঐ হাত বদল হয়ে খাববাবকে উঠানো হয় মক্কার ক্রীতদাস বেচাকেনার হাটে। তখনো তিনি যৌবনে পদার্পণ করেননি। সুঠাম দেহের অধিকারী বালক খাববাবের চেহারায় ছিল বুদ্ধিমত্তার ছাপ। কর্মস্পৃহা ও দক্ষতার চিহ্ন ফুটে ওঠেছিল তার পুরো অবয়বে। এক নযরেই পসন্দ হবে যে কারো।
এদিকে মক্কার বনু খুযা‘আ গোত্রের উম্মে আনমার (أم أنمار) নামক জনৈকা মহিলা তার নিজের জন্য একটি গোলাম খরীদ করার উদ্দেশ্যে ঐ বাজারে গমন করে। তার উদ্দেশ্য, সে সবল, কর্মঠ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একটি গোলাম খরীদ করবে। এ লক্ষ্যে বাজারে আনীত দাসদের চেহারা ও স্বাস্থ্য সে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। অবশেষে চোখ পড়ল খাববাব বিন আল-আরাতের উপর। দেখামাত্রই পসন্দ হ’ল। চাহিদার সাথে প্রাপ্তির অপূর্ব সংযোগ ঘটল। বরং প্রত্যাশার চাইতে প্রাপ্তিই যেন বেশী হ’ল। বিক্রেতার সাথে দর-দাম মিটানো হ’ল। অতঃপর কাঙ্খিত মূল্য পরিশোধ করে খাববাবকে খরীদ করে বাড়ীতে নিয়ে গেল উম্মে আনমার। এভাবেই দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হ’লেন নির্যাতিত ছাহাবী খাববাব (রাঃ)।[2]
.
.
উম্মে আনমার খাববাবকে খরীদ করার পর মক্কার একজন কর্মকারের নিকটে তরবারি নির্মাণের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্রেরণ করে। গভীর মনোনিবেশের সাথে খাববাব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মেধাবী খাববাব অল্পদিনের মধ্যেই তরবারী নির্মাণ শিল্পে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হ’লে তার মুনীব তার জন্য একটি দোকানঘর ভাড়া নেয় এবং তরবারি নির্মাণের বিভিন্ন সরঞ্জাম খরীদ করে দেয়। অতঃপর খাববাব সুনিপুণভাবে তরবারি নির্মাণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর আমানতদারিতা, সততা ও তরবারি নির্মাণের দক্ষতার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা এসে তার দোকান থেকে তরবারি কিনে নেয়। মক্কার বাইরেও বিভিন্ন বাজারে তার নির্মিত তরবারি বিক্রি হ’তে শুরু করে। এভাবে তরবারি নির্মাণের একজন দক্ষ কারিগর হিসাবে তিনি মক্কায় ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেন।[3]
.
.
বয়সে তরুণ হ’লেও বুদ্ধিমত্তায় খাববাব ছিলেন পরিপক্ক। ছিলেন চিন্তাশীলও। তিনি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে মাঝে মধ্যেই চিন্তামগ্ন হতেন। কাজের অবসরে সুযোগ পেলেই ভাবতেন জাহেলিয়াতের অতল গহবরে নিমজ্জিত ঘুণেধরা সেই সমাজ নিয়ে। নেতাদের দুশ্চরিত্রতা, নীতিহীনতা, যুলুম-নির্যাতন, শোষণ-নিপীড়ন, সূদ, ঘূষ, জুয়া, লটারী, মদ ও নারীতে চুর হয়ে থাকা, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে দেওয়া এসব কিছু রীতিমত তাঁর হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। আনমনা হয়ে এসব ভাবতেন আর বলতেন,لا بد لهذا الليل من آخر، ‘এই রাত্রির (অন্ধকারের) অবশ্যই শেষ আছে’। অর্থাৎ অন্ধকার ছাপিয়ে একদিন আলোর রেখা উদ্ভাসিত হবেই। আর তা দেখার জন্য তার দিলে ছিল ব্যাপক তামান্না। সেকারণ তিনি দীর্ঘ হায়াত কামনা করতেন।[4]
দুর্ভাগ্য, দেড় হাযার বছর পূর্বে ক্রীতদাস খাববাবের হৃদয়ে তৎকালীন সমাজের করুণ চিত্র দেখে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছিল এবং তা থেকে মুক্তির প্রেরণা জাগ্রত হয়েছিল, দেড় হাযার বছর পরে এসে আমাদের নেতৃবৃন্দের মনে সেই প্রেরণা তো দূরের কথা, তাদের মনে সামান্য রেখাপাতও করে না। অথচ জাহেলী আরবের প্রায় সকল অপকর্মই আজ সর্বত্র ব্যাপকভাবে বিরাজ করছে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে গোটা জাতি। খোদ নেতা ও দায়িত্বশীলরাই জড়িত এসব অন্যায় ও অপকর্মের সাথে। কথায় বলে বেড়া যখন ক্ষেতের ফসল খায়, তখন আর রক্ষা করবে কে? অতএব নেতারা সাবধান! আল্লাহকে ভয় করুন! ফিরে আসুন যাবতীয় অন্যায় ও দুর্নীতি থেকে। প্রতিষ্ঠা করুন ইনছাফ ও ন্যায়-নীতি। নচেৎ যেকোন সময় বড় ধরনের এলাহী গযবের শিকার হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। আজকের বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীও সেই সতর্ক বার্তাই বহন করে।
.
.
অবশেষে খাববাবের সেই কাঙ্খিত আলো উদ্ভাসিত হ’ল। রাতের আধার কেটে পূর্ব গগনে রক্তিম টগবগে সূর্য উদিত হ’ল। তাকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হ’ল না। সমাজ নেতাদের দুষ্কর্মে অতিষ্ঠ খাববাব জানতে পারলেন যে, বনু হাশেম গোত্রের এক যুবক নতুন এক দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে আভির্ভূত হয়েছেন। যে দ্বীন প্রচলিত ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। ঠিক যেমনটি খাববাবের হৃদয় কন্দরে লালিত বাসনা ছিল। আল্লাহ খাববাবের হৃদয়কে দ্বীনের জন্য প্রশস্ত করে দিলেন। অতঃপর কাল বিলম্ব না করে তিনি ছুটে গেলেন বনু হাশিম গোত্রের সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে। সেখানে গিয়ে তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ হ’লেন। সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে হাত রেখে পরম তৃপ্তির সাথে ঘোষণা করলেন,أشهد أن لا إله إلا الله و أشهد أن محمدا عبده ورسوله ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’।[5] আর এভাবেই তিনি শামিল হ’লেন পৃথিবীর প্রথম সারির মুসলমানদের কাতারে। রচিত হ’ল এক অন্য ইতিহাস।
উল্লেখ্য যে, তিনি কততম মুসলিম ছিলেন এ নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে هو سادس الإسلام ‘তিনি ষষ্ঠ মুসলিম’। এই মতটিই প্রসিদ্ধ।[6] তবে মুজাহিদ বলেন, ‘সর্বপ্রথম ইসলামের ঘোষণা দেন রাসূল (ছাঃ)। অতঃপর (ইসলাম কবুল করেন) আবুবকর, খাববাব, বেলাল, ছুহাইব ও আম্মার (রাঃ)’। এই মত অনুযায়ী তিনি তৃতীয় মুসলমান। ইবনু ইসহাকের মতে, তিনি ১৯ জনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। وَأَنَّهُ كمَّل العِشْرِيْنَ অর্থাৎ তিনি ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা বিশ পূর্ণ করেন।[7] তবে এ বিষয়ে সকলে একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দারুল আরক্বামে প্রবেশের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।[8]
উল্লেখ্য যে, দারুল আরক্বাম হচ্ছে ছাফা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত আরক্বাম বিন আবুল আরক্বামের বাড়ী। জায়গাটি ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও মুশরিকদের দৃষ্টির আড়ালে। মুশরিকদের বাধার কারণে ৫ম হিজরীতে রাসূল (ছাঃ) এই বাড়ীটিকে প্রশিক্ষণও প্রচার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেন।[9] এটিকে ইসলামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বললেও অত্যুক্তি হবে না।
.
.
খাববাবের জীবনে শুরু হ’ল নতুন অধ্যায়। যুলুম-নির্যাতনের অধ্যায়। শুরু হ’ল ঈমান ও ছবরের কঠিনতম পরীক্ষা। খাববাব (রাঃ) ছিলেন প্রথম প্রকাশ্যে ইসলাম প্রকাশকারী। অন্যান্য ছাহাবীগণ মুশরিকদের নির্যাতনের ভয়ে ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখলেও খাববাব (রাঃ) তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি কারো নিকটেই গোপন রাখলেন না।[10] ফলে তার উপর নেমে এল বিশ্ব ইহিাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, লোমহর্ষক ও বর্বরোচিত নির্যাতন। যার দু’একটি নমুনা নিম্নে তুলে ধরা হল।-
সিবা‘ নেতাদের পক্ষ থেকে নির্দেশ ও দায়িত্ব পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে তার দলবল নিয়ে খাববাবের উপর নানা তরীকায় নির্যাতন শুরু করে। তারা খাববাবকে মক্কার বালুময় উত্তপ্ত উপত্যকায় নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তার গায়ের জামা খুলে ফেলে লৌহ বর্ম পরিধান করিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেলে রাখে। উপর থেকে সূর্যতাপ নীচ থেকে যমীনের উত্তাপ ও শরীরে পরানো লৌহ বর্মের তাপ এই ত্রিমুখী তাপে খাববাবের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত ছিল। তৃষ্ণায় ছটফট করলেও তাকে পানি দেওয়া হ’ত না। পানি চাইলে এরা বলে, ‘মুহাম্মাদ সম্পর্কে তোমার মতামত কি’? কঠিন নির্যাতনের শিকার তৃষ্ণার্ত খাববাব এই অবস্থায়ও দৃঢ়চিত্ততার ভাব জওয়াব দেন,هو عبد الله ورسوله جاءنا بدين الهدى والحق ليخرجنا من الظلمات إلى النور- ‘তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য সত্য ও সঠিক দ্বীন সহ প্রেরিত হয়েছেন’। এই জওয়াব শুনে কাফেররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পুনরায় নির্যাতন শুরু করে। অতঃপর আবার জিজ্ঞেস করে, ‘লাত ও উযযা সম্পর্কে তোমার অভিমত কি’? স্পষ্টবাদী খাববাব এবারও দ্ব্যর্থহীনভাবে জবাব দেন,صَنَمَانِ أَصَمَّان أَبْكَمَانِ لا يَضُرَّان ولا يَنْفَعَان، ‘বোবা-বধির দু’টি মূর্তি, যাদের পক্ষে কারো ক্ষতি বা কল্যাণ করার কোন ক্ষমতা নেই’। অতঃপর আবার শুরু হয় মারপিট। এভাবেই চলতে থাকে নির্যাতন।[13]
ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে একদিন তিনি তাঁর নিকটে গেলেন। ওমর (রাঃ) তাকে একটি আসনে বসতে দিয়ে বললেন, একমাত্র বিলাল ব্যতীত এই স্থানে বসার জন্য তোমার অপেক্ষা অধিকতর উপযুক্ত আর কেউ নেই। খাববাব তখন বললেন, তিনি কিভাবে আমার সমান হ’তে পারেন? কেননা মুশরিকদের মধ্যেও তার সাহায্যকারী ছিল। অথচ একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আমার কোনই সাহায্যকারী ছিল না। ওমর (রাঃ) তখন তার উপর কাফেরদের নির্যাতন সম্পর্কে জানতে চাইলেন। খাববাব (রাঃ) তখন কিছু না বলে নিজের চাদরটি আলগা করে তার পিঠ খলীফা ওমর (রাঃ)-কে দেখালেন। খাববাবের পিঠের বীভৎস চিত্র দেখে খলীফা অাঁতকে ওঠলেন। জানতে চাইলেন, এটি কি করে হ’ল খাববাব? খাববাব তখন ঘটনা খুলে বললেন।[15]
أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالًا وَوَلَدًا، أَطَّلَعَ الْغَيْبَ أَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا، كَلَّا سَنَكْتُبُ مَا يَقُولُ وَنَمُدُّ لَهُ مِنَ الْعَذَابِ مَدًّا، وَنَرِثُهُ مَا يَقُولُ وَيَأْتِينَا فَرْدًا-
‘তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছ যে আমাদের আয়াত সমূহ প্রত্যাখ্যান করে আর বলে যে, আমাকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অবশ্যই দেওয়া হবে। সে কি গায়েবী বিষয় জেনে গেছে, নাকি দয়াময়ের নিকট থেকে কোন অঙ্গীকার পেয়েছে? কখনোই না। যা সে বলে আমরা তা লিখে রাখব এবং তার জন্য শাস্তি দীর্ঘায়িত করতে থাকব। সে যে বিষয়ে বলে (অর্থাৎ মাল ও সন্তানাদি), তার মৃত্যুর পরে আমরাই তার অধিকারী হব। আর সে আমাদের কাছে আসবে একাকী’ (মারিয়াম ১৯/৭৭-৮০)।[17]
.
.
একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ পথে যাচ্ছেন। তখন লোহার পাত গরম করে খাববাবের মাথায় ঠেসে ধরে নির্যাতন করা হচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর হৃদয় ব্যথিত হ’ল। খাববাবের ব্যাপারে কিছু করা দরকার। কিন্তু সেই সামর্থ্য তখনো তাঁর নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন সেখানেই দুই হাতের তালু আকাশের দিকে প্রশস্ত করে মহান আল্লাহর দরবারে খাববাবের জন্য দো‘আ করলেন, اَللّهُمَّ انْصُرْ خَبَّابًا ‘হে আল্লাহ তুমি খাববাবকে সাহায্য কর’।[18]
.
.
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় অল্প কয়েকদিন যেতে না যেতেই উম্মে আনমার এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হ’ল, যার কোন চিকিৎসা নেই। মাথার যন্ত্রণায় সে সবসময় কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করত। চিকিৎসকরা বলে দিলেন, এই রোগের কোন ঔষধ নেই। তবে লোহার পাত আগুনে গরম করে মাথায় সেক দিলে কিছুটা উপশম হ’তে পারে। পরামর্শ অনুযায়ী মাথায় সেক দেওয়া শুরু হ’ল। খাববাবের শাস্তি আল্লাহ এভাবেই যালেম উম্মে আনমারকে ফিরিয়ে দিলেন। আল্লাহর বিচার কতই না সূক্ষ্ম!
.
.
আখেরাতে মুক্তির আশায় ও জান্নাত লাভের নেশায় খাববাব (রাঃ) কাফের-মুশরেকদের অমানসিক নির্যাতনেও ছবরের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘খাববাবের শাস্তির পরিধি ছিল বড়। কিন্তু তার শাস্তির চাইতেও (দ্বীনের উপর) তার অবিচলতা ও ধৈর্য ছিল অনেক বেশী’।[19]
আর ঈমানের প্রতি তাঁর এই দৃঢ়তা ও ছবরের তীব্রতা ষোল আনা জাগ্রত হয়েছিল যখন তিনি নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কা‘বা চত্বরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে উপদেশ লাভ করেছিলেন। ছহীহ বুখারী সহ অন্যান্য হাদীছের কিতাবে খাববাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন,
شَكَوْنَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِى ظِلِّ الْكَعْبَةِ، قُلْنَا لَهُ أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلاَ تَدْعُو اللهَ لَنَا قَالَ كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ-
‘আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে (কাফেরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে) অভিযোগ করলাম। তখন তিনি নিজের চাঁদরকে বালিশ বানিয়ে কা‘বার ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য (আল্লাহর নিকটে) সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের (দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের) জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করবেন না? তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা এমন ছিল যে, তাদের জন্য মাটিতে গর্ত খনন করা হ’ত এবং ঐ গর্তে তাকে পুঁতে রেখে করাত দিয়ে তাঁর মস্তক দ্বিখন্ডিত করা হ’ত। অথচ (এ অমানুষিক নির্যাতন) তাদেরকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে শরীরের হাঁড় থেকে গোশত ও শিরা-উপশিরা সব বিচ্ছিন্ন করে দিত। এরপরও তাদেরকে দ্বীন থেকে সমান্যতম দূরে সরাতে পারেনি। আল্লাহর কসম, অবশ্যই তিনি এ দ্বীনকে পূর্ণতা দান করবেন। তখন একজন উষ্ট্রারোহী ছান‘আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে, আল্লাহ ব্যতীত সে অন্য কাউকে ভয় করবে না এবং তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণকেও সে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছ’।[20]
মূলতঃ এরপর থেকে তাঁর ঈমান আরো অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে কাফেরদের নির্যাতন তাঁকে দ্বীন থেকে এক চুল পরিমাণও টলাতে পারেনি। নির্যাতনের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন সবকিছুই তিনি ঈমান ও ছবরের হাতিয়ার দ্বারা পরাভূত করে দিতেন। দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় অবিচল থাকতেন ইসলামের উপরে।
.
.
নির্যাতিত ছাহাবী খাববাব (রাঃ) পবিত্র কুরআনের দরস-তাদরীসে বেশ পারদর্শী ছিলেন। ইসলামে দীক্ষিত হওয়া নতুন মুসলিম, যারা কাফেরদের ভয়ে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখতেন, তিনি তাদের বাড়ীতে গিয়ে কুরআন শিক্ষা দিতেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি কুরআনের পঠন-পাঠনে এতটাই বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন যে, অনেক ছাহাবী তাকে গুরুত্ব দিতেন। যাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। খলীফা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাব ও তার স্বামী সাঈদ বিন যায়েদকে তিনি তাদের বাড়ীতে গিয়ে কুরআন শিখাতেন।[21]
.
.
খাববাব, বিলাল, ছুহাইব, আম্মার (রাঃ) প্রমুখ দুর্বল ও ক্রীতদাস ছাহাবীরা প্রায় সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আশপাশে থাকতেন। তাদেরকে কিভাবে রাসূলের পাশ থেকে দূরে সরানো যায় এবার সেই ফন্দি আটল কাফেররা। দু’জন প্রতিনিধি পাঠাল রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে। আক্বরা‘ ইবনে হাবিস ও উ‘য়াইনা ইবনে হাসান আল-ফাযারী নামক দুই কুরাইশ নেতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে গিয়ে এই প্রস্তাব পেশ করল যে, মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আপনার কাছে আসেন। এখানে এসে এই গোলাম ও দুর্বলদের সাথে বসতে তাদের আত্মসম্মানে বাধে। আপনি ঐ সময় এদেরকে একটু দূরে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে কিছুটা দুর্বলতা দেখালে সাথে সাথে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করে রাসূল (ছাঃ)-কে সতর্ক করে দেন,وَلَا تَطْرُدِ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُوْنَ مِنَ الظَّالِمِيْنَ- ‘আর তুমি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না, যারা তাদের প্রতিপালককে আহবান করে তার চেহারা (সন্তুষ্টি) অন্বেষণে সকালে ও সন্ধ্যায়। তাদের হিসাবের কোন দায়িত্ব তোমার উপরে নেই এবং তোমার হিসাবের কোন দায়িত্ব তাদের উপরে নেই যে, তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে। তাহ’লে তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৫২-৫৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا-
‘আর তুমি নিজেকে ধরে রাখো তাদের সাথে যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে আহবান করে তাঁর চেহারা কামনায় এবং তুমি তাদের থেকে তোমার দু’চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায়। আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)।
.
.
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় হিজরতের অনুমতি লাভ করলেন তখন অন্যান্য ছাহাবীদের ন্যায় খাববাব (রাঃ)ও মদীনায় হিজরত করেন।[22] এ হিজরত ছিল স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য, যুলুম-নির্যাতনের ভয়ে নয়। তিনি বলেন, هَاجَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى سَبِيلِ اللهِ نَبْتَغِى وَجْهَ اللهِ ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মদীনায় হিজরত করেছিলাম’।[23] মদীনায় পৌঁছে তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হ’ল। চরম অশান্তির পর যেন পরম প্রশান্তি লাভ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনছার ছাহাবী জুবায়ের বিন আতীকের সাথে তার দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দেন। অতঃপর মক্কার ন্যায় মদীনায়ও তিনি দাওয়াত ও তা‘লীমের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
.
.
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার সংগ্রামেও খাববাব (রাঃ) ছিলেন একজন দক্ষ সৈনিক। বাতিলকে পরাভূত করতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন সর্বক্ষণ। বদর, ওহোদ সহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত সকল জিহাদেই তিনি শরীক ছিলেন ছবর ও দৃঢ়তার সাথে। ওহোদের যুদ্ধে তিনি মক্কায় তাকে নির্যাতনকারী উম্মে আনমারের ভাই সিবা‘ বিন আব্দুল উয্যার পরিণতিও স্বচক্ষে দেখেছিলেন। সেদিন হযরত হামযা (রাঃ)-এর হাতে সে নিহত হয়েছিল।[24]
.
.
তাঁর নিকট হ’তে মোট ৩২টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মুত্তাফাক্ব আলাইহে তথা ইমাম বুখারী ও মুসলিম একত্রিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া ইমাম বুখারী (রহঃ) পৃথকভাবে ২টি ও ইমাম মুসলিম (রহঃ) ১টি হাদীছ বর্ণনা করছেন। তাঁর থেকে যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তারা হ’লেন তার পুত্র আব্দুল্লাহ, আবূ উমামা বাহেলী, আবু মা‘মার, আব্দুল্লাহ বিন শু‘আইব, কায়েস বিন আবী হাযেম, মাসরূক ইবনে আজদা, আলকামা ইবনে কায়েস প্রমুখ।[25]
দারিদ্রে্যর কষাঘাতে জর্জরিত খাববাব (রাঃ) শেষ জীবনে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা লাভ করেন। খলীফা ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর শাসনামলে তার জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এতে তার স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। পরবর্তীতে তিনি কূফায় একটি বাড়ী নির্মাণ করেন। তবে তিনি অর্থের প্রতি কখনো আগ্রহী ছিলেন না। বরং আখেরাতে জবাবদিহিতার ভয়ে ভীত থাকতেন সব সময়। তিনি দানের প্রতি এতটাই উদার ছিলেন যে, কূফার বাড়ীতে পৃথক একটি কক্ষ নির্ধারণ করেছিলেন, যেখানে তিনি অর্থ জমা রাখতেন। যে কক্ষের কোন তালা-চাবি ছিল না। কোন অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। লোকেরা সেখানে যেত এবং তাদের চাহিদামত মাল গ্রহণ করত।[26] এভাবে সাহায্যপ্রার্থী বা ফকীর-মিসকীনদের জন্য সম্পদের ভান্ডার খুলে দেওয়ার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। সমাজের ধনিক শ্রেণী বিষয়টি ভেবে দেখবেন কি?
.
.
তাঁর আল্লাহ ভীতি ও পরহেযগারিতা ছিল অতুলনীয়। শেষ বয়সে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে রীতিমত চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, না জানি আল্লাহ আমার সৎকর্মের পুরস্কার দুনিয়াতেই দিয়ে দিলেন। আর এই ভীতি থেকেই তিনি তাঁর সকল দীনার-দিরহাম উন্মুক্ত কক্ষে রেখে দিতেন। যেন যে কেউ সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারেন। আর এর জন্য কোন অনুমতিরও প্রয়োজন হ’ত না। তিনি বলতেন,
وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَمْلِكُ دِينَارًا وَلا دِرْهَمًا وَإِنَّ فِي نَاحِيَةِ بَيْتِي فِي تَابُوتِي لأَرْبَعِينَ أَلْفٍ وَافٍ. وَلَقَدْ خَشِيتُ أَنْ تَكُونَ قَدْ عُجِّلَتْ لَنَا طَيِّبَاتُنَا فِي حَيَاتِنَا الدُّنْيَا
‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমি একটি দীনার বা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর এখন আমার সিন্দুকের কোণায় চল্লিশ হাযার দীনার জমা আছে। আমি ভয় পাচ্ছি আল্লাহ আমার সকল নেক আমলের ছওয়াব আমার জীবদ্দশায় আমার ঘরেই দিয়ে দেন কি-না!’।[27]
অন্য বর্ণনা মতে তিনি তার সম্পদ নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে, তার অসুস্থাবস্থায় তার কয়েকজন সাথী তাকে দেখতে গেলে তিনি তার ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন,إن فى هذا المكان ثمانين الف درهم والله ما شددت عليها رباطا قط ولا منعت منها سائلا قط،‘এখানে ৮০ হাযার দিরহাম আছে। আল্লাহর কসম আমি কখনো এর মুখ বন্ধ করিনি এবং কোন সায়েলকে কখনো নিষেধ করিনি’। এই বলেই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। তখন সাথীরা কেন কাঁদছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
لِأِنَّ أصحابى مَضَوا ولم ينالوا من أجورهم فى هذه الدنيا شيئا و أننى بقيت فنلتُ من هذا المال ما أخاف أن يكون ثوابًا لتلك الأعمال،
‘আমার সাথীরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে কোন প্রতিদান প্রাপ্তি ছাড়াই। অথচ আমি এখনো বেঁচে আছি এবং এত সম্পদের মালিক হয়েছি। আমার ভয় হয় এই সম্পদ না জানি আমার আমলের প্রতিদান হয়ে যায়’।[28]
মৃত্যুর সময় তাকে পরিচর্যাকারী জনৈক সাথী বললেন,أَبْشِرْ يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، فَإِنَّكَ مُلاَقٍ إِخْوَانَكَ غَدًا، ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কেননা কালই আপনি আপনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হবেন’। তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,ذَكَّرتموني أقواماً، وإخواناً مَضَوْا بِأُجُورهم كُلِّهَا لَمْ يَنالُوا مِنَ الدُّنيا شَيْئًا ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’।[29]
তিনি তার জন্য ক্রয়কৃত কাফনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এই যে আমার কাফনের কাপড়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাচা হামযা ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হলে তার কাফনের জন্য একটি চাদর ব্যতীত আর কোন কাপড় পাওয়া গেল না। যে চাদর দিয়ে তার পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে যেত, আর মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যেত। অবশেষে রাসূল (ছাঃ) তার পায়ের দিকে ‘ইযখির’ ঘাস দিয়ে ঢেকে দিতে বললেন’।[30]
.
.
মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পূর্বে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগ যন্ত্রণা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় তিনি মাঝে মাঝে বলতেন,لولا أن رسول الله صلى الله عليه و سلم نهانا ان ندعو بالموت لدعوت به، ‘যদি রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ না করতেন, তাহ’লে আমি মৃত্যুর জন্য দো‘আ করতাম’।[31] অবশেষে ৩৭ হিজরীতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি কূফায় মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য, ছাহাবীদের মধ্যে তাকেই প্রথম কূফায় দাফন করা হয়।[32]
আলী (রাঃ) ছিফফীনের যুদ্ধে বের হয়ে যাওয়ার পর তিনি ইন্তেকাল করেন। অতঃপর ফেরার পথে তিনি তার কবর যিয়ারত করেন। অতঃপর তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, رَحِمَ اللهُ خَبَّابًا، لَقَدْ أَسْلَمَ رَاغِبًا، وَهَاجَرَ طَائِعًا، وَعَاشَ مُجَاهِدًا، وَابْتُلِيَ فِي جِسْمِهِ أَحْوَالاً، وَلَنْ يُضَيِّعَ اللهُ أَجْرَهُ- ‘আল্লাহ রহম করুন খাববাবের উপর, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আগ্রহের সাথে, হিজরত করেছিলেন আনুগত্যের সাথে, জীবন যাপন করেছিলেন মুজাহিদ হিসাবে, নির্যাতিত হয়েছেন দৈহিকভাবে বিভিন্ন সময়ে। অতএব আল্লাহ কখনোই তার পুরস্কার বিনষ্ট করবেন না’।[33]
.
.
ছাহাবীদের জীবনী থেকে ইবরত হাছিল করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক। কেননা তাঁরা দ্বীনের উপর যেমন ছিলেন অবিচল, তেমনি ছিলেন দুনিয়াবিমুখ। আর এ পথে তাঁদেরকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক ঘাত-পতিঘাত। হাসিমুখে বরণ করে নিতে হয়েছে অবর্ণনীয় যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়ন। তাঁদের কাঙ্ক্ষিত মানযিল ছিল জান্নাত। আর সে লক্ষ্যেই তারা সব সময় কাজ করতেন। আমরাও যদি একই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি এবং সে মোতাবেক সকল কর্ম সম্পাদন করতে পারি, তাহ’লে আখেরাতে সফলতার স্বর্ণ চূড়ায় আমরাও পৌঁছতে পারবো ইনশাআল্লাহ। এটিই হৌক আমাদের প্রত্যাশা। জান্নাতুল ফেরদৌস হোন আমাদের শেষ ঠিকানা-আমীন!
[1]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা (কায়রো: দারুল হাদীছ ১৪২৭ হিঃ/২০০৬ খৃ.), ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৭, জীবনী নং ১৫৮।[2]. ডঃ আব্দুর রহমান রাফাত পাশা, ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা (বৈরূত: দারুন নাফাইস, ১ম প্রকাশ ১৪১২ হিঃ/১৯৯২ খৃ.), পৃ: ৪১১-৪১২।
[3]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃঃ ৪১২।
[4]. ঐ, পৃঃ ৪১২-৪১৩।
[5]. ঐ, পৃঃ ৪১৩।
[6]. ঐ, পৃঃ ৪১৩।
[7]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৪/৭।
[8]. ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তাবি), ৫ খন্ড, পৃঃ ১৩৮; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (কায়রো: দারু এহইয়াইত তুরাছিল আরাবী, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খৃ.), ৭ম খন্ড, পৃঃ ৩৪৪।
[9]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, নভেম্বর ২০১৫ খ্রি.), পৃঃ ১৫০।
[10]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৩।
[11]. ঐ, পৃঃ ৪১৩-৪১৪।
[12]. খালেদ মুহাম্মাদ খালেদ, রিজালুন হাওলার রাসূল (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪২১ হিঃ), পৃঃ ১৬৮।
[13]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৪-৪১৫।
[14]. ঐ, পৃ: ৪১৫; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৪৫।
[15]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/৩৪৪।
[16]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৫-৪১৬।
[17]. আহমাদ হা/২১১০৫; তিরমিযী, হা/৩১৬২, সনদ ছহীহ।
[18]. রিজালুন হাওলার রাসূল, প: ১৭০।
[19]. ঐ, পৃঃ ১৬৯।
[20]. বুখারী হা/৩৬১২; মিশকাত হা/৫৮৫৮।
[21]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃঃ ১৭১।
[22]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃঃ ৪১২।
[23]. মুসলিম হা/৯৪০।
[24]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৬-৪১৭, হা/১৭২৪।
[25]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/৭।
[26]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ১১৭-১১৮।
[27]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃ: ১৪৭-১৪৮।
[28]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃঃ ৪১৮; রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ: ১৭২।
[29]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৪৮।
[30]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ: ১৭২।
[31]. আহমাদ, হা/২৭২৫৯ সনদ ছহীহ।
[32]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/৩৪৪।
[33]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৮; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৪৭।
[3]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃঃ ৪১২।
[4]. ঐ, পৃঃ ৪১২-৪১৩।
[5]. ঐ, পৃঃ ৪১৩।
[6]. ঐ, পৃঃ ৪১৩।
[7]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৪/৭।
[8]. ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তাবি), ৫ খন্ড, পৃঃ ১৩৮; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (কায়রো: দারু এহইয়াইত তুরাছিল আরাবী, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খৃ.), ৭ম খন্ড, পৃঃ ৩৪৪।
[9]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, নভেম্বর ২০১৫ খ্রি.), পৃঃ ১৫০।
[10]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৩।
[11]. ঐ, পৃঃ ৪১৩-৪১৪।
[12]. খালেদ মুহাম্মাদ খালেদ, রিজালুন হাওলার রাসূল (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪২১ হিঃ), পৃঃ ১৬৮।
[13]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৪-৪১৫।
[14]. ঐ, পৃ: ৪১৫; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৪৫।
[15]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/৩৪৪।
[16]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৫-৪১৬।
[17]. আহমাদ হা/২১১০৫; তিরমিযী, হা/৩১৬২, সনদ ছহীহ।
[18]. রিজালুন হাওলার রাসূল, প: ১৭০।
[19]. ঐ, পৃঃ ১৬৯।
[20]. বুখারী হা/৩৬১২; মিশকাত হা/৫৮৫৮।
[21]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃঃ ১৭১।
[22]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃঃ ৪১২।
[23]. মুসলিম হা/৯৪০।
[24]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৬-৪১৭, হা/১৭২৪।
[25]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/৭।
[26]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ১১৭-১১৮।
[27]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃ: ১৪৭-১৪৮।
[28]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃঃ ৪১৮; রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ: ১৭২।
[29]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৪৮।
[30]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃ: ১৭২।
[31]. আহমাদ, হা/২৭২৫৯ সনদ ছহীহ।
[32]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/৩৪৪।
[33]. ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ: ৪১৮; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৪৭।
▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃
Last edited: