- Author
- মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রহিম
- Publisher
- খায়রুন প্রকাশনী
- Language
- বাংলা
- Number Pages
- 492
- ISBN
- 984-8455-16-1
মানব প্রকৃতিতে স্বভাবতই দুইটি পরস্পর-বিরোধী ভাবধারা বিদ্যমান। একটি অপরের আনুগত্য স্বীকার করা আর দ্বিতীয়টি অন্য লোককে নিজের অনুগত বানাইয়া লওয়া।' অন্য কথায়, আনুগত্য স্বীকার ও আধিপত্য বিস্তার এই দুইটি গুণই মানুষের স্বভাবগত এবং এই গুণ দুইটি মানুষের মধ্যে সাধারণত প্রায় সমান মাত্রায় বিদ্যমান। মানুষের প্রকৃতি এক দিকে যেমন তাহাকে অপর লোকের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য উদ্যোগী করিয়া তোলে, অপর দিকে ঠিক অনুরূপভাবেই তাহাকে অপর শক্তির নিকট আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করিতে বাধ্য করে।
যে লোক দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছে, তাহাকেই দেখা যাইবে অপর কোন উচ্চতর বৃহত্তর শক্তির সম্মুখে অবনমিত মস্তকে। প্রভাব বিস্তার ও আনুগত্য স্বীকার এই উভয়বিধ ভাবধারাই মানুষের প্রকৃতি নিহিত বলিয়া মানুষ সমাজ জীবন যাপন করিতে ও বহু মানুষের সহিত মিলিত হইয়া সামাজিক দায়িত্ব পালন করিতে সক্ষম। এই ভাবধারা না থাকিলে না সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত, না সমাজের উপর মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিত কোন রাষ্ট্রের প্রাসাদ।
মাবন-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের গভীরতর অনুশীলনের ফলেই এই তত্ত্বের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব। মানব-প্রকৃতি নিহিত এই দুই বিপরীতমূখী ভাবধারা যেমন অপ্রয়োজনীয় নয়, তেমনি নয় কোন দূষণীয়। সকল প্রকার স্বাভাবিক ভাবধারা, প্রবণতা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসের একটি স্বভাবসম্মত সীমা নির্দিষ্ট রহিয়াছে এবং সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকিলেই তাহা মানুষের জন্য কল্যাণকর হইতে পারে। আনুগত্য ও প্রভাব বিস্তারের এই ভাবধারা কালভিত্তিক ক্রমবিকাশের বিশাল ক্ষেত্রে বহুর সঙ্গে এক-এর সম্পর্ক-সম্বন্ধ ও যোগাযোগ সৃষ্টি করে। এই ভাবধারার প্রবাহ শুষ্ক ও স্তব্ধ হইয়া গেলে সভ্যতার অগ্রগতি ব্যাহত হইতে এবং জীবন-যন্ত্র বিকল ইহয়া পড়িতে বাধ্য।
দুনিয়ার কোন মতাদর্শ ও চিন্তাধারাই এই কারণে সম্পূর্ণ অভিনব ও অপূর্ব হইতে পারে না, বাহ্য দৃষ্টিতে তাহা যতই ‘আনকোরা’ ও ‘নূতন' বলিয়া মনে হউক না কেন। বরং একটু সন্ধানী দৃষ্টিতে বিচার করিলেই উহার প্রত্যেকটির মূল শিকড় অতীতের গভীর তলদেশে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রতিভা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক হইলে অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে প্রবহমান এক চিরন্তন জীবন ঝর্ণার ফল্গুধারা লক্ষ্য করা কিছুমাত্র কঠিন নহে। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই এমন নহে, যাহার বীজ পূর্ববর্তী কোন আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর ক্ষেত্র ইহতে সঞ্চারিত নয়। সভ্যতা সংস্কৃতির এই উত্তুংগ প্রাসাদ আদিম প্রাচীনত্বের ধ্বংসস্তূপের উপরই দণ্ডায়মান, তাহাতে সন্দেহ নাই ।এই কারণে দুনিয়ার কোন সংস্কৃতিবান জাতিই স্বীয় অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। অতীতকাল জাতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তিই দেয় না, ভবিষ্যতের চলার পথে দান করে বহুবিধ বাস্তব অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞান-পাথেয়। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি, পদস্খলন ও ঘাত-প্রতিঘাত তাহাকে অধিকতর সতর্ক করিয়া তোলে।' কিন্তু সেইজন্য জাতির মধ্যে নিরপেক্ষ ও উদার মননশীলতা এবং উপদেশ গ্রহণের অনুকূল মানবিক অবস্থা বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যক।
ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব এই দৃষ্টিতেই অনুধাবনীয়। ইহার সাহায্যে অতীতকে বর্তমানের পাশাপাশি স্থাপন করিয়া পারস্পরিক যাচাই ও তুলনা করা এবং উহা হইতে অর্জিত জ্ঞান-আলোকে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের তিমিরাচ্ছন্ন দিগন্তকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলা প্রত্যেক জাতির পক্ষেই সহজ। উপরন্তু একটি জাতির ইতিহাস কেবল সেই জাতির জন্যই নয়, দুনিয়ার সকল মানব জাতির জন্যই তাহা এক অমূল্য সম্পদ। এই কারণে কুরআন মজীদ সংক্ষিপ্তভাবে হইলেও বহু প্রাচীন জাতির ইতিহাস উল্লেখ করে এবং সেইসব জাতির উত্থান-পতন ও কল্যাণ-অকল্যাণের মর্মস্পর্শী কাহিনী হইতে এক নির্ভুল ইতিহাস-দর্শন গড়িয়া তোলে। ফলে কুরআন সকল যুগের মানুষের জন্য কল্যাণ পথের দিশারী।
কিন্তু ইহার কার্যকারিতা নির্ভর করে ঘটনার যথার্থতা, সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপর। এই গুণাবলী সঠিকভাবে অর্জিত হইলে আজিকার মানুষও তাহা ইহতে যেমন সঠিক পথের নির্দেশ লাভ করিতে পারে, তেমনি পারে ভবিষ্যতের দুর্গম পথে চলিবার বিপুল উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করিতে। মানুষের কল্যাণকামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন শ্রেণী রহিয়াছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক উন্নতমানের কল্যাণকামী লোক হইতেছেন আল্লাহর প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কিরাম। তাঁহারাই বিশ্বমানবতার উজ্জ্বলত্ব আদর্শ। তাঁহারা সকল প্রকার পাপ-ত্রুটি ও গুনাহ-নাফরমানীর কলুষতা হইতে চিরমুক্ত। তাঁহাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিকোণ, কথা ও কাজ—সবকিছুই সরাসরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন।
অতএব তাঁহারা সাধারণ মানুষের নিকট কেবল ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ারই যোগ্য পাত্র নহেন, আকীদা ও বিশ্বাস হইতে শুরু করিয়া জীবনের সকল পর্যায়ের সকল প্রকার কাজে ও কর্মে বাস্তবভাবে অনুসৃত হইবারও যোগ্য ।সকল নবীই একই নূরানী কাফেলার অগ্রপথিক, একই মূলনীতি ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থার উদ্গাতা এবং প্রচারক; একই দ্বীনের প্রবর্তক। মানব-প্রকৃতিও চিরন্তনভাবে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। এই কারণে মানুষের প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশ এবং উহার মৌলিক ভাবধারা ও চূড়ান্ত আদর্শও অভিন্ন, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। এই মৌলিক শাশ্বত আদর্শের নাম 'দ্বীন'। আর দ্বীন-ইসলাম এই কারণেই বিশ্বমানবের জন্যচূড়ান্তভাবে প্রবর্তিত এক অখণ্ড জীবন বিধান। হযরত আদম (আ) হইতে শেষ নবী মুহাম্মাদ (স) পর্যন্ত সকল নবীই দ্বীন ইসলামের বাহক প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকামী। নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মাদ (স) সর্বশেষ পর্যায়।
আল্লাহ তাঁহাকে যেমন সকলের শেষে প্রেরণ করিয়াছেন, তৃেনি তাহাকে ধারণাতীতভাবে সামগ্রিক পূর্ণত্বও দান করিয়াছেন। মানবীয় গুণের দিক দিয়া যেমন, নবুওয়্যাতের যোগ্যতায়ও তিনি ছিলেন তেমনই এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাহাকে উত্তরকালের সকল স্তরের ও সকল দিক ও ক্ষেত্রের জন্য উজ্জ্বলতৃ নিদর্শনরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ শরীয়াত চিরকালের, সমগ্র মানুষের এবং ইহকাল-পরকাল উভয় ক্ষেত্রের সার্বিক কল্যাণ লাভের একমাত্র নিয়ামক। সময় ও স্থানের পরিধি বা আবর্তন-বিবর্তন উহাকে স্পর্শ করিতে অক্ষম। এই কারণে নবুওয়্যাত তাহাতেই চূড়ান্তভাবে পরিণতি লাভ করিয়াছে। আর এই কারণেই তিনি ‘খাতামুন নাবিয়্যীন, 'রাহমাতুললিল আলামীন'।
পূর্বেই বলিয়াছি রাসূলে করীম (স) মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ আদর্শ। মানব জীবনের কোন একটি দিক বা একটি কাজ এমন নাই— হইতে পারে না— যে সম্পর্কে রাসূলে করীমের নিকট হইতে পথ-নির্দেশ লাভ করা যায় না। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন, পারস্পরিক লেন-দেন, সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন, আত্মীয়তা-শত্রুতা, শিক্ষাদীক্ষা, দেশ শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক – যুদ্ধ ও সন্ধি— সবকিছু সম্পর্কেই সুস্পষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রহিয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে। রাসূলে করীম (স) ইসলামী আদর্শ প্রচার ও উহার প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। এইজন্য তাহাকে পরিচালনা করিতে হইয়াছে এক সর্বাত্মক সাধনা, এক ক্ষমাহীন অভিযান। ইহা কোন সহজসাধ্য কাজ নহে। ইহা যদি কেবল চিন্তার সূক্ষ্ম জাল রচনা কিংবা বাণীর যাদুমন্ত্র সৃষ্টির দ্বারাই সম্ভব হইত, তাহা হইলে চিন্তা ও কল্পনার নির্লিপ্ত প্রশান্তির আসনে অধিরূঢ় দার্শনিকদের দ্বারাই মন ও জীবনে অনুরূপ বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হইত, সম্ভব হইত মৃত জাতির পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুরূহ কাজ। এই কাজ প্রকৃতপক্ষে একজন নবীর দ্বারাই সম্পাদিত হওয়া সম্ভব।
যে লোক দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছে, তাহাকেই দেখা যাইবে অপর কোন উচ্চতর বৃহত্তর শক্তির সম্মুখে অবনমিত মস্তকে। প্রভাব বিস্তার ও আনুগত্য স্বীকার এই উভয়বিধ ভাবধারাই মানুষের প্রকৃতি নিহিত বলিয়া মানুষ সমাজ জীবন যাপন করিতে ও বহু মানুষের সহিত মিলিত হইয়া সামাজিক দায়িত্ব পালন করিতে সক্ষম। এই ভাবধারা না থাকিলে না সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত, না সমাজের উপর মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিত কোন রাষ্ট্রের প্রাসাদ।
মাবন-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের গভীরতর অনুশীলনের ফলেই এই তত্ত্বের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব। মানব-প্রকৃতি নিহিত এই দুই বিপরীতমূখী ভাবধারা যেমন অপ্রয়োজনীয় নয়, তেমনি নয় কোন দূষণীয়। সকল প্রকার স্বাভাবিক ভাবধারা, প্রবণতা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসের একটি স্বভাবসম্মত সীমা নির্দিষ্ট রহিয়াছে এবং সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকিলেই তাহা মানুষের জন্য কল্যাণকর হইতে পারে। আনুগত্য ও প্রভাব বিস্তারের এই ভাবধারা কালভিত্তিক ক্রমবিকাশের বিশাল ক্ষেত্রে বহুর সঙ্গে এক-এর সম্পর্ক-সম্বন্ধ ও যোগাযোগ সৃষ্টি করে। এই ভাবধারার প্রবাহ শুষ্ক ও স্তব্ধ হইয়া গেলে সভ্যতার অগ্রগতি ব্যাহত হইতে এবং জীবন-যন্ত্র বিকল ইহয়া পড়িতে বাধ্য।
দুনিয়ার কোন মতাদর্শ ও চিন্তাধারাই এই কারণে সম্পূর্ণ অভিনব ও অপূর্ব হইতে পারে না, বাহ্য দৃষ্টিতে তাহা যতই ‘আনকোরা’ ও ‘নূতন' বলিয়া মনে হউক না কেন। বরং একটু সন্ধানী দৃষ্টিতে বিচার করিলেই উহার প্রত্যেকটির মূল শিকড় অতীতের গভীর তলদেশে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রতিভা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক হইলে অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে প্রবহমান এক চিরন্তন জীবন ঝর্ণার ফল্গুধারা লক্ষ্য করা কিছুমাত্র কঠিন নহে। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই এমন নহে, যাহার বীজ পূর্ববর্তী কোন আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর ক্ষেত্র ইহতে সঞ্চারিত নয়। সভ্যতা সংস্কৃতির এই উত্তুংগ প্রাসাদ আদিম প্রাচীনত্বের ধ্বংসস্তূপের উপরই দণ্ডায়মান, তাহাতে সন্দেহ নাই ।এই কারণে দুনিয়ার কোন সংস্কৃতিবান জাতিই স্বীয় অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। অতীতকাল জাতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তিই দেয় না, ভবিষ্যতের চলার পথে দান করে বহুবিধ বাস্তব অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞান-পাথেয়। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি, পদস্খলন ও ঘাত-প্রতিঘাত তাহাকে অধিকতর সতর্ক করিয়া তোলে।' কিন্তু সেইজন্য জাতির মধ্যে নিরপেক্ষ ও উদার মননশীলতা এবং উপদেশ গ্রহণের অনুকূল মানবিক অবস্থা বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যক।
ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব এই দৃষ্টিতেই অনুধাবনীয়। ইহার সাহায্যে অতীতকে বর্তমানের পাশাপাশি স্থাপন করিয়া পারস্পরিক যাচাই ও তুলনা করা এবং উহা হইতে অর্জিত জ্ঞান-আলোকে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের তিমিরাচ্ছন্ন দিগন্তকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলা প্রত্যেক জাতির পক্ষেই সহজ। উপরন্তু একটি জাতির ইতিহাস কেবল সেই জাতির জন্যই নয়, দুনিয়ার সকল মানব জাতির জন্যই তাহা এক অমূল্য সম্পদ। এই কারণে কুরআন মজীদ সংক্ষিপ্তভাবে হইলেও বহু প্রাচীন জাতির ইতিহাস উল্লেখ করে এবং সেইসব জাতির উত্থান-পতন ও কল্যাণ-অকল্যাণের মর্মস্পর্শী কাহিনী হইতে এক নির্ভুল ইতিহাস-দর্শন গড়িয়া তোলে। ফলে কুরআন সকল যুগের মানুষের জন্য কল্যাণ পথের দিশারী।
কিন্তু ইহার কার্যকারিতা নির্ভর করে ঘটনার যথার্থতা, সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপর। এই গুণাবলী সঠিকভাবে অর্জিত হইলে আজিকার মানুষও তাহা ইহতে যেমন সঠিক পথের নির্দেশ লাভ করিতে পারে, তেমনি পারে ভবিষ্যতের দুর্গম পথে চলিবার বিপুল উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করিতে। মানুষের কল্যাণকামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন শ্রেণী রহিয়াছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক উন্নতমানের কল্যাণকামী লোক হইতেছেন আল্লাহর প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কিরাম। তাঁহারাই বিশ্বমানবতার উজ্জ্বলত্ব আদর্শ। তাঁহারা সকল প্রকার পাপ-ত্রুটি ও গুনাহ-নাফরমানীর কলুষতা হইতে চিরমুক্ত। তাঁহাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিকোণ, কথা ও কাজ—সবকিছুই সরাসরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন।
অতএব তাঁহারা সাধারণ মানুষের নিকট কেবল ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ারই যোগ্য পাত্র নহেন, আকীদা ও বিশ্বাস হইতে শুরু করিয়া জীবনের সকল পর্যায়ের সকল প্রকার কাজে ও কর্মে বাস্তবভাবে অনুসৃত হইবারও যোগ্য ।সকল নবীই একই নূরানী কাফেলার অগ্রপথিক, একই মূলনীতি ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থার উদ্গাতা এবং প্রচারক; একই দ্বীনের প্রবর্তক। মানব-প্রকৃতিও চিরন্তনভাবে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। এই কারণে মানুষের প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশ এবং উহার মৌলিক ভাবধারা ও চূড়ান্ত আদর্শও অভিন্ন, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। এই মৌলিক শাশ্বত আদর্শের নাম 'দ্বীন'। আর দ্বীন-ইসলাম এই কারণেই বিশ্বমানবের জন্যচূড়ান্তভাবে প্রবর্তিত এক অখণ্ড জীবন বিধান। হযরত আদম (আ) হইতে শেষ নবী মুহাম্মাদ (স) পর্যন্ত সকল নবীই দ্বীন ইসলামের বাহক প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকামী। নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মাদ (স) সর্বশেষ পর্যায়।
আল্লাহ তাঁহাকে যেমন সকলের শেষে প্রেরণ করিয়াছেন, তৃেনি তাহাকে ধারণাতীতভাবে সামগ্রিক পূর্ণত্বও দান করিয়াছেন। মানবীয় গুণের দিক দিয়া যেমন, নবুওয়্যাতের যোগ্যতায়ও তিনি ছিলেন তেমনই এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাহাকে উত্তরকালের সকল স্তরের ও সকল দিক ও ক্ষেত্রের জন্য উজ্জ্বলতৃ নিদর্শনরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ শরীয়াত চিরকালের, সমগ্র মানুষের এবং ইহকাল-পরকাল উভয় ক্ষেত্রের সার্বিক কল্যাণ লাভের একমাত্র নিয়ামক। সময় ও স্থানের পরিধি বা আবর্তন-বিবর্তন উহাকে স্পর্শ করিতে অক্ষম। এই কারণে নবুওয়্যাত তাহাতেই চূড়ান্তভাবে পরিণতি লাভ করিয়াছে। আর এই কারণেই তিনি ‘খাতামুন নাবিয়্যীন, 'রাহমাতুললিল আলামীন'।
পূর্বেই বলিয়াছি রাসূলে করীম (স) মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ আদর্শ। মানব জীবনের কোন একটি দিক বা একটি কাজ এমন নাই— হইতে পারে না— যে সম্পর্কে রাসূলে করীমের নিকট হইতে পথ-নির্দেশ লাভ করা যায় না। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন, পারস্পরিক লেন-দেন, সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন, আত্মীয়তা-শত্রুতা, শিক্ষাদীক্ষা, দেশ শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক – যুদ্ধ ও সন্ধি— সবকিছু সম্পর্কেই সুস্পষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রহিয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে। রাসূলে করীম (স) ইসলামী আদর্শ প্রচার ও উহার প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। এইজন্য তাহাকে পরিচালনা করিতে হইয়াছে এক সর্বাত্মক সাধনা, এক ক্ষমাহীন অভিযান। ইহা কোন সহজসাধ্য কাজ নহে। ইহা যদি কেবল চিন্তার সূক্ষ্ম জাল রচনা কিংবা বাণীর যাদুমন্ত্র সৃষ্টির দ্বারাই সম্ভব হইত, তাহা হইলে চিন্তা ও কল্পনার নির্লিপ্ত প্রশান্তির আসনে অধিরূঢ় দার্শনিকদের দ্বারাই মন ও জীবনে অনুরূপ বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হইত, সম্ভব হইত মৃত জাতির পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুরূহ কাজ। এই কাজ প্রকৃতপক্ষে একজন নবীর দ্বারাই সম্পাদিত হওয়া সম্ভব।