Member
অভিযোগঃ হাদিস অস্বীকারকারী (Quranists), শিয়া, খ্রিষ্টান মিশনারী, নাস্তিক-মুক্তমনাসহ ইসলামবিরোধীদের অনেকেই হাদিসশাস্ত্রকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তারা অভিযোগ করে - আবু হুরায়রা (রা.) ৭ম হিজরী সালে ইসলাম গ্রহণ করেছেন; তাঁর পূর্বে বহু সাহাবী (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অথচ তাঁদের বহু পরে ইসলাম গ্রহণ করেও আবু হুরায়রা (রা.) কিভাবে তাঁদের সবার চেয়ে অনেক গুণে বেশি পরিমাণে হাদিস বর্ণনা করেন? তাদের দাবিমতে এত কম সময়ে ৫ হাজারের অধিক হাদিস মুখস্ত করা বা পরে সেগুলো বর্ণনা করা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব। আবু হুরায়রা (রা.) হচ্ছেন সর্বোচ্চ পরিমাণে হাদিস বর্ণনাকারী। তাঁকে এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে হাদিসশাস্ত্রকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা।
জবাবঃ অভিযোগকারীরা হাদিস শাস্ত্র ভালো করে অধ্যায়ন করলে এই বিষয়ে আপত্তি থাকার কথা ছিল না। হাদিসশাস্ত্রের মাঝেই তাদের এইসকল আপত্তির জবাব পাওয়া যায়।
১। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক অধিক হাদিস বর্ণনার কারণঃ
ক) অন্যান্য সাহাবীদের চেয়ে নবী (ﷺ) এর নিকট অধিক সময় অবস্থান এবং শিক্ষাগ্রহণঃ
আবু হুরায়রা (রা.) নিজেই এ ব্যাপারে উত্তর দিয়ে গেছেন যে কেন তিনি অন্যান্য সাহাবীদের (রা.) চেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আপনারা বলে থাকেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) থেকে আবূ হুরায়রা (রাঃ) বেশী বেশী হাদীস বর্ননা করে থাকে এবং আরো বলেন, মুহাজির ও আনসারদের কি হল যে, তারা তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ননা করেন না? (কিন্তু ব্যাপার হল এই যে) আমার মুহাজির ভাইগন বাজারে কেনা-বেচায় ব্যাস্ত থাকতেন আর আমি কোন প্রকারে আমার পেটের চাহিদা মিটিয়ে (খেয়ে না খেয়ে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(ﷺ) এর নিকটে পড়ে থাকতাম। তাঁরা যখন (কাজের ব্যাস্ততায়) অনুপস্থিত থাকতেন, আমি তখন উপস্থিত থাকতাম। তাঁরা যা ভুলে যেতেন, আমি তা সংরক্ষন করতাম। আর আমার আনসার ভাইয়েরা নিজেদের ক্ষেত-খামারের কাজে ব্যাপৃত থাকতেন।
আমি ছিলাম আসহাবে সুফফার মিসকীনদের এক মিসকীন। তাঁরা যা ভুলে যেতেন, আমি তা সংরক্ষন করতাম।… … ”
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, লোকজন (অভিযোগের সুরে) বলে থাকেন যে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) অনেক বেশী হাদিস বর্ণনা করে থাকেন। বস্তুতঃ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর খেদমতে আত্মতৃপ্তি নিয়ে পড়ে থাকতাম। ঐ সময়ে আমি সুস্বাদু রুটি ভক্ষণ করিনি, দামী বস্ত্র পরিধান করিনি। তখন কেউ আমার খেদমত করত না, এবং আমি ক্ষুধার জ্বালায় পাথরময় যমিনের সাথে পেট চেপে ধরতাম। কোন কোন সময় কুরআনে কারীমের আয়াত বিশেষ, আমার জানা থাকা সত্ত্বেও অন্যদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম যেন, তারা আমাকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে কিছু আহারের ব্যবস্থা করেন। গরীব মিসকীনদের জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যাক্তি ছিলেন জাফর ইবনু তালিব (রাঃ)। তিনি প্রায়ই আমাকে নিজ ঘরে নিয়ে যেতেন এবং যা থাকত তাই আমাকে আহার করিয়ে দিতেন। (কোন সময় এমন হত যে তাঁর ঘরে কিছুই থাকে নাই) ঘিয়ের শূন্য পাত্র এনে তিনি আমাকে সামনে তা ভেঙ্গে দিতেন আর তা চেটে খেতাম।”
“তিনি আরো বলেছেন, আমার এমন সময়ও গিয়েছে, ক্ষুধার কারণে মিম্বর ও হুজরা মুবারকের মাঝে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতাম। লোকেরা ভাবত, বোধহয় মৃগী রোগের কারণে আমি এভাবে পড়ে আছি। তাই তখনকার নিয়ম অনুসারে তারা আমার হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমার ঘাড়ে পা চেপে ধরত। কিন্তু হায়! আমার মৃগী রোগ ছিল না; ক্ষুধার কারণে এভাবে পড়ে থাকতাম!”
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ) এর সহচার্যে তিনটি বছর কাটিয়েছি। আমার জীবনে হাদীস মুখস্ত করার আগ্রহ এ তিন বছরের চেয়ে অধিক আর কখনো ছিল না।…”
আবু হুরায়রা (রা.) নিজেই আলোচনা করে গেছেন যে, অন্য সাহাবীদের (রা.) থেকে তিনি অধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন কেননা অন্যান্য সাহাবীরা যে সময় পেশাগত ব্যাস্ততার জন্য বাইরে থাকতেন, তিনি সে সময়েও খেয়ে না খেয়ে অনাহারে থেকে নবী(ﷺ) এর সাহচর্যে থেকে ক্রমাগত হাদিস শিখে যেতেন। হাদিসের জন্য তিনি জীবনে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন। তিনি ছিলেন আসহাবে সুফফার একজন যাঁরা মসজিদে নববীতে বাস করতেন এবং দুনিয়া ত্যাগ করে শুধুমাত্র দ্বীনের ইলম সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। যে তিন বছর তিনি নবী(ﷺ) এর সাহচর্যে ছিলেন, তিনি এভাবেই বিরামহীনভাবে হাদিস শিখে গেছেন। কাজেই অন্যান্যদের থেকে তাঁর হাদিস শিক্ষা এবং বর্ণনার পরিমাণ অধিক হবে এটিই স্বাভাবিক। অন্যান্য সাহাবীদের প্রাত্যাহিক পেশাগত কাজকর্মের জন্য আবু হুরায়রা (রা.) এর মতো বিপুল হাদিস আত্মস্থ করা ও বর্ণনা করা সম্ভব হতো না।
খ) নবী(ﷺ) এর মুজিযাঃ
পূর্বে আবু হুরায়রা (রা.) অনেক হাদিস ভুলে যেতেন। পরবর্তীতে আল্লাহর ইচ্ছায় নবী(ﷺ) এর মুজিযার দরুণ তিনি আর হাদিস ভুলে যেতেন না। এর ফলে অন্য সবার চেয়ে তিনি বেশি হাদিস বর্ণনা করতে পেরেছেন।
“আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললামঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার নিকট হতে অনেক হাদীস শুনি কিন্তু ভুলে যাই।’ তিনি বললেনঃ তোমার চাদর মেলে ধর। আমি তা মেলে ধরলাম। তিনি দু’হাত খাবল করে তাতে কিছু ঢেলে দেয়ার মত করে বললেনঃ এটা তোমার বুকের সাথে লাগাও। আমি তা বুকের সাথে লাগালাম। অতঃপর আমি আর কিছুই ভুলে যাইনি।”
গ) কুরআনের আয়াতের নির্দেশঃ
আল কুরআনের দুইটি আয়াতের কারণে আল্লাহর ভয়ে আবু হুরায়রা (রা.) অধিক হাদিস বর্ণনার করার প্রেরণা লাভ করতেন।
“আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ লোকে বলে, আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) অধিক হাদীস বর্ণনা করে। (জেনে রাখ,) কিতাবে দু’টি আয়াত যদি না থাকত, তবে আমি একটি হাদীসও পেশ করতাম না। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করলেনঃ ‘‘আমি সেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্য কিতাবে তা বিস্তারিত বর্ণনার পরও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ্ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয় কিন্তু যারা তওবা করে এবং আত্মসংশোধন করে এবং প্রকাশ করে দেয় যে, আমি তাদের (ক্ষমার) জন্য ফিরে আসি, আর আমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’ (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ ২/১৫৯-১৬০)। ... ”
ঘ) অন্যান্য সাহাবীদের থেকে হাদিস শিক্ষাঃ
আবু হুরায়রা (রা.) সব থেকে প্রসিদ্ধ সাহাবীদের সাহচর্য নিতেন এবং যেসব হাদিস নবী(ﷺ) থেকে শিখতে পারেননি সেগুলোও তাঁদের নিকট থেকে মুখস্ত করে নিতেন। পরবর্তীতে সেই হাদিসগুলোও বর্ণনা করতেন। এভাবে তাঁর বর্ণনাকৃত হাদিসের পরিমাণ আরো বিপুল হয়ে যায়।
২। অন্যান্য অনেক সাহাবী কেন অধিক হাদিস বর্ণনা করেননি?
অন্যান্য অনেক সাহাবী (রা.) থেকে কম পরিমাণে হাদিস বর্ণনার একটি কারণ উল্লেখ করে সানাউল্লাহ নজির আহমদ রচিত 'হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে,
“রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর মৃত্যুর পর সাহাবিগণ হাদিস বর্ণনার সংখ্যা কমিয়ে দেন, যেন তাতে ভুল ও মিথ্যা প্রবেশ না করে। এক সাহাবি হাদিসের খিদমত আঞ্জাম দিতে সক্ষম হলে অপর সাহাবি চুপ থাকেন। কম বর্ণনা হাদিস স্মরণ রাখার একটি পদ্ধতি। অনেক সাহাবি বার্ধক্য জনিত স্মরণ শক্তি হ্রাস পেয়েছে সন্দেহে হাদিস বর্ণনা বন্ধ রাখেন। মাস ও বছর পার হত, তবু কতক সাহাবি বলতেন না: ‘রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন’। ভুল থেকে সুরক্ষার জন্য তারা এরূপ করতেন।”
আবু হুরায়রা (রা.) সহ ৭ জন সাহাবী হাজারের উপর হাদিস বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য আরো সাহাবীগণ (রা.) হাদিস বর্ণনার খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন। কাজেই সব সাহাবী অধিক হাদিস বর্ণনা করার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
৩। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক মুখস্তকৃত বা বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা কি আসলেই অস্বাভাবিক?
আবু হুরায়রা (রা.) সর্বমোট ৫৩৭৪টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন ৭ম হিজরীতে, খায়বার বিজয়ের বছরে। তাঁর নিজ বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ৩ বছর [৩*৩৬৫ = ১০৯৫ দিন] নবী(ﷺ) এর সাহচর্যে থেকে হাদিস মুখস্ত করেছেন। তাহলে গড়ে প্রতিদিন তাঁর মুখস্তকৃত হাদিসের পরিমাণ ৫৩৭৪/১০৯৫= ৪.৯০ বা প্রায় ৫টি। এই সংখ্যাটি কি খুব বেশি অস্বাভাবিক? দিনে ৫টি মাত্র হাদিস মুখস্ত করা কি এমনই অস্বাভাবিক বা অসম্ভব কাজ?
আল কুরআনের সর্বমোট আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬। এই পরিমাণ আয়াতের আল কুরআনকে অনেক মানুষ ১ বছরে বা আরো কম সময়ে মুখস্ত করে ফেলে। সেখানে ৩ বছরে আবু হুরায়রা (রা.) কেন ৫৩৭৪টি হাদিস মুখস্ত করতে পারবেন না?
এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত ‘হাদিস’ এর সবগুলোই নবী(ﷺ) এর বাণী নয়। এর মাঝে অনেকগুলো বর্ণনায় তিনি নবী(ﷺ)কে কী করতে দেখেছেন [যেমনঃ নবী(ﷺ) কী খেয়েছেন, পরিধান করেছেন] তা বর্ণনা করেছেন। কারো বাণী হুবহু বর্ণনা করার চেয়ে এভাবে চোখে দেখা বিষয় বর্ণনা করা অনেক বেশি সহজ, যা করতে আলাদা কিছু মুখস্তও করতে হয় না। তাছাড়া এই হাদিসগুলোর মধ্যে বর্ণনার পুনরাবৃত্তিও রয়েছে। অর্থাৎ মূলত একই বর্ণনা একাধিকবার এসেছে।
কাজেই আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক মুখস্তকৃত বা বর্ণনাকৃত হাদিসের পরিমাণ কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়।
৪। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস অন্য সাহাবীদের থেকেও বর্ণিত হওয়াঃ
আবু হুরায়রা (রা.) যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন, এর অধিকাংশই অন্যান্য সাহাবীদের (রা.) থেকেও ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো মোটেও ভিত্তিহীন বা বানোয়াট কিছু নয়।
৫। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বিপুল পরিমাণে সাহাবী-তাবিঈর হাদিস বর্ণনাঃ
সাহাবী-তাবিঈদের মধ্য থেকে বিপুল পরিমাণে মানুষ আবু হুরায়রা (রা.)কে নির্ভরযোগ্য হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে গণ্য করে তাঁর থেকে হাদিস রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবী(র.) উল্লেখ করেছেন এদের মোট সংখ্যা ৮০০! ইমাম হাকিম(র.) তাঁর মুস্তাদরাকে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে হাদিস বর্ণনাকারী ২৮ জন সাহাবীর কথা উল্লেখ করেছেন। এত অধিক পরিমাণে সাহাবী-তাবিঈ যেখানে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে 'অস্বাভাবিক' কিছুই পাননি, বরং তাঁকে নির্ভরযোগ্য মনে করতেন ও তাঁর হাদিস বর্ণনা করেছেন, সেখানে ১৪০০ বছর পরে কোনো বিভ্রান্ত ব্যক্তি নিজ অজ্ঞতাকে পুঁজি করে আবু হুরায়রা (রা.) এর হাদিস বর্ণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলে তা কোনো বিজ্ঞ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
জবাবঃ অভিযোগকারীরা হাদিস শাস্ত্র ভালো করে অধ্যায়ন করলে এই বিষয়ে আপত্তি থাকার কথা ছিল না। হাদিসশাস্ত্রের মাঝেই তাদের এইসকল আপত্তির জবাব পাওয়া যায়।
১। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক অধিক হাদিস বর্ণনার কারণঃ
ক) অন্যান্য সাহাবীদের চেয়ে নবী (ﷺ) এর নিকট অধিক সময় অবস্থান এবং শিক্ষাগ্রহণঃ
আবু হুরায়রা (রা.) নিজেই এ ব্যাপারে উত্তর দিয়ে গেছেন যে কেন তিনি অন্যান্য সাহাবীদের (রা.) চেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আপনারা বলে থাকেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) থেকে আবূ হুরায়রা (রাঃ) বেশী বেশী হাদীস বর্ননা করে থাকে এবং আরো বলেন, মুহাজির ও আনসারদের কি হল যে, তারা তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ননা করেন না? (কিন্তু ব্যাপার হল এই যে) আমার মুহাজির ভাইগন বাজারে কেনা-বেচায় ব্যাস্ত থাকতেন আর আমি কোন প্রকারে আমার পেটের চাহিদা মিটিয়ে (খেয়ে না খেয়ে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(ﷺ) এর নিকটে পড়ে থাকতাম। তাঁরা যখন (কাজের ব্যাস্ততায়) অনুপস্থিত থাকতেন, আমি তখন উপস্থিত থাকতাম। তাঁরা যা ভুলে যেতেন, আমি তা সংরক্ষন করতাম। আর আমার আনসার ভাইয়েরা নিজেদের ক্ষেত-খামারের কাজে ব্যাপৃত থাকতেন।
আমি ছিলাম আসহাবে সুফফার মিসকীনদের এক মিসকীন। তাঁরা যা ভুলে যেতেন, আমি তা সংরক্ষন করতাম।… … ”
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, লোকজন (অভিযোগের সুরে) বলে থাকেন যে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) অনেক বেশী হাদিস বর্ণনা করে থাকেন। বস্তুতঃ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর খেদমতে আত্মতৃপ্তি নিয়ে পড়ে থাকতাম। ঐ সময়ে আমি সুস্বাদু রুটি ভক্ষণ করিনি, দামী বস্ত্র পরিধান করিনি। তখন কেউ আমার খেদমত করত না, এবং আমি ক্ষুধার জ্বালায় পাথরময় যমিনের সাথে পেট চেপে ধরতাম। কোন কোন সময় কুরআনে কারীমের আয়াত বিশেষ, আমার জানা থাকা সত্ত্বেও অন্যদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম যেন, তারা আমাকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে কিছু আহারের ব্যবস্থা করেন। গরীব মিসকীনদের জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যাক্তি ছিলেন জাফর ইবনু তালিব (রাঃ)। তিনি প্রায়ই আমাকে নিজ ঘরে নিয়ে যেতেন এবং যা থাকত তাই আমাকে আহার করিয়ে দিতেন। (কোন সময় এমন হত যে তাঁর ঘরে কিছুই থাকে নাই) ঘিয়ের শূন্য পাত্র এনে তিনি আমাকে সামনে তা ভেঙ্গে দিতেন আর তা চেটে খেতাম।”
“তিনি আরো বলেছেন, আমার এমন সময়ও গিয়েছে, ক্ষুধার কারণে মিম্বর ও হুজরা মুবারকের মাঝে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতাম। লোকেরা ভাবত, বোধহয় মৃগী রোগের কারণে আমি এভাবে পড়ে আছি। তাই তখনকার নিয়ম অনুসারে তারা আমার হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমার ঘাড়ে পা চেপে ধরত। কিন্তু হায়! আমার মৃগী রোগ ছিল না; ক্ষুধার কারণে এভাবে পড়ে থাকতাম!”
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ) এর সহচার্যে তিনটি বছর কাটিয়েছি। আমার জীবনে হাদীস মুখস্ত করার আগ্রহ এ তিন বছরের চেয়ে অধিক আর কখনো ছিল না।…”
আবু হুরায়রা (রা.) নিজেই আলোচনা করে গেছেন যে, অন্য সাহাবীদের (রা.) থেকে তিনি অধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন কেননা অন্যান্য সাহাবীরা যে সময় পেশাগত ব্যাস্ততার জন্য বাইরে থাকতেন, তিনি সে সময়েও খেয়ে না খেয়ে অনাহারে থেকে নবী(ﷺ) এর সাহচর্যে থেকে ক্রমাগত হাদিস শিখে যেতেন। হাদিসের জন্য তিনি জীবনে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন। তিনি ছিলেন আসহাবে সুফফার একজন যাঁরা মসজিদে নববীতে বাস করতেন এবং দুনিয়া ত্যাগ করে শুধুমাত্র দ্বীনের ইলম সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। যে তিন বছর তিনি নবী(ﷺ) এর সাহচর্যে ছিলেন, তিনি এভাবেই বিরামহীনভাবে হাদিস শিখে গেছেন। কাজেই অন্যান্যদের থেকে তাঁর হাদিস শিক্ষা এবং বর্ণনার পরিমাণ অধিক হবে এটিই স্বাভাবিক। অন্যান্য সাহাবীদের প্রাত্যাহিক পেশাগত কাজকর্মের জন্য আবু হুরায়রা (রা.) এর মতো বিপুল হাদিস আত্মস্থ করা ও বর্ণনা করা সম্ভব হতো না।
খ) নবী(ﷺ) এর মুজিযাঃ
পূর্বে আবু হুরায়রা (রা.) অনেক হাদিস ভুলে যেতেন। পরবর্তীতে আল্লাহর ইচ্ছায় নবী(ﷺ) এর মুজিযার দরুণ তিনি আর হাদিস ভুলে যেতেন না। এর ফলে অন্য সবার চেয়ে তিনি বেশি হাদিস বর্ণনা করতে পেরেছেন।
“আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললামঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার নিকট হতে অনেক হাদীস শুনি কিন্তু ভুলে যাই।’ তিনি বললেনঃ তোমার চাদর মেলে ধর। আমি তা মেলে ধরলাম। তিনি দু’হাত খাবল করে তাতে কিছু ঢেলে দেয়ার মত করে বললেনঃ এটা তোমার বুকের সাথে লাগাও। আমি তা বুকের সাথে লাগালাম। অতঃপর আমি আর কিছুই ভুলে যাইনি।”
গ) কুরআনের আয়াতের নির্দেশঃ
আল কুরআনের দুইটি আয়াতের কারণে আল্লাহর ভয়ে আবু হুরায়রা (রা.) অধিক হাদিস বর্ণনার করার প্রেরণা লাভ করতেন।
“আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ লোকে বলে, আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) অধিক হাদীস বর্ণনা করে। (জেনে রাখ,) কিতাবে দু’টি আয়াত যদি না থাকত, তবে আমি একটি হাদীসও পেশ করতাম না। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করলেনঃ ‘‘আমি সেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্য কিতাবে তা বিস্তারিত বর্ণনার পরও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ্ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয় কিন্তু যারা তওবা করে এবং আত্মসংশোধন করে এবং প্রকাশ করে দেয় যে, আমি তাদের (ক্ষমার) জন্য ফিরে আসি, আর আমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’ (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ ২/১৫৯-১৬০)। ... ”
ঘ) অন্যান্য সাহাবীদের থেকে হাদিস শিক্ষাঃ
আবু হুরায়রা (রা.) সব থেকে প্রসিদ্ধ সাহাবীদের সাহচর্য নিতেন এবং যেসব হাদিস নবী(ﷺ) থেকে শিখতে পারেননি সেগুলোও তাঁদের নিকট থেকে মুখস্ত করে নিতেন। পরবর্তীতে সেই হাদিসগুলোও বর্ণনা করতেন। এভাবে তাঁর বর্ণনাকৃত হাদিসের পরিমাণ আরো বিপুল হয়ে যায়।
২। অন্যান্য অনেক সাহাবী কেন অধিক হাদিস বর্ণনা করেননি?
অন্যান্য অনেক সাহাবী (রা.) থেকে কম পরিমাণে হাদিস বর্ণনার একটি কারণ উল্লেখ করে সানাউল্লাহ নজির আহমদ রচিত 'হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে,
“রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর মৃত্যুর পর সাহাবিগণ হাদিস বর্ণনার সংখ্যা কমিয়ে দেন, যেন তাতে ভুল ও মিথ্যা প্রবেশ না করে। এক সাহাবি হাদিসের খিদমত আঞ্জাম দিতে সক্ষম হলে অপর সাহাবি চুপ থাকেন। কম বর্ণনা হাদিস স্মরণ রাখার একটি পদ্ধতি। অনেক সাহাবি বার্ধক্য জনিত স্মরণ শক্তি হ্রাস পেয়েছে সন্দেহে হাদিস বর্ণনা বন্ধ রাখেন। মাস ও বছর পার হত, তবু কতক সাহাবি বলতেন না: ‘রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন’। ভুল থেকে সুরক্ষার জন্য তারা এরূপ করতেন।”
আবু হুরায়রা (রা.) সহ ৭ জন সাহাবী হাজারের উপর হাদিস বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য আরো সাহাবীগণ (রা.) হাদিস বর্ণনার খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন। কাজেই সব সাহাবী অধিক হাদিস বর্ণনা করার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
৩। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক মুখস্তকৃত বা বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা কি আসলেই অস্বাভাবিক?
আবু হুরায়রা (রা.) সর্বমোট ৫৩৭৪টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন ৭ম হিজরীতে, খায়বার বিজয়ের বছরে। তাঁর নিজ বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ৩ বছর [৩*৩৬৫ = ১০৯৫ দিন] নবী(ﷺ) এর সাহচর্যে থেকে হাদিস মুখস্ত করেছেন। তাহলে গড়ে প্রতিদিন তাঁর মুখস্তকৃত হাদিসের পরিমাণ ৫৩৭৪/১০৯৫= ৪.৯০ বা প্রায় ৫টি। এই সংখ্যাটি কি খুব বেশি অস্বাভাবিক? দিনে ৫টি মাত্র হাদিস মুখস্ত করা কি এমনই অস্বাভাবিক বা অসম্ভব কাজ?
আল কুরআনের সর্বমোট আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬। এই পরিমাণ আয়াতের আল কুরআনকে অনেক মানুষ ১ বছরে বা আরো কম সময়ে মুখস্ত করে ফেলে। সেখানে ৩ বছরে আবু হুরায়রা (রা.) কেন ৫৩৭৪টি হাদিস মুখস্ত করতে পারবেন না?
এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত ‘হাদিস’ এর সবগুলোই নবী(ﷺ) এর বাণী নয়। এর মাঝে অনেকগুলো বর্ণনায় তিনি নবী(ﷺ)কে কী করতে দেখেছেন [যেমনঃ নবী(ﷺ) কী খেয়েছেন, পরিধান করেছেন] তা বর্ণনা করেছেন। কারো বাণী হুবহু বর্ণনা করার চেয়ে এভাবে চোখে দেখা বিষয় বর্ণনা করা অনেক বেশি সহজ, যা করতে আলাদা কিছু মুখস্তও করতে হয় না। তাছাড়া এই হাদিসগুলোর মধ্যে বর্ণনার পুনরাবৃত্তিও রয়েছে। অর্থাৎ মূলত একই বর্ণনা একাধিকবার এসেছে।
কাজেই আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক মুখস্তকৃত বা বর্ণনাকৃত হাদিসের পরিমাণ কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়।
৪। আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস অন্য সাহাবীদের থেকেও বর্ণিত হওয়াঃ
আবু হুরায়রা (রা.) যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন, এর অধিকাংশই অন্যান্য সাহাবীদের (রা.) থেকেও ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো মোটেও ভিত্তিহীন বা বানোয়াট কিছু নয়।
৫। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বিপুল পরিমাণে সাহাবী-তাবিঈর হাদিস বর্ণনাঃ
সাহাবী-তাবিঈদের মধ্য থেকে বিপুল পরিমাণে মানুষ আবু হুরায়রা (রা.)কে নির্ভরযোগ্য হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে গণ্য করে তাঁর থেকে হাদিস রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবী(র.) উল্লেখ করেছেন এদের মোট সংখ্যা ৮০০! ইমাম হাকিম(র.) তাঁর মুস্তাদরাকে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে হাদিস বর্ণনাকারী ২৮ জন সাহাবীর কথা উল্লেখ করেছেন। এত অধিক পরিমাণে সাহাবী-তাবিঈ যেখানে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে 'অস্বাভাবিক' কিছুই পাননি, বরং তাঁকে নির্ভরযোগ্য মনে করতেন ও তাঁর হাদিস বর্ণনা করেছেন, সেখানে ১৪০০ বছর পরে কোনো বিভ্রান্ত ব্যক্তি নিজ অজ্ঞতাকে পুঁজি করে আবু হুরায়রা (রা.) এর হাদিস বর্ণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলে তা কোনো বিজ্ঞ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।